কৌশিক ভট্টাচার্য

কৌশিক ভট্টাচার্য-র কবিতাগুচ্ছ

 

 

সন্ধ্যায়, আনমনে

 

হাওয়ার মর্মবেদনার গায়ে চুম্বনটুকুর রেখে আসে যে রেশ
তারে তুমি বীজের সম্ভাবনা দিও প্রেম

শিশিরের নিশিডাক শুনে যে জীবন ব্রাত্য রয়ে গেল
তার হৃদকমলে তুমি ফুটে উঠবে সন্ধ্যামণি ফুল?

এদিকে এ দেহে কৃষিকাজের সম্ভাবনা নেই বলে
পাড়ায় পাড়ায় কী ভীষণ বদনাম রটে গেছে
বদনখানি তার আলুথালু পড়ে থাকছে বস্ত্রহীনের ডেরায়
চোখে একদিন ঘুঙুর বেজেছিল এই তার অপরাধ
নিঃশ্বাসে একদিন নদী ডেকেছিল এই তার অপরাধ?

আলোর আস্তানা দেখে মাটির ময়লা যে ঝেরে ফেলেনি
তার খোঁপায় তুমি একদিন তারা হয়ে দুলো, দুলে উঠবে তো জোনাকি?

 

 

 

এইসব বিরহ ব্যাকুল সন্ধ্যায় পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে
পথে পথে পাখিদের পায়চারি
পূবের আলোর মতই সম্ভাবনাময়

দিনান্তে বয়ে যাওয়া বৈঠা যেন কোনো বৈদিক গান
যার সুরে নক্ষত্রের নদীপথ পারাপার করে মানুষ

গতজন্মের থেকে হাওয়া এসে
যে দেহ ভিজে যায় যে দেহ শিরশির করে শীতে

পঞ্চভূতের সেই দেহ, বাহান্ন খণ্ডে টুকরো টুকরো সেই দেহ

কার যেন বাঁশি শুনে খোলস ছেড়ে যায়

বাঁশি যাকে বদনাম করে
বৃষ্টি যার ভেঙে দেয় বাঁধ

সে এই পঙ্কে জেনো
পুষ্প হতে কখনো আসেনি

 

 

 

পাহাড়ের উপর একটা বসত হোক আমার। আমাতে সহবাস করুক অবিন্যস্ত বাতাস। বাতাসের বেদনা নিয়ে বিষাদ, একটা তিরতরে নদীর মতো বয়ে যাবে। তার বয়ে যাওয়াটুকু নিয়ে একটা দীঘল চোখ কাল পারাপার করবে মেঘের বীণায়। শ্যামার শয্যায় যখন কলমিলতা দুলে উঠবে আর খোঁপা থেকে খুলে যাবে নক্ষত্রের উঠোন তখন সপ্তর্ষিমন্ডলের আদলে ধীরে ধীরে বিকশিত হবে ইহকাল। খিটখিটে গৃহিণীর মতো তখন সেই শয্যায়, সেই কলমিলতায় হানা দেবে হিংসুটে চাঁদ। তার অনলে যে পুড়ে যায় তার নাম বাঁশি। বাঁশি, বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব প্রেমের হাতে।

 

 

 

 

এসো পথিক, অনুভব কর এই মায়া ও মেঘ। দ্যাখো তোমার স্বপ্নের ভিতর দিয়ে মন্থনরত পথ নেমে গেছে নদী আর নাভিতে। এ জন্ম সত্য জেনে তুমি উপভোগ কর জীবনানন্দ। জন্মান্তর সত্য জেনে তুমি অনুভব কর এই সমুদ্রসফেন, অনুভব কর চারিদিকের শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম। মায়া ও মন্থনের জগতে এসে তুমি ক্রমশ বুঝে নাও গদাচক্র রাজার পথ, রাজার পথে লোক ছুটে যাবে। তোমার সাথী অলসবেলার রাকা, রাকার আদরে আচ্ছন্ন হয়ে তুমি দেখবে চরাচর জুড়ে শঙ্খ লেগে আছে, শঙ্খ লেগে আছে চ্যাঙমুড়ি কানি আর চাঁদ বণিকে, শঙ্খ লেগে আছে সনাতন আর শ্রমণে, শক-হুণ-পাঠানে আর মোঘলে। মন্থন সত্য জেনে তুমি ক্রমশ প্রয়োগ করবে আসুরিক শক্তি, মেঘ আর বৃষ্টির দিনে তুমি নাচতে থাকবে পেখম মেলে। আর এভাবেই দিবার স্বপ্নে বুড়িয়ে যাবে দিবাকর। ক্রমশ তুমি বুঝতে পারবে বাঁশিতে লুকানো আছে বিষ, তুমি বুঝতে পারবে কোলাহল তো বারণ হল। তোমার উদাসীন চোখ তখন নেমে আসবে নাভিমূলে। পঙ্ক থেকে যার উত্থান তার রঙ পবিত্র ভেবে তুমি ভুলে যাবে রেললাইনে পড়ে ছিল রুটি আর রক্ত, শব আর শকুন ভাসছিল পতিতপাবনী গঙ্গায়, ভুলে যাবে এসবই ছলনা মাত্র। এই মায়া ও মন্থন সত্য জেনে, জন্ম ও জন্মান্তর সত্য জেনে তুমি ভুলে যাবে নিবেদিত আঙুলের নীচেই যুগে যুগে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে নিয়তির নিদারুণ ছোবল।

 

 

 

বড়ো নিয়তিতাড়িত এই চলে যাওয়া

যেন পাখি ঠোঁটে নিয়ে ফেরে অস্তরাগ
যেন সন্ধ্যের বারান্দায় বসে বসে কেউ
লিখে ফেলে আস্ত একটা নদী

দিনের আড়ালে ঝরেছিল যে ফুল
ডুবেছিল ডিঙি

তার মালি, তার মাঝি
জানে এই পথ, এই পথশ্রম

তারা জানে কার বুকে একদিন বেজেছিল সারিন্দা
আর কার পায়ে পায়ে ফিরেছিল ধুলো

এই পথ, এই পথশ্রম তাদের বাঁশি

যার সুরে সুর করে
পাঁচালি পড়েন দেবী লক্ষ্মী

অমৃত ও গরল
উঠে আসে মন্থন থেকে

 

 

 

অঙ্কুরোদগম

 

কেন চাঁদ রেখে যাও করতলে?

আমি তো নই সেই অনন্ত হাত
যার অভিকর্ষে ঘুমিয়ে থাকবে তারাদল
পাঁপড়ি খুলে দেবে সময়
সূর্যমুখী সকালে

আমি তো গহন প্রান্তে
মৃত্তিকা দিয়ে নির্মাণ করি
দেবতা, প্রেম আর আমাকে

আমি তো এক বিরাট সপ্তর্ষিমণ্ডলের লেজ ধরে গির্জায় গুনছি প্রহর পুঁথি
নিজস্ব হোলিগ্রেল থেকে রক্তফোঁটা তুলে নিয়ে ঢেলে দিচ্ছি মুণ্ডমালিনীর লজ্জাবতী জিভে

আমার কি ভার বহনের ক্ষমতা আছে?
সংসার জানলো না যে নববধূ
তার হাতে যে বিশ্বসংসার তুলে দিলে!

বরং করতলে রেখে যাও বাসনা, প্রাপনীয় শস্য

অসংখ্য ঘণ্টাধ্বনির অকালমৃত্যু শেষেও
মন্দিরগাত্র থেকে উন্মোচিত হবে
একদিন দেবতার ক্ষুদ্র শেকড়-
আমাদের কাঙ্ক্ষিত আহার্য

 

 

 

 

পিতৃজন্ম

 

নক্ষত্রমন্ডল থেকে ঝাপটা আসে বাতাসের
ঝিঙেফুল দোলে
দোলে আমাদের ইহকাল

বাইরে অঝোর শ্রাবণ
শ্রাবণে কর্মফল ঝরে

একে একে সব লন্ঠন নিভে যায়
ছাই ওড়ে

পরিমাণমতো লবণের অভাবে
আমাদের সব আহার্য ফেলে দিতে হয়
অজানা ফেরিওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে
নিরুদ্দেশে চলে যায় রিফু করা শৈশব

ব্যাঙেদের কোলাহলে ভীত হয়ে
ক্রমশ আমরা বেছে নিই সরীসৃপ প্রণালী

আমাদের সহবাস থেকে ভূমিষ্ঠ হয়
জল এবং জঙ্গল
আর আমাদের অতৃপ্ত রতিক্রীড়া থেকে
কিছু শতছিন্ন কালপুরুষ জন্ম নেয়

যাদের আমি সন্তানস্নেহে লালন করি

 

 

 

 

লুপ্তপ্রায়

 

কখনও স্যাঁতস্যাঁতে আমার উঠোনে
উপচে পড়ে নীল পরীদের রোদ

আসলে অবকাশে
ঘাম আর উষ্ণতা খেতে আসে পরিযায়ী আত্মার দল
মুক্ত বিহঙ্গের মতো আমিও বাড়িয়ে দিই হাত
ভাবি আলো হয়ে যাব একদিন

সিগারেট কাউন্টার দিতে দিতে বন্ধুরা বলে
এবার তুই বৃন্তচ্যুত হবি
আমি মুঠোতে ধরে রাখি
ফিনিক্স পাখির গল্প

চেতনার ঘাস চেপে রেখে
পেরিয়ে যাই স্বপ্নের ঋতুচক্র
হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে যাই জোনাকি ভরা গাছ
অশ্বত্থের আলগা আঁচল

যদিও ছুঁতে গিয়ে দেখি
ছাই উড়ছে নিজের
আর অবকাশ সন্ধানী আত্মারা
ঢেকুর তুলতে তুলতে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে আকাশে

সিগারেট আর বন্ধুদের কথা মনে পড়ে
মুঠো খুলে দেখি
আক্রান্ত এক ডোডো পাখি
শেষ খাঁচাটার দরোজা খুলছে

 

 

 

 

ফেরা

 

অবিরাম বৃষ্টির দিকে আমাদের যাত্রা

কেননা বৃষ্টি আমাদের যা দিতে পারে
– প্রেম এবং কাদা

আমাদের পরজীবনের সম্বল

আমাদের যা যাবতীয়
– লাঠি এবং লন্ঠন

হাটে ও ক্লেশে বুড়ো হয়ে গ্যাছে

চলো, তবে ফিরি
কেননা ডিঙোতে হবে বয়স, নদী আর আগ্নেয়গিরি

চলো
সন্ধের অদূরে বাতাস বইছে মৌরিফুলের

 

 

 

 

প্রণাম

(নিত্য মালাকার শ্রদ্ধাস্পদেষু)

 

ওদিকে অনেকটা পথ হেঁটে এসে
একটু ক্লান্ত হয়েছে আকাশ

অথচ তার আঙুলের চিহ্ন দেখেই
কচি মেঘেদের যাত্রা শুরু হয়

তারাও সকলে সন্তানসম্ভবা

পথে উপেক্ষা করে রোদ
আর পেটে ধারণ করে সরস্বতী

ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে ওঠে খুব
ক্রমশ অন্ধের বাগানে ফুটে ওঠে পলাশ

দানা ফসলের দেশে বৃষ্টি শুরু হয়

কচি মেঘেদের উষ্ণপ্রস্রবণধারা
গড়িয়ে পড়ে সূত্রধরের পদপৃষ্ঠে

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment