নববারোক দল
সেই স্বেচ্ছাচারী যে মায়ের থেকে পালায়।
বিদায় নেওয়া মানে এক শিশিরবিন্দু চাষ করা যাতে সে লালার ধর্মনিরপেক্ষতায় মিশে যায়।
স্বেচ্ছাচারের গভীরতা কখনই তার ফল হরণের পথে যায় না।
স্বেচ্ছাচারী তার মাকে দেখা বন্ধ করে।
সেই দীর্ঘায়িত হয়ে চলা ঘটমান দিনের অনুপস্থিতি
এবং রাত্রিবেলা সেই অনুপস্থিতি ক্রমশ ছুরির মত গভীর হয়ে ওঠে।
আর সেই অনুপস্থিতিতে খুলে যায় এক মিনার, সেই মিনারের মধ্যে নাচে এক ফাঁপা আগুন।
আর এভাবেই সে নিজেকে পুষ্ট করে, আর মায়ের অনুপস্থিতি এক শান্তিতে থাকা সমুদ্র।
কিন্তু সে পলায়নপর দেখেনা সেই প্রশ্নকর্তা ছুরিটিকে,
সে ছুরি মায়ের, সে ছুরি নকল ও নিশ্চিত দরজার, যা থেকে সে পালাচ্ছে।
যা কিছু পতন তা পুরনো রক্তের মধ্যে বড় বেশি ফাঁকা শোনায়।
পতনশীল ও গোল করে ছড়ানো রক্ত শীতল হয়।
মা শীতল ও তাঁর কাজ শেষ হয়েছে।
যদি তা মৃত্যুর কারণে হয় তাহলে তাঁর ওজন এখন দ্বিগুণ এবং আমাদের উপর তা ঝাঁপিয়ে আসছে না।
যা দিয়ে আমাদের পরিত্যক্ত এখন উঁকি দিচ্ছে এখন তা আর দরজা নয়।
সে এক স্পষ্টতা যার মধ্যে দিয়ে মা চলে যাচ্ছেন কিন্তু আর আমাদের পিছনে আসছেন না।
সে এক স্পষ্টতা, সেখানেই অন্ধত্ব আর আমাদের ছেড়ে যাওয়া।
–স্বেচ্ছাচারীর ডাক (১৯৪২), [আংশিক অনুবাদ],
হোসে লেসামা লিমা
এই কবিতাটি দিয়েই শুরু হচ্ছে মেদুসারিও নামক এক প্রবাদপ্রতিম কবিতা সংকলন, যা গোটা লাতিন আমেরিকার কবিতার অন্যস্বরকে চিহ্নিত করবে। টেনে বের করে আনবে ১৯৭০ দশকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হওয়া এক কবিতারীতিকে, সেই মহাবিস্ফোরণকে, যার চিহ্ন এখনও পাওয়া যায় সেইসব দেশের কবিতায়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। রয়েছে গোটা আমেরিকা মহাদেশের এস্পানিওল ও পুর্তুগেশভাষী ২২ জন তখনও পর্যন্ত “অপর” কবির কবিতা। প্রায় ৫০০ পাতার এই সংকলন শুরু হচ্ছে ১৯৪০ এর দশকের কবি হোসে লেসামা লিমার কবিতা দিয়ে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে, কারণ “তিনিই সত্যদ্রষ্টা”। কী সেই সত্য? নববারোক রীতির উদ্ভাবক তিনি। কী করতে চায় নববারোক? চায় কল্পনার স্বাভাবিক জনগ্রাহ্য চেহারাকে ভেঙে দিতে। যেখানে তথ্য এক সংগ্রাম যা আমাদের চলমান ও পরিবর্তনশীল “ক্রমমুক্তি”-র দিকে নিয়ে যাবে। নববারোকের কাছে কী ডাক সর্বাধিকগ্রাহ্য? তা কোনও প্রচলিত সত্ত্বা নয় বরং কল্পনার ডাক। কল্পনালতার বিস্তার। আমাদের মনে পড়ে যাবে মণীন্দ্র গুপ্ত, পঞ্চাশের স্বাভাবিকতার সীমা তিনি অঘোষিতভাবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন — মনে পড়ে যাবে ‘মোমবাতি এক জটিল উদ্ভিদ’ বা ‘চাঁদের চাকার দাগ’। মনে পড়ে যাবে ৭০ দশকের স্বেচ্ছা নির্বাসনের কবি জমিল সৈয়দ ও তাঁর ‘নীলক্ষুর চন্দ্রযান’ অথবা তাঁর লেখা ‘বাংলা কবিতাঃ রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর’- এর ভূমিকা, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন দৈনন্দিনে ক্লিষ্ট জীবন থেকে কবিতার দূরত্ব, মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইউনিকর্ন বা স্বর্ণমারীচ আসলে কবিরই কল্পনা। আশ্চর্যভাবে বাংলা কবিতায় ‘মণীন্দ্র গুপ্তের পাঠশালার’ অন্যরকম কবিরাও সত্তর দশকে পরিস্ফুট হচ্ছেন এই নববারোকদের মত। সুব্রত সরকার লিখছেন দীর্ঘ কবিতা, যা কিনা নববারোকদের একদলের টান। শুধু নববারোকদের মণীন্দ্র গুপ্ত পঞ্চাশের নয়, তিরিশের কবি।
নববারোক রীতি জানায় সেখানে কল্পনাই প্রধান, ফলত আবেগের পরিমাণ হয়ত বেশি কিন্তু সে আবেগ কখনই স্পষ্ট কোনও প্রচল পথচারি নয়, অর্থাৎ বহুস্তরীয়, অর্থাৎ জটিল। যেমন বারোকরীতির এক স্পেনীয় স্তম্ভ কবি লুইস দে গোংগোরা ( ১৬শ শতক, সমসময়ে অপ্রধান, পরে গার্সিয়া লোরকাদের দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত) সাধারণ কোনও চলতি কথাকে বদলে নিতেন কোনও সৌন্দর্যজ্ঞাপক অলংকারে, তেমনই এখানে নববারোক কবিরা বিস্তার করেন কল্পনাতীত, সংস্কারমুক্ত এক ক্রমপ্রসারমান ক্ষেত্র, শুধু দেখা যায় এঁরা কোনওদিন কোনও রাজনৈতিক দলের প্রচার কবিতা লেখেন নি, কারণ তা একরৈখিক। এঁদের লক্ষ্য এক অ-শেষ কবিতা। অনেকদিন আগে জহর সেনমজুমদার বুঝিয়েছিলেন “বি-দিশা” র কথা। পোস্টমডার্ন কবিতা লক্ষ্যণ বোঝাতে গিয়ে। অর্থাৎ আধুনিক দিশাতাড়িত কবিতা থেকে জীবনানন্দ বেরিয়ে আসছেন বি-দিশার দিকে। দিশাকে তিনি ভেঙে দিচ্ছেন। জহর সেনমজুমদারের নিজের কবিতাও সেই দিকেই যায়। আর আশ্চর্যভাবে সমাপতন ঘটে এই নববারোকদের সময়ের সঙ্গে। অথচ এঁদের কোনও যোগ থাকা সম্ভব নয়। এই বিদিশা বা বহুরৈখিকতাই নববারোকদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রচলিত কবিতার নির্দিষ্ট ফরমুলা ভেঙে দেবার জোর ও রাস্তা। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই পথে বদলে যাচ্ছে কবিতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক। যে সম্পর্ককে এই দলেরই এক প্রধান কবি নেস্তোর পেরলোংগের বলেন “সৃষ্টিশীল কুষ্ঠরোগ” — যে রোগ যাবতীয় অফিশিয়াল সংস্কৃতির ভাল কবিতার গায়ে পচন ধরাবে — ধরাবে কবিতা পাঠের অভ্যাসে। এই কবিদের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল দীর্ঘ কবিতা। যেহেতু ছোট কবিতা আসলে দিশারই প্রতীক, তাই এঁদের প্রবণতা দীর্ঘ কবিতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এঁরা একটাই বইদীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। বা সিরিজ লিখেছেন। রাউল সুরিতার দীর্ঘতম (ওঁর সব বই আসলে একেকটা দীর্ঘ কবিতা) কবিতাটি ৭০০ পাতার। দাবিদ উয়ের্তার ৯০০ পাতার। এবং সমস্ত কবিতাই কাহিনিসূত্রহীন।
এই নববারোক রীতির আজ অনেক বছর হল। এই দলের প্রধান কবিরা আজ সকলেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। অনেকেই যেমন রাউল সুরিতা (Raúl Zurita), দাবিদ উয়ের্তা (David Huerta), কোরাল ব্রাচো (Coral Bracho), নেস্তোর পেরলোংগের (Nestor Perlongher), হোসে কোসের (José Kozer), খেরারদো দেনিস (Gerardo Deniz), হারলদো দে কাম্পোস (Haroldo de Campos) নানা রকমের পুরস্কারে ভূষিত। রাউল সুরিতা বা দাবিদ উয়ের্তার নাম নোবেলের দিকে যাচ্ছে। তার মধ্যে দাবিদ উয়ের্তা ২০১৯ সালে পেলেন লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ, অর্থমূল্যে এবং সম্মানে, সাহিত্য পুরস্কার, প্রেমিও ফিল। কোরাল ব্রাচোর কাব্যভাষা ছড়িয়ে গেছে আগুনের মত। দশ বছর বয়সে, ফ্রাঙ্কোর হাত থেকে বাঁচতে বাবা-মার সঙ্গে এস্পানিয়া ছেড়ে মেহিকোয় চলে আসা খেরারদো দেনিস (১৯৩৪-২০১৪) কবিদের কবি হিসেবে এখন প্রায় জাতীয় সম্পত্তি। হারলদো দে কাম্পোস তাঁর গালাক্সিয়াস নামক দীর্ঘ কবিতাটির জন্য তরুণ কবিদের কাছে সম্পদ, শুধু তাঁর দেশ ব্রাসিলে নয়, গোটা আমেরিকা মহাদেশে।
এই নববারোক প্রকৃত অর্থে কোনও দল বা আন্দোলন নয়। কারণ এই কবিরা গোটা আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে। একটা দীর্ঘ সময় অব্দি পরস্পরকে চিনতেন না। দীর্ঘ সময়ের কবিতা এক সঙ্গে পড়ে চিহ্নিত করা গিয়েছিল সমপ্রবণতা। আর্খেন্তিনার তাত্ত্বিক কবি নেস্তোর পেরলোংগের ও উরুগুয়াই এর কবি রোবের্তো এচাবাররেন প্রায় আবিষ্কারই করেন এই মিল এবং লিখতে শুরু করেন নববারোক নিয়ে। পরে এর তীব্রতা এতই ছড়ায় যে ব্রাসিলে তা ছাপ ফেলে স্থাপত্যেও। এবং আজ স্বীকৃত গোটা ইবেরো-আমেরিকাতে (ইস্পানো-পুর্তুগেশ) এত বড় অভিঘাত কোনও কাব্যাদর্শই আনেনি, যার জনক হোসে লেসামা লিমা।