সিদ্ধার্থ মাইতি

কিস্যা কাহানি কা

 

‘ভাদ্র মাস যায় মিছে মিছে কথা না শুনে’ – এ জনশ্রুতি, জনসংস্কৃতি জনজীবনের এক খাঁটি আয়নার মতো। মিছে কথা।

শুনতেই হয় ভাদ্রমাসে। তার মানে কি আশ্বিন থেকে শ্রাবণ সব সত্য কথা? অসত্য শুধুই ভাদ্র মাসে! মনে পড়ে ‘এ মাহ ভাদর এ ভরা বাদর? হ্যাঁ, ভাদ্রের ভরা বর্ষায় কাদা প্যাচপ্যাচে পথঘাট, টইটম্বুর মাঠপাথার। বুড়ি অঞ্জুমান বানু বলছিলেন এ সময় নদী বড়ো  ফেঁপে ওঠে, পোয়াতির মতো ভরে যায়। সে সময় ছেলে-বুড়ো মেয়ে-মদ্দ সব ঘরবন্দী। কাজহীন নিস্তরঙ্গ জীবনে তখন রঙ্গরসিকতা, শোলোক-কাহানি, আলকাপ, কবিগান। মিছে কথা মানে গল্প কথা, কিস্যা, কাহানি… শোলোক বলা দিদির খোঁজ পড়তো সত্যিই চাঁদ উঠুক বা না উঠুক। তবে রাতের মিছে কথার যোগানদার আজও ডাক পান। সে কথার কথক পুরুষ। সে কাহানিওয়ালা। আর শোলোক বলা দিদিরা রসের গল্প বলতেন শুধুই মেয়েদের মহলে, যেখানে পুরুষ বা শিশুরা অবশ্যত্যাজ্য। তা বলে কি পুরুষের রসের টান পড়লে তারা রসের গল্প বা কাহানি শুনতেন না যে আসরে মেয়েদের, ছোটদের প্রবেশ নিষেধ? লোকসংস্কৃতি পন্ডিত শক্তিনাথ ঝা তাঁর গবেষক ছাত্রী মৌসুমী মজুমদারকেও সঙ্গে নিতে পারেননি পুরুষের রসের কাহানি শোনার আসরে। মৌসুমী প্রায় পাঁচশ কাহানি সংগ্রহ করেছেন তাঁর পিএইচ.ডি কাজের পরিসরে। ১০০ গল্প ছেপে বেরিয়েছে। ‘দোজখনামা’ মনে পড়ছে আপনাদের? পুরানা লক্ষ্ণৌ-এর ফরিদ মিঞা নমাজ পড়ার ভঙ্গীতে হাঁটু মুড়ে বসে অগুন্তি তবায়েফের জীবন বিবৃত করতে করতে লেখককে কিস্যার ভাঙ্গা মজলিসে টেনে নিয়ে যান। কিস্যা লেখার দায় আল্লাহ্ যাঁকে দিয়েছেন সে মানুষ বড়ো একা। সে পাগল হয়ে বাঁচে ছায়া ছায়া আদমসুরত-এর অস্পষ্ট কোলাহলে। তিনি দাস্তানের সাদাত হোসেন মান্টোকে চেনান। সে আজিব দাস্তান বয়ে যেতে থাকে, পূর্ণচ্ছেদে ফুরোয় বা নভেলের শেষ পাতা। সে পৃষ্ঠার উপাখ্যান হাজির হয় না কোনওদিন। সে দাস্তান বা তার আগের কিস্যায় মহরম মানে ফরিদ মিঞার মৃত্যুর উপত্যকার ফিসফাস। 

    মুর্শিদাবাদে এসে মহরম ঘিরে জারিগান যে লোকজীবনের জনঅস্তিত্বের পারস্পরিক সংঘর্ষের ট্র্যাজিক গাথা জানতে জানতে সিরাজি নবাবী ও তাঁর বেদনগাথা, বিশ্বাস অবিশ্বাস, ক্ষমতা-অক্ষমতার অবিরাম দাস্তান হয়ে উঠতে পারে এ ঘনঘোর রোমান্টিক বিশ্বাসে বাগড়ি (ভাগীরথীর পূর্ব পাড়) ছেঁকে ফেলে হতাশ হয়েছিলাম। দোর্দণ্ড সাংবাদিক হাতেমুল ইসলাম সে হতাশা কাটিয়ে নিয়ে গেছিলেন হরিহরপাড়ার পেছনে ছুঁয়া পীরতলার আজিজ শেখের কাছে। আশির ওপরে বয়স, আজিজ শেখ শেষ কাহানি বলেছেন প্রায় বাইশ বছর আগে। একটা নাতি চোখে দেখতে পেতো না, তার আঁধারে রং ফোটাতে আজিজ নানান কাহানি জানাতেন, শোনাতেন প্রিয় নাতিকে। সেসব প্রাত্যহিক নাতি-সোহাগ থেকেই তাঁর গুরু এলাকার নামকরা কাহানিওয়ালা নূর আলম শেখের দোহার বনে যাওয়া। আজিজ শেখ দুঃখ করেন, “আর তো গাইতে পারি না ভাই! বয়স হয়েছে, চোখে জোর নাই, দাঁত মাত্র তিনটে আর কি গান গাওয়ার দম পাই!” তবু বলি তাঁকে, “এত দূর থেকে এলাম আপনার কথা শুনতে, আর না শুনে ফিরে যাবো!” – তখন আজিজ শেখ সাদা দাড়ি দুলিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে দাওয়া থেকে বেরিয়ে খড় ছোড়ানো উঠোনে একটা খাটিয়া টেনে বসলেন আর ফোকলা মুখে রসিকতা করে বললেন, “কাহানিওয়ালা লোকের বাড়ি যায়, লোক কি তার বাড়ি আসে!” এর মধ্যে বড় ছেলে দেদার শেখ বলে উঠলেন, “বইসেন না দাদা, চা আনি।” খেয়াল করলাম আজিজ শেখ ঘাড় গুঁজে বসে আছেন। মনে হল যেন আমাদের পাশে নেই তিনি। সঙ্গী সৌরভ হোসেন তার অল্প বয়সের, তখনও সে বাংলা সাহিত্যে প্রতিশ্রুতিমান কিস্যাওয়ালা হয়ে ওঠেনি এবং পাছে আমার ফিরতে দেরি হয়ে যায়, তাড়া দিতে বলে উঠল, “চাচা, দু-এক লাইন বলে দাও না, এতো কী ভাবছ!” আজিজ শেখ যেন তাতে খানিক রুষ্ট হলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজ থাক, আপনি আরেকদিন আসেন।” তারপর সৌরভের দিকে প্রায় ধমকের গলায় জানালেন, “সারা রাইত ধর্যে কাহানি বলা হতো, তুমি কী বলো দু-তিন লাইনে কাহানি বলব! এভাবে হয় না। তোমরা কী মনে কর! আমার দোহার নাই পাশে। গান গাইতে দোহার লাগে। মহররমের গলা বড়ো মিঠে। ভাই, আপনাকে বলি, মহররম শেখ আমার দোহার। সে ঐ দোস্তপুরে থাকে। তাকে খবর দিয়ে রাখবো, আপনারা আরেকদিন ফোন করে আসবেন।

দেদার, তোর নাম্বার বাবুরে দিয়ে রাখ।” দেদার প্লেটে ডিম সেদ্ধ আর এক কাপ চা দিল। আমরা চুপচাপ দেখে আজিজ বললেন, “আপনি বোঝেন আমি শেষ কাহানি বলেছি, কবে যেন?” দেদার বলল, “তা সে ১৫ বছর হবে।” 

“নাহ্, আরো আগে” – বলে বাধা দিলেন। “ঐ যে ঐ বাড়িগুলো দেখছেন, তার পরে একটা বড় মাঠ আছে। সন্ধেবেলা শুনলাম কে একজন কাহানিওয়ালা আইসবে। গিয়ে দেখি, ছেলে-ছোকরারা স্টেইজ কইরেছে চার ফুট উঁচু, তার উপরে তিনজন, দুইটা দোহার, একজন কাহানিওয়ালা। ভাইবলাম, দেখি কেমন কাহানি বইলে। চাঁদ উঠতে শুরু করলে সে বইলছে আরব্য রজনীর কাহানি! সিন্দাবাদের কাহানি! শুইনছি আর দেইখছি সামনে যারা রয়েছে সে দুশো-আড়াইশো লোক কেমন এদিক ওদিক কইরছে যেন মন নাই কাহানিওয়ালার কাহিনিতে। আমার মন খারাপ হল। উঠে পইড়লাম কোলে সেই ছোট নাতিকে নিয়ে। মনে হছিল, যে কাহানি বইলছে, তার যেন মন নাই। সে যেন কথা বইলছে দোহারের সঙ্গে। দোহাররা গান গাইছে যেন গাইত হয় তাই। দেখেন কর্তা, কাহানিওয়ালার যদি মন না থাকে, যারা শুইনতে আসছে তাদের কি মন লাইগবে? তা আমি উঠে চলে আসার পথে মনে হল – এই ছেইলেরা জড়ো হয়েছে কাহানি শুইনতে তাদের কী মনে হবে! সেডাই কাহানি। গুরুর কথা মনে হলো, নুর মহম্মদের দোহার আমি, সে বইলতো, কাহানিওয়ালারা ভাদ্র মাসভর লোকের ডাকে তাদের বাড়ি যাই, লোকের বাড়ির উঠোনে মেইয়েছেলে, বেটা-বেটিরা সব পাটি পেতে বইসে পড়ে, আমরা কাহানি শুরু করার আগে তারা খেইয়ে দেইয়ে আসে। রাতভোর কাহানি শুইনে তাদের মন ভালো হয়, আমাদের কথা শুইনতে তারা সারারাত ঠায় বইসে থাকে কতো আনন্দের কথা ভাবিস আজিজ! তো আমি সেই দিন স্টেজের কাছে ফিরে গেলাম। বইললাম, তোমাদের মন নাই তো কাহানি বইলছো কেন? আর কাহানি আবার কবে কোথায় স্টেজে বলা হইয়েছে! থামো! আমি তোমাদের কাহানি শোনাই। সবাই দেইখলাম আমার কাহানি শুইনতে চায়। আর সে ছেলে, মানে যে কাহানি বলছিল, সেও বলল – আমি চাচা কবিগান করি। এরা আমায় বইললো কাহানি শোনাতে, স্টেজে বসে কাহানি শোনাতে হবে। তা আমি কাহানি কইরতে এলাম – এই বইলতে বইলতে সে স্টেজ থেকে নেইমে এলো। আমি কোলের নাতি রেখে সেই দুশো-আড়াইশো লোকের সামনে বইসে পড়লাম। ওরাও জায়গা দিল আর দোহার ছেইলে দুটো আমার পাশে মাথা নীচু করে বইসে রইল। আমি নতুন করে ধইরলাম সিন্দাবাদ নাবিকের কাহানি। দোহারেরা সাথ দিতে লাইগলো। সামনের শ্রোতারা চুপ। ছেইলে যতো জুটেছিলো, সবাই সবাইকে থাইমতে বলল। আমার সেই রাতে শেষ কাহানি বলা। বুঝলেন, কাহানি আজ শোনার সময় নাই। টিভি দেখে, নাচ-গান দেখে, তা বলে কি আমি আজিজ শেখ কাহিনিওয়ালা কাহানির অপমান হতে দিতে পারি?” 

খানিক চুপ করে আজিজ চা খেতে শুরু করলেন। আবার বললেন, “আরেকদিন আইসেন, আমি মহররমকে খবর দিই। সময় নিয়ে আইসেন, রাত আটটার সময় কাহানি শুরু করব। সেদিন নাহয় আমার বাড়িতে আপনার দাওয়াত।” মন খারাপ করে উঠে এসেছিলাম। আমার মনে হল, এতোদিন ধরে সব্বাই তো বলছিল কাহানিওয়ালারা সব্বাই মরে গেছে। এখন আর কেউ কাহানি শোনেও না কাহানিওয়ালার খোঁজও রাখে না। তারপরেও আজিজ শেখ, মহররম শেখের খবর মিলল। একজন কাহানিওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। ফেরার পথে হাতেমুল দা বলছেন – আপনি পাগল মানুষ, ঠিক পাবেন। দেখবেন খোঁজ বন্ধ করবেন না। 

মনে পড়ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারের কিস্যা খাওয়ানি বাজারের কথা। একসময় এখানে কাহয়াহ-র পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে নানান প্রান্তের ব্যবসায়ীরা একে অপরের দেশের গল্প বলতে বসতেন। কাহয়াহ তখন ছিল সুরা, এখন তা দারুচিনি সুরভিত চা। কিস্যা খাওয়ানি বাজারে রসিক শ্রোতারা যায় পয়সা দিয়ে গল্প শুনতে। তবে আজকের পেশোয়ারে কিস্যা খাওয়ানি বাজারের কাহানি ভর্তি থাকে স্যুইসাইড বোম্বারের কথা, রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের কথায়। কাহানির ঐতিহ্য কিন্তু সচল আছে। 

মনে হচ্ছিল পেশোয়ার, লক্ষ্ণৌ আবার মুর্শিদাবাদের গ্রাম গ্রামান্তরের আজিজ শেখ–সব জড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের সহস্র এক আরব্য রজনীর কাহানির সঙ্গে! 

যে কাহানি বলে চলেন রাতের পর রাত শাহরিয়ার বেগম শাহারজাদ! 

সেই আদিম কৌম সভ্যতা থেকেই গল্প মেয়েদের, না, ভুল হলো, নারীর নিজস্ব কলা! বারোমাস্যা থেকে ঠাকুরমার ঝুলি। দক্ষিণারঞ্জন বলেছিলেন, “বাঙ্গালার শ্যামল পল্লীর কোণে কোণে এমনি আনন্দ ছিল, এমনি আবেশ ছিল। মা আমার অফুরন রূপকথা বলিতেন। জানিতেন বলিলে ভুল হয়। ঘরকন্নায় রূপকথা যেন জড়ানো ছিল; এমন গৃহিণী ছিলেন না যিনি রূপকথা জানিতেন না, না জানিলে যেন লজ্জার কথা ছিল। কিন্তু এত শীঘ্র সেই সোনা রূপার কাঠি কে নিল, আজ মনে হয় আর ঘরের শিশু তেমন করিয়া জাগে না, তেমন করিয়া ঘুম পাড়ে না। মা’র মুখের অমৃতকথার শুধু রেশগুলি মনে ভাসিত। পরে, কয়েকটি পল্লীগ্রামের বৃদ্ধার মুখে আবার যাহা শুনিতে শুনিতে শিশুর মত হইতে হইয়াছিল সেইসব ক্ষীণ বিচ্ছিন্ন কঙ্কালের উপরে প্রায় এক যুগের শ্রমের ভূমিতে এই কূলমন্দির রচিত। বুকের ভাষার কবি পাপড়িতে সুরের গল্পের আসন: কেমন হইয়াছে বলিতে পারি না।” 

কেমন হয়েছে আমরা অবশ্যই জানি। যে শৈশবে ঠাকুরমা’র ঝুলি নেই হয়তো তাতে আমাদের মতো চাঁদের মা বুড়ির খোঁজে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা বিস্মিত রাত নেই। ‘কুঁচবরণ রাজকন্যে তার মেঘবরণ চুল’ যে কী এক মায়াবী না ছুঁতে পারা – বয়ঃসন্ধির আনমনা সময়ে তা কখনও মনে আসার সুখ নেই। তারপর আবার মনে পড়ে, ঠাকুমার বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে টলটলে কাঁপা ল্যাম্পের আলোয় খড়ের চালের কানাচে ফোকরে ঘুরে বেড়ানো আঁধারের রহস্য, ভরা ভোরের ঠান্ডা পালাতো আর ঠাকুরমার মিহি তিরতিরে স্বরে ‘লালকমল জাগে নীলকমল জাগে’র ছমছমানি। তা কী আজ ছাপার অক্ষরে ধরা যায়! 

দীপক বিশ্বাস মূলত নাট্যকর্মী। তাঁর আরেক আনন্দ লোকশিল্পীর জীবনী রচনায়। তাঁর সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল লিখে ফেলা লোকগাথা আর পরিবেশিত কাহিনির ভেদাভেদ বিষয়ে। খেয়াল করলেই দেখা যায়, যা মুখে বলে চলি, যে কোনও ঘটনা প্রতিবার বলার সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলায়, বদলে যায় শব্দ চয়ন, বদলে যায় বলার ধরন – তা যেন অনেকটা তরতরে তরলের মতো আর রেকর্ড করে তা লিখে সারলে তা আগামীর প্রয়োজনে বাঁধা পড়ে, যাকে মনে হয় পোড়ানো ইটের মতো, নির্দিষ্ট অবয়বে তলতলে কাদার নরম গড়িয়ে থাকা হারিয়ে যায়। 

এসব ভাবনার ফাঁকে খবর এল, নবগ্রামের সাঁওতাপাড়ার ষষ্ঠীচরণ হাজরা কাহানিওয়ালার হদিশ দিতে পারেন। সত্তর পেরনো ছিমছাম চেহারা, টিকলো নাক, গাঢ় বাদামী গায়ের রঙ, হাতে লম্বা এক লাঠি। নবগ্রামের সমাজকর্মী লাইব্রেরিয়ান ফারুক হোসেন তাঁকে দেখিয়ে বললেন, “দেখুন, এই কাকা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আলকাপ দলে ছিলেন। কাকা – দাদা এসেছেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে।” ষষ্ঠীচরণ হাজরা তোবড়ানো গালে একগাল হেসে বললেন, “ওই দু’কানে দুল পরতাম, নাকে নোলক, প্রথমে চুল লম্বা রাখতাম পরে পরচুলো লাগিয়ে…” এপর্যন্ত বলেই তিনি আচমকা কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে এক হাতের লাঠি তুলে তুলে নাচ শুরু করে দিলেন। নিজের মজায় নিজেই হাসছেন আর বলছেন, “এমন নাচতুম সব্বাই আমায় মেয়েই ভাবতো। কামিজের ভেতরে নকল বুক দোলায় কতো পুরুষ যে উছল হতো ভাই কী বলবো!” জানতে চাইলাম, “আপনি কি ‘ছোকরা’ ছিলেন?” জিভ বের কর,  যেন আমি কোনও অন্যায় করে ফেলেছি, এমন ভাব করলেন। 

“ছোকরা হতে হয় ছোট বয়স থেকে। আমি সিরাজ মাস্টারের আলকাপ দলেই ছিলাম। তবে ছোকরা ছিল অন্য কয়েকজন সময়ে সময়ে।” এরপর তিনি আলকাপের বিস্তারে যাচ্ছেন বুঝে সঙ্গী সৌরভকে বলি, “কাহানিওয়ালা কোথায় চল।” ষষ্ঠীচরণ বুঝলেন, তিনি আমার কাছে সেদিন অন্তত বিশেষ কাজে আসবেন না। ফারুক বাবুকে বললেন, “চলো, ওনারে মোক্তারের কাছে নিয়ে যাই।” মোক্তারের বাড়ি গিয়ে হাঁক পাড়তে প্রায় ছ’ফুটের টান টান চেহারা, বার্ধক্যের টানে চামড়া শিথিল এক মানুষ এলেন। কাহানি শুনতে এসেছি শুনে খানিক তাকিয়ে থেকে বললেন, “আর যে মনে নাই!” তারপর ফারুকের অনুরোধে বাড়ির বারান্দার চৌকির ওপর পাটি বিছিয়ে বসলেন। জানতে চাইলেন, “কী কাহানি শুনবেন বলেন, রামায়ণ-মহাভারত না আমাদের হাদিস শরিফের কাহানি, আরব্য রজনীর কাহানি – কোনটা শুনবেন?” দীপক বিশ্বাস বলেছিলেন – আজগুবি গল্প হয়, রসের গল্প হয়, কাল্পনিক গল্প হয়। মোক্তার শেষ-কে বললাম, “আপনি আমায় কাল্পনিক গল্প শোনাতে পারেন।” মোক্তার হাসলেন, “কাল্পনিক গল্প… মানে ধরেন আমাদের হাদিস মতে কেউ মরলে তো কবর দেওয়া হয়। সেই কবরে গেলে হাদিস মতে মুসাহ্ এসে তাকে জিগ্যেস করে সে জীবিতাবস্থায় কী কী করেছে? কোনও অন্যায় করে থাকলে, তা কেন করেছে তার জন্য কী কী শাস্তি পাওনা হয় – সেই সব বলে। একটা ছেলে মহা ফক্কর ছিল। সে এইসব কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতো না। নামাজ পড়তে গেলে ফেরার সময় বলতো, আমি জানি না যা হাদিসে বলে সে সব সত্যি কিনা। তো একদিন সে ভাবলো, কবরে গিয়ে দেখবো মুসাহ্ এসে কেমন প্রশ্ন করে! একদিন গেল কবরখানায়। একজনের ইন্তেকাম হয়েছে, কবর দিয়ে তার বাড়ির লোকজন চলে যাওয়ার পর কবরে পানে চুপ করে শুয়ে থাকল সন্ধেবেলা।” ষষ্ঠীচরণ দোহারের কাজ করল। বলে উঠল “শুয়ে থাকলো সন্ধেবেলা।” মুচকি হেসে মোক্তার বললো, “সারারাত মশার কামড়ে পড়ে থেকেও কিছু হল না। পরের দিন মৌলবীকে বলল – মুসাহ্ আসেন না আমি ঠিক জানি। মৌলবী বলল – কী করে জানলি তুই, হাদিস কি মিথ্যে বলে? তুই কী সব বলছিস খারাপ কথা! ছেলেটা বলল – আমি নিজে কবরের পাশে শুয়ে দেখেছি, কেউ আসেনি কেউ আসে না। মৌলবী রেগে বললো – তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে আসবে মুসাহ্! তুই কি পাগল হলি?” 

আবার মোক্তার শেখ বলে, “ছেলেটা জেদ করেছে জানতেই হবে মুসাহ্ কখন আসে, কী বলে। তো ক’দিন কবরখানায় ঘুরতে ঘুরতে দেখল, একটা কবরের গর্ত খালি পড়ে আছে। হয়তো কোনও কারণে ওই কবরের মরিজ কোনও ভাবে মিশে গেছে আর কবরের গর্তে জল জমে মাটি বসে গেছে। ছেলেটা একটা সাদা কাপড় নিয়ে কাঁথা মুড়ি দেওয়ার মতো সারা শরীর ঢাকা দিয়ে কবরের গর্তে শুয়ে পড়ল, আর অপেক্ষা করতে লাগল, কখন মুসাহ্ আসে। ওদিকে পাড়ায় একটা চোর পালিয়েছে, পুলিশ তাকে খুঁজতে খুঁজতে লোকজনকে জানতে চাইল কেউ চোর দেখেছে কিনা। দারোগাকে দেখে একজন বলল, একটা লোককে তারা কবরখানার দিকে যেতে দেখেছে। দারোগা তার দলবল নিয়ে কবরখানার দিকে ছুটল। এদিকে ছেলেটা শুনতে পাচ্ছে কয়েকটা পায়ের শব্দ এবং নিশ্চিন্ত হল মুসাহ্ তবে একা আসেন না, সঙ্গে দলবল নিয়ে আসেন। দারোগা উর্চ নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে দেখে একটা লোক কবরে সাদা কাপড় মুড়ে শুয়ে আছে। লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে দারোগা বলল – এই ব্যাটা ওঠ, এই ব্যাটা ওঠ – সে কী আর ওঠে! দারোগা লাঠি দিয়ে যতোই গুঁতোয় ছেলেটা শক্ত হয়ে পড়ে থাকে। তো খানিক পর দারোগাকে তার ছোট দারোগা বলল – ছ্যার এ মরিজ আছে, চোর নয়। তখন দারোগার কেমন ভয় হল রাতের কবরস্থান, কী ভেবে ফিরে চলে গেল। ছেলেটা যেই বুঝল, লোকজন চলে গেছে, একছুটে সোজা মৌলবীর বাড়ি। সে রাতে মৌলবী সবে শুতে গেছে। ভাবলো কেউ মরেছে বুঝি। আবার বেরোতে হবে এই রাতেই। চুপ করে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলো। ছেলেটা তো নাছোড়। সে মুসাহ্-র কথা বলেই ফিরবে। দরজায় আরো জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বলল – মুসাহ্-র দেখা পেয়েছি। মৌলবী ভাবল – তবে কি আমি মরে গেছি তাই মুসাহ্ এসেছে? দরজায় এমন আওয়াজ শুনে বুড়ি মা- মৌলবীর মা দরজা খুলে দেখতে এল, কে ডাকছে একবার দেখি! দরজা খুলতেই ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল – মৌলবী সাহেবরে ডাকেন, আমি মুসাহ্-র দেখা পেয়ে এই এলাম। 

মৌলবী বেরিয়ে এলেন। তখন ছেলেটা বলছে – মৌলবী সাহেব, আমি কবরে ছিলাম। মুসাহ্ এল, আমার সারা গায়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে নিল আমি সত্যিই মরেছি কিনা। অনেক বার বলল, এই ওঠ এই ওঠ এই ওঠ। ব্যস তারপর যখন বুঝল, আমি উঠবো না, সত্যিই মরেছি, তখন চলে গেল।”

    এই হল কাল্পনিক গল্প – বলে, মোক্তার শেখ নিজেই মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। মোক্তার শেখের বাবা মারা গেছিলেন ছোট্টবেলায়। মাঠেঘাটে ঘুরতে ঘুরতে খ্যাপা রুস্তমের দলে ভিড়ে যান। সেখানেই শেখেন কবিগান। পরে ইদ্রিস মাস্টারের দলে গেলেন। এ পর্যন্ত শুনে নিশ্চিত হওয়া গেল আসলে মোক্তার শেখ আসলে কবিগান আলকাপের মানুষ। তাই তিনি বলেন, হিন্দু- মুসলমান সবার বাড়িতেই কাহানি বলেন। সারা বছরই কাহানি বলেন এবং ওঁর গল্প তিনি পড়ে পড়ে শিখেছেন। তিনি গীতা থেকে উদ্ধৃতি শোনান। বুঝতে হবে, যারা খাঁটি কাহানিওয়ালা, তাঁরা ভাদ্র মাসেই শুধু গল্প বলতেন। তাঁরা গল্প বানাতেন। লোক অভিজ্ঞতা থেকেই সে গল্প উঠে আসত।

খাঁটি কাহানিওয়ালারা কি সম্প্রদায় ধর্মভেদ করতেন? না, কখনোই না। লোকধর্মের বাইরে তাঁদের কোনো ধর্ম কোনও দিন ছিল না। মোক্তার শেখ ষষ্ঠীচরণ হাজরাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় বাড়ির বড় বৌ আর এক ভদ্রলোক বললেন, “নাকু ঘোষ আছে ঐ পাড়ায়, যান, সেও কাহানি বলে।” তখন বিকেল গড়াচ্ছে। সংশয় হল, মাঠে গরু চরিয়ে ফিরেছে কি এখন? ফারুক তাঁর অন্যান্য কাজ ছেড়ে কাহানিওয়ালার নেশায় মেতেছেন। এ বাড়ির উঠোন পেরিয়ে আরেকবার দেওয়াল ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে নাকু ঘোষের বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতে গলায় ঘাড়ে গামছা ফেলে হাফ হাতা মলিন জামা আর লুঙ্গি পরা নাকু ঘোষ বাড়ির মুখেই। নাম বলেছি, “নাকু ঘোষ কি আপনি?” তিনি এক প্রশ্রয়ের হাসিতে ভারি গলায় উঁচু স্কেলে বললেন, “এট্টু ভুল করলেন। বাপ নাম দেছিল বুদ্ধদেব ঘোষ। আর লোকে ডাকে নাকু ঘোষ নামে।” কাহানি শোনার কথা উঠতেই বললেন, “সে আর হবে না। এই বিকেল হলো, একটু পরেই রুগীরা আসবে, ঝাঁড়ফুক করতে হবে সময় নাই এখন।” বহু দূর থেকে এসেছি যে। যেন খুব বিপদে পড়লেন। মাদুর বিছিয়ে দাওয়ায় বসতে বললেন। বাবা শ্যামহরি ঘোষের কাছে কাহানি শিখেছেন। “কী করি বলেন, বেহুলা সুন্দরী করি? এই বলো কোনটা করি। দোহার আমার বৃন্দাবন ঘোষ সে গান করে, আমি বক্তৃতা করি যে।” বারবার অনুরোধে কানে হাত দিয়ে বেহুলা সুন্দরীর গান ধরলেন –

“কোন পাপে তোরে ধরলাম পেটে রে

আগে জানলে মেরে ফেলতাম তোরে”

থামলেন। একা একা কী গান হয়! মাঠে একাই গাই, গরুর বাগাল আমি, গরু চরাই আর এ গান নিজের মনে গাই বলে আবার ধরলেন-

“বেহুলা বলে জানতাম না রে এমন হবে রে

আগে জানলে এক ফুল হয়েই বাঁচতাম রে”

সুরের গান থামিয়ে বললেন, “বেহুলা বলছেন, আগে জানলে এক ফুলের মতো ওজন হতো আমার, সেভাবেই বাঁচতাম।”

আমার সামনে নাকু ঘোষ, বাগালের জীবন, মাঠে ঘাটে গরু চরানো… আর ছড়িয়ে যায় বেহুলার বেদনা ছড়িয়ে যায় “এক ফুল থেকে দু’মণ ওজন হলো মা আমার…” গুম মেরে গেলেন নাকু ঘোষ। বেহুলার দুঃখে নাকি নিজের হারিয়ে যাওয়ায়? আবার বলেন, “যন্ত্র নাই দোহার নাই আপনারা এছেন, দোহার থাকলে, জোড়ি থাকলে দুনিয়া ছড়িয়ে দিতাম, কী গলা সেই বৃন্দাবন ঘোষের! শুইনলেন কোথায়! হঠাৎ এসে

গান শুনবেন বইল্যে হয়?” আবার টুকরো কাহানি ছড়াতে থাকেন—-

এক আঁটকুড়ে রাজা আছে তার ছেলেপুলে নাই, রাজার প্রজারা রাজার মুখ দেখে না। এক ঝাড়কুসিওয়ালা এল। সে ভোরবেলা ঝাড়ু দিয়ে চলে যায়, রাজা দেখে, ঝাড়কুসিওয়ালার দেখা পায় না। ঝাড়কুসিওয়ালা ভোর বেলা কাজ করতে এসে রাজার মুখ দেখে ফেললে ঝাঁটা দেখায়। রাজা আঁটকুড়ে, তাই অপয়া, রাজ্যের প্রজার অমঙ্গল। 

রাজার বিলাপের গান ধরেন নাকু–

“এমন জীবন রাখি কেমন করে রে, 

রাজার কাজে প্রহরী ক্ষতি কেমনে হয় রে 

ছেইলে নাই মেইয়ে নাই আঁটকুড়ে রাজা আমি রে।”

কাহানি এগোয়—-

 সাধু আসে, জড়িবুটি দেয়, রাজরাণী চান করে সে জড়িবুটি খাবে আর চালের ঘাটে মাঝি-শিকারীরা রাণীর ‘মুখ দেখলো’। তাই রাণীর যে সন্তান হল বড় হতে হতে সে পাখি মারে, গাছে চড়ে, শিকার করে, গুলতি দিয়ে জল আনতে যাওয়া মেয়েদের কলসী ফুটো করে দেয়…।

এ কাহানি এক রাতের কাহানি নয়, দু-রাত লাগে। জানো, সে ছেইলে সাত পরীর ছোট পরীকে বিয়ে করতে যাবে পরীস্তান, বুইঝলেন, পরীস্তানে যাবে…

“আজ তবে এখানে থাক। কাহানি করতো শক্তি ঘোষ। আমার বাবা শ্যামহরি ঘোষ করতো এখন ঐ গোকর্ণের ষষ্ঠীচরণ ঘোষ করে। যান দেইখেন, তারে যদি পান।” জিজ্ঞেস করলাম, “দুধে বা দইয়ে চিনি খান আপনারা?” হেসে বললেন, “আমরা আহেরি ঘোষ, চিনি দিয়ে দুধের সোয়াদ হারাতে পারি? কী যে বলেন!” 

এভাবে আহেরি ঘোষ আর যাদব ঘোষ আলাদা করতে শিখিয়েছিলেন ড. শক্তিনাথ ঝা। এই আহেরি ঘোষরা এসেছেন মধ্য বিহারের কোনো অঞ্চল থেকে। এরা গরু চরায়, গরুর সেবা করে। তাই তাদের মৌলিক কাহানি ‘লোরিক’। লোরিক আজও করেন চিতু মাস্টার। ভগবানগোলার পীরতলায় নেমে বালিপাড়ায় গিয়ে খোঁজ করতে হবে হাঁড়িটাঙা চিতু মাস্টারের বাড়ি কোথায়। এ খবর দিলেন সুদার শেখ। চিতু মাস্টার লোরিক কাহানি করে। আশির ওপর বয়স, চিত্তরঞ্জন ঘোষ, ভোজপুরী লোরচন্দ্রানী ও সতীময়না – বাংলার বীরত্বগাথা কাহানি বলেন। তিনি এখন সারা মুর্শিদাবাদে একাই। দোহার নিয়ে অপেক্ষা করবেন। শরীর একটু ভালো হোক। লোরিক বললেই যে গোরক্ষক রাজা লোর আর চামার রাজা ‘বামন’-এর ক্ষমতার যুদ্ধ এ কাহানি যে দৌলত কাজী সৈয়দ আলাওল-এর প্রসঙ্গে টেনে আনবেন সচেতন পাঠক। আহেরি ঘোষেরা পশ্চিম বিহার থেকে কীভাবে আওধি হিন্দির মৌলানা

দাউদের চান্দানি নিয়ে এলেন তা সাংস্কৃতিক নৃতত্বের পণ্ডিতেরা বলবেন। তবে চিতু মাস্টার একাই টিকিয়ে রাখছেন সে কাহানি। তার সঙ্গে হারিয়ে যাবেই লোরিক।

ভাদ্রমাস এলে মা বলতেন, “একদিন হবে না কাহানি?” বাবাকে বলতেন। আর যেদিন বৃষ্টি না হল, বাড়ির উঠোনে পঞ্চাশ-ষাট জন জড়ো হয়ে যেতো কাহানিওয়ালা এলে। রাত আটটা থেকে বারোটা। এ অভিজ্ঞতা দীপক বিশ্বাসের। তেমন ভাবে না হলেও পীরতলার ফৈয়জদ্দিন শেখ কাহানিওয়ালার ছেলে মুদার শেখ, তার ভাইপো আব্দুর রসিদ দোহার থেকে আজ কাহানিওয়ালা। আব্দুর রসিদ নিজের বাড়ি ছাড়িয়ে আমবাগানের মাঝে পাটি ছড়িয়ে বসলেন। সঙ্গে মুদার শেখ, বাক্কার আলি আর সনাতন দাস। কাহানি হলো মালঞ্চবতীর। আঁটকুড়ে রাজা যাদবের ছেলে মাধব। ব্যস, মৈমনসিং গীতিকার মাধব মালঞ্চীর উপাখ্যান মুর্শিদাবাদে বীরভূমে মালঞ্চবতীর কাহানি হয়ে ঘুরে ফেরে। মুনমুন কাঠের নৌকো আর পবন কাঠের দাঁড়ে মাধব ঘোরে মালঞ্চবতী ওড়ে –

“যারে নৌকা খুঁজে আনরে আমার মাধবরে। মুনমুন কাঠের নৌকা পবন কাঠের দাঁড় রে যারে”…

বাকার আলি, মুদার শেখ, সনাতন দাস কানে হাত চেপে ঝুঁকে পড়ে তার সপ্তকে থেই ধরে…। “মালঞ্চবতীর উপাখ্যান কী আর একবেলায় শেষ হয়, তিনদিনের কাহানি বাবু!” বলে, আব্দুর কাদের তিনঘণ্টার কাহানি শুনিয়ে হাঁপিয়ে পড়েন।

আসল কাহানি জানেন নতুন গ্রামের জেকের আলি। সে কাহানি জীবনের অভিজ্ঞতায় ছেয়ে থাকে। তুলসীদাসের “দিন কা মোহিনী ঔর রাত কা বাঘিনী” তার কাহানি হয়ে ওঠে ‘বৌ বাঘ হইয়াছে’ নামের রসের গল্পে। এ গল্প পুরুষের নিজস্ব আড়ালে অন্যতর বিনোদন ঘটায়। শ্রমের শেষে সে কিস্যায় রাতের পর রাত কাটে। শরীরের জ্বর সারে। গরীব মানুষের নমাজ পড়া নিয়ে আরেক রসিকতা করেন জেকের আলি। পোশাক সঠিক হলেই না জুম্মার নমাজে যেতে পারে! যে কৌতুকে, শ্লেষে জেকের আলি ‘নমাজ পড়া’র গল্প বলেন, আপনি শুনলে হেসে গড়িয়ে পড়বেন। এ দাবী ড. ঝা-এর। যখন বিশেষ অনুরোধ করি, একটা রসের গল্প শোনান স্যর। রসের কাহানি। ড. ঝা প্রত্যেক কাজে, প্রতিটি গবেষণায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জনে পথ চলার ওপর জোর দিয়ে চলেন সারাক্ষণ। তাই তাঁর কৃপণতা অকৃত্রিম। তবু বলেন, “শুনুন তবে ‘জ্বরের দুটো পা’ কাহানি। চাষীর মধ্যে এক চাষী, সারাদিন মাঠেই ভালো থাকে। সেই সকালে সে মাঠে যায়, ফেরে বিকেল ফুরোতে। এর মধ্যে ছেলে বড়ো হয়েছে, তাকে ইস্কুলে পাঠায় চাষীর বৌ। ছেলে সকালে যায়, দুপুর দুপুর ফেরে। তা, চাষীর বৌয়ের এক ছেলের সঙ্গে

একটু ‘আসনাই’ হলো। চাষীর বৌ নিজের ছেলেকে ইস্কুলে পাঠালে প্রেমিকের সঙ্গে ঘরেই কাটায়। একদিন চাষীর ছেলের মনে হল বাড়িতে মুড়ি-গুড় আছে, তাই খাবো। সে ছুটে এসে ঘরে ঢুকছে দেখে চাষীর বৌ প্রেমিককে নিয়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে থাকে। ছেলে বলে, মা-রে তোর কী হলো? চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছিস এ সময়ে, সকাল বেলা? 

বাবা রে, গুড়-মুড়ি ঐ ঘরের তাকে আছে নিয়ে খা তুই। আমার বড়ো জ্বর হয়েছে। 

ছেলে বাটিতে মুড়ি নিয়ে খেতে খেতে দেখে মায়ের চাদরের নীচের দিকে দু’জোড়া পা বেরিয়ে আছে। সরল মনে মাকে বলে, মা-রে তোর তো দুটো পা! চাদরের নীচে যে চারটে পা? মা সপ্রতিভ জবাব দেয়, বললুম যে তোকে, আমার জ্বর হয়েছে। তো, আমার দু’টো পা, আর জ্বরের দুটো পা।

আসনাই-এর কামজ্বরের মিলনখেলার এ কাহানি বলে বেড়াতেন শোলোক বলা

বুড়িরা। এ কাহানি মেয়েদের একার, মেয়েদের নিজেদের রসালোচনার মেশামেশি।

আরো কত কাহানি চলেছে বীরভূম, বর্ধমান, করিমপুর, নদীয়া এবং সারা মুর্শিদাবাদে। সে কাহানি স্মৃতিতেই আছে নানান শ্রোতার।

প্রত্যেকেই ভাবছেন, কাহানিওয়ালারা কী পারিশ্রমিক নিতেন? প্রশ্ন করেছি আর আজিজ থেকে মোক্তার কী চিতু মাস্টার থেকে ষষ্ঠীচরণ বিস্মিত হয়ে বলেছেন – খুশি হয়ে মানুষ চা বিস্কুট খাওয়ায়, রাতিতে দুটো মুড়ি গুড়, যা তারা খায় তাইই খাই, ব্যস, এই তো,পারিশ্রমিক আবার কী!

চুয়া পীরতলার আজিজ শেখ কাহানি না শুনিয়ে যেদিন ফিরিয়েছিলেন, আলাদা করে ডেকে প্রায় কানে কানে বলেছিলেন, “কাহানিতে রসের ওঠাপড়া হয় ছ্যার, আপনি বুইঝবেন, যদি কাহানিওয়ালার চোখে শ্রোতার চোখ ফেরতা আলো না জ্বলে কাহানিওয়ালার কাহানি প্রাণ গায় না। মহররম শেখকে খবর দিইলে, ও যেদিন দোহার হবে, আশপাশের গ্রামের খবর পড়ে – আজিজ শেখ কাহানিওয়ালা আজ কাহানি কইরবে। আমি কাহানি ধরলে মহররম গান ধইরবে। ষাট-সইত্তরটা লোক আমার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাইকবে। তাদের চোখের থিকেই আমার কাহানির পাখনা মেইলে। ওদের চোখেই সে ডানা মেইলে। আপনি আমায় ক্ষমা করুন। শ’ শ’ লোকের সাইমনে যে কাহানি বইলেছে, তিনটে লোকের সামনে সে কাহানি সাজায় না।”

আবার যাবো আজিজ শেখের কাছে। একা একা কথা বলেন আজিজ শেখ ফরিদ মিঞা। পুরাতন লক্ষ্ণৌ আর চুয়া পীরতলা দাস্তানের অফুরান কাহানি লালবাগের ভাঙাহাভেলি থেকে বন্দর কাশেম বাজার হয়ে লোরিকের চিতু মাষ্টার সব মিশে যায় রসের ভাঁড়ার নিয়ে অস্থির সময়ের আয়নায়। আঁধারে লম্ফ জ্বলে, বুড়ি অঞ্জুমান বানু ফেঁপে ওঠা রসের কাহানি নিয়ে চলন্ত জলে রসাক্ত হন। কাহানি ভরা জলের হাঁড়ি আর কেনে না।

 কৃতজ্ঞতা : হাতেমুল ইসলাম, সৌরভ হোসেন সুজিত সিনহা, শুভেন্দুকৃষ্ণ তরফদার, ড: শক্তিনাথ ঝা,দীপক বিশ্বাস, ফারুক হোসেন

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment