সোহম দাস

উত্তরাধিকার

জানুয়ারির শেষ বিকেল। সূর্য ডুববে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। গত কয়েকদিনে বেশ গরম পড়েছে এই অঞ্চলে। হলদেটে ঘাসের রঙে যেন আরও বেশি আগুনের পরত। মেলুলি সাবি নদীর চড়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার পাশে তার জ্যেষ্ঠ সৎভাই জেঞ্জো। দুই সৎভাইয়ের মধ্যে মেলুলি একবছরের বড়ো। জেঞ্জোকে বলা যায় তার রাইট-ইন কমান্ড। তাদের সংগঠনে এবং এলাকায় মেলুলির পরেই জেঞ্জোর অঘোষিত স্থান। 

তবে, সেইসব দিন আর নেই।

সাবি নদীর গায়ে যেটুকু অল্প জল রয়েছে, সেখানে অস্তগামী সূর্যের ছায়া পড়েছে। মেলুলি সেদিকে তাকিয়ে ছিল। একঝাঁক পোকা তার চোখে-নাকে উড়ে বেড়াচ্ছে, সে বারবার মাথা নাড়িয়ে তাদের সরানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই পোকাগুলো বড়ো ঢ্যামনা, মাঝেমধ্যে কেশরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বয়সের ভারে কেশরের বেশিরভাগ অংশ কালো হয়ে এসেছে, সেই কালোর ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যায় মাছিদের ঝাঁক। 

জেঞ্জো একটু আগেই সৎদাদার বামপাশটিতে এসে বসেছে। মেলুলি তাকে কোনও কাজে পাঠিয়েছিল।

জেঞ্জোর আগমন মেলুলি টের পেলেও এতক্ষণ সে কোনও কথা বলেনি। এবার সে জিজ্ঞাসা করে, কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ – “আশেপাশে সোলারিরা কেউ নেই তো?”

বেশ বোঝা যায়, জেঞ্জোকে এই কাজেই পাঠানো হয়েছিল। সে শুকনো গলায় বলে – “না, এখন ওরা এদিকে কেউ নেই, একটা মদ্দা মোষ শিকার করেছে, সেটাকে খাচ্ছে এখন। বাচ্চাগুলোও ওদের সঙ্গেই আছে।”

মেলুলি শুনে নিশ্চিন্ত হয়। যাক, এখন ওরা আপাত-নিরাপদ। জেঞ্জো বলে – “দু’একটা বাচ্চা এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়লে বেশ হত। দিতাম শেষ করে। কিন্তু শালারা চারিদিকে কড়া নজর রেখেছে। পাঁচটাই আছে দেখলাম।”

একথা মেলুলির মধ্যে কোনও ভাবান্তর ঘটায় না। সে সাবি নদীর বুকে নিজের ছায়াটাকে দেখার চেষ্টা করে, সূর্যটা অনেকটাই ডুবে এসেছে। বাঁ চোখের পাশে একটা কাটা দাগ, অনেকদিনের পুরনো একটা লড়াইয়ের স্মৃতি। ওদের সমাজে এসব স্মৃতিচিহ্ন থেকে যায়, যার যত বেশি, সে তত বড়ো বীর, এইই নিয়ম। আজ তিনদিন হয়ে গেল, দুই ভাইয়ের ভালো করে খাওয়া জোটেনি। আজ সকালের দিকেই মেলুলি যখন সোলারিদের বড়ো ভাইটার তাড়া খেয়ে মোপেন গাছের জঙ্গলে গিয়ে লুকোল, কিছুক্ষণ পরেই সে মাথার উপরে একটা কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। মেলুলির বয়স তেরো বছর দু’মাস। এমন দীর্ঘায়ু জীবনে এই বিশেষ শব্দটির তীক্ষ্ণতা উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তার ভাণ্ডারে। তাই সে আর মাথা তুলে তাকায়নি। বা, তাকানোর সাহস করেনি।

দু’খানা হুডেড ভালচারের অবিরাম ওড়াউড়ি দেখতে তার অস্বস্তি হয়েছিল।

হঠাৎ কী মনে হলে জেঞ্জোকে সে জিজ্ঞাসা করে – “সাখিলেকে দেখতে পেলি?”

জেঞ্জো এই প্রশ্নটা আশা করেনি। সে অবাক হয়। কিন্তু দু’বছরের বড়ো দাদার মুখের ওপর কথা বলার দুঃসাহস তার কোনোদিনই ছিল না, সে এনকোসির মতো নয়। 

এনকোসি ছিল তাদের ভাই। ছ’জনের মধ্যে পঞ্চম। সেই এনকোসি বড়োদাদা মেলুলির কাছে হেরে গিয়ে উত্তরের বনে চলে গেল তার পিঠোপিঠি ভাই বুথোকে নিয়ে, বুথোর মৃত্যুর পর ফিরে এসে দাদার ছানাগুলোকে চিবিয়ে শেষ করল দাদার চোখের সামনেই। তারপরেও দাদা তাকে রাজা বলে মেনে নিল। জেঞ্জো কি কখনও এমনটা ভাবতে পেরেছিল? বস্তুত দাদাকে ছাড়া সে এবং তারা যে অসহায়, এমনটাই বরাবর ভেবে এসেছে সে। আজকে জীবনের এই অনিশ্চিত শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও তেমনটাই ভাবে। 

সে তাই সরাসরি দাদার প্রশ্নের উত্তর দেয় – “হ্যাঁ, ও-ই তো মোষটাকে মুখ চেপে মারল।”

মেলুলি বলল – “ওর মতো শিকারি এ অঞ্চলে আর কেউ নেই। এখনও নেই। কত বয়স হয়ে এল, তাও এখনও শেষ মারটা ও-ই মারছে। ভালো!”

অথচ দাদার অভিসারিনীদের সংখ্যা কিছু কম ছিল না। সাখিলের চেয়ে কম বয়সি স্মিলো বা সিবুসিসো বা সিমাঙ্গালিসো, এরা সকলেই দাদার ঔরস বহন করেছে, সন্তানধারণ করেছে, কিন্তু রাজত্ব, সন্তান, সঙ্গিনী, সমস্ত হারানোর পরে দাদার মনে সাখিলের জন্য এখনও বিশেষ জায়গাটি সুসংরক্ষিত। ওদের এই সংরক্ষিত অরণ্যটির মতো। সেখানে অযাচিত কারও প্রবেশাধিকার নেই।

জেঞ্জোর কি কারও কথা মনে আছে বিশেষভাবে? সাখিলের সঙ্গে তো সে-ও সঙ্গম করেছে, স্মিলো আর সিমাঙ্গালিসোর গর্ভে তারও সন্তান এসেছে, ওদের নিজেদের প্রাইড ছাড়া আরও বেশ কিছু প্রাইডের সিংহীর সঙ্গেই সে সঙ্গম করেছে, কিন্তু কাউকেই কি তেমনভাবে মনে আছে তার? জেঞ্জো ভাবার চেষ্টা করে। প্রত্যাশিতভাবেই কোনও নাম তার মনে আসে না। এখানেও সে বুঝি দাদার চেয়ে পিছিয়ে। 

অন্ধকার হয়ে আসছে। নদীর চড়া আর নিরাপদ নয়। দুই ভাই তাই ধীরে ধীরে ইউফরবিয়ার ঝাড়টার দিকে এগোয়। বয়সের কারণে মেলুলি বেশ মন্থর, জেঞ্জো তাই নিজের গতি কমিয়ে দাদার পাশে পাশে হাঁটে। জেঞ্জো জানে, রাত নামলেই অতিবৃদ্ধ দাদার জন্য বৃদ্ধ ভাইই ভরসা। মেলুলি জানে, জেঞ্জো কখনও ছেড়ে যাবে না তাকে।

ইউফরবিয়ার ঝোপের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে দুই ভাই। এই ঝোপগুলোর সুবিধা হল, ঘন হওয়ায় লুকিয়ে থাকা সহজ। ওই সোলারিদের কোনও বিশ্বাস নেই, যে কোনও মুহূর্তে তাড়া করতে পারে। পাঁচজন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলে আর কোনও উপায় থাকবে না বাঁচবার। নিজেদের এমন পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে জেঞ্জোর কেশর খাড়া হয়ে ওঠে।

মেলুলিকে আজকে সেভাবে কথা বলতে উৎসাহী মনে হচ্ছে না। জেঞ্জো চায়, সে কথা বলুক। কথা বলে বয়সের ভারকে নিক্ষেপ করুক সাবি নদীর শুকিয়ে আসা জলে। 

অবশেষে তার ইচ্ছাপূরণ হয়। মেলুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বলে ওঠে – “এভাবে বাঁচার কোনও মানে হয়, বল? তাও ওরা তেড়ে এলে স্বাভাবিক নিয়মেই পালাতে ইচ্ছে করে। লড়ব যে, সেই শক্তিও আর নেই।”

জেঞ্জো জিজ্ঞাসা করে – “আজ ওরা তোমায় তাড়া করেছিল না?”

মেলুলি উত্তর দেয় – “হ্যাঁ, দেখতে পেলেই তেড়ে আসে হারামিগুলো। আজকে দিব্যি লুকিয়ে ছিলাম, ওই শালা ইম্পালাদের সর্দারটা দেখতে পেয়ে গিয়ে এমন হাঁকডাক শুরু করল… ভাগ্যিস, অনেকটা দূরে ছিলাম, তাই দৌড়ে বেঁচেছি।”

জেঞ্জো ইম্পালাদের সর্দারের প্রতি একটা বিদ্বেষসূচক ‘গরগর’ শব্দ নিক্ষেপ করল। তারপর বলল – “মালগুলোর এই এক পাড়া মাথায় করা স্বভাব। থাকত আমাদের দিন, ওইখানেই ব্যাটা সর্দারকে শুইয়ে দিতাম, অমন কত মোষ আর জিরাফকে শুইয়ে দিয়েছি, আর ও ব্যাটা…”

এই বলে থেমে যায় সে। হাঁপায়। দাদার সঙ্গে সঙ্গে তারও যে বয়স ঘনিয়ে আসছে, সেকথা মাঝে মাঝেই মনে থাকে না, উত্তেজিত হয়ে পড়ে। 

তাদের সংসারজগতে এমনই হয়। জন্ম, মায়ের পায়ে পায়ে লেগে থাকা, ভাগ্য ভালো থাকলে বেঁচে যাওয়া, কৈশোর পার, তারুণ্য, গৃহত্যাগ, তারপর সংসার পাতার লক্ষ্যে জমিদখলের লড়াই, লড়াইতে জিতলে দলের অধিকারী হওয়া, বাচ্চা থাকলে তাদের একে-একে শেষ করা, কয়েক বছর চুটিয়ে নারীসঙ্গ উপভোগ, তারপর বিতাড়ন অথবা মৃত্যু, অথবা বিতাড়িত হয়ে ক্রমশ মৃত্যু, এভাবেই তো হয়ে আসছে শুরুর দিন থেকে। এদিকের সাবি স্যান্ড কি ওদিকের মালা মালা, সর্বত্রই তো নিয়ম একই। মেলুলি বা জেঞ্জো কি জানত না? জানত। সবই জানত তারা।

কিন্তু মেলুলি বা জেঞ্জো কেউই আশা করেনি এত বছর বাঁচার, সাধারণত এত বছর কেউই বাঁচে না। ওদের ভাইরাও বাঁচেনি। বাঁচা যায় না। হয় খাদ্যাভাব আর নয় প্রতিদ্বন্দ্বীর থাবা আর দাঁতের ফলার কাছে হার মানা, এই দুইয়ের যেকোনো একটি ঘটনা ঘটে গিয়ে জীবনে দাঁড়ি পড়ে যায়। 

মেলুলি বা জেঞ্জো ভাগ্যবান, তেমন কিছু তাদের হয়নি। 

মেলুলি বা জেঞ্জোর দুর্ভাগ্য, বদলে যেটা হয়েছে, সেটাকে বাঁচা বলে না। 

***

“ক্রুগারের দিকটায় চলে যাবে, দাদা? ওদিকে গিয়ে যদি কিছু করা যায়।”

জেঞ্জো প্রস্তাব করে মেলুলিকে। নিঃসন্দেহে উত্তম প্রস্তাব। তবে মেলুলি কোনও উত্তর দেয় না। সে নেতা, তাকে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

জেঞ্জো আর কোনও কথা বলে না। দাদা এখন ভাবছে। 

রাত নেমে গিয়েছে। সকালের গরম ভাবটা কেটে গিয়ে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে সাবি নদীর দিক থেকে। সে হাওয়ায় ভেসে আসে সোলারিদের বড়ো ভাইটার গর্জন। চারবছর আগে হলে মেলুলি এই ডাক শুনে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াত, জেঞ্জো, থেম্বা, লাঙ্গারা অনুসরণ করত তাকে। মিলিত হত সকলে। তারপর এক অদ্ভুত কৌশলে অগ্রসর হত অনুপ্রবেশকারীদের দিকে। বাচ্চাদেরকে আড়ালে রাখত সাখিলে, বুঞ্জিওয়ে, সিবুসিসোরা। 

তারপর কিছুক্ষণের রক্তপাত। 

রাজ্যদখল করতে আসা যুবকটির গোপনাঙ্গ ছিঁড়ে নিয়ে মাজা ভেঙে দেওয়া হত। গোপনাঙ্গ ছিঁড়ে নেওয়ার কাজটা বেশিরভাগ সময়ে জেঞ্জোই করত। থেম্বার দায়িত্ব থাকত টুটি টিপে ধরা। তাদের সমাজে এই নিয়ম, নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজের কাজ বেছে নাও। বেশি ভাবাভাবির অবকাশ থাকে না।

কিন্তু আজ সত্যিই ভাবতে হচ্ছে মেলুলি আর জেঞ্জোকে। কীভাবে সোলারিদের চোখ এড়িয়ে থাকা যায়, কীভাবে হায়েনাগুলোকে তাড়িয়ে তাদেরই শিকার করা দু-একটা উইল্ডেবিস্ট বা জেব্রা বাগানো যায় – এখন এসব ভাবনার জোরেই বেঁচে থাকা। 

দাদা এত ভাবে কি? নিশ্চয় ভাবে। সাখিলের কথা, নিজের চলে যাওয়া রাজত্বের কথা, বিশ্বাসঘাতক ভাই এনকোসির কথা, এনকোসির দাঁতে মৃত অসহায় শাবকদের কথা, বিস্মৃতিতে চলে যাওয়া বুথোর কথা, হয়তো বাবা-মায়ের কথাও। যদিও তাদের পাঁচ ভাইয়ের বাবা আর দাদার বাবা এক নয়। তবু দাদার সঙ্গে দল গড়তে কোনও মানসিক বাধা আসেনি কখনও।

দাদা আজকাল কথা বলে বড়ো কম, বয়সের কারণে কথা বলতে কষ্ট হয়। বস্তুত, চিরকালই সে কম কথা বলে, সে কেবল বোঝে কাজ। কিন্তু ইদানীং যেন কথা বলা আরও কমিয়ে দিয়েছে সে। আর এই স্তব্ধতাকেই জেঞ্জো ভয় পায়। 

দাদাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

নিজের একা হয়ে যাওয়ার ভয়।

“তোর বুথোকে মনে পড়ে?” দাদার ভরাট স্বরে চমকে ওঠে জেঞ্জো। একটানা স্তব্ধতার পর হঠাৎ দাদার কণ্ঠস্বর তাকে একইসঙ্গে স্বস্তি আর সম্ভ্রম এনে দেয়। ভাবনার ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিল সে, দাদার গলার আওয়াজে সে বাস্তবে ফিরে আসে। উত্তর দিতে কিছু সময় নেয়। তারপর বলে – “হ্যাঁ। এতক্ষণ ওর কথাই ভাবছিলাম। মানে, শুধু ওর না, অন্যদের কথাও, এনকোসি, বাবা-মা…”

এনকোসির নাম শুনে দাদার মুখ শক্ত হল। পরক্ষণেই সে আবার স্বাভাবিক হয়ে জেঞ্জোকে জিজ্ঞাসা করল – “তুই খুব ভাবিস, না রে? পুরনো দিনের কথা?”

জেঞ্জো বলে – “তিনদিন ধরে যে খাওয়া জোটেনি, চারিদিকে সোলারিদের আক্রমণের ভয়, পুরনো দিনের কথা ভাবলে এই বর্তমানটা থেকে দূরে থাকা যায়।”

মেলুলি কৌতুক বোধ করে ভাইয়ের কথায়। সে বলে – “খুব ভুল বলিসনি তুই। সত্যিই আমাদের কত কিছু ছিল তাই ভাবি। আমাদের সিংহকুলের ইতিহাসে এমনটা কেউ করতে পারেনি, আমরা যা করেছিলাম। পুরো সাবি স্যান্ড আমাদের কব্জায় ছিল কত বছর!”

জেঞ্জো উৎসাহ পায় – “তোমার মনে আছে, আট-আটটা প্রাইড আমাদের হাতে ছিল। মাইলের পর মাইল শুধু আমাদেরই রাজত্ব। যত বাচ্চা হয়, সব আমাদের। যত শিকার ধরা হয়, আমাদেরই সিংহীরা ধরে। পালা করে করে আমরা একবার এখানে, একবার ওখানে। কত সিংহই এসেছিল, বলো? কেউ শালা টিকতে পারেনি। সোলারির ঢ্যামনাগুলো আর এসব কী জানে!”

মেলুলি বলে – “এই ব্যাপারে ওদের দোষ দিয়ে আর কী হবে? এমনই তো হয় ভাই। আমরাও তো এমনই করেছি। পার্থক্যটা অন্য জায়গায়। আমাদের যখন সুসময় ছিল, তখন সকলে আমাদের নাম শুনলে কাঁপত, এখন আর সেই যুগ নেই, তুই তাও দেখবি, আমাদের নামে গোটা সাবি স্যান্ড কেঁপে যাবে। এরপর আমরা যখন আর কেউই থাকব না, তখনও আমি নিশ্চিত, আমাদের নাম শুনলে বুক কাঁপবে সকলের। সোলারিদের ভাগ্যে এসব জুটবে না। কেউ মনে রাখবে না ওদের।”

জেঞ্জোর কী ভালো লাগছিল শুনতে! আজ কতদিন পরে দাদা একটানা এত কথা বলল। কথা বলার সময়ে তার জিভ থেকে রাজ-গর্ব যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল। জেঞ্জো তো এই দাদাকেই চেনে, এই দাদাকেই সে চায়। সে বলে – “ঠিকই বলেছ। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে, ওদের ডেকে এগুলো শোনাই। দুদিনের ছোকরা সব, আমাদের বুড়ো পেয়ে বীরত্ব দেখায়। ওদের মতো কত শালার কোমর ভেঙে দিয়েছি। কিন্তু সে উপায় নেই। আমাদের বাগে পেলে ওভাবেই শেষ করে দেবে, কোনও সম্মান-টম্মান দেখাবে না।”

মেলুলি বলে – “এমনই কিছু হবে, জানি। তবে আফসোসটা কী জানিস? ওদের একটাকেও যদি বাগে পেতাম একদিন…” তারপরেই সে চুপ করে যায়। এই পড়ন্ত বয়সে এসে জোয়ান যুবককে চ্যালেঞ্জ জানাতে জানাতেও সে কোনও এক কারণে চুপ করে যায়। আর জেঞ্জো এই মুহূর্তগুলোরই কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। দাদা যেন হঠাৎই হারিয়ে যায় তার তার থেকে, হয়তো নিজের থেকেও।

তবে, আজকের রাতের আবহাওয়ায় হয়তো অন্য কিছু আছে। তাই দাদা আবারও কথা বলে। ফিরে যায় কিছুক্ষণ আগের প্রশ্নে। “বুথোর কথা মনে আছে তোর?”

জেঞ্জো আবারও একই উত্তর দেয় – “হ্যাঁ। খুবই।”

মেলুলি বলল – “বুথোটা সকলের ছোটো ছিল। অথচ দেখ, ও মরল সবার আগে।”

-তাই তো, এটা তো কখনও খেয়াল করিনি। রাগ হয়েছিল খুব, যখন আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু এখন ছেলেটার কথা ভাবলে খারাপই লাগে। ওয়েস্টার্ন প্রাইডের বাহলেকে ও ভালোবাসত ভীষণ। বাহলে যদিও তেমন ভালোবাসেনি ওকে। বুথোকে শেষ কবে দেখেছি, এখন আর সত্যিই মনে পড়ে না।

-জানিস, ওর পিছনের একটা পা খুবলে খেয়ে নিয়েছিল ইম্পিরা। ইম্পিদের একজনকে ওরা দুজনে মেরে দিয়েছিল, তার বদলা নিতে বুথোকে ওভাবে শেষ করেছিল। এনকোসি কিছুই করতে পারেনি ওদের বিরুদ্ধে।

-এনকোসি এসব বলেছিল তোমাকে?

-বলেছিল। ও এটাও চেয়েছিল, আমরা সকলে মিলে বুথোর মৃত্যুর বদলা নিই।

-তুমি রাজি হলে না?

-না।

-কেন?

-সকলে চলে গেলে আমাদের রাজত্ব, সংসার সবের ভার নেবে কে? ফিরে এসে দেখব, সব শেষ। ওঁত পেতে থাকত সব, কখন ফাঁকতালে এসে দখল করা যায়। সেই ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানে ছিল না। আগে ভাই না আগে রাজত্ব? এই একটা কারণেই আমি রাজি হতে চাইনি। নয়তো আমার ওদের উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ কখনোই ছিল না।

-এনকোসির বোধহয় সেই কারণেই তোমার উপর রাগ ছিল।

-হতে পারে। তবে তার আগে থেকেই তো আমার সঙ্গে ওর বনিবনা হত না। হঠাৎ একদিন আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসল। সে ভাবল, আমি বুড়িয়ে গেছি, অনায়াসেই জোয়ান শরীর নিয়ে সে পেরে যাবে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফল ভালো হয় না। সে তরুণ, আমি অভিজ্ঞ। তাও ভাই বলে পায়ে কামড় দেওয়া ছাড়া আর গুরুতর কিছু করিনি। তাতেই সে অপমানিত হয়ে আমার রাজত্ব ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল বুথোকে।

-বুথো ওর খুব ন্যাওটা ছিল।

-তা তো হবেই। পিঠোপিঠি ভাই যে। 

-সেই বুথোকে আমরা শেষ দেখেছিলাম। 

-হ্যাঁ।

কয়েক মিনিটের কথোপকথনের পর দুই বৃদ্ধ ভাইই হাঁপিয়ে ওঠে। চারপাশের অরণ্যের দিকে তারা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আপাতত আশেপাশে কোনও বিপদ নেই। সোলারিদের গর্জনও আর শোনা যাচ্ছে না। তবু হরেক আওয়াজে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে সাবি স্যান্ডের রাত। কোনোটা হায়েনাদের শিকার করার আওয়াজ, কোনোটা সন্ত্রস্ত, পলায়নপর কুড়ু বা জেব্রাশাবকের দ্রুত নিঃশ্বাস পতন, কোনোটা হয়তো রাতচরা নাইটজারের অবিরাম ডাক। কান প্রখর হলে কখনও কখনও একলা লেপার্ডের নিঃশব্দ পদচারণাও দিব্যি শুনতে পাওয়া যায়। এসব ডাক কত বছর হয়ে গেল একই থেকে গিয়েছে, ভাবে জেঞ্জো।

***

গরমের রাত বেশিক্ষণ থাকে না। এর অর্থ, খুব বেশিক্ষণ অন্ধকারের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনা নেই। মেলুলি জেঞ্জোর কথাটা বারবার ভাবছে। ক্রুগারের দিকটায় চলে যাওয়াটা কি সত্যিই নিরাপদ হবে? জেঞ্জো হয়তো এখনও পরিবার গড়ার কথা ভাবছে। এখনও দুই ভাইয়ের গায়ে অসম শক্তি, জোয়ান আগ্রাসীদের মহড়া নিতে পারে দিব্যি। কিন্তু ক্রুগারের দিকের রেসিডেন্ট প্রাইডদের সঙ্গে কতটা পারা যাবে, তা জানা নেই। 

তাদের দুনিয়ায় অবশ্য কোনোকিছুই আগে থেকে নির্ধারিত থাকে না। জন্ম থেকে মৃত্যু, সমস্তটাই তাৎক্ষণিক। 

সবকিছু ভেবে মেলুলি আর বুথো ক্রুগারের দিকেই চলে যাওয়া স্থির করল। খানিক লুকিয়ে যেতে হবে। সোলারিদের তো বটেই, ওদিকে ভেল্ড নামের যে ছোটো প্রাইডটা আছে, তাদেরকেও কোনোভাবে এড়াতে হবে। ভেল্ড প্রাইডের জোয়ান মদ্দাগুলোর বয়স কম, মেলুলি আর জেঞ্জোকে দেখলেই অসম্ভব আক্রোশে তেড়ে আসবে। 

আরও একটা দিন সাবি স্যান্ডের চিরকালের চেনা আস্তানায় কাটায় তারা। সাবি নদীর তীরে শেষবারের মতো শেষ বিকেলের বিশ্রাম নিতে বসে দুই ভাই। 

হাঁপানি এখন মেলুলির নিত্যদিনের সঙ্গী। সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, মেলুলি সূর্যের দিকে তাকিয়েছিল অন্যদিনের মতোই। সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে বহুদিন, একে একে মরেছে চার ভাই, তাদের বাচ্চারা, সঙ্গিনীরাও সরে গিয়েছে নতুন জীবনের খোঁজে, রয়ে গিয়েছে কেবল তারা দুজন। মেলুলি আজকাল এই সূর্যটাকে বেশ চিনতে পারে।

জেঞ্জো না থাকলে কী করত সে? একা?

মেলুলির আজ বড়ো গল্প করতে ইচ্ছে করছে।

সাবি নদীতে এখন জল অনেক কম। ফলে কুমিরদের আনাগোনা নেই। আবার বর্ষা পড়লে এসে হাজির হবে। ফলে, নিশ্চিন্তে নদীর চড়ায় বসে থাকা যায়। অবশ্য, একদম ফাঁকা হওয়ায় সোলারিদের চোখে পড়ে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকি আছে। তাও এই শেষ বিকেলটা এলেই পুরনো অভ্যাস চাড়া দিয়ে ওঠে। তার উপর আজ এখানে তাদের শেষদিন। কে জানে, ক্রুগারের ঘাসজমি তাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে!

আর বেশিক্ষণ বসে থাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু আজ যেন আর উঠতেই মন চাইছে না। জেঞ্জো খোঁচা মারে দাদাকে – “দাদা, চলো।”

মেলুলি বলে – “দাঁড়া না, আরেকটু বসে যাই।”

জেঞ্জো সবই বোঝে। তার সাবধানী চোখ ঘুরতে থাকে এদিক-ওদিক। কোনও ঝোপের আড়ালে নিয়তি ওঁত পেতে নেই তো? 

কিছুক্ষণ পর তারা সত্যিই ওঠে। উঠতে হয়। সন্ধে নামার কিছুক্ষণ আগে তারা চলে যায় ইউফরবিয়ার ঝোপটার আড়ালে। জেঞ্জো মেলুলিকে বলে – “আমরা শেষরাতের দিকে রওনা দেব, বুঝলে। ওই সময়ে সোলারিরা বেশি এদিক-ওদিক ঘোরে না। গা গরম করায় ব্যস্ত থাকে। আমরা স্যান্ড নদীর দিকটা ধরে চলে যাব।”

মেলুলি শুধোয় – “ভেল্ডরা আছে না ওদিকে?”

জেঞ্জো উত্তর দেয় – “আছে। তবে ও আমরা ঠিক লুকিয়ে চলে যাব।”

মেলুলি ঠিক যেন ভরসা পায় না। তবে বুঝতে পারে, ক্রুগারের টানে জেঞ্জোর মন ওদিকেই পড়ে আছে। জীবনে এই প্রথম সে ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। অবশ্য, এর আগেও একবার আরও এক ভাইয়ের বশ্যতা সে মেনে নিয়েছিল। এই নিয়ে বাকি ভাইয়েরা তাকে অনেকবার প্রশ্ন করলেও সে কোনও উত্তর দেয়নি। আজ হঠাৎ মনে হল, এই ব্যাপারটা জেঞ্জোকে বলা দরকার। তাই সে বলল – “জেঞ্জো, তোরা আমাকে সেবার বারবার প্রশ্ন করেছিলি, আমি কেন এনকোসিকে মেনে নিয়েছিলাম রাজা হিসেবে।”

জেঞ্জো এই মুহূর্তে দাদার কাছ থেকে একথা আশা করেনি। সে বলে – “থাক না দাদা, সেসব পুরনো কথা।”

মেলুলি সেকথায় আমল না দিয়েই বলল – “তোরা ভাবিস, আমি খুব নিষ্ঠুর। আমার বাচ্চাগুলোকে, আমাদের সবার বাচ্চাগুলোকে ও এক-এক করে মারল, কয়েকজনকে চিবিয়েও খেল, তারপরেও আমি কিছু বললাম না কেন? ওকে মেরে দিতেই পারতাম। বুথোকে বাঁচাতে গিয়ে ও ইম্পিদের আক্রমণে আহতও হয়েছিল। আমার সঙ্গে পেরেও উঠত না, তোরাও ছিলিস। তাও কিছু বলিনি কারণ আমি বুঝেছিলাম ওর সময় ফুরিয়ে এসেছে। ও আমার চেয়ে অনেক ছোটো, ওর চেয়ে এই জঙ্গলের পৃথিবীটাকে আমি অনেক বেশি দেখেছি, অনেক বেশি জানি। কিন্তু বারবার সে একই ভুল করে গিয়েছে। তাই সব দেখেও আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলাম। ছেড়ে দিলাম আমার রাজত্ব।”

জেঞ্জো শুনছিল দাদার কথা। অবাক হয় সে। এনকোসি তাদের এলাকায় ফিরে আসার পরে মাত্র কয়েক মাস বেঁচেছিল। তার মৃত্যুর পরেই সোলারিরা আক্রমণ হানে তাদের সাম্রাজ্যে। থেম্বা আর লাঙ্গা ততদিনে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। জেঞ্জো শুনেছিল, দুজনকেই গুলি করে কারা যেন মেরে ফেলেছিল। কীভাবে যেন জঙ্গলের বাইরে চলে গিয়েছিল ওরা। 

মেলুলি আবার বলে – “তোর মনে আছে হয়তো, সোলারিদের পাঁচটা মদ্দা যেদিন প্রথম আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়ল, আমি এনকোসিকে সাবধান করেছিলাম। সে তখন নিজের গর্বে মশগুল। আমাদের একবারও জানাল না পর্যন্ত, একাই চলে গেল পাঁচজনকে টিট করতে। আমি কিছুটা দূরে একটা কোপি থেকে দেখেছিলাম সবটা। পাঁচজন পুরো ওকে খেলিয়ে খেলিয়ে মেরেছিল।”

জেঞ্জো জিজ্ঞাসা করে – “তুমি একবারও গেলে না ওকে বাঁচাতে?”

-না। গিয়ে লাভ হত না। পাঁচজনের সঙ্গে পেরে উঠব কীভাবে?

-শুধু একারণেই গেলে না?

-বুঝতে পেরেছি তুই কী বলতে চাইছিস। আমি তো তোকে আগেই বলেছি, এনকোসির সময় ঘনিয়ে এসেছিল। ওর মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারত না। এটা হওয়ারই ছিল। আমি তাই যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।

জেঞ্জো আর কিছু বলতে পারে না। বুথোকে বাঁচাতে গিয়ে এনকোসি আহত হয়েছিল। আর দাদা কিনা সব দেখেও এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। জেঞ্জো কী একটা বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত থেমে যায়। দাদার মুখের উপর কথা বলার সাহস তার কোথায়?

***

ভোর হয়ে আসছে। একনাগাড়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে দুই ভাই স্বভাবতই ক্লান্ত। খুব একটা বাধার মুখে তাদের পড়তে হয়নি। ভয় কেবল হাতির পাল আর অন্যান্য সিংহদের দলকে। অবশ্য বুনো মোষদের দলকেও রাতের অন্ধকারে ভয় করার কারণ আছে। কালো দৈত্যের মতো চেহারা তাদের, একটি শিঙের আঘাতে মেলুলি বা জেঞ্জোকে কয়েক হাত দূরে আছড়ে ফেলতে পারে। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে হানা দিলে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে। 

মেলুলি আর সাখিলের দুটো বাচ্চা এই করে মরেছিল। তাদের ঝোপের আড়ালে রেখে শিকারে বেরিয়েছিল মেয়েদের দল, সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন এসে আক্রমণ করে যায় বাচ্চাদের। অনেকগুলো বাচ্চা একসঙ্গে ছিল, বাকিরা বেঁচে যায়। মরা বাচ্চাদুটো ছিল সবার ছোটো। সাখিলে কয়েকদিন ভীষণ মনমরা হয়ে ছিল। বেশিদিন অবশ্য চুপচাপ বসে থাকা যায় না তাদের সমাজে।

মেলুলির মনে এসব মাঝেমধ্যে ভেসে ভেসে উঠছিল। সমস্ত স্মৃতিকে রেখে দিয়ে আসতে হচ্ছে আজ।

অল্প দূরেই ক্রুগার। দূর থেকে দেখা যায় পল ক্রুগারের নামাঙ্কিত গেট। নতুন দেশ। মেলুলি থমকে দাঁড়ায়। ওই তাদের নতুন বাড়ি? 

গেটের একপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে মানুষের তৈরি পিচঢালা রাস্তা। সেখান দিয়ে আর কিছু পরেই শুরু হবে গাড়ির আনাগোনা। মেলুলি আর জেঞ্জো গাড়ি, মানুষ সবই দেখেছে। কিন্তু কখনও খুব বেশি আমল দেয়নি সেগুলোকে। সাবি স্যান্ডের বিশাল এলাকা ছেড়ে কখনও অন্য কিছুর কথা ভাবা সম্ভবপর ছিল না তাদের পক্ষে। ভাগ্যিস তা করেছিল। নয়তো থেম্বা আর লাঙ্গার মতো অবস্থা হত।

ক্রুগারের সীমানা পেরোল তারা। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে হবে। 

সকালের আলো ফুটে গিয়েছে। ঘাসজমির অরণ্য জ্বলজ্বল করছে সূর্যের আলোয়। 

কিছুদূর মাত্র এগিয়েছে, হঠাৎ ডানদিক থেকে একটা চিরচেনা শব্দ ভেসে এল দুই ভাইয়ের কানে। দুজনেই তাকাল সেদিকে। কাঁটাঝোপটার পাশেই দাঁড়িয়ে এক স্বজাতি। চোখ তাদের দিকে স্থির। মেলুলি আর জেঞ্জো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুঝতে পারে, এগোনোর উপায় নেই। লড়ো কিংবা মরো। জেঞ্জো অভ্যাসবশত এগিয়ে যেতে শুরু করে মদ্দ জোয়ানটির দিকে। মেলুলি শরীরের কারণেই খানিক পিছনে থাকে। 

জোয়ান সিংহটি চার্জ করে আসে তাদের দিকে। তার দলের বাকিরা আশেপাশেই কোথাও আছে। তবে এখন আপাতত দুইয়ের বিরুদ্ধে এক। সে ভরসা করে তার তারুণ্যকে, মেলুলি আর জেঞ্জোর নির্ভরতা তাদের সুদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায়। প্রথামতো, দুই ভাই দুদিক থেকে আক্রমণ করে এলাকার অতন্দ্র রক্ষীটিকে। ঘুরে ঘুরে নিজেদের জায়গা বদল করে সিংহটিকে ক্লান্ত করে তোলে। কামড়ে ধরে পিঠ, আবার পরক্ষণেই সে বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে, ক্ষয়ে আসা দাঁতের আর সে শক্তি নেই। 

বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি চলার পরে অবশেষে পাহারাদার তরুণটির কোমরে একটা মোক্ষম কামড় বসাতে সক্ষম হয় জেঞ্জো। চামড়া ভেদ করে হাড় ফুটো করে দেয় সেই কামড়। কিছুক্ষণ পরেই সিংহটি লক্ষ করে, কোমরের নিচের অংশে আর সাড় পাচ্ছে না সে। অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাও সামনের দু’পায়ের উপর ভর দিয়েই দুই অনুপ্রবেশকারী বৃদ্ধের আক্রমণ সামলে যায় সে। 

তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না সেই প্রতিরোধ। মেলুলি সামনের দু’পা দিয়ে তাকে মাটিতে ধরাশায়ী করে ফেলে, তারপরেই জেঞ্জো কামড়ে ধরে পিছনের বাঁ পা’টি। সেই পুরনো পদ্ধতি, তাদের তীক্ষ্ণ দাঁতের সামনে হতভাগ্যটির উন্মুক্ত গোপনাঙ্গ। মেলুলি দেরি করে না, মারণ কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে অণ্ডকোষ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আর্তনাদ করতে থাকে সে। 

কিছুক্ষণ পরে নিস্তেজ হয়ে গেলে তাকে ছেড়ে দেয় মেলুলিরা।

তরুণ সিংহটি জানল না, সাবি স্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত দুই বৃদ্ধের হাতে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল।

পাঁচ মিনিট পর জেঞ্জোই প্রথম কথা বলল – “ব্যাটার ভাগ্য খারাপ। পড়বি তো পড়, একেবারে আমাদেরই মুখোমুখি।” মেলুলি কিছু বলল না। সৎভাইয়ের মতো উচ্ছ্বাসে ভাসার বান্দা সে কোনোকালেই নয়।

জেঞ্জো মৃতপ্রায় পাহারাদারটির মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকে – “সাবধান ক্রুগার, আমরা এসে পড়েছি।”

টানা কয়েক মিনিট ধরে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার পর্ব চলে। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দাদার উদ্দেশে বলল – “চলো, বাকিদের খোঁজ লাগাই।” মেলুলির ইচ্ছা করছে না। অনেকদিন পর এমন ধকল গেল শরীরের উপর দিয়ে। যদিও বেশিরভাগ কাজ জেঞ্জোই করেছে, তাও এই বয়সে একটা প্রমাণ সাইজের সিংহকে মাটিতে ধরাশায়ী করতেও প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়। হাঁপ ধরে গিয়েছে তার, এখন জিরোতে চায় সে। 

জেঞ্জোর অবশ্য সেসব ভাবনা নেই। মরণের আগে বুঝি আরও একবার রেখে যেতে চায় তার দাগ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানুক, তাদের সংগঠনের বৃদ্ধরা এই বয়সে এসেও অনায়াসে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত তরুণ রেসিডেন্ট আলফা মেলদের। সে এগিয়ে যেতে উদ্যত হয়। এই প্রাইডে সদস্য সংখ্যা কতজন, জানা নেই তার। যাই হোক, পরোয়া করা তাদের চরিত্রে কোনোদিন ছিল না।

মেলুলি ভাইয়ের এহেন আচরণে খানিক ক্ষুব্ধ হয়। বলে – “নিজের বয়সের কথাটা ভুলে যাস না, জেঞ্জো। আমাদের এখন বিশ্রামের দরকার। একটা ছায়া-ছায়া জায়গা খোঁজ, বাকিদের খোঁজ এখন না লাগালেও চলবে।”

দাদার আদেশ, অতএব জেঞ্জো নিরস্ত হয়। 

দু’ভাই আবার হাঁটতে থাকে। অল্প দূরেই সবুজ কাঁটাবন। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক একটা বুশউইলো গাছ। জায়গাটা নিরাপদ মনে হওয়ায় সেদিকেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এগিয়ে যায় তারা। মেলুলি লক্ষ করে, জেঞ্জো পিছনের ডান পায়ে খোঁড়াচ্ছে। অভিজ্ঞ চোখ এক লহমায় বুঝে নেয় কারণ। বয়সের ভার নেহাত অবহেলার জিনিস নয়। ক্রুগারে পদার্পণের প্রথম ঘণ্টাই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, জীবনপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর ভ্রাতৃদ্বয়ের বাকি দিনগুলো কেমন যেতে পারে।

যদিও সেকথা বোঝার জন্য একদিনও অপেক্ষা করতে হল না তাদের।

রাতে জেঞ্জো একটা কাঁটাগাছের তলায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। পায়ের ব্যথাটা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সকালের আলফা মেলটার থাবায় নাকের একটা অংশে গভীর ক্ষত, সেখানে মাছি ভনভন করছে। এছাড়া, শরীরের বহু জায়গায় জ্বালাযন্ত্রণার অনুভূতি। বয়সের কারণেই সেসব অনুভূতি যেন আরও দমিয়ে দেয় মনকে। দাদা ঠিকই বলেছিল, বিশ্রাম নেওয়া দরকার। কেন যে সে দাদার মতো হতে পারল না!

এসব ভাবছে, হঠাৎ মাত্র কয়েক থাবা দূরে চারজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ দেখে চমকে উঠল সে। চোখের চারপাশে ফুলে ওঠা কেশর দেখেই আন্দাজ করা যায়, এই আগন্তুকের দল কারা। 

জেঞ্জো বোঝে, বিপদ আসন্ন। আশেপাশে তাকিয়ে দাদাকে খোঁজে সে। দাদা নেই। সর্বনাশ, এরা দাদাকে কিছু করেনি তো? একথা মনে হতেই জেঞ্জোর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। প্রাণাধিক প্রিয় দাদার ক্ষতি সে প্রাণ থাকতে হতে দেবে না। চারজন আরও এগিয়ে এসেছে। জেঞ্জোর পক্ষে এখন আর লুকিয়ে থাকা মুস্কিল। ওদের রাডারে সে পড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন, হয় লড়ো, নয় মরো।

এগারো বছরের জেঞ্জো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সামনে চার মৃত্যুদূত। অন্ধকারে চোখ জ্বলছে তাদের। একজনকে বলতে শুনল – “ওই যে হারামখোরটা। এরাই মেরেছে ফিলানিকে।”

তারপরেই তারা গতি বাড়িয়ে ছুটে আসে তার দিকে। জেঞ্জো যত জোরে সম্ভব, একটি গর্জন ছাড়ে। ক্রুগারের সীমানা ছাড়িয়ে সে ডাক বুঝি শোনা যায় সাবি স্যান্ডেও। কিন্তু সামনের চারজনকে তাতে এতটুকু বিচলিত হতে দেখা যায় না। তাদের লক্ষ্য একটাই, জেঞ্জোর মৃত্যু।

ওদের মতো সবচেয়ে বড়ো আকার যার, সে প্রথমে জেঞ্জোকে পিছন থেকে কামড়ে ধরে। স্বাভাবিক নিয়মে জেঞ্জো এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিতে চায় নিজেকে। পারে না। সেই রিফ্লেক্স আর নেই। সিংহটির কামড় ধরে থাকে তার পিঠ। টানতে শুরু করে পিছন থেকে। আর বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন এবার দু’পাশ থেকে একযোগে আক্রমণ করে তাকে। জেঞ্জোর প্রতিরোধের চেষ্টা কোনও বাধাই হয় না তাদের আক্রোশের কাছে। আর্তনাদ-গর্জনের মিশ্র শব্দে আশেপাশের জঙ্গল কেঁপে ওঠে। চতুর্থ জনের আক্রমণের লক্ষ্য হয় জেঞ্জোর পিছনের একটি পা। 

কিছুক্ষণ একতরফা লড়াই চলার পর জেঞ্জো অবশেষে খানিক পাল্টা লড়াইয়ের চেষ্টা করে। সকালে ওই ফিলানিকে মারতে গিয়ে সে আহত হয়েছিল, ফলে ক্লান্ত ছিল সে। বাঁচার কোনও আশা আর নেই, তাও তার নাম জেঞ্জো। শেষ মুহূর্তের আগে জমি ছেড়ে দেওয়ার শিক্ষা দাদা তাকে বা তাদের দেয়নি। সে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের পিঠ ছাড়িয়ে নেয়। উদ্দেশ্য, কোনোভাবে চারপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু সেটা করার ফলে তার পিঠের অনেকখানি চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে মাংস উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। 

পিছনের যে পায়ে সে সকালের লড়াইয়ের পর থেকে খুঁড়িয়ে চলছিল, সে পায়েও আর শক্তি বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা। সেই অবস্থাতেই পাশ থেকে যারা আক্রমণ করছিল, তাদের একটিকে এক থাবায় ফেলে দেয় সে। জেঞ্জোর নখে সে ব্যাটার একটা চোখ অর্ধেক উপড়ে এল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, বাকি তিনজনের মিলিত আক্রমণের ধার আরও বাড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। 

জেঞ্জোর আহত পা-টা ফালাফালা করছিল দুটো সিংহ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রুগারের অখ্যাত কাঁটাবনের মধ্যে পড়ে থাকবে ওর ধূলিধুসরিত, ছিন্নভিন্ন দেহটা। অণ্ডকোষ কামড়ে ধরেছে ওরা। 

আর কয়েক মিনিট মাত্র আয়ু। ওরা কামড় ছাড়েনি, সারাজীবনের সমস্ত রাগ বুঝি জমিয়ে রেখেছিল আজকের রাতটার জন্য। জেঞ্জোর আর থাবা তোলারও ক্ষমতা নেই। তবু ওরই মধ্যে আচ্ছন্ন চোখজোড়া খুঁজছিল আরেকটা চোখ, সে চোখের পাশে একটা কাটা দাগ – তাকে এনকোসি খুঁজেছে, থেম্বা-লাঙ্গারা খুঁজেছে, বোধহয় সবার চেয়ে ছোটো বুথোও খুঁজেছে।  

***

কাঁটাবনের পাশ দিয়ে চারজন ফিরছিল। উদ্দেশ্য সফল। কিন্তু প্রত্যেকেই বেশ ক্লান্ত। তাই হাঁটার গতি বেশ ধীর। সবার পিছনে যে ছিল, সে খোঁড়াচ্ছিল। বলল – “মালটার কী জান মাইরি। পড়ে গিয়েও আবার উঠে এসে আমাকে ফেলে দিল। একটা চোখ পুরো কানা করে দিল হারামখোরটা!”

বড়ো সিংহটা এদের নেতা, সে সবার সামনে। বলল – “হবে না? মান্ডলাদের রক্ত বইছে যে শরীরে।”

আরেকটি সিংহ বলল – “বলিস কী, এ সেই মান্ডলা প্রাইডের নাকি?”

নেতা বলল – “নইলে আর এমন হয়! বুড়ো হয়ে মরতে বসেছে, তাও এখনও দুজনকে মহড়া নিতে পারে। বাবা-কাকাদের মুখে ওদের কথা কত শুনেছি ছোটো থেকে! ওদিকের সক্কলে ভয় পেত ওদের। বড়ো ভাইটাও নিশ্চয় আশেপাশে কোথাও আছে। দুজনেই একসঙ্গে ঢুকেছে আজকে। সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।”

নিজেদের মধ্যে এইসব কথা বলতে বলতে ওরা চারজন এলাকার দিকে ফিরে যাচ্ছিল। ওরা জানল না, কিন্তু খানিক দূরে একটা বুশউইলো গাছের আড়ালে বসে ওদের সব কথাই শুনল একজন। 

তার বাঁ চোখের পাশে একটা কাটা দাগ, এখনও উজ্জ্বল। বয়স হয়ে এসেছে তার, এখনও শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ। মুখ দিয়ে একটা চাপা ‘গরগর’ শব্দ করল সে। যেন বলতে চাইল – “সাবাস জেঞ্জো।”

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment