১
শুরু বলা যেতে পারত ১৯৯৮ সাল, যখন জমিল সৈয়দের হাত ধরে আমি প্রথমবার মণীন্দ্র গুপ্তের লেখা পড়ি। কিন্তু সে ভাব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০ বছরের আমি অচিরেই মজে যাই তাঁর চেয়ে বেশি চমক জাগানো অন্য কবিদের লেখায়। এই ঘটনার ১০ বছর পর ২০০৮ সালে নানা কবিতার মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বাংলা কবিতার স্বভাব প্রবণতা তার সুন্দর ও স্মৃতিধার্য লাইনে খানিকটা বিরক্ত হয়ে ফের ঢুকে যাই মণীন্দ্র গুপ্তে। ততদিনে উনি মণিদা হয়ে গেছেন আমার কাছে। আমি শিখতে শুরু করেছি কীভাবে স্তবক থেকে স্তবকে নিয়ে যেতে হয় কবিতার স্তরবিন্যাস। কীকরে কবিতার প্রাণে ঢুকে আসে আমাদের আবহমান বাংলা। যদিও মণিদা নিজে কখনোই বলে দেননি সেসব। কিন্তু আমি নাছোড় তাঁর কাছ থেকে শুনে নিয়েছি অনেক কথা, আর সেইভাবেই হাতে উঠে এসেছে বাংলা কবিতার আপাত অচেনা দিক। আবহমান বাংলা কবিতা। সেই পড়ার সময় আবিষ্কৃত হয়েছেন কীকরে লালন ও রবীন্দ্রনাথ একই কালের রথে আরূঢ়। একটু করে শিখে নিচ্ছি কাকে বলে বই শক্ত মলাটে বাঁধিয়ে কালের গর্ভে ফেলে দেওয়া। মণিদা ( আর অবশ্যই দেবারতিদি) আমাকে হাতে করে চিনিয়ে দিচ্ছেন শামসের আনোয়ার বা শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়।২০০৯ সালে এসে সেই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক আরও গাঢ় হল। সপ্তাহে প্রায় দুদিন করে দেখা ও শেখা। তখন তৈরি হয়ে গেছে আমার চিতাবাঘ শহর নামক কবিতার বইটির পাণ্ডুলিপি। মণিদা-দেবারতিদি পড়লেন। আমার তখন প্রায় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসার কথা। কী অসম্ভব উৎকণ্ঠায় কেটেছে সেই ১৫টা দিন। যদিও তার মধ্যে আড্ডা বা আমার শেখায় কোনও ছেদ পড়েনি। মণিদার কাছে আরও গভীরে গিয়ে ভারতীয়তা অনুভবের মধ্যে আনার চেষ্টা তখন। এরই মধ্যে একদিন সেই আড্ডায় মণিদা বললেন “দার্জিলিং যাবার দুটো পথ, একটা সহজ হিলকার্ট রোড, আরেকটা যে কোনও জায়গায় নেমে বুনো পথে যাওয়া। গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়া না করে চারপাশটা দেখে নেওয়া। তোমার রাস্তা সেই বুনো পথ”।
২
আমি ভাবতে শুরু করি সেই বুনো পথ নিয়ে, কীভাবে মণিদা নিজে একক ও স্বতন্ত্র। কীভাবে আমাদের সভাপ্রেমী হাততালিপ্রবণ বাংলা কবিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে এক সুগভীর অথচ চিরায়তের দিকে যাত্রা করেছিলেন। যার কথা জমিল সৈয়দ লিখেছিলেন “ভাবি কে সেই প্রণম্য কবি, যিনি আবিষ্কার করেছিলেন মৎসকন্যা, ইউনিকর্ন, বা স্বর্ণমারীচ। তিনিই তো সেই কবি, যিনি এখন আবিষ্কার করেন ‘চাঁদের চাকার দাগ’…”
আসল কথাটা হল কল্পনা। আমাদের এই পীড়িত দুনিয়ায়, ক্লিষ্ট জীবনের বোধহয় একমাত্র রাস্তা এই কল্পনাপথ। মণিদা বারবার জোর দিয়েছিলেন এই সেই দেখায়, যেখানে আমাদের ভাবনা ও কল্পনা উশকে দিতে পারে অন্য সম্ভাবনা। যে সম্ভাবনা আমাদের ধ্যানী করে, আমাদের উড়াল চিহ্নিত করে। যে দেখা শুধু হুবহু বর্ণনা নয়, এবং যে দেখা আমাদের চারপাশ থেকে বিচ্যুত নয়। আর এইভাবেই মণিদা নির্মাণ করে নিয়েছেন এক ভাষা যাকে হয়ত আপাতদৃষ্টিতে ভাষাহীনতা মনে হয়, তারপর আমরা ডুবে যাই স্তবক নির্মাণে যার হাত ধরে খানিকটা মৃদু তরঙ্গের মত ধাপে ধাপে চলে যাই এক তুঙ্গ মুহূর্তের দিকে, আবার সে মুহূর্ত লীন হয়ে যায় শান্ত পুকুরের জলে, যেখানে চৈত্রের চালতা গাছের ছায়া লেগে আছে, লেগে আছে তার ফল সম্ভাবনা। যা আমাদের সমস্ত অস্থির কবির শিক্ষনীয়।
৩
মণিদার সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাটানোর সময় আমার জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০১০ সালে আমি দিল্লি চলে আসি আমার বর্তমান কাজের জগতে। মণিদা সে সময় রং কাঁকর লিখছেন। আমাকে টেলিফোনে বললেন পারলে রিজার্ভ ব্যাংকে গিয়ে রামকিঙ্করের যক্ষ-যক্ষী দেখে এসো। আমার ক্যাম্পাসে পৌঁছনোর রাস্তা রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে দিয়েই যায়, আমি শুরু করলাম আমার যক্ষ-যক্ষী দেখা। প্রায় এক বছর ধরে দেখার পর একটা চিঠি লিখি মণিদাকে। পরে দেখলাম সেই চিঠি তিনি হুবহু তুলে দিয়েছেন, লেখকের নাম সহ, তাঁর রং কাঁকরের একটি অধ্যায় করে। আমার ক্ষুদ্র জীবনের সে এক পরম স্বীকৃতি, এক চাঁদের চাকার দাগ।