দেবব্রত কর বিশ্বাস

দেবব্রত কর বিশ্বাসের কবিতাগুচ্ছ

তোমাকে বলছি, নিজেকে বলছি

৬.
বিকেল আর সন্ধের মাঝে যে অন্ধকার
সেখানে যখন অঝোর বৃষ্টিপাত হয়, ঠিক তখন
সেই আবছায়ার ঘন শীতল হাওয়ায়, বিছানায়
শুয়ে শুয়ে তোমার কথা মনে পড়ে আমার

মনে হয়, বুকের ভেতরটা একটা ভিজে মাঠ
বৃষ্টির জল পড়ে পড়ে নরম হচ্ছে মাটি
আমি আর টাল রাখতে পারি না কিছুতেই

জল কতরকমের হয় আমি কি জানি না?
শুধু কিছুতেই বুঝতেই পারি না
কতটা ডুবে গেলে অন্ধকার সয়ে যায়
কীভাবে ঘুমোলে নিজেকেই মনে থাকে না আর?

 

৭.
মাঝেমধ্যে পাগল পাগল লাগে
আমি একা একা আর নিতে পারছি না

কী যে নিতে পারছি না জানি না
পাশের ফাঁকা জমিতে জমে থাকা জলের মতো
দূরে মাথা নেড়ে বৃষ্টিতে ভেজা গাছের মতো
দীর্ঘদিন ট্রেন না ছোঁয়া রেললাইনের মতো
একা-বোকা হয়ে আছে মন

কে সামলাবে তাকে? কে বলবে, ওসব কিছু না
ওসব তো আসলে মাটি আর জলের খেলা
মানুষ যাকে জীবন ভেবে পুতুল ভেবে খেলা করে

 

৮.
একেকটা দিন কাটিয়ে মনে হয়, অনর্থক!
মনে হয়, ভুল বাগানে ফুলগাছ পুঁতেছে সময়।
পরক্ষণেই ঘোর ভাঙে, লজ্জায় নীচু হয় মুখ।
কী অহংকার চিরে কী অন্ধকার মহাশূন্য!

মনে পড়ে, আমাকে ভাঙতে চেয়ে
হে প্রেম, নিজের ছেনি হাতুড়ির শক্তিপাতে
নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করেছ ভালোবাসায়।
ঠিক তখনই, আমিও ছিটকে পড়েছি যন্ত্রণায়!
একাকার হয়ে আছে তোমার আর আমার
শরীর, মন, মনের অতীত আর বর্তমান সব

দেখি, শূন্যের ভেতরে শূন্য হয়ে আছে ‘আমি’

 

৯.
মানুষের প্রতিহিংসার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী আছে!
মনে মনে সে নিজেকেই খুন করে বহুবার।
আমি দেখি, একেকটি রক্তাক্ত শরীর হাহাকার করছে।

দ্বন্দ্বের তড়িৎ-চুম্বকে কেঁপে ওঠা জীবন
ক্ষয়ের সাক্ষী হয়ে জেগে থাকে,
গতিপথ বদলে ফেলা নদীর একাকিত্ব-জুড়ে!

অস্ত্রের প্রতিহিংসার চেয়ে ‘বড় মানুষ’ আর কে আছে?

 

১০.
সারাদিন ধরে যতবার ‘আমি’ ‘আমি’ বলি
ঠিক ততবার দূরে সরে যাই নিজের থেকে।
এক পা এক পা করে মুছে যেতে থাকে চিহ্ন…
দেখি, দীর্ঘ বালুচর আরও লম্বা হচ্ছে স্বপ্নে।
সব ভেঙে দিতে ইচ্ছে হয় তখন।
মনে হয় জেগে উঠি, যেভাবে পুরনো গান
মনে পড়ে যায় অসম্ভব বিকেলের দিকে।
এসব কি বলে বোঝানো যাবে তোমায়?
না বলেও বুঝে নেওয়া স্বভাব যার
সে তো জানে, আসলে দ্বিতীয় বলে কিছু নেই
প্রথম বলেও কেউ নেই। কখনও ছিল না।

 

১১.
বয়স্ক পাথরের সিঁড়ি, গাছ নেই কেন তাঁর?

আমার প্রশ্নের উত্তরে চড়াই আরও কঠিন হয়।
পুরনো প্রেমের মতো, ভালোবাসা আর ঝগড়া
আলাদা করে চেনা যায় না কিছুই।
শুধু হেঁটে যেতে যেতে বোঝা যায়,
আর কিছু না থাক, স্বয়ং বিশ্বাস হাঁটছে পাশে…

এসবই জড়িবুটি। এসবই তুলসীপাতা-মধু।
অপরূপ শান্তিতে ঝোলায় লুকিয়ে থাকা বই।

বয়স্ক সিঁড়ি। যারা সব হেঁটেছে এখানে,
তাঁরাই তো গাছ হয়ে আছে পরম সাধনায়…

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment