প্রচারক
উদাত্ত গলার আওয়াজে তারা মন্দির-প্রাঙ্গণের বাইরে এল। রুক্ষ পাথুরে রাস্তাটার উপর সাদা কাপড়ে মাথা ঘাড়। চোখে শেডস। অনাঘ্রাত সেই যুবতীর দল বিস্ময়ে ভেবেছিল তাকে কোনো সন্ত বা প্রচারক, নিদেন তীর্থক। তার পিছন দিক থেকে যখন বেরিয়ে যখন ঘিরে ধরল ছায়ামূর্তিরা তখনও তারা শঙ্কিত হয়নি। প্রচারক ঠান্ডা গলায় তাদের বলল, সঁপো – তারা বোঝেনি – জংলি পোশাকের হাতগুলো তাদের বুক, পাছা থেকে ছিঁড়ে নিতে লাগল আবরণ, দেওয়ালের গা থেকেও যেমন প্রত্যেকটা ইঁট। একখান চেয়ার মাঝখানে রেখে কনচার্তো-র সফল কন্ডাক্টরের মতো ব্যস্ত ছিল সে, উত্তেজিত ও মগ্ন। সার্চ – বলতেই তার সঙ্গীরা সমস্ত প্রাঙ্গণ, ঘর, শরীরের আনাচকানাচ, চোখ, মুখ, দাঁত, হাত, পা দিয়ে তন্নতন্ন করতে লাগল। আলো ডুবে রাত নামল। বড় বড় লাইট ফেলা হল। পরের দিন ভোরের দিকে দেখা গেল তারা ক্লান্ত, উৎসাহ ফুরিয়ে আসছে। ব্লু-শেডস তুড়ি মেরে বলল, রিট্রিট। এক নিমেষে যেন ফাঁকা হয়ে গেল, যেন স্রেফ দুঃস্বপ্ন ছিল। শুধু রাস্তার ধারে চেবানো-কাঁটার মতো পড়ে থাকা মেয়েটা কষের থেকে বুড়ো আঙুল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে শুনতে পেল অধুনা-অদৃশ্য ব্লু-শেডসের গমগমে গলা – এগুলো সব ভালোর জন্যই হয়েছে। বুঝতে পারল মেয়েটা, সে ভুল করেনি শুরুতে – আসলে যে প্রচারকের আবির্ভাব হওয়ার কথা ছিল – এই সে। কিন্তু কাউকে বলার মতো অবস্থায় সে আর ছিল না।
কথা-খেলাপিরা
ক্রমবর্ধমান ঠুং। মাদকতার বেলোয়ারি। কথাখেলাপিরা মুখোমুখি বসে চুমুক মারছে শব্দে, গিলে নিচ্ছে, আর জানলার বাইরে পৃথিবীর মূকাভিনয়। এর মধ্যে বৃষ্টি। যেন সিনেমা সবাক হল এমন রিমিঝিমি রুমুঝুমু। রুমু বা ঝুমু কেউ একটা তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে মেঘলা রঙের ঘরে দুধ-সাদা বিছানায়। স্প্রেড-ঈগল। আঙুল ঠোঁটে গোঁজা – উপর ও নিচ দুয়েরই। রিমঝিম জলাভাস, দরজার সামনে নিঃশব্দে জুতো খোলার তাড়নায় থাকে কথাখেলাপিরা – এমনই ফ্যান্টাসিতে ঝিম, রিমি বা ঝিমি। বেলোয়ারি নেশায় কথাখেলাপিরা মশগুল – ঠুং রেস্তরাঁয় – প্যান্টের উপর দিয়ে ঘসতে থাকে খাড়া লিঙ্গ। কে কার কাছে যাবে ঠিক করার আগেই মুষল ধারা হয় আর এমন সময় গমগমিয়ে শুরু হয়ে যায় দাস্তান। রুম ও ঝুম খাটে শুয়ে দেখে সেগুলো তাদের চামড়ায় ছাপা হয়ে যাচ্ছে। খিলখিলিয়ে ওঠে তারা। এবার কথাখেলাপিদের যে কেউ ফিরে যেতে পারে তাদের বিছানা থেকে বিনা বাক্যব্যয়ে।
ন
তাকে বলা হয়েছে নজরদারি, অপারগ না হলেও টিকটিকিবৃত্তি সম্মাননীয় নয়, যদি না জনপ্রিয় সাহিত্যের পাতায় কোনো ঘ্যামচ্যাক নামে উপস্থিত থাকে। অথচ বাস্তব পৃথিবীর সমস্ত টিকটিকির মতো সে নামহীন, যেমন কাফকার নায়কদের হয়। ‘কে’। অবশ্য অতটা পরিসর তার ভাগ্যে জুটবে না হয়ত, অতটা গুরুত্ব তার কপালে নেই। কারণ, তার কাজ উদ্ঘাটন নয় রহস্যের। স্রেফ নজরদারি। এটা তার পেশা, চাকরি, কাজ! অজস্র সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে, যান্ত্রিক স্বয়ংক্রিয় হরবখৎ ক্রিয়াশীল অ্যাপ, মেকানিজম মনুষ্য-শ্রম-ব্যতিরেক – তার মাঝে সে পেশাদার টিকটিকি! ভুল করে হয়ত তাকে এই কাজটা দেওয়া হয়েছে। কাজের তালিকা থেকে হয়ত বাদ যায়নি পেশাটা, চোখ এড়িয়ে টিকে গেছে। অথবা অতীতের স্মৃতি হিসেবে অদরকারি হলেও রেখে দেওয়া হয়েছে যেমন টেকনোলজিকাল ম্যুজিয়মে থাকে সচল স্টিম ইঞ্জিন। সেও এখন পুরদস্তুর হয়েছে। বিকেলের আবছা স্তিমিত আলোয়, রাতের ধোঁয়াশা ঝিম মিটমিটে স্ট্রিটল্যাম্পের বা কাঠ-দুপুরের ভিড়ের মধ্যে তার চলাচল। এই নজরদারির রিপোর্ট তাকে একদিন জমা দিতে হয়। ই-মেইলে পাঠিয়ে দেয়। কার কাছে পাঠায় সে ঠিক জানে না কারণ মেইল আইডি আর হোয়াটস্যাপ নম্বর ভিন্ন কোনো পরিচিতি নেই তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। তার সে রিপোর্ট নিয়ে কী করে তাও সে জানে না। জানা দরকারিও নয় – ওটা তার কাজের আওতায় পড়ে না। সে নিজের কাছে নিজের পরিচয় দেয় নজরদার হিসেবে। ন। গোয়েন্দা ন। রাস্তার ধারে মাঝে মধ্যে ভাঁড়ে চা খেতে খেতে সে জিরোয়, আর ভাবে গোটা পৃথিবীটাই যখন নজরদারি করছে, তখন আমার এই কাজটা কতটা অকিঞ্চন। নিজের ব্যর্থ জীবনের কথা ভেবে তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে সেই মুহূর্তে। সে বুঝতে পারে না যে এমন অকিঞ্চন হয়ে গেছে বলেই তার কামিজ থেকে ঝরে পড়ছে অসম্মান আর অপমানের ধুলো।
লীলা
লীলার জীবনে দুই প্রেমিক। দু-জন দু-রকম। একজন তাকে ডাকে লীলাবতী, আরেকজন লীল্। একজন ফর্মাল শার্ট ও ট্রাউজারের ভাঁজে ভাঁজ ইস্তিরিতে শোভন; আরেকজন হারেম প্যান্টস, প্রিন্টেড শর্ট কুর্তি ও টি-শার্ট। একজন তাকে নিয়ে যায় অনুষ্কা শঙ্কর বা সুজাত খানের কনসার্টে, আরেকজন তাকে শোনায় হিপহপ। একজন তারকোভস্কির ভক্ত অন্যজন দেখে গেম অফ থ্রোনস। একজন তার মাথা কাঁধে নিয়ে বসে থাক গঙ্গার তীরে, আরেকজনকে সে লালামাখা চুমুতে ভরিয়ে দেয় হাইওয়ের ধারে। একজনকে সে ডাকে এলিটিয়া, আরেকজনকে সে ডাকে হিপিহুপু। লীলা বলে তার বাম বুকের ভিতর দিকের তিলটা একজনের জন্য আর ডান থাইয়ের ট্যাটু-টা অন্যজনের। তার এক প্রেমিক আরেকজনকে বলে ক্লাউন, অন্যজন অপরকে বলে স্নব। আদরের সময় লীলা একজনের কাছে স্ফুরিত-অধরা থরোথরো যুবতী, অন্যজনকে সে উত্তেজনা জাগায় লেদার লঁজেরিতে ডমিন্যাট্রিক্সের প্রায়। একজন তাকে উপহার দেয় ফুকোর ‘যৌনতার ইতিহাস’ আরেকজন তাকে কোলে বসিয়ে শোনায় অ্যানাইস নিন-এর ডেল্টা অফ ভেনাস। একজন তাকে নিয়ে যায় পিটার ক্যাট-এ চেলো কাবাব খেতে, আরেকজন তাকে নিয়ে বিফ বিরিয়ানি খায় ধর্মতলার শুয়োর গলিতে। একজনকে লীলা মনে করে শিকড়, আরেকজনকে আকাশ। লীলা ভালবাসে দু-জনকেই। লীলা কারো মালিকানা চায় না। তারা কি চায় লীলা তাদের একজনের হোক এবং একজনেরই মতো? লীলা জানে না সেটা। তাদেরও হয়ত অন্য প্রেমিক আছে। লীলা এবং অন্য প্রেমিকা। দু-জনে দু-রকম।