জিৎ মুখোপাধ্যায়

দ্রষ্টা

লিখতে না পারার ভেতর একটা চিলেকোঠা আছে। লেখকের উদ্‌ভ্রান্ত মন তখন অনন্ত শূন্যের ভেতর ভাসতে থাকা ওই চিলেকোঠায় একা বসে থাকে। লেখক হয়তো সেইসময় সকালবেলা চা খেতে খেতে একবার রোদ্দূরের দিকে তাকালেন। দু’-একবার গাছপালার রঙ পেরিয়ে, আরও দূরে যেতে চাইল তাঁর চোখ। বাইরের আলতো হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘরদোর। প্রাত্যহিক কাজকর্মও নিয়ম মেনে গড়িয়ে চলেছে। কিন্তু মন? মন বসে আছে, সেই নির্জন ঘরে। অন্যমনস্ক। কখনো আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ভাবছে: ‘আর কোনোদিন একলাইনও লেখা হবে?’ দূর থেকে কখনো দেখা যায়, লেখক নামছেন ট্রাম থেকে। কাউকে হাত নেড়ে বলার চেষ্টা করছেন: ‘হ্যাঁ, কাল বা পরশু দেখা হচ্ছে’। সশব্দে ব্রেক কষল একটা বাস। মন তখনও সেই নিজস্ব চিলেকোঠায়, নাকি বুরুজে—ঠায় বসে আছে। 

     নিঃসঙ্গ। নির্মম সেই অপেক্ষা। 

     এইসব সময় একটা লাইন পেতে দৈব অনুগ্রহের কাছে দ্বিধাহীন মাথা খুঁড়ে মরে যেতে হয়! 

     এইসবই সাতপাঁচ ভাবছিলাম বুদ্ধদেব বসুর গদ্যসন্দর্ভ ‘কবিতা ও আমার জীবন’ পড়ে। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। প্রায় উপার্জনহীন। স্বাস্থ্যে ধরছে ভাঙন। তবে কবির হৃদয়ে স্বাস্থ্য কবে আর নিজের নিশান উড়িয়েছে! জয়সূচক রানটি নিতে পেরেছে! চিন্তা স্বাস্থ্য নিয়ে নয়। আদতে তাঁর ভাবনা: ‘সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছি যেহেতু কবিতা আমাকে পরিত্যাগ করেছে।’ তবে গদ্য লেখা হচ্ছে: ‘রোজ দু-এক পৃষ্ঠা…অপরিসীম অনিচ্ছা ঠেলে, অনপনেয় ব্যর্থতাবোধে পিষ্ট হতে-হতে’। দূর থেকে লক্ষ করি, এই ‘অপরিসীম’ শব্দটি। ভারাক্রান্ত মনের সব জোর যেন, এই শব্দে এসে ডুবে গেছে! ভিতরকার সার্মথ্য হয়তো ভাঙছে। কিন্তু মনীষা আর অন্তর্দৃষ্টি, এখনও শাশ্বত, কেননা ‘অনপনেয় ব্যর্থতাবোধে পিষ্ট হতে-হতে’ গদ্য লেখা যাচ্ছে ‘রোজ দু-এক পৃষ্ঠা’। তাছাড়া উপার্জন না থাকাও, তখন তাঁর জীবনে নানা সংকট ঘনিয়ে তুলেছে। 

    বুদ্ধদেব বসু চিরকালীন এক সম্পাদক। তাই এইসব প্রেক্ষিতে কবিতা পত্রিকার সেই সময়ের সংখ্যাগুলি একবার মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। বুদ্ধদেব বসুর বয়স যখন চল্লিশ, অর্থাৎ ১৯৪৮সালে কবিতা পত্রিকার ত্রয়োদশ বছর। কবিতা পত্রিকার আষাঢ় ১৩৫৫ (বর্ষ ১৩, সংখ্যা ৪) বঙ্গাব্দের সম্পদকীয়তে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন : ‘দেশের দুঃসময়ে প্রথমে মরে তারা, যারা মনের খিদে মেটায়। ‘কবিতা’র সংসারে অকুলান ঘটতে-ঘটতে এখন অসম্ভবের কাছাকাছি এসেছে।’ আশ্বিন-পৌষ যুগ্ম সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত (বর্ষ ১৫, সংখ্যা ১) ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের সম্পাদকীয়র প্রথম লাইনটি ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া: ‘কবিতা’ বন্ধ হ’তে হ’তেও হ’লো না। সভাস্থল থেকে হঠাৎ অপসৃত হওয়া অশোভন, যাবার মুখে একটা নমস্কারের নিয়ম আছে।’ পত্রিকা চালাতে গিয়ে আর্থিক টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা থেকেই ১৯৫৩ সালে লেখা ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে তাঁকে বলতে হয়েছিল : ‘লিটল ম্যাগাজিন ব্যবসা হিসেবে অচল, তাকে চালাতে হলে আর্থিক অপব্যয়ের শক্তি চাই’। কবিতা পত্রিকা অবশ্য বেঁচে গিয়েছিল। কেননা অর্থ না থাকলেও ‘বন্ধুবল ছিল, আর ছিল সম্পাদকের পূর্ববঙ্গীয় গোঁয়ার্তুমি’। আর্থিক কষ্টের এই সমস্যা বুদ্ধদেব বসুকে তাড়া করে ফিরেছিল অনেকদিন। ১৯ অক্টোবর ১৯৫১ সালে চাইবাসা থেকে নরেশ গুহকে এক চিঠিতেও জানিয়েছিলেন, বাড়িতে বসে বি.এ পরীক্ষার্থী ছাত্রছাত্রী পড়াতে চান। কেননা যদি সাহিত্যে ফেরা না হয়, তাহলে তাঁর ‘সুখ শান্তি স্বাস্থ্য কিছুই হবে না—তার জন্য যে-কোনো উপায় বরেণ্য!…’। 

    কবিতা লেখা এইসময় প্রায় বন্ধ। ১৯৪৮ সালে মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল কবিতার বই : দ্রৌপদীর শাড়ি। আর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে : শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর। এই মধ্যবর্তী বছরগুলিতে উপন্যাস-প্রবন্ধ বা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হলেও, তাঁর কবিতার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এ-প্রসঙ্গে এতদূর বলা চলে, কবিতা পত্রিকার আশ্বিন ১৩৫৫ থেকে বৈশাখ ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত পরপর সাতটি সংখ্যায়, বোদলেয়ার, চীনে কবিতার অনুবাদ বা অপরাপর গদ্যরচনা থাকলেও, মাত্র একটি সংখ্যাতে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ছিল। লক্ষ করে দেখেছি, শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর  বইয়ের রচনাকাল ১৯৪০-৫৪ হলেও এই বইয়ের কবিতাগুলির রচনাতারিখের ভেতর কোথাও একান্ন ও বাহান্ন সালে লেখা কবিতা নেই। রয়েছে আটচল্লিশ সালে লেখা মাত্র তিনটি কবিতা: ‘এও তার’, ‘আকাশ-পাতাল’ আর ‘৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮’। বুঝতে পারি, দীর্ঘদিন বুদ্ধদেব বসু কবিতা লেখেননি। লিখে থাকলেও তা প্রকাশ করেননি। এ-এমন এক সময়, যখন খাতার পৃষ্ঠায় : ‘কাটাকুটি ছাড়া অন্য কিছুই ফলিত হয় না’। তবে এর মধ্যে শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর  বইয়ের ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ ছিল তাঁর জীবনের শেষ কবিতা, যেটা তিনি ‘তোড়ে’ লিখেছিলেন। যে লেখার সূচনা এইরকম: ‘এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থ্যের ভাবনা,/ এর পর কী হবে, এর পর,/ ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ।’ এই শব্দগুলির আবরণের ভেতর মরিয়া হয়ে ওঠা আছে। আছে অসহয়তার মুখচ্ছবি।

       কখন লিখেছিলেন এই কবিতা? 

    জীবনে প্রথম দেশান্তরে এসেছেন। পিটসবার্গ। ১৯৫৩ সাল। এখানে ‘কবিতাভবন’-এর আড্ডা নেই। নিদারুণ নির্বান্ধব। দিনের বেলাটা পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেন্স-এ অধ্যাপনা আর নানা কাজকর্মে কেটে গেলেও, ঘরে ফিরে আসার পর, ডিসেম্বরের শীতল রাত বড় যন্ত্রণার। তাছাড়া বাড়ির তাপযন্ত্রটিও দূর্বল। তাই মনে হয়: ‘এই ঠান্ডা লম্বা রক্ত-জমানো রাত্তিরটাকে কেমন করে কাটাবো? …আমার কানে আসে নেকড়ের চিৎকার, ডাইনির হুল্লোড়, উত্তরমেরুর বাতাসের দল যেন জগৎটাকে ছিঁড়ে ফেলছে… আমার নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতাবোধ…শীতের মধ্য থেকে অতর্কিতে একটি ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ বেরিয়ে এসেছিল।’ এই কথাগুলোর সঙ্গে ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ মিলিয়ে পড়লে আমাদের মনে পড়তে পারে কয়েকটা পঙ্‌ক্তি: ‘…বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীৎকারের মতো হাওয়া;/অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ;/আজ আর কিছু নেই তোমার—।’

    পরের বছর কলকাতায় ফিরে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে দেখা হতে, তিনি জানালেন ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ ভালো লাগার কথা। কিন্তু ততদিনে বুদ্ধদেব বসু বুঝে নিয়েছেন, তিনি আর ফিরবেন না ‘পুরোনো ধরনে’। এখন তাঁর উপলব্ধি: ‘আমাকে ছেড়ে দিতে হবে সরলতার পথ; বলতে হবে উক্তির বদলে চিত্রকল্প দিয়ে, ঘোষণার বদলে ছবির সাহায্যে’। এখান থেকে শুরু হল পরের কবিতাবই যে আঁধার আলোর অধিক লেখার পথ। যেখানে আছে নশ্বরের আর্তি। এখন কবিতা লেখেন আর শব্দ বদলান মনে মনে। কয়েকটা পঙ্‌ক্তি পূর্ণভাবে মনে তৈরি না হলে, লিপিবদ্ধ করেন না। কখনো একটা উপযুক্ত মিল খুঁজতে বেলা অতিবাহিত হয়। এবার আশ্রয় নিলেন সনেটের শৃঙ্খলে: ‘লিখতে হলো ভেবে-ভেবে, থেমে-থেমে, কাটাকুটির জঙ্গল পেরিয়ে’। ১৯৫৪-৫৮ সাল। চার বছর ধরে হয়ে উঠল যে আঁধার আলোর অধিক। বলতে পারলেন : ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত’ (‘রাত তিনটের সনেট : ১’)। কাটিয়ে উঠলেন কবিতা লিখতে না পারার সংকট। এই যাত্রাপথে কেবল কবিতার ‘কলাকৌশল’ শিখলেন না, জানলেন ‘অন্তরাত্মা বিষয়েও’। তিনি তাই দ্রষ্টা। আজও নিপুণতম শিল্পী। ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারি নরেশ গুহকে এক চিঠিতে বুদ্ধদেব লিখেছিলেন: ‘শিল্পী হওয়া সহজ না, নরেশ; অনেক দুঃখের জন্য তৈরি হতে হয়। ধ’রে নিতে হবে যে, কেউ তোমার কথা শুনবে না, সমস্ত পৃথিবী তোমার বিরুদ্ধে, কিংবা উদাসীন; আর তার পরেও যাঁর কলম চলে, তাঁকেই বলবো শিল্পী, স্রষ্টা।’ 

   তাই লিখতে না পারার ভেতর যে চিলেকোঠা রয়েছে, তা অলঙ্ঘ্য নয়। যা পেরিয়ে নীল বিদ্যুৎরেখা ক্রমশ দিগন্তের দিকে প্রসারিত। তার সামনে তারাভরা উষ্ণীষ। তখন বুদ্ধদেব বসুর মতো বলতে পারা যায়: ‘কবিরা ভাগ্যবান, তারা অজানার উদ্দেশ্যে বলতে পারেন’। 

 কৃতজ্ঞতা: নরেশ গুহ। জয় গোস্বামী

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment