অরূপ গঙ্গোপাধ্যায়

অরূপ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ

যৌনতার দিকে

দুপাশে মাধবীলতার ঝুঁকে পড়া ভারের ভেতরে

         মানুষটা হেঁটে যাওয়া একাকী নির্জন রাস্তা, কাঁকরমেশানো,

                 নম্র বুকের ওপর দিয়ে 

হেঁটে যায় মেঘ, ময়ূরীর পেখম- উচ্ছ্বাস, 

আবেশে এলানো, ভিজে রাস্তা ক্রমশ ঘন হয় আসে—

দ্রুত চেপে ধরে, ফর্সা ও গোলাপী পায়ের রূপোলি নুপুর

 

উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে ময়ূরী শরীর—

          লজ্জায় কেটে ফেলে জিভ

চারপাশে পাতাদের ওড়াউড়ি 

                          মুছে দেয় চলমান পদরেখাগুলি

 

অন্য পৃথিবীর কথা

কবেকার বাঁধা গানগুলি ফাটছে হাওয়ায়;

পাঁজরে পাঁজরে  ভালবাসা

খসে পড়ছে, শূন্যে জ্বলছে পুরাণ-পাখির ডানা

সাপেরা মেতেছে উৎসবে,

           অতিশকুনেরা লুব্ধ চাটে গোটা পানশালা

বড়োরা কিছুটা জানে, শিশুরা জানে না 

ওডেসার সিঁড়িতে লাফিয়ে নামছে অবিকল মৃত্যু নাবিকেরা

ব্লাড ব্যাঙ্ক ফাঁকা, সব রক্ত মাটি অভিমুখী—

মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে গোটা আন্তর্জাতিক

 

করতল

করতলে তোমার ঘন ও আবেগময় মুখ ধরে রাখি

অন্যমনস্কতায় হাত থেকে ছিটকে পড়ে আলো—

পতনের ধাক্কায়, প্রাণপন আঁকড়ে ধরি রাত্রিকে।

আমাকে ফেরালো নির্জন, ধুলোমাখা গা 

ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার খুঁজি মি: রমনকে, 

গত তিন দিন ধরে আমার অতিথি, শেষ উদ্ধার, 

ছবি তুলেছেন 

                  আমার সংকটময় কবিজীবন নিয়ে—

আমি কি বলবো! 

ধানক্ষেত জুড়ে মল উঠছে,

              টিভি সভ্যতা ঢুকে পড়েছে গ্রামে, 

আবছা খোয়াই এখন পিচ রাস্তা,

ছিন্ন একান্ত গ্রামটি 

                        দূরে সরে গেছে।

হাজার বছরের তাঁতবোনার শব্দ কানের পর্দা 

ভেদ করে চলে যায়, 

                     ক্রুরতম ঈগলের ডানায়।

ঘাই মারা রক্তের ভেতরে একটা তালা মনে করায়–

                   বন্ধন ছিন্ন হে,

ফিরিয়ে দেওয়া মাতাল অপমানে 

মানুষের রুচিবোধ

                    ক্রমশ গড়িয়ে পড়ছে আয়নায়,

রাত্রি চেটে নেয় নক্ষত্রদল, মেঘ-নৌকা, শস্যের ঘ্রাণ।

হাওয়া থেমে গেলে,

          অফুরান বৃষ্টির প্রার্থনায় স্তব্ধ হয়ে খুঁজি—

                       ধীর মুখচোরা এক শান্ত ভোরবেলা, 

যেখান থেকে ভিতরের শিশুটি 

আলো ফোটার আলোয়

                     যাত্রা শুরু করেছিল 

                                          করুণ দূর্বার সাথে…

 

মরিয়ম ৩

আজ সাতটাকায় গোলাপের কুঁড়ি কিনে নিচ্ছে কেউ

সমস্ত চার্চের ঘন্টা পর পর মন্তাজ হয়ে বেজে চলেছে

কে বিনীতা যার জন্য অখিল খ্রীশ্চান হয়ে চলে গেল?

বুঝে গেলাম, এই ভ্যালেন্টাইনে মরিয়ম আসছে না!

 

সে নাকি সামনের গ্রীষ্মে আসবে, এই লু’নগরীতে—

যখন পাখিরা থাকবে না, এক খুনে নিদ্রাহীনতা 

সাইরেন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ঊষাগ্রামে, মুর্গাশোলে

আশ্চর্য পানীয় নিয়ে ঘরে ফিরবে শ্রমিকের দল

মরিয়ম ভ্যালেন্টাইন জানাবে তিনমাস তেরোদিন পর;

          তারপর কাঁধে ডানা নিয়ে দ্রুত উড়ে যাবে কুয়োতলা

শীতলতা কতো গভীর, কুয়োতলার দড়ি তা জানে—

কার সাথে স্নানে যাবে মরিয়ম?

                                        জিজ্ঞেস করিনি।

 

রাজেশ ঝা

মিস্টার রাজেশ ঝা’র টেলিফোন এলো রাত ১১ টায়

কাটাকুটিময় লেখার পাতা বন্ধ করে দ্রুত 

রাজদূতে ঊঠে পড়ি,

                     ১১ মাইল দূরে গিয়ে, 

                                             জল ভাঙ্গি,

২টো মৃতদেহ উদ্ধার হলো, সাইটে হাজার লোকের ভীড়। 

কেঁদে চলেছেন দুই সদ্য বিধবা, টুকে নিই মরা কান্না

এফ আই আর-এ পুলিশের জেরা রক্ত গরম করে,

ভীড় ফুঁসে উঠে টিয়ার গ্যাসে ফের নিভে যায়,

প্রানভয়ে ভীত জেব্রার দল ছুটে চলেছে মধ্যরাতে—

শাঁখা ভেঙে মেয়ে দুটি অনড়, দাঁত যেন শানিত বাটালি

পুলিশের পাতা হাতে তবু কিছু দিতে হয়, সামনে ছটপরব।

পুরোন বয়ান কেটে তৈরি করা হলো নতুন বয়ান;

শেষ রাতে ঘরে ফিরি, শুরু করি নতুন লেখনী,

চোখের সামনে পাতা পুলিশের ফাঁদ 

                                             আর ২ ক্রন্দসী রমণী।

 

আলোর মুকুট

চেম্বার বোঝাই দেশলাই কাঠির মাথায় বারুদের মহাসমারোহে

একদলা অন্ধকারে যারা আমায় একদিন পতঙ্গজ্ঞানে নানাভাবে ছুঁড়ে ফেলেছে তাদের খুঁজে চলেছি শূন্যের ভেতর;

ভয় যতো বাড়ে অন্ধকারের সাহস তত বড় হয় আর সামান্য আলোয় দেখি বারুদের বিরুদ্ধে চারদিকে ঘনদারিদ্রের ডিফেন্স, অনন্ত ঘুঁটের দেয়াল, দুর্বাদলশ্যামে জুড়িয়ে থাকা নদী,

পুণ্যব্রতারা চলেছে নদী পেরিয়ে তাদের ভাগ্য ফেরাতে, 

              পথ দেখিয়ে চলেছেন ক্ষণজন্মা শূকরদেবতা।

লক্ষ লক্ষ বছরের ওই মাতৃগর্ভের অন্ধকার সামনে থেকে

কত কত ঘুমন্ত নক্ষত্র সন্তানের পাশে আমাকে ঢেকে ফেলল

লেলিহান জিহ্বা, কড়ি ও কোমল জঙঘা, অন্তহীন অবরোহী  কুন্তল, 

দীর্ঘ স্তনভান্ড আর আমাজন অরণ্যের মতো ম্লান যোনীদেশ

যেখানে কোটি আলোকবর্ষের আঁধারভুক সূর্যদেবতা বহু শ্রমে ঢুকতে পারেনি, 

এসেছে আলোর মুকুটপরা নীতিহীন পণ্যলোভী চোরা কাঠুরেরা                                  

তারপর চলে গেছে, 

                        মৃত্যুর চালান নিয়ে দীর্ঘ বনের ভেতর

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment