বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

ব্লীডিং হার্ট

 

 

দুপুরের খাওয়া সেরে ইরার চোখে যখন ক্লান্ত দুপুরের আলস্য, সেই সময় পাঁচিলের ছায়া যতটুকু গড়ায়, বাগানের সীমানা সেইটুকুই । একচিলতে।

একসময় আগাছায় ভরে ছিল, এখন সেখানে অনেক রং। ইরার হাতের নির্যাস থেকে এই রং ছড়িয়ে পড়েছে, এমনটা ভেবে ইরার বুকে একটা পাখি ডানা ঝাঁপটায় । যত গাছ লাগাতে চায়, ততো আর পারে কোথায়? অমূল্য বলে প্রতিটা গাছের বাড়ার জন্য একটা জায়গা ছাড়া চাই । শুধু তাই? সব গাছ সবার পাশে বাড়তেও চায় না দিদি।

অমূল্যর নার্সারি আছে। সবুজপাতা নার্সারি, সেখান থেকেই চারা কেনে ইরা।

সেটা কিরকম?

শুধু আলো বাতাস পেলে হয় না কি? পাশের বাড়ির লোকও ভাল হওয়া চাই। ইরার অবাক চাহনি দেখে কথাটা আরও ভাঙে, প্রতিবেশী গো দিদি, যার গায়ে গা লাগিয়ে বাঁচতে হয়।

মাঝে মাঝে অমূল্য এমন সব কথা বলে! গাছের প্রাণ আছে না দিদি? জগদীশ বোস তো কবেই সেটা বলে গেছে।

আর অমূল্য বোস বলছে গাছের মনও আছে, তাই তো?

অমূল্যর পদবী বোস নয়, খাঁড়া। কিন্তু ইরার এই খোঁচাটা সে গায়ে মাখে নি। এই যে দেখছেন সুর্যমুখী গাছ, কেন বাগানের ধার ধরে লাগাতে হয়?  কারণ এনার কারো সঙ্গে বনিবনা নেই, দেখেন না কেমন ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ায়। গর্বে তেনার মাটিতে পা পড়ে না যে। গুমর! সত্যি বলছি দিদি, অন্য গাছের মাঝে রাখলে তাদের ঝাড়ে বংশে শেষ করে দেবে।

এমনভাবে বলো না তুমি অমূল্য! গাছ না যেন মানুষ এক একটা। বলতে বলতেই মনে হয় সব মানুষেরই কি মন আছে? ছোঁয়ার মত? ভাবনাটা বেশি দূর গড়ানোর আগেই অমূল্যর কথার টানে তলিয়ে যায়। কিংবা তার মনের কথাটা তুলে নিয়েই বলে উঠেছিল, মানুষের বেশি গো দিদি এরা। ভাবো কথা বলে না, ব্যাস! রাগ দুঃখ কিচ্ছু থাকতে নেই। গারডেনিয়া দেখেছো তো? পাশের গাছটা শুকিয়ে গেলে, যতই যত্ন করি, তাজা রাখতে পারি না অন্যটাকেও। সেও কেমন গুমসো মেরে দেয়। তারপর ফিক করে হাসে অমূল্য, যেন সতীসাধ্ধী স্বামীর সঙ্গে এক যোগে চিতেয় উঠছে। তোমাদের উপরের ঘরের ঠাম্মার মত, দাদু গেল আর তার তিনদিন বাদে ফুস।

এই যে এতো বেশি কথা বলে ছেলেটা, ইরার মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে গাছ গছিয়ে দেওয়ার জন্য। বাগানে জায়গা নেই জেনেও ইরা ওর নার্সারিতে যায়, প্রাণভরে ওর বানানো কলম, বেড়ে উঠতে থাকা কচি কচি চারা দেখে। তারপর নেবো না নেবো না ভেবেও, ঠিক কোন একটা গাছের চারা নিয়ে বাড়ি ফেরে।

এইভাবেই একদিন নিয়ে এসেছিল ব্লীডিং হার্টের চারাটা। অমূল্যর ওখানে দেখেছিল একটা টবে বড় হয়ে ওঠা এই গাছ।  কি সুন্দর পাতাগুলো, পানের মত, কিন্তু খুদে খুদে। আর সাদা ফুলগুলো। সাদা তো নয়, সাদা তেলে ভাজা ঝুরো নিমকি। সার দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সব। ভালোবাসার বেদনা বুকে নিয়ে। এমনটাই মাথায় এসেছিল ইরার।

পান পাতা নয়, লভ সাইন গো দিদি, বড় প্রেমিক গাছ এটা। এর পরেই অমূল্য ছেলেটা পেয়ার হুয়া একরার হুয়া গুনগুন করতে করতে গাছের যত্নে লেগে যায়।

প্রেমিক গাছ! কি যে তার মানে? অমূল্য এইসব গদগদ কথা দিয়ে তাকে গছিয়ে দিয়েছিল একটা কলম, কড়কড়ে পঁচাত্তর টাকায়। অত দাম দিয়ে কেনা, জীবনকে বলেছিল কুড়ি। তাতেও জীবন বলল, এই কুড়ি কুড়ি করে এমন কত টাকা যে অন্যের জমিতে ঢালবে তুমি!

ইরারা ভাড়ায় থাকে। দোতলা বাড়ির নিচেরটা ভাগ্যিস তাদের, ভাগে পড়েছে উঠোন। বছর দুই এসেছে এখানে।  বাড়ির মালিক বিদেশে থাকে, হঠাৎ করে উঠে যেতে বলবে, এমনটাও তো নয়। তাহলে? আসলে ফুলের প্রতি জীবনের কোন টান নেই। আগের বাড়িতে থাকতে, সেখানে কোন বাগানের বালাই ছিল না, ইরা মাঝে মধ্যে একগোছা ফুল কিনে আনতো। ঘরের কোনায় একটা ছোট্ট ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখত আর জীবন কি বলে এই ভেবে বুক কাঁপতো। জীবন হয়তো কিছুই বলত না, ভাল মন্দ কিচ্ছু না। কখন বলবে এই ভাবনাটা বুকে বেঁধে এদিক ওদিক করত ইরা।   খেতে বসে মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে হয়তো একবার মুখ তুলল, ওই ফুলের দামে আরও এক পিস মাছ বেশি কেনা যায়।

খাবে আর একটা? এই আলটপকা কথায় থতমত খেয়ে নিজের ভাগের মাছটা তুলে দিয়েছে ওর পাতে।

জীবন একবার সঙ্গম সেরে বলেছিল, ফুল না কিনে একটা ফুলের গন্ধের পারফিউম তো কিনতে পারো।  কালিপূজার রাতে দমকা হাওয়ায় পটপট করে নিভে যাওয়া মোমবাতিগুলোর কথা ইরার মনে এসেছিল আচমকা। হাওয়া আটাকতে ঝুলের ফ্রক মেলে দাঁড়িয়েছিল ইরা, বাতাসে উড়ে ফ্রকের লেস মোমবাতির আগুন টেনে নিয়েছিল সেদিন। উরুতে পোড়া দাগের ঝাপসা স্মৃতি আজও।

তার গায়ে নাকি বড় বেশি মাটির গন্ধ। মাটিও না, সার। কিসের সার দাও বলো তো তোমার গাছে? জীবন তার গায়ে মাখার জন্য চন্দন সাবান এনে দিয়েছিল একবার। গাছের নির্যাস দিয়েই তৈরী – এমন কথা বলে হালকা রসিকতার চেষ্টাও করেছিল। ইরার মুখে হাসি না ফোটায় জীবন আরও গুম হয়ে গেছিল সেদিন।

জীবন বেরিয়ে গেলেই শাড়িটা গাছকোমর বেঁধে বাগানে চলে আসে ইরা। শুধু যে গাছের গোড়ায় জল দেয়, তা নয়। পাতলা কাপড় নিয়ে গাছের পাতা জল দিয়ে মুছতে থাকে। পিচভাঙা রাস্তায় লরিগুলো এতো ধুলো উড়িয়ে যায়! না মুছে দিলে দুদিনেই পাতাগুলো ধূসর। গাছের গা মোছাতে মোছাতে ওদের সঙ্গে গল্প জোড়ে। অমূল্যের স্বভাব বর্তে গেছে তার উপরে। ভেবেই ফিক করে হেসে ফেলে ইরা। আগে যখন বর্ধন দাদু ঠাম্মারা উপরে ছিল, দাদু উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার এইসব কীর্তি কলাপ দেখে মজা পেতো। বলতো, আমার বয়েস হয়েছে তো, এখন আমিও একটা গাছের মত। তুমি তোমার বাক্যালাপ চালিয়ে যাও।

লজ্জা পেয়ে হয়তো খানিক চুপ করে যেতো ইরা। এখন তো পুরোই চুপ। দাদুরা চলে গেলেন তিনদিন আগে পরে। খুব কষ্ট হয়েছিল। ছিল তো দুটো মানুষ। এখন উপরের তলা ফাঁকা। ভাড়াটে আসেনি। জীবন চেয়েছিল উপরে উঠে যেতে, অনেক বেশি নাকি আলো হাওয়া, মশাও কম হবে। ইরা ঠিক জানে উপরে গেলে এই বাগান আর তার এক্তিয়ারে থাকবে না, নতুন যে ভাড়াটে আসবে সে ছাড়বে কেন? জীবন তো সেটাই চায়। ইরা মাটি কামড়ে পড়ে রইল। রাগে মিশমিশ করতে করতে বাঁ গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরেছিল একদিন। ইরা গাছ হয়ে পড়ে রইল দিন সাতেক। তার শিকড় উপড়ানো যায়নি।

বরং আরো বেশি বেশি করে গাছেদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ইরা। নিজের দিকে তো একটু চোখ দিতে পারো। মিনমিন করেছে জীবন তারপর কতদিন। জানো তো রাগ হলে আমার মাথাটা কেমন হয়ে যায়।

আমি কি কিছু বলেছি? বলতে বলতে কথা কানে ঢোকার সীমানার বাইরে ছিটকে গেছে ইরা। মন দিয়েছে তার গাছেদের সংসারে।

অমূল্য এতো যে বলেছিল, কই এই গাছে তো কোন সাড়া শব্দ নেই। বাড়ছে, কিন্তু কেমন শিকুরে থাকে। নার্সারিতে দেখা গাছের সেই ঝলক কোথায়? ফুল হবে না অমূল্য? সেই ঝুরো ঝুরো হৃদয় ঝুঁকিয়ে একসার ফুল?

সময় দাও আর কদিন। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল তো সমান হয় না। একটু কাটছাঁট করে দিও তো দিদি। ছায়া পড়ছে না তো? পাশের গাছটা কি খুব গা লাগোয়া? এমনি নানান টোটকা দিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। সব কিছু করে দেখেছে ইরা, গাছের কোন সাড়া নেই।

বড্ড বেশি গাছ গাছ তোর। জামাইয়ের খেয়াল রাখিস? ইরার মা রাগ করে বলেছিল একদিন।

কেন মা, তোমার জামাই কিছু বলেছে?

বলতে হয়? নিজের ছিরি ছাঁদটা দেখেছিস একবার? চুলে চিরুনি দিস কিনা তাও বোঝা দুষ্কর। ছেলেটা দিন শেষে ফেরে একটু ফিটফাট তো থাকতে পারিস। আয় দেখি তোর চুলটা বেঁধে দিই।

ধুত, আমি কি বাচ্চা , নিজেই তো করি।

মায়ের সঙ্গে এখন বসে চুল বাঁধলে বেলা পড়ে যাবে, গাছেদের সঙ্গে এবেলার কথাই হবে না আর। তরতর করে উঠোনে নেবে গেছিল ইরা। দেখো মা , এই সাদা জবাটা , কেমন লাল লাল ফুটকি যেন টিপ পড়েছে।

হ্যাঁ, তোমার ফুলেরা টিপ পড়ুক আর তুমি খালি কপালে আগান বাগান করো। আকবর বাদশার বাগানের মালি হয়েছেন উনি! এইসব বিনবিন করতে করতে বাগান পেরিয়ে বাড়ির পথ ধরেছিল মা।

ইরাকে জীবন একতলা থেকে উপড়ে দোতলায় বসাতে পারেনি। তার গজগজ একসময় নিঃশব্দ ক্রোধে বদলে গেছিল। আবার ফেটে পড়ল যেদিন উপরে নতুন ভাড়াটে এলো। ওদের মালপত্তর তখনো সিঁড়ি দিয়ে উঠছে উপরে, জীবনের চাপা রাগ সেদিন লাভা স্রোতের মত রান্নাঘরের দুয়ারে ধেয়ে এলো। হল তো? এসে গেল ভাড়াটে? এখন তোমার গাছ আর মশা নিয়ে বাস করি? শেষ আশা চলে গেলে যেমন রাগ হয়, সেই ভাব নিয়ে দাঁত পিষছিল লোকটা।

নতুন লোকেদের সামনে নিজের গলার জোর না দেখালেই কি নয়?

মুখে কথা বলার মেয়ে নয় ইরা, তাই জীবনের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়েছিল। এর পরে মুখ আর না চালিয়ে, কথা বলেছিল হাতে। গাছের গায়ে শিল পড়ার মত। আরও কিছু পাতা শুকিয়ে ঝরে যাওয়ার মত শ্বাস টেনে বাকি রান্নায় হাত লাগিয়েছিল ইরা। জীবনের রাগ কমেনি তাতে, দপদপিয়ে না খেয়েই অফিসে চলে গেল।

ঝুমা আর প্রবীর। উপরের নতুন ভাড়াটে। নতুন বিয়ে করে প্রথম বাড়ি তাদের। জীবন বেরিয়ে যেতে ইরা গিয়ে খোঁজ খবর করেছিল। বেশ মিষ্টি মেয়েটা, সবে বিশের কোঠা ছাড়িয়েছে। মেয়েটি কলকাতার, ছেলেটিও অনেকটা তাই। মানে মালদার ছেলে, পড়াশোনা কলকাতায়। এখানের স্কুলে ও পড়ায় ইরাদি, কলকাতা থেকে রোজ দুই ঘণ্টা আসা যাওয়া, তাই এখানেই চলে এলাম। দাদা কি খুব রাগী?

ভিতর থেকে একটা লজ্জা ঠেলে উঠেছিল ইরার। ওই ওমনি মানুষ আর কি, ম্লান মুখে কোনমতে নিচে নেবে এসেছিল তড়িঘড়ি। বাগানে কাজও ছিল। অমূল্য তাকে ব্লীডিং হার্টের একটা কলম থেকে দুই ভাগ করে দিয়েছে গতকাল বিকেলে। আগে থেকে পয়সা দিতে হবে না, তুমি একবার লাগিয়ে দেখো। একদম পাশাপাশি, দেখো কেমন তরতরিয়ে বাড়ে। তারপর দাম দিও না হয়।

 

এই গাছের কথা জীবনকে বলেনি। ফ্রিতে যখন বলবেই বা কেন! আগের গাছটা শুঁটকেই আছে, এত রোদ হাওয়ায় রেখেও। বেঁটে, মরেনি যে তার প্রমান রেখে দু চারটি পাতা উঁকি দেয় শুধু। তার পাশ ঘেঁষেই জমি বানালো ইরা। একবার মনে হচ্ছিল যদি অমূল্যর কথা সত্যি হয়? পাশের গাছটার মতই ম্যাড়মেড়ে ভাব নেয়?  কিন্তু এছাড়া আর জায়গা কোথায় ইরার। মাথা নিচু করে গাছের গোড়া ঠিক করছিল, উপর থেকে কলকল করে উঠল ঝুমা। তোমার বাগানটা কি সুন্দর ইরাদি, চোখ জুড়িয়ে যায়। নিজেই করো?

এই এক কথায় সকাল থেকে জমা সব মেঘ উড়ে গেল এক লহমায়।  উঠে দাঁড়িয়ে উপর দিকে মাথা তুলল ইরা, ঠিক যেমন বর্ধন মাসিমার সঙ্গে করত একসময়। আর কে করবে! এই তো একচিলতে জমি, নিজেই যা পারি করতে থাকি।

দুদিন বাদে ঝুমা বলল, দিদি ও বলছিল এই বাগানের একধার দিয়ে একটা ছোট বেঞ্চি বানিয়ে দিলে বেশ বসা যায়। বসাবো? যখন তোমরা বসবে বসলে, কখনো আমরা।

গাছেদের জায়গা নিয়ে নেবে কিনা এই ভাবনাটা একবার মনে ঘাই দিয়েছিল ইরার। তবু বেঞ্চি বসাতে আপত্তি করেনি, বেশ পার্কের মত যেন। নিজেও এমন ভেবেছিল একসময়, কিন্তু জীবনের ভয়ে কথাটা তুলতে পারে নি। একবার হ্যাঁ বলতেই, ছেলেটা স্কুলের থেকে একটা ভাঙা বেঞ্চি এনে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিল বেল গাছের ডালে। এটাই বেশি ভাল দিদি, আপনার গাছেদের জায়গা নিল না।

প্রবীর ছেলেটিও খুব মিশুকে। বাগান ঘুরে ঘুরে কত তারিফ করল। এই যে দু তিনটে বড় বড় গাছ আছে না, এদের পাতা একটু ছেঁটে দিলে ফুলের গাছেরা বেশি আলো বাতাস পায়।

ওইটাতো আমি পারি না একদম।

তাতে কি, আমি হলাম মালদার ছেলে। আমবাগান আছে আমাদের। গাছে উঠে আমিই কত পারি।

রবিবার দেখে করেও দিল ছেলেটা।

করবে না কেন? থাকে উপরে, কিন্তু দখল নিচ্ছে নিচের জমির। পেটে পেটে প্যাঁচ যত।

তাতে তোমার কি? তুমি যেন বাগানে কত আসো।

তাতে কি? বাগান তো আমাদের ভাগে। আজ ওদের বেঞ্চি ঝুলিয়েছে। উঠোনে জামা কাপড় মেলা হয়, দেখবে এর পরে সেখানেও ওরা মেলতে এসেছে। একে বলে দখল নেওয়া। মানুষের চরিত্র তো জানি আমি।

বেশি কথা হলে উপরে কথা ভেসে যাবে, ইরা মুখ বুঁজে শুনে গেল শুধু। নিজেও ভোগ করবে না, অন্যকেও করতে দেবে না , এ কেমন কথা! বলল না মুখে। কথা বাড়ালেই বাড়ে। ওই যে ওরা বিকেল করে বাগানের ঝুলায় বসে হাসাহাসি গল্পগুজব করে, তাতে  ক্ষতিটা কোথায়?  এমন তো নয় জীবন কোনদিন তাকে নিয়ে বসবে। ইরা দুপুরবেলা বসে দেখেছে, বেশ লাগে। একদিন বেলার দিকে ঝুমা এসে হাজির, হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক। তোমার ঘর থেকে দুটো কাপ নিয়ে নেবে ইরা দি? বেশ আমরা এখানে বসে চা খাঁই!

কি ভাল যে লেগেছিল ইরার। কদিন বাদে কয়েকটা ডালের বড়া বানিয়ে নিজেই ডাক দিয়েছিল ঝুমাকে। তোর চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে আয়, বড়ার সঙ্গে খাবো।

তোর বাবা মাকে এখানে আসতে বল একদিন। গল্পের ফাঁকে বলেছিল ইরা।

হালকা মেঘ উড়ে গেল ঝুমার মুখের উপর দিয়ে। ওরা ত্যাজ্য করেছে ইরাদি। স্কুল মাস্টার জামাই ওদের পছন্দ নয়। দিদির বর ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্গালোর থাকে।  ওদের ওখানেই জামাইয়ের খোঁজ করছিল।

ভালবাসার বিয়ে বুঝি তোদের?

নিমেষে হাসিতে ভরে গেল মেয়েটার মুখ। ভালবাসা, ঠিক তোমার ওই গাছদুটোর মত। আঙ্গুল তুলে দেখাল তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা ব্লীডিং হার্টের দিকে। এই কদিনেই গাছে নুয়ে পড়া ফুলের ঝাঁক, ঠিক যেমন অমূল্য বলেছিল। পাশাপাশি দুটো গাছ, হাওয়ায় একটু একটু কাঁপছে ফুলের পাপড়ি। ভালবাসায় দুটো গাছ একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সত্যিই তো ঝুমা আর প্রবীরের মত। এমন ভালবাসা হয় বুঝি স্বামী স্ত্রীতে! রাতে দোতলার বারান্দায় বসে ওরা গল্প করে, ঝুমা মাঝে মাঝে গানের দুই এক কলি গেয়ে ওঠে। প্রবীরকেও গলা মেলাতে শোনে মাঝে মাঝে।

ঠিক করেছিস ঝুমা, তোরা আলাদা হয়ে গেলে কি হত! শুকিয়ে যেতো দুটো গাছই, ভেবেই মনের মধ্যে কেমন করে। কদিনেরই আলাপ এদের সঙ্গে, তবুও।

ঝুমার থেকে ধার করা খুশি স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছিল ইরার মনে। তাই বলে আশা করেনি জীবন তাকে সন্ধ্যাবেলায় হাতে একতারা টিপ ধরিয়ে দেব। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, আসলে ট্রেনে একটা ছেলে উঠেছিল, খুব জোরজার করছিল কিনা। তাই।

আমি কি এসব পড়ি?

কেন পড়লে কি হয়? গলাটা উষ্ণ হয়ে উঠল জীবনের। সব উষ্ণতা রাগ হয় না। ঝপ করে গলা নাবিয়ে বলল, তোমার প্রতিবেশী তো পড়ে এসব। তুমি কেন নয়?

সেদিন রাতে জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিল ইরা।

পরদিন সকালে স্নান করে টিপ পড়ল কপালে, চুলও আঁচড়াল পরিপাটি করে। বাগানে গিয়ে উবু হয়ে বসল ব্লীডিং হার্টের পাশে। দুটো গাছই ফুলে ভরন্ত এখন। লাবন্যে পূর্ণ প্রাণ, ঝুমা প্রবীরের গাওয়া গানের কলি ভেসে উঠল গলায়। অথচ অন্য গাছটা যে কে সেই। নাকি একটু চাঞ্চল্য এসেছে তার শরীরেও? হালকা হাতে না বেড়ে ওঠা গুমড়ানো গাছটার কান্ডে হাত বোলায় ইরা। ফিসফিস করে ওর কানে কানে। অমূল্য যে বলে তোরা মানুষের মত? প্রতিবেশী ভাল পেলে নাকি গাছেরা ভাল থাকে? এত ভালবাসা তোর পাশে এনে দিয়েছি, এবার তো ডালপালা মেল একবার। কুঁড়ি বেরোক তোরও।

একলা গাছটারও কুঁড়ি ফুটুক সেটা মনেপ্রাণে চাইছিল ইরা।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment