ঋতম সেন

অন্ধকার দিনগুলিতে অনুবাদ

লেখার বিষয় যতটা অনুবাদ, ঠিক ততটাই এই অন্ধকার দিনগুলি। যখন ধর্মের ভিত্তিতে জনগণকে ভাগ করার চেষ্টায় ভয়ানক তৎপর বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রণয়ন এবং তা রুজু করার মাধ্যমে তারা বাতিল করে দিতে চাইছে এক বিশাল সংখ্যক জনগণের অস্তিত্ত্ব এবং তার সংশোধনকারি আইনের দ্বারা তারা বাতিল করছে সম্পূর্ণ মুসলিম সম্প্রদায়কে যারা ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্য সমস্ত ধর্মের নাম থাকলেও সিএএ থেকে নির্দ্বিধায় এই হিন্দুত্ববাদী সরকার বাদ দিয়েছে মুসলিম ধর্মের নাম। এটাই স্বাভাবিক যে এর বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষের সমস্ত সাধারণ নাগরিক, প্রতিবাদ করবেন, আওয়াজ তুলবেন, রাস্তায় নামবেন। দেশব্যাপী এই প্রতিরোধের পুরোভাগে রয়েছে এদেশের ছাত্রী এবং ছাত্ররা। আমাদের মেনে নেওয়া উচিত যে তারাই ভবিষ্যত, তাদের তোলা প্রশ্নের উত্তর আমাদের দেওয়া উচিত, তাদের সঙ্গে আমাদের সকলের আলোচনায় বসা উচিত। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় সরকার সেই রাস্তায় না হেঁটে তাদের ওপর নামিয়ে এনেছে পুলিশ, তাদের হোস্টেলে লেলিয়ে দিয়েছে লাঠি হাতে নিজেদের ছাত্র ইউনিয়নের গুন্ডাদের। জামিয়া মিলিয়া , আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আজকে আমরা সবাই জানি, প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আজ লজ্জিত, উত্যক্ত, অস্থির। কিন্তু যা আমরা জানি না তা হল প্রতিটি মোড়ে মোড়ে, প্রতিটি বাজারে, প্রত্যেক পাবলিক স্পেসে কিছু অশিক্ষিত ধান্দাবাজ মেয়েদের উত্যক্ত করছে, শিল্পীদের কবিদের মারছে , রাস্তাঘাটে কথা বলতে বাধা দিচ্ছে আমাদের সবাইকে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৈরি করে রাখছে সন্ত্রাসের পরিবেশ। আয়রনি এই জায়গাটাতেই, যে তারা নির্বাচনে জিতে জনতার ভোটে ক্ষমতায় এসে এখন চাইছে যাদের জন্য তারা মসনদে বসেছে, সেই জনতাকেই বাতিল করতে। অর্থাৎ তারা শুধু গদিটাকেই চায়, নিজেদের জন্য। সাধারণ মানুষের কথা ভাবার কোনো দায় দায়িত্ব তারা নিতে অস্বীকার করছে। দুঃখ এই জায়গাটাতেই যে আমরাই তাদের মাথায় তুলেছি।

তবে আলো এবং অন্ধকারের স্বভাবই এই যে তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘোরাফেরা করে। এই অন্ধকার দিনগুলিতেও আমাদের ভাগ করার বদলে এই বিভেদনীতি আমাদের নতুন করে জোড়া লাগিয়ে ফেলছে। আমরা সগর্বে উচ্চারণ করছি আমরা ভারতীয়। এই ভারত কোনো ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। এই ভারত আমাদের সবার দেশ। আমরা একে অপরের আরো কাছাকাছি চলে আসছি। আর ভারতের বহুত্বই আমাদের নতজানু হতে বাধ্য করছে অনুবাদের সামনে। জানতে অজান্তে একজন ভারতীয়র অস্তিত্বই প্রকৃতপক্ষে বহুভাষিক এ আমরা সকলেই স্বীকার করব। আমি নিশ্চিত এই লেখার পাঠিকা এবং পাঠকেরা সবাই হিন্দি বোঝেন, অসমিয়া উড়িয়া শুনলে মানেটা বুঝতে পারেন, ইংরেজী তো জানেনই, উর্দু বোঝেন, সংস্কৃতের সামান্য ধারণাও রয়েছে, কেউ কেউ হয়তো তামিল তেলুগু মালয়ালমও বোঝেন। যা বললাম তার থেকে অনেক বেশি বাদ পড়লো, আমায় ক্ষমা করবেন, আমি আসলে বোঝাতে চাইছি একজন ভারতীয় বহুভাষিক। ভারতীয়ত্ব প্রকৃতপক্ষে বহুভাষিক এবং আমরা সকলেই অনুবাদক। আর এই আর্গুমেন্টটিও আমি  পেশ করতে চাই যে আমাদের বেঁধে বেঁধে থাকা এবং বেঁধে বেঁধে রাখার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এই অনুবাদের প্রক্রিয়াই।

এইবার আক্ষরিক অর্থেই এই অন্ধকার সময়ে আমার করা কিছু অনুবাদ আমি এই লেখাটির মধ্যে আনতে চলেছি, তার সঙ্গে মূল কবিতার লিঙ্ক এবং সামান্য পরিচয়। এই কবিতাগুলির প্রত্যেকটিই আমার কাছে এসেছে অন্তর্জাল মারফত। অর্থাৎ কবিতাগুলি আমি শুনেছি, পড়িনি, কবিকে দেখেছি কবিতাগুলি পড়তে, কখনো বহু লোকের মিছিলের মাঝখানে, কখনো একা। তাই চেষ্টা করলাম সেই মূল লিঙ্কগুলি দেওয়ার যাতে সকলেই এই অভিজ্ঞতার ভাগীদার হতে পারেন।

আমির আজিজের কবিতা জামিয়া কি লেড়কিয়া

মূল কবিতা-

শাহো কো বেনাকাব করতি হ্যায়

ঈশারো সে ইনকিলাব করতি হ্যায়

জামিয়া কি লেড়কিয়া

অউর পিতৃসত্তা কে কাপড়ে ফাট যাতে হ্যায়

সব লোগ রাহ সে হট যাতে হ্যায়

যব রাস্তো পে ডট যাতি হ্যায়

জামিয়া কি লেড়কিয়া

অর যব পুলিশ উঠাতি হ্যায় লাঠি

অর লোগ উঠাতে হ্যায় পাত্থর

মক্তো সে চিখে উঠতি হ্যায়

ইনসানকে শ্বাসে ঘুটতি হ্যায়

যব আহো সব ঘুটতি রেহতি হ্যায়

নিগাহে সব ঝুঁকতি রেহতি হ্যায়

ঝুঁকনে লাগতে হ্যায় জুলম কে আগে যব দুনিয়া কি সব আদমি

থকনে লাগতে হ্যায় মালিকো সে লড় লড় কে গুলাম ভি

যব ইনসানিয়তকে টুটে টুকরে সড়কো পর গিরনে লাগতে হ্যায়

ভিচকে মুঠি সড়কো সে নারে উঠাতি হ্যায়

জামিয়া কি লেড়কিয়া

গিরে হুয়ে মর্দ অর ভি গির যাতে হ্যায়

সিতারে পেহলে ইনে দেখনে আতে হ্যায়

আসমান মে ফির যাতে হ্যায়

চুলো সে বান্ধ দি গেয়ি চিঙ্গারিয়া মশাল বন যাতি হ্যায়

গুলাম কি বেড়িয়ো কি আওয়াজে আজাদি কি ঝংকার বন যাতি হ্যায়

তানাশাহ কি জি কা জঞ্জাল বন যাতে হ্যায়

জালিম কি জমি হিলনে লাগতি হ্যায়

হকিকত খোয়াব সে মিলনে লাগতি হ্যায়

অর কিসি কি মা কিসি কি বেটি কিসি কি বিবি কিসি কি বেহেন নেহি

ইয়ে হ্যায় জামিয়া কি লেড়কিয়া

কিসি কি ইজ্জত কিসি কি আব্রু কিসি কি ঘর কিসি কা সহন নেহি

ইয়ে হ্যায় জামিয়া কি লেড়কিয়া

অর জিন্দেগি ভি জিতি হ্যায়

সিগ্রেট ভি পিতি হ্যায়

আওয়ারগি কি মিশাল ভি হ্যায় জামিয়া কি লেড়কিয়া

অর রায় আপনা আপনা হাত মে রাখিয়ে

জরুরত পড়ে তো হিজাব রাখিয়ে

নিকালতি বালোকি খাল ভি হ্যায়

জামিয়া কি লেড়কিয়া

অর ইনকিলাব মে জিতনি ভি লিখি গেয়ি ইতিহাস কে পান্নো পর

ও সব আয়াতে ভি হ্যায় জামিয়া কি লেড়িকিয়া

অর মন হি মন মে দুনিয়া কে সারি অউরতে ভি হ্যায়

জামিয়া কি লেড়কিয়া।

কবিতাটির অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছি, আক্ষরিক অনুবাদ নয়। তবে যেটা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি তা হল ছন্দ এবং অন্ত্যমিল, কিছু ক্ষেত্রে, বাংলা ভাষার নিজস্ব ছাঁচে ফেলতে গিয়ে ছন্দেরও কিছু রদবদল হয়েছে। আরেকটা মজার কথা হল, আমির নিজেই বিভিন্ন জায়গায় কবিতাটি বিভিন্ন ভাবে বলেন, ফলে পারফরমেন্স ভেদে কবিতাটি বদলে বদলে যায়, আমি যে কবিতাটি অনুবাদ করেছি সেটি ঠিক এই ভার্সনটি নয়, ফলে বাংলায় একটু তফাত পাবেন মূল কবিতাটির থেকে। এটুকু তফাত উপভোগ্য হবে বলেই আমার ধারণা।

জামিয়ার মেয়েরা

হিন্দুরাষ্ট্রকে বেয়াকুব বানিয়েছে

গোলাপকে ইনকিলাব বানিয়েছে

আমাদের লাল সেলাম জানিয়েছে

জামিয়ার মেয়েরা

আর পিতৃতন্ত্রের চাড্ডি ফেটে গেছে

ভুল ভাল লোকজন ফুটে গেছে

যখন রাজপথ দিয়ে আজ হেঁটে গেছে

জামিয়ার মেয়েরা

যখন রাজপথ দিয়ে আজ হেঁটে গেছে

জামিয়ার মেয়েরা

কোনো হিন্দু, কোনো মুসলমান

কোনো শিখ কোনো খ্রিস্টান

কোনো জৈন কোনো নাস্তিক ছিলনা

ছিল জামিয়ার মেয়েরা।

কোনো দিস, কোনো দ্যাট

কোনো গুড, কোনো ব্যাড

কোনো আমরা কোনো ওরা

কোনো ছুরি , কোনো ছোরা ছিলনা

ছিল জামিয়ার মেয়েরা।

এরা কারো মা কারো বোন

কারো মেয়ে কারো বউ নয়

এরা জামিয়ার মেয়েরা

কারো ইজ্জত কারো আব্রু

কারো ভয় কারো লজ্জা নয়

এরা জামিয়ার মেয়েরা

যখন পুলিশ ওঠায় লাঠি

আর ভিড় কুড়োয় পাথর

আর্তনাদে পথ ভরে ওঠে

আতঙ্কে নিঃশ্বাস ধরে ওঠে

চোখ ভয়ে নিচে নেমে যায়

হাতের মুঠোর হাত ঘেমে যায়

জুলুমের মুখে নুয়ে পড়ে পৃথিবীর পুরুষদের মাথা

মালিকের ক্রোশ যখন নেমে আসে চাকরের ওপর

মানবতা থেঁতলে ছড়িয়ে থাকে কংক্রিটের রাস্তায়

তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরে, নিষেধের আঙুল ওঠায়

জামিয়ার মেয়েরা

আর তাদের গলা যত চড়ে

ভন্ডদের মুখ ততোই ছোটো হয়ে যায়

আকাশের তারারাও মেয়েদের চোখে নেমে এসে জ্বল জ্বল করে

শীতের রাতে ডিউটিতে না গিয়ে

তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরে, নিষেধের আঙুল ওঠায়

জামিয়ার মেয়েরা

উনুনের আগুনের ফুলকিও মশাল জ্বালায়

স্বর্গচ্যুত ফরিস্তা হাত সেঁকে নেয় সেই আগুনে

ওরা বাঁচতেও জানে

আর সিগারেটও টানে

মুক্তির নেশায় উত্তাল জামিয়ার মেয়েরা

আমি জানি না আপনি কি মনে করবেন

আপনার চোখে লাগলে আপনি বোরখা পরবেন

ওরা এরকমই, জামিয়ার মেয়েরা

বিপ্লবের যত কবিতা, ইনকিলাবের যত গান

ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি মেয়ে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি মেয়ের মুখে আজ একটিই নাম

জামিয়ার মেয়েরা।

বরুণ গ্রোভারের কবিতা হাম কাগজ নেহি দিখায়ঙ্গে

বলিউডের সূত্রে বরুণ গ্রোভার বেশ পরিচিত একজন গীতিকার। তাঁর এই কবিতাটি এখন মুখে মুখে ঘুরছে। একটি বাংলা অনুবাদও হয়েছে যেটি বেশ পরিচিত হয়েছে। আমি দুটিরই লিঙ্ক দিলাম। মূল কবিতাটি এবং আমার অনুবাদটিও দিলাম তলায়-

মূল কবিতা

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

তানাশাহ আকে জায়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

তুম আঁসু গ্যাস উঝালোগে

তুম জহর কি চায়ে উগালোগে

হাম পেয়ার কি শক্কর ডালকে উসকো

গঠ গঠ গঠ পি জায়েঙ্গে

এ দেশ হি আপনা হাসিল হ্যায়

যাঁহা রামপ্রসাদ ভি বিসমিল হ্যায়

মিট্টি কো ক্যায়সে বাঁটোগে

সব কা খুন তো শামিল হ্যায়

তুম পুলিশ সে লঠ পারাদোগে

তুম মেট্রো বন্ধ করাদোগে

হাম পয়দল পয়দল আয়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

হাম মঞ্জি ইয়েহি বিছায়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

হাম সংবিধান কো বাঁচায়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

তুম জাতপাত সে বাঁটোগে

হাম ভাত মাংতে আয়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে

আমরা কাগজ দেখাবো না

আমরা আর ভয় পাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

তোমার টিয়ার গ্যাসের হুমকিকে

সাম্প্রদায়িক আগুনের ফুলকিকে

ভালোবাসায় নেভাব আমরা

দাঙ্গা করতে যাবো না।

আমরা আর ভয় পাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

এই দেশ প্রত্যেক জনগণের

রামপ্রসাদের লালনের

এই দেশ ফ্যাসিবাদীর নয়

নয় স্বৈরাচারী শাসনের

তোমার পুলিশ লাঠি চালালে

তুমি মেট্রো বন্ধ করালে

আমরা পায়ে হেঁটে আসবো

তোমায় গোলাপ দেওয়া থামাবো না

আমরা আর ভয় পাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

আমরা মিছিল থামাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

দেশের সংবিধানকে আমরা

চুলোয় পাঠাতে পারবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

জনগণমন গাওয়া থামাবো না

আমরা কাগজ দেখাবো না

তুমি জাতপাত তুলে রাখো গে

 আমরা ভাত খাওয়া থামাতে পারব না

ভাতের লড়াই থামাতে পারব না

আমরা কাগজ দেখাব না

আমরা আর ভয় পাব না

আমরা কাগজ দেখাব না।

আরো একটি বাংলা অনুবাদ হয়েছে এই কবিতাটির, সেটিও দেওয়া হল

এই দুর্দশা এবং ভন্ডামির কোনো শেষ তো আপাতত দেখতে পাচ্ছি না। এই শব্দ গুলো লিখতে লিখতে নোটিফিকেশন আসছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এককথায় এই মানুষ ভাগাভাগি করার আইনকে বাতিল করার বদলে সরকার পক্ষকে নির্দেশ দিচ্ছে চার সপ্তাহের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের। তারপর তারা কিছু এ্কটা সিদ্ধান্তের দিকে যাবে। এই চার সপ্তাহে আরো বেশ কিছু কাজ মুগ্ধ করবে, আরো অনুবাদ হবে আশা করি। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, হাম দেখেঙ্গে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment