বিতান চক্রবর্তী

কমরেড

‘শেষ খেয়া; কে যাবে গো?’

একজন চাপ দাড়িওয়ালা লোক ডাক দিচ্ছে। পরনে হাঁটু পর্যন্ত গোটানো প্যান্ট। আগে হয়তো প্যান্টটার কোনো রং ছিল, এখন তাকে কেবল সাদা-কালো বলেই চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। গায়ে ফ্যাকাসে লাল রঙের গেঞ্জি। তাতে চারটে ফুটোও আছে। ভালোভাবে খেয়াল করলে আরও ফুটো চোখে পড়ত মনে হয়। কিন্তু সে ডাক দিতে দিতে এদিক-ওদিক ঘুরছে। এত চলমান দৃশ্যকে ধরে রাখা যায় না। লোকটার চুল হাওয়াতে হাওয়াতে ঝাউবন হয়ে গেছে। গায়ের রঙের সাথে চুলের রঙের ফারাক কেবল এটুকুই যে চুলে কিছুকাল আগে লোকটি মেহেন্দি লাগিয়েছিল, তার লালচে কমলা রং খেয়াল করলে চোখে পড়ে। সে কেবলই ডেকে চলেছে। যদিও যতদূর চোখ যায় কাউকে দেখা যায় না। এখানে কি কোনো নদী আছে? বোঝা যায় না। দূরের দৃশ্যকে ঘষা কাচের মতো মুছে দিয়েছে একটা কুয়াশা। এখানে কি খুব ঠান্ডা? তাহলে লোকটার গায়ে কোনো ভারি জামা নেই কেন? জলে তো আরও ঠান্ডা লাগে। অভ্যাসে তাকে আটকানো যায় কি? এখানে রাস্তা কাঁচা। পিচের গন্ধ এ-মাটি মাখেনি কোনোদিনও। পাড় ঘেঁষে রাস্তা। তারই ধারে ধারে দোকান, বাড়ি। সবই কাঁচা। সে দেওয়ালেও নতুন মাটির প্রলেপ পড়েনি অনেকদিন হল। মাটি ফেটে গেছে। এই ঘরগুলোতেও কি মানুষ নেই? দৃশ্যে কেবল সেই মাঝি ছাড়া আর কেউ নেই কেন? খুব ভালোভাবে দেখলে একটা খোলা ঘর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা যাচ্ছে। উনুন ধরিয়েছে কেউ! চায়ের দোকান বুঝি? ভেতরে বাঁশের বেঞ্চি আছে? ও বাবা, এ যে আর্যা! সে এই দোকানে কী করছে? চা সে খায় না। প্রতিদিনের মতো তার সেই বেরঙা সালোয়ার কামিজেই সে বেরিয়েছে। তাকে মেক-আপ করতে কেউ দেখেছে বলে দাবি করতে পারে না। সারাদিনের পর কোনো বিয়ে বাড়ি থাকলেও সে ধুলো পায়ে, রং-চটা জামাকাপড়েই চলে যায়। আবদারে ছবিও তোলে। কেউ অনুযোগ করলে মুচকি হাসে। এড়িয়ে যায় সেই সব আলোচনা। জাঁকজমকের যে একটা ঔপনিবেশিক ইতিহাস আছে সে কথা ওখানে কে শুনবে? ও চোখের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে মিহি হাসি। তার ফর্সা কুমারী মুখে ওটুকুই লাবণ্য। বাকি শরীরটা নুয়ে গেছে কোনো এক অজানা লড়াইয়ে। মাঝি ডেকেই চলেছে এই দৃশ্যে। তাকে যেন কেউ থামতে মানা করেছে। অথবা বুঝিয়েছে এমন দৃশ্যে আজকাল সিনেমামেকাররা পয়সা খরচ করে মিউজিক করেন না। ডাকটাই এখানে মিউজিক হিসেবে বুঝে নিতে হয় দর্শকদের। সে আর্যাকে ডাকে। ‘দিদি, যাবে নাকি?’ আর্যা হেসে মুখ ফেরায়। সে যাবে না। ওকে এই লোকটাও চেনে? আর্যাকে সকলে চেনে। সে সকলের দিদি। আশি বছরের সবজিওয়ালারও সে দিদি, বস্তির সদ্য মস্তানেরও সে দিদি। তাকে কঠোর মুখে খুব কম মানুষই দেখেছে। কেউ কেউ দেখেছে যদিও। সেসব উত্তাল সময়ে। তা স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। সময়ের খরস্রোত আছড়ে নিয়ে চলে যায়। বাকি সময় আপাত স্থির, শান্ত উপত্যকা। একঘেয়ে চলতে থাকা জীবন। গ্রীষ্মে কপালে ঘাম জমে, জলে কাদায় হালকা রঙের প্যান্ট নোংরা হয়, শীতে আগুন জ্বালায় পথবাসী, বসন্তে পলাশ খোঁজে বনসাই শহর। বন্যা, ঝড় এখানে মুহূর্ত, তুষারপাতের এখানে প্রবেশ মানা। ‘দিদি, তুমি যাবে না?’ মাঝি আর্যার এত কাছে চলে এলো কখন? আর্যা দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে কিছু? হঠাৎ সমস্ত দৃশ্যের নৈশব্দ খানখান করে গুলি চালায় কে? আর্যার ফর্সা প্রশস্ত কপালের ঠিক মাঝখানে। স্কেল দিয়ে না মেপেও বলে দেওয়া যায় এখানটাই মাঝখান। দু-ভুরুর ঠিক মাঝখানে। ফ্যাকাসে মুখটা এখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর্যা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। ধুলোতেই গড়িয়ে পড়েছে। তবে তার হাসি মিলিয়ে যায়নি। ভারী রক্ত বন্ধ করতে পারেনি তার বিষাদপারের চোখ। দৃশ্যে কুয়াশা বাড়ছে। ঢেকে যাচ্ছে মাঝি, মাটির ফুটিফাটা ঘর। আর্যা? আর্যাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? এত সাদা, এত তীব্র এ-কেমন কুয়াশা?

গলা শুকিয়ে গেছে দিব্যর। মাথার পাশের টেবিলেই প্রতি রাতে কুহু জলের বোতল রাখে। সুন্দর দেখতে কাচের বোতল। নিউ টাউনের কোনো এক হোম ডেকর শপ থেকে সে নিজে বেছে কিনে এনেছে। দিব্য সাবধানে সে বোতলের মুখ খুলে জল খায়। অনেকটা। গলা সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখলে যেন এই পিপাসা মিটবে! কুহু আশেপাশে নেই। হয় রান্নাঘরে, না হলে স্নানে গেছে। কুহু সকাল সকাল স্নান করে নেয়। খুব গরম পড়লে তিনবেলা স্নান করে ও। সে গায়ে ঘাম জমতে দেয় না। এ তার শৌখিনতা। কুহু একেবারে ঘরোয়া মেয়ে। সংসার সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসে। পরিপাটি রান্না, জমকালো ড্রয়িং রুম, টিপটপ ওয়ারড্রোব। এই তার সারাদিনের কাজ। এর বাইরে জগতে কী ঘটে চলেছে তাতে সে নিরুত্তাপ। দিব্য এলাকার হবু কাউন্সিলর। এটুকু জেনেই কুহু খুশি। দিব্যর কোন দল, সে দলের এজেন্ডা কী… তাতে কুহুর কিছুই যায় আসে না। এতে দিব্যর বেশ সুবিধেই হয়েছে। প্রশ্নের তলায় থাকতে হয় না। তার কেরিয়ার সম্পর্কে যেটুকু সে বলে দেয়, তার বাইরে কিছুই জানতে চায় না কুহু। তবে দিব্যর সময়াভাবই তার একমাত্র অভিযোগের জায়গা। এই যে বিপুল সংসারের ভার সে একা কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে এই অভিমান, বিয়ের দেড় বছরেই বেড়ে বেড়ে পাহাড় হয়ে উঠেছে। দিব্য মাঝে মাঝে ভাবে এমন জীবনই কি সে চেয়েছিল? সেই ছাত্রজীবনে যখন আগত বিপ্লবের শপথ নিয়েছিল, তখন চার দেওয়ালের বাইরে এই বিশ্বচরাচরই ছিল সংসার। একে সুন্দর করাই ছিল তার স্বপ্ন। আর্যা সেই স্বপ্নের সাথী। যাকে প্রোপোজ করা বলে, তা কোনোদিন তাদের করতে হয়নি। মিছিলে পাশাপাশি হেঁটে এ-ওর ক্লান্ত স্লোগান ধরে নেওয়ার অভ্যাস, ভরসাই তাদের ভালোবাসা হয়ে উঠেছিল। এই দৃশ্যে কুহু বড়ো বেমানান। তবু দিব্য তার নতুন জীবনে বহু প্ল্যান করে এই ডিসিশন নিয়েছিল। কুহু ছিল তার এগোনোর পথ। স্বপন ঘোষ, কুহুর বাবা রুলিং পার্টির জেলা সম্পাদক, এলাকার পুরোনো প্রোমোটার। আজকাল সরকারি কনট্রাক্টও নিচ্ছেন। বিয়ের পর দিব্য এখন তার পার্টনার। কুহু এক সন্তান হওয়ায় রাজপাট পেতে সুবিধেই হয়েছে দিব্যর। একদম নতুন দলে অল্প দিনেই তার এই বিশেষ গুরুত্বের জন্যও এই ভদ্রলোকই দায়ী।

–উঠলে? চা বানিয়ে তা আবার ঠান্ডাও হয়ে গেল! 

কুহু ভেজা চুলে টাওয়েল জড়িয়ে সিঁদুর পরতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আজ সকালবেলাতেই শাড়ি পরেছে। কোথাও যাবে নাকি?

–সকালে বেরোবে নাকি? 

দিব্য বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করে। কুহু জানালা খুলে দেয়। বদ্ধ ঘরে সিগারেট খাওয়াতে তার ঘোরতর আপত্তির। এসি বন্ধ করে দেয় দিব্য। কলকাতায় মার্চ থেকেই এসি চালাতে হয়। 

–না তো! 

–তবে শাড়ি পরেছ যে! 

–ওমা, আজ বৃহস্পতিবার না! লক্ষ্মীর ঘট বসাতে হবে। দাঁড়াও চা গরম করে দিচ্ছি। আজ ব্রেকফাস্ট হতে দেরি হবে। পুজো করে দেব। তোমার বেরোবার তাড়া নেই তো? 

দিব্য জানায় তার তাড়া নেই। আজ একটাই মিটিং। সে-ই প্রধান বক্তা। পৌরসভার ইলেকশন ডেট প্রকাশ হয়ে গেলেও এখনও প্রচারের সেই জোয়ার ওঠেনি। দেওয়াল লেখা চলছে, সাথে প্রার্থী পরিচয়পর্ব। আগামী সপ্তাহ থেকে আর নিশ্বাস নেওয়ার সময় থাকবে না ওদের। দিব্যর প্রথম লড়াই বেশ কঠিন। সতেরো বছরের রাজনৈতিক গুরুই ওর অপোনেন্ট। জিততে দিব্যকে হবেই। নতুন দল তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। বিরোধীদের এই দুর্জয় ঘাঁটি তাকেই জয় করে দিতে হবে। কারণ, এই এলাকা তার নখের ডগার মতো চেনা। আর যে অপমান তাকে নলিনদা করেছিল, তার প্রতিশোধও ওকে নিতেই হবে! 

কুহু চা রেখে যায় টেবিলে। দিব্য পেপারের প্রথম পাতায় খবর খুঁজছে। বক্তৃতার রসদ। চোখ তুলে কুহুকে দেখে। ফিরে যাচ্ছে সে তার ঠাকুরঘরে। ডিপ কাটের ব্লাউজে অনেকখানি পিঠ দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়েই থাকে দিব্য। দরজার আড়ালে সে হারিয়ে গেলে মনে হয়, কুহুকে ডাকলেই হত। এমন নিস্তরঙ্গ সকালে আদরে ভাসলে ক্ষতি কী? 

–এই কুহু! কুহু! একবার শোনো না। 

কুহু ফিরে আসে। 

–কী বলছ? 

–এদিকে এসো। 

কুহু দিব্যর কাছে এসে দাঁড়ায়। দিব্য তার হাত ধরে আদরে। 

–বসো না একটু। 

–না, না। বাসি বিছানায় বসব না। পুজো দিতে যাব!

দিব্য নাছোড়। সে হেঁচকা টানে বুকের কাছে টেনে নেয় কুহুকে। কুহু নকল আপত্তি জানায়। দিব্য তার সদ্য শ্যাম্পু করা চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে আপত্তিকে আদরের দিকে নিয়ে যেতে চায়। কুহুর আঁচল বুক থেকে খসে দিব্যর হাতে জড়িয়েছে। সেটা সরাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হয় আর্যার দেওয়া শাড়িটা না? চমকে কুহুর মুখের দিকে তাকাতেই দেখে তার একদম সামনে আর্যা, কপালে বুলেটের গভীর ক্ষত, রক্ত শুকিয়ে আছে তার চারপাশে। এখনও কেউ পরিষ্কার করেনি। ভয়ে দু-হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় শরীরটা। কুহু যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে ওঠে— 

–আঃ, কী হচ্ছে দিব্য! লাগছে! 

দিব্য সম্বিত ফিরে উঠে বসে। কুহুর জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে সে বোকার মতো চুপ করে থাকে। কাপড় ঠিক করতে করতে কুহু দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

 

 

মুখের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। একগাদা পেস্ট নিয়েছে দিব্য। ইচ্ছে করেই নিয়েছে। আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখাটা কাজের নয়! কুহু কী ভাবল কে জানে? একটা অপরাধবোধ কাজ করছে সেই তখন থেকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে কুহুর দিকে তাকাতে পারবে? দিব্যর সমস্ত অতীত সে জানে না। কোনোদিন জানতেও চায়নি। দিব্যর বিশ্বাস বিয়ের আগে বাবার কাছ থেকে সে জেনে নিয়েছে তার অতীত। তবু, সবটা কি জানতে পেরেছে? জানলে আজ সকালে আর্যার দেওয়া শাড়িটা পরত? তাদের বিয়েতে ইচ্ছে করেই পুরোনো দলের অনেককে নিমন্ত্রণ করেছিল দিব্য। বুঝতে চেয়েছিল আর কে কে তার সঙ্গে আসতে চায়। আর্যা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কোনো মিছিল থেকে এসেছিল বোধহয়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা ব্যানার উঁকি মারছিল। সেই আলুথালু ড্রেস, ধুলো-মাখা পায়ে সস্তার জুতো। খায়নি কিছুই। গিফট প্যাকেটটা কুহুর হাতে দিয়ে একটা ছবি তুলেছিল। ঠোঁটে লেগেছিল নরম হাসি। আর্যা ঠাট্টার ছলে বলেছিল, ‘সামলে রেখো কিন্তু, বাবু মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যান!’ বউভাতের পরের দিন কুহুই শাড়িটা দেখিয়েছিল। ‘যাই বলো, আর্যার পছন্দ আছে। কী সুন্দর ডিজাইন!’ হালকা হলুদের মধ্যে লাল সুতোয় বোনা। আর্যাকে কোনোদিন শাড়ি পরতে দেখেনি দিব্য।

পরের বেশ কয়েক সপ্তাহ ওয়ার্ডে আলোচনা চলেছিল আর্যা কি নতুন দলে যাচ্ছে! দিব্য তাকে বিরাট টোপ দিয়েছে। না হলে দল ছেড়ে যাওয়া কোনো কর্মীর বিয়েতে কেউ যায়? তাও তাদেরই রাইভাল দল! এসবই আর্যা ভুল প্রমাণ করেছিল সপ্তাহ তিনেক পর মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিল লিড করে। দিব্য কড়া নজর রেখেছিল সমস্ত ঘটনার ওপরে। সে ছাড়া আর কেউ এলো না নতুন দলে। নতুন যারা দলে বন্ধু হল তাদের সকলকেই দিব্য বাজিয়ে দেখল। যাদের মনে ধরল না, সন্দেহের ডায়েরিতে আলাদা লিখে রাখল নাম-ধাম।

কুহু দরজায় টোকা দিলো। ‘চা যে আবার ঠান্ডা হয়ে গেল’। কমোডের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে ফ্লাশ করে দেয় দিব্য। হাতে ধূপকাঠি নিয়ে সারা ঘরে ঘুরছে কুহু। দিব্যর দিকে না তাকিয়েই হাত তুলে টেবিলে রাখা চায়ের কাপ দেখিয়ে দেয়। দিব্য রাতের বিছানা গুছিয়ে রাখে। সাধারণত এটা তার কাজ নয়। কিন্তু আজ সকালের এমবেরাসমেন্ট কমানোর এটা একটা প্রস্তুতি। হ্যাঙার থেকে ঘরে পরার ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে, চায়ের কাপ নিয়ে বসে চেয়ারে। মাথাটা টিপটিপ করছে। ঘুমের ডিস্টার্বেন্স থেকে হতে পারে। তবু কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা! প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সাথে দেখা করছে, আজকাল মাস্ক পরাও উঠে গেছে। সে মাস তিন আগেই ইনফেকটেড হয়েছিল। মাইল্ড কিন্তু শরীরের দুর্বলতা কাটতে প্রায় পনেরো দিন লেগেছিল। কুহু নিয়ম করে চিকেন স্টু খাইয়েছে। সেবার প্রায় মাস দেড়েকের জন্য টাইফয়েডে ভুগেছিল দিব্য, নদীয়ার একটি গ্রামে ভোট করাতে গিয়ে। বাপ্পা আর আদিত্য ছিল ওর সাথে। সারাদিন কাজ করে এসে ছেলে দুটো রান্না করত। ডাক্তার বসু বাইরের কোনো খাবারই না করে গিয়েছিল। বসু দলের নদীয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। বাপ্পারা বাইরে খেয়ে এলেও দিব্যর খাবার রেঁধে দিতে হত। সেই সময় প্রায় সাতদিন জ্ঞান ছিল না দিব্যর। ছেলে দুটো ওর সঙ্গ ছাড়েনি। সারা রাত পালা করে মাথায় জল ঢেলে সকালে গেছে ভোটের প্রচারে। ট্রেনে কলকাতা ফিরতে পারবে না, আবার গাড়ি ভাড়া করে আসাও সম্ভব নয় বলে দিব্য ওখানেই থেকে গিয়েছিল। হঠাৎ ছেলে দুটোর মুখ মনে পড়ল দিব্যর। আদিত্য আর নেই। গেল বিধানসভা ভোটে খুন হয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ভোট করাতে গিয়েছিল। রাতে বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল থেকে নামিয়ে কুপিয়েছিল। বড়ো হেডলাইন হয়েছিল। পুলিশ ডাকাতি বলে চালিয়েছিল। কোর্টেও তাই প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু কী খোয়া গেছে ছেলেটার থেকে তা আজও কেউ জানে না। দিব্য জানে ছেলেটার পকেটে খুব বেশি হলে হাজারখানেক পার্টি ফান্ডের টাকা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। ডাকাতরা সাইকেলটাও নেয়নি। কোর্টে এসব প্রশ্ন এসেছিল, কিন্তু তথ্য-প্রমাণ জোগাড় হয়নি। বাকি কানাঘুষো বিপুল জনসমর্থনের ভোটে ভেসে গিয়েছিল। দিব্যও এত খুঁটিনাটি পেপার থেকেই জেনেছে। ছেলেটা খুব ভালো ডাল রাঁধত। হরেক রকম ডাল। সাথে ওর এক বাংলাদেশি মাসির থেকে শেখা ভর্তা। একবার শুঁটকি মাছের ভর্তা খাইয়েছিল। দিব্য শুঁটকি খায় না। ওকে না জানিয়েই খাইয়েছিল। ওহ, কী স্বাদ! দিব্যকে কথা দিয়েছিল আরেকবার খাওয়াবে…

কুহু পুজো দিয়ে আয়রন করা জামা-কাপড় আলমারিতে তুলতে এসে দাঁড়ায়,

–মাথায় কী হল? 

কপাল থেকে হাত সরিয়ে দিব্য তাকায়! তাকিয়েই চোখ লুকিয়ে নেয়। 

–কিছু না। মাথাটা ধরেছে। 

কুহু জামা-কাপড়গুলো বিছানার ওপর রেখে কাছে আসে। কপালে হাত রাখে। তাপ বুঝে নেয়। 

–জ্বর তো নেই! 

–না, না, জ্বর নয়। রাতে ঘুমের মধ্যে খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছি।

কুহু উদ্বেগের সঙ্গে তাকায়। দিব্যর কাছ ঘেঁষে বসে। 

–বাবাকে বলো, ক-দিনের বিশ্রাম নাও।

–তা কেমন করে হয়! সামনে ইলেকশন। এখন বিশ্রাম নেওয়া যায়? জিততে হবে না? 

দিব্য কুহুর পিঠে হাত রাখে। ক্ষমা চাওয়ার মাটি প্রস্তুত।

–আজ সকালের জন্য স্যরি। কাল রাতে এমন স্বপ্ন দেখেছি না! 

–কী এমন দেখেছ যে আমাকে দেখেও ভয় পেয়ে গেলে? 

–খুন। খুনের স্বপ্ন…

কুহু চমকে ওঠে। 

–কী বলছ! বাবাকে বলো তোমার যেন সিকিউরিটি দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তুমি না বললে আমিই ফোন করছি।

কথা শেষ করতে না করতেই ফোন তুলে নেয়। দিব্য ব্যস্ত হয়ে তাকে থামায়। 

–আরে স্বপ্নের জন্য কেউ কোনোদিনও সিকিউরিটি পেয়েছে আজ পর্যন্ত? লোকে হাসবে যে! 

–হাসুক। জানো না ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়!

অন্য সময় হলে দিব্য খুব খিল্লি করত। এমন কুসংস্কারের জন্য দেশের কত কত ক্ষতি হচ্ছে তার লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে দিত। কিন্তু সে সময় আর নেই। সে একটু হেসে কুহুকে বুকের কাছে টেনে নেয়। 

–তুমি আছ না। তুমিই সব খারাপের থেকে আমাকে ঠিক বাঁচিয়ে আনবে। আমি জানি। 

কুহু সোহাগে নিজের রাঙা মুখখানা দিব্যর বুকে লুকিয়ে দেয়। সদ্য শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ সারা শরীর ভরে আছে। জীবনের এমন নতুন ছন্দ ভালোই লাগে দিব্যর। তার চোখ বুজে আসে। 

***

লম্বা কালো রাস্তায় কেবল লাল পতাকা, তার থেকেও বেশি মানুষের মাথা। মিছিল, মিছিল। কত কত ছন্দোবদ্ধ কথা। সমস্ত পা চঞ্চল। সমস্ত হাত স্বপ্নের কাছে সমর্পিত, দৃঢ়। দূরের আকাশ এখনও নীল। যদিও তারই এক কোনায় কালো মেঘের দল লুকোনো দেখা যাচ্ছে। তবে সে আছড়ে পড়তে পড়তে রাত হয়ে যাবে। না হলে ভেসে যাবে অন্য কোনো আকাশে। কিন্তু এ কী, মিছিলের মুখ ঘুরে গেল কেন? ভয়ঙ্কর স্রোতের মতো মিছিল পিছনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। দিব্যদের মতো কিছু ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়েই রইল স্রোতের বিপরীতে। জলপাই রং পোষাকের পাল পাল র‍্যাফ উন্মাদের মতো লাঠি দিয়ে স্রোত ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে এদিকেই। দাঁত শক্ত করে দাঁড়িয়ে দিব্য। তার থেকে হাত কুড়ি দূরেই লুটিয়ে পড়ে আছে তারই কমরেডরা। নিজেও লুটিয়ে পড়ার আগে অন্তত খান দুয়েক র‍্যাফের মাথা গুঁড়িয়ে দেবেই সে। উন্মাদের মতো তার হাতের পতাকার বাঁশের ফাঁপা লাঠিটা ঘোরাতে থাকে। হয়তো কয়েক ঘা লাগল কারো কারো গায়ে, কিন্তু তখনই কিছু একটা তার মাথায় এসে আছড়ে পড়ল। চোখের মণিতে কয়েক হাজার পাওয়ারের হ্যালোজেন জ্বলে উঠল। তারপর সব শূন্য, সব অন্ধকার। যখন জ্ঞান এলো তখন সে আর্যার কোলে শুয়ে। আর্যার সালোয়ার ছেঁড়া। ওড়না রক্তে ভাসছে। পরে শুনেছিল আর্যা তাকে জড়িয়ে তার পিঠে বাকি সমস্ত লাঠির বাড়ি নিয়েছে। কপালে ন-টা সেলাই নিয়ে দিব্য বাড়িতে শুয়েছিল গোটা একটা সপ্তাহ। আর্যা প্রতিদিন আসত। কোনো একটা পেপার আর্যার সেই দিব্যকে জড়িয়ে বাঁচানোর ছবি ছেপেছিল। সে ছবি পরে ভাইরাল হয়। সেদিন ওই রক্ত স্রোতের মধ্যেও সেকি এমনই আর্যার শরীরের ঘ্রাণ পেয়েছিল? সে কি ঘোরের মধ্যে বলেছিল, আমি জানতাম তুমিই বাঁচাবে!

***

কুহু নিজেকে দিব্যর থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে। বুকের খসে যাওয়া শাড়ি ঠিক করে। 

–চা-টা এবার শেষ করো। ঠান্ডা জল হয়ে গেল। আমি জলখাবারের ব্যবস্থা করি। 

 

 

ড্রেসিং-এর পর ব্যান্ডেজ ছোটো হয়ে এল। ব্যথা নেই। শুধু মাথাটা ভার হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাসে বাড়ি না ফিরে পার্টি অফিসে এসে নামল দিব্য। সাতদিন পর পার্টি অফিসে। রাজনৈতিক আড্ডা চলছে নানান ঘরে। নলিনদাকে খুঁজল দিব্য। সাধারণত এই সময়টাতে সে পত্রিকার ঘরে থাকে। নিজের লেখার প্রুফ বা লেখাটাই এডিট করে। কেউ এসে পড়লে তার লেখাটাও দেখে দেয়। বইভর্তি ঘরে আজ কেউ নেই। অফিসের বারান্দায় বাপ্পা বিড়ি খাচ্ছিল। 

–কী রে, দাদা কোথায়? 

বাপ্পা ধোঁয়া ইন করে বলে, 

–আসছে না অফিসে। 

–কেন? 

–সেকি, খবর যায়নি? 

–মানে? কী হয়েছে রে?

–সেন্ট্রালের সাথে হেব্বি ঝামেলা হচ্ছে। জানো তো এবার সাতাশ নম্বর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য হয়েছে। আলমদা প্রস্তাব দিয়েছিল, ওই ওয়ার্ডে আর্যা দাঁড়াক। কাগজে ছবি ছাপার পর থেকে ওর পপুলারিটি এখন হেব্বি। কিন্তু দাদা চান না। 

–চান না? আরে দাদা তো আর শাড়ি পরে দাঁড়াতে পারবে না! কোনো না কোনো মহিলাকেই তো দাঁড়াতে হবে। 

–দাদা মিতালিদির নাম প্রস্তাব করেছিল অনেকদিন আগেই। কিন্তু পপুলারিটির জন্য পার্টি এখন চায়…

দিব্যর চোয়াল শক্ত হয়। পরের সপ্তাহের লম্বা নির্বাচনী প্রস্তুতিসভা গরম হয়ে ওঠে দিব্য আর নলিনের বিতণ্ডায়। জেলা সম্পাদককে হুমকি দেয়, আর্যা না দাঁড়ালে সে দল ছাড়বে। পুরো সভায় আর্যা ছিল চুপচাপ। সভা শেষে অনেকেই ভেবেছিল আর্যা দিব্যকে নীরব সমর্থন জানাচ্ছে। ভুল ভাঙল পরের দিন। আর্যা চিঠি দিয়ে জানাল সে ভোটে দাঁড়াতে চায় না। সে কর্মী, কর্মী হিসেবেই দলের কাজ করে যেতে চায়। খবরটা দুপুরের দিকে পেল দিব্য। গুম হয়ে রইল সারাদিন। ঠিক করল কয়েকদিন কারোর সাথে দেখা করবে না, অফিসে যাবে না। কিন্তু খবর আসতেই থাকল। নলিন আবার সক্রিয় হয়েছে। পার্টি মিতালির বদলে দলের প্রাচীন কর্মী মন্দিরাদিকে প্রার্থী করেছে। সপ্তাহ শেষের দিকে দিব্যর কাছে শোকজ এলো, সিনিয়রদের সাথে অভব্য ব্যবহার এবং পার্টির শৃঙখলাভঙ্গের অভিযোগ, ফলে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। সময় এক সপ্তাহ। উত্তর দেয়নি দিব্য। এক মাসের মাথায় পার্টি বদল করল সে। এ-সবের পাঁচ বছর হয়ে গেছে। নতুন দল এবার তাকেই প্রার্থী করেছে, উলটো দিকে নলিন। লোকে বলছে লড়াই সেয়ানে সেয়ানে।

***

ব্রেকফাস্ট সেরে কাজের টেবিলে গিয়ে বসে দিব্য। বিকেলের কথাগুলো সাজিয়ে নিতে হবে। আগামীকাল একটা টিভি ইন্টারভিউ আছে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ, বহু চেষ্টা করে ব্যপারটা ম্যানেজ করে দিয়েছে দলের মিডিয়া সেলের সুকান্তদা৷ সে-ই দিব্যর জন্য একটা পিআরটিম ও স্যোশাল মিডিয়া টিম তৈরি করে দিয়েছে। মউ তার হেড। মেয়েটার ডিজাইন সেন্স মারাত্মক। পোস্টে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট মিস হলে যোগ করে দেয়। কোন পোস্টে কতটা বিতর্ক থাকবে, কোনটা হবে তর্কহীন এ-সব যুক্তি তার আঙুলের ডগায়। মউকে দেখলে সৌম্যর কথা মনে পড়ে যায়। দিব্যর প্রথম ফেসবুক প্রোফাইল খুলে দিয়েছিল সৌম্য। ‘এই যুগে স্যোশাল মিডিয়া ছাড়া চলবে না দাদা!’ ছেলেটা মোবাইলে অসাধারণ সব ব্যানার বানাত। ছবি তুলেই তার মধ্যে নিজের আঙুলের ছোঁয়ায় ক্লিপ, মিম তৈরি করে ফেলত নিমেষে। দিব্যর ফেসবুক কভারটাই সৌম্যর করে দেওয়া শেষ ডিজাইন। একটা স্টারের নীচে লেখা, ‘সাম্য আমার জন্মগত অধিকার’। ছেলেটার আজকাল খবর কী কে জানে! সৌম্য নিজেই দিব্যকে আনফ্রেন্ড করেছে। প্রোফাইলও প্রাইভেট করে রেখেছে। শেষবার সৌম্যর খবর পেয়েছিল সপ্তাহ চারেক আগে। রাতে কিছু ছেলেপিলে নিয়ে ঢুকেছিল পাড়ায়, দেওয়াল দখল করতে। দিব্যর ছেলেদের হাতে ধরা পড়ে। খবরটা দিব্যও পেয়েছিল। নির্দেশ দিয়েছিল, ‘ভাঙলে হাত-পা ভাঙিস, মরে যেন না যায়!’ একবার অন্তত ভয় না দেখালে মাথার ওপর নেত্ত করবে ওরা! সৌম্য দিব্য’র দেখা একমাত্র ছেলে যে তত্ত্বে নয় অ্যাকশানে বিশ্বাস করত। রবিবারের পার্টির ক্লাসে গিয়ে সে ঘুমোতো। আর ক্লাস শেষে বলত, ‘এত তত্ত্ব শিখে বই লিখব নাকি! মানুষের কাজ করতে হলে মন তৈরি করতে হয়, থিয়োরি নয়’। ল্যাপটপটা খুলে আজ কভার ফটোটা চেঞ্জ করবে ভাবছে। নিজের নির্বাচনী ব্যনার এসে গেছে। মউ তাড়া দিচ্ছে ওটা আপলোড করতে।

***

ফোনটা অনেক ক্ষণ ধরে ভাইব্রেট করছে। রাপ্পার ফোন। রাপ্পা দিব্যর বাইক ও ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর প্রধান। মিছিলে, বাড়িতে বাড়িতে যাওয়ার সময় এরা থাকে পাশে। পাড়ার লোকে ওদের চেনে। চেনে মানে ভয় পায়। ফলে অভিযোগ থাকলেও ওদের দেখলেই চুপ মেরে যায় ভোটার। না হলে ভোটের আগে পরে বোম বাড়ির দরজায়, এমনকী ভেতরেও পড়তে পারে। আর ওরা পাশে থাকলে সুবিধে। দিব্যকে কথাও কম বলতে হয়। গুঠখা মুখে কথা ওরাই চালিয়ে যায়, ‘কাকু এবারে আমাদের পার্থি, দেবুদা। আপনাদের আসির্বাদ নিতে এসেচে। সক্কাল সক্কাল ভোটটা দিয়ে আসবেন তাহলে’। দিব্য কেবল নমস্কার করে হাসি মুখে। ফোনের ভাইব্রেশনটা থেমে আবার শুরু হয়। কোনো ঝামেলা হল নাকি?

—হ্যাঁ, বল রাপ্পা।

—দাদা, তুমি এখন কোথাও বেরিয়ো না।

—কেন?

—ঝামেলা হবে। ওই মেয়েটা বিশাল মিছিল করছে, ভাটিখানা ঘিরে ফেলেছে। পাড়ার মেয়েদের এনে আগুন লাগাবে বলছে। তাই বলছি তুমি বেরিয়ো না বাড়ি থেকে, কাকু বলে দিয়েছে। আমি আর কাকু সামলে নেব সব!

—কোন মেয়েটা…

উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দেয় রাপ্পা। কাকু মানে কুহুর বাবা। একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবে দিব্য, কোন মেয়েটার কথা বলছিল রাপ্পা! আর্যা?

***

বিকেল পাঁচটায় যখন গাড়িতে উঠল দিব্য তখন খবর এলো ফর্টি পারসেন্ট বার্ন নিয়ে এখনও হাসপাতালের বেডে লড়ে যাচ্ছে আর্যা। বোমটা ওর থেকে হাত সাতেক দূরে পড়লেও সে রক্ষা পায়নি। নিজেকে শক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করে দিব্য। বিরোধী সে। আর ভোটের আগে এসব সামান্য ঝামেলা হয়েই থাকে। মিডিয়া তাদের দিকে আঙুল তুললেও কোনো প্রমাণ নেই কে করেছে। কিছু সাংবাদিক ফোন করেছিল, দুষ্কৃতিদের কাজ বলেই পাশ কাটিয়েছে দিব্য। সভায় যাওয়ার আগে থানায় যাবে। কুহুর বাবাও সঙ্গে যাবে। দাবি জানিয়ে আসবে ভোটের আগে এই সব কার্যকলাপ যেন কড়া হাতে দমন করা হয়। আর দোষীদের শাস্তির দাবিও ওরা জানাবে। তবে আহতদের দেখতে হাসপাতালে যাবে কিনা এখনও ঠিক হয়নি। দলের একাংশের মত, দিব্য হাসপাতালে গেলে প্রাক্তন দল তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবেই। কিন্তু দিব্যর বড়ো ইচ্ছে করছে আর্যাকে দেখতে যেতে। খুব ইচ্ছে করছে চুপ করে তার পাশে গিয়ে বসতে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কুহুও শুনেছে ঘটনাটা। খানিকক্ষণ সকালে পরা শাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল। বেরোবার আগে কুহুর চোখের কোনায় যেন এক ফোঁটা জল দেখল দিব্য।

মাঠ ভরে গেছে। প্রথম জনসভাতেই জনবল দেখাতে হবে। রাপ্পা খুব ব্যস্ত। কে কোন চেয়ারে বসবে তার তদারকি করছে। মঞ্চে কোনো এক ছোটোখাটো নেতা বক্তৃতা দিচ্ছে। দিব্য সকলকে এখনও চিনে উঠতে পারেনি। দিব্যকে দেখে এগিয়ে আসে রাপ্পা। ‘সব ঠিক আছে, দাদা। আমরা সব সামলে নিয়েছি’। হঠাৎ ইচ্ছে হল ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারে ওকে। এই মালটাই বোমটা মেরেছে। তবু নিজেকে সামলে নেয় দিব্য। হাসবার চেষ্টা করে। রাপ্পাকে কাছে টেনে কানে কানে জানতে চায়, ‘মেয়েটা বেঁচে আছে তো?’ মুখের চিবোনো গুঠখা পাশে ফেলে কী একটা বলতে যাচ্ছিল রাপ্পা, ওমনি মঞ্চ থেকে দিব্যকে ডেকে নিলো সভাপতি। মঞ্চ থেকে সমস্ত মাঠটা একবার দেখে নিয়ে শুরু করল দিব্য।

–আজ খুব খারাপ সময় এসেছে। খুন হচ্ছেন আমার কমরেডরা, আজও সকালে বোম মেরেছে ওরা। আমি এর বিচার চাই। আপনারা চান না?

সমস্ত মাঠ হঠাৎ চুপ করে যায়। দিব্যও। এসব কী বলছে সে? মাইকে কেবল তার নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। স্বপন ঘোষ খানিক বিব্রত হয়েও দ্রুত মাইক নিয়ে নেয় দিব্যর হাত থেকে। তারপর নিজেই বলতে শুরু করে, ‘হা হা হা, পুরোনো অভ্যেস তো, এখনও তাই…’ কে যেন একটা বুম মঞ্চের দিকে তুলে প্রশ্ন করল, ‘খুনটা কে করেছে দিব্যদা?’

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment