প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

ফৌজি কওয়াল

(আজিজ মিঁয়া: ১৯৪২ – ২০০০)

 

দৃশ্য ১:

করাচির জৈনাব মার্কেট, আটের দশক। জুম্মার নামাজ শেষে কাওয়ালির আসরে ভিড় করেছেন কয়েকশ মানুষ৷ ‘কওল’ দিতে আসছেন আজিজ মিঁয়া, কওয়ালির ‘বেতাজ বাদশা’। তাঁর কওয়ালি শুনতে ভেঙে পড়েছে শহরের মানুষ। কিন্তু একি! কওয়ালির আসরে পুলিশ কেন? বিস্ময়ে সবাই দেখে, বিরাট পুলিশ বাহিনী ঘিরে রেখেছে গোটা অঞ্চল, যেন কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারাও বুঝি কওয়ালি শুনতে এসেছে! নাহ, সে রাতে পুলিশ এসেছিল পরিস্থিতি সামলাতে৷ আজিজ মিঁয়ার সুরের এমনই জাদু, লোকেরা পাগল হয়ে যায়, শুরু হয় মাতলামো, ভাঙচুর, চরম বিশৃঙ্খলা। সেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আটকাতেই পুলিশের আগমন। এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেছে কি? অবশ্য ‘শাহেনশাহ-এ-কওয়ালী’র সেদিকে হুঁশ নেই। নেশায় চুর, টলোমলো পায়ে এগিয়ে এসে মঞ্চে উঠেন। হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে সমবেত পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে ছুঁয়ে দেন ‘নজ্ম’-‘কিঁউ গুস্তাখি করতা হ্যায় / জরা হোশ মে আ’…

 

দৃশ্য ২:

সত্তরের দশক, লাহোর ক্যান্টনমেন্ট। কওয়ালির আসরে আচমকা চলল এলোপাথারি গুলি, তবে তা কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। সে রাতে খোলা আকাশের দিকে প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিল ব্যারাকের জওয়ানরা। কওয়ালি শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন তাঁরা। কার গান শুনে এমন ‘মদহোশ’ হয়ে পড়েছিলেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি লাহোরবাসীর। এনকোয়ারি বসে, হয়েছিল জনা চারেক কোর্ট মার্শাল। রিপোর্টে উঠে আসে অভিযুক্ত কওয়ালী গায়কের নাম, তিনি আজিজ মিঁয়া। তাঁর কওয়ালির সুরে আত্মহারা হয়ে যখন সেনারা শূন্যে একের পর এক গুলি দাগছেন, সে সময় হারমোনিয়াম থেকে হাত সরাননি আজিজ মিঁয়া, ভাবোন্মত্ত হয়ে চিৎকার করে বলেছেন, ‘খুদা ই রহমত’, ‘শুভান আল্লাহ’! গোটা পাকিস্তান সেদিন তাঁকে ‘ফৌজি কওয়াল’ নামে চিনেছে।

তখনও ‘নুসরাত’ জমানা শুরু হয়নি কওয়ালির জগতে। ‘তুম এক গোরখধান্ধা হো’ আসতে বহু দেরী। তখন তামাম পাকিস্তান জুড়ে একজনের নামই কওয়ালির জগতে ‘রৌশন’; তিনি আজিজ মিঁয়া৷ কওয়ালির জগতে যে এক অনন্ত বিস্ময়, প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। যাঁর গান একদিকে যেমন আম-জনতার ‘দিল-ও-জান’ এ ঢেউ তুলেছিল; তেমনই শানিত হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা, বিরুদ্ধাচার, এমনকি অধার্মিকতার অভিযোগ ও বিতর্ক৷ একধারে রসিকজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, অন্যদিকে কট্টরপন্থীদের চোখ রাঙানি – সাতান্ন বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে সবকিছুরই আস্বাদ গ্রহণ করেছিলেন আজিজ। ক্রমশ, নিজেই হয়ে উঠেছেন এক জলজ্যান্ত কিংবদন্তি।

‘শাহেনশাহ্-এ-কওয়ালি’ আজিজ মিঁয়ার জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ এপ্রিল, দিল্লিতে, তাঁর খালার বাড়িতে। দিল্লিতে জন্ম হলেও আজিজ ছিলেন উত্তরপ্রদেশ-মেরঠের বাসিন্দা। তাঁর ‘ওয়ালিদ’ আকবর হুসেইন ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ, পছন্দ করতেন শাস্ত্রীয় সংগীত৷ দেশভাগের সময়, মাত্র পাঁচবছর বয়সে মেরঠ ছেড়ে লাহোর, পাকিস্তানে উঠে আসে তাঁর পরিবার। মেরঠ ছেড়ে লাহোরে চলে আসা গভীর প্রভাব ফেলেছিল আজিজের মনে। বহুদিন স্বাভাবিক কথাবার্তা বন্ধ রেখেছিল ছোট্ট আজিজ। তাঁর মা-বাবা পড়েছিলেন গভীর দুশ্চিন্তায়৷ এই সময়ে ভর্তি হন লাহোরের দাতা গঞ্জ বখশ স্কুলে। এর পরেই তাঁর চরিত্রে দেখা যায় অদ্ভুত পরিবর্তন। শিকড় উপড়ে দেশান্তরি হওয়ার যন্ত্রণায় যে শিশুটি প্রায় মূক-বধির হয়ে পড়েছিল; হঠাৎই উদ্ধত, দুর্বিনীত, আগ্রাসী হয়ে ওঠে৷ স্কুলে বা কলোনিতে যখন তখন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া অভ্যাসে পরিণত হয় তাঁর। ঝগড়া ঝামেলা মারপিটে প্রায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷ পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায়, ছেলেকে বাগে আনতে কিরানা ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী উস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিমের জন্য পাঠান বাবা আকবর হুসেইন, আজিজ তখন বছর দশ। আবদুল ওয়াহিদের কাছেই সংগীতের প্রথম পাঠ নেন আজিজ মিঁয়া; শেখেন শাস্ত্রীয় রাগদারি, সেমি ক্লাসিকাল, গজল এবং সর্বোপরি কওয়ালি।

খুব অল্পসময়ের মধ্যে নিজ সাঙ্গীতিক প্রতিভার পরিচয় দেন আজিজ। সাকরেদের সুরের দখল ও ঈশ্বরদত্ত গায়কীর আভাস পেয়ে মুগ্ধ আবদুল ওয়াহিদ। কে বলবে যে ছেলে সর্বক্ষণ মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অভ্যস্ত; তাঁর এমন ওজস্বী কণ্ঠ, এমন নিখুঁত সুরের দখল ও অসম্ভব লয়কারি। আবদুল ওয়াহিদ তাঁর সর্বস্ব ঢেলে সাজাতে থাকেন তাঁর শিষ্যকে। খুব অল্পবয়সে গুরুর পাশাপাশি স্টেজ শো করতে দেখা যায় আজিজকে। ভালোবেসে নিজের নাম রেখেছিলেন আজিজ মিঁয়া ‘মেরঠি’। পাকিস্তানে চলে আসলেও আজিজ ভোলেননি মেরঠের চৌক-বাজার, ব্যারাক, আম বাগানের কথা। এতটাই ওতপ্রোতভাবে জুড়ে ছিলেন মেরঠের সঙ্গে; নিজের নামের শেষে তার শিকড়চিহ্নকে সংযুক্ত করতে দ্বিধা করেননি একমুহূর্ত। অথচ তাঁর এই নব্য পরিচয় ভালো চোখে নেয়নি নতুন দেশের ‘আওয়াম’। সমালোচনা শুরু হয় তলে তলে৷ কিন্তু আজিজ ছিলেন নির্বিকার। একটা বড় সময় নিজেকে ‘মেরঠি’ বা মেরঠের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তিনি৷ হিন্দুস্তানী রাগ রাগিনীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, অনুরাগ ছিল অসম্ভব৷ শুরু করেছিলেন নতুন করে, অন্যরকম বিদ্যাভ্যাস৷ এই শিক্ষার মূলে ছিল নিজের ফেলে আসা ঐতিহ্য-পরম্পরা চিনে নেওয়ার তাগিদ।

লাহোরের সুপ্রাচিন দাতা গঞ্জ বখশ স্কুলে পাক্কা ১৬ টি বসন্ত কাটানোর পর, পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্রুপদি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হন তিনি। ছিলেন অসম্ভব মেধাবী ছাত্র। কলেজ জীবনেই শেক্সপিয়ার, মিলটন, চসার, বায়রন, শেলি, জন কিটস কণ্ঠস্থ করেছেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি ও উর্দু সাহিত্য সহ দর্শনশাস্ত্রেও স্নাতকোত্তর করেন তিনি৷ অনিবার্য ভাবে কলেজ জীবনে তিনি প্রেমে পড়েন ‘মদ্যপানে’র। বন্ধুরা বলতো, উট যেভাবে জলপান করে, একইভাবে আকণ্ঠ মদ্যপান করতেন আজিজ। একবার এহেন মদের নেশায় চুর হয়ে হোস্টেলের ছাদের রেলিঙে উঠে পড়েন; খালি পায়ে বিপজ্জনক ভাবে এ-মাথা ও-মাথা করতে করতে সুফিসাধক বাবা ফরিদ ও কিটস আওড়াচ্ছিলেন আজিজ। সে দৃশ্য দেখে বন্ধুদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, তাঁরা জানতেন একমুহূর্ত অসতর্ক হলে অনিবার্য মৃত্যু। কিন্তু কারুর সাহস নেই তাঁকে গিয়ে নেমে আসতে বলে, সে ক্ষেত্রে আজিজের অকথ্য ও নক্কারজনক গালি-গালাজের তোপের মুখে ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। বরাবর একরোখা, জেদি, দুর্বিনীত এবং উগ্রচণ্ডা স্বভাবের আজিজ মিঁয়া, কিন্তু হারমোনিয়াম ধরলেই মুহূর্তে পালটে যেতেন। যেন ঈবাদতে বসেছেন, নিরলস সাধনা করছেন সুরের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে৷ কলেজ ফাংশন থেকে কলোনি ম্যহফিল; ধীরে ধীরে একটু একটু সংগীতের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে নিজেকে মেলে ধরছিলেন আজিজ মিঁয়া। প্রথমে লাহোর জুড়ে ছোট ছোট জলসা, ব্যক্তিগত ম্যহফিল বা অন্য অনুষ্ঠানে গানের ডাক পান, যা অচিরেই ১৯৬৬ সাল থেকে অফিসিয়াল কনসার্টে ভাগ নিতে শুরু করেন আজিজ মিঁয়া৷। অচিরেই তাঁর নামডাক ছড়ায় তামাম পাকিস্তানে৷

আজিজ যখন নাবালক, সে সময়ে পাকিস্তানে গজল, হাভেলি সংগীত ও কওয়ালির সিংহাসন দখল করে রেখেছেন প্রথিতযশা কওয়াল বাচ্চা – সাবরী ব্রাদার্স বা সাবরী ভায়েরা। উস্তাদ গুলাম ফরিদ সাবরী ও উস্তাদ মকবুল আহমেদ সাবরী তখন ‘দিওয়ান-এ-ম্যহফিল’এ অভূতপূর্ব চারচাঁদ লাগাচ্ছেন। আজিজ যখন মাত্র ১৬; একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে, রাস্তায় চায়ের দোকানে রেডিওতে সাবরী ব্রাদার্সের কওয়ালি শুনে মুগ্ধ হন। এরপর যেখানে যেখানে সাবরী ব্রাদার্সের কওয়ালি ম্যহফিল, সেখানে সেখানেই নগ্নপদে ছুটে গেছেন আজিজ মিঁয়া। সাবরী ব্রাদার্সের কওয়ালি শুনেই তিনি কওয়ালি গাইবার সংকল্প নেন ও গুরুর কাছে কওয়ালি শেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ প্রথমে সে প্রস্তাবে রাজি হননি, কিন্তু আজিজের মেধা ও পীড়াপীড়িতে শেখাতে রাজি হন। কওয়ালি শুধু শেখা নয়, তা নিয়ে রীতিমতো সাধনা শুরু করেন আজিজ। বাবা আকবর হুসেইন বরাবর চেয়েছিলেন তাঁর মেধাবী পুত্র পড়াশোনা শেষ করে সরকারি মুলাজিম হোক; কিন্তু ‘ওয়ালিদে’র সেই ভাবনায় জল ঢেলে নিজেকে ‘কওয়াল’রূপে প্রতিষ্ঠা করতে মনোনিবেশ করেন আজিজ। শুধু গায়কী বা আঙ্গিক পরিবর্তন নয়; কওয়ালির বন্দিশও নিজেই লেখা শুরু করেন তিনি। কবি হিসেবে আগেই খ্যাতি পেয়েছিলেন আজিজ, এ বার ‘কওয়াল’ হিসেবেও নিজেকে অল্পসময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজের দল। শুরু হয় অবিচ্ছিন্ন রেওয়াজ, লেখালেখি এবং ম্যহফিল সাজিয়ে তোলার মহার্ঘ ব্রত।

১৯৫৮ সালে ‘ইএমআই-পাকিস্তান’ থেকে মুক্তি পায় সাবরী ব্রাদার্সের কওয়ালির প্রথম এলবাম – ‘মেরা কোই নেহি হ্যায় তেরে সিবা’। দাবানলের মতো ছড়ায় সাবরী ভায়েদের সুখ্যাতি, যার আঁচ মাত্র ১৬ বছর বয়সে টের পেয়েছিলেন আজিজ মিঁয়া। পরবর্তীতে, কওয়াল বিশারদ হয়ে ওঠেন তিনি নিজেও। এক্ষেত্রে বলে রাখা জরুরি, আগে কওয়ালি গাওয়া হতো পঞ্জাবী ভাষায়, সুফিসূত্র ধরে পঞ্জাব প্রদেশ, মূলতান, পেশোয়ারে; মূলতঃ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত জনপ্রিয় ছিল কওয়ালি৷ আজিজ মিঁয়া এবং সাবরী ব্রাদার্সের মহান অবদান – সেই কওয়ালিকে শহর জীবনে, নাগরিক জনজীবনে মিশিয়েছেন তাঁরা৷ আমীর খসরুর এই অসামান্য সৃষ্টিকে এক ব্যতিক্রমী রূপদান করেছিলেন উভয়ে। এতদিন পঞ্জাবী বা ঠাট খড়িবলিতে কওয়ালি গাওয়া হলেও, এবার উর্দু ভাষার গাওয়া শুরু হয়, যার নেপথ্যে ছিল সাবরী ব্রাদার্স ও আজিজ মিঁয়ার মতো কওয়াল বিশেষজ্ঞরা। পরবর্তী কালে কওয়াল গায়কদের এই সৌহার্দপূর্ণ স্বহানস্থান পরিণত হয় রূদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যাকে বৈরীতা বললেও কম বলা হয়। সে আরেক ইতিহাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ডিঙানোর সময়েই আজিজ মিঁয়া মনস্থ করে ফেলেছিলেন তিনি কওয়ালিকেই তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও পেশাদারিত্বে পরিণত করবেন। তখন তাঁর উঠতি বয়স, প্রতিভাবান গায়ক হিসেবেও ছড়িয়েছে নাম-ডাক। আস্তে আস্তে লাহোরের বিভিন্ন ম্যহফিল রৌশন করা শুরু করেন তিনি। আজিম মিঁয়ার স্টাইল স্টেটমেন্টও সে সময়ে যথেষ্ট নজর কেড়েছিল। লম্বা ফর্সা টকটকে চেহারার মানুষ, অবিন্যস্ত চুল, রংবেরঙের সালওয়ার-কামিজ পরিহিত, আগুনঝরা দুটি চোখ আর ততোধিক বুলন্দ আওয়াজ – তাঁকে ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল৷

আগে যারা কওয়ালি গাইতেন; তাঁরা উঠে আসতেন গ্রাম-দেহাত থেকে, তাঁদের ফকিরি জীবনযাত্রা এবং কওয়াল গায়ক হিসেবেও নিরালম্ব সাধন-মার্গ লোকেদের আকৃষ্ট করত। কিন্তু কওয়ালি গায়কদের সেই বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করেছিলেন আজিজ। তাঁর কথাবার্তা, আদব কায়দায় উপচে পড়ত আভিজাত্য, বনেদিয়ানা। অনর্গল বলে যেতে পারতেন উর্দু, ফারসি, পঞ্জাবি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায়। সাথে মিশেছিল সুরাপানের নেশা। অধিকাংশ সময়েই নেশার ঘোরে বিভোর হয়ে থাকতেন। জড়িয়ে যেত কণ্ঠস্বর, অথচ গান গাইতে বসলেই একদম স্টেডি। হারমোনিয়ামে তুলতেন অনর্গল ঝড়৷ এমন ক্যারিশমাটিক মানুষ যে জনপ্রিয় হবেন, সেটাই প্রত্যাশিত।

আজিজ মিঁয়া যখন সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন, তখন পাকিস্তান জুড়ে সর্বত্র ‘সাবরী’ ভাইয়েদের দাপট৷ লোকেরা ‘সাবরী ব্রাদার্স’কে দেবজ্ঞানে পুজো করত৷ উস্তাদ গুলাম ফরিদ এবং মকবুল আহমেদ – দুই ভাইয়ের কওয়ালি শুনতে উপচে পড়ত ভিড়৷ ১৯৫৮ সালে ইএমআই-পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সাবরী ভায়েদের ‘কোই নেহি হ্যায় তেরে সিবা’ রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে৷ সেই গান শুনে উদ্বেলিত হন আজিজ মিঁয়াও। সেই প্রথম সাবরী ভায়েরা উর্দু ভাষায় কওয়ালি গান, তার আগে কওয়ালি গাওয়া হত পাঞ্জাবি ও ফারসিতে৷ উর্দুতে প্রথম কওয়ালি শুনে মুগ্ধ হন আজিজ।

একসময় সাবরী ভায়েদের মনে মনে গুরু ঠাউরে হারমোনিয়ামে সুর ভাঁজেন তিনি৷ ষাটের দশক, গোটা লাহোরে কওয়ালির ম্যহফিলে তখন একটাই নাম – আজিজ মিঁয়া। একটা বড় সময় প্রচলিত কওয়ালি গাওয়ার পর, নিজের হাতে কওয়ালির বন্দিশ লিখবার কাজ হাতে নেন তিনি, যা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। অবশ্য প্রথমেই কিন্তু ‘বন্দিশকার’ হয়ে ওঠেননি আজিজ। সাবরী ভায়েদের অনুকরণে তাঁদের কলমচিদের কাছে যান আজিজ, যদিও কেউ তাকে পাত্তা দিতে চায়নি৷ সাতের দশকে প্রথম স্বরচিত কওয়ালি গেয়ে জনপ্রিয়তা পান তিনি৷ এর পর নিজের লেখা কওয়ালিই বরাবর গেয়ে এসেছেন তিনি৷ কয়েক বছরের মধ্যেই মিঁয়া আজিজ হয়ে ওঠেন ‘জাতীয় সম্পদ’।

একদিকে যখন খ্যাতির চূড়ায় পা রেখেছেন আজিজ, অন্যদিকে বাজারে নতুন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলে আসায় সমস্যা বাড়ে সাবরী ভায়েদের। নতুন এই প্রতিভা অচিরেই তাঁদের হিংসা এবং চক্ষুশূলের কারণ হয়ে ওঠে। অন্য দিকে সে সব বিষয়ে উদাসীন; লাহোরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে একের পর এক ম্যহফিলে সুরের আগুন ধরাচ্ছেন তরুণ আজিজ মিঁয়া৷ সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তাঁর মদ্যপানের ধুম। ষাটের দশকের শেষ থেকে গোটা সত্তর দশক, এককথায় আজিজ মিঁয়ার যুগ৷ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় আজিজ মিঁয়ার প্রথম ডেবিউ অ্যালবাম ‘ম্যায় শরাবি’। রাতারাতি প্রায় ১০ লক্ষ রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায় ‘শরাবি’র৷ আজিজ মিঁয়ার কথায়, সুর ও গানে বুঁদ তামাম পাকিস্তান। যে কোনও ম্যহফিলের আলো কেড়ে নিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। মুখ ভর্তি পান, আকণ্ঠ সুরা, চড়া আতর, অবিন্যস্ত পায়ে টলমল করতে করতে মঞ্চে উঠতেন তিনি, হাতড়ে হাতড়ে টেনে নিতেন হারমোনিয়াম – এর পরেই ঘটত বিস্ফোরণ, ‘সুরেলা’ বিস্ফোরণ।

এইসময়, বিশেষ করে সাতের দশকের প্রথম ভাগে তুমুল বিতর্কে জড়ান আজিজ মিঁয়া৷ প্রশ্ন ওঠে তাঁর লেখা কওয়ালির দিকনির্দেশ নিয়ে। কওয়ালির বন্দিশ রচবায় প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন আজিজ, তুলে আনেন এক নতুন ধারার কাব্যিক অথচ আধ্যাত্মিক মননের প্রতিফলন। পরমকল্যাণময় ঈশ্বরকে আহ্বান করার নতুন ভাষা তৈরী করেন। এই প্রাত্যহিক দৈনন্দিনতার প্রতিটি আচারে-আওচারে ঈশ্বরকে স্মরণ করার সহজসরল কথ্য ভাষাপ্রয়োগ করা শিখিয়েছিলেন আজিজ, যেখানে ঈশ্বর হয়ে ওঠেন আপনার সতীর্থ, বন্ধু, সকল সুখদুখমাখা এক নশ্বর মানব, যার সঙ্গে অবলীলায় ‘তুই-তোকারি ও খুনসুটি করা যায়, ভাগ করে নেওয়া পেয়ালা। কিন্তু কওয়ালির সুরে এমন সহজসাধ্য ঈশ্বরচেতনা পছন্দ হয়নি পাকিস্তানের সাবেক রক্ষণশীল, কট্টরপন্থী সমাজের। আজিজের নামে ‘হুলিয়া’ বের হয়, দেওয়া হয় চোখরাঙানি। কিন্তু আজিজ ‘নির্বিকার’। তিনি সুরা ও সাকির মাধ্যমে ঈশ্বরিক সাধনার নতুন মার্গ খুলে দেন। এর ফলও ভোগ করতে হয় তাঁকে। তাঁর গানের অনুষ্ঠানে চলে হামলা, শুরু হয় কুটিল ষড়যন্ত্র। কিন্তু আজিজকে থামানো যায়নি, তিনি তখন সর্বার্থে অপ্রতিরোধ্য৷

অন্যদিকে দূরত্ব বাড়তে থাকে সাবরী ভায়েদের সঙ্গেও। প্রকাশ্যে আজিজকে উপহাস, অপমান করতে থাকেন ‘সাবরী’রা। তাঁর কওয়ালি শুধুই হইহল্লা ও উচ্চকিত ধ্বনির আঁতুড়ঘর বলে প্রায় লেভেল এঁটে দেন সাবরী ভাইয়েরা। কিন্তু মিঁয়া আজিজ নিজের অবস্থান থেকে সরে বিন্দুমাত্র সরে আসেননি। ১৯৭৫ সাল এক্ষেত্রে উভয় শিল্পীদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সালেই মুক্তি পায় ‘সাবরী ব্রাদার্স’দের অ্যালবাম ‘ভর দো ঝোলি মেরি অ্যায় মহম্মদ’, রাতারাতি যা ব্যাপক হিট হয়। অন্যদিকে একইসময়ে মুক্তি পেয়েছিল আজিজ মিঁয়ার ৫০ মিনিটের সুদীর্ঘ ‘তেরি সুরত’ অ্যালবাম, যা এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়ে যায়৷ সেই গানে মুগ্ধ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭৬ সালে বিশেষ আমন্ত্রণ পাঠান আজিজ মিঁয়াকে৷ আজিজের এই খ্যাতিলাভে বেজায় চটেন সাবরী ভাইয়েরা। এবার কবির লড়াইয়ের মতো কওয়ালির লড়াই বাঁধে। মিঁয়া আজিজকে উপহাস করে সাবরী ব্রাদার্স গান বাঁধেন – ‘ও শরাবি, ছোড় দে পিনা’। থেমে থাকেননি আজিজ মিঁয়াও, সাথেসাথে নতুন গান বেঁধে দেন জবাব – ‘হায় কমবখত্, তু নে পি হী নেহি’।

কিন্তু এই সামগ্রিক তাল-বেতালার সুর কাটে ১৯৭৭ সালে, তৎকালীন জেনারেল জিয়া উল হক সরকারের জমানায়। সে সময় সুরাপান, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন হয় একপ্রকার ‘নিষিদ্ধ’। কড়া পরোয়ানা জারি হয় আজিজ মিঁয়ার বিরুদ্ধে৷ একটা সময় ছিল, যখন মিঁয়া আজিজ এর অনুষ্ঠান মানে মদের ফোয়ারা, সুর ও সাকির নেশায় মাতোয়ারা হতো আবালবৃদ্ধবনিতা, সে সব নিমেষে বন্ধ হয়ে যায়৷ মিঁয়ার অনুষ্ঠান হলে সেখানে আগেভাগে পৌঁছে যেত পুলিশবাহিনি, রাখা হতো ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে কড়া নজর। আস্তে আস্তে ভাঁটা পড়তে থাকে আজিজ মিঁয়ার শো-তে। এমনকি আজিজ মিঁয়ার অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে পুলিশ, চলেছে লাঠিচার্জ, অবাধে গ্রেফতারি। ক্ষোভে শোকে ভেঙে পড়েন মিঁয়া আজিজ। এতে অবশ্য খুশিই হয়েছিলেন সাবরী ব্রাদার্সরা৷

কিন্তু আজিজের মতো অপ্রতিরোধ্য প্রতিভাকে বেশিদিন দমিয়ে রাখা মুশকিল৷ আটের দশকে পুলিশি অত্যাচার এবং আগ্রাসন ঠেকাতে নতুন এক পন্থা নিলেন আজিজ। কওয়ালি ম্যহফিলে অপেক্ষারত পুলিশদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে গাইতে শুরু করেন সুদীর্ঘ কওয়ালি, যার দৈর্ঘ্য কম করে দেড় থেকে দুঘন্টা। ১৯৭৯ সালে তাঁর সুপারহিট কওয়ালি ‘আল্লা হি জানে’ দিয়ে শুরু করতেন অনুষ্ঠান, শেষ করতেন ‘হসর কে রোজ ইয়ে পুছুঙ্গা’ গান দিয়ে যার দৈর্ঘ্য ১১৫ মিনিটের কিছু বেশি৷ অধিকাংশ সময়ে অধৈর্য, ক্লান্ত হয়ে ম্যহফিল ত্যাগ করত যুযুধান পুলিশ বাহিনী। এর মধ্যে ‘হসর কে রোজ ইয়ে পুছুঙ্গা’ কওয়ালিটি বিশ্বের দীর্ঘতম গানগুলির অন্যতম হয়ে ওঠে।

আশির দশকের শেষভাগে আর তেমন নতুন করে অনুষ্ঠান পাচ্ছিলেন না আজিজ মিঁয়া। সে সময়ে আসর জমাচ্ছেন এক নতুন প্রতিভাবান কওয়াল – নুসরাত ফতেহ আলী খান৷ নুসরাতের ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ, গায়কি ও প্রতিভায় মুগ্ধ গোটা বিশ্ব, পাকিস্তানও। জিয়া উল হক সরকারের জমানায় পাকিস্তানের কওয়ালির স্বর্ণযুগ প্রায় শেষ হয়ে আসে৷ সাবরী ব্রাদার্স বা আজিজ মিঁয়া কেউই আর হালে পানি পাচ্ছিলেন না। সময়ের মার বুঝি একেই বলে! এর মধ্যেই দু:খে হতাশায় দৈন্যদশার বেদনা ঢাকতে নিজেকে ক্রমশ মদ ও নেশার মহাসমুদ্রে ডুবিয়ে দেন আজিজ মিঁয়া। ঘরে দুটি বউ, ১২ টি সন্তান; তাদের ভরনপোষণ করতে গিয়ে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন তিনি। সে এক অস্থির সময়, দিনরাত মদের নেশায় ডুবে তিনি, লিখতে পারছেন না একলাইনও, যা কিছু লিখছেন তা ফরমায়েশি, সেই টাকা দিয়ে ঘরে অন্ন জোগান দেন আজিজ। নয়ের দশকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

১৯৯৪ সাল, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন সাবরী ব্রাদার্সের প্রাণপুরুষ উস্তাদ গুলাম ফরিদ সাবরী৷ চরম শত্রুতা থাকলেও এই ঘটনায় ভেঙে পড়েন আজিজ মিঁয়া৷ গুলাম ফরিদের স্মরণে লেখেন, ‘ইয়ার না রুঠে, ফির না রুলায়ে কোই’। টানা নয়ের দশক ছোট ছোট করে অনুষ্ঠান করা জারি রাখলেও আজিজ মিঁয়া অচিরেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সময় ফুরিয়েছে। ২০০০ সালে ইরানের সুলতানের আমন্ত্রণে তেহরান পাড়ি দেন আজিজ মিঁয়া, তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে। ইরান সফর মাঝেই ৬ ডিসেম্বর ২০০০ সালে ঘুমের মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করেন আজিজ মিঁয়া। সে সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর৷

২৩ বছর হল প্রয়াত হয়েছেন আজিজ মিঁয়া। কিন্তু আজও তাঁর গান, কওয়ালি অবিনশ্বর, অক্ষয় অমরত্ব পেয়েছে৷ তিনি শিখিয়ে গেছেন ঈশ্বরসাধনার এক ভিন্নমার্গ। সে পথে কেউ চলুক না চলুক, ঈশ্বরচেতনার যে অনন্ত আলোর সন্ধান দিয়েছেন আজিজ, আজও তা সসম্মানে প্রণিধান যোগ্য। কওয়ালির ইতিহাস যতদিন অক্ষত থাকবে, চির অমরত্বের মহাসমুদ্রের তল ছুঁয়ে থাকবেন আজিজ মিঁয়া।

 

* কৃতজ্ঞতা: উর্দু আকাদেমি, পাকিস্তান এবং ‘দ্য ডন’ সংবাদপত্র।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment