নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ১৩

মানসিক বিপর্যয় কাল ও টাকশালের ওয়ার্ডেন পদ-প্রাপ্তি  

 

১৬৯৬-এ পাকাপাকি ভাবে কেমব্রিজ ছাড়েন নিউটন। বসবাস শুরু করেন লন্ডনে। কিন্তু কেমব্রিজ ছেড়ে যাওয়ার আগে, ১৬৯০-এর দশকের প্রথম কয়েক বছর ছিল তাঁর জীবনের বৌদ্ধিক চর্চার চূড়ান্ত অধ্যায়। এমন নিমগ্নতা, এমন আলোর ঝলকানি, এমন আত্মবিস্মৃতি, আবার গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া আগে কখনো ঘটেনি। আর কখনো ঘটবেও না পরবর্তী জীবনকালে। 

পার্লামেন্টে সদস্য পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, দ্বিতীয়বারের জন্য ১৬৯০-এ যখন নতুন করে উইলিয়াম ও মেরির পার্লামেন্ট গঠন করা হচ্ছে, তাতে সদস্য হতে চাইলেন না নিউটন। পার্লামেন্ট-কক্ষের অন্দরে তেরো মাসের যে অভিজ্ঞতা তা উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলেনি তাঁর ওপর। বরং ওই সময় লন্ডনের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মহলের সান্নিধ্য অনেকটাই বদলে দিয়েছে তাঁকে। নিজের চারপাশে যে কৃত্রিম গণ্ডি রচনা করে রেখেছিলেন এতকাল, যার জন্য গুটিকয় মানুষের বাইরে কারও সঙ্গেই সহজে মিশতে চাইতেন না, এবার যেন সেই গণ্ডি পেরিয়ে নতুন নতুন ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হলেন। সেই সব মানুষদের মধ্যে যেমন রয়েছেন ওই কালের প্রসিদ্ধ কয়েকজন বিজ্ঞানী, তেমনই আছেন রাজ-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরাও।  

রয়্যাল সোসাইটিতে যাতায়াতের সুবাদে, আলাপ হল জ্যোতির্পদার্থবিদ খ্রিস্টিয়ান হাইগেন্স-এর সাথে। ঠিক ওই সময় নেদারল্যান্ডস থেকে লন্ডনে আসেন হাইগেন্স। তাঁর রচিত ‘Treatise On Light’ বইটি প্রকাশের আগে রয়্যাল সোসাইটিতে এর বিষয়বস্তুর ওপর একটি বক্তব্য রাখেন। হাইগেন্স আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেন – মহাকর্ষের সঠিক কারণ অনুসন্ধান – The Cause of Gravity। 

রয়্যাল সোসাইটির সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন নিউটন। 

নিউটন জানেন, আলোকতত্ত্ব ও মহাকর্ষ, এই দুই বিষয় চর্চায় তাঁর সমকক্ষ যদি আর কেউ থেকে থাকেন তবে তিনি অবশ্যই হাইগেন্স। অপরদিকে নিউটনের এই সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ের কথা হাইগেন্সেরও অজানা নয়। সদ্য প্রকাশিত প্রিন্‌খিপিয়া পড়েছেন ইতিপূর্বেই। এক-কথায়, সতের শতকের এই দুই অগ্রগণ্য জ্ঞান-তাপস পরস্পর-পরস্পরের বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞার প্রতি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের মধ্যে একপ্রকার সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল। হাইগেন্স-এর ভাই কন্সটান্টাইন-এর ডায়েরি থেকে জানা যায়, কেমব্রিজের একটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে নিউটনের নাম মনোনয়নের জন্য রাজ-ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি মারফত চেষ্টাও করেছিলেন নাকি হাইগেন্স। যদিও সে-কাজে সফল হননি তিনি। অধ্যক্ষের পদলাভ হয়নি নিউটনের।     

দার্শনিক জন লক-এর সাথে নিউটনের পরিচয় হয় এই সময়টিতেই। দুজনের মধ্যে একাধিক পত্র বিনিময় হয়। এতকাল নিবিড় অধ্যয়নে, একান্তে, যে বিষয় চর্চায় ব্যয় করেছেন জীবনের প্রায় বিশটি বছর, কখনো যা প্রকাশ্যে আসতে দেননি, এবার সে-সব উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো একজন মানুষকে পেয়েছেন যেন। তিনি নিজে অ্যান্টি-ট্রিনিটারিয়ান। কিন্তু তাঁর ত্রিত্ববাদ-বিরোধী মনোভাবের কথা জানতে দেননি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে। কেমব্রিজে নিজ-কক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে নোটবুকের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন থিয়লজি গবেষণার সমস্তটুকুই।  

জন লকের পান্ডিত্যে আস্থাশীল নিউটন। একইসঙ্গে বিশ্বাসও করলেন লক-কে। ত্রিত্ববাদ বিরোধী ভাবনা প্রকাশ করলেন তাঁর কাছে। ত্রিত্ববাদের তীব্র সমালোচনা করে লেখা যে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ, “Historical Account”, তা পত্র মারফত পাঠালেন নিউটন। প্রবন্ধটি পড়ে তো লক বিস্মিত। বুঝলেন, সমগ্র ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস চর্চায়, পান্ডিত্যে, কেমব্রিজের গণিতের এই অধ্যাপকের সমতুল্য আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। পরবর্তীকালে নিউটন সম্পর্কে, তাঁর এক আত্মীয়কে লক লেখেন – “really a very valuable man, not only for his wonderful skill in mathematics, but in divinity too, and his great knowledge of the Scriptures, wherein I knew few his equals…”। 

শুধুমাত্র ধর্মতত্ত্ব নয়। লক ও নিউটনের আলোচনার অনেকখানি অংশ জুড়ে থাকে অ্যালকেমি গবেষণার খুঁটিনাটি। রবার্ট বয়েলের কথাও এসে যায় সে-প্রসঙ্গে। বয়েলের তীব্র সমালোচনা করলেন নিউটন। অ্যালকেমি সংক্রান্ত বয়েলের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পায় ফিলজফিক্যাল ট্রানজাকশন পত্রিকায়। বয়েল লেখেন, তিনি এমন এক বিশেষ জাতের পারদ তৈরি করেছেন যা নাকি সোনার সংস্পর্শে উত্তপ্ত হয়ে যায়। প্রবন্ধটি পড়ে নিউটনের বুঝতে অসুবিধা হয়-না যে বয়েল সম্পূর্ণ ভুল লিখেছেন। পারদ ও পারদঘটিত নানান যৌগ এবং এদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের বিক্রিয়ায় বিক্রিয়াজাত পদার্থ কী প্রকার হতে পারে তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কেইবা জানেন!  

লক-এর সঙ্গে নিউটন যখন এসব আলোচনা করছেন তার অল্পদিন আগেই রবার্ট বয়েল মারা গেছেন। ১৬৯২-এর জুলাই মাসে লককে লেখা নিউটনের একটি চিঠি পড়ে জানা যায়, বয়েলের অ্যালকেমি বিষয়ক কিছু কাগজপত্র লক পাঠিয়েছিলেন নিউটনকে। সেসব পড়ে  নিউটন বুঝলেন, বয়েল যে গাঢ় লাল রঙের পাউডার অর্থাৎ ‘রেড আর্থ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন তা আদৌ রসায়নাগারে প্রস্তুত করতে পারেননি বয়েল। পরের চিঠিতে নিউটন তাই  লককে নিষেধ করলেন যাতে এই বিষয়টি নিয়ে বৃথা অর্থ বা সময় কোনোটাই নষ্ট না করেন লক।   

লকের সঙ্গে শুধুমাত্র পত্র মারফত যোগাযোগ নয়। লক ওই সময় যেখানে থাকতেন, এসেক্সের সেই ওটস্‌ ম্যনর হাউসে বেশ কয়েকদিন কাটিয়েও আসেন নিউটন। এরপর কেমব্রিজে নিউটনের কাছে ঘুরে যান লক। গণিত বা বিজ্ঞান নয়। দুজনের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসের কথা, তার পথ-ভ্রষ্টতার কথা। আর থাকে অপরসায়ন। বলা বাহুল্য, এ-দুটিই যে নিউটনের প্রধান সাধনার ক্ষেত্র। 

রয়্যাল সোসাইটির যে সভায় হাইগেন্স তাঁর বই-এর বিষয়বস্তুর ওপর বক্তব্য রাখেন, সেই সভায় নিউটন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নিকোলাস ফাতিও দে দ্যুইলার্‌। সুইস গণিতবিদ। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সেই গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করেছেন। রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে সদস্যপদ প্রদান করেছেন ইতিমধ্যেই। ফাতিও, হাইগেন্স-এর বন্ধু। সেই সূত্রেই লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সভায় উপস্থিত হওয়া এবং নিউটনের সঙ্গে পরিচয়। নিউটনের বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে উঠতে দেরি হল না ফাতিওর। ইংল্যান্ডে আসার আগে যে ফাতিও ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ‘কার্তেজিয়ান’, লন্ডনে কয়েকমাস কাটানোর পরই হয়ে উঠলেন ঘোরতর ‘নিউটনিয়ান’! এতদিন ছিলেন রণে দেকার্তের প্রাকৃতিক দর্শনে বিশ্বাসী। এবার কেমব্রিজের বিজ্ঞান সাধকের সংস্পর্শে গভীরভাবে প্রভাবিত ফাতিও। বন্ধুকে লেখা চিঠিতে ঝরে পড়ছে তাঁর সেই বিস্ময়, “le plus honnete homme (the most honest man) I know and the ablest mathematician who has ever lived…” – এমন সততা, এমন গাণিতিক দক্ষতা, ইতিপূর্বে কোনো মানুষের মধ্যে দেখেননি তিনি!      

অপরদিকে নিউটন খুঁজে পেলেন প্রতিভাবান বিশ্বস্ত এক বন্ধুকে। লন্ডনে এলে ফাতিও-র বাসায় মাঝে মধ্যে ওঠেন নিউটন। ওই সময় প্রিন্‌খিপিয়ায় কিছু ত্রুটি সংশোধন ও সংযোজন করে দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার কথা ভাবছেন নিউটন। এ-কাজে ফাতিও তাঁর সহযোগী। অবশ্য আরো অনেক কারণে ফাতিও-কে প্রয়োজন তাঁর। আলোক তত্ত্ব বিষয়ক হাইগেন্স-এর বইটি প্রকাশ পায় ফরাসি ভাষায়। হাইগেন্স তাঁর বই উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন নিউটনকে। ফরাসি ভাষায় লেখা বইটির পাঠোদ্ধারে ফাতিওর সাহায্য প্রয়োজন। সেজন্য এই সময় ফাতিও-র লন্ডনের বাসায় থেকেছেন কয়েক মাস। মাঝে মধ্যে ফাতিও গেছেন কেমব্রিজে নিউটনের কাছে।  

 

হাইগেন্স ও লাইবনিৎজ অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন কেমব্রিজের বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে। এই দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে নিউটনের প্রধান সংযোগরক্ষাকারী হয়ে উঠেছিলেন ফাতিও। মহাকর্ষের কারণ এবং ক্যালকুলাস নিয়ে নিউটনের কী ভাবনা, অথবা আলো প্রকৃতিগতভাবে তরঙ্গ, নাকি কণার স্রোত, এ-বিষয়ে নিউটনের ঠিক কী অবস্থান, তা জানার মাধ্যম তো ফাতিও-ই।   

এই কালটিতে ফাতিও-র ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন নিউটন। শুধুমাত্র গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শন নয়। এই নবীন বন্ধুর সাথে অ্যালকেমি বিষয়েও আলোচনা করেন নিউটন। ফাতিও যেন তাঁর ছায়াসঙ্গী। 

নিঃসঙ্গ বিজ্ঞানীর এমন বন্ধুলাভ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। হঠাৎই যেন সুর কাটলো। 

১৬৯২-এর একেবারে শেষদিকে ফাতিও-র একখানি চিঠি হাতে পেলেন নিউটন। অল্পদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ঘুরে গেছেন ফাতিও। চিঠিতে লিখেছেন – ‘আপনার সাথে আর দেখা হওয়ার আশা নেই। কেমব্রিজ থেকে আসার পর ঠাণ্ডা লেগে আমার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। ফুসফুস সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত… ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই যে এমত অবস্থাতেও আমার অন্তরাত্মা সম্পূর্ণ শান্ত, আর এর জন্য আপনার ভূমিকাই প্রধান… আমার অনুরোধ, যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার বড় ভাই যিনি অতীব সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি, তিনি যেন আমার স্থলাভিক্ত হয়ে আপনার বন্ধুত্ব লাভ করেন।’ 

প্রত্যুত্তরে উদ্বিগ্ন নিউটন লিখলেন – ‘গতরাতে তোমার চিঠি পেয়ে কী পরিমাণে যে চিন্তিত হয়েছি তা প্রকাশ করার ভাষা নেই। একটুও দেরি না করে চিকিৎসকদের পরামর্শ নাও, আর যদি অর্থের প্রয়োজন হয় জানাবে, আমি পাঠিয়ে দেবো …তোমার দ্রুত আরোগ্য প্রার্থনা করি – ইতি তোমার অনুরক্ত ও বিশ্বস্ত বন্ধু – আইজাক নিউটন।’ 

১৬৯৩ সাল। নিউটনের জীবনের ভয়ানক এক অধ্যায়। যাকে ‘a time of great emotional stress’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন জীবনীকার রিচার্ড ওয়েস্টফল। এক সাংঘাতিক মানসিক বিপর্যয়কাল। ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক ম্যানুয়েল, নিউটনের ‘ব্ল্যাক ইয়ার’ বলেছেন বছরটিকে। 

এই সময় লেখা নিউটনের কয়েকটি চিঠিপত্র এর সাক্ষী হয়ে আছে। তারা যেন প্রশ্ন করে, “বিজ্ঞানী, আপনি কি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন?”     

প্রথম যে চিঠিতে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেয়েছে সেটি স্যামুয়েল পেপিস-কে লেখা। এই স্যামুয়েল পেপিস-এর নাম অমর হয়ে আছে প্রিন্‌খিপিয়ার শিরোনাম পাতায়, যেখানে লেখক নিউটনের নাম আছে তার ঠিক নীচে জ্বলজ্বল করছে পেপিস-এর নাম। প্রিন্‌খিপিয়া যখন প্রকাশ পায়, সেই সময় রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন পেপিস। তাঁর অনুমোদনক্রমেই যে ছাপা হয় প্রিন্‌খিপিয়া। সেই পেপিসকে চিঠিটি পাঠালেন নিউটন। 

১৩ সেপ্টেম্বর, ১৬৯৩-এ লেখা সে চিঠির একটি অংশ এরকম – ‘এই মুহূর্তে অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমায় এবং গত বারো মাস না-খেতে পেরেছি, না-ঘুমতে পেরেছি। আর আগের মতো মানসিক স্থিতাবস্থাও এখন আমার নেই। আপনার উৎসাহে অথবা কিং জেমস-এর অনুগ্রহে কিছু লাভ (পদলাভ) করবো, এমন অভিপ্রায় কখনোই ছিল না আমার। ভেবে-চিন্তে ঠিক করেছি, এখনই আপনার পরিচিতি থেকে দূরে সরে যেতে হবে আমায় এবং আপনার সাথে বা অন্য বন্ধুদের সাথে আর কখনো দেখাও করবো না।’* 

স্পষ্টত, চিঠিটি নিউটন যখন লিখছেন তখন মানসিক দিক থেকে একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই তিনি। চিঠি লেখার দু-একদিনের মধ্যেই লন্ডনে যান নিউটন। অন্য সময় সেন্ট্রাল লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার-এর কাছাকাছি কোথাও থাকেন। এবার শহরতলি এলাকা, শোরডিচ (Shoreditch)-এর একটি হোটেলে এসে ওঠেন নিউটন। ঠিক কী কারণে শোরডিচ গিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। সেখান থেকেই জন লককে একখানি চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিতেও মানসিক ভারসাম্যহীনতার ছাপ স্পষ্ট। 

লকের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনলেন নিউটন – ‘নারীদের সাথে ও অন্যভাবে ঝামেলায় জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আপনি এবং এতে এতটাই বিচলিত হয়েছিলাম যে যখন কেউ একজন বলে যে আপনি অসুস্থ, হয়তো আর বাঁচবেন না, তখন আমি বলেছিলাম আপনি মারা গেলেই ভাল। এই অকৃতজ্ঞতার জন্য আশাকরি ক্ষমা করবেন আমায়।’**    

এমন অপ্রত্যাশিত চিঠির ভাষায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন পেপিস ও লক উভয়েই। 

পেপিস তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তিকে নিউটনের মানসিক অবস্থার খোঁজ নিতে পাঠালেন। নিউটনের সঙ্গে দেখা করলেন সেই ব্যক্তি এবং পেপিসকে জানালেন, ‘দেখা হওয়া মাত্রই নিউটন বললেন, আপনাকে একখানি অস্বাভাবিক চিঠি পাঠিয়ে ফেলে ভীষণ চিন্তিত রয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন যে মানসিক ভাবে ভাল ছিলেন না (“was in a distemper”), যে-কারণে টানা পাঁচ রাতেরও বেশি সময় অনিদ্রায় রয়েছেন এবং তাঁর এই চিঠির জন্য আমার মাধ্যমে মার্জনা প্রার্থনা করেছেন।’    

সেই ব্যক্তি আরও জানালেন, ‘নিউটন অনেকটাই ভাল আছেন এখন। তবে কিছুটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাঁকে। যদিও এজন্য তাঁর চিন্তাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সন্দেহ করার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’   

অর্থাৎ, এ-কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওই সময় এক বা একাধিক কারণে বিষণ্ণতা, অবসাদ, এ-সব তাঁকে গ্রাস করেছিল। কিন্তু কখনোই তিনি উন্মাদ হয়ে যান নি। 

কিছুটা যেন মানসিক সুস্থতা পরীক্ষা করতেই পেপিস, একখানি গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পাঠালেন নিউটনকে।  

সমস্যাটি সম্ভাবনা তত্ত্বের। পাশার চাল সংক্রান্ত। পেপিস তিনটি ভিন্ন প্রকার চালের কথা বললেন এবং জানতে চাইলেন কোন ক্ষেত্রে সম্ভাবনা সর্বাধিক। প্রথম ক্ষেত্রে, A-ব্যক্তি ছটি পাশার চাল দিয়ে কমপক্ষে একবার ছক্কা লাভ করবেন, তার সম্ভাবনার হিসাব। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, B-ব্যক্তি বারোটি পাশার চাল দিয়ে কমপক্ষে দুবার ছক্কা লাভ করবেন, তার সম্ভাবনার হিসাব। তৃতীয় ক্ষেত্রে, C-ব্যক্তি আঠারোটি পাশার চাল দিয়ে কমপক্ষে তিনবার ছক্কা লাভ করবেন, তার সম্ভাবনার হিসাব।  

পেপিস-এর মনে হয়েছিল, তৃতীয় ক্ষেত্রটির সম্ভাবনা সর্বাধিক। ঠিক চার দিনের মাথায় চিঠির উত্তর এসে পৌঁছল পেপিসের কাছে। সংক্ষিপ্ত চিঠি। পেপিস যেভাবে সমস্যাটির বর্ণনা দিয়েছেন তা নিউটনের পচ্ছন্দ হয়নি। গণিতের ভাষায় নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছেন (ওপরে নিউটনের বর্ণনার অনুরূপেই সমস্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে)। এরপর নিউটন লিখেছেন যে সমস্যাটিকে যদি এভাবে দেখা হয় তাহলে প্রথম ক্ষেত্রের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। পরিশেষে যোগ করেছেন, পেপিস যদি চান তিনি সম্পূর্ণ গণনাটি দেখার জন্য পাঠিয়ে দেবেন।  

পেপিস ধন্যবাদ জানালেন নিউটনকে। সেই সঙ্গে লিখলেন, যদিও গণিতে তেমন পারদর্শী নন তিনি তবুও গণনাটি দেখতে ইচ্ছুক। 

প্রত্যুত্তরে, পরের চিঠিতেই নিউটন অংক কষে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঠিক কি কারণে এবং কত মানে প্রথম ক্ষেত্রের সম্ভাবনা অপর দুটির চেয়ে বেশি হয়।  

সম্ভাবনা তত্ত্বের এই গাণিতিক আলোচনা আরো দুটি চিঠির আদান-প্রদান পর্ব পর্যন্ত গড়ায়। নিউটন কেন এত সময় ব্যয় করলেন গণিতের ‘সামান্য’ এই সমস্যাটির জন্য? দশ বছর আগে হলে পেপিসের এ-চিঠির কোনো উত্তর কি দিতেন? স্পষ্টত, দশ বছর আগের নিউটন আর এই নিউটনের মধ্যে এখন বিস্তর ফারাক। সরকারি উচ্চ-পদপ্রাপ্তির আশা মনের মধ্যে কোথাও যেন বাসা বাঁধছে। আর তাই, পেপিস-এর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চান-না। পাশাপাশি আরো একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হল, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৬৯৩-এ পেপিসকে যে চিঠি পাঠিয়েছেন তার জন্য অনুতপ্ত ছিলেন তিনি এবং সচেষ্ট হয়েছিলেন সম্পর্ক মেরামতিতে।   

তবে পেপিস নিশ্চিন্ত হলেন যে, তাঁর গবেষক বন্ধুটির মস্তিষ্ক অটুট আছে। তুলনাহীন মেধার হানি ঘটেনি ছিটেফোঁটাও।   

অপরদিকে, চিঠি পাওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই, উদ্বিগ্ন লক নিউটনকে লিখলেন, ‘আশাকরি আমি আমার অতি মূল্যবান বন্ধুটিকে হারিয়ে ফেলিনি (hopes I have not lost a friend I so much valued)’।  

উত্তরে নিউটন তাঁর দীর্ঘ অনিদ্রার কথা জানিয়ে লককে লিখলেন, ‘আপনাকে যে লিখেছিলাম তা মনে করতে পারছি, কিন্তু আপনার বই নিয়ে ঠিক কী লিখেছিলাম তা মনে করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে চিঠির সেই অনুচ্ছেদের একটি প্রতিলিপি যদি পাঠাতে পারেন তাহলে আমি বলতে পারবো কীজন্য লিখেছিলাম।’ 

নিউটনের এমন উদাসীন নিরুত্তাপ উত্তরে, সম্ভবত আহত হয়েছিলেন লক। কারণ, এরপর দীর্ঘদিন নিউটনকে আর কোনো চিঠি তিনি লেখেননি।     

নিউটনের এই মানসিক বিপর্যয়ের খবর রটে গিয়েছিল সমগ্র ইউরোপে। আর তাতে রঙ চড়ে যায় অতিমাত্রায়। 

জনৈক স্কটিশ সংবাদদাতার কাছে হাইগেন্স শুনেছিলেন, আগুন লেগে নিউটনের সমস্ত লেখাপত্র ও গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি পুড়ে যাওয়ায় নিউটন নাকি উন্মাদ হয়ে যান এবং অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন দীর্ঘ আঠারো মাস! হাইগেন্স সে-খবর দেন লাইবনিৎজ-কে। যদিও এ খবরের সত্যতা নিয়ে সংশয়ী ছিলেন লাইবনিৎজ। তিনি জানতেন নিউটনের অতিমানবীয় গাণিতিক দক্ষতা সম্পূর্ণ অটুট রয়েছে।     

অ্যালকেমিস্টদের অগ্নি-সংযোগের মতো ঘটনা, সেকালে মোটেও বিরল ছিল না। নিউটনের কেমব্রিজের বাসায় এক বা দু-বার যে আগুন লেগেছিল সে তথ্য পাওয়া যায়। ১৬৯০-এর প্রথমদিকের তারিখ উল্লেখিত, প্রিন্‌খিপিয়ার পরবর্তী সংস্করণের জন্য সংশোধন-সংযোজন সম্বলিত কিছু আংশিক পোড়া কাগজপত্র ও প্রিন্‌খিপিয়ার একটি অল্প পোড়া খন্ড, সংরক্ষিত আছে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে (MS Add. 3965.6)। যে প্রশ্নের উত্তর মেলে না তা হল, ওই সময় গণিত অথবা আলো নিয়ে নতুন কোনো আবিষ্কার করেছিলেন কিনা নিউটন। সেই সংক্রান্ত পান্ডুলিপি পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেই কি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? 

ঠিক কী কারণে ভারসাম্য হারিয়েছিলেন নিউটন?  

এ-বিষয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত।  

নিউটন নিজে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা যথেষ্ট নয়। অনিদ্রা একমাত্র কারণ হতে পারে না। গবেষকদের মতে, অমানুষিক পরিশ্রম, আর সেই সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের গবেষণার ফসল, ‘a new mathematical essay’ এবং ‘Optics’, গণিত ও আলোকবিদ্যার ওপর তাঁর এই দুই গ্রন্থ প্রকাশ ঘিরে যে অনিশ্চয়তা, এসবের জন্য মানসিক ভাবে এমনিতেই বিপর্যস্ত ছিলেন নিউটন। এরই পাশাপাশি সরকারি উচ্চপদ লাভে ব্যর্থতা জন্ম দিয়েছে চরম হতাশার।  

ঠিক ওই সময়ই, ফাতিও দে দ্যুইলার্‌-এর শারীরিক অসুস্থতার কারণে, হঠাৎ করেই তাঁদের যৌথ গবেষণার পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। এমন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সান্নিধ্য হারিয়ে, নিউটন যে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিলেন তা তাঁর চিঠিতেই স্পষ্ট ধরা পড়ে।  

অপর একটি বহুল প্রচলিত মত হল, দীর্ঘকাল অপরসায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর সময়,  লেড ও মার্কারির মতো ‘হেভি মেটাল’-এর বাষ্পের সংস্পর্শে বিষক্রিয়া ঘটে, যার ফলে অনিদ্রা, বদহজম, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, প্যারানয়েড চিন্তা, এসবের শিকার হন নিউটন। মৃত্যুর পর স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল এই মহামানবের এক গুচ্ছ মাথার চুল। ১৯৭৯ সালে, ‘নিউট্রন অ্যাক্টিভেশন’ ও ‘অ্যাটমিক অ্যাবজর্বশান অ্যানালাইসিস’, এই দুই আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত  চুল পরীক্ষা করে, এক গবেষণায়, মার্কারির অতিরিক্ত (স্বাভাবিক মাত্রার প্রায় চল্লিশ গুণ বেশি) উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

তবে এই ‘হেভি মেটাল’ তত্ত্ব সঠিক হতে পারে না বলেই আধুনিক জীবনীকাররা মনে করেন। কারণ, মার্কারির ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। অপরদিকে, অল্পদিনের মধ্যেই নিউটন কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন তাঁর মানসিক বিপর্যয় দশা। এবং আরও চৌত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন, মানসিক ও দৈহিক উভয় দিক থেকেই, ভরপুর প্রাণশক্তি নিয়ে। ১৯৭৯-র পরীক্ষায়, অতিরিক্ত মাত্রার মার্কারি, লেড, আর্সেনিক ছাড়াও স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় তিনশো গুণ বেশি সোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মানুষটি যে একজন ঘোরতর অ্যালকেমিস্ট ছিলেন, তা জানার জন্য এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিই-বা হতে পারে!   

নিউটনের মানসিক বিপর্যয়ের আর একটি সম্ভাব্য কারণ, তাঁর স্বতন্ত্র ধর্ম বিশ্বাস। ‘গৌরবময় বিপ্লব’-পরবর্তী অধ্যায়ে আরিয়াসের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের অর্থাৎ ‘আরিয়ান’দের ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করা হল। নিউটন নিজে যে ‘আরিয়ান’, সে কথা তাঁর দু-একজন নিকট বন্ধুরাই কেবলমাত্র জানেন।   

স্পষ্টত, লুকাসিয়ান প্রফেসরের পদ ছেড়ে উচ্চতর কোনো সরকারি পদ প্রাপ্তির জন্য যে, অপ্রিয় ‘ভ্রান্ত’ শপথ গ্রহণ করতে হবে তা নিয়ে ভয়ানক শঙ্কিত নিউটন। একদিকে উচ্চ-পদলাভের হাতছানি, অপরদিকে নিজস্ব ঈশ্বর চেতনা। এই দ্বন্দ্বজাত মানসিক পীড়ায় নিউটনকে যে দগ্ধ হতে হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। প্রসঙ্গত, খ্রিস্টিয় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, সমসাময়িক বিজ্ঞানী, রবার্ট বয়েল অথবা দার্শনিক, জন লক, এঁদের মতোই নিউটনও, ইংল্যান্ডের চার্চের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি আজীবন। যদিও, ইংল্যান্ডের অ্যাংগলিকান চার্চের ধর্মাচরণের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব হল ত্রিত্ববাদ, যা ‘আরিয়ান’দের একেশ্বরবাদের বিপ্রতীপে অবস্থান করে। 

নিউটন যে অল্পদিনের মধ্যেই মানসিক বিপর্যয় দশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন, তার একাধিক প্রমাণ আছে। 

১৬৯৪-এর গ্রীষ্মে, বেশ কিছুদিন, স্কটিস গণিতজ্ঞ ডেভিড গ্রেগরি, নিউটনের বাসায় থেকে সাহায্য করেন প্রিন্‌খিপিয়ার সংশোধন ও পরিমার্জনে। গ্রেগরি জানান, নিউটন যে সকল বিষয়ে কাজ করতেন, আলোচনা করতেন, তার সাথে তাল মিলিয়ে নোট নিতে প্রায়শই পিছিয়ে পড়তেন তিনি। এর অর্থ, দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণই ছিল ওই সময় নিউটনের।     

ইতিপূর্বে, ১৬৯০-এ, ফাতিও-কে প্রিন্‌খিপিয়ার ভুল-ত্রুটির একটি তালিকা পাঠান নিউটন। ১৬৯২ নাগাদ ফাতিও-র সহযোগিতায়, প্রিন্‌খিপিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার পরিকল্পনাও ছিল নিউটনের। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। 

১৬৯৩ ও ১৬৯৪, এই দু-বছর, প্রিন্‌খিপিয়ার ত্রুটি সংশোধন ও বেশ কয়েকটি নতুন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি, এবং একইসাথে, গণিত ও অপরসায়ন চর্চায় চূড়ান্ত ব্যস্ত ছিলেন নিউটন। ওই সময়ই আবির্ভাব ঘটে গ্রেগরি-র। ১৬৯৪-এর শেষদিকে গ্রেগরি চিঠি লিখছেন নিউটনকে এই বলে যে, দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার ভাবনা এগিয়েছে জেনে খুব খুশি হয়েছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে, নতুন বিষয়ের সংযোজন ও চাঁদের গতির সঠিক ব্যাখ্যাদানের চেষ্টায়, আরো আঠারো বছর পিছিয়ে যায় প্রিন্‌খিপিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশ।

ঠিক ওই বছরই, অর্থাৎ, ১৬৯৪-এ, ‘অপটিক্স’ গ্রন্থটি প্রকাশ করার কথা ভেবেও পিছিয়ে যান নিউটন। শেষপর্যন্ত ‘অপটিক্স’ প্রকাশিত হয় ১৭০৪-এ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ঠিক আগের বছরই, ১৭০৩-এ, মারা যান রবার্ট হুক। সম্ভবত নিউটন তাঁর এই তীব্র সমালোচক ‘বন্ধু’-র জীবদ্দশায়, ‘অপটিক্স’ প্রকাশ লাভ করুক, তা চাননি। 

১৬৯৫ সাল জুড়ে, চাঁদের গতির সঠিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লাগলেন নিউটন। পাতার পর পাতা অংক কষেন। তবুও কিছুতেই যেন চাঁদের কক্ষপথের বিচলনের হিসেব মেলাতে পারেন না। চাঁদের গতির অসঙ্গতির ব্যাখ্যা অধরাই রয়ে যায়। নিউটনের স্থির বিশ্বাস, এর সমাধান তাঁর হাতেই হবে। কেবলমাত্র আরো সঠিক পর্যবেক্ষণ, আরো উচ্চমানের তথ্যের প্রয়োজন। 

গ্রেগরিকে সঙ্গে নিয়ে, লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্বে গ্রীনিচ-এ যে রয়্যাল অবজারভেটরি অর্থাৎ মানমন্দির রয়েছে সেখানে গেলেন নিউটন। ১৬৯৪-এর শেষদিক তখন। অবজারভেটরির দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল জন ফ্ল্যামস্টিড। ইতিপূর্বে, দুটি ধূমকেতু ও বৃহস্পতির উপগ্রহদের সময় নিরিখে অবস্থান জানতে, একাধিকবার ফ্ল্যামস্টিড-এর সাহায্য নিয়েছেন নিউটন। তখন তিনি মহাকর্ষ সূত্র প্রতিষ্ঠা করছেন প্রিন্‌খিপিয়ার পাতায়।

এবার ফ্ল্যামস্টিড-এর পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য, দেখতে চাইলেন নিউটন। চাঁদের প্রায় পঞ্চাশটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মান, নিউটনের হাতে তুলে দিলেন ফ্ল্যামস্টিড। কথা দিলেন, চাঁদের আরো একশটি অবস্থানের পরিমাপ পাঠাবেন তিনি। 

দুজনের মধ্যে, পত্র মারফত আলোচনা চলতে থাকে পরবর্তী আট মাস। পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া চাঁদের অবস্থানের মান পাঠাতে থাকেন ফ্ল্যামস্টিড। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে নিউটন চেষ্টা করেন ‘পারফেক্ট লুনার থিয়রি’ গড়ে তোলার। কিন্তু বারে-বারে ব্যর্থ হন চাঁদের গতিতত্ত্বের রূপদানে। বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ নিউটনের মনে হতে থাকে, ফ্ল্যামস্টিড সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না তাঁকে। ইচ্ছে করেই গোপন করছেন বেশ কিছু সঠিক মান।  

অপরদিকে, ফ্ল্যামস্টিডেরও অপমানজনক লাগে নিউটনের ব্যবহার। নিউটনের চিঠির ভাষায় কেমন কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বর। এই গবেষণায় জ্যোতির্বিদ হিসাবে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতেই চান না নিউটন। দুজনের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে ক্রমশ। 

১৬৯৫ সাল-ই হল বহু-চর্চিত নিউটন-ফ্ল্যামস্টিড বিবাদের সূত্রপাতের বছর। চাঁদের গতিতত্ত্বের রূপদান স্থগিত হয়ে যায় তখনকার মতো।    

১৬৯৬-এর বসন্তে, একখানি চিঠি হাতে পেলেন নিউটন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির একসময়ের সহপাঠী ও বন্ধু, চার্লস মন্টেগু পাঠিয়েছেন চিঠিটি। রাজকোষাগারের চ্যান্সেলর পদে উন্নীত হয়েছেন মন্টেগু অল্পদিন আগেই। যে কোনো সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে, অনেকটাই ক্ষমতা ধরেন এখন। রয়্যাল মিন্টের ওয়ার্ডেন পদে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেছেন নিউটনের জন্য তিনি। চিঠিতে, ‘ওয়ার্ডেন অফ দ্য মিন্ট’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মন্টেগু। 

কিন্তু, গবেষণা ছেড়ে, অধ্যাপনা শিকেয় তুলে, টাকশালের কোনো প্রশাসনিক পদে যোগ দেবেন তো নিউটন?  

পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন কেমব্রিজে। সেখানে আর এমন কিই-বা আছে যার আকর্ষণে থাকবেন তিনি? কেমব্রিজের শিক্ষিতমহল কখনোই সেভাবে টানেনি তাঁকে। সহকর্মীদের থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়েই রাখতেন দূরে। কেমব্রিজ তাঁকে দিয়েছিল অধ্যয়নের অনুকূল পরিবেশ। গবেষণার একান্ত অবসর। কিন্তু জোয়ারের কাল যে এসেছেন পেরিয়ে। গবেষণায় এখন ভাটার টান। পঞ্চাশোর্ধ তিনি।    

মন্টেগুর প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন নিউটন। 

এক মাসের মধ্যেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে, তল্পিতল্পা বেঁধে, কেমব্রিজ ছেড়ে, তুলনায় নিম্নতর প্রশাসনিক পদ, ‘ওয়ার্ডেন অফ দ্য রয়্যাল মিন্ট’-এ যোগ দিতে চললেন রাজধানী লন্ডন শহরে। লুকাসিয়ান প্রফেসর পদ এবং ফেলোশিপ তখনই ত্যাগ করলেন না। আরো পাঁচটি বছর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসর রয়ে যাবেন তিনি। যদিও এই পাঁচ বছরের মধ্যে মাত্র একবারই ফিরবেন কেমব্রিজে, তাও অর্ধ-সপ্তাহ কালের জন্য।  

(চলবে)

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall – Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. A. R. Hall – Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
  3. Issac Newton as a Probabilist – Stephen M. Stigler, Statistical Science, 2006, Volume 21, No 3, pp 400-403.
  4. Newton’s ‘derangement of the intellect’. New light on an old problem P. E. Spargo and C. A. Pounds, Notes Rec. R. Soc. Lond. 1979, Volume 34, pp  11-32

* ‘I am extremely troubled by the embroilment I am in, and have neither ate nor slept well this twelve month, nor have my former consistency of mind. I never designed to get anything by your interest, nor by King James’s favour, but am now sensible that I must withdraw from your acquaintance, and see neither you nor the rest of my friends any more…’

** ‘Sir, being of opinion that you endeavoured to embroil me with woemen & by other means I was so much affected with it as that when one told me you were sickly & would not live I answered twere better if you were dead. I desire you to forgive me this uncharitableness.’

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment