নবব্রত ঘোষাল

নিউটন

প্রাক কথনঃ 

১৬৮৭ তে নিউটনের প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশিত হওয়ার পর, ফরাসি গণিতবিদ দ্য লোপিতাল  প্রিঙ্কিপিয়ার প্রাকৃতিক দর্শন গাণিতিক সূত্রাবলীর বিপুল কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে গভীর বিস্ময়ে বলে ওঠেন – ‘তিনি কি খাওয়াদাওয়া করেন? পান করেন? ঘুমোন? আর সব মানুষেরই মতন কি তিনি?’

সতেরো শতকের বিখ্যাত দার্শনিক ইতিহাসবিদ গিলবার্ট বারনেট, নিউটন সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে – ‘সবচেয়ে বিশুদ্ধ হৃদয় সম্পন্ন মানুষ।’

‘Nec fas est propius mortali attingere Divos”

লাতিন ভাষায় লেখা এই কথাগুলির বাংলা তর্জমা এইরকম – 

ঈশ্বরের নিকটতম তিনি। সর্বশক্তিমানের কাছে এরচেয়ে বেশি আর কোনো মানুষের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়।‘ 

নিউটন সম্পর্কে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালিরএই বিখ্যাত উক্তিটির  কারণ, হ্যালির হয়তো মনে হয়েছিল, নিউটনই সেই অতিমানব যাঁর কাছে এই মহাবিশ্বের গ্রহনক্ষত্রদের চলাচলের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ধরা দিয়েছে মহাজাগতিক সত্য।  

আর এক সমকালীন দার্শনিক জন লক, তাঁর এক তরুণ আত্মীয়কে একবার নিউটনের সঙ্গে দেখা করার জন্য লন্ডনের বাড়িতে পাঠান। জন লক সেই আত্মীয়টিকে সতর্ক করেন, ‘দেখো, নিউটন কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান ব্যক্তি। কেবলমাত্র গাণিতিক দক্ষতার কারণে নয়, তাঁর মতো ধার্মিক বাইবেল বিষয়ে সুপণ্ডিত আর দ্বিতীয় কেউ নেই। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় যতটা সম্ভব কোমলতা প্রদর্শন করবে।’

আইনস্টাইন নিউটনকে বলেছেন ‘হ্যাপি চাইল্ড অব নেচার’। বিশ্বপ্রকৃতির সুখী সন্তান।   

 নিউটন প্রসঙ্গে সমকালীন এবং পরবর্তী সময়ের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের এরকম নানা মন্তব্য পাওয়া যায়। তবে অনেকে আবার একেবারে ভিন্ন অভিমতও ব্যক্ত করেছেন।  

যেমন, অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল জন ফ্ল্যামস্টিড যাঁর সঙ্গে নিউটনের চরম  বিরোধ হয় গ্রহনক্ষত্রের পঞ্জি প্রকাশকে ঘিরে, তিনি জনৈক ব্যক্তিকে নিউটন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন – ‘ভয়ঙ্কর সন্দেহপ্রবণ মনের মানুষ এই নিউটন। শুধু তাই নয়, এতটুকুও সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।’                    

এইরকম বর্ণময় চরিত্র যে মহাবিজ্ঞানীর তাঁকে নিয়ে তিনশো বছরের অধিক সময়কাল জুড়ে যে চর্চা হবে তা আর আশ্চর্যের কী! সুদীর্ঘ তিন শতাব্দীর  বিভিন্ন সময়ে নিউটনের জীবনী লেখা হয়েছে এবং এখনও সে ধারা অব্যাহত।  

নিউটনের মৃত্যুর (১৭২৭) কয়েকবছর পর, ১৭৫২তে  সর্বপ্রথম তাঁর জীবনীমূলক  বই, ‘মেময়্যর্স অব স্যর আইজাক নিউটনস্লাইফপ্রকাশ পায়। লেখক ছিলেন নিউটনের বন্ধুস্থানীয় এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর এক জুনিয়র ফেলো, উইলিয়াম স্টাক্লি।  নিউটনের স্কুল জীবনের অনেক অজানা তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন গ্রান্থামের মানুষজনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেউল্লেখ্য, গ্রান্থামের কিংস স্কুলে সাতটা বছর কেটেছিল নিউটনের তবে স্টাক্লির এই বইকে ঠিক জীবনী বলা যায় না। কারন, নিউটনের শুধুমাত্র শৈশব কৈশোর কালের কিছু ঘটনা এই লেখার উপজীব্য।  

১৮৩১ সালে ডেভিড ব্রুস্টার, নিউটনের সম্পূর্ণ জীবনীদ্য লাইফ অব স্যার আইজাক নিউটনগ্রন্থটি রচনা করেন। বইটির ভূমিকাতে তিনি লেখেন, ‘যেহেতু স্যার আইজাক নিউটনের জীবন নিয়ে যাবৎ কালে আর কোনো বই লেখা হয়নি, এটিই একমাত্র বই, তাই বইটি প্রস্তুত করতে আমাকে যারপরনাই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।’  

পর্যন্ত  আইজাক নিউটনের যতগুলো বায়োগ্রাফি লেখা হয়েছে, নিঃসন্দেহে, রিচার্ড ওয়েস্টফলের গবেষণা মূলক বই, ‘নেভার অ্যাট রেস্ট‘  অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮০ সালে প্রকাশ পায় বইটি ওয়েস্টফল বইটির মুখবন্ধে লিখছেন, ‘দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে নিউটনের বায়োগ্রাফি রচনা করতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হল, যত তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছি তিনি আমার থেকে ততই দূরে সরে গেছেন তাঁকে পরিমাপ করা এককথায় অসম্ভব কাজ শুধুমাত্র আর একজন নিউটনই পারেন তাঁকে সম্যকরূপে অনুধাবন করতে।’ 

ওয়েস্টফলের এই সাবধানবাণী শিরোধার্য করে, বর্তমান লেখকের  এক অক্ষম প্রচেষ্টা  – যদি এক আঁজলা জল তুলে আনতে পারা যায়, নিউটন নামক সেই অনন্ত সাগরটি থেকে, দুধের স্বাদ নিদেনপক্ষে ঘোলে মেটান যায় তাহলে!   

নিউটনের একাধিক গবেষণা পত্র, তাঁর লেখা বইপত্র, যেমনপ্রিঙ্কিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা, অপটিক্স ইত্যাদি তাঁর বায়োগ্রাফি লেখায় সহায়ক হয়েছে। 

লন্ডনে বসবাস করার সময় নিউটনের কাছে থাকতেন তাঁর ভাগ্নি কাথেরিন ভাগ্নিজামাই জন কনদ্যুইত। এই কনদ্যুইত দম্পতির কাছ থেকেও মহাবিজ্ঞানী সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।  

আইজাক নিউটন সারাজীবনে বহু নোটবুক ব্যবহার করেছেন। গ্রান্থামের কিংস স্কুলের শিক্ষক, হেনরি স্টোকস্‌-এর সাহচর্যে আইজাক নিউটনের নোটবুক ব্যবহারের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা রয়ে যায়। নিউটনের সেই সব নোটবুক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে কয়েকটি (Add MS 0.10 A.33, Add MS 3975, Add MS 3996, Add MS 4000) নিউইয়র্কের মর্গ্যান লাইব্রেরি এবং মিউজিয়াম একটি নোটবুক (MA 318) সংরক্ষিত আছে।

গ্রান্থামের কিংস গ্রামার স্কুল এবং তারপর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে পড়ার সময় যে সব নোটবুক নিউটনের সঙ্গী ছিল সেগুলির পাতা ওল্টাতে থাকলে খুঁজে পাওয়া যায় এক অন্য নিউটনকে। এক প্রায়সাধারণ গ্রাম্য ছাত্রের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার অর্থাৎ, মেটামর্ফসিস বা রূপান্তরণের হদিশ মেলে এই নোটবুকে। ভবিষ্যতে যিনি এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর আসনখানি দখল করবেন, সেই রক্তমাংসের মানুষটি কীভাবে সব মহা আবিষ্কারের পরিকল্পনা গড়ে তুলেছিলেন, সেসবের সাক্ষ্য বহন করে এই সব নোটবুক।  

বলা যেতে পারে নিউটনের জীবনী রচনার এইগুলিই হল মুখ্য উপাদান। এগুলির ওপর ভিত্তি করে, এরপর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মহাবিজ্ঞানীর জীবনের নানান  দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। প্রসঙ্গে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী আর একটি বইপ্রিস্ট অব নেচারদ্য রিলিজিয়াস ওয়ার্ল্ড অব আইজাক নিউটনএর কথা উল্লেখ করা যায়। লেখক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর, রবার্ট ইলিফ। একদিকে বিজ্ঞান চেতনা, আর অপরদিকে গভীর ধর্মবিশ্বাসএই দুই দূরতম মানসিক প্রক্রিয়া নিউটনের মধ্যে কীভাবে সমান্তরালে সক্রিয় ছিল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আছে বইটিতে। আশ্চর্য হতে হয়, এতবড় একজন বিজ্ঞানী, অথচ কী গভীর তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাস! নিউটনের ধর্মানুরাগের পরোক্ষ তথ্য এবং বিপুল পরিমাণ থিয়োলজিকাল লেখাপত্র আশ্রয় করে রবার্ট ইলিফ নির্মাণ করেছেন তাঁর এই বই।  

লিংকনশায়ারের এক অখ্যাত গ্রামে আইজাক নিউটনের জন্ম। জন্মের আগেই পিতার মৃত্যু। তাঁর জন্ম   শৈশব বৃত্তান্ত, যতটুকু জানা যায়, প্রথম পর্বে থাকছে সেসবের  সংক্ষিপ্ত বিবরণ

 

উলসথর্পের নিঃসঙ্গ বালকঃ  

লন্ডন শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে লিংকনশায়ারের ছোট একটি  গ্রাম উলসথর্প। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা একখন্ড উপত্যকা, মাঝ দিয়ে তির তির করে বয়ে গেছে এক নদী। উইথাম। দুপাড়ে কোমল চুনা পাথর জেগে থাকে। উইথামের পশ্চিম তীরবর্তী এই গ্রামটি  উলস্‌থর্প-বাই-কোলস্‌টারওরথ্‌ নামেই বেশি পরিচিত। ছোট এই জনপদকে ঘিরে চারপাশে বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র ও মধ্যে-মধ্যে ইতস্তত বৃক্ষরাশি    

গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে এক খামার বাড়ি। সেই খামার বাড়িতেই জন্ম আইজাক নিউটনের। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে দিনটি ছিল ১৬৪২-এর ২৫ শে ডিসেম্বর* ইংল্যান্ডে সেদিনটা উৎসবের দিন। খ্রিস্টমাস ডে ধূসর চুনাপাথর নির্মিত ছোট একটি দোতলা বাড়িতে ভোর রাতে জন্মায় এক প্রি-ম্যাচুয়র বেবি। সাত মাসেই ভূমিষ্ট হল প্রাণশক্তিহীন দুর্বল এক শিশু। বাঁচার আশা অতি ক্ষীণ। আর এতই ছোট চেহারা যে সামান্য একটি ‘কোয়ার্ট পট’ অর্থাৎ এক লিটার আয়তনের কাছাকাছি ছোট কোনো পাত্রে অনায়াসে ধরে যায়।  পরবর্তীকালে, ভাগ্নি  কাথেরিন ও ভাগ্নি-জামাই জন কনদ্যুইতকে নিউটন তাঁর এই জন্ম বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন। দুজন মহিলাকে বাচ্চাটার জন্য কিছু ওষুধ আনতে পাঠানো হয়। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলেন, “এতটা পথ গিয়ে আবার ফিরে আসার আগেই বাচ্চাটা নির্ঘাত মারা যাবে। অযথা তাড়াহুড়ো করে আর কী হবে!”  

আহা রে, তারা যদি জানতেন, ক্ষুদ্র এই মানব সন্তানটি কী বিপুল প্রাণ-শক্তি ও ঐশ্বর্যের অধিকারী!    

নিউটনের জন্মের তিন মাস আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতার নামও আইজাক নিউটন অথবা বলা ভাল, পিতার নামেই শিশুটির নাম রাখা হল আইজাক নিউটন। পিতা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত চাষী ইওম্যান শ্রেণীভুক্ত। সামাজিক স্তর  বিন্যাসে  বেশ উপর দিকের। ভেড়া পালন ও কৃষিকাজ মূল জীবিকা। কিন্তু এই নিউটন পরিবারের সকলেই ছিলেন নিরক্ষর। ভাবা যায়! ভবিষ্যতে যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হবেন তাঁর পিতৃকুলে শিক্ষার প্রদীপখানিই জ্বালা হয়নি তখনও! মাতৃকুল তুলনায় অভিজাত ও শিক্ষিত। যদিও আইজাকের মা, হান্নার, কেবলমাত্র অক্ষর-পরিচয়টুকুই ছিল কিন্তু, মামা উইলিয়াম আইস্‌কফ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজের গ্র্যাজুয়েট।  

(* গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৬৪৩-এর ৫ই জানুয়ারি)

নিউটন পরিবারের আর্থিক অবস্থা অবশ্য খুব খারাপ ছিল না। আইজাক নিউটনের ঠাকুরদা, রবার্ট নিউটন ১৬২৩ সালে উলস্‌থর্পের খামার বাড়িটি ক্রয় করে সেখানকার লর্ড অব ম্যানর্‌হন।লর্ড অব ম্যানর্‌‘, ভূস্বামী বা তালুকদার গোত্রের। কিছু স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারীযেমন ছোটখাটো অশান্তি বা বিবাদের বিচার করে প্রয়োজনে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা ধার্য করতে পারতেন এনারা। রবার্ট নিউটন, তাঁর উলস্‌থর্পের সমস্ত সম্পত্তি বড়ছেলে আইজাক নিউটন (সিনিয়র) ও হান্না নিউটনের নামে উইল করে দেনপিতার মৃত্যুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আইজাক নিউটন (সিনিয়র)-এর মৃত্যু হয়। সন্তান ও বিধবা স্ত্রীর জন্য খামার বাড়ি ও স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পত্তি রেখে যান তিনি তাঁর উইলে দেখা যায়, ২৩৫টি ভেড়া, ৪৬টি অন্যান্য গবাদি পশু ও গোলা ভর্তি শস্যের উল্লেখ রয়েছে একজন চাষি কতগুলি ভেড়ার মালিক সেটাই ছিল তখনকার আর্থিক অবস্থা বিচারের মাপকাঠি সেই সময় লিংকনশায়ারের গ্রামাঞ্চলে একজন গড়পড়তা কৃষকের সাধারণত ৩০-৩৫টি ভেড়া থাকত। সবকিছু মিলিয়ে এস্টেট থেকে যা আয় (বছরে ১৫০ পাউন্ড-এর থেকে কিছু কম নয়) তাতে বোঝা যায় নিউটন পরিবারের অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল      

আইজাক নিউটনের যখন জন্ম হয় তখন  ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতা একেবারে  তুঙ্গে। কয়েক মাস আগেই শুরু হয়েছে ‘সিভিল ওয়ার’ গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ চার বছর ধরে  (১৬৪২-১৬৪৬) চলল সেই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ রয়্যালিস্ট এবং বিদ্রোহীদের পারস্পরিক হানাহানিতে প্রাণ গেল শয়ে শয়ে সাধারণ নাগরিকেররাজা প্রথম চার্লস বন্দী হলেন বিদ্রোহীদের হাতে। চার্লসের স্ত্রী, দুই পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন ফ্রান্সে। দুবছর আপাতভাবে শান্তি ফিরে এল ইংল্যান্ডে। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। ১৬৪৮-এ আরম্ভ হল দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধশেষপর্যন্ত রাজতন্ত্র হটিয়ে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ক্ষমতায় এলেন পার্লামেন্টারিয়ানরা। ১৬৪৯ এর ৩০শে জানুয়ারি রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদের আদেশ কার্যকর হয়আইজাক নিউটনের বয়স তখন সাত। রাজার মৃত্যুর খবর নিশ্চয়ই পৌঁছে গিয়েছিল তাঁদের গ্রামে। সেই সময় আইজাকের আঁকা রাজা প্রথম চার্লসের একটি চিত্রও পাওয়া যায়।

পার্লামেন্টারিয়ানরা ক্ষমতায় আসার পর ইংল্যান্ডের চার্চ-গুলির প্রথাগত ধর্মাচরণ এবং রীতিনীতি সম্পূর্ণ লুপ্ত হল। তার পরিবর্তে জনগণের মধ্যে পিউরিটান ভাবধারা প্রচার করতে আরো কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন জারি হয় পরবর্তী প্রায় দশ বছর ইংল্যান্ডের ‘লর্ড প্রটেক্টর’ ক্রমওয়েল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে দেশ পরিচালনা করার চেষ্টা করলেন। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর (১৬৫৮ তে) কিছুদিন পর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছাপূরণ করে পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল ইংল্যান্ডে। প্রথম চার্লসের পুত্র এতদিন নির্বাসনে ছিলেন ফ্রান্সেসেই দ্বিতীয় চার্লসকে ফিরিয়ে এনে বসানো হল রাজ-আসনে। রাজা দ্বিতীয় চার্লস ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুদক্ষ প্রসাশক। 

ইংল্যান্ড জুড়ে যখন এত ভয়ানক অস্থিরতা, ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার পালা বদল ঘটে চলেছে, লিংকনশায়ারের  উলস্‌থর্প-বাই-কোলস্‌টারওরথ্‌ কিন্তু একেবারেই শান্ত, সেখানে অশান্তির আঁচ লাগেনি। সেখানকার সরলপ্রাণ মানুষগুলির পূজার্চনায়ও কোনরকম প্রভাব পড়েনি।

জন্মের ঠিক এক সপ্তাহ পর, ১লা জানুয়ারি, ১৬৪৩, পাশের গ্রাম কোলস্‌টারওরথ্‌-এর সেন্ট জন চার্চে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হল ব্যাপ্টিজম বা দীক্ষাস্নানের জন্য। চার্চের যাজক শিশু নিউটনের মাথায় পবিত্র জল দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, “ঈশ্বরের সেবক আইজাক নিউটন-কে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হল।” 

পিতৃহীন আইজাকের শৈশবকাল ছিল মাতৃ-স্নেহ বঞ্চিত। 

সবে তিনে পা দিয়েছে আইজাক। মা হান্না, বিয়ে করলেন পাশের গ্রামের সদ্য বিপত্নীক এক প্রৌঢ় ব্যক্তিকে। পেশায় যাজক। বয়সে হান্নার চেয়ে প্রায় তিরিশ বছরের বড়। বেশ অবস্থাপন্ন ও শিক্ষিত মানুষ। নাম বারনাবাস স্মিথ। অক্সফোর্ডের লিঙ্কন কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ। বাড়িতে আলমারি ভর্তি বই। অধিকাংশই থিয়োলজির অর্থাৎ ধর্মতত্ত্বীয় ভাই উইলিয়ামের উদ্যোগেই হান্নার দ্বিতীয় বিবাহটি সম্পন্ন হয়।      

হান্না স্মিথের নতুন ঠিকানা হল লিংকনশায়ারের নর্থ উইদম্‌ উলস্‌থর্প এর দক্ষিণে মাইল দেড়েকের পথ। বারনাবাস এই অঞ্চলের গির্জার যাজক বা রেক্টর। কিছুটা বাধ্য হয়েই তিন বছরের ছোট্ট আইজাককে হান্না, তাঁর মা, মার্গেরি অ্যাইস্‌কফ-এর জিম্মায় রেখে গেলেন। রোগা পাতলা শিশুটিকে বারনাবাস তাঁর নতুন সংসারের সদস্য করতে রাজি হননি। শর্তটি বিয়ের আগেই দিয়ে দেন হান্নাকে। কখনো  সখনো দিদিমার হাত ধরে দেড় মাইল পথ উজিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে আইজাক।  

‘আইজাক’ শব্দটি হিব্রু ভাষা থেকে আহরিত এর অর্থ ‘সদাহাস্যময় ব্যক্তি’ হায় রে! মাতৃ-স্নেহ বঞ্চিত, পিতৃহীন আইজাকের ছেলেবেলা ছিল যে কেবল নৈরাশ্যে ভরা! এক অনাথ শিশু। 

সতের শতকে ছেলে ‘মানুষ’ করা প্রসঙ্গে একটা কথা খুব চালু ছিল – ‘বাচ্চাকে লাঠির ডগায় না রাখলে, সে বখে যাবে‘ আন্দাজ করা যায় দিদিমার কড়া নজর ও শাসনেই খামার বাড়িতে অতিবাহিত হয়েছে আইজাকের ছেলেবেলা    

আইজাক নিউটন, দিদিমা মার্গেরি অ্যাইস্‌কফ সম্পর্কে কোনো সুখস্মৃতি উল্লখ করে  যাননি। শুধুমাত্র, ১৭০৫ সালে যখন ‘নাইটহুড’ উপাধি পান সে সময় এপিডেভিডে লেখেন, এগারো বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর দিদিমার কাছেই কেটেছে। ব্যস, এই পর্যন্ত। 

  এককথায়,  নিঃসঙ্গ নির্বান্ধব ছিল আইজাকের বাল্যকাল গম, ওটস্‌, ভূট্টার  শস্যক্ষেত ও বৃক্ষরাশির মাঝখানে খামার বাড়িটাও ছিল যেন তারই মতো সঙ্গীহীন। আশেপাশে খামারের মজুরদের কয়েকটা ঝুপড়ি ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না। একেবারে সুনসান নিরিবিলি এলাকা। খামারে যে মজুররা কাজ করে তাদের বাচ্চাদের সাথে খেলার অনুমতি মেলে না। বালক আইজাক লক্ষ্য করে, অন্য সব শিশুদের মত তার বাবা নেই। ভাইবোন নেই। আর মা থেকেও নেই। 

মায়ের স্নেহ-ভালবাসা না পাওয়াটা পিতৃহীন বালক আইজাকের পরবর্তী জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এমনটাই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানীর ক্ষমতা-স্পৃহা ও অবিশ্বাসী সন্দেহপ্রবণ মনের হদিশ মেলে অবহেলিত শিশুকালের মধ্যে। কেমব্রিজে পড়ার সময় নিউটন, তাঁর ‘পাপ কাজ’-এর একটি তালিকা নোটবুকে লিপিবব্ধ করেন। সেখানে দেখা যায় ওই সময় তিনি একজনের মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কার মৃত্যু কামনা করেছিল বালকটি? দিদিমার? নাকি বারনাবাসের? সেটা অবশ্য তিনি লেখেননি। তবে আরও সাংঘাতিক কথা লিখেছেনসৎ-বাবা ও মা-কে পুড়িয়ে মারা এবং একই সঙ্গে গোটা বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন একবার মনস্তাত্ত্বিক ফ্রয়েডের মতে, পুত্রসন্তানের মধ্যে  পিতাকে সরিয়ে মায়ের সম্পূর্ণ অধিকার পেতে চাওয়া ব্যক্তিত্ব স্ফুরণ প্রক্রিয়ার অনেকগুলি স্তরের মধ্যে একটি। ফ্রয়েড একে ‘অয়দিপাস কমপ্লেক্স’ নামে অভিহিত করেছেন। অধিকার হরণে ব্যর্থ হয়েই হয়তো নিউটনের এরকম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যাইহোক, সৎ-বাবা বারনাবাস সম্পর্কে তাঁর ভাবনার আর কোনো তথ্য নিউটন রেখে যাননি।      

একটু বড় হতে, কাছাকাছি দুই গ্রাম, স্কিলিংটন এবং স্টোক রচফোর্ড -এর অতিসাধারণ দুটি  প্রাইমারী স্কুলে তাকে পাঠান আইজাকের দিদিমা। ধরে নেওয়া যায়, আইজাকের লেখাপড়ায় হাতে-খড়ি গ্রামের এই পাঠশালাতেই। এখানে একটি কথা বলতেই হয়আইজাককে বড় করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব মা, দিদিমা এবং বিশেষ করে মামা উইলিয়াম আইস্‌কফ নিয়েছিলেন বলেই একাডেমিক ওয়ার্ল্ডের সংস্পর্শে আসা সম্ভব হয়েছিল। কারণ আইজাকের এক কাকা, রিচার্ড নিউটনের কথা জানা যায়, যিনি নিরক্ষর ছিলেন এবং তাঁর পুত্র কন্যারাও কেউ নিজের নামটুকুও লিখতে জানতেন না। একটি উইলে টিপ সই দিতে দেখা গেছে আইজাকের খুড়তুতো ভাই বোনদের।      

আইজাক যখন বছর দশেকের সেসময় বিপিতা বারনাবাসের মৃত্যু হয়।  বারনাবাসের মৃত্যুর পর হান্না উলস্‌থর্পে ফিরে আসেন। সঙ্গে এক পুত্র ও দুই শিশুকন্যা। কিছুটা আকস্মিক ভাবেই আইজাক মাকে ফিরে পেল। যদিও মায়ের আদরের অনেকটাই ছোট-ছোট সৎ ভাইবোনদের জন্য বরাদ্দ। আইজাকের ভাগ অতি অল্পই। তবু সেই যৎসামান্য মাতৃস্নেহও আইজাকের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। নিঃসঙ্গ বালকের কাছে এ-এক পরম প্রাপ্তি! 

এই বয়সের আর পাঁচটি ছেলে যেরকম দুষ্টুমি করে, এই সময় আইজাকের আচরণেও তা প্রকাশ পেতে থাকে ‘পাপ কাজ’-এর তালিকাটি দেখলে তা স্পষ্ট হয় সে ভাইবোনদের সাথে মারামারি করছে, মায়ের বাদাম ও মিষ্টি চুরি করছে, ইত্যাদি অর্থাৎ, মা ও ভাইবোনদের সঙ্গ পেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে আইজাক।         

মৃত্যুর আগে বারনাবাস তাঁর সম্পত্তি উইল করে যান স্ত্রী হান্না ও পুত্র কন্যাদের নামে। বারনাবাসের সম্পত্তির কণামাত্রও পাননি আইজাক। আইজাকের প্রাপ্তি বলতে, আলমারি ভর্তি শ’দুই-তিনেক বই ও একটি মোটা খাতা যার কয়েকটি মাত্র পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে বারনাবাস এই খাতাটিতে ধর্মতত্ত্বের নোট রাখতেন। যাজক হিসাবে যে শাস্ত্র বচন শোনাতেন তার প্রস্তুতিতে কাজে লাগত ওই সব নোট।   

খাতাটি হস্তগত হওয়ার পর, তাতে যেসব ফাঁকা সাদা পৃষ্ঠা রয়েছে আইজাক তার সদ্ব্যবহার শুরু করে এবং খাতাটির নাম দেয় ‘ওয়েস্ট বুক’ অর্থাৎ, ‘বাজেখাতা’** সৎ বাবার ওপর তীব্র রাগ থেকেই খুব সম্ভবত এমন একটি নামকরণ!     

মা ও ভাইবোনেদের সঙ্গলাভ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না আইজাকের। মা ফিরে আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই চলে যেতে হয় উলস্‌থর্প-এর সাত মাইল উত্তরে গ্রান্থামে। সেখানকার কিংস-গ্রামার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল আইজাককে। হান্না হয়তো ভেবেছিলেন, জ্যেষ্ঠপুত্র যদি কিছু লেখাপড়া শিখে নেয় তাতে এত বড় এস্টেটের দেখাশোনা এবং হিসাবপত্র রাখার কাজে সুবিধা হবে। হান্নার এক বান্ধবী বিবাহসূত্রে গ্রান্থামে থাকেন। তাঁর বাড়িতেই আইজাকের থাকার বন্দোবস্ত হল 

বারো বছরের আইজাক উলস্‌থর্প ছেড়ে, ছোট একটি বাক্স হাতে চড়াইউতরাই বেয়ে গুটি গুটি পায়ে চলল কিংস-গ্রামার স্কুলের উদ্দেশ্যে আইজাক নিউটনের জীবনের সম্ভবত এটিই ছিল প্রথম টার্নিং পয়েন্ট    

(**নিউটনের  ‘ওয়েস্টবুক’ কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে (MS Add. 4004)। ট্রিনিটি কলেজে পড়াকালীন ক্যালকুলাস এবং মেকানিক্সের বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধানে ‘বাজেখাতা’টি ব্যবহার করেছিলেন নিউটন। পরবর্তীকালে তাঁর বেশ কয়েকটি আবিষ্কারের ভিত্তিস্বরূপ ছিল এইসব গণিতচর্চা)  

 

 

(চলবে)

অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment