রাজদীপ রায়

খুকি ও তার ভূতেরা

‘খুকু’ দেবারতি মিত্রের ডাকনাম। এ-তথ্য জানা গিয়েছে তাঁর ছোটবোন দেবার্চনা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তায়। নিজের দিদির সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে দেবার্চনা জানাচ্ছেন: “…ওর ডাকনাম খুকু, তা কিন্তু শুধু বাবা-মায়ের কাছে নয়, বিশ্বজগতের কাছেও তাই। আমিও ওকে খুকু-ই বলি। আমাদের ভাইজিরাও এমনকী ওকে খুকু বলে। আজকের মানুষেরা নিজেকে প্রোজেক্ট করতে চায়, ও ঠিক উলটো।” ছোটবেলা থেকেই, থমকে যাওয়া, আত্মবিশ্বাসহীন, রক্তমাংসের দেবারতিকে এই কথাবার্তায় দেবার্চনা যে নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে উপস্থাপনা করেছেন, দেবারতির কবিতা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তা অপরিহার্য সহায়ক হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। যদিও আপাতত এই নিবন্ধের মুখপাতে দেবারতির ডাকনাম সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই। শৈশব থেকে বহন করে চলা একটি ডাকনাম, আদরে, অবহেলায় ঠোক্কর খেতে খেতে কবির ব্যক্তিগত ও অনিবার্য মোটিফে পরিণত হচ্ছে ‘ভূতেরা ও খুকি’ কবিতা লেখবার পর। আরও সুনির্দিষ্টভাবে সেই কাব্যজগতের কূট প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ১৯৮৮-এ এসে, যখন এই নামেই পূর্ণাঙ্গ কবিতাবই বেরোচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। উত্সর্গপত্রে নাম রয়েছে দেবারতির মাসি গায়িকা কেতকী ঘোষের নাম। খুকু এখানে সামান্য পরিবর্তনে ‘খুকি’। শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা অংশ মামাবাড়িতে কাটানো দেবারতির জীবনের শেষদিন পর্যন্ত, গানের প্রতি যে আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল, তা এই মাসির কারণেই। এই মাসির সম্পর্কে অনেক কথা দেবারতির ব্যক্তিগত লেখালিখিতে, সাক্ষাত্‍কারে পাওয়া যায়। এই উত্সর্গ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই—দেবারতি মিত্রের মাসুরও কোনও সন্তান ছিল না। বিয়ের তেরো বছরের মাথায় প্রকাশিত এই বইয়ের অলৌকিক, মরবিড জগত্‍ আক্ষরিক অর্থেই দেবারতির সন্তানহীনতার দুঃখে ভরপুর। তাঁর জীবনসঙ্গী মণীন্দ্র গুপ্ত ‘দেবারতি মিত্রের এখনকার লেখা’ শীর্ষক আলোচনায় দেখিয়েছেন, সন্তানহীনতার মনোকষ্ট কীভাবে তাঁর একসময়ের মনোজগত্‍কে অধিকার করেছে। “সে কবিতার কঠোর ভাষা ও রুষ্ট আর্তনাদ যুবতীর অভিশাপের মতো শোনায়”—লিখছেন মণীন্দ্র গুপ্ত ওই লেখায়। তার মানে যে উদ্ভিন্ন যৌবনের নিঃসঙ্গতা দিয়ে শুরু হয়েছিল দেবারতির নারীত্ব, সেই নমনীয় ভাষা থেকে সরে আসছেন দেবারতি এই বিশেষ পর্যায়ের লেখাগুলির ক্ষেত্রে। ভাষা–কঠোর হচ্ছে, কবিতার বিষয়ের কারণে। কিন্তু বিষয়ের এই পরিবর্তন কেন? পুরোনো বই থেকে কাব্যভাষা আলাদা করতে হবে বলে? নাকি জীবনের অন্তর্গত ক্রূর অভিশাপে, সম্পর্কের অস্থির না-পাওয়ার মধ্যে এমন এক অভিজ্ঞতা, যাকে দেবারতি মর্মে-মর্মে অনুভব করতে চেয়েছেন, কিন্তু পাননি—সেই সন্তানহীনতার কারণেই কি এই অনিবার্য প্রস্থান? বিবাহ-উত্তীর্ণ ‘খুকি’-র মধ্যে যে অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দেবারতি রেখেছেন, তাঁর অপরিণত পরিণতির সাপেক্ষে এই সিদ্ধান্তে বা অনুভবে তাঁকে উপনীত হতে হয়েছিল, এহেন পৃথিবীতে কোনও স্বাভাবিক জীবিত এনটিটির পক্ষে তাকে আর বুঝে ওঠা সম্ভবপর নয়। একারণেই ‘ভূতেরা ও খুকি’ এত কঠোর, নির্মম, দমচাপা এবং রুষ্ট আর্তনাদে ভরা। এমনকী সেই আর্তনাদ বিবর্তিত হচ্ছে একজন যুবতীর অভিশাপে। তাহলে, আগের বইগুলির মতো এই বইটিও কি তুমুলভাবে আত্মজৈবনিক? এই প্রশ্নের একদিকের জোরালো উত্তর যেমন হবে হ্যাঁ; তেমনি অন্যদিকে আবার এই নিশ্চিত উত্তরকে সংশয়ের মধ্যে ফেলতে পারে এই গ্রন্থজগতের মধ্যে থাকা পরিবেশ এবং চরিত্র। এইসমস্ত ঘটনা তো সরাসরি দেবারতির জীবনে আসেনি, তাহলে যে-দেবারতি জীবন-নিষিক্ত করেই কবিতা লিখে এসেছেন এতকাল, তিনি এই কবিতাগুলি লেখবার সময় কোন মনোজগতের মধ্যে প্রবেশ করলেন? সেই যুবতীর অভিশাপ বাংলা কবিতার মধ্যে কী কী বিস্ময় নির্দিষ্ট করে দিল সেকথা তাকে সবচেয়ে কাছ-থেকে-দেখা মানুষটি ব্যাখ্যা করছেন। এবং তিনি এখানে যেমন একজন কবিতার আলোচক, তেমনিই দেবারতির স্বামী হিসেবে বয়াননির্মাতা। মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন, “প্রথম দিকে অজাত সন্তানকে নিয়ে আশায় ও রোমাঞ্চে বিভোর কবিতা লিখেছে। পরের পর্যায়ে লিখেছে সন্তানহীনার মনোকষ্টের কথা।” দেবারতির আকাঙ্ক্ষিত মাতৃসত্তাকে এই দুটি ব্যাবচ্ছেদ যার মধ্যে সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরার সংযোগ রয়েছেই। এবং এখানেই ‘ভূতেরা ও খুকি’-র কাব্যবীজ প্রোথিত রয়েছে বলে মনে হয়।

বইয়ের শুরুর কবিতাই জনৈক কোনও এক পাহাড়ি রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার চিত্রকল্পে প্রস্তুত। যেন একেবারে বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে এই কবিতাটি নির্বাচন করা হয়েছে বইটির সঙ্গত আবহ নির্মাণের জন্য। চিলাপাতা জঙ্গলে কালভার্টে ধাক্কা খেয়ে পালটি খেয়ে যাওয়া গাড়ির হতভাগ্য পরিণতির সূত্র ধরে ‘ঘাসের মায়ের বাড়ি পৌঁছে থেমে গেছে / বিকেলের শেষে’। সূর্যাস্তের এই আনক্যানি অশুভের সূত্রপাতের মধ্যে দিয়ে দেবারতি ‘একটি তারার থেকে আরেকটি তারার ঘনিষ্টতা’-র উপাখ্যান বুনতে শুরু করলেন। ‘কী রয়েছে অন্ধকারে তারপর?’—এই প্রশ্ন শুধু এই কবিতারই নয়—সামগ্রিক বইয়ের। অশুভের উপাখ্যানের তার তখনই বেঁধে দেওয়া হয়, যখন ‘ভূতেরা ও খুকি’ কবিতার ক্রূর নির্মমতা প্রকাশ্যে এল। রূপকথার ছলে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শুরু হওয়া এই কবিতা ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যায় অসহ্য এক নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে।

ভূতের সঙ্গী এসে বলেছিল, চলো শেষরাতে,
ওখানে গাছের নীচে
ফুল কুড়বার সাদা নদী,
খরগোশের মতো মেঘ,
হাওয়া হই যদি
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নরম বোঁটার রসে রাঙা
হাত পা চালিয়ে দেবে গায়ের মধ্যে দিয়ে
তাদের মজার খেলা আমাদের ভাঙা।

খরগোশের মতো নরম মেঘ, হাওয়া দিয়ে তৈরি এইসব সন্তানেরা এর-ওর শরীরে হাত-পা চালিয়ে খেলে। নরম বোঁটার রসে রাঙা ছেলেমেয়েদের পাননি দেবারতি। সেই অভিমান ‘আঙুলপ্রমাণ’ এক মেয়ের জন্ম দেয়, যাকে কেউ ফেলে দিয়ে গেছে অনাদরে। সেই মেয়ের সম্পর্কে কী বলছেন দেবারতি?

আগে আমি লম্বা ছিলাম,
বাঁশের কোঁড়ের মতো শাড়ি পরতাম,
তারপর অচেনা অসুখে খুব ছোট হয়ে গেছি
তাই আমি ফ্রক পরি।
গালে ঠোঁটে ফুটো
গলায় পুঁতির দাগ পুতুল মেয়েটি
সেই ভূতেদের কাছে চুপিচুপি বলেছিল।

খুকির বিবরণ দিতে গিয়ে তার যায়গায় নিজের আত্মকে প্রতিস্থাপিত করছেন দেবারতি অনিবার্য ঘোষণার মতো। এই যে মেয়ের কথা নৈর্ব্যক্তিক বয়ানে বলছিলেন, তাকে আর নিজের থেকে আলাদা রাখতে পারলেন না বলেই কি নৈর্ব্যক্তিকতা সরিয়ে দেবারতি ওই মেয়েটির বয়ান নিজের করে তুললেন? আগে লম্বা, শাড়ি পড়া মেয়েটি পরে অজানা অসুখে ছোট হয়ে গেছে (বুড়ো আংলা?) তাই বিপ্রতীপে হাঁটা তার সেই অপুষ্ট শরীরে শাড়ি আর ধরে না। ঋতুমতী হবার বদলে তার ঋতু পিছিয়ে যায়। গালে ও ঠোঁটে ফুটো সরাসরি লিঙ্গ রাজনীতির কথা বলে। এই হাহাকার দেবারতির নারীত্বের পূর্ণ না-হওয়ার বেদনা। যে পূর্ণতার কথা তাঁর স্বামী মণীন্দ্র গুপ্ত বুঝেছিলেন বলেই লিখেছিলেন: “…কিন্তু হায়, যে মেয়ের মন এইরকম আগ্রহী আর শরীর ভিনাস অফ উইলেনদর্ফের মতো উর্বরতার প্রতিমূর্তি সত্যিকারের জীবনটা তাকে নিঃসন্তান হয়ে কাটাতে হল।” পুরুষ হিসেবে দেবারতি সবচেয়ে যাঁকে ভরসা করেছেন, সেই মণীন্দ্র গুপ্তই তামাম সেইসমস্ত পুরুষের প্রতিনিধি হয়ে মুখচোরা দেবারতির দমিত অতীতের বাস্তবকে এইভাবে রেখে যাচ্ছেন দেবারতির কাব্যজগতের প্রবেশক হিসেবে। এই ‘হায়’-অব্যয়ের প্রয়োগ একজন আলোচকের নয়, দেবারতির মর্মসঙ্গী মণীন্দ্র গুপ্তের। এবং ওই অনন্বয়ী অব্যয়টি দেবারতির পূর্ণ নারীত্বের অপূর্ণত্বের দিকনির্দেশক অব্যর্থ কয়েনেজ।

‘ভূতেরা ও খুকি’-র প্রসঙ্গে ‘হারামণি’ কবিতাটির নামও অবশ্যম্ভাবী মনে আসে। এখানেও একটি মেয়ের অপমৃত্যুর কথা দেবারতি বলেছেন। ধূপের ধোঁয়ার মতো শোকজাত ও বিষণ্ণ দ্বিতীয়ার চাঁদ যা অমাবস্যার পরেই সরু ফালির মতো আকাশে দেখা যায়; অর্থাত্‍ প্রায় নেই বললেই চলে। এই অপসৃয়মান চাঁদের মোটিফ দিয়েই কবিতার নান্দী প্রস্তুত করছেন দেবারতি। এক মৃত মেয়ের জবানি শুরু হবেই একটু পরে; তারই কথামুখ বলে দিচ্ছে ওই মৃদু চাঁদের অপসৃয়মান অস্তিত্ব।

ধূপের ধোঁয়ার মতো দ্বিতীয়ার চাঁদ যেই
তাড়াতাড়ি মুছে যায় পড়ন্ত বিকেলে
মৃত মেয়ে এসে বলল:

এরপর কবিতার কাহিনিকূট নিয়ে যায় হতভাগ্য এক মেয়ের মর্মান্তিক পরিণতির দিকে, যার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে দেবারতির কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তবুও কখনো এমন মানসিক স্থিতি আসে, যখন আশেপাশে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে বিশেষ কিছুকে আর আলাদা বলে মনে হয় না। নিজের অত্যন্ত এই ব্যক্তিগত বই সম্পর্কে ‘শিলাদিত্য’-পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাত্কারে দেবারতি জানিয়েছিলেন: “…’ভূতেরা ও খুকি’ লেখবার সময় আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দুঃখগুলি আমাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছিল। নিজের অকৃতার্থতা, বিফলতা, সন্তানহীনতা আমাকে অত্যন্ত চঞ্চল করে তুলেছিল। সেই প্রতিকারহীন দুঃসহ জগতে অন্য কারোর প্রবেশাধিকার ছিল না; তাই স্বভাবতই পাঠকের কথা আমার মনে পড়েনি।” পাঠকের কথা না-ভেবে শুধু নিজের উপশমের জন্যেই লেখা এই বই যে-তিনটি বিশেষ কারণের ফল, সে তো দেবারতি নিজেই জানিয়েছেন। অকৃতার্থতা, বিফলতা বলতে কী, ভেঙে না-বললেও এর সঙ্গে দেবারতির বিবাহ-পূর্ব জীবনের যে যোগ আছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সম্পন্ন, ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশা পূরণ করতে না-পারার দীর্ঘস্থায়ী বেদনাবোধ সমস্ত জীবনই তাঁকে তাড়িত করেছে। বিফলতা—শব্দের মধ্যে যেমন আছে পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি অর্জনের ব্যর্থতা, তেমনি বিবাহিত জীবনে সন্তানধারণের অপূর্ণতাও তাঁর মাতৃচেতনাকে বিফল করেছে। কিন্তু যেটা লক্ষ করবার, অকৃতার্থতা, বিফলতার পরেও সরাসরি সন্তানহীনতার কথা বলে ফেলছেন দেবারতি। এমনকী এও বলছেন ‘প্রতিকারহীন’ সেই দুঃসহ জগতে কারোর প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনি কাউকে প্রবেশাধিকার দেননি। মণীন্দ্র গুপ্তকেও না। এতটাই ব্যক্তিগত সেই জগতের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা আর গভীরতা—তার অতলে কেউ পৌছতে পারেনি। মণীন্দ্র গুপ্তের মতো সংবেদনশীল মানুষ সেই কষ্টের স্বরূপ না-বুঝতে পারলেও, তাকে অনুভব করতে কি পারেননি একেবারে? পেরেছিলেন বলেই নিজের নৈর্ব্যক্তিক সমালোচক সত্তা ভেঙে ওই একবারের জন্যে তাঁকে ‘হায়’ অব্যয়টি উচ্চারণ করতে হয়েছিল।

ফিরে আসা যাক ‘হারামণি’-তে। অস্তিত্ব-বিলীন-প্রায়, এমন এক পড়ন্ত বিকেলে মৃত এক মেয়ে এসে বলছে তার হত্যার বিবরণী। কতদিন আগে, ইট চাপা দিয়ে থেঁতো করে, ফুলের টবের মধ্যে পুঁতে রেখেছিল। সেই নৃশংস মৃত্যুর পরেও কষ্ট থেকে তার মুক্তি হয়নি। ছাদের ট্যাংকের জলের মধ্যে অদৃশ্য জীবাণু হয়ে( জীবাণুর অস্তিত্ব মানুষের চোখে না-এলেও তা আছে। এটাই দেখবার, দেবারতির নিজেকে এই সমাজ, সামাজিকতা, লোকজন থেকে সরিয়ে রাখবার প্রাণনা এখানে ওই মেয়েটির এইভাবে অদৃশ্য অস্তিত্বের জন্ম দিচ্ছে।) সে কেন রয়ে গেছে একা, নিজেও জানে না।

আজ কতদিন আগে ইট চাপা দিয়ে থেঁতো করে
ফুলের টবের মধ্যে কে আমাকে রেখেছিল পুঁতে,
ছাদের ট্যাংকের জলে অদৃশ্য জীবাণু হয়ে
আমি কেন রয়ে গেছি একা,

ফলে এই মেয়ের কষে যাওয়া অঙ্ক যেমন মিলবে না, তেমনি দেবারতিও তাঁর জীবনে সাফল্যের অঙ্ক মেলাতে পারেননি। এরপরে সেই ভূতের ছায়ার সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলে যাওয়ার নির্মম বাত্সল্যরসের দৃশ্য নিষ্ফল জীবনের যে হাহারব মূর্ত করে, তা দেবারতির নিজস্ব বাগানেরই দীর্ঘনিশ্বাস। সেই ছোট্ট মেয়ের ভূত যখন প্রশ্ন তুলেছে, তখন উত্তর দেওয়ার জন্যে কাউকে পায়নি সে। ছায়ার নামতা শিখে, ছায়ার সঙ্গে এক-দুই-তিন গুণ করে কেন তাকে সারদিন একা কাটাতে হচ্ছে, কেন তার একাকিত্ব-মোচনের জন্যে কেউ উপস্থিত নেই—এই প্রশ্নের পরেই এক বাতাবিলেবুর গাছ ‘আঁধারের বুক ফেটে’( সীতাকে উদ্ধার করতে আসা পৃথিবী-মা? সীতাকে যিনি অপমানের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে ওপর এক অন্ধকার(ভূ-গর্ভ)-এ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যেখানে এই অপমানের জ্বালা আর তাকে সহ্য করতে হবে না।) একফোঁটা জোনাকির মতো ওই প্রাণকে নিজের মধ্যে মাতৃস্নেহের অন্ধকারের আলোয় টেনে নিচ্ছে। কেননা পরে যে সূর্যোদয় হবে, সেই তাপ এই সূক্ষ্ম-শরীরী মেয়েটির সহ্য হবে না। ‘পাতার আড়াল’—সেই মায়ের নিভৃতি, যেখানে সন্তান পরম আনন্দ বোধ করে বলে দেবারতি মনে করেছেন মা-হিসেবে, একইসঙ্গে সন্তান হিসেবেও।

Oxford Advance learrner’s Dictionary-র মতে ভূত হল—“the spirit of a dead person that a living person believes they can see or hear”। এখন, ভূতের এই সর্বজনবোধ্য অর্থ দেওয়ার একটাই কারণ, ভূতের ব্যাখ্যা দেওয়া নয়, বরং এটা মনে করিয়ে দেওয়া, ভূতের অস্তিত্ব নির্ভর করে বিশ্বাসীর দৃষ্টিতে। অর্থাত্‍ বিশ্বাসী যা দেখতে চায়, দেখে বিশ্বাস করতে চায়। এই বিশ্বাসীর মন দেবারতি পেয়েছিলেন ছেলেবেলায় মামাবাড়ি সূত্রে পাওয়া বৈদান্তিক দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে। এমনকী ঐশী মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গেও ছিল উপনিষদ নিয়ে চর্চা। ঈশ্বরের প্রতি স্থির বিশ্বাসের মন থেকেই এই ভূতের জন্ম। দেবারতির ‘ভূত’ অবশ্যই কোনও আতঙ্ক তৈরি করে না। ঘাড়-মটকায় না, গলা টিপে ধরে না। বরং সেই ভূত সমাজে মানসিকভাবে একাকী, অন্তর্মুখী, জনবিরল, প্রান্তিকদের প্রতিনিধি হয়ে কষ্ট সহ্য করে, অতৃপ্ত বাসনার আখ্যান শোনায়, অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। সেকারণে এইসব ভূতেদের নিয়ে দেবারতি যে নিজস্ব হাওয়ামহল বানিয়ে তুলেছেন, তার প্রতিটি অশরীরী ইষ্টকে–প্রতিহিংসা নয়, আসমুদ্র অভিমান বহমান। সেই অভিমানে দেবারতি ফালাফালা হতে হতে লেখেন: “নিষ্ফলা তীরের ফাটা মাটি/ ওলটপালট করে পাগলের মতো/ দুঃখস্বপ্নচারী হাওয়া কাঁপে বলে যায়–/ অন্তিম লুপ্তির টানে নেমে আয়,/ ও অপয়া নারী।” নিজেকে কাউন্টার করে লেখা এই কবিতার কাল কাকভোর, ধোঁয়াওঠা কুয়াশার মতো নদীর কাছে পৌঁছে দেখা যায়—“ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে শবদেহ/ মাথার ফোঁপরা খুলি–/ তাতে রত্ন: মায়ের অনন্ত বৃষ্টিধারা।” কোনও সন্দেহ নেই, দেবারতি মিত্রের কবিজীবনের অন্যতম বড় ডার্ক ফেজকে ধারণ করে রেখেছে এইসমস্ত বীভত্স রসের চিত্রকল্প। মৃত এইসমস্ত সন্তানেরা তাঁর নিজের অজাত শিশু—এবং তারা উপযুক্ত মাতৃযোনি পায়নি বলেই স্নেহের অভাবে এত ছিন্নভিন্ন—একটেরে—রক্তাক্ত। অকালমৃত সন্তান-কল্প শিশুদের নিয়ে দেবারতি কিছুই করতে পারেন না। বরং নিজের ব্যক্তিগত বাস্তব, অপরের ব্যক্তিগত সমাজবাস্তবকে ইন্দ্রিয়-বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে সমান্তরাল কল্পনার বাস্তব নির্মাণ করতে পারেন। ‘ভূতেরা ও খুকি’-র আরেকটি কবিতা ‘উত্সর্গপত্র’। এই কবিতা নিয়ে অনুষ্টুপ পত্রিকায়(২০০৪) নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে দেবারতি লিখেছিলেন:

“যখন কান দেখতে পায়, চোখ শুনতে পায়, মাথা দিয়ে মানুষ স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে, হাতের আঙুল ভাবতে পারে, এতটা বলছি না, তবে আর কাছাকাছি একটা ওলটপালট হলে তখন কবিতার জন্ম হয়। ইন্দ্রিয়েরা নিজের স্বভাব ভুলে অভূতপূর্ব উন্মাদনায় মেতে ওঠে, বিশেষ কোনো ঘটনা, উদগ্রীব আনন্দ, ধূ ধূ শোক, বিরল প্রেমানুভূতি, অসমাপ্ত স্বপ্নদৃশ্য, যা হোক কিছু তার ইন্ধন হয়ে সৃষ্টির উন্মুখ আবহাওয়ায় কবিকে প্রাণিত করে তোলে।”

সবসময় কবির এই মনোগত ওলটপালট কোনো তত্ত্ব বা সবিশেষ পূর্ণাঙ্গ কোনো সামাজিকতার অনুশাসনে চলবে, এমনটা নাও হতে পারে। যে সমাজবোধ দেবারতির কাছে অল্পবয়স থেকেই অথৈ সমুদ্র হয়ে দেখা দিয়েছিল, তাকে একমাত্র কবিমন দিয়েই যুঝে ওঠবার বাসনা নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন কবিতার অবলম্বনে। সরাসরি ভূতুরে অস্তিত্বের কথা ‘ফুল গাছে যক’, ‘সুরঞ্জনের ভাই’, ‘সতিন’ কবিতায় উঠে এসেছে উপকথা ও লোককথার ধরণে। এখানেও ওই ভূতুরে সত্তাদের মধ্যে সাধারণ ধর্ম একটিই, এঁরা এক অর্থে প্রান্তিক, যে-অর্থে দেবারতি নিজে প্রান্তিক। সুধীর বামুনের ভূত, সাতষট্টি বছরে মারা গিয়েও উপনিবেশ আক্রান্ত জনপদের মায়া ভুলতে পারেন না। কাঞ্চন গাছে তিনি রয়ে গেছেন কেন? আসলে তিনি নন, তাঁর অতীত, মৌখিক ইতিহাসের অলিগলি উঠে আসবে এই কবিতায়। কিন্তু অবাক লাগে এই ভেবে, চারটি স্তবকে বিভক্ত কবিতার প্রথম তিনটি স্তবকের নৈর্ব্যক্তিকতা ভেদ করে দেবারতির আত্মস্বর প্রবেশ করছে শেষ স্তবকে:

যদি মিশতে পারতাম,
যদি ঝরতে পারতাম ওদের বিষ্টিতে কোনোদিন।
সাতষট্টি বছরের পরে আর এখন বছর নেই,
তবু লোভ, শুধু লোভ ঐ কাঞ্চন ফুলের গাছ
থোপাথোপা সাদা, বোধ হয় জন্মেরও আগে,
মনে আসতে গিয়ে আসতে চায় না—
অমনি ছিল আমার মা।
বলিসনি, কাঞ্চন গাছ ছাড়তে বলিসনি আমাকে।

জীবনের প্রতি অপরিসীম মায়া দেবারতির স্বভাব এবং তাঁর কবিতাজগতের অন্যতম ভিত্তি। শরীরীভাবে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মা-হতে পারেননি বলেই যেন জন্ম দেওয়ার যোনিজ বাসনা এভাবে সর্বত্রগামী হতে চেয়েছে। ‘সুরঞ্জনের ভাই’ কবিতার কাহিনিকূট আবার এক মৃত সন্তানের কথা বলে; শুধু তাই নয়—বলে টান-ভালোবাসার কথাও। বাংলা কবিতায় এহেন হরর এলিমেণ্ট কি এত সার্থকতার সঙ্গে এভাবে এসেছে? কবিতার প্রথম লাইনেই একটা ট্যুইস্ট আছে, যদিও পাঠক সেটা বুঝবেন একেবারে শেষে! প্রথম নির্বিষ লাইনটি আদৌ নির্বিষ নয়, বরং সেখানেই উদ্দিষ্ট বক্তব্যের কূটাভাষ রয়েছে। লেখাটি শুরু হয়েছে এইভাবে :

দ্বিতীয় ছেলের অন্নপ্রাশন কালকে ভোরবেলা।
ফটোটার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন:
কোণছেঁড়া ঘুড়ির মতন।
খাটের ডান দিকে অল্প লটপট করছে বাতাসে—
সে ছিল বর্ষাশ্যামলা, দুই চেখে অর্ধমনস্কতা,
দু’বছর পাঁচ মাস আগে—এগারোতে পা রাখতেই—

প্রথম লাইনটি কেবল দ্বিতীয় ছেলেকে নিয়ে; এক বাবা-মা ছেলের অন্নপ্রাশনের দিনে ভাবছে মৃত প্রথম সন্তানের কথা—বাকি প্রত্যেকটি লাইন সেই সন্তানের স্মৃতিচারণা। ঐ বাবা-মায়ের কাছে এ-যেমন আনন্দের দিন, তেমনি অসম্ভব দুঃখেরও। এই দৈধতা নিয়েই কবিতার স্তবক গড়ে তোলা। প্রথম স্তবকে অকালমৃত সন্তান, দ্বিতীয় স্তবকে মুখে ভাত নিতে যাওয়া শিশুর জগত্‍, কিন্তু সেখানেও তো হানা দেয় অতীতের ছায়া। বাবা-মা চাইছেন, পরের সন্তানের গায়ে যেন কোনও অশুভের আঁচ না-আসে; সেকারণে অন্নপ্রাশনের আগে তাঁর স্বস্ত্যয়ন হবে। পরলোক—দেবারতির ভাষায়—‘অস্বচ্ছ বিষমকোণ’, যেখানে অনেক অপূর্ণ মনস্কামনার জট সলতে পাকিয়ে ওঠে। যে-সন্তানের কথা ভেবে বিনিদ্র রাত কাটে, যাকে ভুলতে চেয়ে আরেকটি সন্তান নিয়েছে ওই দম্পতি, তারা আবার আশঙ্কাও করছে:

দু’বছর পাঁচ মাস আগেকার অশুভ গহ্বর
ঢেকে দাও দই ফুল ঘৃত আর সংকট কুশ ঘাসে—
অন্নপ্রাশনের আগে তাই আজ স্বস্ত্যয়ন,
যদি ছোট ভাইটিকে সুরঞ্জন ডেকে নিতে আসে!

প্রথম লাইনে যে ইঙ্গিত, শেষ লাইনে এসে সেটা প্রতিষ্ঠিত ভয়ে পরিণত হয়। আপাত মনোকষ্টের এই কবিতা শেষে এসে অমঙ্গলের বার্তা রেখে শেষ হয়ে গেল; রেখে গেল বিস্ময়চিহ্ন। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাক্ষাত্‍কারে দেবারতিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বিষয়টা—তাঁর সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন ছিল: “…আপনার লেখায়, কিছু লেখায় অন্তত একটা জিনিস এসেছে যে, একটা অশুভ বা অমঙ্গলসূচক শক্তি উঠে এসেছে।” এই অমঙ্গলবোধ ভয় না দুঃখ সে-প্রশ্নও করেছেন তিনি— “…আপনি কোনো অতিলৌকিক জায়গা থেকে কিছু লিখেছেন? নাকি এগুলো আপনার নিজস্ব অপূর্ণতা থেকে উঠে আসা—ভয় নয়, বরং দুঃখেরই ছবি?” দেবারতির উত্তর ছিল: “…এটা দু-রকমই হয়েছে। যেমন, ঠিক অশুভ বা অমঙ্গল শক্তি নয়, ঈশ্বর তো শুভ-অশুভ দুইই। আমাদের হিন্দুধর্ম তো তাই বলে।” এই মনোভাবের প্রতিফলন শুধু এই বিশ্বাসেই থেমে থাকেনি, বরং একনিষ্ঠভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন দৈনন্দিন ক্লেদ, মর্ষকামিতার গ্লানি পার করে যে বৃহত্তর কর্মকান্ডে পরিণত হয়েছে—যাকে আমরা ওয়ার্কসপ বলতেই পারি, সেখানে জীবনের অপ্রাপনীয়তার অনেকটাই সমর্পণ করে দিয়েছিলেন দেবারতি। তাঁর গর্ভের শূন্যতা যে কাঠামো ধারণ করতে চেয়েছিল, যে রক্তমাংসের ভার তিনি অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন শরীরে-শরীরে, সেই অপরিমেয় অভাববোধ তাঁকে নিয়ে গেল স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম থেকে বাত্‍সল্যের রূপান্তরে। কেমন সেই রূপান্তরের স্বরূপ? ‘ভূতেরা ও খুকি’ বই হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে ১৯৮৮-তে। মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবন ততদিনে তেরো-য় পড়েছে। দেবারতি বুঝতে পারছেন বা নিশ্চিতভাবে পেরে গেছেন তিনি আর শারীরিকভাবে মা-হতে পারবেন না। ‘জীবনের অন্যান্য ও কবিতা’ গ্রন্থের ‘বিবাহ’ নামের নিবন্ধ মণীন্দ্র গুপ্ত ও তাঁর দাম্পত্য নিয়ে সম্ভবত প্রথম (একমাত্র কি?) লেখা। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখছেন:

১. “আমার স্বামীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, তাঁর একটি পুত্রসন্তান আছে।” এরপর একটা স্পেস দিয়ে নতুন অনুচ্ছেদ করে লিখছেন: “আমার স্বামীকে আমি পেয়েছিলাম ভাঙাচোরা অবস্থায়। তখন তাঁর রসকষ আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। দৈনন্দিন খাওয়াপরা, জীবনযাপনে ক্রমাগত অব্যবস্থা ও অশান্তি সহ্য করার ফলে তিনি কেমন কলের পুতুলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। আদর আপ্যায়ন তো দূরের কথা তিনি আমাকে নাম ধরে ডাকেননি পর্যন্ত। … … এখানে এসে দেখলাম সবকিছু সামলানো অপরিহার্য। বরং এভাবেই বলা ভালো–একটি আড়াই-তিন বছরের শিশুর মা-বাবা দুইই হয়ে তাকে দেখাশোনা করা ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে দাঁড়াল আমার কাজ। আজও আমার স্বামীকে একটি ছোট বাচ্চা ছাড়া কিছু মনে করি না।”

এই নিবন্ধ ঠিক কবে লিখছেন সে তথ্য এ-মুহূর্তে হাতের কাছে না-থাকলেও এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭-এ। এবার এর পাশে এই লেখার প্রথম দিকে উল্লেখ করা ‘দেবারতি মিত্রের এখনকার লেখা’ শিরোনামে মণীন্দ্র গুপ্তের সেই ‘হায়’ শব্দটির প্রয়োগ ভাবুন। ‘রসকষহীন’, ‘কলের পুতুলের মতো’ মণীন্দ্র গুপ্তও দেবারতির সন্তান ধারণ করতে না-পারার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করছেন। দুজনেই দুজনকে সবচেয়ে বেশি বোঝেন, অথচ এই সমস্যা; যার ইচ্ছে ও প্রাবল্য দেবারতির দিক থেকেই, তার কোনো সমাধান তৈরি হচ্ছে না। ‘বিবাহ’ শীর্ষক লেখাতেই দেবারতি আরও লিখছেন:

২. “বিয়ের প্রথমদিকে আমার স্বামী সমুদ্রের ধারে জেলেদের জাল শুকোবার কাঠের খুঁটির মতো নিষ্প্রাণ ও নির্বিকার হয়ে থাকতেন, আমি অনবরত ঢেউয়ে, কলরবে, উচ্ছ্বাসে ওঁর গায়ে ভেঙে পড়তাম। এইরকম কয়েক বছর, কত বছর কেটেছে জানি না।”

নিজের দাম্পত্যকে বোঝাতে গিয়ে রূপকের ব্যবহার খুবই অভিনব। গোপনীয়তা ভেঙে যতদূর সম্ভব জানিয়েছেন বলেই দেবারতির মাতৃসত্তার এই ক্রমরূপান্তরকে আঁচ করতে পারা যাবে। মণীন্দ্র গুপ্তের ‘প্রেম, মৃত্যু কি নক্ষত্র’ যাঁরা পড়েছেন, তারা মণীন্দ্র গুপ্তের প্রথম দাম্পত্যের ইশারা বুঝতে পারবেন। কষ্ট হয় এই ভেবে, দেবারতির হয়তো যা স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল, পাননি এবং এই না-পাওয়ায় কষ্টকে শোধরানোর জন্যে উভয়েই জীবনের মহাকাব্যিক শূন্যতায় পতিত হয়েছিলেন। খুঁজছিলেন মুক্তির পথ।

কিন্তু স্বাভাবিক, পরিচিত দাম্পত্য-ছকে তাঁদের জীবন এগোলোনা বলেই দেবারতির কামভাব বদলে গেল বাত্সল্যে—শুধু তা তীব্রতা হারালো না। একনিষ্ঠ পূজারিনীর মতোই দেবারতি স্বামীকে আবিষ্কার করলেন নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু এই যাত্রপথের বিবর্তনে রয়ে গেল কিছু রক্তাক্ত কবিতার চিহ্ন। সাক্ষাত্কারে তাঁকে খুব স্পষ্টতই বলতে দেখা গেছে: “…এই ‘ভূতেরা ও খুকি’ বইটাতে আমার সন্তানহীনতার দুঃখটা আমাকে খুব পেয়ে বসেছিল।” ‘সতিন’-কবিতায় ভূতের ভর হওয়ার প্রসঙ্গ সেই একা থাকবার ভয় থেকেই লেখা। লেখাটি যার জবানিতে, সে মৃত। সে মারা গেছে বলেই তার স্বামী আবার নতুন বিয়ে করেছে। কিন্তু এই ভূত হয়ে যাওয়া বউটি একা থাকতে চায় না। শুধুমাত্র একাকিত্ব ঘোচাবার তাগিদেই সে নতুন বউ অর্থাত্‍ তার সতিনের শরীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে। কোন সময়ে? যখন–‘নারকেল গাছের মাথা রোদের টায়রা পরে কাঁপে’। পুকুরঘাটে নতুন বউয়ের শরীরে প্রবেশ করবার পর সেই ভূতের ভয়েস ওভার:

আমি একা, আমি বড় একা।
রাত যায় না, দিন যায় না,
চোখে পাতা তারা নেই
হাত পা মুখের ছাঁদ ফাঁকা মাঠে হাওয়া,
বুকের নিনাড় খোপে ঝিঝিপোকা মরে গেছে কবে।

এই ‘নিনাড়’ শব্দের অর্থ দেবারতিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কবি শংকর লাহিড়ী। দেবারতি উত্তর দিয়েছিলেন—‘নিনাড়’-এর মানে হচ্ছে নির্জন। যখন এই সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন কবি, তখন ২০২২—মণীন্দ্র গুপ্ত আর নেই। সেখানে এক জায়গায় দেবারতি বলছেন: “একা থাকতেও পারি না, ৩১ জানুয়ারি (২০১৮) তিনি মারা গেছেন, তারপর থেকে কিছুতে আমি স্থির থাকতে পারছি না”। স্থির তিনি হতে পারেননি ১১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত। ‘সতিন’ কবিতার ভূতের বক্তব্য শেষ হচ্ছে এইভাবে— “আমি তরু, শুনেছিস আমার মরার কথা,/ আমার সুখের কথা?/ সঙ্গে চল–/ একা থাকতে বড় হিংসে, ভয় লাগে”। হিংসে তার স্বামীর জন্যেও, এই নতুন মেয়েটির জন্যেও; অন্যদিকে ভূতেরও ভয় হয়—একাকিত্বের। যে একাকিত্বের দহন শুরু হয় সন্তান না-হওয়ার মধ্যে দিয়ে, তাই পরিপূর্ণ আত্মাহুতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে সন্তান-কল্প স্বামীর চলে যাওয়াতে।

কখনো তাই অন্যের মধ্যে নিজের অতৃপ্ত স্নেহ ও দুঃখ দেখতে দেখতে দেবারতি নিজেই নৈর্ব্যক্তিকতার দূরত্ব নিকেশ করে একীভূত হয়ে যান। ‘জঙ্গলের ঘোর’ কবিতায় ঘাস লেগে থাকা প্রাকৃতিক ছেলেটিকে দেখেন ‘শীতের কুয়াশা লেগে জঙ্গলের ভূতপেত্নী’-র মধ্যে থেকেই। ছেলেটি অত ভূতপেতনীর মধ্যে তাঁকেই নির্বাচন করে বলছে—‘তারা দাও, অন্তত একটি তারা/ রুমালের কোণে বেঁধে রাখি।’; এমনকী এই আহ্বান কিছুক্ষণ সাড়া না-পেয়ে পালটে গেছে আরও ব্যাকুলতর আর্তিতে—‘তারা দাও, তারাটি ঝরিয়ে দাও/ দাও দাও দাও।’ রুমালের কোণে যাকে বেঁধে সম্পর্ক নির্ণয় করা গেল না, তাকেই মহাশূন্যে ভাসিয়ে দেওয়ার আর্তি ফিরে এল ব্যর্থতর কোনো চাহিদায়। দাও দাও দাও—যেন সমস্ত জঙ্গলের ঘোর এই শব্দবন্ধের বারবার ধ্বনিশক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ছে। নক্ষত্রের ঝরে পড়াও তো মৃত্যুই। ঝরে-পড়া তারা প্র্রার্থনা করে যে-ছেলেটি ভালোবাসার পিঁড়ি পেতে গেল, তাকেও এই অন্তঃসারশূন্য ভূতের শরীর কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারছে না। আফশোসের সুরে বলে যাচ্ছে নিজের মনে:

আমি তো ভিতরশূন্য ব্ল্যাকহোল—
বিকিরণ, অন্ধ তাপ, রশ্মির আওতা থেকে চিরদূরে,
ব্যর্থতার চেয়ে মিথ্যে পথে
মরেও চলেছি ছুটে
একা একা ছুটে।

এই পর্যন্ত দেবারতির আত্মপ্রতিকৃতি। ভিতরশূন্য—ফাঁপা মাতৃত্ব—যা-নিয়ে মৃতবত্‍ একা-একা ছুটে চলেছেন—ভূতের সঙ্গী কেউ হয় না, হতে পারে না। তবু ওই শূন্যের বিস্ফোরণে একটি প্রশ্ন ওঠে শীলমোহরের মতো: ‘অত কাছে এসে তবু সে কিছু বোঝেনি?’। পুরুষমানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে নয়, বরং তাঁদের সীমাবদ্ধতার প্রতি স্নেহপ্রবণ থেকেই দেবারতি তাঁর স্মিত অনুযোগটুকু রেখে যান। নিজের লেখাতেই দেবারতি জানিয়েছিলেন: “ভূতেরা ও খুকি-র কবিতাগুলি লেখবার সময় পাঠকের কথা না-ভেবে আমার মনের জটিল চিন্তা ও অনুভূতি আমি সরাসরি কবিতায় ঢেলে দিয়েছিলাম।” সেকারণেই আড়ালে-আবরণে-আলো-আঁধারির এইসব ছায়া-উপাখ্যানে জনতার প্রবেশ নিষেধ, কিংবা ঘটনাচক্রে জনতার কেউ রসিক হলেও দেবারতির স্থিরপ্রাজ্ঞ নারীত্বের বিস্ফোরণের মধ্যে সেইসব বোধবুদ্ধি অসহায় হয়ে পড়বে। প্রশ্ন তুলতে বুকের পাটা লাগে—দেবারতির যে-কোনও কবিতার প্রথম পাঠক ছিলেন যিনি, এই বইয়ের পাঠ, তাঁর জন্যেও কি একটু হলেও অস্বস্তির ছিল?

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment