গৌতম বসু

কবি গৌতম বসুর সঙ্গে আলাপবিস্তার

কথা শুরু হয় যুগান্তর চক্রবর্তী এবং পুর্ণেন্দু পত্রীকে নিয়ে… তারপর একটু চুপ থেকে… 

গৌতম বসুঃ খুব কঠিন প্রশ্ন করবে? 

অনিমিখ পাত্রঃ (সমবেত হাসি) এ বাবা… কঠিন প্রশ্ন করতে পারবো কি? 

গৌতমঃ এ মা… সে কী… তোমরা কত কিছু লেখো, পড়ো… 

সঙ্ঘমিত্রা হালদারঃ চেষ্টা করি…

গৌতমঃ না… ব্যাপার হচ্ছে কী… প্রত্যেক মানুষের তো একটা টাইম স্প্যানের ব্যাপার আছে! তোমার সঙ্গে আমার তফাত হচ্ছে আমার বয়সটা বেশি, আমি অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। আর তো কিছু নয়! এই অ্যাডভান্টেজ দিয়ে কিন্তু বেশিদিন চলবে না! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আপনার ক্ষেত্রে যে শুধু বয়সের অ্যাডভান্টেজ তা আপনি কী করে ভাবলেন… !

অনিমিখঃ একটা জিনিস আমার মনে হয়, সাহিত্য পড়েছি তো, বাংলা সাহিত্য ইংরেজি সাহিত্য… একইরকম ব্যাপার… সাহিত্যের ইতিহাস আমরা যখনই যে ভাষাতেই পড়ি তখন তো এক একটা যুগ ধরা হয় ন্যূনতম চল্লিশ বছর… ষাট, একশ এমনকি দেড়শো বছর করে ধরা হয়। তখন সবাই আমরা কলিগ হয়ে যাই। 

গৌতমঃ এটা আমিও খুব অনুভব করেছি। যেমন আমি একদিন দেখছিলাম, নিধুবাবুর একজন কনটেম্পোরারি ছিলেন, মেমরিটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে… শ্রীধর কথক… তাঁদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান পঁচাত্তর বছর! একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে গেছি, উৎপলদা এসেছেন… অনেকদিন বাদে দেখা হচ্ছে, আমি তো কফিহাউস যাইনা… উৎপলদা হচ্ছেন আমার গুরু একদম! নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, আগে আমার কী মেমরি ছিল জানো! স-অ-ব কিছু মনে থাকতো! এখন কিচ্ছু মনে রাখতে পারিনা। এটাই যদি না থাকে, আমার তো বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই! আমি ওঁর আবেগটা বুঝতে পারলাম। একটা ফ্যাকাল্টি চলে গেছে, সেটার ওপরেই তিনি এতদিন নির্ভর করেছিলেন, সেটা চলে গেছে… ভাবলাম একজন একটা দৌড়বীরের যদি পা-দুটো চলে যায়, তার যে অবস্থা হয়, উৎপলদার আজ সেই অবস্থা! তারপরে বেঁচে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু …

সঙ্ঘমিত্রাঃ এটা কবে নাগাদ হয়েছিল?

গৌতমঃ ওঁর মৃত্যু হয়েছিল ২০১৫ সালে, যুগান্তর চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়েছিল ২০১১তে। যুগান্তর চক্রবর্তী আর তুষারদা (চৌধুরী) এক দিনে মারা গিয়েছিলেন। এটা আমার মনে আছে। আমাকে একজন খবর দিলেন, তুষারদা আর নেই। শ্মশানে যাবো বলে জামাকাপড় পরছি, ঠিক তখন আরেকজন ফোন করে বললো, যুগান্তর চক্রবর্তী মারা গেছেন। আমি নিমতলা চলে গেলাম। আমি দেখলাম যে, তুষারদা… খুবই দুঃখজনক… কিন্তু তুষারদার ওখানে লোকটোক যাবে, যুগান্তর চক্রবর্তীর ওখানে কেউ যাবেনা। 

উৎপলদার মৃত্যুর বেশ কয়েকবছর আগেকার কথা এটা। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ তারপরেও তো কিছুটা স্বাভাবিক জীবন তো ছিলই, উনি কফিহাইসেও তো আসতেন!

গৌতমঃ হুঁ। কফিহাউস আসতেন, কিন্তু সেটা উনি ভালো করতেন না! তখন ওঁর ইয়েটা কেউ বুঝতে পারতো না… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ ওঁর যে ক্ষমতাটা…

গৌতমঃ হ্যাঁ। উনি বলতেন, জানো তো আমি একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে যাই কাটু’র জন্যে। আমি বুঝতে পারছি উনি চাইছেন আবার সেই আগের মতো… উনি যখন ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন… কিন্তু সেটা তো আর হয়না! সময় পালটে যায়… লোক পালটে যায়… রুচি পালটে যায়। শেষের দিকে আসতেন বটে…

অনিমিখঃ আমার এখন খুব আপশোশ হয়। আমরা তো তখন কলেজে পড়ি, রোজই দেখতাম উৎপলবাবুকে কফিহাউসে…

সঙ্ঘমিত্রাঃ দু-তিনটে টেবিল পরেই…

অনিমিখঃ  কিন্তু কখনো কথা বলার সাহস হয়নি। পরে যখন বুঝতে পারলাম কী মাপের লোকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হারিয়েছি… অবশ্য কীই বা বলতাম! তখন তো আর মননটাও সেভাবে গঠিত হয়নি…

গৌতমঃ ওটার কিন্তু একটা ইউটিলিটি আছে! যেহেতু তোমার মাথাটা পরিষ্কার… মানে, লোডেড  নয়, তার নিজস্ব কিছু সুবিধে আছে। ওই জেন গল্প আছে না… গুরু চায়ের কাপে চা ঢালছেন… ঢেলেই যাচ্ছেন… পড়ে যাচ্ছে। তখন যুবক বলছে, একী, একী, কী করছেন? তখন গুরু বলছেন, তোমার মাথা তো ভর্তি হয়ে আছে, তুমি আমার কাছে কী শিখবে? 

আর উৎপলদার একটা ইয়ার্কির ব্যাপারও ছিল, একটা বৈঠকী মেজাজ ছিল। সেই ইয়ার্কিটাই লোকে বেশি পছন্দ করতো। কিন্তু ওটা ওঁর ওপরের একটা বর্ম’র মতন ছিল। ভেতরের মানুষটা একদম অন্যরকম। ওঁর কাছে যে কত কিছু শিখেছি! আমি হয়তো গল্প করছি বসে ওঁর সঙ্গে… তারপর যেই লোক আসতে শুরু করলো, উনি গুটিয়ে যেতেন। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা!

গৌতমঃ গুটিয়ে গিয়ে তখন… ইয়ার্কি করতে লাগলেন। কিন্তু ওটা ওঁর আসল চেহারা নয়। উনি নানা রকম চিন্তা করতেন।

সঙ্ঘমিত্রাঃ সে তো ওঁর লেখাতে বোঝাও যায়!

গৌতমঃ হ্যাঁ। নানারকম! তার মধ্যে একটা আমার খুব ভালো লাগে… মিথ সম্পর্কে বলেছিলেন আমাকে। ধরো, একটা জায়গায় একটা আণবিক বোমা পড়েছে বা খুব খারাপ কোনো ঘটনা ঘটেছে এবং তুমি চাও যে লোকে সেখানে যেন না যায়। রেডিয়েশন ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন তুমি লোককে কী করে নিষেধ করবে? কোনো লোক যাতে না যায়? আমি বললাম, কেন? সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেবো! ‘তোমার বোর্ড কত বছর থাকবে?’ আমি বললাম, সেটা তো ঠিক… উনি বোঝালেন ‘এইজন্য মিথ-এর দরকার। তুমি ওখানে একটা গল্প বানাবে। গল্পেতে বলা থাকবে এই জায়গাটা কত খারাপ! এবং সেই গল্পটা ছড়িয়ে যাবে।’ 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা… ! (বিস্ময়) 

গৌতমঃ ওইজন্যেই লোকে আর আসবে না। এইরকম ওরিজিনাল কথা না আমি আর কোনোদিন শুনিনি!  

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, এই কথাটা কোথাও থেকে আহৃত নয়। 

গৌতমঃ এবং আমি পরে মিলিয়ে দেখলাম… আমি জানিনা তোমাদের ছোটোবেলা কেমন ছিল… আমাদের ছোটোবেলায় দুটো জিনিস বলতো। একটা হচ্ছে, বালিশে বসিস না, পেছনে ফোঁড়া হবে। আমি বিরাট ভয় পেতাম। বালিশে বসতেও খুব আরাম, আবার একটা বিরাট আতঙ্ক হতো – এইই ফোঁড়া হবে! পরে বুঝলাম, ওটা যাতে বালিশে কেউ না বসে ওইজন্য বলে! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ একদমই তাই! 

গৌতমঃ বা লেবুর বিচি খেয়ে ফেললে পেটে গাছ হবে। এরকম অজস্র!

অনিমিখঃ  চিন্তা কীরকম মানুষকে প্রভাবিত করে দেখুন, অনেকসময় গদ্যে সেটা করা যায়, কবিতা হয়তো সব মানুষ সমানভাবে আস্বাদন করতে পারেন না… ওই যে উৎপলকুমার বসু একজায়গায় বলছিলেন না যে, একজন মানুষ এমন একটা ভাষার শেষ প্রতিনিধি যে ভাষা অনেক আগে মরে গেছে। তো… তিনি ছোটোবেলায় একটা গান শুনেছিলেন ইন্ডিজেনাস ট্রাইবদের কাছে… 

গৌতমঃ এটা তুমি কোথায় পড়েছ?

সঙ্ঘমিত্রাঃ খুব সম্ভবত ওঁর গদ্যে আছে এটা…

অনিমিখঃ খুব সম্ভবত… 

গৌতমঃ এই গল্পটা উনি আমায় বলেছিলেন। একজন বিজ্ঞানের অধ্যাপক…

অনিমিখঃ  মারা যাওয়ার আগে হঠাৎ সেই হারিয়ে যাওয়া গানটা গাইতে শুরু করেন… 

গৌতমঃ হুঁ, মনে পড়ে যায়… 

অনিমিখঃ  আমার পরিচিত কেউ কেউ, তাঁরা হয়তো নিয়মিত কবিতা পড়েন না, কিন্তু এটা পড়ে খুবই বিচলিত হয়েছিলেন – সত্যিই এরকম হতে পারে? ব্যাপারটা এত স্ট্রাইকিং!

গৌতমঃ গল্পটা কিন্তু সাংঘাতিক! ইনি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি যখন মারা যাচ্ছেন তখন সুর করে তিনি কী-একটা বলতে শুরু করলেন। বাড়ির লোকেরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পারছে না। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ দীর্ঘদিন কোমা’য় ছিলেন। মৃত্যুর কিছু আগে হঠাৎই জ্ঞান ফেরে।

গৌতমঃ হ্যাঁ। তখন একজন বললো যে, এটা তো একটা ইউনিভার্সিটি! আমরা বরং ভাষাবিজ্ঞানের লোককে ডেকে আনি। স্যার কিছু একটা তো বলছেন! তখন ওদের ডেকে আনা হলো, ওরা বললো, এটা হচ্ছে মেক্সিকোর একটা লুপ্ত ভাষা …ছোটোবেলায় দাই-মা শেখাতো… সেইটা। 

অনিমিখঃ  গৌতমদা, আপনার তো এইরকমই নানান দিকে ইন্টারেস্ট আছে। গদ্যসংগ্রহটা পড়লে বোঝা যায় যে, কবিদের গদ্যসংগ্রহ যেরকম হয় আপনার গদ্যসংগ্রহ সেরকম নয়। বিষয় ধরে ধরে, তার অজস্র রেফারেন্স…

সঙ্ঘমিত্রাঃ এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে যে, যখনই আপনার যে বিষয়ে কৌতূহল হয়েছে খুঁজতে খুঁজতে একদম তার উৎসে চলে যাওয়ার যে চেষ্টা… যেমন ধরুন, ভাষার যে ক্ষয় বা মৃত্যু নিয়ে আমরা ইদানিং চিন্তা করি, তা বোঝাতে গিয়ে আপনি একেবারে নিয়ান্ডারথালদের ইতিহাসে চলে গেছেন! এত গভীরে চলে যাওয়া, তার ইতিহাস তার বিজ্ঞান খুঁটিয়ে দেখা… এটা তো খুব কম পাই…

গৌতমঃ নেই যে তা নয়, তবে একটা জিনিস আমার মনে হয় যে, উনবিংশ শতাব্দির বাঙালির মধ্যে এই জেনারেল ইন্টারেস্ট যেটা… এটা কিন্তু বিশেষজ্ঞর ইন্টারেস্ট নয়… বিশেষজ্ঞরা কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে সারাজীবন পড়ে থাকেন। কিন্তু জেনারেল ইন্টারেস্ট যদি ছড়িয়ে দিতে পারো, তাহলে সারাজীবন ধরে তোমার আইডিয়া আসতে থাকবে। কারণ একটা সময়ে গিয়ে … ক্রিয়েটিভিটির সুবিধের দিক যেমন আছে, বিরাট অসুবিধের দিক হচ্ছে – তার একটা সরবরাহ দরকার। আমি বিশ্বাস করি, এটা যৌবনের একটা ব্যাপার। যুবক বয়সের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে ক্রিয়েটিভিটির। সেটা যখন ক্ষয় হতে থাকে…    

সঙ্ঘমিত্রাঃ সেটা কি মানসিক যৌবনের কথা বলছেন? 

গৌতমঃ মনের এবং শারীরিকভাবেও। শারীরিকভাবে ইয়ুথ এর সঙ্গে ক্রিয়েটিভিটির সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয়। কারণ যাঁরা কিছু করেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই উইদিন থার্টি ফাইভ তাঁদের পরিচয় দিয়ে গেছেন।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ বাংলা ভাষায় মণীন্দ্র গুপ্ত কিন্তু ব্যতিক্রম!

গৌতমঃ মণীন্দ্রদা একদমই ব্যতিক্রম নন। মণীন্দ্র গুপ্ত’র আউটপুটটা আমরা পরে দেখছি।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ মণীন্দ্র গুপ্ত’র উপন্যাসগুলোর কথা যদি আমি ধরি… শেষবয়সে উনি যা লিখলেন… নেংটি বা তার আগের দুটো উপন্যাস, নুড়ি বাঁদর বা আলতামসী, তখন তো উনি নব্বই…

গৌতমঃ মণীন্দ্র গুপ্ত’রটা আমার মনে হয় বিশ্বরেকর্ড। মানে, অত বয়সে কেউ… একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা পুরো লেখা! মানে, মাথা তো কাজ করেছে! দেবারতিদি আমায় বলেছেন, উনি তো মরতে মরতে লিখেছেন! মানে, ফিজিক্যালি একটা লোক আর নিতে পারছে না! বিরানব্বই বছর বয়সে লিখবে কী করে! তো, মণীন্দ্র গুপ্ত একটা ব্যতিক্রম। ওঁকে নিয়ে পরে আমরা কথা বলবো, এই কারণে যে ওঁর সবচেয়ে যেটা বড় জিনিস… মণীন্দ্র গুপ্ত যে প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়েছিলেন… তাঁর ওই সময়ের বয়সটা এখন আর মনে করতে পারছি না! সেইটা সহ্য করা এবং সেটা থেকে রসদ নেওয়া… এটা খুব বিরল ব্যাপার!   

সঙ্ঘমিত্রাঃ মানে, কারো কারো হতাশা আসে… ওঁর ক্ষেত্রে বোধহয় উলটো হয়েছিল…

গৌতমঃ ওঁর মনের জোরটা বেড়ে গেছে। ওঁর জীবনেও কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে… যেমন আমার একটা মনে হয় যে… আমি নিজেও ওঁর পুরোনো কবিতার খুব অনুরাগী নই। ‘চাঁদে চাকার দাগ’ – এই লেখাগুলো সাংঘাতিক ভালো। কিন্তু, এই লেখা, ব্রেনের লেখা। অসম্ভব ভালো লেখা, কিন্তু মস্তিষ্কপ্রসূত লেখা। কোনো একটা সময়ে উনি খুব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেটা খুব বেশি বয়স না, তখন ‘অক্ষয় মালবেরি’ লেখা হয়ে গেছে। সেই সময় দু তিনটে কাগজে ওঁর তিনটে চারটে লেখা দেখলাম। সালটাও বলছি, ১৯৮২। কারণ, লেখাটা ছিল – এশিয়ান গেমস এর শেষদিন। তাতে উনি বলছেন, ফেয়ারওয়েল সেরিমনিতে সবাই হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছে… মেয়েরা হাঁটছে… খুব সুন্দর একটা দৃশ্য… সেইখান থেকে উনি  নিয়ে গেলেন – এই যে মেয়েরা হাত নাড়ছে, কোন শতাব্দী থেকে আমরা দেখছি! আরেকটা লেখা ছিল – অসুস্থতাতেই মানুষের অন্তর্দৃষ্টি জাগে –সারদা মায়ের কথার সূত্র উল্লেখ করে লেখাটা লিখেছিলেন। তারপর ওঁর লেখাই পালটে গেল! এই হল অন্তিম পর্বের মণীন্দ্র গুপ্ত, কবিতায়। কিন্তু গদ্যের ব্যাপারে, সঙ্ঘমিত্রা, আমার যেটা মনে হয়, উনি অনেক আগে থেকেই খুব আত্মস্থ। সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। উনি কিন্তু জানতেন। এই কারণে বলছি যে, আমি তার সাক্ষী। কোনও একটা অবিচুয়ারিতে আমি এটা লিখলামও… অক্ষয় মালবেরী তখন হয়ত পাণ্ডুলিপি স্টেজে আছে… বেহালার দিকে কোথাও একটা কবিতা পড়ার ব্যাপার হচ্ছে… খুব ঘরোয়া… তো, উনি সবথেকে প্রবীণ, ওঁকে শেষে পড়তে বলা হয়েছে। উনি বললেন, কী আর কবিতা পড়বো! আমি একটা গদ্য লিখছি, বরং ওটা পড়ি। ততক্ষণে দু-আড়াই ঘন্টা কবিতা পড়া হয়ে গেছে। আমরা তো এই অনুষ্ঠানগুলো দেখেছি! লোকে যথেষ্ট বোর হয়ে পড়েছে। লোকেদের মধ্যে কথা হচ্ছে… এ হচ্ছে ও হচ্ছে… উনি পড়া শুরু করলেন যেমনভাবে পড়তেন… স্মার্ট লোক তো! খানিকক্ষণ বাদে … যখন মাথাটা একটু ঠিক হলো… দেখলাম, প্রত্যেকটা ( জোর দিয়ে) লোক একদম টানটান হয়ে বসে আছে! যখন শেষ করলেন… তিন চারপাতা পড়তে পড়তে হট করে থেমে গেলেন… তখন না, দৃশ্যটাই পুরো পালটে গেছে! মানে, একটা লোক একা কথা বলে চলেছে তার যে কী শক্তি! এখন, সেই জায়গাগুলো তো আর আমি জীবনে ছুঁতে পারবো না! কিন্তু জিনিসটা দেখেছি। মণীন্দ্র গুপ্ত’র ব্যাপারটাই অন্যরকম! 

অনিমিখঃ  উপন্যাসগুলোতেও কিন্তু অক্ষয় মালবেরীর কিছুটা ছায়া আছে… গৌতমদা যেমন বলছেন যে ব্যাপারটা রেডি হয়েই ছিল, শুধু কেউ চাপ দেয়নি বলে লেখার জন্য… 

গৌতমঃ হ্যাঁ। সৌরভ-দেবজ্যোতি ওই চাপটা দিয়েছিল তো… অ্যাট গান পয়েন্ট লিখিয়েছে তো,
তাই লেখাগুলো বেরিয়ে গেছে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনি বলছেন যে সেই অবস্থাটা মনে অনেকদিন আগেই তৈরি হয়ে ছিল। কিন্তু অনেকসময় এরকম তো হয় যে সেই অবস্থাটা দৈনন্দিন জীবনে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষয়ে যায়! মানে, সেই সময়েই যদি সেটা না লেখা হয়… তাহলে ওঁর ক্ষেত্রে কি এটা ব্যতিক্রম না কি এরকমভাবে লেখা যেতে পারে?

গৌতমঃ সাধারণ ভাবে আমি তোমার সঙ্গে একমত। ওঁর ক্ষেত্রে এটা একটা নতুন অল্টারনেটিভ যে, এভাবেও হয়। কারণ এরকম দৃষ্টান্ত তো খুব বেশি নেই! ওঁর একটা সমস্যা ছিল… আমার যেটা মনে হয় যে, একটা সিদ্ধান্ত নিতে উনি অনেক সময় নিয়েছিলেন যে উনি ছবির জগতে থাকবেন না লেখার জগতে। এটাতে ওঁর অনেক বছর চলে গেছে। তারপরে, আমরা যেভাবে কবিদের দেখতে অভ্যস্ত উনি একদমই সেরকম ছিলেন না। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ উনি বিশ্বাসও করতেন না। 

গৌতমঃ আমি দেখেছি… তখন তো বেশি চ্যানেল ছিল না… AXN  বলে একটা চ্যানেল ছিল… এখন আর কেউ দেখেনা… তো উনি ধাই ধুপ… সারাক্ষণ ওইগুলো দেখতেন। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ তাই?

গৌতমঃ হ্যাঁ, ভক্ত ছিলেন AXN এর। তারপরে, উনি আর্মিতে কাজ করেছেন… যদিও ওঁকে যুদ্ধ করতে হয়নি, উনি টেকনিকাল লোক…  

অনিমিখঃ  গৌতমদা, ওই ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে যৌবনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আসা যাক। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, তার আগে আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। আপনি বললেন না যে, মণীন্দ্র গুপ্ত যখন অসুস্থ হয়েছেন বা ওঁর জীবনে কিছু বিপর্যয় হয়েছে তারপর থেকে ওঁর লেখা বা মনোগঠন আস্তে আস্তে পালটে যেতে থাকে। তো, এটা তো আমরা অনেকসময় ভাবি যে একজন ভেতরে এবং বাইরে খুব স্থিতধী মানুষের পক্ষে লিখতে আসা সম্ভব নয় বা শিল্পী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।  বিপর্যয় কিংবা দোটানা যার মধ্যে যত তীব্র তার কবিমনের বা শিল্পীমনের স্ফূরণ তত বেশি – এরকম কি বলা যায়? 

গৌতমঃ এটা নির্ভর করছে যে সে তার অশান্ত চিত্তের কতটা সদ্‌ব্যবহার করতে পারছে তার ওপর। মানে, কেবল দুর্ভাগ্য দিয়ে কিন্তু কিছু হয়না। 

**গৌতমঃ স্থিতধী মানুষ বলতে আমরা কোনও জ্ঞানীকে যদি শনাক্ত করি, যিনি মীমাংসাসূত্রের অধিকারী, তা হলে, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তিনি শিল্পী নন । শিল্পীসত্তার সঙ্গে একজন নিঃস্ব অনুসন্ধানকারীর একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় । সন্দেহ নেই, তিনি অশান্ত । আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন, ঝড় লুটোপুটি খেলেও তার কেন্দ্রবিন্দু স্থির,গুটি-গুটি পায়ে সে মানচিত্রের ওপর দিয়ে এগোয় । এক সময়ে তার ক্ষয়প্রাপ্ত শক্তির উপযোগিতা ফুরোয় । ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুর মতোই মহৎ শিল্পী তখন মহাশূন্যে লীন হয়ে যান!  ছটফটে ভাবুক ও সাহিত্যকর্মীর সঙ্গে তাঁর একটা প্রভেদ আছে বলে অনুমান করি।

**( আমরা ইন্টারভিউ-র লিখিত রূপ যখন কবি গৌতম বসু’কে দেখাই, উনি প্রশ্নটার প্রেক্ষিতে পরে এই বক্তব্যটি লিখে পাঠান। স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব যাতে না ঘটে তাই আমরা এভাবেই রাখলাম, ওঁর বক্তব্যটিকে। নাহলে পরের প্রশ্নগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত কিছুটা)   

সঙ্ঘমিত্রাঃ দুর্ভাগ্য নয়, আমি বলতে চাইছি এই যে টানাপোড়েন একটা মানুষের মধ্যে… নানা বিপর্যয়ের কারণে তৈরি হওয়া টানাপোড়েন। 

গৌতমঃ সেইটা লাগাতে হবে না কাজে! যেমন জীবনানন্দ কাজে লাগিয়েছিলেন। জীবনানন্দকে যে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল… উনি কি কারো সঙ্গে কোনো ঝগড়া করেছেন? উনি লেখায় জবাব দিয়েছেন। এটার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হচ্ছেন দান্তে। যারা লাঞ্ছনা করেছে তাদের মধ্যে একটা লোকও মুক্তি পায়নি ওঁর লেখা থেকে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা…

গৌতমঃ দান্তের একটা তত্ত্ব আছে, কন্ট্রাপাসো। সেটা হচ্ছে, ধরো, তুমি আমার সঙ্গে একটা খুব অন্যায় আচরণ করলে… অপমান তো খুব সাধারণ ব্যাপার, ধরো, খুব পার্টিকুলার কোনো ক্ষতি করলে আমার… ওঁর একটা সেন্স অফ জাস্টিস ছিল… তো, উনি বলতেন ধরো, তুমি আমার বাড়িতে চুরি করলে, তোমারও ওইটাই হবে। সেটা উনি ডিভাইন কমেডিতে এনেছেন। একটা লোক ধর্মযাজক ছিল, তাকে উনি উলটো ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ ওই শাস্তিই সে অন্যকে দিত। ভার্জিল আর দান্তে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় এলেন, দেখলেন সেখানে দণ্ডিতরা বরফের চাঁইয়ের ভেতর বুক অব্দি  বন্দী, দু’ হাত ওপরে তুলে তারা হাঁউ মাউঁ করে কাঁদছে – ভাবতে পারো? 

সঙ্ঘমিত্রাঃ অনেকটা পোয়েটিক জাস্টিস এর মতো? 

গৌতমঃ পোয়েটিক জাস্টিস ঠিকই, তবে এর সঙ্গে ধর্মশাস্ত্রেরও একটা যোগ আছে। এটা ওঁর মাথা থেকেই বেরিয়েছে, আর কোথাও নেই। এখন ওঁর মতো অসুবিধে তো অনেক লোকের ছিল! কিন্তু, ঐটাকে সদ্‌ব্যবহার করা, যেটা আমি বলছিলাম। আমি দান্তের সঙ্গে জীবনানন্দের কোনো তফাৎ পাইনি।  

অনিমিখঃ এবার সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি? জেনারেল ইন্টারেস্ট নিয়ে আপনি বলছিলেন যে ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে যৌবনের সম্পর্ক…

গৌতমঃ হ্যাঁ, এটা ভুলে যাচ্ছিলাম। নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরিতে বাঙালিরা যে এতো উন্নতি করেছিল তার একটা কারণ হচ্ছে এই যে, সবকিছুর ব্যাপারে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এই যে রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ বলা হয়, এটা সেরকম বিরাট কিছু বলে আমার মনে হয়নি। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কলকাতার কতিপয় কিছু মানুষের কাছে… বিনয় ঘোষ বলেছেন… জাতির ওপরে সেভাবে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।  

গৌতমঃ হ্যাঁ। জাতির ক্ষেত্রে তো হয়নি, মূল ইতালিয়ান রেনেসাঁতেও একই ব্যাপার। কিন্তু যেটা ঘটেছিল সেই সময়, নানা ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন লোকের। বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ, যেটা বাঙালির কোনোদিন ছিল না! খেলাধুলো সম্পর্কে, শরীরচর্চা সম্পর্কে… আর রাজনীতি, ধর্মশাস্ত্র এগুলো তো আছেই! যেমন, এক ভদ্রলোক ছিলেন, ‘ভারত শ্রমজীবি’ নামে একটা কাগজ করেছিলেন, লেবার পত্রিকা। এটা আমরা আজকে ভাবতে পারবো না। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরিতে? সেটা কত সাল নাগাদ?

গৌতমঃ ১৮৭০ এর দশক! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ মানে, প্রমথ চৌধুরী’র ‘সবুজপত্র’ থেকে অনেক আগে! 

গৌতমঃ অ-নে-ক অ-নে-ক আগে!

সঙ্ঘমিত্রাঃ ভাবা যাচ্ছে না!! এমনকি ‘বঙ্গদর্শন’-এরও আগে…  

গৌতমঃ হ্যাঁ, ‘ভারত শ্রমজীবি’ – নামটাই কেউ ভাবতে পারবে না। তো, ধরো, একটা সময় পর তোমার যৌবন ফুরিয়ে যাবে। তখন তুমি কী করবে? যে প্রাকৃতিক সাপোর্টটা তোমার ছিল সেটা চলে যাচ্ছে… তখন তোমাকে বাঁচাতে পারে তোমার আইডিয়াগুলো। নাহলে কী হবে, তুমি বা আমি সেই একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে থাকবো। সেখানেও নানান জিনিষ তৈরি হতে পারে কিন্তু! যার ক্ষমতা বেশি সে কিন্তু তার নানারকম রঙ বদল করে… তার চেহারা বদল করে… কিন্তু বেসিক্যালি সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মানবিক সম্পর্ক নিয়ে অসাধারণ লেখা হয়েছে, আরও লেখা হবে। কিন্তু এটা আমার একটা সীমাবদ্ধতা যে আমি কিন্তু কুকুর বেড়াল নিয়ে ভাবতে পারছি না। এটাও আমার উৎপলদার কাছ থেকে শেখা। আমায় বলেছিলেন, তুমি কুকুরদের লক্ষ করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? উনি বললেন, দেখবে, একসঙ্গে দৌড়চ্ছে সবক’টা। হঠাৎ একটা কুকুর দাঁড়িয়ে গেল। এইবার, আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করলো! সে আওয়াজটা কিন্তু বার্কিং নয়। ও কিন্তু একটা সিগনাল পাচ্ছে! এইরকম ভাবতেন উনি! 

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, আমাদের বাংলা সাহিত্যে মানব মানবীর প্রেম নিয়ে যত লেখা হয়েছে সেই নিরিখে এই পৃথিবীটা যে কেঁচো কুকুরের কেন্নোরও, তা নিয়ে কিন্তু লেখা হয়নি। 

গৌতমঃ একদম হয়নি বলবো না, হয়েছে, কিন্তু সেটা তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এগুলোতে না অশেষ সম্ভাবনা আছে!  

অনিমিখঃ  এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে গৌতমদা। আমি অবশ্য একটু বাঁকা চোখেই দেখি, সেটা আমারই সীমাবদ্ধতা। বিদেশে কিন্তু, বিশেষ করে আমেরিকাতে, ইওরোপেও কোথাও কোথাও, একদম সমকালীন কবিতা… তারা কিন্তু একরকম জঁর তৈরি করেছেন যে এনভায়রনমেন্টালি অ্যাওয়ার পোয়েট্রি – ক্যাম্প হচ্ছে, প্রজেক্ট হচ্ছে, বই বেরচ্ছে। তো, এটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন? এটা কি ওই দেখার ভঙ্গিটা পালটে যাচ্ছে বলেই হচ্ছে? সাহিত্য হিসেবে তার কতটা মূল্য থাকতে পারে? 

গৌতমঃ সাহিত্য হিসেবে মূল্য আসতে পারে। আমার মনে হয়, এই জিনিসগুলোর একটা উপযোগিতা আছে… এগুলো নিজে হয়তো মহৎ কিছু শিল্পসৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু, ক্ষেত্রটাকে সম্প্রসারিত করতে পারবে। হেনরি ডেভিড থরো পরিবেশ-সচেতন সাহিত্যের একজন পথিকৃৎ, তাঁর লেখা পড়ে কত মহৎ মানুষ নিজেদের তৈরি করেছেন তার ইয়ত্তা নেই, অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি একজন অবহেলিত লেখক। সবসময় তো ইন্ডিভিজুয়াল বেসড হয়ে সাহিত্য এগোয় না! যেমন, শেলী আমার কাছে ইন্ডিভিজুয়াল বেসড সাহিত্যের একটা বড়ো উদাহরণ। শেলী যা লিখেছেন – ওঁর লেখার কোর এরিয়া নিয়ে আমি কোনো কথাই বলছিনা – কিন্তু বিপ্লব নিয়েই হোক, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে হোক, তারপরে নন ক্রিশ্চিয়ান দেবতাদের নিয়ে হোক – এগুলোতে উনি পথপ্রদর্শক। এবং ধরো, একটা রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছে, আর উনি তার বহু আগে অভ্যুত্থানটা দেখছেন! এটা আমার ওঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে। কীটস অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, কিন্তু শেলী সর্বত্রগামী। এমন অনেক জিনিস নিয়ে উনি ভেবেছেন যা বাস্তব জগতে অনেক পরে আসছে। যেমন, সত্তর দশকের লেখার সঙ্গে নকশালপন্থী আন্দোলনের যে মিলগুলো দেখানো হয় সেটা আমি স্বীকার করি না এই কারণে যে একটা ঘটনা ঘটে গেলে তা নিয়ে কবিতা লেখা তো খুব সহজ! সেটা তো আমি আমার সংবেদনশীলতা দিয়ে ধরতে পারছি। কিন্তু আমি পূর্বানুমান করতে পারছি কি? র‍্যাঁবোর একটা লেখায় আছে, অন্যরা যেগুলো কল্পনা করেছে আমি তা দেখে এসেছি। এ ভাবাই যায়না! এই হলো দ্রষ্টা। 

অনিমিখঃ Seer। 

গৌতমঃ হ্যাঁ, seer। এই জিনিসটা খুব বেশি আসে না। হয়তো তাহলে এর মাহাত্ম্যই নষ্ট হয়ে যাবে! জীবনানন্দ একজন seer । আমি ওঁকে আর কবি হিসেবে দেখিই না! আমার তো মনে হয় যেন খড়ম পরা একটা লোক! স-অ-ব দেখতে পাচ্ছেন! 

অনিমিখঃ  এবং তার হাত থেকে তো পঞ্চাশ বছরেও ষাট বছরেও মুক্তি হলো না আমাদের!

গৌতমঃ হবে না তো!

অনিমিখঃ   এবং বাক্যগঠন তো সেরকমই এখনো রয়ে গেলো! 

গৌতমঃ হ্যাঁ। ইন ফ্যাক্ট, আমি বলবো আমরা অনেক সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছি।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ কবি মাত্রেই যে seer হবেন তা বলছেন কি আপনি? 

গৌতমঃ হ্যাঁ, কিছুটা হতেই হবে…

অনিমিখঃ  গৌতমদা বলছেন যে বেশিমাত্রায় যদি আমি দেখে ফেলি তবে তাকে লেখার ফ্রেমের মধ্যে আনাটা বোধহয় খুব দুরূহ!

গৌতমঃ হ্যাঁ, আনাটা খুব মুশকিল।  

অনিমিখঃ   কোথাও একটা রিয়েলিটি আর লেখার মধ্যে তো একটা তফাত থাকে… মানে, ইটস থার্ড টাইমস রিমুভড ফ্রম রিয়েলিটি তো বলাই হয়… তো, সেই স্পেসটা দিতে হবে আর কী… 

গৌতমঃ হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। এটা আমার এই সময়ের সম্পর্কে মনে হয়। বাংলা কবিতা যতদূর এগিয়ে গেছে ততদূর ছন্দশাস্ত্রের লোকেরা এগোয়নি। ছন্দ কিন্তু এগিয়ে চলেছে! অনেক লোকে ছন্দ তৈরি করছে, ছন্দ ভাঙছে কিন্তু কোনো হিসেবরক্ষক নেই যে সেগুলোকে ক্যাটেগরাইজ করবে।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ এবার একটু আপনার গদ্য নিয়ে কথা বলব। যবে থেকে পড়েছি তবে থেকেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে… প্রবন্ধটা ‘ভাষার ক্ষয়’ নিয়ে… এতটা সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন সেখানে… ভাষার ক্ষয় দু’রকম। একটা ক্ষয় বাহ্যিক, আর একটা ভেতরের ক্ষয়। ভেতরের ক্ষয় কীরকম বলতে গিয়ে আপনি বলছেন যে, এক হচ্ছে ভাবনাচিন্তার দৈন্য – সেটা ভাষার কিছুটা ক্ষয় করে, আরেকটা হলো একজন খুব বড়ো কবি যিনি ভাষাটাকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছেন! ভাষাটাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিতে পারছেন, তিনি ভাষাটার কিছুটা ক্ষতি করেছেন। বলতে গিয়ে আপনি মাইকেলের কথা বলেছেন। তো, আমি বলতে চাইছি যে, একজন বড়ো কবি যিনি একটা দানবিক শক্তি নিয়ে ভাষা ব্যবহার করছেন… তার সঙ্গে ভাষার এই ক্ষয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি… যদি একটু বলেন… মাইকেলের মতো ওইরকম একজন কবি একটা শব্দকে যেভাবে দুমড়েমুচড়ে ব্যবহার করছেন তার পরবর্তী কবি দশবার ভাববেন যে ওই শব্দটা আর ব্যবহার করবেন কিনা! তো, এটাকে ভাষার ক্ষয় না বলে আমি এভাবেও তো ভাবতে পারি যে আরও একটা রাস্তা খুলে গেলো… একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে এটা নিয়ে…  

গৌতমঃ আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে এইটার দুটো সূত্র আছে। একটা সূত্র আছে এলিয়টের একটা লেখায়। কোনও হীনমন্যতা  থেকেই উনি হয়তো লিখেছেন… আমি জানি না… কথাটা হচ্ছে যে ইংরেজিতে কোনো এপিক নেই। কিন্তু অন্য ভাষায় আছে। মিল্টনকে উনি খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তো, ওই লেখায় উনি বলছেন, এপিক যে ভাষায় থাকে সেই ভাষাটাই নষ্ট হয়ে যায়। সেখানকার লেখকরা এতো ক্ষমতাবান হন যে তারা ভাষাটাকেই নষ্ট করে দেন। আমাদের প্রেক্ষিতে সাজিয়ে নিলে বলতে হয়, ‘মহাভারত’ একটা তৈরি হলে সে ভাষা তার নীচে crumble করে। 

অনিমিখঃ  হ্যাঁ…  

গৌতমঃ উনি বলেছেন যে ইংরেজি ভাষায় যদি এপিক থাকতো তাহলে ভাষাটা এতো সমৃদ্ধ হতো না। এতজন সে ভাষায় কাজ করতে পারতো না। একটা এপিক আমি পেলাম কিন্তু আর  কিছু পেলাম না। তোমাদের যেরকম শকিং লাগছে, সেরকম আমারও খুব শকিং লাগতো। আরেকটা  কথা আছে, জীবনানন্দের। উনি বলছেন, পৃথিবীতে কোনো গ্রন্থ শাশ্বত নয়। এত বড়ো একটা কথা… সাহস হলো কী করে বলার? যেখানে আমাদের একটা বিরাট পরম্পরা আছে। পরে, আমি ভাবতে ভাবতে দেখলাম, কতটা সত্যি কথা! আমরা যদি একটা ডেটিং করি, মহাভারত বা রামায়ণ – মানে, এপিকের পরে একটা বিরাট গ্যাপ আছে ভারতীয় সাহিত্যে। এরপরে যাঁর খোঁজ আজও পাওয়া যাচ্ছে তিনি হচ্ছেন অশ্বঘোষ। অন্তত চারশ-পাঁচশ বছর পরে। অশ্বঘোষের আগের লেখকরা সম্পূর্ণ মুছে গেছেন। এইটা হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় মহাভারত রামায়ণের জন্য। কারণ, তখন কি আর কবি ছিলেন না? প্রচুর লেখক ছিলেন। তাঁরা মহাভারত রামায়ণ ভেঙে ভেঙে লিখছেন, সে লেখা বাঁচেনি। অশ্বঘোষই প্রথম লেখক যিনি ভাবলেন,  আমাকে যদি কিছু করতে হয় তাহলে আমাকে সম্পূর্ণ অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে।  বুদ্ধচরিতের টেক্সট ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেছে, একটা অংশ একদিকে অন্য অংশ একদিকে আরেকদিকে চলে গেছে, তবু বেঁচে রয়েছে আজও, অনুবাদের মাধ্যমে গোটা টেক্সট আবার পূর্বাবস্থায় ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, চিন..

গৌতমঃ হ্যাঁ, চিনে। ইসলামিক আগ্রাসনের সময়ে সমস্ত নষ্ট হয়ে গেছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খানিকটা উদ্ধার করেছেন নেপাল থেকে। খানিকটা চিন থেকে এসেছে। যেকারণে এখন দুটো অংশ পাওয়া  যায়। ভারতের প্রাচীন সাহিত্য ধ্বংস হয়ে যেত যদি অশ্বঘোষ না আসতেন। এখন, আমার লেখাপড়া এত কম যে… (বাধা পেয়ে) না না… এগুলো টেকনিকাল ব্যাপার গো…

সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনার লেখা তো পড়লে তো তা মনে হয় না …

অনিমিখঃ  এখানেই আশ্চর্য লাগার জায়গাটা এই যে বিষয়গুলি নিয়ে কেউ লিখে থাকতে পারেন, কিন্তু তার মধ্যে একটু কাব্য মিশেই যায়… আপনি  একেবারে টেকনিকাল দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখেই লিখেছেন… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ এবং তার পেছনে চিন্তাটা আছে। এটা খুব বড়ো ব্যাপার… 

গৌতমঃ আসলে আমি সাহিত্যের লোক নই তো…

সঙ্ঘমিত্রাঃ না, সেটা আপনি চিন্তক বলেই সম্ভব হয়েছে। আপনি চিন্তাসূত্র ধরে এগিয়ে যান, এটা দেখেছি… 

গৌতমঃ সাহিত্যের বিবর্তনে কোনও সাধারণ নিয়ম নেই, এটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক প্রসঙ্গ। আমি কেন বলতে পারছি না যে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর বাদে একটা ভাষার অবস্থান কী হবে! বলতে পারছি না কারণ, সাহিত্যের ভাষা খানিকটা ধাক্কা খেতে খেতে এগোয়। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ এইসূত্রে আমার একটা কথা মনে এলো। অশ্বঘোষ যেমন একটা আলাদা  ভাষাপ্রকৃতির জন্ম দিয়েছেন তেমনই তো রবীন্দ্রনাথও বলতে গেলে বাংলা ভাষাকে একা হাতে অনেকখানি ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাহলে সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথও বাংলা ভাষাটার ক্ষতি করেছেন? 

গৌতমঃ হ্যাঁ, অবশ্যই! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু এটাও তো ঠিক সেই ক্ষতির মধ্য দিয়েই ভাষার তো কিছু পুনরুজ্জীবনও সম্ভব হচ্ছে!   

গৌতমঃ হ্যাঁ। তা তো বটেই। এই ক্ষতি শব্দটার একটা সেমান্টিক সমস্যা আছে। মানে, আমি ক্ষতি বলতে যা বলছি তুমি ক্ষতি বলতে অন্য কিছু বুঝছো।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ ঠিক।

গৌতমঃ যেমন,  বিখ্যাত একটা বিতর্ক আছে না যে, আমি ‘টেবিল’ বললাম… কিন্তু টেবিল বলতে একটা অন্য কিছু বোঝাল! তো, সেইদিক থেকে নয়। ক্ষতি বলতে আমি পুরোটা নেগেটিভলি দেখবো না। ক্ষতি বলতে irreversible change।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ বুঝতে পেরেছি।

গৌতমঃ সেই পূর্বাবস্থায় আমি আর কোনোদিনই ফিরতে পারছিনা। সেইটা হলো ক্ষতি।

অনিমিখঃ  হুঁ। যেহেতু এটা কোনো ল্যাবরেটরি নয়, সুতরাং স্বাভাবিক ডেভেলপমেন্ট হলে কীরকম হতো সেটা আমরা কেউ বলতে পারছি না! এটা জীবনের মতোই, জীবনে একটা পরীক্ষা আপনি দু’বার করতে পারবেন না। একইরকমভাবে এই যে সিনিয়ারিটি বেসিসে আমরা উপদেশ দিই…  

গৌতমঃ হ্যাঁ, উপদেশ দিতে পারি, বকাঝকা করতে পারি, কিন্তু সেটা বোকা বোকা শোনাবে। 

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, কেননা একজনের জীবন তো আরেকজনের মতো নয়।  

গৌতমঃ হ্যাঁ, কিংবা আমি যাকে বোঝাতে চাইছি তার বয়স আমার থেকে কুড়ি বছর কম হতে পারে, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা হয়ত আমার থেকে বেশি। ফলে, আমি কাকে জ্ঞান দিচ্ছি এখন? মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। রবীন্দ্রনাথও ওই একই ‘ক্ষতি’ করেছেন। আমি এটা হিসেব করে দেখেছি, বুঝলে, রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবন হচ্ছে তেষট্টি বছর। ওদিকে বাল্মীকি প্রতিভা যদি ধরা হয় তাহলে আরেকটু বাড়বে। কারণ, বাল্মিকী প্রতিভা আমার মনে হয় একটা সর্বকালীন সম্পদ। সেটা থেকে যদি ১৯৪১ ধরা যায় – ওই সময়খণ্ডে উনি যা পরিবর্তন এনেছেন, তা অন্য ভাষায় শ’দুয়েক বছরের কাজ। এইটাকেই আমি ‘ক্ষতি’ বলছি । ‘ক্ষতি’ এইকারণে যে, আর কোনোদিন তুমি বিহারীলালের মতো লিখতে পারবে না। আরেকটা দুঃখের জায়গা, গোপাল উড়ে।   

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, আপনি লিখেওছেন। 

গৌতমঃ আমাকে একশটা বাংলা কবিতা যদি বাছতে বলা হয় আমি গোপাল উড়ের ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার’ – এই কবিতাটা নির্দ্বিধায় বাছব। বাংলা সাহত্যের বড়ো বড়ো লোকেদের নীচে এই লেখা চাপা পড়ে গেছে।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, জাংশানের মাঝে যে হল্টগুলো বা বিচিত্র জনপদ থাকে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়…

গৌতমঃ ভাল বললে। বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়।  

অনিমিখঃ  ক্ষমতাবান সাহিত্যিকদের কারণে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি কিন্তু এই ক্ষতিটাও হয়েছে! 

গৌতমঃ হ্যাঁ, আমাকে মনে রাখতে হবে যে এই ক্ষতিটাও কিন্তু হয়েছে!  

অনিমিখঃ  ঐ ছন্দের ব্যাপারে যা বললেন সেটা আমি এখন ভাবছিলাম বসে যে ছন্দে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে কিন্তু কোনো রেকর্ড বুক নেই। তো, বাংলা কবিতায় গীতলতা বরাবরই ছিল। বঙ্গভূমিটাই সেরকম, ঠিক। কিন্তু বাংলা ভাষায় চিন্তা কে কবিতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রটায় কি কিছুটা ঘাটতি পড়েছে? ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে দেখে আপনার কী মনে হয়? 

গৌতমঃ একটা কথা তো ঠিকই, যেটা তুমি বলছো, মানুষের ভাবনার জগতে যখন দৈন্য দেখা যায় তখন সে নিষ্ফলা শৈলী নিয়ে ভাবে। যেমন যেখানে বিজ্ঞানের ভূমিকা মানুষের জীবনে কমে যাচ্ছে, তখনই গ্যাজেটের ভূমিকা বাড়ছে।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ বাহ! চমৎকার!

গৌতমঃ তাই না? বিজ্ঞানচেতনা কমে গেছে কিন্তু যন্ত্রচালনায় দক্ষতা বাড়ছে! এই কথাগুলো বলতে পারছি কারণ আমি অন্য ডিসিপ্লিনের লোক! ক্রিয়েটিভিটির দিকে যদি দেখি, টেকনিকাল ইনোভেশন যেখানে নেই সেখানে ভাষাও শেষ হয়ে যায়। তুমি যে প্রশ্নটা তুললে, সেই ভাবনার উদারতা বা চিন্তার ব্যাপ্তিকে বাঁচিয়ে রাখা… এর একটা বড়ো উপকরণ হচ্ছে টেকনিক। টেকনিক না থাকলে কী হয়… ধরো, ওয়ান টু টেন পয়েন্ট স্কেলে তোমার চিন্তা সীমাবদ্ধ আছে। সেটাকে তুমি বাড়াতে চেষ্টা করছো বারো তে। কিন্তু নানা কারণে সেটা আট-এ নেমে এসেছে। এবার, আট থেকে বারো পয়েন্টে পৌঁছতে গেলে তোমাকে কিন্তু একটা টেকনিকাল ধাক্কা দিতেই হবে। 

আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যে প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা মরে যেতো। যদি না আমির খসরু বলে একটা লোক আসতেন।

সঙ্ঘমিত্রাঃ একদম!  

গৌতমঃ আমির খসরু এসে বাইরে থেকে নানারকম টেকনিক প্রয়োগ করলেন… নানা কিছু করলেন… ভারতীয় সঙ্গীত চালু হয়ে গেল আবার! পারস্য সঙ্গীতের সঙ্গে আজকের ভারতীয় সঙ্গীতের তুলনা যদি করি দেখব যে, ভারতীয় সঙ্গীত কতো এগিয়ে গেছে! সেতার তো ওদের ওখান থেকে এসেছে! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ সন্তুরও ওখান থেকে এসেছে। 

গৌতমঃ হ্যাঁ… সেতার ওঁরা পিড়িং পিড়িং করে বাজান, তার কোনো ডেপথই নেই! এইখানকার লোকেরা সেটার বদল আনলেন। বাদ্যযন্ত্রটাই পালটে গেল! রবিশঙ্কর বীণার তার লাগালেন। সো, টেকনিক ইজ দ্যাট ইম্পর্ট্যান্ট! একটা সময়ে ষাটের আন্দোলনে যেগুলো চলতো… কবিতাকে একরকমভাবে সাজাতো… স্পেসিং দিয়ে সাজানো… নানারকম টেকনিক… কিন্তু তার পেছনে কোনো গভীড় চিন্তাসূত্র নেই। সংস্কৃত কবিতা যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে তখনও এই প্রবণতা আমরা দেখি কিন্তু। একটা কবিতা পদ্মফুলের মতো… আনফরচুনেটলি মালার্মেও করেছেন জিনিসটা। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কামিংসও তো করেছেন কিছুটা?

গৌতমঃ কামিংস লাইনটা সাজিয়েছেন। ক্যাপিটাল লেটার উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মালার্মের একটা কবিতা আমার মনে পড়ছে, আওয়ার গ্লাসের মতো করে সাজিয়েছিলেন। আমার আর কিছু বলার নেই বলেই তাই আমাকে ওই আয়োজন করতে হচ্ছে।  

আমি পোস্ট ওয়ার জাপানিজ পোয়েট্রি বলে একটা বই কিনেছিলাম… পেংগুইন থেকে বেরত… পোস্ট ওয়ার পোলিশ পোয়েট্রি, পোস্ট ওয়ার রাশিয়ান পোয়েট্রি… এরকম অনেকগুলো বেরিয়েছিল। তো ওই সংকলনে অসম্ভব সব লেখা আছে! একটা লেখা আছে … মনে হবে বাংলাদেশের কথা লেখা হচ্ছে… একটা ছেলে চাল পাচার করছে… ট্রেনে বস্তাগুলো ঢিলে করে বাঁধতে হয়… ফেলে দিচ্ছ তো ট্র্যাকের ওপরে… টাইট করে বাঁধলে সেগুল কিন্তু ফেটে যাবে! চোরাচালানকারী নিয়ে জাপানি কবিতা… যেটা আমরা আজকে ভাবতেই পারিনা… জাপান এত উন্নত একটা দেশ! ওইখানে একটা কবিতা ছিল ‘আকাশ’ এর বিষয়ে… সেখানে ওদের অক্ষরে ছোট্টো একটা ফ্রেম করেছে। আর কিচ্ছু নেই কবিতাটায়! এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল, কিন্তু এটা তুমি কতবার করবে? একবার ওটা দেখতে খুব ভাল্লাগে, কিন্তু তারপর? 

সঙ্ঘমিত্রাঃ ঠিক!

গৌতমঃ নতুন আইডিয়া আসার জানলাটা তুমি যদি খোলা রাখো… তখন অন্য সবকিছু যখন শুকিয়ে যাচ্ছে… একটা উন্নতি হতে পারে তোমার! এটার সবথেকে বড়ো উদাহরণ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ! 

অনিমিখঃ  তাহলে কি আপনার কাছে দুটোরই সমান মাপের গুরুত্ব আছে?

গৌতমঃ আসলে আমার মনে হয় একেক জনের প্রসেসটা একেকরকম হবে। এমন একজনের কথা আমি ভাবতেই পারি যিনি হয়তো একটা বা দুটো বই লিখলেন… আর দরকার নেই তার লেখার! যেমন বিনয় মজুমদার। দুটো বই যথেষ্ট! ওর চেয়ে বেশি কিছু দরকারই নেই! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ দুটো বই বলতে কি ‘ফিরে এসো চাকা’ আর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’?

গৌতমঃ হ্যাঁ। এর বাইরে যদি কোনও বই নাও থাকত তাহলেও আমাদের কিন্তু…

সঙ্ঘমিত্রাঃ বিনয় মজুমদারকে চিনতে কোনো অসুবিধা হত না… 

গৌতমঃ হ্যাঁ। তাহলে তাঁকে একজন সর্বকালীন প্রধান লেখক হিসেবে চিনতে কোনো অসুবিধে হতো না! 

অনিমিখঃ  গৌতমদা, আমি জেনারেল টার্মে জিজ্ঞেস করছি- ছন্দ আর চিন্তা দুটোর তাহলে সমান সমান গুরুত্ব কবিতায়? 

গৌতমঃ একসাথে অনেকসময় হাঁটতে পারে না। তখন একটা খিটিমিটি লেগে যায়! 

অনিমিখঃ  অনেকটা মুখের ভাষার কাছাকাছি অক্ষরবৃত্ত। ফলে সচেতন না থাকলেও অনেকসময় সেখানে অক্ষরবৃত্তের চলন চলেই আসে। 

গৌতমঃ বা অক্ষরবৃত্তে থাকতে থাকতে হুশ করে মাত্রাবৃত্তে ঢুকে গেল… এরকম একটা হয়! 

অনিমিখঃ  সেটা আপনার ভালো লাগে নাকি মনে হয় এমনটা না হলেই ভালো? 

গৌতমঃ সেটা নির্ভর করছে ভাবের শৃঙ্খলা রক্ষিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার ওপর । দ্যাখো,  বাঙালি কবিরা ছন্দসিদ্ধ। বাংলায় বহুক্ষেত্রে যে অসুবিধে তৈরি হয়েছে… সেটা হচ্ছে …  সেটা হচ্ছে ছন্দ আমার ভাবনার গতিপথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। আমায় যেহেতু মেলাতে হচ্ছে… কখনও কখনও আমি শব্দপ্রয়োগে আপোষ করছি। 

এটা খুব সাহসের সঙ্গে বলেছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’ সম্বন্ধে। প্রচন্ড প্রশংসা করে উনি একটা বাক্যে তাঁর লেখা শেষ করেছিলেন – কিন্তু কোথাও কোথাও এই অন্ত্যমিলটা একটা বাতিকের মতো হয়ে যাচ্ছে। বাতিক কথাটা আমি বললাম। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত কোন শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন, এত বছর বাদে তা আমার মনে নেই। কতটা ভালবাসা থাকলে, পারস্পরিক বোঝাপড়া কতটা নিবিড় হলে একজন কনটেম্পোরারি সম্বন্ধে এরকম বলা যায়, আমরা জানি তো! পরবর্তীকালে অলোকরঞ্জন নিজেই বেরিয়ে এসেছিলেন এখান থেকে। এর একটা বিপদ থাকেই।   

অনিমিখঃ  গৌতমদা, অনেকদিন আগে আপনি আমাকে একফর্মার বই আর চারফর্মার বই সম্পর্কে বলছিলেন… বইভাবনাটা আপনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সে বিষয়ে একটু বলবেন? মানে, আপনার প্রথমদিকের বইগুলো সবই প্রায় দশবছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছে… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ তাও চটি চটি বই…

গৌতমঃ হ্যাঁ।  

আমি বরাবরই কম লিখতাম, এখন একটু বেড়েছে। সেটা খুবই লজ্জার বিষয়। আমার কাছে গীতা চট্টোপাধ্যায় একটা দৃষ্টান্ত, যে কত কম লিখে… কত দূর পৌঁছানো যায়…  

অনিমিখঃ  মানে, আমাদের শূন্য দশকে আপনার দুটি বই বেরিয়েছে। এটি হচ্ছে আপনার রেকর্ড! (সমবেত হাসি) এবং একেকটা বই একেকরকম্ভাবে তৈরি করা হয়েছে। যেমন, শেষ বই ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’য় অনেক বড়ো বড়ো কবিতা আছে। তারপর, রসাতল-এ পুরো গদ্য ফর্মাটে লেখা আছে। তার আগের বইটায় খুব ছোটো ছোটো কবিতা আছে। তো, এইটা কি খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করা?

গৌতমঃ আমি খুব ভেবেচিন্তে করিনি, তবে সেভাবেও করা যায়… 

অনিমিখঃ  যেমন, আমার ‘আলো দেখার নেশা’ বইটার তিন লাইনের লেখাগুলো প্রথমে যখন লিখছিলাম তখন মাথায় আসেনি… পরে একটা সময় ক্লিক করলো…

গৌতমঃ হ্যাঁ, সেইভাবে আমিও এগিয়ে যাই… কোথা থেকে একটা ক্ষীণ সিগনাল আসছে বলে  মনে হয়, মনে হয় যে এভাবেই করে যাই না দেখি… দ্যাখো, ফেলিওর ইজ এন্ডলেস! সে নিয়ে তো ভেবে লাভ নেই! পুরোটাই তো একটা ব্যর্থতা! কিন্তু চেষ্টাটা করা দরকার। বই গড়ার ভাবনা আমার মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাও উৎপলদার! শিখিনি… শিখেছি বীরেনবাবুর কাছে… বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উনি তখন ওঁর বইগুলো বার করতেন,  একটাকা দাম থাকতো। আমার মনে হয়েছিল, ওটা একটা অনুকরণযোগ্য আদর্শ, স্বাধীন লেখক হয়ে বেঁচে থাকার একটা পন্থা। তখন তো এত ভালো কমিউনিকেশন ছিল না! কিন্তু ওই পাতলা পাতলা বইগুলো আজ এখানে কাল ওখানে পরশু সেখানে… কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে! বড়ো বই হলে এটা কিন্তু সম্ভব হত না! 

অনিমিখঃ  এবং আপনি বলছিলেন যে ছোট বই করাটা খুব কঠিন। খুব সতর্ক থাকতে হয়। 

গৌতমঃ করাটা বিপজ্জনক ! মানে, ঝুলে গেলে তো ঝুলেই গেল! খারাপ লেখা কেন হয়?  খারাপ লেখা এই কারণে হয় যে, তুমি তাকে বই থেকে ফেলতে পারছো না, তোমার কোনও একটা ভাবনাসূত্র সেখানে লুকিয়ে আছে। হয়তো তুমি ওই কবিতাটা ঠিকঠাক গড়ে তুলতে পারোনি, কিন্তু ওর মধ্যে কিছু একটা আছে যা তুমি ছাড়তেও পারলে না। একটা ৪৮ পাতার বইয়ের মধ্যে তুমি যে ওই ৫টা কবিতা রাখছো, এটা জেনেই রাখছো  যে ওই লেখাগুলো অন্য লেখার মতো হলো না। তাতে দুটো লাভ হয়। একটা লাভ এই হয় যে, বইটায় ঢেউয়ের একটা ওঠাপড়া আসে। টানটান চার ফর্মার বই কিন্তু পড়া যায়না। স্তরের একটা বৈচিত্র্য থাকলে পড়তে সুবিধে হয়। অন্য লাভের দিকটা হল বইটার বাইরের রূপ, যা গৌণ। কিন্তু, ধরো আমি একটা বইয়ে মাত্র ১৬টা বা ১৪টা কবিতা রাখছি। সেখানে কিন্তু একটা কবিতা এতটুইকু কম হলেই পুরো বইটা ঝুলে যাবে। আমার কাছে সার্থক পাতলা বইয়ের সবথেকে বড়ো উদাহরণ… জানিনা তোমাদের কেমন লাগে… সুধীন্দ্রনাথের ‘দশমী’। ওখানে একটাও কবিতা যদি এতটুকু কম হত, বইটা বসে যেতো। মাত্র দশখানা লেখার ওপর ভর করে ‘দশমী’ দাঁড়িয়ে রয়েছে, অপ্রতিম!  মনে রাখতে হবে, উনি কিন্তু তখন বাংলা কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন! অমিয় দেব কোট করছেন সুধীন্দ্রনাথের একটা চিঠি… সুধীন্দ্রনাথের বেতার ভাষণের কিছু একটা ট্রান্সক্রিপ্ট বেরিয়েছিল… সেটা পড়ে বুদ্ধদেব বসুর ভালো লেগেছিল। বুদ্ধদেব বসু তো সর্বক্ষণ সাহিত্য নিয়ে থাকতেন! তো, উনি তো ওঁকে জানিয়েছেন যে খুব ভাল্লেগেছে। সুধীন্দ্রনাথ লিখছেন যে, আপনার ভালো লেগেছে জানতে পেরে আমারও খুব ভালো লাগছে। পাঁচবছর পরে আমি বাংলা লিখলাম। মানে বুঝতে পারছো, একটা লোক কতদূর চলে গেছে বাংলা সাহিত্য থেকে! সে লেখেইনি! সাহেবিপনা করেছে, বিরাট চাকরি করেছে, কোট-প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়িয়েছে। কবিতা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই ছিল না! ভাবা যায়না এ রিস্কটা! দীর্ঘ বিরতির পর দশটা কবিতা নিয়ে বাজারে নামলেন সুধীন্দ্রনাথ ! তার কয়েক বছর বাদে মারাও গেলেন! 

অনিমিখঃ  আপনার প্রথম বই ১৯৮১। তারপর ১৯৯১। তারপর ২০০১। মানে, ২০০১ এ আমরা যখন কলেজে পড়ছি তখন আপনার তিনটি ছোটো ছোটো বই, তাও একটি সদ্য বেরিয়েছে! এর মধ্যে কি কবিতা কম লিখছিলেন, নাকি ইচ্ছে করেই বইতে রাখেনই নি? 

গৌতমঃ লিখেছি অনেক… ওই মক্‌শো করা…এদিক ওদিক নানারকম চেষ্টা করেছি… কিছুই দাঁড়ায়নি। আমি একটা জিনিস করি, একদম ছুঁড়ে নষ্ট করে ফেলি , যাতে পরিত্যক্ত লেখাগুলোর প্রতি  কোনোরকম মায়া মমতা না থাকে।  

অনিমিখঃ  মানে, ‘অগ্রন্থিত’বলেও কিছু নেই?

গৌতমঃ কিচ্ছু নেই! অর্থাৎ, হিন্দি সিনেমায় যাকে বলে ‘নাম অওর নিশানা মিটা দিয়া!’ (সমবেত হাসি) 

অনিমিখঃ  পার্সেন্টেজ কত হতে পারে?

গৌতমঃ অনেক!  

সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনি প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতে বসেন না যখন লেখা আসে তখনই বসেন?

গৌতমঃ না, যখন লেখা আসে। আসলে কী, আমাকে যে চাকরিটা করতে হত… বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং… 

অনিমিখঃ  কী চাকরি? 

গৌতমঃ আমি একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করতাম। আমি শহরের লোক, গ্রামজীবন আমার একটা বিরাট ধাক্কা হয়ে যায়! আমি ওইরকম মানুষজন, ওইরকম ডোবা – কখনও দেখিনি! ফলে, প্রথম পাঁচবছর তো সর্বক্ষণ মাথা ঘুরতো! লিখব কী! তারপর আস্তে আস্তে যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখলাম যে, এগুলোও তো লেখার বিষয়! ওইজন্য আমার খানিকটা সময়… আর তাছাড়া নানারকম পড়ছিলাম আর বলা যেতে পারে যে আগের লোকেরা কী কী করে গেছে সেটা খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে গেছি। এইটাতে আমার অনেকটা সময় চলে গেছে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ এটা তো একজন কবির খুব জরুরি কাজও গৌতমদা!

অনিমিখঃ  এটা কি নিজের স্থানাঙ্ক নির্ণয় করার একটা ব্যাপার?

গৌতমঃ হ্যাঁ, খানিকটা। যে, আমায় কী করতে হবে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ বা, কী করতে হবে না…

গৌতমঃ কী করতে হবে না… সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ ।

অনিমিখঃ  সেটাও কি এই বইভাবনার পেছনে কাজ করেছে?

গৌতমঃ হ্যাঁ। যেমন ধরো, এখন এইবয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে যে তোমাদের ক্ষেত্রে  কর্মপদ্ধতি অন্যরকম হওয়া উচিত। আমার নিজের ভাবনা এটা … প্রত্যেকের তো একটা নিজের সময়ের প্রেক্ষিত থাকে… আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের কিন্তু এক ফর্মার বই না করাই ভালো।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ কেন? 

গৌতমঃ এটা এই কারণে যে একফর্মার বই করে তুমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে না। তুমি তো দশজনের  একজন এখন! তোমায় হতে হবে দু-তিনজনের একজন। এই জিনিসটা খুব পরিষ্কার আমি দেখতে পাই ভাস্করদার ক্ষেত্রে। ভাস্করদা যখন ছিলেন আমাদের মধ্যে, ভাস্করদা কুড়িজনের একজন ছিলেন। আজ তিনি সর্বাগ্রে ।

ভাস্করদাকে তখন অনেকেই খুব একটা গুরুত্বও দিত না…  অভিযোগ ছিল যে উনি তো ওই মনখারাপের কবিতাই লেখেন!

অনিমিখঃ  দশজনের একজনটা কি শুধু আমাদের ক্ষেত্রে বলছেন?

গৌতমঃ তোমাদের জেনারেশনের কথা বলছি।  

অনিমিখঃ  সেটা কেন বলছেন?

গৌতমঃ আমি সম্প্রতি শরৎচন্দ্রের ওপর একটা ছোট কাজ করলাম। চিঠি। সবই প্রকাশিত। কিন্তু বিশালসংখ্যক! সেগুলোকে আমি ছোট করে এনে, টীকা দিয়ে… নিজের বোঝার জন্যে… তাতে দেখছি ওর নিজের স্ট্রাগলটা চিঠিপত্র থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। 

ওঁর কথাটা এইজন্য আসছে যে তিনি বার্মায় চাকরি করতেন… সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন… তারপর লিখে দুম করে তার একটা নাম হয়ে গেল! এইবার তিনি দেখলেন যে পুরোটাই একটা হস্টাইল পরিবেশ… কেউ তাকে নিচ্ছেন না… রবীন্দ্রনাথও সদয় নন ! কিন্তু তাঁরও তো বলার একটা বিষয় আছে! তাঁকে এমন একটা ঝাঁকুনি দিতে হবে যাতে তিনি দশজনের একজন না হয়ে একজনের একজন হয়ে উঠতে পারেন। সাম্প্রতিককালে ভাস্করদা এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ভাস্করদার মৃত্যুর সময়ে লেখক হিসেবে তাঁর স্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, তাঁর  তেমন গুরুত্বই ছিল না!  

অনিমিখঃ  গৌতমদা, আমরা যখন লিখতে এসেছিলাম তখন কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তীকে নিয়ে তেমন হৈচৈ কিছু দেখিনি। তেমন কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা চোখে পড়েনি। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর পরে, আমাদের জেনারেশন থেকেই ভাস্কর চক্রবর্তী পড়া এবং ওঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়। তরুণদের কাছে উনি এখন অসম্ভব জনপ্রিয়। কিন্তু সম্প্রতি এরকম একটা মত শুনলাম যে, উনি তো অকালপ্রয়াত হয়েছেন, বেঁচে থাকলে ওঁকে ঠিকই গুরুত্ব দেওয়া হতো। 

গৌতমঃ এই শেষ মন্তব্যটি আমার কাছে পরিষ্কার নয় । ভাস্করদার চলে যাওয়া আমরা কেউই  মেনে নিতে পারিনি, কিন্তু স্বল্পায়ু তিনি নন, মধ্যায়ু বলা যেতে পারে। তুমি যে মতের উল্লেখ করলে তা সুব্রত চক্রবর্তী এবং অনন্য রায়ের ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় প্রযোজ্য। ষাট বছর ব্যাপী কবিজীবন নিয়ে ভাস্করদা আমাদের অনেকের কাছে আইকনপ্রতিম ছিলেন, আজও আছেন। ভাস্করদার লেখা প্রসঙ্গে আজ যদি অভিযোগ ওঠে, যদি বলা  হয়, ওঁর মনখারাপের কথার বাইরে কবিতায় বিশেষ কিছু বলার ছিল না, তা হলে সে-মতকে প্রাথমিক স্তরে গুরুত্ব দিয়েই, তার ভ্যালিডিটি আছে ধরে নিয়েই, এগোতে হবে। ভাস্করদার পাঠক হওয়ার সুবাদে আমার মনে হয়েছে, বাচন ভঙ্গিতে উনি সম্পূর্ণ নতুন একটা কণ্ঠস্বরের প্রচলন করতে পেরেছিলেন, যা আজ, অন্য কণ্ঠস্বর পেরিয়ে এসে তরুণ প্রজন্মকে নাড়া দিতে পারছে । সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, তাঁর লেখার ছায়া অনেক সূক্ষ্ম এখন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ের তরুণ কবিরা কেউ-কেউ তাঁর লেখা টুকে জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন, সৌভাগ্যবশত, সেই প্রবণতা আজকের তরুণদের লেখায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এর পরে উঠতে পারে ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখার মনোলগের প্রসঙ্গ । এটি এক দুরূহ এলাকা যেখানে তাঁর পূর্বগামী লেখকদের সার্থকতা-অর্জন এবং তাঁদের ব্যর্থতা, অনিবার্যভাবে এসে পড়বে। এখানে তাঁর লেখা বিপুল ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হবার প্রবল সম্ভাবনা। আমি যতদূর ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা ধরতে পেরেছি, মনে হয়েছে, সেখানে ফুটে-ওঠা আত্মক্ষয়ী সঙ্কটের স্থানাঙ্কের সঙ্গে তাঁর পূর্বগামীদের বীক্ষার ব্যাপ্তি ও গভীরতার তুলনা করা চলে না । জীবনানন্দের সঙ্গে নয় , বিনয় মজুমদারের সঙ্গে নয় , শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও নয়। ভাস্করদা এঁদের কারুর নিকটবর্তী হতে পারেননি। অধুনা টের পাই, তরুণদের কবিতাপাঠ শুরুই হচ্ছে ভাস্কর চক্রবর্তী থেকে, ঠিক যেমন দশ বছর আগে শুনতাম ওই জায়গাটি ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অধিকারে। এটা বেদনাদায়ক। তবু, মুক্তমনে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমি স্বীকার করি, ভাস্করদা বাংলা লিরিকের পরিধি প্রসারিত  করেছেন, তাঁর উদ্যাগে নতুন প্রেক্ষিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা কবিতায়।   

অনিমিখঃ  এটা কিন্তু বলতেই হবে যে প্রায় কবিতার মতো নয় এরকম জিনিসকে উনি কবিতা করে ফেলেছেন! 

গৌতমঃ হ্যাঁ। সেখানেও কিন্তু সেই পুরনো কথাটা বলতে হবে। ওঁর লেখায় টেকনিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা বোঝা যায়না। যে টেকনিক চোখে পড়ে না সেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ টেকনিক। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ ওঁর শেষ যে বই ‘জিরাফের ভাষা’ – আমার খুব প্রিয়। মনে হয় ওঁর বাকি বইয়ের থেকে এখানে একটা অদ্ভুত জায়গা তৈরি হয়েছে।  

গৌতমঃ অত্যন্ত সুচিন্তিত। জীবনযাপনের বাইরের দিক থেকে ওঁকে দেখে এলোমেলো মনে  হত, কিন্তু উনি অর্গানাইজড লোক ছিলেন। যাদের বাইরে থেকে দেখে মনে হয় এলোমেলো তারা কিন্তু ঠিক উল্টোটা! উৎপলদা! আমাদের মতো ফেক্‌লু ছেলেছোকরার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এমন বলা চলা না। সেই উৎপলদা কি ভয়ানক সুগঠিত!  উৎপলদার ভেতরের ঘরে একটা টেবিল ছিল। রাইটিং টেবিল। সেখানে এককণা ধুলো পাবে না। সমস্ত কিছু সাজানো। বেশি বই নেই। একটা পেরেক পোঁতা। তাতে চারটে রাবার ব্যান্ড ঝোলানো। ভাস্করদাও প্রায় অতটাই অর্গানাইজড লোক ছিলেন। ওঁর ওপরের ঘরটায় গেছ তো, সবকিছু বাঁধানো। ওঁর লেখা দেখলে স্বভাব বোঝা যায়। আমি তো ভাস্করদার সঙ্গে বিরাট আড্ডা ফাড্ডা মারতাম না! আমি অতটা পারিও না। লেখা পড়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সবার যে এই চারিত্রিক গুণ থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।

অনিমিখঃ  শক্তির বোধহয় ছিল না! ভেতরে-বাইরে…

গৌতমঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা এলোমেলো ব্যাপার ছিল ঠিকই, কিন্তু লেখার জায়গাটা অর্গানাইজড ছিল। যিনি অতগুলো চতুর্দশপদী কবিতা লিখেছেন তিনি কি আর এলোমেলো লোক হতে পারেন ? এলোমেলো জীবনযাপনে একটু মার্কেটিং এর ব্যাপারও আছে। সেসব কথা আমি এখন বলতে চাই না। এখন বৃদ্ধ বয়সে আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা  পড়তে শুরু করেছি। কারণ আমার ছোটোবেলায় বিরাট রাগ ছিল ওঁর ওপরে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ শক্তির ওপর? (বিস্ময়)

গৌতমঃ হ্যাঁ। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কেন? 

গৌতমঃ আমার মনে হয় কী জানো, উনি বাংলা কবিতাকে খুব তরল করে দিয়েছেন! বিনয় মজুমদারের সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা মিল আছে তো! আমি নিজেই এই  এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখেছি, বিনয় মজুমদার তুমি যদি মনে মনে পড়ো না… যত মনে মনে পড়বে তত ভালো লাগবে! আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তুমি উচ্চস্বরে পড়ো, তোমার ভালো লাগবে। তুমি মনে মনে পড়ো, অতটা ভালো লাগবে না। এই যে বিরাট নাম করেছে না – এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে – অসাধারণ লিরিক! ওরকম লিরিক কেউ লিখতেই পারবে না, চারজন্ম ঘুরে আসতে হবে! কিন্তু, এই পঙক্তি আমাকে কী দিচ্ছে, একটা শব্দচিত্র ছাড়া? এবং আমি আলঙ্কারিকদের খুব মানি, ওঁরা বলছেন শব্দচিত্র যেখানে অন্য উপাদান সরিয়ে ফেলছে সেটা অধম কবিতা। ‘অধম’ মানে আজকে যে অধম অর্থে বলা হয় সেটা নয়। কিন্তু ন্যূনতম স্তরের। কারণ শুধু চিত্র আঁকাটা কিন্তু আমার কাজ না।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ সে তো চিত্রকর করতে পারবেন! যদিও শক্তি খুব প্রিয়… 

গৌতমঃ হ্যাঁ। চিত্রকর যেরকম পারবেন আমি কি পারবো সেটা? পারবো না! ভাষার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা আমার লেখায় স্থায়িত্ব এনে দেবে।  

অনিমিখঃ  গৌতমদা, আপনার কথাটা আমি স্বীকার করে নিয়েও বলছি… এটা নিয়ে আমি কয়েকবছর ধরেই ভাবছিলাম… যে, কবিতা আমাদের শেষমেশ কী দেয়? আমার তো মাঝে মাঝেই কবিতা পড়তে ইচ্ছে করে না। অবশ্যই আমাদের কোনো কবিকে অনুধাবন করতে গেলে তার সমস্ত কাজ পড়া উচিত… একটা কবিতা পুরোটা নিয়েই কবিতা… সবই ঠিক, কিন্তু শেষমেশ না জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে এক একটা কবিতার লাইন বলে উঠি… কোনো কবিতার এক একটা অংশ আমাদের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়, ছায়া দেয়… সেটাই তো আমার বড়ো পাওয়া বলে মনে হয়। আল্টিমেটলি এটা মনেরই তো একটা এন্টারটেনমেন্ট! এন্টারটেনমেন্ট কথাটাকে সদর্থকভাবে নিচ্ছি। একটা বই আমি যখন পড়ি তখন এন্টারটেইনড হই। কিন্তু আমাদের স্মৃতিশক্তি তো অত ভালো নয় যে আমরা সব কবিতা মনে রাখবো! তাহলে, বিশেষ বিশেষ সময়ে যদি একটা বিশেষ বিশেষ লাইন মনে পড়ে… এর থেকে বড়ো উপযোগিতা আর কী আছে? এটাকেই শক্তির সঙ্গে মিলিয়ে যদি দেখি… 

গৌতমঃ  তোমার বক্তব্য পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয় পঙক্তির  উপযোগিতা আমি কিছুটা স্বীকারও করছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখাকে আমি খারাপ বলছিনা তো ! ওঁর লেখার সঙ্গে এসেনিন-এর লেখার কিছু আশ্চর্য মিল আছে, জীবনও কোনও-কোনও জায়গায় মিলে যায় । কাজের সূত্রে আমায় বহরু গ্রামের রাস্তায়-রাস্তায়, ঘরে-ঘরে, ঘুরতে হত। সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমি বিলক্ষণ চিনি। এই কারণে আমি বৃদ্ধ বয়সে ‘প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই’ পড়তে বসেছি। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ ‘প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই’ খুব চমৎকার… 

গৌতমঃ খুব! ‘ছিন্নবিচ্ছিন্ন’ আমার অসামান্য লাগে… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ অসামান্য… ওই যে টুকরো টুকরো… 

গৌতমঃ হ্যাঁ, চার লাইন চার লাইন… ওরকম লেখাই যায়না!

সঙ্ঘমিত্রাঃ অথচ ওই বইটার কথা কেউ বলেই না!

গৌতমঃ কেউ বলেনা। উনি এত বেশি লিখেছেন যে আমার মনে হয় ওঁর ভালো লেখাগুলো…

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, নজরে আসেনি। ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে’ ওই বইটাও অসামান্য…

গৌতমঃ হ্যাঁ, অসামান্য! ওর প্রথম বইটা ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ ভীষণ ভালো…   

অনিমিখঃ  এই প্রসঙ্গ ধরেই ওই স্মৃতিধার্য লাইনের কথা বলি… যে, অনেক সমালোচকেরা বলেন যে কবিতা কেন শেষ লাইনের মারের দিকে যাবে? শেষ লাইনটা কেন উঁচু হয়ে থাকবে বাকি কবিতার থেকে! উৎপলকুমারের আছে… অনেক কবিতারই শেষটা শেষ বলে মনে হয়না। তো, গোটা কবিতাই কেন নয়, স্মৃতিধার্য লাইন কেন থাকবে – এরকম একটা সমালোচনা আছে। আবার আমরা আলোচনা করার সময় লাইন কোট করে করেই বলি যে এটা আমার ভালো লাগলো। আপনার কবিতায় কিন্তু স্মৃতিধার্য পঙক্তি কম। আপনি সাধারণত কোনো ঘটনা, মিথ ইত্যাদির বর্ণনা দিতে দিতে এগোন, কবিতার শরীরে কোথাও কোথাও হয়তো সেরকম পঙ্কক্তি থাকে। কিন্তু… এটা হয়তো পাঠকেরও একপ্রকার তরলতা যে গৌতম বসুর কবিতা বললেই সেই ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’ এইরকম কিছু পঙক্তিই কিন্তু আমরা কোট করি। 

গৌতমঃ এটা তো আছেই! আমার কাছে এর কোনো স্ট্যান্ডার্ড ব্যাখ্যা নেই। আমি পরিষ্কার করেই বলছি, গোদা পাঠককে এটা যেমন আকর্ষণ করে তেমনই মনোজ্ঞ পাঠককেও। কিন্তু এই যে একটা লাইন অতর্কিতে উঠে দাঁড়াচ্ছে , যেমন ধরা যাক ভাস্করদার ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে  ’ – এইটা ভাস্করদার ফর্মুলা হয়ে গেল তো! যারা গোদা পাঠক তারা এইখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু মনোজ্ঞ পাঠকের কাছে এইটাই একটা ধরতাই হলো। ঐটা ধরেই সে লেখার ভেতরে প্রবেশ করল। যার বয়স কুড়ি বছর, সে তো অজস্র জিনিস পড়ছে! এবার সে আইডেন্টিফাই করবে কী করে এবং কোন পথে সে এগোবে। সে কিন্তু ওই ধরতাইগুলো ধরেই এগোবে! এই প্রক্রিয়ার একটা অন্য বিপদের দিকও আছে । তরুণ পাঠক অনেক ক্ষেত্রে তরুণ  লেখকও, সে ভাবতেই পারে আমি যেমন চিত্তাকর্ষক লাইনের প্রতি টান অনুভব করছি, অন্য পাঠকরাও আমার লেখায় ওই রকম লাইন পড়ে হৈ হৈ করুক। এইবার সে বেচারীও বিনোদনের কাদা মেখে মুখ কালো করে বসে রইল! এটাও তো সম্ভব।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ  অনিমিখের কথার সূত্র ধরেই বলি, কোনো কোনো কবিতার ক্ষেত্রে হয় যে আমরা একটা লাইনেই আটকে গেলাম, আবার খুব কম কবিতার ক্ষেত্রেই হয় যে পুরো কবিতাটা পড়ার পর মনে হয় এর আগে যে আমিটা ছিলাম তার থেকে এক অন্য অনুভূতি নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। আমার জীবন খানিকটা বদলে গেল… এরকম কবিতা তো সবসময় একজন কবির পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। বা এই অবস্থাটাও সবসময় একজন কবির মনে তৈরি হয়না। এই দুটোর মধ্যে কোনো শ্রেষ্ঠত্বের পৃথকীকরণ কি করতে পারেন?

গৌতমঃ আলাদা তো করতেই হয়! কবিতা পড়ার পরে আমার জীবনটা পালটে গেল… এবং  সেটা তো ঘটতে দেখা গেছে… আমার যে উদাহরণটা মনে পড়ছে, তা হচ্ছে উইলফ্রেড আওয়েন… আওয়েন তো কবিতা লিখতেন … তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প আগে ফট করে মরে গেলেন… তখন আওয়েনের সব কাগজপত্র, ডায়েরি সব মায়ের কাছে এল… মা তখন দেখলেন আওয়েনের ডায়েরিতে  রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন টুকে রাখা আছে… সেটা খুব সাধারণ একটা লাইন – ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’ –ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এরকম ঘটনা আছে যে পদাতিক তার ক্যাপ্টেনকে বলছে ‘আমি যুদ্ধ করবো না’ … I refuse to fight … কারণ আমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছি। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের জীবনে এইটা সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার; একজন লেখকের জন্য যখন মানুষের জীবনের লাইন অফ অ্যাকশন পালটে যায়। পালটে যায়, মানুষ লেখা পড়ে একদম পালটে যায়! আমরা কিছু কিছু লেখা পড়ে আগের জায়গাটা ছেড়ে এসেছি। এই জিনিসটা যখন নিজের জীবনে, ওর জীবনে, তোমার জীবনে ঘটেছে তখন তো তাকে সত্য বলে স্বীকার করতেই হচ্ছে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু এটাও তো সত্যি গৌতমদা যে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও সব কবিতা এমনটা নয়। 

গৌতমঃ আমি এইটুকু বলে রাখি লজ্জাসহ যে, আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতাও খুব ভালো লাগে। এখন তো লোকে রবীন্দ্রনাথের গান আর ছবি নিয়ে বলে, নাটক নিয়ে বলে… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ রবীন্দ্রনাথের তো বোধহয় ৫২ টা মতো কাব্যগ্রন্থ আছে…

গৌতমঃ সবক’টা তো আর ওরকম হয়না! তার কারণটা বুঝতে হবে। উনি তো মাটি কাটার কাজ করছিলেন! মাটি কাটার কাজ করছিলেন বলেই কিছুটা রাফ এজ তো থাকবেই! সবচেয়ে বিরল বৈশিষ্ট্য যেটা ওঁর,  সেটা হল উনি একটা ভারী কবিতার পাশে একটা হাল্কা কবিতা রাখতেন। এতে ওঁর কোনো অসুবিধা হত না। আজকে কিন্তু তুমি-আমি এটা করতে পারবো না। আমরা অনেক বেশি সিরিয়াসলি দেখি কবিতাকে।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ চমৎকার!  

গৌতমঃ তাই না? উনি হিংটিং ছট লিখেছেন, তার পাশেই খুব গম্ভীর একটা লেখা। কী মনোবল !

অনিমিখঃ  তার কারণ হচ্ছে উনি আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পেতেন না আর কী… (হাসি)

গৌতমঃ কিছুই দেখতে পেতেন না। একদম possessed একজন লোক ছিলেন!

অনিমিখঃ  গৌতমদা, এই কবিতাটা আমার সম্প্রতিই চোখে পড়েছে। পড়ার পর আমিও একটু অন্যরকম হয়ে গেছি আর কী! পড়ে শোনাচ্ছি, ‘স্বর্ণগরুঢ়চূড়া’ থেকেঃ

‘এমন একটা ভরা সংসার এখানে ছিল

তাকে বিদায় জানাতে গিয়ে, দেখি বহুদূর থেকে 

নিজেরই পানে হাত নাড়ছি, কামনা করছি যাত্রা শুভ হোক।’ 

খুব স্মৃতিধার্য পঙক্তির মতো কিছু নেই কিন্তু এখানে! কিন্তু চিন্তাটা ভীষণ নাড়া দিল, যে সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি আর হাত নাড়ছি বটে, নাড়ছি তো নিজেরই উদ্দেশ্যে আসলে! 

গৌতমঃ এটা তো আমি দেখি! তুমিও দেখেছো, আমিও দেখি। 

অনিমিখঃ  সেটা এত সহজভাবে বললেন! অতিরিক্ত শব্দব্যবহার রইল না, দৃশ্যটাই শুধু বললেন… এটা কি কম আয়োজনে বেশি সূচীভেদ্য করবার একটা ব্যাপার?

গৌতমঃ তুমি নিজে লেখো, তুমি এগুলো ভালো বুঝতে পারবে। এগুলো ভেবে হয়না। কিন্তু লেখা হয়ে যাওয়ার পরে মনে হয় যে এখানে হয়তো কিছু সূত্র রইল যা আমি পরে কখনও ব্যবহার করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো আর পরে ব্যবহার করা হয়না। এগুলো ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড এর মতো।  

অনিমিখঃ  এটা থেকে আরও প্রশ্ন জাগছে মনে। আপনি বাড়িতে ঢুকবার সময় যে জীবনের গল্প বলছিলেন আপনার পূর্বপুরুষদের… আপনার প্রচুর কবিতায় যাওয়ার কথা আছে… মানে, চলে যাওয়ার কথা, ছেড়ে যাওয়ার কথা… জার্নির কথা আছে… এইটা কীভাবে এলো?

গৌতমঃ এটাও তুমি বললে বলে আমার খেয়াল হলো, আমি নিজে অতটা খেয়াল করিনি। এই যে অভিযাত্রার যে ব্যাপারটা…

অনিমিখঃ  এক্সোডাস.. .

গৌতমঃ এক্সোডাস… এইটা মানব সভ্যতার একটা বিরাট স্তম্ভ ! আমার মনে হয় মানুষের সঙ্গে পশুর তফাতটা ওইখানেই… পশু কথাটা আমি কদর্থে বলছিনা… আমরা যাকে নিম্নপ্রাণিজগত বলি… মানুষের সঙ্গে তার তফাতটা হচ্ছে ভয়হীনতায়। ধরো তুমি একটা বেড়াল দেখলে, বেড়ালটাকে তুমি কোনোভাবেই  আক্রমণ করছো না! কিন্তু সে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সে ভাবছে এবার আমাকে আক্রমণ করা হবে, আমি পালাই কোথাও। মানুষ এটা করে না। মানুষ একটা সম্মানজনক বিকল্প খুঁজে বার করে।  

আমার মনে হয় ভয়হীনতার এই স্পর্ধা মানুষের বরাবর ছিল। নাহলে, অনেক আগেই সব শেষ হয়ে যেত। ভয় তো পেয়েইছি , ভয়ই আমাকে সাহসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ! আমার একটা প্রিয় চিন্তা হচ্ছে, প্রথম যখন বাজ পড়েছিল… তখন কী হয়েছিল! আমার মনে হয় গোটা বসতি ভয়ে মরে গেছিল, এটা কী হচ্ছে! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, ওই অভিজ্ঞতা তো আগে পায়নি! (বিস্মিত)

গৌতমঃ ভাবাই যায়না! আমার ছোটোবেলাতেই এই অভিজ্ঞতা আছে! একটা দৃশ্য মনে পড়ে, মা’কে আমি জড়িয়ে ধরে আছি… আর একটা তালগাছকে দেখছি এদিক থেকে ওদিক দুলছে (হাত দিয়ে দেখিয়ে)… শব্দ মনে নেই, দৃশ্যটা মনে আছে… সে ভয়ানক ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এরকম ঘটেছে! তো, সেইটাকে মানুষ পেরিয়ে গেছে। দুষ্টু লোকেরা  খুব খারাপভাবে পৃথিবীকে শাসন করেছে, এখনও করছে, কিন্তু মানুষকে বশে আনতে পারেনি, কারণ মানুষ ভয় পায়নি। 

তুষারযুগে মানুষ মহাদেশের পর মহাদেশ হেঁটে গেছে! হয়তো চার জেনারেশন লেগেছে, কিন্তু গেছে তো! সমাপ্তির বাজনা সবসময়ই বাজে, সেটাকে পেরিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা মানুষের মধ্যে সবসময়েই আছে।  

দ্যাখো, খুব সাধারণভাবে আমরা আর কী করতে পারি? বড়োজোর কিছু বাংলা কবিতা লেখার চেষ্টা করে চলেছি।এখানেও তো পাহাড়পর্বত, নদনদীর বাধা, তবুও আমরা তো কিছু একটা করার চেষ্টা করছি! আমরা তো ডিফিটেড নই বাই রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ! না হলে, সত্যিই তো তোমার আমার লেখার কোনো মানে হয়? এঁরা যা লিখে গেছেন তার ধারেকাছে তো আমরা কোনোদিনই যেতে পারবো না!  তবুও তো চেষ্টা করছি!

অনিমিখঃ  টু ক্যারি দ্য ব্যাটন ফরওয়ার্ড…

গৌতমঃ হ্যাঁ, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নইলে এখানে বসে কীই বা করলাম!  

অনিমিখঃ  গৌতমদা, তাহলে এক্সোডাসের চিন্তা থেকেই এই এলিমেন্টগুলো এসেছে?

গৌতমঃ হ্যাঁ, আমার মনে হয় মানুষের জীবনে এক্সোডাসের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। আমরা তো এদেশি ঘটি, ফলে, দেশভাগের যন্ত্রণার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিজের জীবনে নেই…

অনিমিখঃ  আপনার জন্ম তো কলকাতাতেই? 

গৌতমঃ আমার জন্ম বাবার চাকরিসূত্রে দার্জিলিঙে, কিন্তু আমি ছোটো থেকেই কলকাতায়…

অনিমিখঃ  মেদিনীপুরের কোনো স্মৃতি আপনার নেই? (গৌতম বসুর পূর্বপুরুষের নিবাস মেদিনীপুরের পিংলায়) 

গৌতমঃ না। 

অনিমিখঃ  মেদিনীপুরের বাড়িতে গেছেন?

গৌতমঃ হ্যাঁ, বাবা জ্যাঠাদের সঙ্গে যেতাম দেশের বাড়িতে। তবে সেটা কেরাণীটোলায়। (মেদিনীপুর টাউন) পিংলাতেও গেছি। ছবিও আছে সে বাড়ির, সব ভেঙে টেঙে পড়ছে। 

আমার ভয়ের স্মৃতি হচ্ছে , ৪৭-পরবর্তী শেষ উদ্বাস্তুদের ঢেউ আমি দেখেছিলাম। শেয়ালদা স্টেশনের পাশ দিয়ে আসতে হতো। এখন যেখানে ফুলগাছের দোকানের সারি আছে…

সঙ্ঘমিত্রাঃ সেটা কত সাল?

গৌতমঃ এটা হচ্ছে ৫৯। 

অনিমিখঃ  তখন তো আপনি অনেক ছোটো!

গৌতমঃ সাংঘাতিক মনে থাকে গো, ওগুলো! কারণ তার আগে আমি তো ওরকম দেখিনি কখনো! আমরা  যেখানে থাকতাম সেখানে ভিজিয়ানাগ্রামের নবাবের এক পোড়ো রাজপ্রাসাদ ছিল। বেলেঘাটার ওই অঞ্চলটায় তখন হায়দ্রাবাদী একটা ব্যাপার ছিল। এখন সব চলে টলে গেছে।  আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল পুঁটু। তা, পুঁটু আর আমি একসঙ্গে খুব খেলতাম। পুঁটু আমার বাড়িতে ঢুকতো না, ওর বাড়িতেও আমাকে নিয়ে যেতে চাইত না। একদিন বৃষ্টি টৃষ্টি পড়েছে, আমি পুঁটুর বাড়িতে পৌঁছে গেছি। ওরা যেখানে থাকে সেটা হচ্ছে একটা বিরাট রাজবাড়ির দালান, তার একটা দিক ভেঙে গেছে। হু হু করে জল পড়ছে আর পুঁটুর পরিবার ওখানে বসে আছে। পুঁটু আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিল। কারণ ওই ছোট বয়সেও ও কিন্তু ক্লাস ডিফারেন্স বুঝে গেছে। পুঁটু আমাকে সরিয়ে দিল, কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই  আমি সম্যক বুঝে নিলাম, কিছু মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে ! ওই অভিজ্ঞতা যে কী প্রভাব ফেলেছিল আমার ওপরে , তা আমি প্রকাশ করতে পারবো না! 

আর একটা সূত্র হচ্ছে আমার মায়ের কাছে শোনা পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিবরণ। এই দুটো মিলে, শৈশবেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম বঞ্চনা, হিউম্যান মিজারি কী জিনিস!  এরপর এলো ভিয়েতনাম। ততদিনে আমি কৈশোরে পৌঁছে গেছি । এখন , এই তিনটে অভিজ্ঞতা আমি আর আলাদা করতে পারিনা। আমার একটা প্রশ্ন আছে, শেয়ালদায় ফুলের নার্সারিগুলো এখন যাঁরা চালান তারা তো কেউ পূর্ববঙ্গের মানুষ নন । যেমন, বেরা। বেরা তো মেদিনীপুরের লোক! তবে আমার ছোটবেলায় দেখা ফুটপাথের পরিবারের সেই সদস্যরা গেলেন কোথায় ?

অনিমিখঃ  গৌতমদা, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনা যখন হল, তারপরেই তো আপনার ‘নয়নপথগামী’ বেরলো! সেখানে ‘১৪ই মার্চ’ বলে একটা কবিতা আছে, আমি পাতিরামে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, এখনো মনে আছে – ‘বুকে গেঁথে দাও তমলুক, ছেঁড়া পতাকা’…

গৌতমঃ আমি ওরকম প্রথানুগ ছন্দে লিখিনা তো! ওটা এসে গেছিল আর কী! ওই ধরনের ঘটনাগুলোতে আমি আসলে অন্যভাবে রিয়াক্ট করি… আমি বরাবর ফোল্ডার করে আসি। এটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজ থেকে শেখা । নন্দীগ্রামের পরে ফোল্ডার করেছিলাম, নাম ছিল ‘রক্তগঙ্গা’। তারপরে আমাকে বিরাট ধাক্কা দিল কেদার-বদ্রীর ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগ…  যা আসলে মানুষেরই তৈরি! মনে আছে ঠিক ১৮ ঘন্টায় ফোল্ডারটা তৈরি করে ছাপতে দিয়ে দিয়েছিলাম। আবার একটা ফোল্ডার তৈরি হচ্ছে ,এবার আর একা নই, তিনজনে মিলে করছি। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা… সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু বছর ধরেই আমরা যে জিনিসটা দেখছি, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন শিল্পীর দুটো কাজ থাকে। এক, সেটাতে আক্রান্ত হয়েই লেখা। দুই, বড়জোর তিনি রাস্তায় নামতে পারেন। তাতেও যে খুব কিছু হবে তাও নয়…

গৌতমঃ তার  অপরাধবোধ খানিকটা ইয়ে হয় যে আমি কিছু একটা করলাম।   

সঙ্ঘমিত্রাঃ এটা তো খুব বড় অসহায়তা! মানে, এত কিছু হচ্ছে…

গৌতমঃ অসহায়তা, কিন্তু আমার কাছে একই সঙ্গে শিক্ষা। যেটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সাম্প্রতিক ঘটনায়… দ্যাখো, তোমার আমার মধ্যে তো নানারকম বিভেদ ছিল! তুমি যেভাবে ভাবো, আমি সেভাবে ভাবি না… এবং ক্রিয়েটিভ লোকেদের মধ্যে তো ভীষণভাবে আছে জিনিসটা… ঝগড়াঝাঁটিটা বেশি তারাই করে… কিন্তু এই ঘটনাটা সক্কলকে এক করে দিয়েছে। 

অনিমিখঃ  শিকড় ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে…

গৌতমঃ হ্যাঁ, এবং মেয়েদের আর ছাত্রদের যে কী power! সেদিনই দেখলাম বেলগাছিয়ার দিকে… মাঝবয়সী অল্পবয়সী সব মেয়েরা রাস্তায় নেমে গেছে! যতই বলি কিছু হবে না… কিন্তু গণআন্দোলনের ভূমিকা কোনোদিন হারাবার নয়। তুমি একা চেঁচাও, কেউ শুনবে না। কিন্তু দশটা লোক চেঁচালে তার ইম্প্যাক্টটাই অন্যরকম হয়ে যাবে।  

অনিমিখঃ  গৌতমদা, ওর প্রশ্নের ভেতরে একটা প্রশ্ন ছিল। যে, এখন এই কবিতা লেখা, বইমেলা, বই বেরনো ইত্যাদি ব্যাপারগুলো খুব ছোট মনে হচ্ছে। খুব মুষড়ে রয়েছি। মানে, যেখানে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হতে পারে, সেখানে এসবের কী মূল্য আছে? কিন্তু আবার এটাও তো ঠিক, আমাদের কাজগুলো তো করেও যেতে হবে! সময়টা তো চলেই যাচ্ছে…

গৌতমঃ আমার কী মনে হয় জানো তো, এই কাজগুলোকে ছোট মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, তোমার রেজিস্ট্যান্স কিন্তু সর্বত্রই আছে! তুমি যে জিনিসটা মেনে নিচ্ছ না… এটা যে আমাদের দেশের মানুষের জন্য অকল্যাণ বহন করে নিয়ে আসছে, সেটা তুমি তোমার মতো করে বলছো।  

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, আমরা পরপর দুটো পথসভা করলাম… সেখানে আমরা কবিতা পড়লাম, গান গাইলাম, কেউ নাটক করলো… সেটা তো রেজিস্ট্যান্স এরই একটা অংশ। কিন্তু আমি আত্মজৈবনিক কবিতা লিখেছি, সেই কবিতা নিয়ে আমার একটা সংকলন প্রকাশ পাচ্ছে – এই জিনিসটাকে আমার অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। এইটা কি আমি ঠিক ভাবছি?

গৌতমঃ নিজের  সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে তোমার বই প্রকাশ করার দায়কে শৌখিন ও  অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। তুমি একটা বড়ো জায়গার কথা ভাবছো বলেই তোমার ক্ষুদ্র প্রেম বিরহের প্রসঙ্গ অতটা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না…

অনিমিখঃ  সঙ্ঘমিত্রা একটা গদ্যলেখা লিখছিল… সেখানে ও বলছিল যে শুধু সচেতনতামূলক লেখালিখিই নয়, আমাদের স্বাভাবিক যে ক্রিয়াকর্ম… যেরকম কবিতা গান নিয়ে আমরা বাঁচি, সেটাকেও সমানভাবে চালিয়ে যাওয়ার দরকার আছে। শিল্পের পক্ষে আছি – সেটাও কোনো না কোনোভাবে…

গৌতমঃ সেটাও রেজিস্ট্যান্স! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ মানে, শাসক যখন চাইছে যে আমাদের যাবতীয় নরম অনুভূতিগুলো হারিয়ে যাক যাতে তাদের কাজে লাগাতে সুবিধে হয়… তখন যদি আমি ভালোভাবে বাঁচতে পারি, সেটাও তো একধরণের রেজিস্ট্যান্স! 

গৌতমঃ সেটাই… এই যে বার্তা ঘুরছে সর্বত্র, আমার মতো কথা না বললেই তুমি ভারতমাতার বিরুদ্ধে কথা বলছো… তোমার প্রত্যেকটা অ্যাকশনের মধ্যেই তার বিরোধিতা থাকছে। তুমি যখন বাজার করতে যাচ্ছো, তখনও থাকছে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, একটা প্রশ্ন মাথায় এলো। আপনার সতীর্থদের পাশে তো আপনার বইয়ের সংখ্যা তো কম!

গৌতমঃ না, যারা লেখা ছেড়ে দিয়েছে তাদের থেকে বেশি! (সমবেত হাসি)

সঙ্ঘমিত্রাঃ না, ধরুন, সত্তরের কবিদের পাশে আপনার বইয়ের সংখ্যা তো কম! একজন কবির  এব্যাপারে একটা ভয় কিংবা একটা সচেতনতা থাকেই! ভূমিকা পড়তে গিয়ে আমি খেয়াল করেছিলাম যে, আপনি বলেছেন, নানারকম চিন্তাভাবনার সঙ্গে ছিল রণকৌশল নীতি… এটা কি কোনো রণকৌশল নীতিরই অংশ? 

গৌতমঃ তোমাদের যেমন একটা যুদ্ধং দেহি মনোভাব আছে, আমারও ছিল! এটা যৌবনেরই ধর্ম। দেখে নেবো! তারপর আস্তে আস্তে ওটা কেটে যায়। সেই কেটে যাওয়াটা আমার মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমার যুদ্ধ কারুর বিরুদ্ধে নয় কিন্তু! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ না… আমি বলতে চাইছি, কমসংখ্যক বই করাটা কি কোনও রণকৌশল?  

গৌতমঃ এটা আমি খেয়াল করিনি! রণকৌশল যদি নাও বলি, কৌশল তো বটেই! সারাজীবন ধরে তুমি যা লিখছ, তুমি জানো যে তার অনেকটাই অনুশীলনের স্তরে রয়ে গেছে, অনেকটা অনুশীলন থেকে একটু বেরিয়ে এসেছে, অনেকটা তোমার যা করার ছিল তুমি তা করেছ। এরকম অনেক ক্যাটেগরি করা যেতে পারে, কিন্তু মোটামুটি এই দাঁড়াচ্ছে যে তোমার মনে হচ্ছে যে তুমি একটা কিছু করতে পেরেছ। এবার তুমি যদি স-ব-কি-ছু রাখো না… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ তাহলে তো পাঠকেরও খুব সমস্যা…   

গৌতমঃ হ্যাঁ, সমস্যা এই কারণে যে আজকে আমার ৩৫ বছর বয়স… আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না যে আমার ৬০ বছর বয়সে চল্লিশটা বই হয়ে যাবে! চল্লিশটা বই হয়ে গেলে আমি আমার নিজের লেখাই খুঁজে পাবো না! যারা কম ছাপিয়েছেন, তাদের আমি অনেক পরিষ্কার করে দেখতে পাই। আমি  সমালোচকদের বক্তব্য মানি না, কিন্তু অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারি যে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েন না, ঠিক এই কারণেই। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ এটা বড় একটা বাধা। রবীন্দ্রনাথেও রিপিটিশন আছে!

অনিমিখঃ  এইখানে শ্রেষ্ঠ কবিতার একটা ভূমিকা আছে।

গৌতমঃ শ্রেষ্ঠ যদি নাও ভাবি, কোনো কোনো বই কিন্তু ছাপ রেখে যায়! সেইটা যদি না থাকে কোনো কবিকে কিন্তু চেনা যায়না। মানে, সব বইতে একটু একটু করে ভালো লেখা থাকলে  পাঠক হয়ে কবিকে তোমার ধরতে অসুবিধা হবে। তখন হয়তো ওরকম একটা সংকলনের দরকার হবে।

অনিমিখঃ  তার মানে কি কোনো কোনো বই খারাপ হওয়া দরকার, যাতে তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়? (মজা)

গৌতমঃ না। একেকজনের কর্মপদ্ধতি একেকরকম হয়।  

অনিমিখঃ  আপনার ধরুন কুড়ি শতাংশ ছাপা হয়েছে?

গৌতমঃ না অত কম নয়। ৪৫-৫০ শতাংশ হবে হয়তো । এখনও ১০ র মধ্যে ৪ টে লেখার গলা কাটা পড়ে ।

অনিমিখঃ  বাটানগরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল। এখন তো আমাদের বই করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে, তার মধ্যে আমিও আছি হয়তো। তাহলে কি একটু সংবরণ করা উচিত?

গৌতমঃ উচিত আমি বলবো না। নিজের ভেতর থেকেই একটা সঙ্কেত আসবে। আমি এইটা রেখে দি এখন। সঙ্কেত আসেই, সে-সঙ্কেত আমরা শুনতে চাই না বলে শুনতে পাইও না।

অনিমিখঃ  মানে, যা লিখছি তা-ই বই করে ফেলবো না…

গৌতমঃ হ্যাঁ। এখন কী হচ্ছে… আমরা পিয়ার প্রেশারে কাজ করছি। ও বের করছে, তো আমিও বের করে দিচ্ছি! আগে এই পিয়ার প্রেশারটা কাজ করতো পত্রিকার ব্যাপারে। আজ  থেকে ২৫-৩০ বছর আগে আমি শুনেছি, বহু জন গর্ববোধ করতো যে প্রত্যেকটা পত্রিকায় তার লেখা আছে! Visibility ব্যাপারটার একেকটা বাহন হয়, এখন সেটা বই। এখন এই আশঙ্কাটা জন্মাচ্ছে যে, আমি যদি নিয়মিত বই সরবরাহ না করে যেতে পারি তাহলে আমার কাজ কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু, তোমার কাজ কেউ না কেউ দেখছেই। 

অনিমিখঃ  মানে, চাপা পড়ে যাবার আশঙ্কাটা না করাই ভালো…

গৌতমঃ হ্যাঁ। এটা নির্ভর করে লেখার ওপরে, বইয়ের ওপরে নয়। তুমি যদি শুধু পত্রিকাতেও লেখো তাহলেও হবে। এমনকি না ছাপালেও চলবে। 

অনিমিখঃ  এটা কি মানুষের মনোযোগের স্প্যানটা কমে গেছে বলে হচ্ছে? মানে, আপনাদের সময়ে টিভি এসেছিল, এই প্রথম একটা চলমান মাধ্যম। যেখানে ছবিগুলো স্থির থাকছে না, চলে যাচ্ছে। আর এখন তো অনেককিছু এসে গেছে যাতে খুব দ্রুত স্ক্রল করে যাওয়া যায়। আমাদের মনোযোগ খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। বই পড়ার অভ্যেস কমেছে মানুষের। সেই একই কারণে কি দ্রুত সব কিছু করে ফেলবারও মানসিকতা দেখা যাচ্ছে?

গৌতমঃ ছটফটে একটা ভাব এসেছে। কিন্তু, এইটা আমি কখনও মানি না যে, এখন যেগুলো খারাপ, সেগুলো আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ছিল না। তখনও ছিল। দীপ্তেন সান্যাল বলে একজন খুব বদ লোক ছিলেন। তিনি কারো ভালো দেখতে পারতেন না। সারাক্ষণ তার কাজ ছিল সবাইকে গালাগাল দেওয়া। সেই দীপ্তেন সান্যালের একটা সম্পাদকীয় একটা কাগজ উদ্ধার করেছিল, বেশ কয়েক বছর আগে । আমার মনে হয়েছিল কালকের কথা লিখছে! উনি একই কথা বলছেন, এত হড়বড় কীসের রে বাবা! অতএব … সেটা পঞ্চাশের দশক ছিল… তখনও কেউ না কেউ সেটা বুঝেছে… আজ থেকে পনের বছর আগেও কেউ না কেউ সেটা আবার ছেপেছে আর আজকেও তুমি আমি কথাটা বলছি , আমি দুর্মুখ দীপ্তেন সান্যালের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি । তার মানে, এই সমস্যাটা কিন্তু বরাবরের সমস্যা! সময় নিজেই সব বুঝে নেয়! আস্তে আস্তে লেখা ঝরে পড়ে। বিচলিত হবার কিছু নেই। কিন্তু সচেতন থাকতে হবে , আমি যেন ট্র্যাপে না পড়ি।   

অনিমিখঃ  একদম এই সময়ের বাংলা কবিতায়, মানে, আমাদেরও পরে যারা লিখছে… কাব্যভাষায় কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়?

গৌতমঃ এইটা তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে কিনা জানি না… কোথাও তরুণদের লেখা পাঠটাঠ হলে আমি শুনতে চলে যাই… বুঝতে চাই কীরকম লেখা হচ্ছে… তা, একটা জিনিস হয়েছে বলে আমার মনে হয় যে, কবিতা লেখার অপশানগুলো কমে গেছে। মানে, রাস্তাটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এতজন এত কিছু লিখে ফেলেছে তো…

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আচ্ছা, মানে, এক্সপ্লোর করার জায়গাটা কমে যাচ্ছে…

গৌতমঃ হ্যাঁ, এক্সপ্লোর করার রাস্তাটা ছোট হয়ে আসছে। যে কারণে তোমার মনে হচ্ছে কাব্যভাষা পাল্টাচ্ছে না। আসলে, এখন খু-উ-ব কম লোকে হাঁটছে!

অনিমিখঃ  কিন্তু গৌতমদা, কবিতার ইতিহাস তো আজকের নয়! হাজার বছরের ইতিহাস তার পেছনে আছে! রাস্তা তো বরাবর সরু হতে হতেই এসেছে?

গৌতমঃ না, সরু হতে হতে আসেনি! সরু হতে শুরু করেছে রবীন্দ্রনাথ থেকে। তার আগে  কিন্তু সম্ভাবনা সীমাহীন ছিল এবং রবীন্দ্রনাথ সে-অবস্থার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছেন । উনিই প্রথম একটা বাউন্ডারি টেনে দিলেন। মধুসূদনও সেইভাবে না। কারণ মধুসূদন নিজেই একটা পর্বতচূড়ায় কোনওরকমে দাঁড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো উনি ন্যারেটিভ কবিতা, ছোট ভার্স, দীর্ঘ কবিতা – এতকিছু তো করেননি! তারপরে আবার দুম করে সব ভেঙে দিয়েছেন জীবনানন্দ। তাতে আবার সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে! এইজন্যই বলছি, ব্রেক থ্রু’র সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। আমার হিসেবে আগামী কুড়ি-পঁচিশ বছরে একটা ব্রেক-থ্রু আসবে। এই ব্রেক-থ্রুটা যতদিন না হচ্ছে, ততদিন তোমার মনে হতে থাকবে যে , ভাষাটা রিপিটেড হচ্ছে, কাব্যভাষা সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে… আসলে বংলা কবিতা একটা বিস্ফোরণের জন্য জিনিসটা ওয়েট অপেক্ষা করছে। 

অনিমিখঃ  বাহ্‌! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনি বলছেন যে পঁচিশ-তিরিশ বছরে একটা করে ব্রেক-থ্রু আসে?

গৌতমঃ না। নট নেসেসারিলি!

অনিমিখঃ  উনি বলছেন যে আগামী ২৫-৩০ বছরে আসতে চলেছে। 

গৌতমঃ হ্যাঁ। তবে, তা না-ও হতে পারে। আমার সম্পূর্ণ ভুলও হতে পারে!  

সঙ্ঘমিত্রাঃ তাহলে বাংলাভাষার শেষতম ব্রেক-থ্রু কি জীবনানন্দই?   

গৌতমঃ বিরাট কঠিন প্রশ্ন! না, ওইধরণের লণ্ডভণ্ড পরে আর হয়নি, তবে ছোটখাটো বোমা-টোমা ফেটেছে বেশ কয়েকবার! 

অনিমিখঃ  আপনি নাম করবেন না নিশ্চয়ই?

গৌতমঃ না, নাম করতেও অসুবিধে নেই! 

অনিমিখঃ  উৎপলকুমার কি চিন্তার দিক থেকে ব্রেক-থ্রু?

গৌতমঃ উৎপলকুমার সব দিক থেকে ব্রেক-থ্রু!  

অনিমিখঃ  কিন্তু ভাষার দিক থেকে তো খানিকটা জীবনানন্দীয় … 

গৌতমঃ মনে হয়? আমার কিন্তু মনে হয় যে জীবনানন্দীয় ভাষার ব্যবহার বেশি করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার।

উৎপলদা আমায় চুপিচুপি বলতেন, তুমি ‘শকুন’ কবিতাটা লক্ষ করেছ? আমি বললাম, কেন বলুন তো? উনি বললেন, ওইটা দেখে, না, লেখা শিখেছিলাম। আমি বললাম, খুবই ভালো লেখা, কিন্তু কী এমন আছে লেখাটার মধ্যে? বললেন, ওইখানে বলা আছে কোথায় থামতে হয়! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ কী শিক্ষা! 

গৌতমঃ সাঙ্ঘাতিক! ওইটুকু বলেই ছেড়ে দেবেন কিন্তু! … উৎপলদা অসংখ্য উৎস নিয়ে কাজ  করেছেন। তাঁকে ধরে ফেলা মুস্কিল কাজ ।

আমার মনে হয় দেবদাসদা (আচার্য) একটা ব্রেক-থ্রু ,  শম্ভুদা (রক্ষিত) একটা ব্রেক-থ্রু। পার্থদা (পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল) একটা ব্রেক-থ্রু। মানে, বই হিসেবে। জয় একটা ব্রেক-থ্রু। 

অনিমিখঃ  সেটা কি সামগ্রিক?

গৌতমঃ বই হিসেবে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  কোন বই?

গৌতমঃ একাধিক বই। উন্মাদের পাঠক্রম। প্রত্নজীব। ওর প্রথম বইটাও খুব ভালো লাগে – ক্রিসমাস…  

কিন্তু এগুলো সবই পেটো বোমা আর কী… জীবনানন্দের মতো আণবিক বোমা নয়। তবে, বাংলাভাষা এক দিন শম্ভুদাকে আবিষ্কার করবেই। শম্ভুদা একটা জিনিয়াস, অথবা আবেগ সংবরণ করে বলা যেতে পারে শম্ভুদা জিনিয়াস-লক্ষণাক্রান্ত !

অনিমিখঃ  শম্ভুদার সঙ্গে একটা কথোপকথন করতে চাইছিলাম। কিন্তু উনি তো কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই।  

(এরপর মধ্যাহ্নভোজের সামান্য বিরতি ও সত্তর দশকের কবিতা নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কথাবার্তা হয়।) 

অনিমিখঃ  গৌতমদা, তাহলে আপনার সঙ্গে সত্তরের কবিদের কারো সেই দশকেই বন্ধুতা ছিল না? পরে গড়ে উঠেছে?

গৌতমঃ হ্যাঁ। আমি তো কাউকেই চিনতাম না! বইটা বেরোবার পর সকলের সঙ্গে একে একে পরিচয় হলো। 

অনিমিখঃ  পঞ্চাশে যেমন শক্তিকে বা সুনীলকে নিয়ে হয়েছে মিথ তৈরি হয়েছে, সত্তরেরও অনেক মিথ ছিল… যেমন, জয় গোস্বামীকে আবিষ্কার করা… তারপর শ্যামলকান্তি দাশের সুতাহাটা থেকে চিঠি লেখা… এরকম আমরা শুনে এসেছি… আপনারা সত্তরের যারা কবি তারা পরস্পরকে চিনছেন… তখন বোধহয় চিঠিই মাধ্যম ছিল… সেইরকমই আপনার সঙ্গে এঁদের পরিচয় কীভাবে হল?

গৌতমঃ ‘শতভিষা’র সূত্রে একমাত্র কালীদার সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল । বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধেয় লেখককে ডাকে বই পাঠিয়েছিলাম।  উৎপলদা আমায় দেখা করতে বললেন। আমি এতো বড় ইডিয়ট, বললাম, আমি তো আপনাকে চিনিনা… রবীন্দ্রসদনে আমি দাঁড়াবো, আপনি চলে আসবেন। উৎপলকুমার বসুকে কীভাবে কথাটা বলেছিলাম…!! (সলজ্জ) 

অনিমিখঃ  হা হা! তরুণ কবির স্পর্ধা!

গৌতমঃ ইশ্‌শ্‌! আমি গেলাম চিত্রবাণীতে। বিলেত থেকে ফেরার পর তখন উনি ওখানে কাজ করতেন গম্ভীর মুখে কয়েকটি প্রাথমিক প্রশ্ন করলেন, তারপর আপিস থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি হাঁকলেন । বললেন, চলুন আমার সঙ্গে , কফি হাউসে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। কারণ, অনেকে ভাবছে আপনার কবিতাগুলো নাকি আমিই লিখে দিয়েছি! এটা অবশ্য উনি গম্ভীর মুখে মজা করেই বলেছিলেন! প্রথম দিকে ‘আপনি’ করেই কথা বলতেন।  ধক্‌ ধক্‌ করে জ্বলতে থাকা চোখ দুটোর সামনে বসে থাকা বেশ কঠিন কাজ ছিল আমার পক্ষে ।   

অনিমিখঃ  আপনি বলছিলেন যে, পঞ্চাশের পর আবার সত্তরে আবার যে একঝাঁক কবি লিখতে এলেন… এটা অনেকটাই মিথ যতটা না বাস্তব!

গৌতমঃ মিথ যদি না হয়ও, সম্ভাবনা কিন্তু অনেক ছিল। সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা আমার মনে হয় না। যেভাবে তাঁরা শুরু করেছিলেন এবং তাঁদের যা পোটেনশিয়াল ছিল , সেই অনুযায়ী কবিতা তত কিছু  এগিয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।  

অনিমিখঃ  কোথায় অসুবিধেটা হল?

গৌতমঃ আইডিয়াজ। ল্যাক অফ আইডিয়াজ। আত্মতৃপ্তি  প্রভৃতি । কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আরও বেশি কিছু লাগে, নিজেদের যাচাই করার দরকার পড়ে । আমাদের যা ছিল, তা দিয়ে পনেরো-কুড়ি চলতে পারে । তিরিশ চল্লিশ বছর চলার রসদ আমাদের ছিল না 

অনিমিখঃ  যেটা বলছিলেন যে পড়াশোনার ক্ষেত্রটা বিস্তৃত করলে…

গৌতমঃ শুধু পড়াশোনা নয়, কেউ যদি পাহাড়পর্বত, দেশ ঘোরে… মানুষের সঙ্গে মেশে… সেটাও তো পড়াশোনা! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ একদম। প্রতিটাই এক একটা টেক্সট!  

গৌতমঃ হ্যাঁ। সেইটা নেই। আমরা বড্ড বেশি পরষ্পরের সঙ্গে আড্ডা মেরেছি। অতি-উন্নত একটা ভাষায় আমরা যে কাজ করতে এসেছি, সেটা কি আমরা সম্যক উপলব্ধি করেছিলাম ? সংগঠন এবং প্রতি-সংগঠনে আমরা শক্তিক্ষয় করেছি। নির্মল লিখেছিলেন ‘আমাদের সোনা নাই রূপা নাই, / চলো চলো ফুল ফোটাতে যাই’ , সেই জায়গাটা আমরা ধরে রাখতে পারলাম কই ?      

সঙ্ঘমিত্রাঃ নিজের সঙ্গে, নিজের মধ্যে থাকাটা কম হয়েছে – তাই কি?

অনিমিখঃ  তারপর বোধহয় কলকাতাকেন্দ্রিকতা… চাকরি-বাকরি…

গৌতমঃ কলকাতাকেন্দ্রিকতা সাংঘাতিক ক্ষতি করেছে বাংলা কবিতার!

অনিমিখঃ  অথচ সবাই এঁরা গ্রাম থেকেই এসেছিলেন!

গৌতমঃ বেশিরভাগই। ওই যে কলকাতাকে সেন্টার মনে করা হয়েছে! আমি তো দেখছি একমাত্র দেবদাসদা’ই পুরো ব্যাপারটার বাইরে থাকতে পারলেন সারাজীবন। নির্মলও কিছুটা। যদিও নির্মলের কিন্তু কলকাতার কনট্যাক্টগুলো বরাবরই ছিল, কিন্তু দেবদাসদা’র তো তা ছিল না! এইটা ভেঙে গেছে… 

অনিমিখঃ  এটা ভেঙে গেছে মনে হয়?

গৌতমঃ আমার একটা পাগলাটে তত্ত্ব আছে। আমার মনে হয়, কলকাতার সৌধে প্রথম ঘা  দিয়েছিল ‘কৃত্তিবাস’। সেনেট হলে যে কবিসম্মেলন হয়েছিল (২৮ ও ২৯ জানুয়ারি, ১৯৫৪) সেই লিস্টটা আমার কাছে আছে। সেটা এখন আর দুষ্প্রাপ্য নয়। ‘অহর্নিশ’-এর নরেশ গুহ সংখ্যায় পাবে। সেইসময় অ্যাটেন্ডেন্স শীট এর একটা প্রথা ছিল। প্রথাটি আজকাল উঠে গেছে, খুব খারাপ হয়েছে।  একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কারা এসেছিল, কারা আসে নি, এইটা কিন্তু পরে আর কেউ জানতে পারছেনা! 

তো, সেই লিস্টে দেখা যায় যে কলকাতার বাইরের লেখক ছিলেন একমাত্র বিনোদ বেরা ! আজ যদি এইরকম দু’দিনব্যাপী বড় কবিসম্মেলন করতে হয়, কলকাতার ক’টা লোক থাকবে? এতটাই পালটে গেছে। এবং এটা কিন্তু পাল্টেছে ‘কৃত্তিবাস’। 

অনিমিখঃ  কীভাবে?

গৌতমঃ আগে, যাঁরা যাঁরা বিরাট উচ্চশিক্ষিত… অধ্যাপক… তাঁরাই সাহিত্যের জগতে আসতেন। আমরা যদি তিরিশের দশকে দেখি, একমাত্র সুধীন্দ্রনাথ পেশাদার শিক্ষক ছিলেন না (বুদ্ধদেব বসু-র অনুরোধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকাল অধ্যাপনা বাদে), উনি পরবর্তী কালে ডিভিসি-র উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে এসে দেখা গেল, সাধারণ বাঙালি… মানে অজ্ঞাতকুলশীল বাঙালি … তাঁরা আবার লিখতে শুরু করলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাকগ্রাউন্ড কী? তুমি গিয়ে দেখে এসো… শক্তি চট্টোপাধ্যায় কেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় বহড়ু গ্রামে না গেলে বোঝা যাবেনা। ওইখানে বাংলার প্রাচীন লিরিক আকাশে বাতাসে ভাসছে! আমি এঁদের কবিতার অন্ধ অনুরাগী নই। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কে? তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা একজন ইস্কুলমাস্টারের ছেলে। এঁরা তো একশ বছর ধরে বাংলা কবিতা লেখার সুযোগ পান নি ! এই যে ডেমোক্রেসি, এটা কিন্তু ‘কৃত্তিবাসে’র অবদান। অভিজাত মানুষও  আছেন সেই সময়ে, যেমন শঙ্খ ঘোষ , প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত , অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত , আলোক সরকার, সুধেন্দু মল্লিক যাঁরা আবার প্রায় সকলেই অধ্যাপক বা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং কোনও–না-কোনও ভাবে তিরিশের কবিদের উচ্চতার আবহ ধারণ করেছিলেন … কিন্তু এই যে ফ্রেশ ব্লাড ‘কৃত্তিবাস’ আনল এইটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

এই যে শ্যামলদা… শ্যামলদা যে কোন্‌ জায়গা থেকে ‘বররুচি’ কাগজ করতো সেটা কেউ ভাবতেই পারবে না এখন! শম্ভুদা!  এঁরা হচ্ছেন উন্মুক্ত প্রান্তরের প্রথম ফসল । 

অনিমিখঃ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সময়ে পেডিগ্রিটা কোনো ব্যাপার ছিল না…

গৌতমঃ হ্যাঁ। বংশপরিচয় ও সামাজিক উচ্চতার মূল্য হঠাৎ যেন মুখ ধুবড়ে পড়ল। তুষার রায়ের কথা ভাবো ! নিজের নীল রক্ত নিয়ে কি খেলাটাই তিনি খেললেন!      

(এরপর কথা এগোয় বড় দায়িত্বের চাকরি ও কবিতা লেখার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে… )

বড় চাকরির সঙ্গে ক্রিয়েটিভিটির একটা বিরোধ তো আছেই! কিন্তু দেখা যায় যে , সৈনিকেরা কিন্তু খুব ভালো কবিতা লিখেছেন। ডাক্তারেরাও লিখেছেন। চেখভ খুব ভালো ডাক্তার ছিলেন। উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস। আমার খুব প্রিয় লেখক। 

অনিমিখঃ  গৌতমদা, পাঠক হিসেবে আমার একটা ধন্দ আমি সামনে রাখছি। আপনার লেখাতে তো খুবই মিথের ব্যবহার আছে, জীবনের অনেক গল্প আছে, ধ্বনিগাম্ভীর্যও আছে। মধ্যে মধ্যেই তৎসম শব্দের ব্যবহার আছে আবার তার পরে পরেই হঠাৎ করে খুব একটা সাধারণ লৌকিক কথা বলে দেওয়া আছে। দুটোর সংমিশ্রণেই ব্যাপারটা চমৎকারভাবে আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন লেখার একটা ট্রেন্ড এসেছে দেখতে পাচ্ছি… কেবলই মিথ লেখা হচ্ছে… তা থেকে কোনো উত্তরণ হচ্ছে না। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে তিনি লিখছেন সেই সময়বিন্দুর কোনো ছাপ থাকছে না। তার কোনো নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থাকছে না, মিথের ভেতরেই ঘোরাফেরা করছেন। এটা একটা ফাঁদ বলে আমার মনে হয়…

গৌতমঃ এটা কেমন জানো তো… এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল একটা প্রশ্ন… এটা নিয়ে আমি খুব ভেবেছি। আসলে , মিথ সঠিক প্রয়োগ করে,  যিনি কবিতায় সুর তুলতে পারছেন, যেমন পার্থদা পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস, তাঁর কাছে মিথ আর মিথ থাকছে না। দেবী সরস্বতী নিয়ে পার্থদার একটা লেখা আছে, ‘রমণীস্মৃতি’ । আমি যা বলতে চাইছি তার একটা জীবন্ত দৃষ্টান্ত তুমি ওই লেখায় পাবে । লেখকের মনে হতে থাকে এই বুঝি   অর্জুন তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এই বুঝি দ্রৌপদির কাপড়টা খুলে গেল। সে মিথ নিয়ে লিখছে, আবার মিথ নিয়ে লিখছেও না, তার কাছে জিনিসটা ভীষণ বাস্তব! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ মিথ তাঁর কাছে মিথ হিসেবে আসছে না। 

গৌতমঃ হ্যাঁ। সাহিত্যের তো কিছু কিছু রহস্য থাকে… সেরকম একটা প্রসঙ্গ … , দ্রৌপদীকে যখন ওরকম অসম্মান করা হচ্ছিল, ভীষ্ম কিছু বললেন না কেন? বুদ্ধদেব বসু একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, অনেকসময়ে আমাদের একটা উলটো প্রতিক্রিয়া হয় না? সেইরকম ভীষ্ম বলেছিলেন যে আমি হাসছিলাম! কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় যে ভীষ্ম’র যত গুণই থাক উনি মেয়েদের মানুষ বলেই মনে করতেন না।

অনিমিখঃ  পেট্রিয়ার্কাল।

গৌতমঃ হ্যাঁ। ঘটনাক্রম আমরা যদি অনুসরণ  করি , দেখবো উনি মেয়েদের কমোডিটি হিসেবেই দেখেছেন। বংশরক্ষার প্রজননযন্ত্রের  মতো আর কী!  

সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনার বু ব’র ‘মহাভারতের কথা’ কেমন লাগে? উনি তো খানিকটা ওখানে মহাভারতকে নিজের মতো করে দেখেছেন। 

গৌতমঃ হ্যাঁ, ঠিক, উনি অন্যভাবে দেখতে চেয়েছেন। খুবই ভালো লেখা, এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। ওঁর অন্যতম ভালো লেখা এটা। বইটা যখন পড়েছিলাম একটা মুগ্ধতা কাজ করেছিল। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, উনি সেখানে একজন প্রোটাগনিস্ট খুঁজতে চাইছেন।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  হ্যাঁ… 

গৌতমঃ কিন্তু কেন? মহাভারতে তো কোনও প্রোটাগনিস্ট নেই! স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও প্রোটাগনিস্ট নন । সময়, মহাকাল প্রোটাগনিস্ট! তো… ওঁর এই অন্বেষণই ভুল! এই অন্বেষণ বিদেশি সাহিত্যে আটকে পড়ে থাকা মানুষের অন্বেষণ … কই জীবনানন্দের তো এসব মাথায় আসেনি। জীবনানন্দ কি কম বিদেশি সাহিত্য পড়েছিলেন ? জীবনানন্দ বিদেশী সাহিত্যে আটকে যাননি। রবীন্দ্রনাথ নিজের সময়কার বিদেশি সাহিত্য খুবই মন দিয়ে পড়েছিলেন ।এলিয়ট অব্দি এগিয়েছেন, তারপর আর যাননি, সেটা আলাদা কথা।আমাদের মনে রাখতে হবে বয়সে এলিয়ট ওঁর চেয়ে প্রায় তিরিশ বছরের ছোট । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই  ফেটিশ ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর যে ফেটিশ ছিল, তা হচ্ছে ওরা সুপিরিয়র আমরা ইনফেরিওর! কীভাবে লড়ব আমি ? আমাকে রামায়ণ মহাভারত দিয়ে লড়তে হবে। 

অনিমিখঃ  এবং ওঁদের টার্মেই খেলতে হবে…

গৌতমঃ হ্যাঁ, ওঁদের টার্মেই খেলতে হবে! এই জিনিসটাই কিন্তু ভুল! তখনকার দিনে হয়ত এটা প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু এই ভুলটা হয়ে গেছে।

অনিমিখঃ  সেটা ওই সময়ের জন্য হয়ত ঠিক ছিল।

গৌতমঃ যে কারণে মিথ নিয়ে আমাদের একটা একপেশে ভাবনা তৈরি হয়েছে, আমরা মিথকে মিথ হিসেবে দেখি। কিন্তু এ তো কেবল মিথ নয়! এ তো চারপাশে ঘটছে। চারপাশে দ্রৌপদীরা অপমানিত হচ্ছেন।  

অনিমিখঃ  আমার প্রশ্নটা একটু অন্য। ধরা যাক, মিথকে ব্যবহার করে আমি একটা কবিতা লিখব। সেখানে মিথের উপকরণ থাকবে। কবিতাটা কবিতাই হয়ে উঠবে। এবং আমি এইসময়ে দাঁড়িয়ে লিখছি তার একটা ছাপ থাকবে। কিন্তু অনেকে এরকম লেখেন, শুধু ওই জিনিসটাই লিখছেন। আজকের সময়ের কোনও ছাপ বা সংকট সেখানে থাকছে না। সেক্ষেত্রে তার মূল্য কী? এটা তো জল নীচের দিকে যায়—এর মতো সত্য, ধ্রুব, সেটাকে আজকের লেখায় পড়ব কেন? 

গৌতমঃ এবং সবচেয়ে বড় কথা, মিথ সদ্ব্যবহার করে যা কবিতা লেখা হয়েছে, তার ধারে কাছে কী আমি পৌঁছতে পারব! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  এক্সাক্টলি! বৈষ্ণব পদাবলী আর কেউ এইসময়ে লিখে কী করবেন! যদি না তাতে নিজের অনুভূতির কথা, নিজের সময়ের কথা থাকে।

গৌতমঃ হ্যাঁ! আমি তাহলে কী করতে চাইছি?  

এখানে একটা ছোট্ট এবং বিপরীতমুখী কথা আমি  যোগ করতে চাই । ‘নিজের অনুভূতি’র কথা প্রকাশ করা  এবং ‘নিজের সময়’কে প্রতিফলিত করাও কিন্তু সমান বিপজ্জনক প্রস্তাব । বেশি গা ঘেঁষে কথা বললে, তোমার-আমার স্থূল সময় পেরিয়ে গেলেই লেখাটি তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে, আবার খুব দূরে সরে গেলেও তুমি-আমি আমাদের দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হলাম ।        

সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। তবে চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাস শেষ অব্দি কিন্তু নিজের অনুভূতির রঙেই রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহ এঁকেছিলেন। রাধা-কৃষ্ণ আধার মাত্র, এমনটাই মনে হয় আমার। নাহলে চণ্ডীদাস লিখলেন কী করে—‘আমার অন্তর যেমন করিছে/ তেমনি হউক সে।।’?  

আপনি একটু আগে খুব জরুরি একটা কথা বলেছিলেন, যে আপনি আগে বাংলা সাহিত্যটা খুব মন দিয়ে পড়েছেন। তারপর ঠিক করেছেন আপনাকে কী লিখতে হবে বা কী লিখতে হবে না।

গৌঃ কোথায় কাজ করব সেটা আমরা বুঝতে পারি না। সেটাই বুঝে উঠতে পারি না…  

অনিমিখঃ  ওই প্রশ্নের আরেকটা উপপ্রশ্ন এসে যাচ্ছে এক্ষেত্রে। তাহলে কি তৎসম শব্দ দিয়ে কেবল ধ্বনি-গাম্ভীর্য তৈরি করা একটা ফাঁদ?

গৌতমঃ ভীষণভাবে! এবং এতে কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। এতে কী হয়, শুধুমাত্র শব্দটার ধার ক্ষয়ে যায়।এছাড়া আর আমি কিছু দেখতে পাই না। একটা কথা ― বাঙলা সাহিত্য আমি খুব মন দিয়ে পড়েছি এটা একটি অতিশয়োক্তি। আমি সাহিত্যের ছাত্র নই বলে আমাকে আলাদা করে বুঝে নিতে হয়েছে, তোমরা যে নৈসর্গিক সুবিধে ভোগ করেছো তা আমি পাই নি।  এতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই ।  

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, সেটাকে আমি যদি নব নব ইন্টারপ্রিটেশন নাই করতে পারি… তাহলে শুধু শব্দ লিখে তো আমার লাভ নেই! 

গৌতমঃ হ্যাঁ! ভাবনাটা যদি আমার নাই থাকে… খোলসের মধ্যে আমি যদি কয়েকটা শব্দ বসিয়ে দিই… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যদি শুধু ধ্বনিমাধুর্য তৈরি করি আর কোনও অভিঘাত সেখানে না থাকে, তাহলে কী লাভ! সংস্কৃত সাহিত্য প্রসঙ্গে খুব সম্ভবত আনন্দবর্ধন এই ধ্বনিমাধুর্যের কথা বলেছিলেন, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দির দিকে। কিন্তু তারপর তো অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তারপর অভিমুখের নানা বদল ঘটেছে। আজকের সময়ে ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। 

গৌতমঃ হ্যাঁ… সময় বদলেছে, যুগ অনেকটা পালটে গেছে। মানে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যদি আমি ক্রাইসিস পাশ কাটিয়ে লিখি , সে লেখাটা মিথ্যেই হয়ে যায়। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  সেক্ষেত্রে আমি তো পলায়নবাদী।

গৌতমঃ হ্যাঁ, পলায়নবাদী, অবশ্যই। এবং পালাবার জন্য তো আমি কবিতা লিখতে আসি নি!

সঙ্ঘমিত্রাঃ  একদমই তাই… 

অনিমিখঃ  ধরা যাক… আমি রাধাকৃষ্ণের মিথ ব্যবহার করতেই পারি। কিন্তু তাকে তো আজকের সময়ের নিরিখে ব্যবহার করতে হবে! 

গৌতমঃ প্রথমত, তাকে আজকের সময়ের নিরিখে ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেখানে তোমায় মূল্য সংযোজন  করতে হবে।

অনিমিখঃ  হুঁ হুঁ… একদমই… এটাই আমি বলতে যাচ্ছিলাম।

গৌতমঃ কিছু একটা বলতে হবে নতুন, নাহলে বলে লাভ নেই। নতুন কিছু একটা ভাবতে হবে… 

অনিমিখঃ  একদমই।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  এটা কি ভাবনার দৈন্য খানিকটা?

গৌতমঃ আমি ভাবনার দৈন্য ঠিক বলব না… দেখো, উচ্চমানের লেখক এবং মধ্যমানের লেখক সর্বদাই পাশাপাশি থাকেন। মধ্যমানের লেখকদের সংখ্যা সবসময়েই বেশি হয়। এক্সেলেন্স’কে সবসময় পরে বোঝা যায়। পরে বোঝা যাবেই, এটা শুধু আমাদের বাংলা ভাষার নয়, সব সাহিত্যজগতের বৈশিষ্ট্য । 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  এবার আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে যাব। আপনি আপনার একটা গদ্যলেখায় গান্ধী আর থরো’র রাজনৈতিক আদর্শের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে সেখানে একটা কথা বলেছিলেন, যে থরো শেষ বয়সে জঙ্গলে চলে গেছিলেন, এবং সেখানে আদিবাসীদের লুপ্তপ্রায় ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করছিলেন। আর এর এর বিপ্রতীপে গান্ধী মানুষের জন্য কাজ করছিলেন, তাঁর বিশ্বাসটা ছিল অন্য। তো… এখানে বলতে গিয়ে থরো’র প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন—থরো পরিণতিহীন আদর্শের দিকে চালিত হয়েছিলেন। এই ‘পরিণতিহীন’ কথাটা আমাকে খুব ভাবিয়েছে। 

গৌতমঃ এই ‘পরিণতিহীন’ সংগ্রাম আসলে গান্ধির প্রেক্ষিত থেকে দেখা । ব্যক্তিগত ভাবে ওই ধরনের ইন্ডিভিজুয়্যাল রেবেল’কে আমি সবথেকে বেশি শ্রদ্ধা করি। ‘ওয়াল্ডেনে’র মতো বই হয় না। ওইরকম একটা লোককে আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না! কিছুক্ষণ আগে আমরা একটা কথা বললাম না… জীবন পালটে দেওয়া বই… জীবন পালটে দিতে পারে ‘ওয়াল্ডেন’। আমরা বলি না, আমাদের দেশে ভালো লোকদের কেউ পাত্তা দেয় না, তেমনি ওঁকে যেরকম অবহেলা করা হয়েছে, ভাবা যায় না! মানে, গান্ধী যদি ভারতবর্ষের রাজনীতি ব্যাপারীদের   দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে থাকেন, ‘ওয়ালডেন’ তার চেয়ে একশগুণ বেশি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অথচ এই আইডিয়াগুলো তো আমেরিকা থেকে এসেছিল। এই যে ওয়াল্ট হুইটম্যান, থরো—এঁরা তো আমেরিকা থেকে এসেছিলেন। অর্থাৎ যে সমাজ নতুন করে গড়ে উঠছে, ওঁরা সেখান থেকে এসেছিলেন! এটা রাশিয়ায় দেখা গেছে, আমেরিকায় দেখা গেছে… নতুন সমাজ গড়ে ওঠার সময়ে নতুন ভাবনার, সৃষ্টিশীলতার জোয়ার আসে । তারপর যখন রাষ্ট্র তৈরি হয়ে যায় , আস্তে আস্তে… 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  stagnant হতে শুরু করে… 

অনিমিখঃ  ওইজন্য বোধহয় কমিউনিজম বিপ্লব অব্দি ভালো। তারপর স্টেট পলিসি যখন… 

গৌতমঃ স্টেট পলিসি হয়ে গেলেই তখন সব গণ্ডগোল হতে শুরু করে। 

অনিমিখঃ  গৌতমদা, আমিও আপনার প্রবন্ধটা পড়েছি। সেখানে আপনি দেখিয়েছেন বা অন্য জায়গায়ও পড়েছি, গান্ধী—কত অল্প সামগ্রী দিয়ে জীবন নির্বাহ করা যায় তার একটা উদাহরণ তিনি সেট করেছিলেন। রণজিৎ দাশের একটা কবিতা আছে, যেখানে রণজিৎ বলেছিলেন যে—পিকাসো তাঁর প্রেমিকার উপর অত্যাচার করেছিলেন, তাই তাঁর সব ছবি আমি পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারি।            

সঙ্ঘমিত্রাঃ  তাহলে নেরুদা সম্পর্কে কী বলা হবে?

অনিমিখঃ  হ্যাঁ… He was a rapist!  

    (এই প্রসঙ্গ ধরেই কিছুক্ষণ গান্ধীকে নিয়ে কথা হয়।) 

গৌতমঃ কিন্তু গান্ধী কি পার্ফেক্ট ম্যান? তা তো নয়। সাংঘাতিক নিষ্ঠুর। রবীন্দ্রনাথ কী কম নিষ্ঠুর! সাংঘাতিক নিষ্ঠুর! 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  হু… 

গৌতমঃ (একটু চুপ থেকে) কালীমোহন ঘোষ… কালীমোহন ঘোষকে উনি খুব ভালোবাসতেন। ওঁকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে সাঁওতালদের গ্রামে পাঠাতেন। কালীমোহন ঘোষকে ম্যালেরিয়ায় ধরতো । কালীমোহন ঘোষ ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ওষুধ দিয়ে সারিয়ে নিয়ে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দিতেন। এটা আমার চোখে নিষ্ঠুরতা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তো পল্লী- উন্নয়নের একটা লক্ষ্য আছে, তিনি সেই লক্ষ্য সামনে রেখে একটা কিছু করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্যক্তি কালীমোহনের কী হচ্ছে? ব্যক্তি কালীমোহনের তো মনে হতেই পারে যে, আমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে! রবীন্দ্রনাথের কাছে তখন উদ্দেশ্য মুখ্য হয়ে উঠছে!  দশজনের কল্যাণসাধন করতে গিয়ে একজনকে যে কতটা কষ্ট দিচ্ছেন তা তাঁর আর মনে হচ্ছে না। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  অথচ রবীন্দ্রনাথ ওরকম সেনসিটিভ একজন মানুষ। 

গৌতমঃ এইটা হচ্ছে বড় মানুষদের চরিত্রের একটা অন্ধকার দিক । 

অনিমিখঃ  এতে নাহয় একটা গঠনমূলক কিছু হচ্ছে, কিন্তু এই যে অভিযোগগুলো উঠছে, পিকাসো বা নেরুদা’র ক্ষেত্রে। সে সম্পর্কে আপনার কী মত? আপনি কি শিল্পকে ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা করে দেখতে পারবেন? 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  দালি’র কথাই ধরুন না, উনি তো ফ্র্যাঙ্কো’কে সমর্থন করেছিলেন। এবং গোপনে প্রশংসাসূচক চিঠিও লিখতেন! ফ্র্যাঙ্কো যখন সাধারণ মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছেন… সমর্থন জানিয়েছিলেন দালি তাকে!   

গৌতমঃ এই ভুল রাজনীতি তো পিরান্দেলো করেছিলেন।তুমি যে সব গল্প শোনালে তার চেয়েও বহুগুণ ভয়ানক কাজ করেছিলেন পিরান্দেলো । ইথোপিয়ার ওপর ফ্যাশিস্ট ইটালির সামরিক অভিযানের জন্য অর্থদানের উদ্দেশ্যে নিজের নোবেল পদকটিও গলিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী গো । এজরা পাউন্ডও রেডিওতে নিয়মিতভাবে ইহুদি  বিরোধী বক্তৃতা দিতেন। পাউন্ডের কথা আমি তুলতে চাইছিলাম না, পাউন্ড আমার কাছে কবিতার ভগবান । তুলতে এইকারণে বাধ্য হলাম যে, ভাল লিখতে গেলে একজনকে আগে ভাল মানুষ হতে হবে, আমার এই প্রত্যয়, পাউণ্ডে এসে বিরাট ধাক্কা খায় ।  

সঙ্ঘমিত্রাঃ  লিখতে গেলে?

গৌতমঃ লিখতে গেলে ভালো লোক হতে হবে। 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  এটা আপনি মনে করেন তো?

গৌতমঃ এটা আমি মনে করি। অন্য লোকের ক্ষতিতে যদি তোমার সামান্যতম আনন্দও হয়, তাহলে তা তোমার লেখার ক্ষতি করবেই। তুমি বুঝতে পারবে না। তোমার লেখা হয়তো বাইরের দিক থেকে ভালই দেখাচ্ছে, কিন্তু তোমার মন তোমার লেখাকে কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেই । 

অনিমিখঃ  নাহলে হয়ত আরও ভালো লিখতে পারত। অনেক কুচুটে লোকেরা অনেক সময় ভালো লিখে থাকেন, কিন্তু তা না হলে হয়ত আরও ভালো লিখতেন।

গৌতমঃ আরও ভালো লিখতেন? এটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না… কেউ একজন সামাজিকভাবে খারাপ কাজ করে চলেছেন এবং তা আবেগ থেকে নয় বা ইমপালস থেকেও নয়, তাঁর ভেতরে একটা বুদ্ধি কাজ করছে, এবং তা দিয়ে তিনি অকল্যাণ জাগিয়ে তুলছেন। একই সঙ্গে তিনি এরকম লেখা লিখছেন… 

‘With usura hath no man a house of good stone’—(সম্ভবত পাউন্ডের Cantos নামে দীর্ঘ কবিতাটার কথা বলছেন, যেটা অসমাপ্ত একটা লেখা। প্রায় শতাধিক বিভাগে বিভক্ত) অর্থাৎ সুদ নেওয়া অমঙ্গলজনক। কেউ বলতেই পারেন  সাহিত্যের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু কি যে অসাধারণ কবিতা ভাই! একে আমি কী করে অস্বীকার করব? 

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আজকাল এটা নিয়ে আমারও খুব দ্বন্দ্ব হয়। ধরা যাক, কোনও কবি বা শিল্পী খুব ক্রুকেড—আমার তাঁর কাজ নিতে খুব অসুবিধা হয়। 

গৌতমঃ একটা মানুষের উপর থেকে যদি বিশ্বাস চলে যায়, তাহলে তো তার মতো কষ্টের আর কিছু নেই।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  খুব কষ্টের, খুব!   

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment