অমর মিত্র

মৈমনশাহী উপাখ্যান – ৬

১০.   

  বিপুল আছে অনেক পুরোন এক জেলা পরিষদ গেস্ট হাউসে। বাড়িটার চারদিকে নানান গাছ-গাছালি। রোদ এখানে ওঠে অনেক বেলায়। শীতের দিনে এমনিই চলে। গেস্ট হাউস বেজায় ঠান্ড, যাকে বলে হিম শীতল। একটি ঘরে চন্দ্রকুমার, অন্যটিতে বিপুল। গেস্ট হাউসে একজন কেয়ার টেকার আছে। যুবক। বিনু বৈরাগী। চাঁদবিনোদ বৈরাগী।  বয়স বছর পঁচিশ। মোহনগঞ্জ হাওর এলাকায় বাড়ি। তার বাবা জেলা পরিষদে ডি-গ্রুপ কর্মচারী ছিল। বাবার মৃত্যুর পর সে চাকরিটা পেয়েছে, কিন্তু পার্মানেন্ট নয়। মাসে আট হাজার পায়। পাকা হয়ে গেলে মাইনে পনের হয়ে যাবে। কিন্তু কবে পাকা হবে জানে না। চন্দ্রকুমার বলল, ওর বাবা, সিধু বৈরাগী কবিয়াল ছিল স্যার।

   কবিয়াল ছিল মানে ?

   গীতিকা গাইতো, এমন সুন্দর পালা গাইতো, দশ গেরামে ডাক পাইতো লোক খুব ভালো ছিল।

   তুমি গাও না ? বিপুল জিজ্ঞেস করে বিনুকে।

   মাথা নাড়ে বিনু, না, মুর কন্ঠ নাই।

   আছে স্যার, গায় না।

   কেন গাও না ? বিপুল বলে।

   নাই স্যার, মুর কন্ঠ নাই। বিনু বলল, আপনাদের জন্য চা নিয়া আসি। বলে সে চলেই গেল। তখন বিপুল তাকায় চন্দ্রকুমারের দিকে, বলল, বিনু কেন ওর বাপ সিধু বৈরাগীও খুব ভীতু ছিল স্যার, ভয়েই মরে গেল।

   তার সঙ্গে গানের সম্পর্ক কী ?

   সম্পর্ক নাই, আবার আছেও। বলল বিপুল, ওর বাবা ভয় পেয়ে মরেসে, তারে হুমকি দিইসিল এক হুজুরের ফলোয়াররা, গান হারাম, কিন্তু সে তো কবিয়াল, মলুয়ার পালা গাইতো, প্রেমের কাহিনি, কিন্তু তারে  এমন চমকান চমকাইসে রিভলবার দিয়ে যে তিন রাত না ঘুমাই মরেই গেল।

    বিপুল বলল, গাঁয়ের লোক জানত না ?

    জানত না মনে হয়, সিধু বৈরাগীর দলের গান শুনতে গাঁ ভেঙে পড়ত স্যার।

    তুমি আমাকে স্যার স্যার করছ কেন চাঁদু, তুমি একজন জারনালিস্ট, খবরিয়া।

    হাসে চন্দ্রকুমার, বলল,  স্যার বললি খবর বেশি জানা যায় স্যার।

    বিপুল বলল, আমিই তো তোমার দেশে এসেছি খবর নিতে।

    চন্দ্রকুমার বলল, মু আফনের পিছনে ঘুরসি ঐ খবর নিতিই।

    বিপুল জিজ্ঞেস করে, সিধু বৈরাগীকে ভয় দেখাল কেন ?

    দেশটারে আবার পাকিস্তান করবে বলে যারা উঠে পড়ে লেগেসে স্যার, তারা বলে গান হারাম, মৈমনসিং গীতিকা হারাম, প্রেম ভালোবাসা হারাম, রানি কমলার সায়র, মলুয়া, মহুয়ার গান, রূপভান পালা, সোনাভান পালা সব হারাম,  তারা বলে লালন শাহর গান, হাছনরাজার গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, মৈমনসিংহর পালাগান, বয়াতি, বাউল সব বন্ধ করতি হবে, সিধু বৈরাগীর মাথায় পিস্তল ঠেকায়ে বলেসিল ফের গান গাইবে তো শেষ করি দিবে। তারপর মোবাইল ফোনে হুমকি দিতে থাকে।  ভয়েই স্ট্রোক হয়ে গেল লোকটার। বলল চন্দ্রকুমার, আমার দেশে এমন চলতেসে স্যার, শুধু জুলুস আর হুজুরদের চোখ রাঙানো, ছেলেডার এত ভালো গলা, কিন্তু করবেই না গান, ওর মা ওরে দিয়ে শপথ করায়ে নেসে।

        বিনু চা নিয়ে এল, সঙ্গে স্থানীয় বিস্কুট, জিজ্ঞেস করল, কাল কখন বেরুবেন স্যার ?

        তোমার গান শোনা হলো না তো। বিপুল বলল।

        বিনু বলল, উসব সিডি মেলে স্যার, নেত্রকোনা বাজারেই পাবেন, নিয়ে যাবেন।

        সে ইউ টিউবে পাওয়া যায়,  সিডি মিলছে অথচ গান বন্ধ করে দিচ্ছে ?

        বিনু চুপ করে থাকে। চন্দ্রকুমার বলল, এইডাই তো আসল কথা, আসলে গাঁ-গঞ্জের মানুষ খুব ভীরু, তাদের যাওয়ার জায়গা নাই, গাঁয়ের পঞ্চায়েত লিডারকে বলো, সে বলবে, উসব ইসলাম ধর্মের ব্যাপার, হুজুর যা বলবেন, মুসুল্লীরে তা শুনতি হবে, আর বৈরাগী তো হিন্দু, তার কি প্রাণের ভয় নাই ?

         বিপুল বলল, পুলিসে গেলেই তো হয়।

          না, হয় না, খুন করে লাশ পুতে দিয়ে বলে যদি সে ইন্ডিয়ায় পলায়ে গেসে, কে খুঁজ করৎ  নে আসবে তারে ইন্ডিয়া থেকে, পুলিসেরও ধর্মের ভয় আছে, হুজুরের ভয় আছে, তবে কি না মুদেরও শপথ  আছে চাঁদবিনোদরে দিয়া পালা গাওয়াবই, আমি আমার পেপারে সব খবর ছাপসি, হুমকি খাইসি, কিন্তু দমিনি, সিলেটে লালন মেলা বন্ধ করৎ ভেবিসিল জিতি গেসে, মুরা সি মেলা সুনামগঞ্জে করসি স্যার।   

       বিপুল বলে, আপনাদের তাহলে সমস্যা খুব।

       সে সমিস্যা কি আপনাদের নাই, আপনার দেশে, সেখেনে মুসলমানের কি বেহেস্ত যাবার ব্যবস্থা হয় না,  সমিস্যা মনে করলিই সমিস্যা, মুই মনে করি এক নাগাড়ে ইয়ার বিপক্ষে কহি যেতি হবে, তবে হুজুররা থামবে। চন্দ্রকুমার বলল।

       বিনু বলল, কাল বিরাট জুলুস,শুনিসেন, মাইকিং হচ্ছে কদিন ধরে।

       চন্দ্রকুমার বলল, শুনি নাই, মু তো সিলাম না এখেনে।

       বিনু বলল, চাঁদা নিইসে একশো টাহা, বরিশালের  হুজুর আসতেসে, দুফরে শুরু হবে বড় মাঠে।

       চন্দ্রকুমার বলল, কাল সহালে মুরা সুসঙ্গ যাব, উসব কথা থাক।

       বিনু চলে গেল। দুপুরে তারা শহর ঘুরতে বের হয়।  রোদ উঠেছে অনেক বেলায়। টোটো গাড়ি করে তারা পুরোন শহরে ঘুরতে লাগল। কলেজ, ইস্কুল, থানাবাড়ি, ডিসির অফিস, এস,পি-র অফিস দেখতে দেখতে চলে এল সেই ময়দানে। মাইকিং হচ্ছিল। বরিশালের হুজুর আসার সংবাদ ক্রমাগত ঘোষণা করে যাচ্ছিল জুলুসের আয়োজনকারীর লোক। প্রাচীরে ঘেরা সেই মাঠের সমুখে এসেছে ওরা। ১৯৪৫-এ এখানেই হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন নাকি। তিনি তখন কবি হন নাই। কচি বয়েস।  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন নাকি, তখন তিনি অনেক বড় লেখক। জ্যোতি বসু, মোজাফফর আমেদ এসেছিলেন শুনা যায়। সেই সম্মেলন থেকেই টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়। টঙ্ক প্রথা রহিত করার কথা বলা হয়। চন্দ্রকুমার বলছিল, মণি সিং ছিলেন দুর্গাপুরের রাজার ভাগিনেয়। উনিই টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আগে দাঁড়ান। সে অনেক কথা স্যার। সেই বড় ময়দানে কাল জুলুস হবে। জুলুসের কথা শুনলি গা ঠান্ডা হই আসে অনেক সময়। কী যে বলে কী যে বলে না তার ঠিক নাই। তবে মু আমার সংবাদপত্রে  ইয়ার বিরুদ্ধে লিখিসি। ধর্মসভা কর, করতি পার, তা দিয়া মানষিরে ভয় দিখাবা, তা মেনি নিব কেন, তুমি কন্ঠ তুললি, মুরেও কন্ঠ তুলতি হবে।

  বিপুল ভাবছিল কী থেকে কীসে জড়িয়ে যাচ্ছে সে। এসব কথা কি তার কথা ? সে এক ভিনদেশী মানুষ। সে কী বলবে কী বলবে না তা বুঝতে পারে না। বড় প্যান্ডেল প্রায় শেষের মুখে। চতুর্দিকে পোস্টার হোরডিঙে হুজুরের মুখ। আরবিতে তাঁর বাণী। তারা এল অতীনের বাড়ি। অতীন আগামীকাল সকালে যাবেন তাদের সঙ্গে। একটা সি,এন,জি, অটো রিকশা ঠিক করেছেন। সক্কালে তাঁদের নিয়ে রওনা হবে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের উদ্দেশে। অতীন সরকার খুব কথা বলতে ভালোবাসেন। তাঁর আবেগ খুব। এই নেত্রকোনা, মৈমনসিংহকে ভালোবাসেন প্রাণের মতো করে। বাড়িটি ছেড়ে বেরোতে চান না। বাড়ির বাইরে মন বসে না। বললেন, গীতিকার ভিতরে হাজং বিদ্রোহ আর টঙ্ক ঘুমাইয়া আছে, তারে জাগাইতে তো পুনঃলিখন।

      টিক্কা না জ্বালাইয়া বিনোদ হুক্কায় ভরে পানি।

       ঘরে নাই বাসি ভাত কালা মুখখানি।।

       ঘরে নাই খুদের অন্ন কি রাঁধিব মায়।

       উপাস থাকিয়া পুত্র শীগারেতে যায়।।

       মায়ের আক্ষির জলে বুক যায়রে ভাসি।

       ঘরতনে বাইর অইল বিনোদ বিলাতের উপাসী।।

       জষ্টি মাসের রবির জ্বালা পবনের নাই বাও।

       পুত্রেরে শীগারে দিয়া পাগল হইলা মাও।। ****

   কবির নাম চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর মলুয়া পালায় চান্দবিনোদ যে আকালে ঘর ছাড়ল, আকালের দিনে কি রাজার খাজনা দিতে হয় নাই ? জমিনে ফসল হোক না হোক, খাজনা দিতে হবে। পনের মন ধান যদি হয় খাজনা সেটির দাম রাজারে শোধ করতে হবে। সেবার ধানই হয় নাই।

                         সাত ভাইয়ের বইন মলুয়া জল ভরিতে আসে।

                         সন্ধ্যাবেলা নাগর শুইয়া একলা জলের ঘাটে।।

ভিনদেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতোন, লাজ রক্ত হইল্যা কইন্যা পরথম যৈবন। ভিনদেশী পুরুষ চাঁদবিনোদ কাজের অন্বেষণে পথে বেরিয়েছিল। কেন বেরিয়েছিল, ধান হয় নাই, আকাল লেগেছে সব দিকে, ঘরে অন্ন নাই, রাজার খাজনা না দিলে জমিন থাকবে না। সে কোড়া পাখি শিকার করতে পারে। তারই একটা খাঁচা নিয়ে  ঘুরতে ঘুরতে এক ভিন গাঁয়ে পুকুরপাড়ে ঘুমাই পড়ল ক্ষুধার্ত ভিনদেশী পুরুষ চাঁদবিনোদ। মলুয়া সুন্দরী তারে দেখে ভালবাসায় পড়ে গেল। আচ্ছা, ফসল না হইলে ঘর ছাড়তে হবে কেন ? হবে কারণ চাষ ছিল টঙ্ক প্রথায়। এইটা গীতিকায় লেখা নেই। টঙ্ক প্রথা মানে ফসল হোক না হোক তোমাকে সাত থেকে পনের মন দিতেই হবে সাড়ে চার-পাঁচ বিঘেয়। এসবের সঙ্গেই  আমার দেশের গীতিকা জড়িত। রাজার ভয়ে ওকথা বাদ দিয়েই লিখেসিল কবিরা। তুমি খুঁজে দ্যাখো আসলে কী হইসিল, কী আমি ঠিক বলতিসি ?

    চন্দ্রকুমার বলল, ঠিক হতি পারে, নাও পারে, তবে এইডা একটা মত, মনে হয়,  ঠিকই বলতিসেন স্যার, সেই মলুয়া পালার চান্দবিনোদ আমাদের বিনু, পালার সেই নামডা ছেলেরে দিয়েসিল সিধু বৈরেগী।

    বিপুল অবাক হয়ে বিনোদের মুখখানি মনে করতে থাকে। মলুয়া পালার কোড়া শিকারী ভিনদেশী পুরুষ ! তার গা সিরসির করে ওঠে। মনে হচ্ছে নেত্রকোনা থেকে সেই গারো পাহাড় আবার দেখা যাবে।

    চন্দ্রকুমার বলে, আচ্ছা স্যার,  সেই হাজং অথৈচন্দ্রর কী হলো তারপর ?

    অথৈচন্দ্র পার হলো কংস নদী। তাকে না বলার সাধ্য ছিল না কৈবর্ত তরঙ্গচন্দ্রর। আর গাঙ পার হয়ে এদিকে নামতেই অথৈ জানতে পারে কী হয়েছে। এপারের মানুষ বলল, পূর্ব ধলার সেই ত্রিলোচন বামুন বিবাহ করেছে, বউ নিয়ে গেছে এই পথে,কিন্তু সে তো এক পক্ষ হতে গেল,  তুমি কে হে, ঘর কুথা ভিনদেশী ?

     অথৈ বলে, সে সুসঙ্গ দুর্গাপুর থেকে আসছে, সে বামুনের ঘর জানতে চায়।

     তারা বুঝে নেয় এই হাজং কে ? রাজার সিপাই হাজং পুরুষদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই খবর দিয়ে গেছে বাণেশ্বর খবরিয়া। খুব গোলমাল লেগেছে গারো পাহাড়ের কোলে। গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে। সে এই পথ পার হয়েছে একদিন আগে। খবর যা দিয়ে গেছে তা ভয়াবহ। বলে গেছে, রাজার সিপাই হাজং শূন্য করে দেবে দেশ। আর হাজংরাও পণ করেছে হাতিখেদা করবে না। যতগুলি খেদা ছিল গারো পাহাড়ের কোলে, সোমেশ্বরী নদীর ধারে, সব ভেঙে দিয়েছে হাজংরা। তাদের হাতি লেলিয়ে দিয়েছিল রাজার সিপাইয়ের দিকে। তার ফলে মরেছে কয়েকজন সিপাই। চুপ করে শোনে  অথৈচন্দ্র। সে কি বামুনের ঘরে যাবে, না ফিরে যাবে দুর্গাপুর ? অথৈ কিছুই ঠিক করতে পারে না।। লীলাবতী অন্য ঘরে চলে গেছে কি না সে বিষয়ে তার সন্দেহ আছে। কেন সন্দেহ ? আসলে তাকে তখন আবার দুর্গাপুর টানছিল। ভিতরে রোষ জেগে উঠছিল। রোষ সুসঙ্গ দুর্গাপুরের সিপাই বরকন্দাজ, গোমস্তা, তসিলদারের প্রতি যত , রাজার প্রতি তত নয়। রাজা ঈশ্বরতুল্য, রাজা ভগবানের দূত, প্রজা তার সন্তানতুল্য, রাজাকে বিপথে নিয়ে যায় তার চারপাশের লোক। তার রোষ জাগছিল পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের হাজং বসতি এই খবরে। তার পৌরুষে ঘা লেগেছে। লীলাবতী বিবাহ করেছে ব্রাহ্মণকে। লীলাবতী ঘরে আগুন দিয়ে পালায়নি কেন ? তার হাজংজাতি এখন বিপদাপন্ন। হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়ে মরেছে মনা সর্দার। লীলাবতী ঘর ভেঙে বেরিয়ে আসেনি কেন ? বামুনের ঘরের দুধ ঘি লীলাবতী হাজঙের ঘরে পাবে না, তাই।  সে কোথায় যাবে ? বিবাহিত লীলাবতীকে উদ্ধারে, নাকি হাজং জাতির নিকটে ? লীলাবতী কি বামুনের ঘরে ছেড়ে বের হবে ? সমস্ত বামুন গিয়ে রাজার কান ভারী করবে। তাহলে বামুন আর রাজার আক্রোশে হাজং পল্লী ভস্ম হয়ে যাবে। সে কি লীলাবতীকে বামুনের ঘর থেকে বের করে আনতে যাবে, নাকি হাজংজাতির পাশে গিয়ে দাঁড়াবে ? কত রকম ভাবল সে। তারপর আবার কংস নদী পার হলো আর এক মাঝির নৌকায়। পার হয়ে অন্ন সন্ধান করল। অন্ন পায়নি, কিন্তু বাগানের কলা, সবেদা, পেয়ারা, নানা রকম ফল যা পাখিরা খেয়ে বেঁচে থাকে, তা দিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করল। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। খুব ধীরে। যেন সে তার উদ্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছয় অনতিকালের ভিতরে। সে যাবে দুর্গাপুরের পথে, কিন্তু পৌঁছবে না। রাজার সিপাই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে পৌঁছবে না দুর্গাপুরে কেন, না গারো পাহাড় পিছিয়ে গেলে দুর্গাপুরও পিছিয়ে যাবে। তার ভিতরে ভয় ঢুকেছিল, পথে যদি ধরা পড়ে তবে তাকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে মারবে রাজা। রাজা যতই  ভগবান হোক, মনা সর্দার যে ভাবে মরেছে তা কি রাজার আদেশে নয় ? রাজাই কি আদেশ দেননি ঐভাবে মারতে ? মারা হয়েছে ঐভাবে যাতে সকলে ভয় পায়। ভয় পেয়ে রাজার জন্য হাতি ধরতে যায়। কিন্তু হাজংজাতি গারো পাহাড়ের সন্তান। তারা এত সহজে দমে না। চাষের সময় হাতিখেদা করতে গেলে, পেটের ভাত জুটবে না, তা কি রাজা জানে না ? সে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকে না গিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে যেতে থাকে। সেদিকে মোহনগঞ্জ। মোহনগঞ্জে গিয়ে মনে করল থেকে যাবে। কোথায় থাকবে, না এক জমিদারের আশ্রয়ে। জমিদার তাকে জমি দিল নিষ্কর। বলল, চাষ করো। অনেক জমি তার। কয়েক বন্দ নিয়ে চাষ করে ফসল দিতে হবে বছর বছর। তাই হবে। তাই হোক।

     বিপুল বলল, মলুয়া পালার সঙ্গে মিলাতে পারতেন।

     ভিনদেশি পুরুষ দেখি চান্দের মতোন……?

     অতীন বললেন, ওই যে বললাম, না কি বলিনি, হাতিখেদা বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হতেই টঙ্ক প্রথার জন্ম হয়। হাতিখেদা আন্দোলন  থামেনি। হাজংরা একগুঁয়ে। তারা বুঝতে পারছিল বেগার দেওয়ার জন্যই তাদের এই দেশে এনেছিল রাজা সোমেশ্বর সিং। তাদের নদী সিমসাং-এর নামও বদল করে দিয়েছে রাজা।  গারো রাজার সময় এত কষ্ট ছিল না। এসব কথা বলে গারো বুড়োরা। হাতিখেদা নিয়ে হাজংদের সঙ্গে রাজার গোলমাল চলতেই থাকে। কিন্তু সেই যে অথৈচন্দ্র গেল মোহনগঞ্জে, তার সঙ্গে ক’বছর বাদে দেখা হয়েছিল ত্রিলোচন বামুনের।  এই কথা তো মৈমনসিংহ গীতিকায় লেখা নেই। লিখেছিলেন সুধীন্দ্র। সুধীন্দ্রর কাহিনির সঙ্গেই যেন নিজের কাহিনি সেলাই করে দিচ্ছেন অতীন সরকার। কিন্তু সুধীন্দ্রর কাহিনি তিনি পেলেন কোথায় ? কলকাতার পাশে সোমেশ্বরী কলোনিতে বসে সুধীন্দ্র যা লিখেছেন, এই নেত্রকোনায় বসে অতীনও তাই ভেবেছেন অনেকটা। কিন্তু অতীনের কাহিনিতে সব ফাঁকগুলি ভরাট করা আছে।   

       বিপুল জিজ্ঞেস করে, আমরা কখন বেরব, কাল সকালে ?

       আটটার ভিতরে রেডি হয়ে থাকবেন, আমি সি,এন,জি- অটো নিয়ে পৌঁছে যাব, রাস্তা খুব খারাপ, খোয়া পড়েছিল, পিচ পড়েনি, গরমে কাজ আরম্ভ হয়, আধাআধি হয়, বর্ষায় বন্ধ হয়ে সেই কাজ ভেসে যায়, অবস্থা এমন।    

 

১১.

   বিপুল আর চন্দ্রকুমার বেরিয়ে এল আর একটু পরে। সন্ধ্যার পরে এই উত্তরপুবের দেশে হিমশীতল বাতাস বয়। ঠান্ডা যেন পাহাড় হয়ে চেপে বসে। দ্রুত তাপমাত্রা নামতে থাকে। আর কুয়াশা ছেয়ে ফেলছে সব দিক। আকাশ থেকে নেমে আসছে  ধূসর পর্দা। জেলা পরিষদের বাংলোয় ঢুকে বিপুল দেখল বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে চাঁদবিনোদ। চা দেবে বিনু ? বিনোদ নিঃশব্দে উঠে গেল কিচেনে। সে অপেক্ষা করছিল কখন বাবুরা ফেরেন। তারা ঘরে এসে বসল। ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল, দাদা, আপনি কোনোদিন তো দুর্গাপুর দ্যাখেননি, এখেনে কি জন্ম আপনার ?

    না, এখানে বাপ-পিতামহর জন্ম।

    আফনের বাড়ি কোন গ্রামে ছিল ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।

    মনে হয় মোহনগঞ্জের দিকে, বাবা কাকারা কেউ নেই, জিজ্ঞেস করব কার কাছে।

    মোহনগঞ্জ থেকে দুর্গাপুর দূর আছে। বিস্মিত হয় চন্দ্রকুমার।    

    তা জানি, দুর্গাপুরেও আমাদের বাসা ছিল, রাজার কাছারিতে কাজ করত ঠাকুদ্দা।

    সেই বাড়ি চিনতা পারবেন ?

    বিপুল বলল, না।

    তবে কী জন্য আসছেন ?

    আমি তো বলেছি, নিজের দেশ দেখা আর একজনের খোঁজ করা, যদি এসে থাকেন। বলল বিপুল।  

     মোহনগঞ্জ হাওরের দেশ, সেখেনে মাছ-মারাদের বাস বেশি, আফনের বাড়ি ওদেশে কইসেন,  অথৈচন্দ্র মোহনগঞ্জের জমিদারের কাছে আশ্রয় পেল, তাই ? বলতে বলতে চন্দ্রকুমার তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।

     বিপুল বলল, আমার মনে হচ্ছে আমার পূর্ব পুরুষ কেউ ছিল অথৈ।

     চন্দ্রকুমার বলল, তা যদি মনে হয়, তবে দাদা, এই কাহিনি সার্থক, আফনে কাহিনির ভিতরে নিজেকে খুঁজে পেয়েসেন।

     বিপুল হাসে। আসলে সে এসেছিল সুধীন্দ্রকে খোঁজার নাম করে কমলা সায়র আর সোমেশ্বরী নদী দেখতে। এক বিন্দু দর্শন করে ফিরে যাবে। পেয়ে যাচ্ছে এক সমুদ্র। সুধীন্দ্র এসেছেন কিংবা আসেননি, তা আর কোনো বিষয় নয়। সুধীন্দ্র অভিমানে কিংবা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গৃহত্যাগ করেছেন। আর অনিমেষ, সে কি অনিমেষকে ঢাকায় দেখেছিল সত্যি ?  অনিমেষ কেন আসবে ? সুধীন্দ্রর ছেলে চাইলে যেভাবে হোক বাড়ি ভেঙে ফেলবে। আসলে একটা আশঙ্কা সে তার মনের ভিতরে জীইয়ে রেখেছিল। তার আসার উদ্দেশ্যর সমর্থন চাইছিল অনেক ঘটনা নির্মাণ করে। বিভ্রম যেন সেই কারণে। অতীন সরকারের সঙ্গে আলাপের পর বিপুল তার আসার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে যেন। ক্রমশ খুঁজে পাচ্ছে।

   চাঁদবিনোদ চা মুড়ি নিয়ে এল। বসল চেয়ারে জড়সড় ভাব। বিপুল আর চন্দ্রকুমার দুই খাটে।  বিপুল চায়ে চুমুক দিতে দিতে আচমকা বিনোদকে জিজ্ঞেস করে, মলুয়ার পালা গান গাইতে ইচ্ছে করে না ?

    চাঁদবিনোদ চুপ করে থাকে।

    পালা না গাও যদি ভুলে যাবে। বিপুল বলল, শুনাবে ?

    পালা তো শতেকজনের সমুখে হয়। লুকায়ে কি পালা গাওয়া যায়! বিড়বিড় করল চাঁদবিনোদ। বিপুল চুপ করে গেল।

         পরদিন সকালে রোদ ওঠেনি। ঘন কুয়াশা রয়েছে । কিছুটা দূরেই সব কিছু ঢাকা পড়ে গেছে, সঙ্গে  হিমশীতল বাতাস। ঠিক আটটায় সি এন জি–অটো নিয়ে এলেন অতীন। পেছনেই তিনজন ধরে যেত, কিন্তু চন্দ্রকুমার বসে সমুখে, ড্রাইভারের পাশে। বিপুল চলেছে গারো পাহাড়ের দেশে, সুসঙ্গ দুর্গাপুরে। কত পালার কবি না জন্মেছেন এই দেশে। কবি অধরচন্দ্র লিখেছিলেন কমলা সায়রের কাহিনি। সে কাহিনি রাজা জানকিনাথ  সিংহর। আর রানি কমলার। সুধীন্দ্র নতুন করে লিখতে গিয়ে পাণ্ডুলিপি ফেলে রেখে নিরুদ্দেশে গেছেন।

      সি এন জি চলতে শুরু করল। নেত্রকোনার মগরা নদীর স্রোত ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। সেই নদী ব্রিজ  পার হয়ে শহরের বাইরে চলে গেল। অতীন আর নীতিন দুই ভাইই খুব কথা বলতে ভালোবাসেন। অনেকদিন অতীন সুসঙ্গ দুর্গাপুর  যাননি। শেষ কবে গেছেন বলতে পারবেন না। কিন্তু আজ যেন অচেনা এই বিপুল সোমের মতোই তাঁর উদ্বেল ভাব। শহর থেকে বেরিয়ে যে খোয়া তোলা রাস্তায় সি এন জি পড়ল, তার দুপাশে প্রসারিত দিগন্ত। চাষ শুরু হয়ে গেছে। বোরো ধান্য। রাস্তা এক হু হু নির্জনতার ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে। অতীন বললেন, তাঁর মাসি থাকতেন সুসঙ্গ দুর্গাপুর। ১৯৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের সময় মেঘালয়ের বাঘমারা জেলা দিয়ে ভারতে ঢোকেন। আর ফেরেননি।  শুনেছেন শিলিগুড়িতে সেটলড। তাঁরাও তখন মেঘালয়ে ঢুকেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। অতীন মুক্তি যুদ্ধের কথা বলতে লাগলেন। কবে মিলিটারি ঢুকল নেত্রকোনায়। মৈমনসিংহতে বোরখাই তাঁর শ্বশুরবাড়ির স্ত্রীলোকদের বাঁচিয়েছিল। তাঁর শ্বাশুড়ি মা কোরানের সুরা জানতেন। তিনি খুব পড়তেন। প্রতিবেশি মুসলমানবাড়ির কত্রীই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে রামায়ণ পড়ে শোনাতেন। বুঝুন কেমন ছিল দেশটা ! অতীনের কথা শুনতে শুনতে বিপুল জিজ্ঞেস করে, তখন কি মৈমনসিংহ  থেকেও দেখা যেত গারো পাহাড় ?

    অতীন হাসলেন, তখন ব্রহ্মপুত্র নদ কত বড় ছিল ভাবতি পারবেন না, মৈমনসিংহর ব্রহ্মপুত্রর এপার ওপার ছিল না শুনিসি।  

    চন্দ্রকুমার সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছিল, বলল, তখন সে গাঙে বড় বড় সওদাগরের নৌকো যাতায়াত করত, তখন সব কিসু অন্যরকম ছিল।

     অতীন বললেন, তাই, এখন দেখলি কিসুই মেলবে না, গাঙ, পাহাড়, সব নষ্ট হয়ে গেছে, আরো হবে, একদিন পৃথিবীতে শুধু মানুষ থাকবে, গাছ-গাছালি, পাহাড়, নদী সব ফুরায়ে যাবে, চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে, আর মানুষ নিজেদের ভিতর মারামারি করে মরবে।        

     এই রকম কথা হতে লাগল। কুয়াশা তরল হয়নি। এদেশে এমনি হয়।  সি,এন,জি, টলতে টলতে চলতে লাগল। দুপাশে কী আছে কুয়াশায় ভালো দেখা যায় না। তার ভিতর থেকে মুখ বাড়ায় অবারিত শস্যক্ষেত্র। ধান কাটা হয়ে গেছে।  শীতের ফসল করতে মাঠে মানুষ আছে। সবই আবছা। তারপর তারা এক নদীর ধারে এসে পৌঁছল। নদী যেন কুয়াশার ভিতর থেকে মুখ দেখাল। আরে সেই নদী। যে নদী পেরিয়ে এসেও অথৈচন্দ্র আবার পার হয়ে ফিরে যেতে যেতে চলে গিয়েছিল অন্য দিকে।  মোহনগঞ্জে। হুঁ, এর নাম কংস নদী। কংস নদী পার হয়ে তাদের যেতে হবে আরো দূরে। ফেরিতেই সিন,এন,জি, পার হলো। ছোট নদী, কিন্তু স্রোত আছে খুব। পাহাড় থেকে নেমে আসছে তো। তাদের ফেরিতে মোটর সাইকেল, সি,এন,জি, মানুষজন, ছাগল, মুর্গি, সব পার হচ্ছে। যেন নোয়ার নৌকো। বললেন, অতীন সরকার।

   চন্দ্রকুমার বলল, ঠিকই কইসেন সার, নুয়ার নৈকো, কিন্তু এমন যদি হয় বৃষ্টি নাই, তবে নুয়া  কী করৎ নিয়ে যাবে, খরায় ফসল আর মানুষ জন্মাবার আগেই মরে, আর বানের কালে বাঁচনের ভিতর মরে।   

   অতীন বললেন, চান্দবিনোদের জমির ফসল খরায় নষ্ট হইসিল, বানেও নষ্ট হইসিল,আগের বারে খরা, ইবারে বানা, বানার পরের বারে আবার বানা,  ধান বুনাই হয় নাই, তখন আবার জমিদারের খাজনা শোধ করতি হবে, কতদিন বকেয়া থাকবে, টঙ্ক, কিংবা ধানের ভাগ, সে ঘর ছাড়ে কোড়া পংখী শিকারের অছিলায়। আসলে তা না, টঙ্ক না দিতি পারলি চান্দবিনোদের জমি তো যাবে, তারপর তারে খাজনা শোধ করতিও হবে। না করতে পারলে নিগ্রহ হবে খুব।   

         মন্দান্যা আইশ্নারে পানি ভাটি বাইয়া যায়।

         চান্দবিনোদে ডাক্যা কইছে তার মায়।।

         ‘উঠ উঠ বিনোদ আরে ডাকে তোমার মাও।

          চান্দ মুখ পাখলিয়া মাঠের পানে যাও।।

          মাঠের পানে যাওরে যাদু, ভালা বান্দ আইল।

          আগন মাসেতে হইব ক্ষেতে  কাত্তিকা সাইল।। **

       

        গুনগুন করতে করতে চন্দ্রকুমার বলে, ডাক বাংলোর চান্দ বিনোদ শুনায়সে একদিন, শুনাইতে শুনাইতে তার চখে পানি আইস্যা যায়।

         নদী দক্ষিণ পুবে বয়ে গিয়ে উত্তরে আবার বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে। সেই দিকে তাকিয়ে অতীন বললেন, এই যে উত্তরে গেসে নদী, নদী বয়েসিল চান্দবিনোদের সঙ্গে, আবার অথৈচন্দ্রের সঙ্গে, তারা যায় পথে পথে, বনপথে  কিংবা গাঁ-গেরামের পথে, নদী তাদের পাশে পাশে চলেছিল, সেই চলন ছিল দুঃখীর চলন। কবে ফিরবে মায়ের কাছে, কবে শোধ করবে টঙ্ক, হাতে পিঁজিরা নিয়ে চান্দবিনোদ চলে। কোড়া পাখি শিকার করৎ টঙ্ক উপায় করিবে গেরস্ত ঘরে বেচে, কিন্তু আকালের দিনে সে পঙ্খীও নাই। জলাজমি ভিজা মাঠ, পুকুর ধারে, এ গাছ সে গাছের ডালে ঝিমায় যে শাদা কালো বক পঙ্খী, কোড়া পঙ্খী যত, উড়িয়া গিয়েসে তারা ভিন্ন আকাশ আর ভিন্ন দেশের দিকে। তাই  পিঁজিরা পড়ে থাকে খালি, খালি পিঁজিরা নিয়ে চান্দবিনোদ হাঁটে, সঙ্গে চলে কংস নদী। বড় ধীরে ধীরে চলে সে, বিনোদের সঙ্গে চলে।

                                   খালি পিঁজিরা নিয়ে পুরুষ একে,

                                               শিগারী, কোড়া পংখী খুঁজে

                                  পঙ্খী নাই পঙ্খী নাই, বৃক্ষ শাখা দেখে,

                                         পুস্করিনীর পাড়ে তাই দুই চক্ষু বুঁজে। **  

অথৈচন্দ্রের সঙ্গেও অমনি বয় নদী।  সেই কারণে কংস নদী যে এদিকে আছে সেদিকেও আছে, কংস নদী হলো চান্দবিনোদ আর অথৈচন্দ্রের চোখের পানি, মনের বেদনা। দেখুন আপনি, একজন অভাবে আকালে কোড়া পঙ্খী  খুঁজতে খুঁজতে ভিনদেশে যায়, অন্যজন ভয়ে তরাসে, ভালোবাসায় বিফল হয়ে ভিনদেশে যায়। চন্দ্রাবতী কবি লেখে ভিনদেশে গিয়ে মলুয়ারে পায় চান্দবিনোদ। খাজানার কথা বলে নাই।  অধরচন্দ্র কবির কাহিনিতে অথৈচন্দ্রর নাম নাই। কেন নাই, হাতিখেদা করে হাজংজাতি রাজার আমল থেকেই। সোমেশ্বরী নদী আছে, আছে রাজার বাড়ি, কমলা সায়র আছে, হাতির কথা নাই। হাতিখেদা নাই,  তাই অথৈ নাই। অথৈ এল এখন। নতুন উপাখ্যানে।

     নদী পার হয়ে এল তারা। সি, এন,জি–অটোরিকশা  অপেক্ষা করতে লাগল নদী ঘাটের রাস্তায়। তাদের চা দরকার। এতক্ষণে, বেলা দশটায় একটু তরল হয়েছে কুয়াশার পর্দা। বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।  চায়ের দোকানের গায়ে মহুয়াসুন্দরী সিনেমার বড় প্ল্যাকার্ড, জনৈক মনসুর আমেদের নির্বাচনে নমিনেশন পাইবার আকুল আবেদন, দোয়া প্রার্থনা। জনগন দোয়া করলেই উনি ঢাকা থেকে নমিনেশন পাবেন পার্টির বড় কত্তাদের অনুগ্রহে। বলতে বলতে  চা-ওয়ালা বুড়ো জিজ্ঞেস করল, বেল চা দিব ?

    বেল চা কী ? বেলের খোলা শুকিয়ে সেই শুকনো খোলা চূর্ণ করে চায়ের গুড়োর মতো ব্যবহার করা হয়। বুড়ো দোকানির নাম অস্থির মিঞা। বাহ, বড় সুন্দর নাম যে। মিঞা বলল, হাঁ, সোন্দর, কদিন আগে এক ইন্ডিয়ার লোক গেল গাঙ, সায়র আর নদী দেখতে দুর্গাপুর, মুর নাম  শুনে বলল, আমার মতোন স্থির লোক আর নাই।

      তাঁর নাম কী ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।

      সেডা কী করে জানব, তেনাদের বাড়ি ছিল  নাকি এখেনে।

      তিনি কি ফিরে গেছেন ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।

       জ্বি, মু দেখিনি, হয়তো গেসেন হয়তো যাননি। অস্থির মিঞা বলল।

       তাঁর বয়স কত ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।

       সে কি আর বলা যাবে , মুর বয়স যা তাই হবে। অস্থির মিঞা বেলের খোলা চূর্ণ ফোটাতে ফোটাতে  কথাটা বলতে বিপুল জিজ্ঞেস করল, আপনার বয়স ?

      অস্থির হেসে বলল, জ্বি,  জানা নেই, আমার বয়েস কত বাবা মা বলতি পারত, তেনারা নেই।

       মনে হয় সত্তর পার, মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ছিল বয়েস ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।

       কুড়ি হতি পারে, তিরিশও,মু মুক্তিযুদ্ধ করিসি, চল্লিশ, পঞ্চাশ হতি পারে,  কিন্তু সে কথা কেউ বিশ্বাস করে না। অস্থির মিঞা চা ছাকতে থাকে, আমার সেকটর ছিল  গারো পাহাড়ে।

        অদ্ভুত! কী থেকে কী কথা  বেরিয়ে আসছে। অস্থির মিঞা চায়ের গেলাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল, গারো পাহাড় আসলে এক হস্তী, হাতি যারে কয়, তা মুই জেনেসি সেই সময়।

       কেডা কইসে ? এতক্ষণে অতীন সরকার কথা বললেন।

       কেডা আবার কইবে, মু তা দেখিসি, বনের ভিতর সব ছিলাম সকলে, সে সিল অগগান মাস,  শীত নেমি গেসে, খুচখাচ যুদ্ধ চলতিসিল, খালেক মালেক দুই রাজাকার ছিল, নাম শুনেসেন বাবু, পূর্ব ধলায় বাড়ি সিল, কুমারখালি পুলের পাশে, তেনারা পাকিস্তানিদের নিয়ে গারো পাহাড়ের দিকে রওনা হতি, পাহাড় নড়া চড়া আরম্ভ করল, একেবারে সত্যি কথা সার, কী হইসিল জানেন ? অস্থির মিঞা তাদের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে  থাকে। তার চোখদুটি যে বাদামি, কটা তা বুঝতে পারল বিপুল এত সময়ে। কার সঙ্গে মিল এই চোখের ? আমেরিকাবাসী প্লাবনের ? প্লাবনের চোখ কটা। তুমি কে হে অস্থির মিঞা ? তুমি কি জানো সুধীন্দ্র সোম যে গীতিকা লিখেছে কাহিনি করে, সেখেনে যে পলাতক হাজং আছে, তার চক্ষুদুটি বাদামি। একে অন্যেরে চোখে চোখে রাখা একেই বলে। অস্থির মিঞা  এক অদ্ভুত কথা বলল, পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে খালেক মালেক দুই ভাই দুর্গাপুরে ঢুকল সন্ধের সময়। ক্যাম্প করল তারা এখেনে। হাজং বস্তী, গারো বস্তী, বাঙালি গেরস্তর বাড়ি আগুন লাগাবে লাগাবে করতিসে, মানুষজন পলাসসে, মেয়েমানুষ ধরতেসে পাকিরা, সেই টায়েমে গারো পাহাড় থেকে কুয়াশা এল, সব ছেয়ে ফেলল, আর হাতির দল বেরিয়ে পাকিস্তানি আর্মির দিকে ছুটে গেল, অনেক হস্তি নিয়ে পাহাড় তাই পাহাড়ের শেষ নাই। বুঝুন কাইন্ডো ! আর্মির মেজর তখন একটা কচি মাইয়্যা পাইসে, তারে সাইজ করবে বলে মন স্থির করতেসে, বাংলা মুলুকে মেয়েমানুষ অগুন্তি, তাদের ফুর্তির সীমা ছিলনি। কিন্তু হয় নাই। গারো পাহাড় ছুটে এল। হস্তীর ডাকেরে কয়  বিংঘিত ( বৃংহিত ), সেই বিংঘিত হতি লাগল কুয়াশা আর অন্ধকারে। ও কেয়া ও কেয়া বলে মেজর চিৎকার করে উঠল।

     এ কাহিনি এতটা  শুনিনি আমি। বললেন অতীন, পান্ডুলিপিতে নাই।

     আফনে কি ছিলেন তখন এদিকা ? অস্থির মিঞা জিজ্ঞেস করে।

      ছিলাম, সে অনেক কাহিনি,  পরে বাঘমারা চলে যাই।

      সার, সব কথা কি সবাই জানতি পারে, জগতে অনেক ঘটনা ঘটতিসে, সব কি কানে আসে, কত ঘরে কত কিসসা, সে কি কেউ জানতি পারে।  বলতে বলতে বুড়ো অস্থির মিঞা তার কটা চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

      বিপুল জিজ্ঞেস করে, তারপর কী হলো ?

      কী হবে হাজারটা পাহাড় ঢুকে পড়ল সুসঙ্গ দুর্গাপুরে। অস্থির মিঞা বলল।    

       পাহাড় থেকে হাতির দল নেমে এল ? জিজ্ঞেস  করল বিপুল। তার বিস্ময় ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছে।

       জ্বি, তা বলা যায়, আবার বলা যায় পাহাড়্গুলো সব চলতি আরম্ভ করে দুর্গাপুরের দিকে চলে এল।  আসলে যে মাইয়্যাডারে আর্মির মেজর সাইজ করবে বলে ঠিক করেসিল, সেই লীলাবতী না লীলাময়ীই সিল হাতি ডেকে আনার আসল মানুষ, সে গারো পাহাড়ের মাইয়্যার কইন্যা, আবার বামুনের খুন তার ভিতরে, সে তন্ত্র-মন্ত্র সব জানত,গারো পাহাড়  পেরুয়ে কামক্ষ্যা-কামরূপ, তন্ত্র-মন্ত্রর দেশ। তার ক্ষ্যামতা সিল কম না, হাতি সে ডেকেসিল, নইলে আর্মির লোক তারে ছিড়ে আগুনে পুড়ায়ে চাপাটি দিয়া ভক্ষণ করি নিত।

(চলবে)

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment