৮.
হায় হায় কী কয় নতুন বৌ। কানে দিতে দিতে হাত কান অবধি পৌঁছায় না। কথায় বিষ হইলেও, তা বড় মিঠা। কচি মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে বড় মেজ, দুই বৌয়ের অবাক ভাব যায় না। ছোট বউ যেন গনগনে আগুন। এই বয়সে এমনই হয়। তাদের কুড়ি পেরিয়েছে। বুড়ি না হয়েও বুড়ি। বড়র তো তিরিশ হতে যায়। বড় একেবারের বুড়ি গিন্নি। মেজর তেজ বেশি, সে বলল, ও মা, মা, বুঝি নে, সবে তো একদিন, এক বাসর, তুই ওঁরে জাগাইয়া দে, না জাগাইলে যৈবন তুর কেমন সি যৈবন !
মু ও লকের মুখই দেখি নাই।
মেজ খিলখিল করে হাসে, কেনে, শুভ দিষ্টি হয় নাই ?
চখ বুঁজে ছিলাম।
দুই বউ লীলাময়ীর গায়ে হাত রাখে। কী বলবে ? কিছুই বলার নেই। সতীন এল, হিংসে যে হবে, তাও হয় না। বরং কষ্ট হলো কচি মেয়েটার কথা ভেবে। কী হবে পুষ্প শয্যায় ? কন্টক শয্যা হবে তা। জীবন নষ্ট হলো। তাদের স্বামীর প্রতি ঘৃণা হলো তার। ইস, সব গেছে বুড়ার। কচি মেয়েটার সাধ আহ্লাদ সব গেল।
এত অবধি বলে থামলেন অতীন সরকার। তিনি থামলে বিপুল বলে, আপনি বাণেশ্বর খবরিয়ার কথা শুনলেন কোথা থেকে ?
শুনিসি চন্দ্রকুমার খবরিয়ার কাছে।
বিপুল চন্দ্রকুমারের দিকে ঘুরে তাকায়। চন্দ্রকুমার বলে, খবরের সোর্স বলা যায় না স্যার, সকাল হয়ে গেসে অনেক সময়, বড় দাদার কাছে যাবেন না ?
অতীন বলল, হ্যাঁ, বড়দার কাছে চলুন, তিনি এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন।
সকলে উঠে এল। একই ঘেরার ভিতরে দুটি আলাদা বাড়ি। একতলা লম্বা প্যাগোডা গড়নের লম্বা কুটিরের মতো। বাইরে ভয়ানক শীত। রোদ না উঠে বেলা আটটা পার হয়ে গেছে। অতীনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে নীতিন সরকারের বাড়ি। বাগানে ফল ও ফুলের গাছে। সবের পাতা শিশির সিক্ত। নুড়ি পাথরের পথ দিয়ে এগোল তারা। বাগানের ঘাস শিশিরে ভেজা। কুয়াশা কাটেনি এখনো। অতীন বললেন, কুয়াশা কাটতে সময় লাগবে, এমন হতে পারে দুপুরের দিকে, শেষ বেলায় একটুখানি রোদ দেখা গেল, তারপরই সূর্য ডুবে গেল। নীতিন সরকারের বয়স আশির কাছে। বাইরের ঘরে বিছানায় চাদর জড়িয়ে, মাথায় কান ঢাকা উলের টুপি পরে বসে আছেন তিনি। বিপুলের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বিপুল যে আসবে তা তিনি জানেন। চন্দ্রকুমার, খবরিয়া খবর দিয়েছে। খবরিয়া–হা হা হা। খবরিয়া নামটি তাঁর খুব পছন্দ। নতুন শব্দই বলা যায়। তবে গাঁয়ের দিকে এসব চালু শব্দ…। হারিয়ে যাওয়া শব্দ ফিরে আসছে বিপুল দেখছিল দেওয়াল জুড়ে বই। ছোট একটি খাট আর সোফা সেট বাদ দিয়ে সব কিছুতেই বই। শো-কেসে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সম্মাননা। দেওয়ালে মানপত্র। নীতিন ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ছাত্ররা বাংলাদেশ কেন, বিদেশেও ছড়িয়ে আছে। নীতিন বললেন, আপনি স্বাগত, কতদূর থেকে এসেছেন, কিন্তু কেন এসেছেন ?
কেন ? বিপুল কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সে এসেছে তো সুধীন্দ্র সোমের খোঁজে। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? সুধীন্দ্র সত্যিই কি চলে এসেছেন এত দূরে ? সম্ভব ? তাহলে সুধীন্দ্র গেলেন কোথায় ? স্মৃতিহারা মানুষ কোথায় যেতে পারে তা কে বলতে পারে ? হয়তো কলকাতা শহরেই তিনি আছেন। সে জানে না। তাঁর পুত্রই খোঁজ করল না, পুত্র তো এই দেশে উড়ে আসতে পারত। বিপুল টের পায় সুধীন্দ্র একটি সূত্র, আসলে সে কৌতুহলে এসেছে এই দেশে, সুধীন্দ্র যে কমলা সায়রের কথা লিখেছেন, মৈমনসিংহ গীতিকার সেই কমলা সায়র দেখতে তার আসা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর, সোমেশ্বরী নদী, গারো পাহাড়, রাজার বাড়ি দেখতে তার আসা। সে তবু বলল সুধীন্দ্রর কথা। বিবরণ দিল সুধীন্দ্রর। লম্বায় ছ-ফুট, গৌর বর্ণ, সত্তর পেরিয়ে বয়স, আসলে তাঁরা সোমেশ্বরী নদীর কূলের মানুষ ছিলেন। গ্রামের নাম বিরিসিরি বা বহেরাতলী হতে পারে। শুনতে শুনতে নীতিন বললেন, আসলে নদীটা তো সিমসাং, আপনি বলছেন সোমেশ্বরী, এই ভুল নামে চলছে, মানচিত্রেও তা রয়েছে, আর এই দ্যাখেন, কমাস আগে, আমার কাছে কেউ একজন এসেছিল, তিনি তো ধলা নন, আর অত উচ্চও নন। কিন্তু তিনি এসেছিলেন।তিনিও কইলেন যাবেন সোমেশ্বরী গাঙের পারে। কিন্তু আমি বললাম নদীর নাম সিমসাং, বলুন সিমসাং নদীর পারে যাবেন, নদীটার জল আর নাই প্রায়। তাঁরে আমি বললাম গীতিকা যেমন সত্য, টঙ্ক আন্দোলন, হাতিখেদা বিদ্রোহ সত্য, গীতিকা রচনায় সত্য, কবি মানসে সত্য, কিন্তু বিদ্রোহ বিপ্লব যে সব ঘটেছিল তাই সত্য। যা ঘটেছিল তা যদি গীতিকায় আসে সে কেমন হয় ? তিনি বললেন, কমলা সায়রে রানি কমলার মৃত্যু সত্য। কী জানি কোনটা সত্য, সেই সত্যের সঙ্গে আর কোন সত্য জড়িত ?
চেহারায় মিলল না, কিন্তু তাঁর সুধীন্দ্র হওয়ারই সম্ভাবনা আছে। যাকগে। নীতিনের কাছে আসা মানুষ আর অতীনের কাছে আসা মানুষ এক নয়। কিন্তু এক হতেও পারে।
বিপুল যাবে সুসঙ্গ দুর্গাপুর, সঙ্গে যাবে চন্দ্রকুমার। তার ইচ্ছে বিপুলকে নিয়ে একটা খবর করে। খবর বানায়। বিপুলের সঙ্গে সে ইন্ডিয়া থেকেই আসছে। নীতিন বললেন, তুমি ওঁরে নিয়ে যাও নাগরার মাঠে। ১৯৪৫-এর মাঠ ! নেত্রকোনায় ১৯৪৫ এ সারা ভারত কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হয়েছিল গোপাল হালদার এসেছিলেন। তিনি তখন কৃষক সভার নেতা। এসেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আরো সব বড় বড় নেতারা এসেছিলেন। দশদিক থেকে হাজং পাহাড়িয়ারা এসেছিল ঢোল বাজাতে বাজাতে। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সেই সম্মেলনের প্রধান সংগঠক, তিনি তো ছিলেন সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজবাড়ির মানুষ। সব ছেড়ে দিয়ে হাজংদের নিয়ে টঙ্ক বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেন। এসব না থাকে যদি মৈমনসিংহ নিয়ে কী লেখা হবে আর নতুন করে ? মৈমনসিংহ শুধু গীতিকার দেশ নয় মশায়, তার মাটি কত মানুষের মিছিলে মিছিলে কেঁপেছে। কেঁপেছে গারো পাহাড়। ভূমিকম্পের মতো কেঁপেছে গারোপাহাড়ি দেশ।
কী সুন্দর বলছিলেন নীতিন সরকার। বলছিলেন আর হাহা হাসিতে ঘরে তরঙ্গ তুলছিলেন। এত প্রাণ তাঁর ভিতরে। ভাই যেমন বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি কোথাও, ইন্ডিয়াতেও নয়, তিনি অনেক দেশ গেছেন। তাঁর কন্যা থাকে প্রাগ শহরে। ঐ দেশেই বিয়ে করেছে ভিনদেশী পুরুষ এক। হাসলেন তিনি, বললেন, ভিনদেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতোন, লাজ রক্ত হইল্যা কইন্যা পরথম যৈবন…। আমার মৈমনসিংহর কবির কথা। হা হা হা। তিনি বলছিলেন,চন্দ্রকুমার খবরিয়া, তুমি এই এনারে সব দেখাবা, গোপন করবা না কিছু, তুমার কাজই হলো গোপন খবর ফাঁস করে দেওয়া। পারবা তো চাঁদু ?
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, পারব বলে এই লোকেরে নিয়া আসছি এখেনে, ইনি একা আসতিছিলেন, একা এসে কী খুঁজে পেতেন, ঠগের হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতেন।
হুঁ, ঠগের সংখ্যা দিনদিন বাড়তেসে, আপনার দেশেও কি তাই ?
বিপুল বলল, আপনার দেশ আর আমার দেশে তফাৎ নেই, টঙ্ক আন্দোলন কি তেভাগা আন্দোলন ?
তেভাগা আর টঙ্কতে তফাৎ আছে। বললেন নীতিন। বুঝিয়ে দিলেন তফাতটা কী ? তেভাগা ধানের ভাগ নিয়ে আন্দোলন, ফসল তিন ভাগ করে, দুই ভাগ চাষা আর এক ভাগ জমির মালিক পাবে। ফসল যেমন হবে, তেমনি তার ভাগ হবে। এখন তো চার ভাগের তিন ভাগ পায় চাষা আর এক ভাগ পায় মালিক। কিন্তু টঙ্ক প্রথা হলো ফসল নয়, টাকা দিতে হবে। জমি দিলাম চাষ করতে, তুমি এই টাকাটা বছরে আমাকে দেবে। যদি ফসল না হয়, তাহলেও নিস্তার নেই। টঙ্কা দিতেই হবে। খরা বন্যায় নিস্তার নেই। কমরেড মণি সিং রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে হাজংদের নিয়ে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেন। তার কত ইতিহাস।
এতক্ষণে অতীন কথা বললেন, হাতিখেদা না করতে চাওয়ায় রাজা প্রতিহিংসায় নামলেন।
হুঁ, তা সত্য, হাজংরা মিছিল করে গিয়ে বলল হাতিখেদা করব নাই। চন্দ্রকুমার বলল, এই নিয়ে একটা লেখা আমার পত্রিকা, মৈমনশাহী টাইমসে স্যার লিখসিলেন।
নীতিন বললেন, আমার ছাত্র একটা বই লিখেছে টঙ্ক প্রথা নিয়ে, দেখি পাই কি না।
হ্যাঁ, রক্তে ভেজা গারো পাহাড়, শিশির রাজন, ওই রক্তে ভিজল যখন গারো পাহাড়, তখন সে পিছায়, পিছায়ে যেতে থাকে। অতীন বললেন, দাদা পিছিয়ে যায় নাই ?
নীতিন বললেন, সেই যে ১৯৪৫, আমি তখন বছর দশ হবো, স্পষ্ট মনে আছে, পাহাড় নিয়ে হাজং আর গারোরা এসেছিল মিটিং শুনতে, টঙ্কর বিরুদ্ধে রব উঠল, আহা গারো পাহাড়, কবে পিছাই গেলরে অতীন ?
কবে পিছাই গেল, গারো পাহাড় অপর হই গেল ? অতীন বিড়বিড় করলেন।
হাঁ, ঠিক যেন দেখা যেত মিটিঙের মাঠ থেকে, আমার তখন দশ বছর, দেখতিসি পাহাড় থেকে নেমে আসতিসে গারো আর হাজঙের মিছিল, কবে সেই পাহাড় সরে গেল রে অতীন ? নীতিন ঝুঁকে পড়লেন ভাইয়ের দিকে, বিড়বিড় করতে লাগলেন, উত্তর্যা না গারো পাহাড়, ছয় মাস্যা পথ, তাহার উত্তর্যা আছে হিমানী পর্বত, হিমানী পর্বত পারে তাহারই উত্তর, তথায় বিরাজ করে সপ্ত সমুদ্দর……।
শুনতে শুনতে অতীন বিড়বিড় করতে থাকেন, চান্দ সুরজ নাই আন্ধারিতে ঘেরা, বাঘ ভালুক বইসে সিথা, মানষের নাই লরাচরা, শুধু হাতিরে সব ডরায়, হাতি, আসলে পাহাড় একটা হাতি, হাতি পাহাড় ঐ গারো পাহাড়, হাতি ক্রমশ সরে যাচ্ছে দাদা।
নীতিন বললেন, হ্যাঁ, বনও সরে যাচ্ছে, আকাশও, মেঘ বৃষ্টি সব…।
বিপুল দেখতে পাচ্ছিল স্পষ্ট। বন পাহাড় আর বন পাহাড়ের মানুষ……বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছ।।চোখের সামনে থেকে। তার মনে পড়ল পূর্ব ধলার আয়না বিবির কথা। আসলটা ঠিক ধরা যাবেই যতই কিসসা বানাও বাবু।
# #
পাহাড়তলীতে খবরিয়া বাণেশ্বর পৌছল যেদিন সেইদিন ছিল বড় জমায়েত। আকাশ ভারী হয়ে গেছে মেঘে মেঘে। মেঘ আসছে যাচ্ছে। বৃষ্টি নেমে গেলে আর হাতিখেদা হবে না। তারা হাতি ধরছিল না। জমিতে লাঙল দিতে নেমেছিল, একবার হয়ে গেছে। আর একবার হাল লাঙল নামবে, এর ভিতরে জল নামলে বীজতলা করতে নামবে। চাষ আরম্ভ হয়ে যাবে। চাষ-বাস এক উৎসব। ঝিরিঝিরি বাদল আর আকাশ ভর্তি মেঘ, তার ভিতরে জমিতে জমিতে নারী পুরুষ সকলে। চাষ-বাসেই নর নারী এক সঙ্গে কাজে নামে। হাতিখেদায় নয়। সেই কাজে শুধুই পুরুষ। তারা হাতিখেদা করতে জোট বেঁধে গারো পাহাড়ে যাচ্ছিল না। বর্ষা নামলে ও কাজ আর হবে না। পাহাড়ে ভয়ানক বর্ষা হয়। দিনের পর দিন চলতেই থাকে। থামে না। আর থামলেও কিছু সময়ের জন্য, তারপর আবার আরম্ভ হয়। দুর্গাপুরেও তাই। হাতিখেদা বন্ধ করে দিয়েছে হাজংরা এই খবর রাজার কাছে নিয়ে যায় খবরিয়া। খবরিয়া জমায়েত থেকেই রাজার বাড়ি রওনা হয়। সে লীলাবতী বা লীলাময়ীর কথা বলে না জমায়েতে। কোথায় কখন কী বলতে হবে তা সে ভালোই জানে। লীলাবতীকে বামুন অধিকার করে নিয়েছে এই খবর সে বললে, রসিয়ে বললে, হাজং পুরুষ, সে কে তা জানে না খবরিয়া, তাকে ছেড়ে কথা বলত না। বলত তাদের আন্দোলন ভাঙতে এসব কথা। হাতিখেদা বন্ধ। রাজার বাড়ি গিয়ে খবরিয়া বলল, হাতিখেদা বন্ধ রাজা মশায়।
খবরিয়া বলে কথা, তার খাতির রাজার কাছে খুব। খবরিয়ার একটা কাজ হলো রাজার গুণ গাওয়া।
পুরাকালে রাজা ছিলেন রামচন্দ্র তিনি,
হেনকালে আর এক রাজা দুর্গাপুরৎ যিনি ।
গ্রামে গ্রামে বলে বেড়ানো সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজা কত বড় রাজা। ভূভারতে, দিল্লি, আগ্রা কোথাও নাই এমন। তিনি কত ভাবেন প্রজার জন্য। মুর্শিদাবাদ, মুগল সম্রাট হাতি চান তাই তিনি হাতিখেদা করান হাজংদের দিয়ে। তাঁর মনে কত ভালবাসা। খবরিয়া বাণেশ্বর পৌছল রাজার বাড়ি। রাজার বাড়ি গিয়ে রাজার দেখা পাওয়া সহজ নয়। প্রধান তোরণ থেকেই বিদায় হয়ে যায় অধিকাংশ, কাউকে প্রহরী বিদায় করে, কেউ বিদায় হয় কাছারির গোমস্তা, মুনশির কাছ অবধি পৌঁছে, খাজনা দিয়ে। কিন্তু খবরিয়ার আলাদা ব্যাপার আলাদা স্যাপার। তার খাজনা হলো খবর। খবর বেচেই সে বাঁচে। সুতরাং সে প্রহরীকে খবর বলে ভিতরে ঢুকতে পারে। সে খবর কোন যুবতী কন্যারে সিনানের সময় কুম্ভীরে টেনে জলের প্রাসাদে নিয়ে গেছে, এমনি। সেই খবর কোন ঘরের যুবতী কন্যা পালিয়েছে কাজের হেলে-মুনিষের সঙ্গে, তেমনি। বিধবা গর্ভ ধারণ করেছে, আর গর্ভ নষ্ট করতে গিয়ে মরেছে, তেমনি। একটু আদি রসাত্মক খবর কিংবা কিসসা কহে প্রহরীকে খুশি করে কাছারিতে গিয়ে গোমস্তা-মুনশিকে মেঘ আর বৃষ্টির খবর দিয়ে রাজার জন্য বসতে হয়। রাজার ডাক আসবে কিংবা রাজা কাছারিতে আসবেন। কাছারিতে রাজার জন্য আলাদা আসন আছে। সেখানে তিনি বসলে পাংখাদার দুজন এসে পাংখা টেনে রাজাকে আরাম দেয়। তখন গোমস্তা-মুনশি রাজার ইঙ্গিতে বেরিয়ে যায় কাছারি ছেড়ে। রাজা জিজ্ঞেস করেন, খবর কী?
খবর কত হুজুর, বুড়া বামুন ফুলের মতন কইন্যারে বিবাহ করিসে, কইন্যা রাগ করে বামুনকে ছুঁয়া দিতেসে না। বামুনের বড় আর মেজ বউ কত সাধতিসে নোতন সতীনরে।
ইয়ারে খবর কয় না, আর, আর খবর ?
হাজঙের বেটা সেই কইন্যারে ভালোবেসেছিল।
তবে তো বামুন বেশ করিসে, মেরে ধরে সিধে করুক নতুন বউরে।
পাহাড়ে নাকি বর্ষা নামল বলে, পাহাড় অবিশ্যি একটু সরে গেছে, তার জায়গা থেকে।
ইডা আবার কী কথা ? রাজা জিজ্ঞেস করেন।
হাজং পল্লীতে শুনা যায়। খবরিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, পাহাড় সরে গেসে, এ কি সহজ কথা হুজুর !
ঢোল সোহরৎ করে ইসব কথা বলা বন্ধ করা দরকার, ইসব কথা বললে চাবুকের সাত ঘা।
হাঁ হুজুর, করেন তা, কিন্তু ইডা নাকি হইসে, পাহাড় সরে যাচ্ছে কামরূপের দিকে।
তুমি দেখেস সরে যাচ্ছে, পাহাড় কি হস্তি ?
হস্তিই বটে, অচল হস্তী, পাহাড় আসলে মেঘ হুজুর।
রাজা অবাক, এবারে কিন্তু না করলেন না, বললেন, পাহাড় মেঘ না, পাহাড়ের ডানাগুলি মেঘ, পাহাড় এককালে উড়ে বেড়াত শুনি।
হুজুর মহারাজ কত জ্ঞানী আপনি, শিখসি আপনার নিকট, তাই বটে ডানা ছিন্ন হলো, পাহাড় বসে গেল, কিন্তু তাতে তার সরতি আপত্তি নাই, উড়তি পারতিসে না বটে, কিন্তু হাঁটতি পারতিসে, তাই সরতিসে।
রাজা বললেন, হু, কিন্তু হাজংরা হাতিখেদা করতিসে না কেন ?
খবরিয়া বলবে কি বলবে না বুঝে উঠতে পারে না। চুপ করে থাকে। মনা সর্দার আসল লোক। সে উসকেছে হাজংদের। আর আছে তার কয় সাগরেদ। অথৈচন্দ্র, সুস্থিরচন্দ্র, কেষ্টা হাজং এমনি ক’জন। খবরিয়া কি সব খবর দিয়ে দেবে ? খবর দেওয়া তার কাজ কিন্তু এমন খবর না যা দিয়ে কারো ক্ষতি হয়। সে রাজার গুপ্তচর নয়, গারো পাহাড়ের দেশের খবরিয়া। সে বলল, আসলে হুজুর, বন শূন্য হয়ে গেসে। কথাটা সে বানালো। কথা না বানালে সে কিসের খবরিয়া ? যত কথা বানাতে পারবে সে, মনের মতো খবর দিতে পারবে সে, ততো সে বড় খবরিয়া হয়ে উঠবে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না এই খবরে, গারো পাহাড় শূন্য হয়ে গেছে এই খবরে, মানুষ খুশি হবে না উদ্বিগ্ন হবে ? মানুষ খবরটি নেবে না পরিত্যাগ করবে ? রাজার মুখ যে অন্ধকার হয়ে আসে, রাজা উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, সেই কথা তো শুনি নাই, কে কইসে বন শূন্য হই গেসে, বন তো রইসে, বন থাকলে হাতি থাকবে না ?
কথাডা পথেঘাটে শুনা যাসসে হুজুর, হস্তির দল হিমানি পর্বতের দিকে সরি গেসে, ছ’মাসের পথ হিমানি পর্বত, অতঃপর আরু ছমাসের পথ সপ্ত সমুদ্দর, সেথায় বিরাজ করে হস্তির আন্ধার, মানষের যাবার উপায় নাই। বাণেশ্বর কথাগুলি বলল মাথা নামিয়ে রেখে। মাথা নিয়ে বড় অসুবিধা তার। মাথা রেখে যদি রাজার কাছে আসা যেত !
আগে তো শুনি নাই ? রাজা বললেন।
আমি ছাড়া কার কাসে শুনবেন মহারাজাধিরাজ ? বাণেশ্বর ঘাড় হেট করে বলে।
আমার গুপ্তচরও কয় নাই, বরং সে কইসে অন্য কথা। রাজা ধীরে ধীরে বললেন।
বাণেশ্বর প্রমাদ গণল, হাতিখেদা না করার জন্য যে সভা হচ্ছে হাজং পল্লীতে সেই খবর রাজার কানে এসে গেছে গুপ্তচরের মাধ্যমে ? হায় হায়। সে মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে।
৯.
খবরিয়া খবর লুকোচ্চে কি না রাজার আন্দাজ আছে। খবরিয়া খবর বানায়, আবার লুকায়। ভালো খবর শুনতে চায় সকলে, খারাপে বড় ভয়। রাজা বললেন, গুপ্তচর কইসে, কী কইসে, না বলায় কোনো দোষ নাই, যাবে না, কইসে ইবার খুব বান হবে সোমেশ্বরী নদীতে, পাহাড় থেকে ঢল নামবে, কিন্তু হাজংরা কইসে নদীর নাম সিমসাং, সিমসাং হবে নদীর নাম, এইডা কি ঠিক কথা ? রাজা বানিয়ে দেলেন বাণেশ্বরের খবর।
মু শুনি নাই এমন কথা। নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল খবরিয়া বাণেশ্বর।
রাজা বললেন, গুপ্তচর কইসে, গারো পাহাড়ে শ্বেত হস্তী আইসেন।
মুই খবর নিব। দুরু দুরু বুকে বলে খবরিয়া বাণেশ্বর।
বনের ভিতর এক ঐরাবত আইসে, গারো পাহাড়থুন।
খবরিয়া বলে, হস্তী অমনই জীব, অত বড় পেরাণী আর নাই।
আচ্ছা, অই বন কত বড় ?
খবরিয়া বলে, কী কহিব রাজা মশাই, বনের কুনো দিশা নাই, দিক নাই, অই বন থেকে বাঘ, সিংহ, ভালুক, সব পলাইসে মহারাজ।
মহারাজ বলে, কিন্তু খেদায় আনা করতে হবে হস্তী।
খবরিয়া বলে, তবে শুনুন মহারাজ,
খেদার মুখেতে ধীরে আইলো হাতির ঝাঁক।
দরোজার উপরে দরান হামিসা সজাগ।।
বুকের মাঝে দুরু দুরু ন পড়ে শোয়াস।
ইশারায় ধরি রাইখ্যে কল্পি কলর রাশ।।
বড় কঠিন কাম মহারাজ, দরন ( দ্বারবান ) মরিসে কত।
তাতে তুমার কী, আমার কী, ঐটা উয়ার কাজ।
চুপ করে যায় খবরিয়া। আর কথা নয়। মুখে কুলুপ আঁটে সে। বললে বলবে কোন হাজঙের বেটির যৈবন কেমন হইসে, কেমন ভ্রমর ঘুরসে তার চারিধারে। নারীর অঙ্গ অতি মধুর, স্বর্ণ চম্পার বাস, তাহা দিয়া ধরিয়া রাখ, কল্পি কলর রাশ। সে তার পারিতোষিক নিয়ে ফিরল যেদিন, তার পরদিন পথে দেখা হলো এক হাজং পুরুষের সঙ্গে, কেষ্টা হাজং। তাকেই বলল সে কথাটা, অথৈচন্দ্র কেডা আছে হাজং বসতিতে ?
আছে, কিন্তু কেন, খবর আছে কোনো ?
খবর আছে, কিন্তু তা তারেই বলতে হবে।
কেষ্টা হাজং বলল, অথৈচন্দ্র কেন সব হাজং এখন চাষে নামবে কিন্তু রাজার অন্যায় আদেশ হাতি ধরতে হবে তাতে চাষ শেষ হয়ে যাবে …ইত্যাদি ইত্যাদি। কেষ্টার কাছে খবর দেয় না বাণেশ্বর। এমনিতে খবর দেবে কেন ? সে গেল হাজং পল্লীতে। অথৈচন্দ্রকে খুঁজে বের করল। সে দেখল বয়ঃক্রম বিংশতি হয় নাই। কী তার দেহখানি। চওড়া বুক, বৃষের ন্যায় প্রসারিত স্কন্ধ, চক্ষুদুটি তুলিতে আঁকা প্রায়, কিন্তু তা যেন আকাশের দুই তারা। জ্বলজ্বল করছে। মুখখানি হাসিতে ভরা। খবরিয়া তুমি কোন দিক থেকে এলে ?
কংস নদী পার হয়ে এলাম পূর্ব ধলা হয়ে। বাণেশ্বর বলল। দেখল কী জমাট ধলা মাটি দিয়ে তার উরত নির্মাণ করেছে পাহাড় দেবতা। কটিদেশে সংক্ষিপ্ত বস্ত্র। তার উপরে গামছা। গলায় গামছা জড়ানো। কংস নদীর নাম শুনে চঞ্চল হয়ে পড়ে অথৈচন্দ্র। অথৈ যৈবন তার। বলল, তুমি চম্পানগর চেন ?
চিনি, চম্পানগরের খবর নিয়া আসছি তো।
চম্পানগরে এক কন্যা আছে, গারো পাহাড়ি জননীর কইন্যা আছে।
জানি, লীলাময়ী।
না, লীলাবতী।
মুই জানি লীলাময়ী, বামুন ত্রিলোচন চক্কোত্তি কইলো তার বউ লীলাময়ী।
বামুনের বউ, কেডা, লীলাবতী ?
না, লীলাময়ী শুনিসি আমি।
গর্জন করে উঠল সে, ‘ লীলাবতী, মুর লীলাবতী,’ ফুলে উঠতে লাগল সে, ‘ খবরিয়া কহ, লীলাবতী কি না ?’
বাণেশ্বর বলে, লীলাময়ী।
অথৈচন্দ্র বলল, লীলামই আর লীলাবতী এক নহে ?
বাণেশ্বর সত্য খবর দিল না, বলল, না আলাদা, আরো কত লীলা আছে, লীলারানি, লীলাসুন্দরী।
বাণেশ্বর সত্য বলল না বটে, কিন্তু তার মনে উদ্বেগ ঢুকিয়ে দিল। অথৈচন্দ্র ঠিক করল চাষ আরম্ভ করে লীলাবতীকে নিয়ে এসে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করবে। কিন্তু বর্ষা নামে নামে করেও নামছে না। আবার রাজার পাইক-বরকন্দাজ এসে হাতিখেদার কথা বলে যাচ্ছে। মনা সরদারকে সে সন্ধের জমায়েতে বলল, রাজার নিকট বার্তা দিয়া হোক, হাজং আর হাতিখেদা করবে না, হাতি হলো ভগবান, এত পাপ হাজং নিবে না, চলো রাজার নিকট যাই।
রাজার নিকট যেতে হলো না। রাজার পাইক বন্দুক হাতে পরদিন এল, সঙ্গে খাস গোমস্তা, বলল, কে কইসে পাহাড় সরি যাসসে ?
মনা সর্দার বলল, শুনিসি।
গোমস্তা বলল, দেখিস ?
হাঁ দেখিসি, মাপামাপি করে দেখতি পার। মনা সর্দার বলে।
গোমস্তা বলল, আমিনবাবুরে কহা হবে, কিন্তু সবাই জানে ইডা সত্যি না।
মনা সর্দার বলল, তুমু গুমস্তা, ফালতু কথা নিয়া আসছ বলে মনে হয় না, কথাডা বলি ফেল।
গোমস্তা বলল, হাতি লাগবে, হাতিখেদা করার আদেশ নিয়া আসসি।
হবেনি, বর্ষা নামলি চাষে নামব।
কোথায় চাষ করবা, নিষ্কর জমিন দেসে রাজা হাতিখেদার জন্যি, হাতিখেদা না হলি জমিনে নামা বারণ।
মনা সর্দার গর্জে উঠল, পাহাড় থেকে এইসি জমিন দিবে বলে, ওসব কথা ঠিক না গুমস্তাবাবু।
আদেশ জানাই গেলাম, ইবার যা করবার করো।
রাজারে বলে দিবা চাষের পর, বর্ষার পর, পৌষ মাসে হবে হাতিধরা, অঘ্রানে ধান কাটার পর। মনা সর্দার বলে উঠল।
সেই মনা সর্দারকে পরদিন রাজার সেপাই গ্রেফতার করল ডাকতে এসে। কিন্তু হাজং পল্লী অত সহজে ছাড়বে না। মনা তো একা যাবে না। সঙ্গে গেল অথৈচন্দ্র, কেষ্ট হাজং, আর সুস্থির হাজং সহ আরো জনা বিশ। রাজার বাড়ির পিছনে হাতিশালা, ঘোড়াশালা, গোশালা। পশ্চিম ঘেষে মস্ত মাঠ। মাঠে ঘোড়া ছুটানো হয়। হাতি নাচানো হয়। শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথের মেলা বসে। দুর্গা দশমীর মেলাও বসে। সেই মাঠে মনা সর্দারকে দাঁড় করালো সেপাই। তারপর বলল, বিচার হই গেসে তুমার।
কিসের বিচার, কেমন বিচার, কেন বিচার, কিসুই জানিনে। মনা সর্দার গর্জন করে ওঠে, চাবুক মারবা, মারো চাবুক, কত চাবুক সহ্য করতি পারে মনা তা দেখ।
আর এক সিপাই তার এক পায়ে লাগালো শেকল। সেই শেকল বেঁধে দিল লোহার খুঁটোর সঙ্গে, যে খুঁটোয় হাতির পায়ের শেকল বাঁধা হয়। বুক ঝিমঝিম করে উঠল সকলের। তাদের সকলকে আটকে দিয়েছে মাঠের বাইরে। বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে সেপাইরা। মনা সর্দার দাঁড়িয়ে আছে, তাকে জিজ্ঞেস করল গোমস্তা, হাতিখেদা হবে কি হবে না ?
ধানকাটার পরৎ হবে, এখন চাষ। মনা সর্দার চিৎকার করে বলল।
সীমানার বাইরের হাজং জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল। ধানকাটার পর হাতিখেদা। গোমস্তা বলল, রাজার চারটি হাতি চাই, কম হবে না, বেশি হলে ক্ষতি নাই।
ধানকাটার পর জাড়ের কালৎ হবে।
রাজার আদেশ শুনালাম, এরপর যা তোর কপালে। বলতে বলতে গোমস্তা সরে আসে। অতবড় মাঠ, সেই মাঠের একদিক দেখা যায় তো অন্যদিক দেখা যায় না। মাঠ যেন সরে গেছে অনেক দূরে, সেই গারো পাহাড়ের পাশ দিয়ে বন পাহাড় ভেদ করে অন্য দেশে। মনার বয়স পঞ্চবিংশতি অতিক্রান্ত। তার ঘরে বউ আছে, দুই সন্তান আছে। বউ অনেকদিন বলছে এদেশে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। গারো পাহাড় পেরিয়ে কত দেশ। কামরূপ গেলে পেটের ভাতের সংস্থান হবে। এদেশে ভাত জোটে না। চাষই হয় না ভালো করে। হাতি ধরতে জীবন যায় কতজনের। মনা দেখল মাঠের প্রান্তে মানুষজন জমছে। কম না। বিশজন এখন দুশোজন হয়ে গেছে। বড় মাঠের ভিতর সে একা। এখন তাকে চাবুক মারবে রাজার ভৃত্য। সে আছে অনেক, গারো, হাজং, দেশি, পাহাড়িয়ারা। আছে সেই দুই জন, সুবুদ্ধ আর প্রবুদ্ধ। তারা শুনেছে নাকি বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে সুসঙ্গ দুর্গাপুরে। তারা সেই কতকাল আগে এসেছিল, কমলা সায়রে ঝাঁপ দিয়েছিল একজন, অন্যজন তাকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সায়রের জলে। সুবুদ্ধকে প্রবুদ্ধ বলে, তুই ঝাঁপ দিয়েছিলি, প্রবুদ্ধকে সুবুদ্ধ বলে, তুই। তুই না তুই…, কলহপ্রিয় দুইজন কলহ করতে করতে দুই দিন দুই রাত্রি হাঁটতে হাঁটতে এসেছে মনা সর্দারের বিক্রম দেখতে। রাজার আদেশে ‘না’ করেছে , হাতি ধরবে না, তাই বলেছে, তাই তাদের আসা কী ঘটে না ঘটে তা প্রত্যক্ষ করতে। এখন কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন, সায়রের ঘটনা তো কত শত বছর আগের, তবে তারা এল কী করে এখন ? সব খবরিয়া জানে। দুই মামাতো পিসাতো ভাই, সুবুদ্ধ, প্রবুদ্ধ গারো পাহাড়ের কোলের মানুষ। তারা এমনি আসে এমনি যায়। খবরিয়া তখন বলেছিল, তারা রানি কমলার সায়রে ঝাপ দিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল। তারা তা মানেই না। বলে,গভীর শোকে তারা সায়রের এক কূলে ঝাপ দিয়ে অন্য কূলে গিয়ে উঠেছিল। তখন সায়র ছাপিয়ে জল বয়ে গিয়েছিল সিমসাং নদীতক। আর সিমসাং নদী, যারে রাজার নামে নাম দিয়েছ সোমেশ্বরী নদী, তার উজানে ভেসে তারা গারো পাহাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল। সুতরাং তারা আসতেই পারে মনা সর্দারের বিক্রম দেখতে। তারা হাজির হয়েছিল রথের মেলার মাঠে।
অথৈচন্দ্র বলে, মু ভাবিসি, চাবুক মারিবে, রথতলার মাঠ, সেই মাঠে মেলা বসে, মেলা বসবে বসবে করছে। মানুষ সব মাঠের বাইরে। মাঠে ঢুকে গেলেই মেলা। তখনই শোনা যায় হস্তির বৃংহিত। সে কী ডাক তার। তার পিঠে এক ভিনদেশি মাহুত। তার মুখ কেউ দ্যাখেনি। দেখার কোনো উপায় ছিল না। মুখ ঢেকে রেখেছিল সে কাপড়ে। তাকে চিনতে পারেনি কেউ অথবা চিনলেও বুঝে উঠতে পারেনি আসলে সে কি না।
তখন সুবুদ্ধ বলে, প্রবুদ্ধ এ কী হয়রে, ক্ষেপা হাতি যে।
প্রবুদ্ধ বলে, হাজং নেতা মনা সর্দার, মস্ত পাঞ্জালী, তার নিকট হস্তী শিশু বটে, দেখ না কী হয়, হস্তী হাঁটু মুড়ে বসল বলে।
না না না, পায় শিকল বাঁধা, হায় হায় হায়, কী হব ইবার! সুবুদ্ধ চিৎকার করে উঠেছিল।
প্রবুদ্ধ বলে, তুই থাম সুবুদ্ধ, দেখ কী হয়, মনা সর্দার শিকল ছিঁড়ৎ হস্তীর উপরে উঠি যাব।
কিন্তু হলো কী ?হাতির সামনে থেকে নড়তেই পারে না মনা সর্দার। পায়েই পিষে দিল তাকে মত্ত হস্তী। সুবুদ্ধ প্রবুদ্ধ আর সকলের চোখের সামনে। তারপর হাতি নিয়ে মাহুত ছুটে যায় জনতার দিকে। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পালায়। সুবুদ্ধ আর প্রবুদ্ধ হায় হায় করতে করতে জনতার ভিতরে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে গারো পাহাড়ের দিকে চলে যায়। এ কেমন হলো, এই কথা তারা শোনাবে কী করে তাদের গাঁয়ের লোকের কাছে ? তারা ছুটল কমলা সায়রের দিকে। সায়রের জলে ডুবে মরবে। কিন্তু সায়রে জল ছিল কি? খবরিয়া জানে ছিল আবার ছিল না। তারপর তাদের আর খোঁজ নেই। খবরিয়া বলে,
হাতিখেদা বিদ্রোহ অতঃপর শুরু
রাজারবাড়ি হামলে পড়ে, অথৈচন্দ্র আরু।
ক’দিন ধরে কান্না চলে। রাজার বাড়ির দিকে যাত্রা চলে, আবার গুলির শব্দে হাতির দেখায় সব ফিরেও আসে। তারা হাতি ধরার খেদাগুলোই সব ভেঙে দেয়। তীর ধনুক বল্লম বর্শা নিয়ে তারা কিছুই করতে পারে না। রাজার সেনা দুজন পড়ে যায় তো সাতজন পড়ে হাজং। হাতিখেদার সেই অথৈচন্দ্রর উপর হুলিয়া জারি হয়েছিল। চোঙা ফুঁকে রাজার চোঙদার সোয়া হাজং, রতি হাজং, মংলা হাজং, বেহারী হাজং, বাঘা হাজং, অথৈ হাজং, কেষ্টা হাজং, কানু হাজংদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল। অথৈচন্দ্র দিন দশ বাদে দিনে বনের ভিতর লুকিয়ে রাতে ত্যাগ করেছিল দুর্গাপুর। ছুটেছিল কংস নদীর দিকে। না ছুটে উপায় ছিল না। হাজং পল্লীতে রাজার সিপাই ঢুকে পুরুষদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সোয়া হাজং, মংলা হাজংকে পিটিয়ে মেরেছে। অথৈ না পালালে মরত। সে লীলাবতীর কাছে ছুটল।সমস্ত রাত ছুটে গিয়ে ভোরের আলোয় পৌঁছে দেখেছিল ঘরে তালা। বামুন শীতলচন্দ্র পালিয়েছে। খবর এসে গিয়েছিল মনা সর্দার মরেছে হাতিখেদা না করতে গিয়ে। হাতির পায়ের তলায় পড়ে মরেছে বন্দী মনা সর্দার। আরো খবর এসেছিল হাজং জাতি খেপেছে। হাতিখেদা করবে না, এই পণ করেছে। শীতল অতি বুদ্ধিমান। তার মনে হয় এই সময় হাজং বেটা আসবে ঠিক লীলাবতীর খোঁজে। তারা সব মত্ত হস্তীর মতো হয়ে গেছে। লীলাবতীর বাড়ি শূন্য দেখে ক্ষিপ্ত অথৈচন্দ্র ভাঙল সেই ভিটের বেড়া। দাওয়ার খুঁটি। তছনছ করল লীলাবতীর বাগান। বাগানে দাঁড়িয়ে কোকিলের ডাক ডাকল। তিনবার ডাকল। তিনবার ডেকে থেমে গেলে লীলাবতী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসত। সে হতাশ হলো, তার মানে লীলাবতী নেই ধারে কাছে, এই গ্রামে। আবার সে কোকিলের কুহু দিল একটু বাদে। আগেরটা হয়তো শোনেনি লীলাবতী, এবার যদি শোনে। এমন কখনো হয়নি আগে। দু’বার তাকে ডাকতে হয়নি কোনোদিন। চুপ করে অপেক্ষা করল বনের ভিতর। লীলাবতী এল না। কতবার ডাকল। এল না। তারপর ধুঁকতে ধুঁকতে এল কংস নদীর ধারে। সেখানে ঢেউ অপেক্ষা করছিল। তরঙ্গচন্দ্র। সে আন্দাজ করল। সে জানে এই হাজং চাষার জন্য তার মুখে থুক দিয়েছে লীলাবতী। না হলে সে লীলাবতীকে রাজি করাতেই পারত। তার এখন যৌবনবেলা তো। লীলাবতী না করতে পারত না। সে মিষ্টিমুখে জিজ্ঞেস করল, কে গো তুমু, ঘর কুথা ?
অথৈচন্দ্র বলল, বামুন শীতলের কী হইসে, ঘরে নাই যে ?
তরঙ্গ বলল, তিনি উঁচুতে উঠি গেসেন, পতিত নাই আর, শিষ্যঘর গেসেন।
বামুনের কইন্যা লীলা ? দম আটকে যায় জিজ্ঞেস করতে।
তা তো জানি না। তরঙ্গচন্দ্র জবাব দিল।
বামুন কি গাঙ পার হইসে লীলারে নিয়া ?
তরঙ্গচন্দ্র বলল, গাঙ তো পার হয় নাই।
লীলার কি বিবাহ হইসে ? সন্দেহটা প্রকাশ করে ফেলে অথৈচন্দ্র।
সে তো জানা নাই। তরঙ্গ বলল।
ইখান দিয়া বর বউ গেসে পার হইয়া ? জিজ্ঞেস করে অথৈচন্দ্র।
আমি তো পার করি নাই। বলল তরঙ্গ। বলল কেন না সে জানে এমন হতে পারে বামুন ত্রিলোচনের বউ এই হাজঙের হাত ধরে গারো পাহাড় পেরিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারে। তাতে তার নরকবাস হবে সাতজন্ম তা যেমন সত্য, বুড়ার পাশে ঘুমতে হয়, সেও এই জন্মের আর এক নরকবাস বটে। তখন তরঙ্গচন্দ্রের মনে পড়ল বাতাসে ভেসে আসা কথা, মনা সর্দার হাতির পায়ের তলায় মরেছে, হাজং জাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। রাজার লেঠেল, বরকন্দাজ পাইক, দাও, কুড়াল, বর্শা, বন্দুক হাতে পথে নেমেছে। গাঁয়ের পুরুষরা সব পালিয়েছে। এই হাজং কি তার ব্যতিক্রম হবে ? এও এক পলাতক আসামী বটে। সে জিজ্ঞেস করল, সুসঙ্গ দুর্গাপুর ঘর ?
হাঁ, কেনে ? বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে অথৈ।
মনা সর্দার মরিসে ?
অথৈচন্দ্র বলল, হাতি দিয়া মারল রাজার মাহুত, সে খুব বেদনার।
হাজং পুরুষ খুঁজসে রাজা, সব পুরুষ পলাইসে,ধরলি শূলে চাপাবে, হাতির পাওর তলায় দিবে, তুমু কুথা যাবে ? তরঙ্গচন্দ্র জিজ্ঞেস করল।
জানিনে কুথা যাব, পার করি দাও। বলল অথৈচন্দ্র হাজং। বলতে বলতে সে নাওয়ের উপর পা রাখল। আকাশে তখন কত মেঘ। গারোপাহাড় থেকে তারা ভেসে এসেছে এই দিগন্তে। এই মেঘ আসলে পাহাড়ের ডানা। তার মানে হস্তীর ডানা। পুরাকালে পাহাড়ের ডানা ছিল। মানে হস্তীর ডানা ছিল। সেই ডানা ছিন্ন হয়ে মেঘ হয়ে ভাসছে। হস্তী অচল হয়ে গারো পাহাড়। সে সেই গারো পাহাড়ের সন্তান। তার লীলাবতীকে নিয়ে গেছে বামুন। সে লীলাবতীর খোঁজে যাবে, নাকি অচল পাহাড়কে সচল করে ঠেলে দেবে রাজার বাড়ির দিকে। হায় মনা সর্দার, মুই অথৈচন্দ, মু থৈ পাই না কী করব এখন, লীলাবতী না গারো পাহাড়, অচল হস্তীকে সচল করতে যাব সেই নিজ দেশে, সিমসাং নদীর কূলে।
কংস নদী কহ মুর, কুন পথ যাই।
আদরিয়া লীলাবতী মুর আর নাই।।