হৃষিকেশ বাগচী

নেকলেস

 রাতে নার্সিং হোম থেকে ফিরে বাথরুমের বিরাট আয়নাটার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আস্তে আস্তে তার ক্লান্তিটা কেটে যায়। তখন ও নিজের চেহারাটার ওপর খুব তীক্ষ্ণ একটা পর্যবেক্ষণ চালায়। সে আর পাঁচটা সুন্দরী মেয়েদের মত রূপবতী হয়ত নয় কিন্তু তার চেহারার মাপজোক এমনই অসামান্য যে পথফিরতি পুরুষদের চোরা নজর সে সবসময় আকর্ষণ করে। 

  তবু যত দিন যায় তত যেন আয়নাটাকে সে কখনও কখনও এড়িয়ে যেতে পারলে বাঁচেপ্রতিদিন যারা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে নিজেদের চেহারার দিকে তাকায় ছোটখাট পরিবর্তন কিছুতেই তাদের নজর এড়ায় না। সে যেমন কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে তার সামনের দিকের চুল অনেকটাই কমে আসছে। রাত জেগে দীর্ঘদিন ডিউটি দিতে দিতে চোখের নীচে বেশ স্পষ্ট কালি পড়ে যাচ্ছে। ওপরের দিকের চোখের পাতায় সাদা ফোলা ফোলা চর্বির মত দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই ভাবছে কোলেস্টেরলটা একবার চেক করাবে। হয়ে উঠছে না। তার বাবা বেশ অল্প বয়সেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিলেন। ওই সাদাটে ছোপের দিকে তাকালে তার সেই ভয়টা গলায় উঠে আসে। 

  এই বাথরুমটাই তাদের ছোট টু বি.এইচ.কে. ফ্ল্যাটে তার সবচেয়ে প্রিয় ও নিরাময়ের জায়গা। এখানে সময় কাটাতেই তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অনেক সখ করে সে এই বিরাট লম্বা আয়নাটা বাথরুমে লাগিয়েছে। এর পাশে নগ্ন হয়ে দাঁড়ালে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখা যায়। শরীরের প্রতিটি আনাচ-কানাচ তার নজরে আসে। যৌনতার ব্যাপারে সে সবসময় নতুন কিছু খোঁজে। অভিযাত্রীর মনসুজয়কে টেনে নিয়ে আসে এই বাথরুমে। তাদের নগ্ন যৌনাচার দুচোখ ভরে উপভোগ করে। 

  যারা বলে মেয়েরা যৌনমিলনের সময় চোখ বন্ধ রাখতেই বেশি পছন্দ করে তারা সব মেয়েদের দেখে নি। উল্টে সুজয়ের সারাদিন অফিসে বসে বসে কাজ করে একটি মাঝারি মানের ভুঁড়ি হওয়ায় সেই বরং বিছানার অন্ধকারের নিরাপত্তায় ফিরে যেতেই বেশি আগ্রহ দেখায়। যৌনতা সবসময়ই একটা খেলা। সে সেই খেলাটা কখনই অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে খেলতে চায় না। 

  বাথরুমের দেওয়ালে, ছাদে সে নানা রঙের মৃদু আলো বসিয়েছে। তার সংকেতে তারা কখনও জ্বলে কখনও নেভে। সে শুনেছে এমন নাকি দিন আসতে চলেছে যখন তার মনের ভাব বুঝে আলোগুলো জ্বলবে নিভবে। সে তখন অবশ্যই তেমন আলোই রাখবে। এই মুহুর্তে তার স্তনের অপর হালকা নীল রং এসে পড়েছে। সুখের জায়গায় হালকা গোলাপি। চোখের ওপর বেগনি। কলকাতায় একটু একটু করে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সে গিজার চালিয়ে রেখেছে। গিজারের গো-গো শব্দটা এখনো চলছেসে শুকনো গায়েই বডি ওয়াশ লিকুয়িড সাবান গায়ে একটু একটু করে ঘষতে থাকে। নিজের অজান্তেই তার আঙ্গুল সুখের জায়গায় বিলি কাটা শুরু করেকী হয়েছে কে জানে তার শরীর হঠাৎ করেই প্রচন্ড কথা বলে উঠছে ওর সাথে। এই কথা কিন্তু একক কথা। অন্য কাউকে চাইছে না। শুধু তাকেই চাইছে। তার নেল পলিশ পরা দিঘল আঙ্গুল সুখের জায়গার ভেতরে বাইরে খেলা করতে থাকে। খেলা বেড়েই চলে। তার হুঁশ নেই। 

  শুরুর ডিসেম্বরের হালকা শীত নীরব নির্জন ফ্ল্যাটে এক যুবতী বধুর স্বমেহন দেখতে চোখ রাখে। সমান্তরাল বিশ্বের কিছু যুবক গালে হাত দিয়ে তার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ায়। অসম্ভব ক্লিষ্ট কিছু যুবতীকিছু অভাগী সারা জীবনে যারা দেহকে পেল না তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে সেই বাথরুমের ভেতর। তাদের সব কান্না ছিটকে বেরিয়ে আসে তার সুখ হয়ে। সেই জলধারা বেরোতেই থাকে। সে অবাক হয়ে দেখে যে আয়না ভেসে যাচ্ছে। বাথরুমের মেঝে ভেসে যাচ্ছে আঁশটে জলে। সে সেই সুখের জলে শুয়ে পড়ে। তার চুল ভিজে চপচপে। পিঠ ডুবে গেছে সুখের জলেকিন্তু সেই ফোয়ারা তখনও উঠছে। ফোয়ারা আর্টেজিয় কূপের মত এসে পড়ছে তার সারা গায়ে, মাথায়, মুখে। জলের স্রোত যত বাড়ছে ততই বাড়ছে তার আঙ্গুলের খেলা। 

  আঙ্গুল যখন ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন সে লক্ষ্য করল কমে আসা জলধারায় একটা রামধনু তৈরি হয়েছে। সেই রামধনুতে ভেসে উঠেছে মধুরিমা ত্রিপাঠির মুখ। তিনি হেসে উঠলেন তাকে দেখে। হাসি দেখে তার লজ্জা হল। এসময় লজ্জার কোনো কারণই নেই। তবু কেন জানি তার লজ্জা লাগল। ভীষণ লজ্জা। সে বুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে প্রাণ ভরে সুখের জলের আঁশটে সুবাস টেনে নিতে লাগল। সে বুঝল না একজনের বেদনায় কেন সবসময় অন্যজনের সুখ জড়িয়ে যায়। 

  মধুরিমা ত্রিপাঠি শেষের কয়েক বছর সব রকম সামাজিক সংসর্গ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তাই যেদিন তিনি তাদের হাসপাতালে ভর্তি হলেন ওপরতলার কড়া আদেশ ছিল তার অসুখের খবর যেন কোনোভাবেই বাইরে না যায়। খবর যে যাবে সে তো সকলেই জানতেন কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কোনো নিউজ বুলেটিন বা তার অসুস্থতার কোনো আপডেট প্রকাশ করেন নি। ম্যাডাম এমনটাই চেয়েছিলেন। তাদের হাসপাতালে সবসময় বড়সড় কেউ না কেউ ভর্তি থাকেন কিন্তু তারা তো কেউ আর মধুরিমা ত্রিপাঠি নন। তাই যেদিন তার কেবিনে উনি ভর্তি হয়ে এলেন সে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও উনি তখন এতটাই অসুস্থ ছিলেন, ডাক্তারবাবুরা তাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে চার-পাঁচ ঘন্টা কিভাবে কেটে গেল সে বুঝতেই পারে নি। 

  খুব ভোরে ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়। ওনার সবসময়ের পরিচারিকা মেয়েটি ওনাকে এখানে নিয়ে আসে। জরুরি বোর্ড মিটিং ডাকা হয়। কার্ডিওলজিস্টদের প্যানেল সঙ্গে সঙ্গে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়। আগে ওনার ছোট একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তখন অবজার্ভেশন করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। তাই কার্ডিওথোরাসিক সার্জেনরা চাইছিলেন বাইপাস করাতে। এই নিয়ে কার্ডিওলজিস্টদের সাথে ওনাদের একটা মতবিরোধও হয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত অ্যাঞ্জিও করা হল। তাকে কেবিনে দেওয়া হল বেলা দুটোর দিকে। সে তখনই প্রথম মহানায়িকার দিকে একবার ফিরে তাকানোর অবকাশ পেল। 

  হালকা ঘুমের ওষুধের প্রভাবে তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। সকালের কষ্ট ও ধকলটা এখনও যেন মুখের মধ্যে লেগে আছে। নায়িকাদের বয়স কেউ জানে না। তবে তার হাতে ধরা বি.এইচ.টি. থেকে সে জানে ম্যাডামের বয়স সাতান্ন ছুঁয়েছে। গায়ের রং তেমন ফর্সা নয়। প্রসাধনী নেই বলে মুখের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাথার ওপরে তিনটে মনিটর বিপ বিপ করছে। ভেন্টিলেটর তৈরি রাখা হয়েছে। ভি.আই.পি. পেশেন্টদের জন্য কেবিনকেই আই.সি.সি.ইউ. হিসেবে তৈরি রাখা হয়। ম্যাডামের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। 

  হাসপাতালের পোষাক পরে শুয়ে থাকা অচেতন মহানায়িকাকে দেখে তার একদম সাধারণ এক মহিলা বলে মনে হল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসা ম্যাডামের অগুন্তি সিনেমার কথা মনে এল। তাকে নিয়ে আনন্দলোকের পাতায় পাতায় অফুরন্ত গুঞ্জনের খবর ও ছবির কথা মনে এল। সিনেমায় দেখা সেই রূপসী নায়িকার সাথে সে আজকের নায়িকাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। চেহারাটাও তার বেশ খারাপ হয়েছে। ঝরনার জলে চান করা, বিকিনি পরে সুইমিং পুলে হেঁটে যাওয়া, ঘোড়ার পিঠে নায়ককে জড়িয়ে ধরে পাহাড় থেকে নেমে আসা নায়িকাকে সে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না তার মধ্যে এমন কী আছে যে যার জন্য আজকের পুরুষেরাও তার জন্য পাগল। সুজয় আজও তার ছবি দেখালে ডিভানে বসে চিপস খেতে খেতে ছুটির দিন একমনে দেখে যায়। তাদের যখন প্রথম বিয়ে হল তখন একদিন ওনার ওদের অফিসে এক অনুষ্ঠানে চিফ গেস্ট হয়ে আসার কথা ছিলসুজয়ের সেদিন অফিসে যাবার সাজগোজ দেখে সে নিজেই চমকে গেছিল। বিয়ের দিনও সম্ভবত সে এতটা সাজে নি। ঘটনাচক্রে উনি সেদিন আসতে পারেন নি। তাই সে তার কাট আউটের পাশে দাঁড়িয়েই ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। আজ যদি সুজয় তাকে এই অবস্থায় দেখত, সে কী বিষণ্ণ হত নাকি করুণ? পুরুষ নারীকে সারাজীবন কিভাবে দেখতে চায়? তারা প্রিয় নায়িকাকেই বা কিভাবে দেখে? 

  বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল সুজয়কে দেখে ও অবাক হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু টিভি চ্যানেলে, খবরের কাগজে মহানায়িকার সম্ভাব্য অসুস্থতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকদিন ধরে অথচ সুজয়ের কোনো হেলদোল নেই। অনেক চ্যানেলে তাদের নার্সিং হোমের নামও করা হচ্ছে তাও সুজয় কেমন নীরব। খুব ভালো করে ওকে লক্ষ্য করে তার মনে হয়েছে সুজয় হয়ত খবরটাই শোনে নি। কয়েকদিন ও অফিসের কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত। অনেক রাত করে ফিরছে। সকালে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেও খুব সতর্ক থাকে কিছুতেই ওর মুখ দিয়ে যাতে ম্যাডামের নাম না বের হয়। ও এটাকেও একটা খেলা হিসেবেই নিয়েছে। এই মুহুর্তে বেশ মজাই পাচ্ছে। মাঝে মাঝে কয়েকবার কথাচ্ছলে মধুরিমা ত্রিপাঠির কথা তুলেছে। এই যেমন অনেকদিন টিভিতে মধুরিমার ছবি দিচ্ছে না। অনেকদিন ওনার কোনো খবর নেই। উনি কি এই দেশেই আছেন নাকি বাইরে থাকেন এখন? শোনা গেছে ওনার সব সম্পত্তি উনি নাকি ওনার পালিত মেয়েকে দিয়ে দেবেন। সেই পালিত মেয়েটি কে? অত ভাগ্য তার কেন হয় না। এমন নানান কথার কথা। সুজয়ের কোনো জবাব ও পায় নি। এর থেকেই ও নিশ্চিত হয়েছে মহানায়িকার বর্তমান শারীরিক অবস্থার খবর সুজয়ের কাছে নেই। 

  সে সারাদিন এত খবর নিয়ে বাড়ি আসছে অথচ কাউকে কিছু বলতে পারছে না। তার পেট ফেটে যাবার জোগাড় কিন্তু উপায় নেই। বাড়িতে মাকে ফোন করে কিছু বলেছে। মা প্রথমদিকে উৎসাহ দেখালেও পরে কথা বলে দেখেছে উনি শুধু এটাই জানতে চান যে তিনি বেঁচে আছেন কিনা। তাই মার সাথেও এই নিয়ে আর কথা বলে আনন্দ পাচ্ছে না। যার সাথে কথা বলে কয়েক ঘন্টা পার করে দেয়া যেত তাকেই কিছু বলা যাচ্ছে না। যতই হোক এটা একটা খেলা এবং সব খেলার মত এই খেলারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ফলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে সুজয় বা সে বাড়িতে এলে সে সবসময় সুজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মনে কিছুর ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে কিনা। তাকে স্বাভাবিক দেখে একদিকে যেমন তার নিশ্চিন্তি হয় আবার অন্যদিকে কথাগুলো বলার জন্য প্রাণটা নিশপিশ করে। এভাবেই খেলাটা চলতে থাকে। 

  আজ যেমন তার মনে এত কথা সে কাকে আর বলবে! বাথরুমে গিয়ে ঠিক করল আয়নাটাকেই কিছু বলা দরকার। এটা খুবই অবাক করার মত ব্যাপার যে তার মত একজন অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে মধুরিমাকে দেখে বিমোহিত হতে পারছে না। সবসময় তার মনে কে যেন একটা তুলনামূলক মাপকাঠি পুঁতে রেখেছে। তার নিজের সাথে ওনার কোনোদিক থেকেই কোনো তুলনা হয় না। কোথায় উনি আর কোথায় ও। তবু গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন তাকে স্পঞ্জিং করিয়ে, নগ্ন করে জামা-কাপড় পরিবর্তন করে, ক্যাথেটার পরিয়ে, ঘন্টায় ঘন্টায় স্যালাইন আর ওষুধ দিয়ে দিয়ে কোথায় যেন তার এই সম্পূর্ণ অসহায়তাকে সে নিজে উপভোগ করে চলেছে। 

  এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ এমন কত বিখ্যাত মানুষদের সে এই হাসপাতালেই নার্সিং করে এসেছে। প্রচন্ড প্রফেশনাল বলে সুনাম থাকার জন্য বারেবারে ম্যানেজমেন্ট তাকেই এসব ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছে। আগের কোনো ক্ষেত্রে এমন হয় নি। এবার কেন হচ্ছে? এটা কি তিনি মধুরিমা ত্রিপাঠি বলে? বিয়ের পরে সুজয় বহুবার তার কথা এতভাবে তাকে বলেছে যে কখনও কখনও তার মনে হয়েছে সে হয়ত মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেসব পুরুষ মানুষের পরকীয়া করার ধক নেই তারা স্ত্রীর সামনে এমন কোনো বিখ্যাত নারীর সম্পর্কে গভীর প্রেমের মন্তব্য করে তাদের বহুগামিতার আনন্দ নিয়ে থাকে। ঠিক যেমন মধ্যবয়সী শিল্পী বা কবি-লেখক যাদের বিছানায় শকুন চড়ে বেড়ায় তারা তাদের যত অবদমিত কামনা-বাসনা তাদের সৃষ্টিতে প্রকাশ করেন এও তেমনি। তাই সে নিজেকে এভাবেই বুঝিয়েছে তার এই মনোভাবের জন্য তার বা ম্যাডামের কারোরই দোষ নেই। দোষ যদি কারো থাকে তবে তা একমাত্র তার পতিদেবতার। 

  ম্যাডাম সেদিন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সে তার চুল বেঁধে দিয়েছে। মুখে সামান্য কিছু প্রসাধন করে দিয়েছে। অনেকদিন বাদে তিনি বিছানায় উঠে বসেছিলেন। পূবের জানালা দিয়ে ভোরবেলার পৃথিবী নিজেকে সর্বাধিক আনত করে সূর্যের কাছে পৌঁছতে চাইছিল। সেদিন ছিল বাইশে ডিসেম্বর। উত্তর গোলার্ধে সূর্যের দক্ষিণায়ন শেষ হল। দীর্ঘতম রাত। শেষ ডিসেম্বরের দূরতম সৌরকিরণের ম্লানতা তার মুখের ওপর পড়ে তাকে কী যে অপূর্ব সুন্দরী করে তুলেছিল তা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কত পরিচালকের, চিত্রগ্রাহকের মুগ্ধ কামার্ত ক্যামেরা তাকে কতদিন কতভাবে দেখিয়েছে। কিন্তু নরম আলোর তরঙ্গ জানলার পাশে রাখা একগোছা ডেন্ড্রোবিয়াম অর্কিডের গোলাপি শরীর ছুঁয়ে যখন তার মুখে পড়েছে সেই দৃশ্যটি সে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। কোনোদিন পারবে না। কত সময় পার হয়ে গেল তার কোনো হুঁশ নেই। কত ওষুধ তাকে দিতে হবে তার যেন খেয়াল নেই। মহানায়িকা যেন আর মানবী নন তার সারাজীবনের সকল ফ্যান্টাসি, জেলাসি, কাঙালপনা যেন মূর্ত হয়ে ওই অপরূপা দেবীকে আশ্রয় করেছে। 

  উনি তার দিকে হাসিভরা মুখে চাইলেন। তাদের এর আগে অল্পস্বল্প গল্প হয়েছে। সেদিন তিনি অনেকক্ষণ কথা বললেন। অনেক অন্তরঙ্গ কথা। কোথায় যেন মহানায়িকার মনের অর্গল খুলে গিয়েছিল সেদিন। নিজেকে আড়াল করার কোনো ইচ্ছেই তার সেদিন ছিল না। ভোরের আলোয় সেদিন এমন একটা কিছু ছিল, আরোগ্যের আনন্দের মধ্যে এমন একটা নেশা ছিল যা সেদিন প্লাবিত করে দিয়েছিল সেই ছোট কেবিনটিকে। যেন ওষুধের কোনো গন্ধ নেই, রাত জাগার কোনো ক্লান্তি নেই, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া বা আর্তি নেই, মনিটরের একটানা যান্ত্রিক শব্দ নেই- শুধুই একটা ডিসেম্বরের সাধারণ ভোর দুই নারীর মাঝে একটা কিছুক্ষণের অফুরন্ত সাবলীলতা নিয়ে এসেছিল। 

  তিনি সেদিন গলার একটা সোনার নেকলেস পরে ছিলেন। সোনার গায়ে ছোট ছোট হিরে বসানো। তার পান্ডুর রোগা হয়ে আসা গলায় নেকলেসটি পড়ন্ত বিকেলের মত শেষ বিভা ছড়িয়ে দিয়েছিল। নার্সিং হোমে কোনো গয়না পরা বারণ। তবু তিনি পরতে চেয়েছেন বলেই হয়ত কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে। তিনি যত কথা বলছেন, হাসছেন, চোখের-ভুরুর মুদ্রা তৈরি করছেন সেই সব তরঙ্গগুলো ওই নেকলেসটির মধ্যে দিয়ে ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিল। নেকলেসটির দিকে সে অনেক্ষণ ঠায় তাকিয়ে ছিল। হয়ত বোকার মতই প্রশংসা করে বলে ফেলেছিল অত সুন্দর নেকলেসটি পরে ম্যাডামকে কতখানি সুন্দর লাগছে। সারা জীবনে নিজের সৌন্দর্যের কথা তো তিনি কম শোনেন নি। তবু সেদিন ওই যে বললাম ওই ঘরের ভেতরে এমন জাদু কিছু ঘটছিল যাতে তিনি শিশুর মত হেসে উঠলেন। অভিনয় নয়। এটা অভিনয় হতে পারে না। সেই হাসির মধ্যে তার জীবনের কাছে ফিরে যাবার এক প্রচন্ড আবেগ যেন লুকনো ছিল। সেইদিন ঠিক সেই মুহুর্তে সে প্রথমবার মনের অন্তরতম অঞ্চল থেকে চাইল উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। 

  তার গত তিন চারদিন ধরে পিরিয়ড চলছিল। রাতে শোবার সময় অভ্যাসের বশে সুজয় ওর প্যাড হাতে ফিল করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিলআজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে সিগারেট ধরিয়েছে। খুব কম কথা বলছে। ও দেখেছে সুজয় যখন কামার্ত হয় তখন কথা কম বলে। সাদা পাজামার নীচে কোনো অন্তর্বাস নেই। সে আড়চোখে তার পুরুষাঙ্গের ভারের দিকে একবার তাকাল। আজ প্রচন্ডভাবে তার দেহ জেগে উঠছে। রান্নাঘরের ছোটখাট কাজ আজ আর শেষ হচ্ছে না। কোনোমতে বাসনগুলো সিঙ্কে রেখে সে বাথরুমে ঢুকল। মাথার চুল খুলে সুন্দর করে আঁচড়াল। চুলে একটু সুগন্ধি লাগিয়ে ম্যাক্সি খুলে ফেললচোখে কাজল পড়ল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাল। তার সম্পূর্ণ নগ্ন দেহকে আয়নায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখল। সকালের সেই আলো তার শরীরেও এখন এসে পড়েছে। নখ দিয়ে বৃন্ততে সামান্য চাপ দিয়ে দেখল তারা সারা দেহে যেন কিসের তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। আয়নায় তাকিয়ে দেখল তার মুখের জায়গায় মধুরিমা ত্রিপাঠির মুখ বসানো। অবিকল সেরকম হাসি তার মুখে খেলল। গলার কাছে হাত দিয়ে সে নেকলেসটা অনুভব করার চেষ্টা করলখুঁজে পেল না। কিন্তু শরীরে যেখানেই হাত দিচ্ছে বৈদ্যুতিক শক লাগছে যেন। 

  বাইরে থেকে সুইচ বন্ধ করার আওয়াজ এল। সে বুঝল সুজয় বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে। সেবার ওরা যখন টাকিতে বেড়াতে যায় তখন ছোট কৌটোয় এক কৌটো মধু এনেছিল। ওখানে মৌমাছির ফার্ম আছে। এই মধু ডাবর হানির মত নয়। সাদা এবং দানাদার। সে সেই কৌটো থেকে মধু তার দুই স্তনে ভালো করে লাগালো। নাভিতে লাগালো। সবশেষে সুখের জায়গায়। যে জায়গাগুলো সুজয়ের খুব প্রিয় কোথাও বাদ দিল না। আরো কিছুক্ষণ সময় পার করে সুজয়কে কামের উত্তেজনায় কিছুক্ষণ অস্থির রেখে ও নগ্ন হয়ে বিছানায় এল। 

  সেদিন মিলনের পরে সুজয়ের গালে অনেক গভীর চুম্বন দিয়ে ও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ভালোবাসা আজ তাকে তৃপ্ত করেছে। 

  অনেক ভোরবেলায় হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। হাসপাতালের ফোন। ম্যাক্সিটা জড়িয়ে নিয়ে ফোন রিসিভ করল। ওপার থেকে শুধু জানাল এখুনি তাকে একবার হাসপাতালে আসতে হবে। সুজয়কে সেই কথা বলে সে দ্রুতপায়ে উবের ডেকে হাসপাতালে চলে এল। 

  হাসপাতালের সামনেটায় বেশ ভিড়। সে ড্রেস পালটে তার কেবিনের দিকে যেতে যেতেই খারাপ খবরটা পেল। রাতে হঠাৎ করে আরেকবার হার্ট অ্যাটাক হয়। ঘুমের মধ্যেই। আর জ্ঞান ফেরে নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংবাদ মাধ্যমকে জানানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হাসপাতাল চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। ভি.আই.পি. দের গাড়ির হর্নের শব্দে কান পাতা যাচ্ছিল না। 

  ঘরে নিজের বেডে শুয়ে আছেন ম্যাডাম। কাল সকালের হাসিটাই ঠোঁটের মধ্যে ধরা আছে। বহু মানুষের অনেক কষ্টকর মৃত্যুর পরে সে দেখেছে তাদের মুখে একটা অম্লান হাসি আঁকা থাকে। সেই হাসি দেখেই বারবার তার মনে হয় মৃত্যুর বাইরেও যেন একটা অন্য জীবন আছে। তাকে ওরা একটা সুন্দর শাড়ি পরিয়ে দিল। ওনাকে যখন ও চুল বেঁধে দিচ্ছিল তখনই মনে হল উনি যেন তার সঙ্গে কথা বলে উঠবেন। মনে হল ঘাড়টা ঘুরিয়ে তার দিকে এক্ষুনি তাকাবেন ঠিক যেভাবে পিয়ানো বাজাতে বাজাতে উনি নায়কের দিকে তাকাতেন। হঠাৎ তার মনে হল গতকাল ভোরের সেই উচ্ছ্বাস যেন তার আরোগ্যের নয় আসন্ন বিদায়ের আনন্দ। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন জীবনে যে প্রচন্ড তীব্রতা নিয়ে তিনি প্রেমকে গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই দহনকাল পার করে যাবার সময় তার এসে গেছে। এই কথা তার যখন মনে হল সে কিছুতেই আর আবেগকে ধরে রাখতে পারল না। দুচোখ ভরে বিলাপ করে সে এমন করে কাঁদল কেঁদেই চলল যতক্ষণ না তার গলার কাছের বেদনা কিছুটা কম হয়। তার এমন করা উচিত ছিল না। এমনটা তার আগে কখনও হয় নি। যারা তাকে চিনত সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কোনোভাবেই সে নিজেকে সংযত করতে পারছিল না। মুখে রুমাল চেপে সে কেবিনের বাইরে দাঁড়াল। এখানে এসব মানায় না। 

  কিছুক্ষণ পরে মহানায়িকাকে বাইরে বের করে আনা হল। তার কাছের লোক বলতে ওই পরিচারিকাটি। সিনেমার জগতের বহু মানুষ এসেছেন। চারিদিকে তখন শুধু ক্যামেরার শাটার টেপার শব্দ। এত ভিড়ে তার যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ঘোর ভাঙ্গল কার হাতের স্পর্শে। দেখল ম্যাডামের পরিচারিকা তার কাঁধে হাত রেখে তার কানেকানে বলল সে যেন একটু আড়ালে আসে। একটু দূরে যেতেই সে তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বটুয়া বের করে তার হাতে দিয়ে বলল কাল রাতে সে যখন এখান থেকে বাড়িতে যায় তখন মা গলা থেকে এটা খুলে তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন তাকে দিয়ে দিতে। কিছুটা অবিশ্বাস কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে সে তার দিকে তাকাতে মেয়েটি বলে এটাই মায়ের সম্ভবত শেষ ইচ্ছে ছিল। সে যেন প্রত্যাখ্যান না করে। 

  হাতে বটুয়াটা চেপে ধরে ম্যাডামের কাছে ফিরে গিয়ে সে ভিড়ের দিকে চাইতেই দেখল বেশ কিছুটা দূরে সুজয় রাতের পোশাক পরেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস ও অবাক ভাব। তার দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পেরে সুজয়ের দিকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। 

  দুই যুবকযুবতী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না তাদের সম্পূর্ণ অগোচরে মধুরিমা ত্রিপাঠি শীতের এক দীর্ঘতম রাতে তাদের জীবনে প্রবেশ করে গেছেন। 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment