নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ৯

 

নিউটনের ধর্মতত্ত্ব গবেষণা      

ট্রিনিটির নিয়ম অনুসারে, মেজর ফেলো হওয়ার ঠিক সাত বছরের মধ্যে সকল সিনিয়র ফেলোকেই অভিষিক্ত হতে হয় ধর্মযাজকের পদে। ১৬৬৮-র জুলাই মাসে মেজর ফেলো হন নিউটন। কাজেই ১৬৭৫-এ ইংল্যান্ডের কোনও একটি চার্চে ধর্মযাজক অর্থাৎ অ্যাংগলিকান পাদ্রি হতে হবে তাঁকে। 

বালক বয়সে, উলস্‌থর্পের বাড়িতে এবং গ্রান্থামের কিংস স্কুলে যাজকদের সংস্পর্শে ঘোরতর ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে কাটাতে হয়েছে নিউটনকে। হয়ে ওঠেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এক বালক। কেমব্রিজে ছাত্রাবস্থায়, ‘পাপ কাজ’-এর একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। স্পষ্টত, ঈশ্বরের প্রিয়জন হয়ে ওঠার সুতীব্র বাসনা ছিল যুবকটির মধ্যে। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট স্তরে, জন কালভিন ও  টমাস হবস্‌-এর মতো  বিভিন্ন দার্শনিকদের বই এবং সেই সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ নিউ-টেস্টামেন্ট সাগ্রহে পড়েছেন নিউটন। ওই সময়ের নোটবুকে দেখা যায়, ইনফিনিটি বা অসীমের ধারণার কথা লিখেছেন তিনি। তাঁর মতে,  গাণিতিক অসীমতা ও বিশ্বপ্রকৃতির অন্যান্য জটিল রহস্য ভেদ করা সম্ভব মানুষের পক্ষে। এর কারণ হিসাবে নিউটন লিখেছেন, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি (image of God) রয়েছে। ঈশ্বর তাঁর নিজের আদলেই গড়েছেন মানবকে। আর তাই, ঈশ্বর-সৃষ্ট এই বিশ্বপ্রকৃতি মানুষের বোধগম্যতার অতীত হতে পারে না। নিউটনের বিশ্বাস, স্বল্প কয়েকজন মানুষকে ঈশ্বর বিশেষ এক ক্ষমতা প্রদান করেছেন, যাঁরা গাণিতিক পথে, যুক্তির সাহায্যে বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম। আর তিনি নিজে, ঈশ্বরের সেই ‘special gift of understanding’, অন্তর্দৃষ্টির বিশেষ উপহারটি লাভ করেছেন।  

নিউটনের নোটবুক ও পান্ডুলিপি থেকে জানা যায়, তাঁর খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক প্রকৃত গবেষণার সূত্রপাত ১৬৭২ সাল নাগাদ। ওই মুহূর্তে হাতে আছে আর তিনটি বছর। আর তারপরই, ১৬৭৫-এ অর্ডিনেশন অর্থাৎ যাজক পদে অভিষেক ঘটবে তাঁর। কোনও কিছুই হালকা ভাবে নেওয়ার মানুষ নিউটন নন। দিনরাত এক করে শুরু হল ধর্মতত্ত্বের চর্চা। শাস্ত্র পাঠ। চার্চের যাজক হওয়ার আগে খ্রিস্টিয়ান থিয়লজির নাড়ি-নক্ষত্র জানা দরকার। গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, অথবা অপরসায়ন চর্চা যে সুতীব্র টানে আকর্ষণ করেছিল এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। 

প্রথমেই একটি নোটবুক কিনে তাতে, খ্রিস্ট ধর্মের প্রধান প্রধান বিষয়গুলির শিরোনাম পরপর কয়েকটি পাতায় লিখে ফেললেন*। নোটবুকের পাতা ওল্টালে দেখা মেলে “Attributa Dei”, “Deus Pater”, “Deus Filius”, “Incarnation”, “Christi Satisfactio, & Redemptio”, “Spiritus Sanctus Deus” – এরকম বহু শিরোনাম। প্রত্যেকটির নীচে লেখার জন্য কয়েকটি করে পাতা নির্ধারিত। শিরোনামগুলি দেখলে মনে হবে বাইবেল-এর সারাৎসার লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রচলিত সনাতন পথেই যেন অগ্রসর হবেন। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় ধরাবাঁধা পথে হাঁটছেন না তিনি। অধিকাংশ শিরোনামের নীচে কিছুই লিখলেন না। কয়েকটি শিরোনামকেই শুধুমাত্র বেছে নিলেন। যেমন, “Deus Filius” (God the Son অর্থাৎ “পুত্র-ঈশ্বর”)-এর জন্য নির্ধারিত দুটি পাতাই ভরে উঠল, বাইবেল-এ ‘পরম পিতা’ ও ‘পুত্রের’ সম্পর্ক নির্ধারক যে উদ্ধৃতি ও আলোচনা রয়েছে, তা লিখতে। হিব্রু বাইবেল-এর একটি শ্লোক বিশেষ অর্থবহ বলে মনে হল নিউটনের। শ্লোকটি নোটবুকে লিপিবদ্ধ করলেন – ‘ঈশ্বর খ্রিস্টকে রাখলেন নিজের ডানহাতে, ঈশ্বর নামে অভিহিত করলেন তাঁকে…।’ এই অংশের ঠিক পাশেই মার্জিনে লেখা – ‘অতএব বিশ্বপিতাই হলেন পুত্র-ঈশ্বরের ঈশ্বর।’ এখানে নিউটন যেন খোঁজ পেলেন খ্রিস্ট ধর্মের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক তত্ত্বের – ঈশ্বরের পুত্র যীশু, প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর-স্বরূপ, কিন্তু পরমপিতা ঈশ্বর ও প্রভু যীশু এক নন। “God the Father” ও “God the Son” ভিন্ন দুই সত্ত্বা।  

নানান ভাষার বাইবেল-এর একাধিক জায়গায় পেলেন এই ভিন্নতার সুস্পষ্ট হদিশ। “Deus Pater” শিরোনামের নীচে কয়েকটি রেফারেন্স অর্থাৎ তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধ করলেন। এই নির্দেশিত অংশগুলি সরাসরি দুই সত্ত্বাকে আলাদা করে দেখিয়েছে – ‘ঈশ্বর একজনই – একম-অদ্বিতীয়ম, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে রয়েছেন একজন সংযোগরক্ষাকারী ব্যক্তি (মিডিয়েটর), তিনি জেসাস ক্রাইস্ট’; ‘প্রতিটি পুরুষের প্রভু হলেন খ্রিস্ট, প্রতিটি নারীর প্রভু একজন পুরুষ, আর খ্রিস্টের প্রভু ঈশ্বর।’ 

প্রথম পর্বের পড়াশোনায় নিউটনের মনে যেন কোনও সন্দেহই রইল না যে, প্রভু যীশু কখনওই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নন। পৃথক এক সত্ত্বা। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্মের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব, “ট্রিনিটি” (ল্যাটিনে “ট্রিনিতাস”) তো অন্য কথা বলে! ইংল্যান্ডের সকল চার্চে এই কেন্দ্রীয় তত্ত্বই মান্যতা পায়। এর অন্যথা হবার যো নেই। রাজশাসন, চার্চের কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভিন্ন মতাদর্শের কোনও স্থান নেই। চিহ্নিত হবেন ধর্মদ্রোহী হিসাবে। হতে হবে চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার।    

প্রচলিত যে কেন্দ্রীয় তত্ত্ব, অর্থাৎ “ট্রিনিটারিয়ানিজম্‌” বা “ত্রিত্ববাদ” মতে, ঈশ্বর তিন দৈব্য পুরুষে বিদ্যমান হলেও একই সত্ত্বা বিশিষ্ট (‘three persons in one substance’)। এই তিন দৈব্য পুরুষ হলেন, পিতা-ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা-ঈশ্বর ও পুত্র-ঈশ্বর (যীশু খ্রিস্ট)। অর্থাৎ খ্রিস্টকে ঈশ্বরের সমতুল্য বলা হচ্ছে এখানে। তিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতা-লব্ধ কোনও ব্যক্তি বিশেষ নন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর।  

নিউটনের মনে ধীরে ধীরে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। ত্রিত্ববাদকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে তাঁর। ইংরেজি, ফরাসি, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, সিরিয়াক ইত্যাদি নানান ভাষার, তিরিশটিরও বেশি বাইবেল-এর সংস্করণ পড়লেন নিউটন। প্রাচীন সংস্করণের বাইবেল-এ এবং পূর্বাঞ্চলের হিব্রু বাইবেল-এ কোথাও ত্রিত্ববাদের ছিটে ফোঁটার উল্লেখ দেখতে পেলেন না। অবিশ্বাস যেন আরও জোরাল হল। পরম ঈশ্বর-বিশ্বাসী নিউটনের কাছে চার্চের প্রথাগত ধর্মাচরণ বেসুরো ঠেকতে শুরু করল। যে করেই হোক তাঁকে ধর্মযাজক হওয়া থেকে অব্যাহতি পেতে হবে। 

তাছাড়া অন্য আর একটি বিশেষ কারণে তিনি চান না চার্চের পুরোহিত হতে। ঠিক এই কালটিতে অর্থাৎ ১৬৭০-এর দশকে, নিরুপদ্রব একান্ত অবকাশ প্রয়োজন তাঁর। অ্যালকেমি বা অপরসায়ন গবেষণায় নিমগ্ন থাকতে চান তিনি। সেও এক সত্যের অনুসন্ধান। বিশ্ব-প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন। আর তার দ্বারা জীবকুলের উন্নতি সাধন। যার ফল সরূপ মহিমান্বিত হবেন এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা, স্বয়ং ঈশ্বর। অন্তত নিউটনের তেমনই বিশ্বাস।       

একটি সুযোগ এসেছিল, ১৬৭২-এ। ট্রিনিটি কলেজে একটি ‘ল-ফেলোশিপ’-এর পদ শূন্য হওয়ায়, নতুন করে ওই পদে একজন ফেলো নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিল। লুকাসিয়ান প্রফেসার, আইজাক নিউটন-এর একটি ফেলোশিপ ছিলই। কোনও সিনিয়র ফেলোর দুটি ফেলোশিপ থাকলে তাঁকে আর চার্চের যাজকের দায়িত্বভার সামলাতে হয় না। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্ট্যাটিউটে উল্লেখিত এই নিয়মের কথা নিউটন জানতেন। ‘ল-ফেলোশিপ’-এর পদটি অর্জনের জন্য নিউটন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। ট্রিনিটি কলেজের অপর এক সিনিয়র ফেলোর নাম ওই পদের জন্য বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় ফেলোশিপ অর্জনে ব্যর্থ হলেন নিউটন।  

এর বছর দুই পর, ১৬৭৪-এর শেষ দিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালেন যাতে তাঁকে অর্ডিনেশন অর্থাৎ যাজক পদে অভিষেক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সময়ে তাঁর এক বন্ধু, ফ্রান্সিস অ্যাস্টনও চেষ্টা করলেন যাতে তাঁকেও অর্ডিনেশন থেকে ছাড় দেওয়া হয়। ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ (কলেজ মাস্টার) আইজাক ব্যারো। একসময় নিউটনের প্রিয় টিউটর ছিলেন এই ব্যারো। ব্যারোর প্রচেষ্টাতেই গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর হয়েছেন তিনি। কিন্তু এই অর্ডিনেশন-এর বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। আইজাক ব্যারো এবং কলেজের অধিকাংশ প্রফেসর ও সিনিয়র ফেলো অর্ডিনেশনের সপক্ষে। তাঁরা মনে করেন ইউনিভার্সিটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য অ্যাংগলিকান চার্চগুলিতে সুশিক্ষিত যাজক উপহার দেওয়া। ইউনিভার্সিটিই হল যাজক তৈরির আঁতুড়ঘর। 

অর্ডিনেশন থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিপক্ষে কলেজের যে অবস্থান তা ইংল্যান্ডের তৎকালীন ‘সেক্রেটারি অফ স্টেট’, যোসেফ উইলিয়ামসন-কে চিঠি লিখে জানালেন অধ্যক্ষ ব্যারো। 

নিউটনের নোটবুকে উল্লেখ রয়েছে, এই সময় তিনি বার দুয়েক লন্ডনে গিয়েছিলেন। কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে কি দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি? 

নিউটনের একটি চিঠির ড্রাফ্‌ট থেকে জানা যায়, রাজা দ্বিতীয় চার্লস-এর চিকিৎসক অ্যালেকজান্ডার ফ্র্যাজিয়ারকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁর নিজের জন্য এবং একইসঙ্গে বন্ধু ফ্রান্সিস অ্যাস্টনের জন্যও। অ্যালেকজান্ডার ফ্র্যাজিয়ার ছিলেন নিউটনের পূর্ব পরিচিত। 

অ্যাস্টনকে কিন্তু অর্ডিনেশন থেকে ছাড় দেওয়া হল না। যাজক পদে অভিষিক্ত হতে হবে অ্যাস্টনকে এই মর্মে নির্দেশ এসে গেল সরকারি ভাবে। নিউটনের বিষয়টি তখনও বিবেচনাধীন। 

কলেজ মাস্টার আইজাক ব্যারো এবং অতি ঘনিষ্ঠ এক সিনিয়র ফেলো, হাম্ফ্রি ব্যাবিংটনকেও যে অনুরোধ জানিয়েছেন নিউটন তা আন্দাজ করা যায়। চার্চের প্রথাগত ধর্মাচরণে তিনি বিশ্বাসী নন – একথা কিন্তু নিউটন প্রকাশ করেননি কারও কাছে। গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসাবে তাঁর কাজের ভার ও দায়িত্ব কম নয়, হয়তো সেটুকুই বলেছেন তিনি। আর সেই কারণেই অর্ডিনেশন থেকে অব্যাহতি পেতে চান। ব্যারো ও ব্যাবিংটন দুজনেই প্রভাবশালী। কিন্তু তাঁদের নিবেদনে রাজা দ্বিতীয় চার্লস সম্মতি দেবেন কি? পার্লামেন্ট-এর ছাড়পত্র মিলবে? নিউটন সে কথা জানেন না।                           

১৬৭৫। ডেটলাইন নিকটবর্তী। আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন নিউটন। 

রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি ওল্ডেনবার্গ বছর দুই আগে নিউটনকে একটি চিঠি পাঠান। তাতে সোসাইটির সদস্য পদের জন্য প্রদেয় অর্থ ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন নিউটনকে। সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে নিউটন ওল্ডেনবার্গকে লিখলেন – ‘ফেলোশিপ ত্যাগ করতে হবে আমায় এবার। সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে এবং আমি মনে করি এখন ব্যয় সংকোচনই সুবিধাজনক।’        

একেবারে শেষ মুহূর্তে মেঘ কাটল। রাজ বাড়ি থেকে এসে পৌঁছল সেই রয়্যাল ম্যানডেট যা যাজকের পদে অভিষিক্ত হওয়া থেকে উদ্ধার করল ট্রিনিটি কলেজের লুকাসিয়ান প্রফেসারকে। অর্ডিনেশন থেকে বরাবরের মতো ছাড় দেওয়া হল লুকাসিয়ান প্রফেসর পদটিকে। কলেজ মাস্টার আইজাক ব্যারোর প্রচেষ্টাতেই বোধহয় সম্ভব হল এমন অসম্ভব কান্ড। যোসেফ উইলিয়ামসন-কে লেখা চিঠিতে অর্ডিনেশন থেকে ছাড় দেওয়ার বিপক্ষে শুধুমাত্র অ্যাস্টনের নামই উল্লেখ করেছিলেন ব্যারো। নিউটন সম্পর্কে ব্যারোর অবস্থান ছিল ভিন্ন। এই লুকাসিয়ান প্রফেসরকে আর কেউ না জানুক তিনি জানেন তাঁর মূল্য কতখানি। গণিতে এমন প্রতিভা তিনি তো আর কারও মধ্যে দেখেননি।      

যাইহোক অবশেষে মাথা থেকে যেন ভার নামল নবীন প্রফেসরের। একেবারে নিজের মতো করে এখন সময় যাপন করবেন তিনি। 

কেমব্রিজের নিবিড় আশ্রয়ে একান্তে অ্যালকেমি চর্চায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন নিউটন। যদিও মনের মধ্যে রয়ে গেল খ্রিস্ট ধর্মের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও আচার-বিচারের প্রতি তীব্র অনাস্থা ও এক রাশ প্রশ্ন।     

১৬৭৫ থেকে ১৬৮৯ সাল, এই সময় কালে, প্রাকৃতিক দর্শন ও গণিত সাধনার পাশাপাশি খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস চর্চায় রইলেন ডুবে। প্রথমেই নিউটন পড়লেন, ১৬২৭-এ প্রকাশিত জোসেফ মেডের ‘ক্ল্যাভি অ্যাপোক্যালিপটিকা’ (Clavis Apocalyptica)। ল্যাটিনে রচিত এই গ্রন্থে, নিউ টেস্টামেন্ট-এর ধারাবাহিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন মেডে। ইতালিয় ইতিহাসবিদ ও ধর্মগুরু সিজার ব্যারোনিয়াসের বারো খন্ডের ‘Ecclesiastical Annals’ নিউটন সংগ্রহ করলেন। খ্রিস্টিয় ইতিহাস গবেষণায় ব্যারোনিয়াসের এই গ্রন্থ হল নিউটনের প্রাইমারি সোর্স। বইটি পড়ে খ্রিস্ট ধর্মের বিবর্তনের একটা সামগ্রিক ধারণা গড়ে উঠলেও সকল সংশয় নিরসন হল না।  

তাঁর মনে হল, খ্রিস্ট ধর্মের সূচনা কালে চার্চের ফাদারেরাও কি ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন?

খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের ধর্মগ্রন্থে যেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন নিউটন। সুপ্রাচীন সেই সকল পুঁথিপত্র থেকে, “De Trinitate” (ত্রিত্ব বিষয়ক) শিরোনামের নীচে ন-পাতা জুড়ে নোট নিলেন। জানতে পারলেন ঠিক কীভাবে ‘ঈশ্বরের আপন গ্রন্থ’ বাইবেল-কে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। জানতে পারলেন ত্রিত্ববাদের প্রবক্তাদের কথা। অ্যাথানাসিয়াস, জেরম, অগাস্টাইন, নাৎজিয়ানজেন – এরকম কয়েকজন বিশপকে চিহ্নিত করলেন যাঁরা বাইবেলের মূল কাঠামোকেই বদলে দিয়েছেন। কালিমা লিপ্ত করেছেন। এঁরাই ত্রিত্ববাদের প্রবক্তা। নিউটনের আরও মনে হল, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিশতম চার্চ ফাদার অ্যাথানাসিয়াস-ই হলেন আসল চক্রী। অপকর্মের নায়ক।  

কিন্তু ইংল্যান্ড ও সমগ্র ইউরোপের গোঁড়া খ্রিস্টানরা চার্চের অন্যতম এই আদি বিশপকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেন। স্পষ্টত, অ্যাথানাসিয়াস সম্পর্কে নিউটনের মনোভাব প্রকাশ পেলে ধর্মদ্রোহী হিসাবেই চিহ্নিত হতেন তিনি।  

এই কালটিতে নিউটন, সতের শতকের ট্রিনিটি কলেজের রুমে বাস করলেও, কার্যত মনে-মনে প্রায়শই  হারিয়ে যেতেন চতুর্থ শতকের সময়কালে।             

অ্যাথানাসিয়াস তখনও চার্চের বিশপ হননি। ওই সময় আলেকজান্দ্রিয়াতেই বাস করতেন জনপ্রিয় খ্রিস্টিয়ান এক ধর্ম প্রচারক, আরিয়াস। আরিয়াসের প্রচারের মূল বক্তব্য ছিল, গড-দ্য-ফাদার বা পিতা-ঈশ্বরই কেবলমাত্র চিরকালীন। শাশ্বত। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই গড-দ্য-সন বা পুত্র-ঈশ্বরের স্রষ্টা। এমন এক সময় ছিল যখন পুত্র-ঈশ্বর অর্থাৎ জেসাস ক্রাইস্ট ছিলেন না।

আরিয়াসের এই ধারণার ভিত্তি ছিল নিও-প্ল্যাটোনিজম। নিও-প্ল্যাটোনিজমে বলা হয় এই বিশ্বের সমস্ত কিছুই সৃষ্টি হয়েছে একটি মাত্র অখন্ড সত্ত্বা, ‘একক’ (‘One’) থেকে। এই মহান একক সত্ত্বা জগতের পরম আরাধ্য।           

ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আরিয়াস-এর যে ব্যাখ্যা, তা অ্যাথানাসিয়াসের মতো কিছু ধর্মীয় পণ্ডিতদের একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাঁরা ছিলেন আরিয়াসের ঘোর বিরোধী। আরিয়াসকে ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষণা করলেন অ্যাথানাসিয়াসের দল। 

আরিয়াস ও অ্যাথানাসিয়াসের অনুগামীদের মধ্যে বাঁধল বিরোধ।   

যুযুধান দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যেকার বিবাদ মেটাতে ও দেশ বিদেশের সমস্ত চার্চে অভিন্ন ধর্মাচরণ বিধি  আনতে উদ্যোগী হলেন তৎকালীন রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইন। তুরস্কের এক প্রাচীন শহর, ‘নাইস্যিয়া’-তে একটি সভা ডাকলেন তিনি। ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত এই অধিবেশন ইতিহাসের পাতায় ‘নাইস্যিয়ার প্রথম অধিবেশন’ (The First Council of Nicaea) নামে চিহ্নিত। 

পূব-পশ্চিমের নানা দেশ থেকে প্রায় তিন শতাধিক বিশপ ও চার্চের আরো অনেক পদাধিকারীরা উপস্থিত ছিলেন অধিবেশনে। শোনা যায়, অ্যাথানাসিয়াসের দল সংখ্যায় নাকি অনেকখানি ভারী ছিল। ফলে তাঁদের বক্তব্যই গৃহীত হল। অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে জেসাস ক্রাইস্ট সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হল তা এরকম – “…being of one substance with the Father”। অর্থাৎ ‘পিতা-ঈশ্বরের’ সাথে একই ঐশ্বরিক সত্ত্বা বিশিষ্ট, সম-বস্তুর হলেন জেসাস ক্রাইস্ট। ৩২৫-এর প্রথম নাইস্যিয়া অধিবেশনে গৃহীত ধর্মমত একটি বিশেষ গ্রিক শব্দ দ্বারা চিহ্নিত –homoousios’। এর অর্থ, সম-বস্তুর, ‘of one substance’। 

আরিয়াসের ধর্মতত্ত্ব ‘homoousios’-এর একেবারেই বিপরীত। আরিয়াস ও তাঁর অনুগামীদের দেশ ছাড়া করা হল। নির্দেশ দেওয়া হল, আরিয়াসের সমস্ত লেখাপত্র পুড়িয়ে ফেলার। আরিয়াসের কোনও লেখা যদি কোনও ব্যক্তির কাছে পাওয়া যায় তাঁকে দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড। রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইন এমনই ফরমান জারি করলেন। 

তবুও আরিয়াসের অনেক সমর্থক কিন্তু গোপনে রয়ে গেলেন দেশের নানা প্রান্তে।   

কয়েক বছর পর আরিয়াসকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হল। মূলত প্রথম কনস্টানটাইন-এর বোন কনস্ট্যানটিয়ার উদ্যোগেই দেশে ফেরার এবং সেই সঙ্গে চার্চে প্রবেশের অধিকার পেলেন আরিয়াস। 

ইতিমধ্যে অ্যাথানাসিয়াস বিশপ হয়েছেন আলেকজান্দ্রিয়ার। কিন্তু ওই সময় আলেকজান্দ্রিয়ায় আরিয়াসের বহু সমর্থক রয়েছেন যাঁরা অ্যাথানাসিয়াসকে ঘৃণা করেন। অ্যাথানাসিয়াসের সঙ্গে আরিয়াসের বিবাদ নতুন মাত্রা পেল। তবে এই বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারল না আরিয়াসের মৃত্যুর কারণে। 

৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন আরিয়াস। কিন্তু তাঁর এই মৃত্যু সম্পূর্ণ রহস্যে ঘেরা। ঠিক কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। আরিয়াস মারা যাওয়ার প্রায় দু’দশক পর অ্যাথানাসিয়াসের একটি লেখায় সর্বপ্রথম এই মৃত্যুর কথা ও তার কারণ উল্লেখ আছে। অ্যাথানাসিয়াস লিখেছেন, কনস্ট্যানটিনোপল-এর একটি চার্চে আরিয়াস অনুগামীদের নিয়ে প্রবেশ করলে চার্চের বিশপ শঙ্কিত হন এবং তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন। ঠিক সেই সময় ঘটে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। আরিয়াস সহসা মুখ থুবড়ে পড়ে যান ও মৃত্যু হয় তৎক্ষণাৎ।   

বলা বাহুল্য, অ্যাথানাসিয়াসের এই বক্তব্য ইতিহাসবিদরা গ্রহণ করেননি। আরিয়াসের মৃত্যু নিয়ে আর একটি মত হল, শত্রুরা নাকি বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে তাঁকে। আরিয়াসের মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানাই রয়ে যায়। তবে, খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস চর্চায় আরিয়াস যে এক বিতর্কিত চরিত্র তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

একেশ্বরবাদী আরিয়াসকে নিউটন বসালেন নায়কের আসনে। আরিয়াসের যে ঈশ্বর দর্শন অর্থাৎ,  “Omnipotence and Dominance of God the Father” – পরমপিতা ঈশ্বরই হলেন সর্বশক্তিমান, তিনিই প্রধান – এই দর্শনের সাথে নিউটনের ভাবনা যেন এক হয়ে গেল।     

১৬৭০-এর দশকের একেবারে শেষ দিক। অ্যালকেমি চর্চার পাশাপাশি থিয়লজি গবেষণাতেও মগ্ন রইলেন নিউটন।  নাইস্যিয়ার প্রথম অধিবেশনের আগে চার্চের ধর্ম-চর্চা কেমন ছিল, সে-ইতিহাস নিউটন পড়লেন ফ্রান্সের এক যাজক, ডেনিস পিটাউ-এর লেখা পাঁচ-খন্ডের ‘ডগমাটা থিওলজিকা’ (Dogmata Theologica) গ্রন্থ থেকে। জেসাস ক্রাইস্ট-এর প্রকৃত রূপ ঠিক কীভাবে ধীরে ধীরে বিকৃত হয়েছে তা জানলেন। 

সমস্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও ইংল্যান্ডের অ্যাংগলিকান চার্চের ধর্মাচরণের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব হল ত্রিত্ববাদ। নিউটন বুঝলেন, এই ধর্মাচরণ ভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট। খ্রিস্ট ধর্মের এই বিকৃতি (the corruption of Christianity)-কে  ‘The Great Apostasy’ অর্থাৎ, ‘চূড়ান্ত ধর্মভ্রষ্টতা’ বলে অভিহিত করলেন নিউটন।  

অপরদিকে পূর্বাঞ্চলের, মুখ্যত ইহুদি সম্প্রদায়ের একনিষ্ঠ একেশ্বরবাদের চর্চায় স্বাভাবিক ভাবে আকৃষ্ট হলেন নিউটন। হিব্রু ভাষায় রচিত পবিত্র বাইবেলের অপর এক ধারা, ওল্ড-টেস্টামেন্ট পড়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ইহুদীদের প্রাচীন ধর্মাচরণ কেমন ছিল। মধ্যযুগীয় ইহুদি দার্শনিক মুসা বিন মৈমুন (Maimonides)-এর লেখা পত্রে উল্লেখ পেলেন একেশ্বরবাদের (monothesim)। 

নিউটনের মনোজগতে ঈশ্বর সম্পর্কে যেন এক সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠল –  সীমাহীন এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা একজনই, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি চিরকালীন।  

১৬৮০-র গোড়ার দিকে থিয়লজি বিষয়ক একটি গ্রন্থের খসড়া প্রস্তুত করলেন নিউটন*। এর শিরোনাম দিলেন “Theologiae gentilis origines philosophicae”। জেসাস ক্রাইস্টকে এখানে তিনি একজন প্রোফেট হিসাবে দেখছেন, যিনি মানবকুলকে ভ্রান্ত ঈশ্বর সাধনা থেকে মুক্তি দিয়ে সঠিক পথ দেখাবেন। 

নিউটনের মতে, মানুষের এ-এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যে সে নানা প্রকার কুসংস্কার, মূর্তিপূজা, রহস্যময় বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মানুষের এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করেছেন ধূর্ত যাজক ও পুরোহিত বর্গ  বা দেশের রাজারা। কখনও মৃত ব্যক্তি বা জন্তু-জানোয়ার, আবার কখনও আকাশের নক্ষত্রকে ঈশ্বর হিসাবে পূজা করার প্রথা চালু করেছেন। সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ঈশ্বর তাই মহান মানুষদের যুগে যুগে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যেমন আব্রাহাম, মোজেস এবং জেসাস ক্রাইস্ট।

নিউটন লিখলেন, “Worshipping Jesus Christ as God was the highest form of religious perversion…” – অর্থাৎ, জেসাস ক্রাইস্টকে ঈশ্বররূপে পূজা করা হল বিকৃত ধর্মাচরণের চূড়ান্ত রূপ। আর রোমান ক্যাথলিক চার্চে এই বিকৃত ধর্ম পালনের প্রথাই প্রচলিত। থিয়লজি বিষয়ক গ্রন্থটি নিউটন প্রকাশ করেননি তাঁর জীবদ্দশায়।

কেমব্রিজে নিউটনের যে ছোট্ট পরিচিত পরিমণ্ডল রয়েছে, যেমন হেনরি মোর, আইজাক ব্যারো, জন নর্থ – এঁদের প্রত্যেকেই ত্রিত্ববাদ বিরোধী (অ্যান্টি-ট্রিনিটারিয়ান) অবস্থানকে নিন্দা করেন প্রকাশ্যেই। নিউটন কখনই তাঁর ত্রিত্ববাদ বিরোধী মনোভাবের কথা কাউকে জানতে দেননি। থিয়লজি গবেষণার সমস্তটুকুই সারেন গোপনে নোটবুকের পাতায়।   

কেবলমাত্র ১৬৮৯-এর গ্রীষ্মে, দার্শনিক জন লক-এর কাছে তাঁর অ্যান্টি-ট্রিনিটারিয়ান অর্থাৎ ত্রিত্ববাদ বিরোধী ভাবনা প্রকাশ করলেন। ইতিমধ্যে প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই জন লক প্রিঙ্কিপিয়া পড়েছেন। লক শুধুমাত্র দার্শনিক নন, তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো, তিনি চিকিৎসক, কেমিস্ট বা বলা ভাল তিনি একজন অ্যালকেমিস্ট। নিউটনের সঙ্গে লকের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে তাই দেরী হয়নি। যদিও তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ কবে হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। 

লকের গাণিতিক দক্ষতা বিশেষ না থাকায় তাঁর পক্ষে প্রিঙ্কিপিয়ার মেকানিক্স বোঝা সম্ভব হয়নি। সূর্যকে কেন্দ্র করে মহাকর্ষীয় টানে গ্রহদের যে উপবৃত্তাকার গতি তার এক সহজতর গাণিতিক ভার্সান লকের কাছে পাঠিয়েছিলেন নিউটন। লকের সাথে পত্র মারফত নিউটনের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত।  

 ১৬৯০-এর শরতে, অর্থোডক্স ট্রিনিটারিয়ান অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখলেন নিউটন, যার শিরোনাম, “An historical account of two notable corruptions of Scripture, in a letter to a Friend”। নিউ টেস্টামেন্ট-এ দুটি উল্লেখযোগ্য বিকৃতি সুনির্দিষ্ট করে তুলে ধরলেন। জন লককে পাঠালেন তাঁর সেই “Historical Account”। পত্রে নিউটন সৌজন্য মূলক ক্ষমা প্রার্থনা করলেন পেপারটির দীর্ঘতার জন্য। সেই সঙ্গে লককে জানালেন, পেপারটি অন্য কোনও দেশ থেকে ফরাসি ভাষায় প্রকাশ করতে চান। শুধু একটাই শর্ত, তাঁর নাম প্রকাশ করা যাবে না। 

১৬৯০-এর খ্রিস্টমাসের ঠিক পরেই কয়েকদিন নিউটন কাটিয়ে এলেন লকের বাসস্থানে। ওই সময় লক এসেক্সের ওটস্‌ ম্যনর হাউসে থাকতেন। দুজনের আলোচনার অনেকখানি অংশ জুড়ে যে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসের কথা, তার পথ-ভ্রষ্টতার কথা, থাকবে তা অনুমান করা যায়।  

চার্চের ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের বিষয়ে যে সুগভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন নিউটন তা দেখে বিস্মিত হলেন লক। লক বুঝলেন, সমগ্র ইউরোপে, খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস চর্চায়, পান্ডিত্যে, তাঁর সমতুল্য আর দ্বিতীয় কেউ নেই। নিউটন সম্পর্কে লকের উক্তি – “really a very valuable man, not only for his wonderful skill in mathematics, but in divinity too, and his great knowledge of the Scriptures, wherein I knew few his equals…”। 

নিউটনের সুদীর্ঘ “Historical Account” নিজের হাতে কপি করে আমস্টার্ডামের পরিচিত এক ধর্মতত্ত্ববিদ জিন ল্যে ক্লার্ক-কে পাঠালেন লক। কথামত, লেখকের নাম গোপন রাখলেন লক। ল্যে ক্লার্ক ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে পেপারটি সত্ত্বর প্রকাশ করতে চাইলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে নিউটন তাঁর মত বদলে ফেলেছেন। নিউটনের জীবদ্দশায় “Historical Account” আর প্রকাশ পায়নি। ১৭৫৪-তে নিউটনের আমস্টার্ডামের এই পেপারটি জনসমক্ষে আসে। 

১৯৩৬-এ লন্ডনের সদেবিজ নিলামে, আব্রাহাম ইয়াহুদা নিউটনের যে থিয়লজি বিষয়ক পেপারগুলি কিনেছিলেন, তার পরিমাণ এত বিপুল ছিল যে তেতাল্লিশটি ভাগে ক্যাটালগে সাজাতে হয়। থিয়লজি গবেষণায় প্রায় সাড়ে বারো লক্ষ শব্দ লিখেছিলেন নিউটন। 

নিউটন কি আরিয়ান ছিলেন? ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণই কি তাঁর কাছে আদর্শ ছিল? 

নিউটন গবেষকদের মতে, নিউটনের ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ধর্মীয় দর্শন। সেই দর্শনের মর্মবস্তু হল, খ্রিস্টিয়ানিটি এক সরল বিশ্বাস (a simple faith)। একজন প্রকৃত খ্রিস্টিয়ান হতে হলে তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে, জেসাস ক্রাইস্ট হলেন ঈশ্বরের সন্তান (The Son of God), তিনি হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর মেসিয়া (Messiah), সমগ্র মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য যাঁর আবির্ভাব ঘটবে একদিন। শিক্ষিত খ্রিস্টিয়ান অবশ্যই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ (Scripture) অধ্যয়ন ও চর্চা করবে নিয়মিত। ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত উপদেশাবলীর বিমূর্ত ও দুর্বোধ্য অংশগুলি নিয়ে আলোচনা করবে অন্যের সাথে। নিউটন এই সাধনাই করেছেন জীবনজুড়ে। বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নে ছিলেন নিরলস, ক্লান্তিহীন। নিউটনের অতুলনীয় ইন্টেলেক্ট-এর সাথে যুক্ত হয়ে গেছে তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতা। তাঁর সমস্ত কাজে, গবেষণায় ছড়িয়ে আছে এর পরিচয়। 

নিউটনের বিশ্বাস, ঈশ্বরের ভাষা পড়তে গেলে, দৈববাণী বুঝতে হলে তাঁকে হতে হবে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য – “True understanding of prophecy is a gift of God”। নিউটনের স্থির বিশ্বাস ছিল, তিনি নিজে ঈশ্বরের সেই আশীর্বাদ লাভ করেছেন। নিউটন মনে করতেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য ব্যক্তিকে জীবন চর্চায় হতে হবে নিষ্পাপ, নিষ্কাম, আলস্যহীন ও নিরাকার উপাসক। 

মূর্তি পূজা, ধর্ম পালনের নামে হিংসা, নিগ্রহ ঘৃণা করতেন নিউটন। রোমান ক্যাথলিক ধর্মাচরণে এই উগ্রতা দেখেছিলেন নিউটন। তাই ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি ছিল চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা। নিউটনের জীবনে রোমান ক্যাথলিক ধর্ম রাজনৈতিক দিক থেকেও বিপদ হয়ে দেখা দেয়।  

১৬৮৭-র বসন্তে প্রিঙ্কিপিয়ার তৃতীয় খন্ড প্রকাশ পেল। সমগ্র ইউরোপে আইজাক নিউটন তখন পরিচিত এক নাম। ইংল্যান্ডের রাজাসনে ওই সময় রয়েছেন দ্বিতীয় জেমস্‌। তিনি রোমান ক্যাথলিক ধর্মের উগ্র সমর্থক। সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, সেনা বাহিনী ও ইউনিভার্সিটির উচ্চ পদে জেমস্‌ নিয়ে আসছেন রোমান ক্যাথলিকদের। অনেক ক্ষেত্রেই তারা অযোগ্য। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিও বাদ গেল না। কিন্তু আইজাক নিউটন ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন রাজার সেই ধর্মীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে। ট্রিনিটি কলেজের নিভৃত আশ্রয় ছেড়ে নিউটনকে বের হতে হল রোমান ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে।     

 (চলবে)

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017.
  3. A. R. Hall, Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
  4. E. Muehlberger – ‘The Legend of Arius’ Death: Imagination, Space and Filth in Late Ancient Historiography’, Past & Present, Volume 227, Issue 1, Pages 3-29, May 2015

 

* Keynes Ms. 2, King’s College, Cambridge, UK

 ** নিউটন তাঁর অপটিক্স বইয়ের সর্বশেষ প্যারাগ্রাফ ‘Query 31’-এ থিয়লজি গ্রন্থটির কিছু অংশ সংযোজন করেন। প্রিঙ্কিপিয়ায় ‘General scholium’ অংশে দুটি ফুটনোটে থিয়লজি গ্রন্থ থেকে অন্তর্ভুক্ত করেন আরো কিছু অংশ । 

*** নিউটনের লেখা একখণ্ড কাগজ পাওয়া গেছে যাতে সাল লেখা ১৭০৪। সেই কাগজটিতে নিউটন হিসাব কষে নির্ণয় করেছেন যে ২০৬০ খ্রিস্টাব্দ হল এই পৃথিবীর অন্তিম কাল (“End of the World”)। ওই সময় জেসাস ক্রাইস্ট-এর পুনরায় আবির্ভাব ঘটবে এবং যাঁরা খৃস্টধর্মকে কলুষিত করেছে তাঁদের সকলের মৃত্যু হবে ও পরবর্তী সহস্র বছর এ-পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। “The Book of Daniel” বা “The Prophecy of Daniel” হল ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর প্রাচীনতম এক সংস্করণ। জানা গেছে, এই গ্রন্থ থেকেই নিউটন তাঁর “End of the World”-এর হিসাবটি করেন। 

             

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment