অত্রি ভট্টাচার্য্য

প্রস্ফুটিত দুপুর

প্রবাসের অন্যতম অপেক্ষক স্বজনহীনতা। প্রবাসের দূরত্ব ও প্রকৃতিভেদে এই স্বজনের সংজ্ঞাও বদলে যায়, তার জড়তা ও প্রাত্যহিকতা একে অপরকে নেগেট করতে থাকে অহরহ। এ যেন তারকোভস্কির Stalker (১৯৭৯)-এর এক বিশ্বপ্রিয় স্টিল, পরিত্যক্ত দালানে মরুভূমির মত বালিয়াড়ি জমে রয়েছে, ইতস্তত দাঁড়িয়ে রয়েছে বিয়োগান্ত দাবার ছকের মত গোটাতিনেক গুটিমানুষ। দুজন খুব কাছাকাছি, চোখ থেকে দূরে, দরজার কাছে। একজন দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। তিনজনের শামুকসদৃশ রসায়ন পুরো ছবির গতিকেই মরুভূমির মত মন্থর করে রাখছে। তাদের স্বজনহীনতার মন্তাজ-ই তাদের স্বজন হয়ে উঠবার ব্লু-প্রিন্ট রচনা করছে বারবার, আবহ জুড়ে। তাই তারকোভস্কির ছবির বৈশিষ্ট্য তার স্লথতায় নয়, বরং এই মন্থর পরিবেশে চরিত্রদের পারস্পরিক বিভাজন ও জ্ঞাপনের দাবায় পাঠককেও চিন্তাহীন গুটি বানিয়ে তোলবার সুনির্মিত পরিকল্পনায়। আজকের বাংলা কবিতার তাল তাল শ্যাওলা যে গতিহীনতা এনেছে বহতা ভাষার শরীরে, সেখানে প্রবাসী, স্বজনহীন কিছু লেখাই প্রকৃত অ্যানার্কিস্ট, সন্ধিৎসুর ডক্টর ফাউস্টাস ; অথবা হামেহাল পরিত্যাজ্য। 

প্রাথমিক অনুকথাটি, বলাই বাহুল্য, কোনও মতামতের শিলমোহর দেওয়ার পক্ষে বড়ই ভেগ, ধোঁয়াটে। আর তা বাঞ্ছনীয়-ও নয় যেহেতু, একটি যন্ত্রভাষানিয়ন্ত্রিত আধা-গণতান্ত্রিক সমাজে, নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রিতের পারস্পরিক সম্পর্কের কার্টোগ্রাফ এখনোও একাধিক দর্শনানুযায়ী ডিসাইফার করা চলেছে ও চলছে। সেক্ষেত্রে কোনও ঋজু, আন্তর্জাতিক তথা ভাষাকেন্দ্রিক অবস্থান নেওয়া, বর্তমান নিবন্ধকারের মত অর্ধশিক্ষিত অর্বাচীনের পক্ষে অন্যায় শুধু নয়, অসম্ভব-ও বটে। এহ বাহ্য, আজ পয়লা বৈশাখের অপরাহ্নে যে গুটিকয় কবিতাগ্রন্থের পাঠোত্তরপর্বে ঢুকেছি তারা সবাই বান্ধবপ্রসূত, ফলে বায়াসনেসের কোনও অবধি এ যাত্রায় নাই। বরং আলোচ্য লেখকদের সঙ্গে পূর্বপরিচয়কেই পূঁজি করে কিছু রসায়ন খুঁজতে খুঁজতে এগোই। বই ও বইকারদের সম্বন্ধে বাকি বিস্তার না হয় ক্রমশঃ আসুক। 

রক্সি বিচ। প্রচ্ছদ: অংশুমান
রক্সি বিচ। প্রচ্ছদ: অংশুমান 

দুজনের লেখালেখির মধ্যে দশকগত দুরত্ব যন্ত্রভাষার নিরিখেই সিগনিফিক্যান্ট। প্রাক্‌-শূন্য ও শূন্য-পরবর্তীর এই কালস্তম্ভগুলি আমার পাঠাভিজ্ঞতায় নিছক শব্দব্যবহার বা সিগনেচারমাত্র নয়। এদের বিষয়নির্বাচনেও, সামগ্রিক তথা প্রতিটি কবিতায়, ব্যাক্তিগত ও সামাজিক পরিখার পাড় পেরিয়ে পরস্পর থেকে সচেতন অনৈকট্যে দাঁড়াবার প্রয়াস রয়েছে যা নৈকট্যেরই নামান্তর। যেমন দেবাঞ্জন দাস, চেনা আনফ্রেম (২০১২)-এর মত ডিসক্রিট ও সিম্বলিক কাব্যভাষার জগত থেকে সম্পূর্ণ না বেরিয়েও একাধিক অন্যান্য দরজা ( বা জানলা) খুলেছেন তার সাম্প্রতিক বই রক্সি বিচ ( ২০২৪)-এ। এ বইয়ের ‘করোনার দিনগুলিতে’ সিরিজের চার নং কবিতায় এমন স্তবক সচেতনভাবেই আসছে –

‘এক টুকরো সবুজের জন্য
আমরা মৃত্যুগুলো উৎসর্গ করলাম
                              আমেন !’

এমনকি করোনার মত প্রভাবশালী কালপর্ব এড়িয়ে গেলেও, ব্যাক্তিগতের বাইরে সম্পূর্ণ তৃতীয়ে গিয়ে বয়ান নির্মাণের সঙ্গে দেবাঞ্জনে পরিচিত আমরা এমন সব পংক্তি দেখতে অনভ্যস্ত – 

‘প্রকাশ্যেই ওরা ঘাসের চাদর কিনে আনলো
ঘুরে বেড়ালো গায়ে দিয়ে
এভাবে নিজেরাই নিজেদের জনপ্রিয়’

উল্লেখ্য যে, সিরিজের নাম নার্সিসাস, এবং এটি এর শেষ কবিতা। অর্থাৎ নার্সিসিজমের সংজ্ঞা ছোঁয়ার একটা দায়সাড়া কিন্তু স্বভাবপটু প্রচেষ্টাও দেবাঞ্জন করছেন যা প্রশংসনীয় কিনা, তা ভাষা অথবা ভাবে হেলান দেওয়া পাঠকের মন স্থির করুক। কিন্তু এ সব প্রাপ্তি হলেও বোনাস। কারণ চেনা আনফ্রেমের চেনা দেবাঞ্জনের কাব্যভাষা ব্যকরণকে মধ্যমা দেখানো এক চরম উন্নাসিকতার দাবীদার, যোগ্যতম। সে সাধারণ ন্যারেটিভকেও, চেনা ভিস্যুয়ালকেও ভাষার নাড়ি ছিঁড়ে এমন এক রূপ দেয়, পাঠকের চোখে সে ভিস্যুয়ালাইজেশন আদতে তার ডিকশনের প্রশংসাতেই আহা আহা করে ওঠে। কিছু বিরল এমনসহ পংক্তি ছুঁয়ে দেখি আমরাও –

‘অল্প হতে হতে আকাশ নিয়ে উড়ছে পাখি’

‘গ্রীষ্মের বিকেলে যে গাছ হাঁটে / তার জিরাফ জন্ম’

‘এসব ভেবে বিবাহিত আয়নায় নিজেকে রেখে/পরিযায়ী হল ছেলেটি/কথা বরফ ছুঁচ্ছে/ফিরে দেখল কিনা কে জানে?’

‘মদের চেয়েও হালকা স্বরে/চাঁদ হচ্ছে আকাশে’

অথবা আরোও বেশী জীবনানন্দমুখীন প্রকৃতিবর্ণনাতেও তার নিজস্বতা মিশে থাকে – 

‘না থেমে চলেছে মাঠ
এ’ভাবে সব
ভালো থাকা ঝরে শীতে
এগুলো সত্যি হবে ভেবে
ডিম থেকে পাখিরা ফেরে পাখনায়
রাত হয়
বিপাশার মুখে চাঁদ ওঠে’

প্রকৃতি ও ব্যাক্তিগতের সঙ্গে যে চালু, সশব্দ, হারামী কুটিল পারিপার্শ্বিককে সন্তর্পণে আন্তঃস্তর হিসেবে বিছিয়ে দেবার জন্য মতামতনির্বিশেষে কবির, শিল্পী হিসেবে দায়িত্ববোধ, যা এড়াতে গেলে মুখ লুকোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই, দেবাঞ্জন তাকেও এনেছেন মৃদু ও মন্ত্রমুগ্ধতায়, যদিও তার এই সচেতনতার স্বর সমান্তরাল স্রোতের থেকে অনেকটাই মৃত, অথবা ব্যাতিক্রমী। অথবা তার পর্যবেক্ষণেরই এক নিজস্ব কেকা রয়েছে যা প্রচলিত প্রতিবাদধর্মীতার সঙ্গে মেলানো যায় না। এই তেষট্টিটি কথিকার একমাত্র “করোনার দিনগুলোতে”-ই এর কিছু কিছু ছোঁয়া পাওয়া যায়। 

“একটু ভুলচুক, বেপরোয়া ট্রপোস্ফিয়ার
বাড়াতে পারত ফুল আর পাখির রসায়ন
হাসপাতালের বাইরে পাওয়া যেত
পুরনো বিকেল”

করোনার সময়ে হাসপাতাল শব্দটি মৃত্যুর নামান্তর ছিল, সুতরাং একে, প্রসঙ্গবিশেষে নস্টালজিয়ার সঙ্গে মেলানো যায় না। দেবাঞ্জনের ভাষা সিম্বলিক হলেও অক্ষরধর্মী নয়, প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিমূর্ত নয় তার ধীরতম প্রশ্বাসগুলির কন্দরে কন্দরে। বস্তুতঃ গোটা বই জুড়েই ম্যাট্রিক্স গঠন করেছে এই আধা স্বচ্ছ গুয়াশ যে তাতে বাসন্তী ফুল খুঁজে পাওয়াই এক একটি মূহুর্তমাত্রিক সাফল্য – পাঠকের। অচেতন বা আধা সচেতন কবিও হয়তো এই ডিকশনকেই, তার গুটিকয় গ্রন্থের জার্নিতে একান্ত আপন বলে মনে করেন ও করান। 

চালচিত্র। প্রচ্ছদ: কর্ণেলিয়া আহমেদ (বাংলাদেশ)

প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “চালচিত্র” (১৪২৯) তার বছরখানেক আগে প্রকাশিত “ক্যাজুয়াল স্বৈরতন্ত্রী” (১৪২৮)-র প্রিল্যুড, পাথর থেকে মূর্তি কুঁদে নেবার আগের অবস্থা। এবং এ লেখাগুলি সরাসরি মূর্তিই, রিলিফ নয় যে প্রচলিত দেওয়াল থেকে প্রথামত আলাদা হবে না। অথবা এরা উৎস সম্পর্কে এতটাই অবহিত যে মতামতানুসারে এদের স্বয়ম্ভূ বলা চলে, একটি আশিরনখ কাব্যগ্রন্থের নিরিখে। প্রত্যুষ ঘোষিত মার্কসবাদী। কিন্তু এ বইয়ের প্রতিটি লেখায় তার রাজনৈতিক অবস্থান এতটাই মুখ্য ও লাউড, যে লেখারা এ বিষয়ে স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্ত থেকে বিকল্প আবিষ্কারগুলিকে, শব্দ-বাক্য-প্রবচনদের সুচতুর ও অহরহ ব্যবহারকেও ফোকাসে আনতে পেরেছে। 

এ বইয়ের লেখারা অবশ্য আয়না ছাড়িয়ে বাইনারি এই দশকের ভারতীয় গ্লোবাল সমাজের জটিল ও বহুবিন্যস্ত ব্যূহের নানান আঙ্গিকের ঘা খুলে হাঁ করানোর চেষ্টা করেছে। এবং, সংজ্ঞানুযায়ী তারা বড় একুশ শতকীয় ভদ্রতারও ধার ধারে না। ভাষাকেন্দ্রিক রহস্য নয়, বরং রহস্যহীনতার পথে কতটুকু হাঁটতে পারে এই শব্দপটু বহুস্তরীয় উচ্চারণ – তারই এক যাত্রার অংশ পাঠককে ধার দেওয়া। পড়া যাক – 

“আরেকবার দৃষ্টি পাল্টে নিচ্ছে অন্যতর অন্যদিকের নেশার টান ঠেকায় ঠেক দিচ্ছে নৈমিত্তিক লহমা যখন কেউ পাশে বসলেই তার সাথে সাথেই অ অথবা সহিষ্ণুতা এসে বসে তার পাশের ছায়াটাই নিস্পৃহ আর কোথায়ই বা মাথা কুটবে হত্যে দেবে নাকি হত্যা করব না এই অসহায় পিঠ বাঁচানো অবস্থানটাও ঝলসে ওঠে”

প্রত্যুষের এই ধারালো লেখাগুলির মনোজাগতিক বিস্তার কেবল বর্তমান দশকের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, অথবা কোনও ধারাবাহিক রাজনীতিসচেতন কণ্ঠস্বরে তা সম্ভবপরও নয়। আর রাজনীতি যেভাবে প্রতিটি শিল্পমাধ্যমকে জড়ায় তার জটিল বর্ণবিন্যাসে বিভিন্ন পরিমাণ ও ক্রমের প্রভাবে আলোচ্য গ্রন্থের লেখাগুলিও শব্দে, বাক্যে, স্তবকে বা মানসিক পরিসরে তার সার্থক পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে। একটি আসন্ন মঞ্চসম্ভাব্য ভিস্যুয়ালাইজেশন তার এইরকম –

“অস্ত্র-ভাঁড়ারে ক্রমে হত্যার শর্টফর্ম জমা হল কালো হল সাদা স্কিন ক্রিমে এরম ডিমভাজা গন্ধের বিকেলবেলা বাইকের পেছন থেকে কে যেন উবরের দিকে চলে যায় মধ্যিখানে আগুন থাকে সে য না শোনেনি এমন তা নয় তবু সেই শুধু শুধু তাকিয়ে থাকার দিনগুলো চিঠিগুলো পোকায় কেটেছে স্বাভাবিক তাই তো ছিন্ন না হবার কথা বলা”

কয়েকটি চকিত এবং প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা যাক। প্রথমতঃ, ‘এক’, ‘দুই’, ‘তিন’ করে ক্রমচিহ্নিত মোট পঁচিশটি কবিতার প্রতিটিই এইরকম নানান আকৃতির একাধিক স্তবক দ্বারা নির্মিত। একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা (অথবা ভাবনাক্রম) গোটা গ্রন্থেরই অক্ষ এবং তা বড় একটি বন্ধনীতে প্রকাশযোগ্য নয়; কিন্তু এই বিভিন্ন স্তবকের ক্ষেত্রে মূল অক্ষটি স্থির, এবং তার প্রকাশের ক্ষেত্রে বিরল, গত শতকের স্বভাবনির্মিত বিদ্রুপ বা লেখকের নিজস্ব উইট সর্বদা সক্রিয়। উদাহরণস্বরূপ –

সবকটা দরজা একসাথে বন্ধ না করাই শ্রেয় খিড়কিটা অন্তত খোলা রেখো লক্ষ্মণ সেন যাতে পলাইতে পারে

অথবা

“মতামত প্রকাশের সর্বত্র মহামান্য স্টালিন বসে আছেন যাকে মনু’র সাথে কাওতালি করার জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল

অবশ্য সেই ভোটদান ইভিএম-এ হয়েছিল কি না সেই তথ্য জনৈক তথ্যগোপন কমিশন আটকে দিয়েছে ফলত গাধা ও গাজরের প্রাচীন প্রবাদটাও সমান ভাবে প্রযোজ্য থাকছে”

দ্বিতীয়তঃ, কিছু বিরল এবং ব্যাতিক্রমী ক্ষেত্রবিশেষে এক বা একাধিক ইমেজারি বা রূপক ব্যবহৃত, যা পড়তে ক্লিশে হলেও আপামর আবহের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে গিয়েছে। যেমন-

“ভেতরের জন্তুটা ধামাচাপা ছিল আজ সে আমার থালার পাশে হামাগুড়ি বসে আর তারিয়ে তারিয়ে শুধু জিভ পালটায়”

অথবা রূপক নয়, সরাসরি ও কনটেম্পোরারি পর্যবেক্ষণ ও প্রকাশ –

“বন্ধুকে ট্রল হতে দেখে আপাত সঠিক এক বিরোধিতা স্বাভাবিক তবু ওই ঈষৎ যুক্তি কিছু দাবিয়ে ডিলিট এই প্রক্রিয়াজাত যেন অসাধু শ্রমিক তুমি পাশ কাটাতে পারো না তুমি জড়িয়ে যাও সরিয়ে নাও আর পাশে পাও একলা যুক্তি”

প্রসঙ্গতঃ, উপরোক্ত স্তবকটি ছয় নং কবিতার, যার আরেকটি স্তবক উল্লেখ করি –

“একটা মানুষের সিদ্ধান্ত একলা মানুষও দলভুক্তি চায় আশ্বাস চায় সেই সিদ্ধান্ত অথবা দলজীবী হলে তো আর কথাই নেই সেইসব একটা সিদ্ধান্ত দিন শেষের একলা সিদ্ধান্ত তোমাকে দাঁড়িয়ে রেখে একদিকে চলে গেছে”

এই ক্ষুদে মনোস্তাত্ত্বিক উচ্চারণ অমোঘ কবিতার সঙ্গে মিশে একাধিক ছোট ছোট লেখা তৈরী করেছে গোটা বই জুড়ে। এই সূত্রে এটাও উল্লেখ্য, যে এই ছোট ছোট স্তবকের যে সংগঠন তারা পাঠকের নিজস্ব সিদ্ধান্তনির্মাণের উপাদান, ভ্যালু অ্যাডিশন করেছে যা সর্বোপরি লেখকের সোজাসাপটা প্রোপাগাণ্ডা, কোনও ভেগ, ধোঁয়াটে অবস্থানের আবডাল ছাড়াই। 

তৃতীয়তঃ, এই লেখক প্রস্তাবনায় বা স্বীকারে, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে বা হোঁচটে ঘা খাওয়া বোকামীর ডিলেমায় আদ্যন্ত আর্বান, শহুরে। এবং বর্তমান আলোচকের দশকদীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, গ্রাম ও শহরের মনোস্তত্ত্বে, নস্টালজিক থাকা বা নির্দিষ্ট কালখন্ডে বাস করবার অবসেশনের চরিত্রদু’টি আলাদা। বৈচিত্র্য-নির্বিশেষে গ্রামের প্রলেতারিয়েত মানসিকতা তার স্বভাবিক ফিউডাল উৎপাদনযন্ত্রের প্রভাবে সময়ের বাইরে ফিজিকালিই বেরোতে ক্ষেত্রবিশেষে অক্ষম। তাকে যুঝতে হয় শুধু অন্তরে নয়, ঐহিকেও। অথচ এই অপারগতার শহুরে সংস্করণ অনেকটাই স্বনির্মিত, বিলাসিতার নামান্তর।  এবং সেজন্যেই শহরের সচল, আধুনিকতম বাস্তব এই মেক বিলিভ নস্টালজিয়াকে যখন তখন ধাক্কা দিচ্ছে, উপড়ে ফেলছে। অর্থাৎ শহরের গ্র্যান্ড মনোস্তত্ত্বে পূর্বোক্ত স্ট্রাগলের মূলের ক্রাইসিস বা যুদ্ধগুলি অনেক বেশীসংখ্যক পরিবর্তকের অপেক্ষক। এইটুকু লেখবার প্রয়োজন এই জন্যে হল, যে প্রত্যুষের লেখার ছত্রে ছত্রে উল্লিখিত স্ট্রাগলের রক্তদাগ বর্তমান। আর তার পরিসরও যেহেতু অনেক দশক দীর্ঘ, একাধিক সামাজিক ঝঞ্ঝায় ব্যাক্তিগত অংশগ্রহনের চিহ্নে দীর্ণ, বিভিন্ন লেখায় উচ্চারিত উপলব্ধিগুলিও নেহাৎ তার দর্শনের ট্র্যাডিশনাল উত্তরাধিকার মাত্র নয়, বরং নিখাদ নির্ভেজাল অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। যেমন পড়া যাক –

“তুমি তাকে অপাঙ্গে আপাদমাথা পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কীই-বা করতে পারো একসাথে ভাত খাবো না জল ছোঁবো না ইত্যাদি ফতোয়া ও বিপক্ষ চালাচালি ক্লান্ত করে সমগ্র মানুষের অবমাননা এবং তার ভাষা তার ভাষাভাষী বৈরী বাতাস তুমি একা হয়ে পড়ো আরেকটা একা মানুষের ছায়া তুমি দেখতে পাচ্ছো আজকাল”

শেষতঃ, কালেভদ্রে এই যতিহীন মাঠে এক আধটা মেঘহীন চাঁদ পড়ে থাকছে, তাদের উদ্ভাসে লেখার শরীরে ফুটে উঠছে অনন্ত যৌবন। প্রকৃতির কত কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব এই অঘোষিত প্রতিযোগীতার বিপ্রতীপেই হেঁটেছে এ গ্রন্থের অধিকাংশ উল্লেখ, তবু তারই মধ্যে কোথাও কোথাও যেটুকু প্রাপ্তি তা আসলে না পাওয়ার বয়ান, বাসনার ছদ্মবেশে-

আকাশের কথা বলতে পারো না তবে জলের উচ্ছ্বাস পড়তে পারছ সে উঠছে ফুঁসছে ঝাপট মারছে এদিকে সোপান থেকে সরে গেছে চাঁদ নষ্ট ফুসফুস ততোধিক নষ্ট বাতাস এই নিয়ে তুমি যাকে পতন বলছ সেটাকেই মুক্তি ভাবছে কেউ যখন স্থানাঙ্কে কুয়াশা ভর করে যাপিত হাওয়া মোরগ কাটা পড়ে একে একে

আমরা জানি যে কোন টেক্সটের মূলতঃ দু’টি অপরিণতি সম্পর্কে; যে কোন লেখাকেই ছড়িয়ে দেওয়া যায় উত্তরবর্তী আরোও আরোও লেখায়, অথবা নিঃশব্দে আত্তীকৃত করা যায় তার কৃতি, বয়ন, খাঁজের ভাঁজের নগ্ন, জন্মমূহুর্তাবস্থা। এই দুই চির-অবভিয়াস উত্তরণ ছাড়াও একটি তৃতীয়ে বিশ্বাস রাখতেই পারি। ভাবতে পারি প্রতিটি পাঠ পূর্বাপর পাঠের আধখাওয়া কন্টিন্যুয়েশন, তাদের মধ্যে আবছা বা অদৃশ্য ঝিল্লির পাড় ধরে ধরে আমাদের অবচেতনেই চলতে থাকে যে মহাকাব্যনির্মাণ, অন্তর ও ঐহিকের এই মিলনকেই সেলিব্রেট করা যায় পাঠ ও অপাঠের মাঝামাঝি সময়ে, বাক্যের মধ্যেকার শূন্যের মহানির্বাণে স্নাত হতে হতে। বর্তমান আলোচনার শুরুতে যে প্রবাসের, আঙ্কিক, আক্ষরিক প্রবাসের উল্লেখ তার সঙ্গে আলোচ্য দু’টি গ্রন্থের সম্পর্ক টানা যায় মূলতঃ তাদের সশব্দ ও নিঃশব্দ রাজনৈতিক স্বরের তুলনামূলকে। আর সে তুলনার অনেকটাই বাকি রইল এই স্বল্পায়াস পাঠপ্রতিক্রিয়ায়। আমরা হয়তো আরোও ক্রাইসিসের সময়ে, আমাদের কালখন্ডেই পুনরাবিষ্কার করব এদের অন্তর্গত সম্পর্ক, আমাদের অভিজ্ঞতার আগুনে এদের অস্থি পুড়িয়ে পুড়িয়ে। 

 

আলোচিত গ্রন্থঃ-

রক্সি বিচ, দেবাঞ্জন দাস, জানুয়ারি ২০২৪, মুক্তাঞ্চল

চালচিত্র, প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশাখ ১৪২৯, অক্ষরযাত্রা প্রকাশন

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment