প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

পঞ্চ আবের সুরে

সুমিরন কর লে মেরে মন

সাল ১৫০৬ খ্রীস্টাব্দ, আনুমানিক। নীলাচল। সন্ধ্যা নেমেছে পুরীতে। দূরে জগন্নাথ মন্দিরে শুরু হয়েছে মঙ্গলারতি। বাজছে ঘন্টা, মন্দ্রিত শঙ্খধ্বনি। সময় হয়েছে মহাপ্রভুর সান্ধ্যভোজের। মন্দিরে পূজারীরা সোনার থালা, বাটিতে একটু একটু করে পরিবেশন করছেন ‘মহাভোগ’। আকাশ-বাতাস ম ম করছে তার অপার্থিব সুগন্ধে। এ সময় ঈশ্বর খেতে বসেন। বড় পবিত্র, বড় মায়াবী এ সময়।

সমুদ্রতট থেকে দেখা যাচ্ছে মন্দিরচূড়া। গৈরিক পতাকা উড়ছে হাওয়ায়। চন্দন কাঠের মিষ্টি গন্ধ পাক খাচ্ছে বাতাসে। সেই ঈশ্বরিক পরিবেশ ভেদ করে সমুদ্রের ধারে এসে স্থির হল দুটি ছায়া। দুটি মানুষ। তাদের গায়ে লেপ্টে আছে ধূলোয় মাখানো ক্লান্তি, শরীরের ঘামে ভেজা অবসন্নতা, আর এক পৃথিবী ক্ষুধা। বহুদূর থেকে আসছেন তাঁরা। সেই কবে ঘরছাড়া। কবে পিছনে ফেলে এসেছেন সেই সোনার ফসলে মোড়া সুলতানপুর লোদি। পিছনে সরে গেছে আত্নীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সেই পরিচিত অলিগলি আর বিয়াস ও সুতলেজের মাদকতা।

বহুদূর থেকে আসছেন দুজন। নানক ও দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও শিষ্য – ভাই মর্দানা। অভিন্নহৃদয় বন্ধু তাঁরা। পঞ্জাবের সীমানা ছাড়িয়ে পায়ে হেঁটে তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে গেছেন বাংলাদেশ। পরে সেইখান থেকে ফেরার পথে অঙ্গ, বঙ্গ হয়ে অবশেষে কলিঙ্গ রাজ্যে ঘটেছে প্রবেশ। বড় সাধ দুজনের একবার জগন্নাথ দেবের দর্শন করা। আদি শঙ্করাচার্যের চারধামের মধ্যে অন্যতম এই পুরী। মহাতীর্থ বলে কথা। সেই উদ্দেশেই ত’ আসা ওতদূর থেকে। কিন্তু সুদীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি তাদের গ্রাস করছে যেন। খিদে তেষ্টায় কাবু তাঁরা। বিশেষ করে ভাই মর্দানা। অথচ, অন্যদিকে নানকের সেই দিকে নেই হুঁশ। তিনি যেন সেই অলৌকিক আবহে, জাদু পরিবেশে বুঁদ হয়ে রয়েছেন। সমুদ্রের ধারে, ঠান্ডা বালির উপরেই ধ্যানে বসে পড়েন তিনি।

নানক শাহ ও রবাব হাতে ভাই মর্দানা

অন্যদিকে, ভাই মর্দানার তখন পাগল পাগল দশা। চমৎকার রবাব বাজান তিনি। সেটি তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। কিন্তু খিদের জ্বালায় সে সবের দিকেও হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা তার। কিচ্ছুক্ষণ আগে সে একবার চেষ্টা করেছিল মন্দিরে দেয়া ‘মহাপ্রসাদ’ খেয়ে খিদে তাড়ানোর। কিন্তু তাকে সে সুযোগই দেয়া হয়নি। প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র পাননি মর্দানা। কারণ, তিনি বিধর্মী, মুসলমান। দ্বাররক্ষীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। মনের দুঃখে, সমুদ্রের ধারে ফিরে আসেন ক্ষুধার্ত মর্দানা। দেখেন সমুদ্রের দিকে মুখ করে ধ্যানে মগ্ন নানক। তার চোখে মুখে স্বর্গীয় প্রশান্তি। ক্ষোভে ফেটে পড়েন মর্দানা। ‘এ কি অলুক্ষুনে জায়গায় এসেছি আমরা। এখানে ক্ষুধার্তকে খাবারও দেয়া হয়না! সেখানেও অন্তরায় হয়ে উঠেছে ধর্ম! কোথায় তবে ঈশ্বর?’ – রাগে, দুঃখে, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে তার। প্রিয় শিষ্যের আকুতি শুনে চোখ মেলেন নানক। তার ঠোঁটে লেগে থাকে মোহময় এক হাসি। বলেন – ‘চিন্তা নেই। পরম করুণাময় আমাদের অভুক্ত রাখবেন না।’

আর কি আশ্চর্য! তার কথা শেষ হতে না হতেই সমুদ্রের বাতাসে যেন বেজে ওঠে বাঁশী। হালকা এক কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ। আলেয়ার মত কিছু উড়ন্ত আলোক কণিকায় ভরে ওঠে চরাচর। মর্দানা দেখেন, দীর্ঘদেহী আলোকিত এক ছায়া এগিয়ে এসেছে তাদের দিকে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিক মতন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তার হাতে রয়েছে সুস্বাদু সব খাবারের থালা। তাদের সামনে সেইসব খাবার পরিবেশন করে কর্পূরের মত উধাও হয়ে যায় সেই মায়াবী ছায়াশরীর। সমুদ্রের লবনাক্ত বাতাসের গন্ধ কেটে সেখানে দখল নিচ্ছে চন্দন, কর্পূর, আতর মিশ্রিত অদ্ভুত এক নেশাধরা সুগন্ধ। পরম ক্ষুধার্তের কাছে খাদ্যের গন্ধ ছাড়া আর সব গন্ধ অলীক। তাই আর দেরী না করে উদরস্থপূরণে মন দেন দুজন। কিছু পরে খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মর্দানা খেয়াল করেন তাদের সামনে পড়ে আছে সোনার থালা, বাটি। কিন্তু আর কিছু ভাবার মতন ক্ষমতা ছিলনা তাঁর৷ ঘুম এসে ছিনিয়ে নেয় ক্লান্তি। মৃদু হেসে আবারও ধ্যানে বসেন নানক শাহ ফকির।

ভোর হতেই খবর ছড়ায় আগুনের মত। ‘মহাপ্রভু’র মহাভোগের সেই সোনার থালা, বাটি মন্দির থেকে উধাও। এ কি ভয়ানক অলৌকিক ব্যাপার! কারুর সাধ্য নেই সেখান থেকে মহার্ঘ্য সেই জিনিসপত্তর চুরি করার। বিভ্রান্ত মন্দিরের পুরোহিত, মহান্ত ও দ্বাররক্ষী’রা। কোথায় গেল তবে সেই সব? শুরু হল চিরুনী তল্লাশি। খবর গেল রাজার কাছে। আশ্চর্য, রাজামশাই সেই হারানো সোনার বাসন-কোসনের কথা যেন কানেই নিলেন না। তিনি শুধু জানালেন, দুজন ভিনদেশী মানুষ এসেছেন রাজ্যে। তার মধ্যে একজন মহাসাধক। তার কাছেই রয়েছে এই রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি। স্মিত হাসলেন রাজা। তার কথা শুনে অবাক পাত্র-মিত্র-অমার্ত্যরা। আবারও হাসলেন পুরীর রাজা। বললেন, কাল রাতে তার স্বপ্নাদেশ হয়েছে। স্বপ্নে তাঁকে দেখা দিয়েছেন স্বয়ং জগদীশ্বর জগন্নাথ। তিনি জানিয়েছেন, তার এক ভক্ত সাধক ক্ষুধার্ত হওয়ায় ‘তিনিই’ তার কাছে পৌছে দিয়েছেন তাঁর খাবার। রাজা যেন তাকে মহা সমাদরে আমন্ত্রণ জানান। এরপর রাজার নির্দেশ মত সকলেই এসে পৌছায় স্বর্গোদ্বারে। দেখেন সেখানে ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছেন শুভ্রবসনাবৃত, শ্বেতপাগড়ি পরিহত এক দৈবপুরুষ। আর তার আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জগন্নাথ দেবের ‘উধাও’ হয়ে যাওয়া সোনার থালা-বাসন। এই দৃশ্য দেখে আপ্লূত পুরীর রাজা নানক’কে প্রনাম করে মহা সমাদরে তাকে মন্দিরে ফিরিয়ে আনেন।
মন্দিরের পথে যেতে যেতে ভাই মর্দানা নানক-কে বলেন, প্রবল ক্ষুধার তাড়নায় এক মুহুর্তের জন্য ‘ঈশ্বর বিচ্যুত’ হয়েছিলেন তিনি। তিনি অপরাধী। কি ভাবে এই দোষ খণ্ডাবেন? কিভাবেই বা আবার পরম করুণাময়ের উপর আস্থাশীল হবেন তিনি? নানক শিশুর মত হেসে ওঠেন। “তুমি বিচ্যুত হলেও তিনি তোমাকে ছেড়ে যাননি। কারণ তার ইচ্ছেতেই তোমার বিচ্যুতি, তিনিই তোমার ক্ষুধা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির কারণ। কারণ ‘তিনি’ই তুমি। ‘তিনি’ই আমি ও আমরা। আমাদের মধ্যেই তার বসবাস। তবু তাকে আমরা চিন্তে পারিনা, জানতে পারিনা, বুঝতে পারি না। হরিতে আস্থা হারিয়ো না।”
সকালের আলো গায়ে মেখে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে গান ধরেন নানক শাহ। উদাও কন্ঠে উপচে পড়ে ‘ভৈরবী’। অদ্ভুত সেই সুর, অদ্ভুত তার কথা। থরথর হাতে রবাব টেনে বের করেন ভাই মর্দানা। এখুনি এই গান স্বরলিপিবদ্ধ করে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে এইই সুর, এই মাতাল করা সুর, এই পাগল করা ছন্দ, এই অলৌকিক রচনায় যে ভেসে যাচ্ছে তার চোখ। দু’চোখে তার নেমে আসে আনন্দধারা। পুরীর রাস্তা দিয়ে এক দিব্যোন্মাদ পুরুষ ও তার মুসলিম ভাবোন্মাদ শিষ্যের সেই ভুবনমোহিনী যুগলবন্দীতে মথিত আকাশ বাতাস।
সেই সুরের রেশ ধরে এক ফালি রোদ মন্দিরগাত্রে ঠিকরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেবস্থলে। ভোরের নৈবেদ্যস্বরূপ।
“সুমিরন কর লে মেরে মনা
তেরি বিতি উমরো হরিনাম বিনা”
বাংলা ভাবানুবাদ
————-
একবার তাঁর নাম জপে দেখো মন
পার হল দেহতরী হরিনাম বিনা
জল ছাড়া যেমন কুয়ো, দুগ্ধহীন গাভী
মেঘবৃষ্টিরহিত এই ধরা
ফলফুল ছাড়া যেমন নিঃস্ব বৃক্ষরাজি
এ জীবন শূন্য হরি ছাড়া
চক্ষু ছাড়া দেহ যথা, যামিনী চন্দ্রহারা
দীপ ছাড়া মন্দির আর পূজারি শাস্ত্র বিনা
কাম-ক্রোধ-মদ-লোভ ত্যাজ মন
যেমন মোহমায়া ছেড়ে বিবাগী যে জন
নানক শাহ বলে শোন হে করুনাঘন
কেউ নেই এখানে আমার,
তুমিই শেষ ঠিকানা…
একবার তাঁর নাম জপে দেখো মন
পার হল দেহতরী হরিনাম বিনা।

 

খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নেহী জানা

মেয়েটি উন্মাদের মত ভালবেসেছিল আরেক উন্মাদকে। উন্মাদ নয়, দিব্যোন্মাদ! সে রাখাল বালকের মত সহজ, সরল, সুন্দর একটি ছেলে যে ভেড়া চড়ানো আর ‘ওয়াঞ্জলি’ (বাঁশি) বাজানো ছাড়া আর কিচ্ছুটি জানত না।

বহুদূর, সুন্দরী চিনাবের পাশে পঞ্জাবের ছোট জনপদ ‘খাজিয়ান ওয়ালা’ (বর্তমান তখত হাজারা, জিলা সরগোদা, পাকিস্তান) থেকে সে তশরিফ নিয়ে আসে এই ‘জং’ প্রদেশে। ভারী দুঃখী সেই ছেলেটি। সম্পত্তির লোভে তার ভায়েরা, ভাবীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। বাড়ি ছেড়ে এই দেশ, ওই দেশ ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌছে ছিল ‘জং’-এ। সেই জং প্রদেশ, এক সময় যেখানে নিরলস সাধনা করেছেন সুলতান বাহুর মত বিখ্যাত সুফিসাধক।

এখানেই দেখা হয় দুজনের। সুন্দরী সেই মেয়েটির বাবা ‘জং’ অঞ্চলের প্রভাবশালী, ধনী ‘জমিন্দার’। ঘরছাড়া ছেলেটির দুর্দশা দেখে (অনেকের মতে মেয়েটির অনুরোধে) চুচাক মিঁয়া তাকে আস্তাবল সামলানোর কাজ দেয়। তাই ভালবেসে করে সেই ছেলেটি। ঘোড়া, বকরি (ছাগল) আর ভ্যের (ভেড়া) চড়ানো ছাড়া অবসরে ‘ওয়াঞ্জলি’ বাজাতে ভারী ভালবাসত সে।

মেয়েটি ভালবেসে নাম দিয়েছিল ‘মুরলীওয়ালে’। কি অদ্ভুত জাদু সেই ছেলেটির বাঁশিতে। আহা, যেন শতসহস্র ঝর্ণার জল নেমে আসতো জং প্রদেশের উপত্যকায়। তার সেই বাঁশির প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। প্রেমে পড়েছিল চালচুলোহীন সেই ভাসা ভাসা চোখের ছেলেটির। সময় পেলেই চিনাবের পাশে দেখা যায় তাদের। ছেলেটি মনপ্রাণ উজার করে বাঁশি বাজাতো, আর সেই বাঁশির সুরে সাড়া দিয়ে সব কাজ ফেলে ছুটে আসতো মেয়েটি। সে বুঝতেও পারেনি, কখন সেই সুরের পথ বেয়ে তারা স্পর্শ করেছিল একে অন্যের হৃদয়।

কিন্তু সুখ বেশিদিন কারুর কপালে সয়না। একদিন ধরা পড়ে যায় তারা। মেয়েটির কুচুটে, লোভী চাচা কৈয়দো দেখে ফেলে তাদের। ভীষণ মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়া হয় গরীব ছেলেটিকে। গ্রামের এক মৌলবীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মেয়েটির জোর করে বিয়ে ঠিক করে দেয়া হয় সৈয়দা খ্যেরেয়া নামের অন্য একজনের সাথে। এই খবর পেয়ে রাগে, দুঃখে, হতাশায় পাগল হয়ে যায় ছেলেটি। ভগ্নহৃদয় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে অজানা পথে। অন্যদিকে মেয়েটিরও করুণ অবস্থা। সে তার ‘মুরলীওয়ালে’-কে ছাড়া আর কাউকে ‘নিকাহ’ করতে চায়না। প্রেমিকের সাথে বিচ্ছেদে মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে সে বলে –

“খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা…”

………………………..

‘হীর রাঞ্জা’-র এরপরের গল্প সকলেরই জানা। কি ভাবে বঙ্গের ‘কানফাটা’ সম্প্রদায়ের শৈব সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের সংস্পর্শে এসে যোগীতে পরিনত হবে রাঞ্জা, কি ভাবে বাড়ির অমতে রুখে দাঁড়াবে হীর, বহুদিন বাদে আবারও মিলিত হবে তারা ও বিয়ের রাতে পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিষ মাখানো লাড্ডু খেয়ে একসাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে প্রেমিক যুগল। পাকিস্তানের জং প্রদেশে পাশাপাশি মাটির গভীরে আজও শান্তিতে শুয়ে রয়েছে তারা।

অবিভক্ত পঞ্জাবের লোকসংস্কৃতিতে মিশে রয়েছে “হীর রাঞ্জা”-র সেই অমর বিষাদ-প্রেমাখ্যান (Romantic Tragedy) যা আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছরেরও আগে ১৭৬৬ সালে রচনা করেছিলেন মহান কবি ও সুফিসাধক ওয়ারিশ শাহ (১৭২২-১৭৯৮)। পঞ্জাবের লোককথায় যে তিনটি অমর আখ্যানের কথা পাওয়া যায় ‘হীর রাঞ্জা’ তার অন্যতম। বাকি দুটি হল “সোহনী-মহিওয়াল” ও “মির্জা সাহিবা”। এই অমর আখ্যান তিনটির সূত্র ধরে দুই দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ সহ ভালবাসা-বিচ্ছেদের ‘দাস্তান’ শুধু পঞ্জাব প্রদেশেই নয়, সারাদেশ জুড়ে আজ মথিত।

“হীর রাঞ্জা”-র অমর প্রেমকথার স্বাক্ষী হয়ে আজও এই আখ্যান ও বিশেষ করে এই ‘প্রচলিত’ গানটি (অনেকের মতে ওয়ারিশ শাহ-ই এর রচয়িতা) দুই দেশের ভালবাসার মানুষদের মোহাচ্ছন্ন করে। ‘পপুলার কালচারে’ও এই পঞ্জাবী লোকগীতি তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দুই দেশেই ” হীর রাঞ্জা”-র কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। প্রতিটি সিনেমাতেই ঠাঁই পেয়েছে এই লোকগীতি-টি। চল্লিশের দশকে পাকিস্তানী লোকশিল্পী তুফৈল নিয়াজীর কন্ঠে এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর একে একে নূরজাহান, শামসাদ বেগম, নিয়াজি ব্রাদার্স, মেহদী হাসান, তালাত মেহমুদ, নুসরত ফতে আলী খান থেকে শুরু করে হালের শাফাকাত আমানত আলী ও রেখা ভরদ্বাজের মত শিল্পীরা এই গানটিকে অভাবনীয় উৎকর্ষতার উচ্চতায় নিয়ে যান।

মজার ব্যাপার, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বহুল পরিবর্তনও আসে গানটির কথা ও ভাষাতেও। প্রাচীন পঞ্জাবী, গুরুমুখী বা শাহমুখী কখনো বিবর্তিত হয়েছে সিন্ধি, উর্দু আবার কখনও মিশেছে হিন্দী এমনকি খড়িবোলিতেও। কিন্তু তার ভাব বা সুরমাধূর্যে কোথাও ফাঁক পড়েনি। কি ভারত, কি পাকিস্তান আজও পঞ্জাব প্রদেশের বহু পরিবারে বিয়ে-শাদির সময়ে এই গানটি গাওয়া হয়। গানের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়, শ্রদ্ধা জানানো হয় সেই সব মানুষগুলিকে যাদের নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও ত্যাগের কাহিনী যুগ যুগ ধরে মানুষকে ভালবাসার আলোকিত পথে হাঁটতে শিখিয়েছে, দৃপ্ততার সঙ্গে।

………………………….

আধুনিক পাঠঃ

“না মাঈ না ভেজ মুঝে,
ম্যায় নেহী জানা পরদেশ
জিস রাঞ্জে সঙ্গ শ্বাস জুড়ি,
উহ রাঞ্জা হ্যায় ইস দেশ রে…

খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।

লোগ কহে উসে রাঞ্জা যোগী,
মুঝ কো তো রব কা জামাল
জানে না জানে লোগ না জানে
উও জানে মেরা হাল, না মাঈ না ভেজ মুঝে…

খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।

বন্ধ আঁখো সে রাহ দিখে না
জো উহ জ্যোত জাগায়ী
রাঞ্জা মেরা দিন ধরম হ্যায়
রাঞ্জা হ্যায় কুল খুদাই, না মাঈ না ভেজ মুঝে…

খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।”

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment