বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব
করার চেষ্টা করেন। ট্রান্সট্রোমারের কবিতা সেই অসম্ভব প্রক্রিয়ার একটি সর্বোত্তম
ফসল। সারাক্ষণই তিনি সেই দিগন্তে অবস্থান করেন, সারাক্ষণই তিনি ঝড়-জল-দুর্যোগ
ঠেলে এগোতে থাকেন দূর সমুদ্রে অপেক্ষমাণ কাব্যদেবীর ক্যানভাসে অসম্ভব সেই
ছবিটি আঁকবেন বলে। পাতালের অতলে তাঁর আত্মার ধূমকেতু ভেসে যায়। অসীম
নির্জন আকাশে কান পেতে তিনি তারকাপুঞ্জের খুরাঘাত শোনেন।
কমিটি লিখেছিল, “২০১১ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের প্রাপক তিনি, কারণ তিনি
আমাদেরকে তাঁর ঘনবদ্ধ, স্বচ্ছ ছবিগুলোর মাধ্যমে বাস্তবতায় নতুনতর একটা প্রবেশের
সুযোগ দিয়েছেন।”
তার সমন্বিত রঙের দিক থেকেও অনুবাদ করতে। সেই রঙগুলি হতে পারে দৃশ্যমান,
কিংবা কাল্পনিক। হতে পারে সীসার মতো ধূসর বা জ্যোৎস্নার মতো বর্ণান্ধ, নয়তো
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঢেউয়ের মতো সবুজ বা সংগীতের তরঙ্গের মতো অদৃশ্য।
অনুবাদ।
…………………..
ঘুমপাড়ানি গান
অরণ্যের নীল কফিনের ভেতর আমি এক মমি পড়ে আছি, মোটর আর
রাবার আর অ্যাসফল্টের অবিরাম গর্জনের ভেতর।
দিনশেষে যা হয়, কাজকাম সব জীবনের চেয়ে ভারি হয়ে যায়।
ঠেলাগাড়িটি তার একচাকার ওপর দিয়ে সামনে গড়ায় আর আমি আমার
ঘুরন্ত আত্মার ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াই, কিন্তু এখন আমার চিন্তারা
ঘোরাঘুরি থামিয়ে দিয়েছে আর ঠেলাগাড়িটি তার ডানা পেয়ে গেছে।
শেষমেশ যখন অন্ধকার হয়ে আসবে আকাশ, একটি এ্যারোপ্লেন আসবে।
যাত্রীরা নিচে গথিক স্বর্ণের ঝলমলে শহরগুলো দেখতে পাবে।
……………..
বিশেষ পলিক্রোম স্টাইল তৈরি করেছিল।]
১৯৭২’এর ডিসেম্বর সন্ধ্যা
এখানে এসেছি আমি এক অদৃশ্য মানব, সম্ভবত এক বিপুলা স্মৃতির মাধ্যমে
নিয়োজিত শুধু এই মুহূর্তে বাঁচার জন্যে। এবং আমি তালাবদ্ধ এক শাদা গির্জার
দ্বারা তাড়িত─ যার ভেতরে একটা কাষ্ঠনির্মিত সাধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
অসহায়ভাবে হাসছে, যেন তাঁর চশমাটা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সে খুব একা। বাদবাকি সবকিছুই এখন, এখন, এখন। মাধ্যাকর্ষণ দিনে
আমাদেরকে
কাজের দিকে আর রাতে আমাদেরকে শয্যার দিকে টেনে নিচ্ছে। যুদ্ধ।
১৮৪৪’এর একটি স্কেচ
উইলিয়াম টার্নারের মুখটা জলহাওয়ায় বাদামি হয়ে গেছে;
তার ইজেলটা রয়েছে বহু বহু দূরের ফেনিল সমুদ্রতরঙ্গে।
আমরা গভীর অতলের রৌপ্যসবুজ ক্যাবলটা অনুসরণ করি।
তিনি মৃত্যুর গহন রাজ্য ঠেলে এগোতে থাকেন।
একটা ট্রেন ঢোকে। কাছে এগিয়ে আসে।
বৃষ্টি, বৃষ্টি আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে থাকে।
……………
অতি উত্তাল সমুদ্রদৃশ্য তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য।
অন্তর্দেশে নামে ঢল
গাড়িগুলোর ছাদে বৃষ্টি হাতুড়ি পিটছিল।
আকাশে বজ্রের গুরুগুরু। যানচলাচল শ্লথ হয়ে গেছে।
গ্রীষ্মের এই মধ্যাহ্নেও হেডলাইটগুলো সব জ্বালানো রয়েছে।
চিমনিগুলো থেকে ধোঁয়া উপচে পড়ছিল।
জীবন্ত জিনিসগুলো সব চোখ বুজে গাদাগাদি করে ছিল।
অন্তর্মুখী একটা আলোড়ন জীবনকে আরো প্রবলভাবে
অনুভব করছিল।
গাড়িটা প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। সে থেমে গিয়ে একান্ত
একটা আগুন জ্বালিয়ে ধূমপান করতে লাগল যখন
জানালাগুলো প্রবল জলের ছাটে ধুয়ে যাচ্ছিল।
এই অরণ্যের রাস্তায়, যেটা একটা পদ্মফোটা হ্রদের
কাছ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে
আর বৃষ্টিতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দিঘল একটা পাহাড়।
উপরের শিলাস্তূপগুলো লৌহযুগ থেকে পড়ে আছে,
যখন এটা উপজাতিদের একটা কুরুক্ষেত্র ছিল,
শীতলতর একটা কঙ্গো
আর বিপদটা পশু আর মানুষগুলোকে সব একসঙ্গে
দাবড়ে ঝোপঝাড় আর গিরিচূড়ার পাথরগুলোর পেছনে,
প্রাকারের ভেতরকার গুঞ্জরণের ভেতর নিয়ে এলো।
অন্ধকার একটা পাহাড়ি ঢাল, কেউ একজন পিঠে বর্ম
নিয়ে হাচড়ে-পাচড়ে সেই ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে,
─গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সে এইসবই ভাবছিল।
সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠতে শুরু করলে সে
জানালা নামিয়ে দিল।
ক্রমশ পাতলা হতে থাকা নিঃশব্দ বৃষ্টির ভেতর একটা
পাখি আপনমনে শিস দিতে লাগল।
হ্রদের ওপরটা টানটান হয়ে আছে। গুরুগুরু আকাশটা
পদ্মফুলের ভেতর দিয়ে নিচের বালিয়াড়ি অবধি
ফিসফাস করছিল।
অরণ্যের জানালাগুলো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল।
কিন্তু নিস্তব্ধতা খানখান করে বজ্রপাত হলো!
শ্রবণ বধির করা বিকট একটা শব্দ। আর তারপর একটা
শূন্যতা, যেখানে জলের শেষ ফোঁটাগুলো খসে পড়ল।
নৈঃশব্দ্যের ভেতর সে একটা উত্তর আসতে শুনল।
বহু দূর থেকে। রুক্ষ এক ধরনের শিশু-কণ্ঠস্বর।
পাহাড় থেকে উঠে আসা একটা গর্জন।
মিশ্রিত সুরের একটা গোঙানি।
লৌহযুগ থেকে আসা দীর্ঘ রুক্ষ একটা ভেরীধ্বনি।
হয়তো তার নিজের ভেতর থেকেই।
একটা শিশুর মতো
তুমি যেন একটা শিশু আর একটা আকস্মিক অপমান
তোমার মাথার ওপরে একটা বস্তার মতো পরিয়ে দেওয়া
হলো; যে বস্তার বুনুনির ভেতর দিয়ে তুমি সূর্যের আভাস
দেখতে পাচ্ছ আর চেরি গাছের মর্মর শুনতে পাচ্ছ।
কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না, বিপুল অপমানটা
তোমার মাথা, শরীর আর হাঁটুগুলি ঢেকে দিল আর তুমি
বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলে কিন্তু বসন্তে কোনো
আনন্দই পেলে না।
হ্যাঁ, ঝিকমিকে উলের টুপিটা তোমার মুখের ওপর নামিয়ে
আনো আর তার বুনুনির ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকো।
খাঁড়ির ওপর, নিঃশব্দে জড়ো হচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক জলের বলয়।
সবুজ পাতারা পৃথিবীটাকে অন্ধকার করে দিচ্ছে।
থরোর জন্যে পাঁচটি স্তবক
আরো একজন এই অতিকায় নগরীর বুভুক্ষু
পাথরের বলয় ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এবং প্রকৃত
সব শরণার্থীর মাথা স্ফটিকস্বচ্ছ লবণজলে সিক্ত
হয়ে আছে।
নৈঃশব্দ্য এখানে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে খুব ধীরে ধীরে
পাক খেতে খেতে উঠে এসেছে, শেকড় গেঁড়ে বেড়ে
উঠে লোকটির রৌদ্রতপ্ত চৌকাঠের ওপর তার
নিবিড় মুকুটের ছায়া ফেলবে বলে।
*
পা একটা মাশরুমে আনমনা পদাঘাত করে।
দিগন্তে বজ্রমেঘ ফুলেফেঁপে ওঠে। তামার শিঙ্গার
মতো গাছেদের বাঁকা বাঁকা শেকড়গুলো অনুনাদ
তুলতে থাকে আর পাতাগুলো সব আতঙ্কে
বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
তার পাতলা আলখাল্লাটি হলো শরতের উদ্দাম উড়াল,
সেটা ডানা ঝাপটাতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না হিম
আর ভস্ম থেকে ঝাঁক বেঁধে আবার শান্তির দিন আসে
আর তাদের নখরগুলোকে ঝর্ণাজলে অবগাহন করায়।
*
কেউই বিশ্বাস করবে না তুমি একটা প্রস্র্রবণকে
চলে যেতে দেখেছ, পাথরের কুয়ো থেকে পালিয়ে
যাওয়া থরোর মতো, এবং তুমি জানো কীভাবে
নিজের সবুজের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়,
চতুর আর আশাবাদী।
…………….
হেনরি ডেভিড থরো প্রায় দুই বছর ওয়ালডেন হ্রদের কাছে নিজের হাতে বানানো আশ্রমে
বসবাস করেছিলেন। তাঁর এই দুই বছরের বনবাসের কাহিনিই হলো আজকের পৃথিবীতে
তাঁর অসামান্য গ্রন্থ ‘Walden’। স্বভাবতই ট্রান্সট্রোমারের ওপর থরোর চিন্তাধারার
অসামান্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ভ্রমণ
আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন।
অপলক একটা মৃত আলোর ভেতরে
অনেক প্লাকার্ডের মধ্যে একদল জনতা।
ট্রেনটা এসে মুখ আর ব্যাগপত্তর
সংগ্রহ করে।
পাশেই অন্ধকার। রেলের কামরায় আমরা
মূর্তির মতো বসে ছিলাম, যে কামরাটাকে
গুহার ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
জবরদস্তি, স্বপ্ন, জবরদস্তি।
সমুদ্রতলের নিচের স্টেশনগুলোতে তারা
অন্ধকারের খবরাখবর বিক্রি করছিল।
ঘড়ির ডায়ালের নিচে লোকজন
বিষণ্নমুখে নিঃশব্দে হাঁটাহাঁটি করছিল।
ট্রেনটা বাইরের পোশাক-আশাক
আর আত্মা বহন করছিল।
পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে
আমরা চারদিকে চকিত দৃষ্টি দিচ্ছিলাম।
এখনও কিছু পাল্টায়নি।
কিন্তু উপরে উঠতে উঠতে
মুক্তিভ্রমরের গুঞ্জন শুরু হলো।
আমরা পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এলাম।
ভূপৃষ্ঠ আমাদের নিচে একবার তার
ডানাগুলো কাঁপিয়ে আবার স্থির হয়ে গেল,
বিস্তীর্ণ আর সবুজ।
সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ভুট্টার খোসার
ওড়াউড়ি।
শেষ স্টেশন! আমি টার্মিনাল ধরে
হাঁটতে থাকি।
সেখানে কয়জন ছিল?
চার-পাঁচজন, বা কিছু বেশি।
ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, আকাশ-বাতাস,
নীল খাঁড়ি, পাহাড়-পর্বত তাদের
জানালা খুলে দিয়েছে।
কালো পাহাড়
পরের বাঁকেই বাসটি পাহাড়ের শীতল ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে যায় আর সূর্যের
দিকে তার নাকটি ঘুরিয়ে গজরাতে গজরাতে উপর দিকে হামা দিতে থাকে।
বাসের ভেতরে আমরা ঠাসাঠাসি। এর ভেতরে স্বৈরশাসকের খবরের কাগজে
মোড়ানো আবক্ষ মূর্তিটাও রয়েছে। একটা বোতল মুখে মুখে ঘুরতে থাকে।
সবারই মৃত্যুর জন্মদাগ ভিন্ন ভিন্ন হারে বাড়তে থাকে।
পাহাড়ের উপর, নীল সাগর আকাশের সাথে মিশে গেছে।
অনিশ্চয়তার রাজ্য
আন্ডার সেক্রেটারি সামনে ঝুঁকে একটা ক্রুশ আঁকলেন
আর তাঁর কানের দুল ডেমোক্লেসের তরবারির মতো দুলে উঠল।
মাটির ওপরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া একটা ‘নয়ান প্রজাপতি’র মতো
দানবটা খোলা সংবাদপত্রটার সাথে সাথে ভাসছিল।
কেউ প’রে নেই এমন একটা হেলমেট ক্ষমতা দখল করেছে।
মা কচ্ছপ জলের গভীরে উড়ে পালিয়ে যায়।
………………
ডেমোক্লেসের তরবারি: (Sword of Damocles) জীবনের অনিশ্চয়তা এবং আসন্ন বিপদের
অস্তিত্ব বুঝাতে ব্যবহৃত রূপক।
নয়ান প্রজাপতি: speckled butterfly; ডানার উভয় প্রান্তে চোখের নকশাযুক্ত এক প্রজাতির প্রজাপতি।
সোনালি বোলতা
তামাটে সাপটা, পা-হীন ওই টিকটিকিটা, একটা অ্যানাকোন্ডার মতো
নিঃশব্দে রাজকীয়ভাবে
বারান্দার সিঁড়ির ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল, শুধু তার আকারটা আলাদা।
আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে, কিন্তু সূর্য ঠিকরে বেরুচ্ছিল।
এরকমই একটা দিন।
এই সকালে প্রিয়তমা আমার অশুভ আত্মাগুলোকে সব তাড়িয়ে দিয়েছে।
দক্ষিণের কোনো অন্ধকার গুদামের দরজা খুলে দিলে যেমন আলো
উপচে আসে
আর তেলাপোকাগুলো কোনা-কানাচ আর দেয়ালের ওপর দিয়ে তিরের
মতো ছোটাছুটি করে
উধাও হয়ে যায়─ তাদেরকে দেখা যায় আবার যায় না─
তার নগ্নতার কারণেই দানবেরা সব এইভাবে পালিয়ে যায়।
যেন তারা কখনোই ছিল না।
কিন্তু তারা আবার ফিরে আসবে।
স্নায়ুর পুরোনো ঘরানার টেলিফোন একচেঞ্জের গোলমেলে সংযোগ
তৈরি করা হাজার হাজার হাতসহ ফিরে আসবে।
এটা হলো জুলাইয়ের পাঁচ। লুপিনগুলো এমনভাবে প্রসারিত হচ্ছে
যেন তারা সমুদ্র দেখতে চাইছে।
আমরা মৌনতার গির্জায় রয়েছি, হরফবিহীন ধর্মে,
যেন গোষ্ঠপতিদের নির্মম মুখগুলির কোনো অস্তিত্বই ছিল না
আর শিলাপটে ঈশ্বরের নামের অশুদ্ধ বানান।
আমি নিখুঁত একটা টিভি যাজককে দেখেছিলাম যিনি কাঁড়ি কাঁড়ি
টাকা কামিয়েছিলেন।
কিন্তু এখন তিনি দুর্বল হয়ে গেছেন আর তাঁর এখন একজন দেহরক্ষীর
প্রয়োজন হয়, মুখোশের মতো শক্ত হাসিআঁটা কেতাদুরস্ত তরুণ
একজন দেহরক্ষী।
আর্তনাদ-চাপা একটা হাসি।
বাপ-মা বিদায় নেবার সময় হাসপাতালের বিছানায় রেখে যাওয়া
একটি শিশুর আর্তনাদ।
পরমাত্মা মানুষকে স্পর্শ করে একটা বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয় কিন্তু
তারপর আবার পিছিয়ে যায়।
কেন?
শিখাটা ছায়াদেরকে টেনে আনে, ছায়ারা মরমর করে ভেতরে উড়ে
এসে শিখাটার সঙ্গে মিশে যায়।
শিখাটা বাড়তে বাড়তে কালো হয়ে ওঠে। আর তার ধোঁয়া ঘোর
শ্বাসরোধী হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
শেষমেশ শুধুই কালো ধোঁয়া। শেষমেশ শুধুই ধর্মীয় জল্লাদ।
ধর্মীয় জল্লাদ বাজারচত্বর আর জনতার উপর ঝুঁকে থাকে
যেগুলো একটা দানাদার দর্পণ তৈরি করে যেখানে সে নিজেকে
দেখতে থাকে।
সবচে’ বড় ধর্মান্ধ হলো সবচে বড় অবিশ্বাসী। যেটা সে
জানেই না।
সে হলো এই দুইয়ের একটা সন্ধি
যেখানে একটা ‘শতভাগ’ দৃশ্যমান এবং
অন্যটা পুরোপুরি অদৃশ্য।
কতই না ঘৃণা করি আমি ‘শতভাগ’ শব্দটাকে!
যারা তাদের গৃহাঙ্গন ছাড়া আর কোথাও থাকতে পারে না,
যারা কখনও আত্মবিস্মৃত হয় না,
যারা কখনও ভুল দরজাটা খুলে অজানার ঝলক দ্যাখে না─
তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাও!
এটা হলো জুলাইয়ের পাঁচ। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে, কিন্তু সূর্য
ঠিকরে বেরুচ্ছে।
তামাটে সাপটা একটা অ্যানাকোন্ডার মতো নিঃশব্দে রাজকীয়ভাবে
বারান্দার সিঁড়ির ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
তামাটে সাপটা, যেন কোথাও কোনো আমলাতন্ত্র নেই।
সোনালি বোলতা, যেন পৌত্তলিকতার কোনো অস্তিত্ব নেই।
লুপিন, যেন কোথাও কোনো ‘শতভাগ’ নেই।
আমি সেই গভীরতাটা টের পাই যেখানে একজন একইসঙ্গে
কয়েদি এবং কর্তা, পার্সেফোনের মতো।
প্রায়ই আমি ওই শক্ত ঘাসের ভেতর শুয়ে থাকি আর আমার উপরে
পৃথিবীর ধনুকটাকে দেখি।
পৃথিবীর খিলানটাকে।
প্রায়শই, সেটাই আমার জীবনের অর্ধেকটা।
কিন্তু আজ আমার দৃষ্টি আমায় ছেড়ে গেছে।
আমার অন্ধত্ব দূর হয়ে গেছে।
কালো বাদুড়টা আমার মুখ ছেড়ে গ্রীষ্মের উজ্জ্বল আকাশে
কেঁচির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
……………
লুপিন: lupin; বিচিত্র রঙের ফুলবিশিষ্ট একজাতীয় গুল্ম।
পার্সেফোনে: Persephone; (গ্রিক পুরাণ) জিউস এবং দিমিতারের কন্যা, বসন্তের দেবী। হেডিস
যাকে অপহরণ করে বিবাহ করেন এবং পাতালপুরির রানী করেন। দেবী দিমিতারের প্রবল বিদ্রোহে
পার্সেফোনে প্রতি বছর ছয়মাস পৃথিবীর ওপরে থাকার অনুমতি পান। ওই ছয় মাস ধরিত্রী সুফলা
হয়ে ওঠে। সেই কারণেই তিনি পার্সেফোনেকে একইসঙ্গে ‘কয়েদি এবং কর্তা’ বলেছেন।
…………..
আমার মনে হয় সেই কথাগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তাঁর সোনালি বোলতা বিষয়ক কথাগুলি নয়,
বরঞ্চ তাঁর শেষ লাইনটি। মূলত মনুষ্যসভ্যতার প্রধানতম সমস্যার একটিকে তিনি কীভাবে অনুভব
করেছেন সেটাই এই কবিতাটির মূল প্রতিপাদ্য। বাংলা করলে তাঁর সেই কথাগুলি এরকম দাঁড়ায়:
যেটাকে অনেকেই চেনেন না। তারা এটার নামও শোনেননি। বেশিরভাগ লোকই অবশ্য এই পতঙ্গটাকে
দেখেছেন, কিন্তু তারা এটার নাম জানেন না। এবং আমার মনে হয় না আপনাদের দেশেও হুবহু এই
পতঙ্গটিই রয়েছে যেটা আমাদের দেশে রয়েছে, তো এটা হলো এক ধরনের বোলতা কিন্তু খুবই উজ্জ্বল
আর দ্যূতিময়, একটা রত্নের মতো। কবিতাটিতে এটা একটা গৌণ চরিত্র মাত্র, কাজেই সেটা
আসলে বিষয় নয়। সত্যি বলতে কি, মঙ্গলময়, ধর্মীয় একটি প্রেরণা কীভাবে বিকৃতিময় হয়ে উঠতে
পারে এটি মূলত সেই বিষয়ক একটি কবিতা।”