অনিমিখ পাত্র

ডং গুইশিন এর কবিতাগুচ্ছ

কবি পরিচিতিঃ ডং গুইশিন থাকেন বেজিং শহরে, ‘হাইশিন’ ছদ্মনামেও লিখে থাকেন। চীনের দ্য পোয়েট্রি ইন্সটিটিউট এর সদস্য। ‘পোয়েম সিলেকশন ম্যাগাজিন’, ‘ইয়ানহে রিভার’ ইত্যাদি জার্নালে শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নতুন কবিতার সংকলন ‘ফ্লুরোসেন্স’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ তে।

 

 

 

 

ইন শিয়াওজুয়ায়েনঃ কবি, সম্পাদক, অনুবাদক। এনসাইক্লোপিডিক স্কুল অফ পোয়েট্রি’র প্রতিষ্ঠাতা। একাধিক ভাষায় লেখেন। কবিতাও অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। নানান পুরস্কারে ভূষিত।

 

 

 

 

 

ডং গুইশিন -এর কবিতা

ইংরেজি তর্জমা: ইন শিয়াওজুয়ায়েন

বাংলা অনুবাদ: অনিমিখ পাত্র

 

 

 

চাইনিজ ক্যালিগ্রাফি

১.

তাদের প্রবাহঃ যেন চ্যাংজিয়াং নদীর* সারাংশ
তাদের আঁচড়ঃ যেন কুনলুন পর্বতমালার* সিল্যুয়েট
কখনও কখনও স্বর্গীয় হ্রদের মতো পবিত্র
কখনও কখনও মহাসমুদ্রের মতো প্রচণ্ড

তুমি রোপণ করো পাইন আর সাইপ্রেস গাছঃ তোমার শুয়ান ব্রাশ* এর লম্বা মাথা দিয়ে

মিহি টেক্সচারের ধানকাগজের* ওপর উঠে দাঁড়ায় ভূমিরূপ
ঘন কিংবা ফিকে, মোটা কিংবা সরু
সবই তো জীবনের নানারকম রঙ

 

২.

শুরু হয়েছিল নিওলিথিক চিত্রলিপিময় সেরামিকের জিনিস, দৈববাণী লেখা হাড়, এবং তারপর, পড়ন্তবেলার শ্যাং সাম্রাজ্যের* উৎসবের ঘন্টা দিয়ে
স্টিলি অরণ্যে* তা সমৃদ্ধি লাভ করে, ঘষা পাথরফলকের গ্রন্থে, সাটিন-বাঁধানো দেওয়াল স্ক্রল-এ
প্রতিটি চরিত্র যেন শঙখলাগা পাইথনের টোটেম
সহস্র বছর সময় তাদের অন্ধিসন্ধি পালিশ করেছে
আর তাদের দিয়েছে তুলনাহীন দ্যুতি
যা প্রাচীন চীনের নদনদী আর পর্বতমালার ওপর
ছড়িয়ে পড়েছে উজ্জ্বল ঝকঝকে হয়ে
চিরকালীন হয়ে

 

 

৩.

পর্বতমালার যেমন শিকড় আছে তেমনই নদীর আছে উৎস
সেরকমই, চারপ্রকারের যন্ত্রপাতিঃ তুলি, ইঙ্ক স্টিক, কাগজ আর ইঙ্কস্টোন
এসব থেকেই ক্যালিগ্রাফির ক্লাসিক সৌন্দর্য ফুটে বেরয়
উইজেল ব্রাশ যেন এক বীর যোদ্ধা
আবার, উল ব্রাশ যেন মোহিনী নারী
তারা সুষ্ঠুভাবে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না
তাং অয়েল*, কাঁচা বার্নিশ, পাইন পাতা সমস্ত পুড়িয়ে ঝুল করে তোলা হয়
আর মেশানো হয় শেষ উপাদানগুলো
এইবার তুমি তোমার ইঙ্কস্টোনে একে নিতে পারো
পেষাই করো আর পাও সেই সুঘ্রাণ ও প্রশংসা করো তার টেক্সচারের

এই ক্যালিগ্রাফির মধ্যে ধরা আছে
এই জগতের সমস্ত সম্পর্ক আর যাবতীয় বিচার
এতো পরিচিত তোমার, তবুও নিজেকে যেন পর মনে হয়
যাইহোক, তুলির নীচে তো সবসময়ই বিছানো আছে সেই ল্যান্ডস্কেপগুলো

 

 

৪.

প্রত্যেক চাইনিজ লিপিচিহ্নে, কিছু না কিছু আছে
যা চিত্রময় ও কবিতার মতো
যেন অনেক নদনদী আর পর্বতমালা তাদের মধ্যে বিছিয়ে রাখা আছে, এবং তাদের মধ্যে
লুকিয়ে আছে পাখির কিচিরমিচির আর মেঘমালা
চীনের মানুষজন প্রজন্মের পর প্রজন্ম এদের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে থেকেছে, আত্মমর্যাদা আর সহিষ্ণুতার সঙ্গে
অজানা এক মহাজগৎকে বুকে টেনে নিয়ে

 

 

 

পুনরাবৃত্তি

 

একটি ছোট্ট বীজ মাটিতে পড়ে, অঙ্কুরিত হয়
ফুল ফোটে, তারপর ফল ধারণ করে
এ এক আপন কার্য-কারণময় পুনরাবৃত্তি
পুনরাবৃত্তি এইভাবে হতে থাকে যতক্ষণ না অরণ্য গজিয়ে ওঠে
পর্বতমালার শিকড় যা বৃহৎ এই ভূমিকে আঁকড়ে ধরে থাকে

সাদা মেঘ বদলে যায় বৃষ্টিতে
বৃষ্টিফোঁটা মিশে যায় নদীতে
বয়ে যায় তারা, বাষ্পীভূত হয়, তারপর আবার ধারণ করে মেঘের আকার
সর্বদাই এই সমীকরণের সমাধান হলো সমুদ্র

সমুদ্রের সময়রেখা ধরে ঢেউ আছড়ে পড়ে
নন-লিনিয়ার ফাংশানের মত, যথাঃ f(x)
অভিসরণ না অপসরণ – কী দাঁড়াবে তা আমি বলতে পারি না
কেবল শুনতে পাই সৈকত জুড়ে সমবেত গান গাইছে ঝিনুকেরা

তারাভরা আকাশের দিকে তাকাই আমি
কত কত পুনরাবৃত্তি ঘটে গেছে এই মহাবিশ্বে
মানুষ আসার আগে? ঘৃণা, হত্যা, যুদ্ধসমূহ…
শান্তিরঙের প্রেক্ষাপটে কখন মিলিত হবে তারা?

আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, সমস্ত অপরাধের ওপর পর্দা নেমে আসছে
আবার সমস্ত স্বচ্ছ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
পুনরাবৃত্তির জন্য রুজু করা হচ্ছে কেবল ভালোবাসা
হৃদয় থেকে হৃদয়ে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে
একটা টর্চের মতো

 

পাদটীকা: ১. চ্যাংজিয়াং নদী – চীনের মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইয়াংশি নদীর আরেকটা নাম। ২. কুনলুন পর্বতমালা – তিব্বত মালভূমির উত্তর দিক থেকে মধ্য চীন অবধি বিস্তৃত পর্বতমালা। একে পশ্চিম চীনের মেরুদণ্ড বলা হয়। ভৌগোলিক ও কিংবদন্তির দিক থেকে চীনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমালা। ৩. শুয়ান ব্রাশ – চাইনিজ ক্যালিগ্রাফি করবার জন্য ব্যবহৃত একধরনের তুলি, যা কালিতে ডুবিয়ে লেখা/আঁকা হয়। ৪. ধানকাগজ – গাছের ছাল কিংবা খড় দিয়ে তৈরি একধরণের মোড়ক, যা ধান প্যাকেটজাত করার কাজে ব্যবহার হয় বলে এরকম নাম। এটি অরিগ্যামি, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদি কাজে বহুল ব্যবহৃত হয়। ৫. লিখিত ইতিহাসের মধ্যে, শ্যাং সাম্রাজ্য চীনের প্রাচীনতম। ১৬০০-১০৪৬ খ্রীস্টপূর্ব সময়কালে তাদের বিস্তার, এটি চীনের ব্রোঞ্জযুগ হিসেবেও অভিহিত। এইসময় সে দেশে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, শিল্প ও সামরিক কলাকৌশল প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। ৬. স্টিলি অরণ্য (forest of Steles) – এটি উত্তরপশ্চিম চীনের শাংশি প্রদেশে অবস্থিত একটি যাদুঘর, যেখানে ১০৮৭ সাল থেকে পাথরফলকে খোদাই করা ছবি ও ভাস্কর্য সংরক্ষণ করা হয়ে আসছে। ৭. তাং অয়েল – তাং গাছের (চীন, মায়ানমার ও ভিয়েতনামের স্থানীয় গাছ) বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল যা আসবাব ও যন্ত্রপাতি বার্নিশ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment