জ্যোতির্ময় দত্ত

শম্ভু ও সিকিমের ছাম্ব্ হ্রদ

মেদিনীপুরের মাটি ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা কবি- শম্ভু রক্ষিত। প্রাসাদ-পিরামিড-ড্রাগন-গন্ধর্ব অধ্যুষিত এক অলৌকিক বৈভব ও সম্ভোগের জগৎ। তা আকাশে মেঘের সৌধমালা।

শম্ভুর ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করেন। কিন্তু তার কবিতার কোনো আলোচনা কোথাও দেখিনি। অথচ গত তিন দশকের বাংলা কবিতার ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন শম্ভুর কথা আসতে বাধ্য– যা তথাকথিত মূল স্রোতের অনেক কবির বিষয়েই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদি ইয়োরোপের ১৯ শতকের নের্ভাল কি ২০ শতকের ডাডাইস্ট কি ফিউচারিস্ট কবিরা এখনও আমাদের কৌতুহল উদ্রেক করে থাকেন, তবে ব্যাপক না হলেও বলা যায় যে আগামী কয়েক দশকে শম্ভু বিষয়েও থিসিস লেখা হবে, মহাফেজখানায় তল্লাস চলবে, ঠাকুরদাস দত্ত প্রথম লেন-এর বাড়ি নিয়ে মামার সঙ্গে মামলায়, বিরিঞ্চিবেড়ের থানায় মেয়ে-জামাই বিষয়ে ডায়েরির। সে সব অনুপু্ঙখ উদ্ধারের দায়িত্ব ভাবী গবেষকদের। আমি শুধু এটা পাথরে খোদাই করে রেখে যেতে চাই যে স্রেফ নাদমাহাত্ম্যে শম্ভুর ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ অতুলনীয়। ডাডা কবিগোষ্ঠীও শব্দ ভেঙে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন, যা ধ্বনিসর্বস্ব, যার কোনো আভিধানিক অর্থ নেই। কিন্তু শম্ভুর বানানো অভিধানের অজানা, শব্দগুলি মায়াবী অর্থময়। কিন্তু এটা স্মর্তব্য যে রাগ-রাগিণী কি খেয়ালের মতো নয় এগুলো। এটা মার্গসংগীত নয়। এটা কবিতাই। এর অবলম্বন সুর নয়, ভাষা। বাংলা ভাষার একটা স্তর যেমন শব্দের আভিধানিক অর্থ, অন্য একটা স্তর শব্দগুলির আওয়াজ। সেই আওয়াজও কিন্তু বহুমাত্রিক। আওয়াজের নিয়মিত উত্থান-পতনের নাম ছন্দ। যদি কোন-কোন ভাষা-কারিগরের কলমে তা হয়ে ওঠে শব্দ বাহিনীর কুচকাওয়াজ, ভাষা-যাদুকরদের দন্ডে তা হয়ে ওঠে নাচ, ব্যালে, মোহিনী অট্টম। কিন্তু স্তরের তলায়, কিংবা উপরে, আরেকটি স্তর আছে, যেখানে স্রেফ আওয়াজের মধ্যে শব্দের অর্থ গুরুগুরুগুরু প্রতিধ্বনিত। বাংলাভাষায় সেই অর্থ-বিদ্যৎ আলোকিত শব্দ বজ্রের মেঘলোকে একা বিহার করেন শম্ভু রক্ষিত।

তিরিশ বছরের বেশি আমার শম্ভুর সঙ্গে পরিচয়। এর মধ্যে কত ওলট-পালটই না হল—বাংলাদেশের জন্ম, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, পেজ-মেকার, ফোটোশপ, মোবাইল ফোন কিন্তু– শম্ভু বদলালো না। যোধপুর পার্কের বাড়িতে ঝুলি কাঁধে, আধাময়লা জামা গায়ে, ছেঁড়া চটি পায়ে সেই যে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এসেছিলেন তার ‘মহাপৃথিবী’র প্রচ্ছদে ‘কলকাতা’-পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রেখাচিত্র ব্যবহারের অনুমতি চাইতে, তিনি সেই একই রয়ে গেলেন। না-বদলাল পোশাক, না পেশা। তিরিশ বছর আগেও ‘মহাপৃথিবী’ ছিল শম্ভুর জীবিকা। আজও তাই। লিখল না প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস। চাকরি নিল না কোথাও। আঁকল না ছবি, গাইল না গান। বিদেশ তো দুরের কথা, বাংলার বাইরে সম্ভবত দু-বারই গেছে। এমার্জেন্সির সময়, শম্ভু, আকুল ও আমি। আমরা তিনজন, যখন ফেরার- সাঁওতাল পরগনা ও ময়ূরভঞ্জ। এমার্জেন্সির ঐ অধ্যায়টি ছাড়া, কোনো ছেদ নেই শম্ভুর জীবনধারাপাতে। প্রতি বইমেলায় সে পেতেছে টেবিল- কিন্তু স্টল দেয়নি। ‘লিটল ম্যাগাজিন’ -এর ধর্ম অবিচল পালন করেছে শম্ভু, যা আমি তো দূরের কথা, ‘কৃত্তিবাস’-সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও পারেন নি। ঠিক ঐরকম ওয়ান-লেন সোজা রাস্তা ধরে ঝুলি কাঁধে হাঁটেননি ‘পরিচয়’ সম্পাদক   সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কী ‘কবিতা’ সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে শম্ভু অনন্য।

এর অর্থ এই নয় যে শম্ভু অন্যদের তুলনায় বেশি বিশুদ্ধ, কী তার পত্রিকা প্রভাবশালী। প্রকৃতিতে যেমন, সাহিত্যেও তেমনি প্রকৃতিতে কোনো-কোনো স্পিসিস পরীক্ষাপরায়ণ ও দ্রুত পরিবর্তমান, — আবার কোনো প্রজাতি বা প্রকৃতির একটি বিশেষ খাঁজে তৃপ্ত, সেই বিশেষ পরিবেশের সঙ্গে তা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে যে তাকে ছুঁতে পারে না সেই প্রবল শক্তি, ইভোলিউশন, যার প্রভাবে কতো না অতিকায় প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথচ তার সফল অভিযানের কারণে ঐ প্রজাতিটি অবিকৃত রয়ে গেছে কোটি বছর। অনুর্বর ছিলো শম্ভুর সাংস্কৃতিক ‘নীশ’, কিন্তু যা পরাজিত করেছিল অন্যদের, তাকেই শম্ভু পরিণত করেছিল তার সাফল্যের সোপানে। এমার্জেন্সির সময় আমরা দিন তিনেক কাটিয়েছিলাম বিরিঞ্চিবেড়ে-র বাড়িতে। সেই রূঢ়, বিরূপ পরিবেশ যে তাকে পরাভূত করতে পারেনি, – তা ভেবে শম্ভুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেশ কয়েক দাগ উঠে গেল। ব্যক্তি কীসের সৃষ্টি –প্রকৃতির, না পরিবেশের? শম্ভু এর একটা মিশ্রিত উত্তর। তার প্রকৃতি তাকে করেছে কবি, পরিবেশ করেছে মামলাপরায়ণ এক মেদিনীপুরিয়া। এবং তার কঠিন শৈশব তার মধ্যে সংক্রমিত করেছিল এমন সব অভ্যেস যা পরে শম্ভুর বিপুলভাবে কাজে লেগেছিলো। বিরিঞ্চিবেড়ে থেকে সে হাওড়ায় দিদিমার বাড়িতে মাসির কাছে এসে উঠল, লেখাপড়া শিখবে বলে। বহু পুরনো বাড়ি, তার এক লোনাধরা অন্ধকার ঘরের প্রতি তার প্রবল অধিকারবোধ। সেই ঘরেই সে পেয়েছিল বাংলা কবিতার আকাশে মুক্তি। জীবিকা কী হবে? সে শিখল কম্পোজিটারের কাজ। কিন্তু তাকে ছুঁয়ে গেল প্রেম; তার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা প্রকাশ করল নাদের গুপ্ত ঐশ্বর্য। ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’র লেখককে কি টাইপের সাজানাে বাক্সের সামনে দিনে ১২ ঘন্টা বসিয়ে রাখা যায়? অ্যাবসার্ড। সে প্রথমে হয়তো বোঝেনি যে ‘মহাপৃথিবী’ই হবে তার রুজি। সেই এক গ্যালি-দুগ্যালি করে ধরে-ধরে কম্পোজ, হাতে-হাতে বিক্রি করে কাগজের টাকা সংগ্রহ, সেই কবিতা নির্বাচনে সতর্কতা, সেই নির্ভুল মুদ্রণ! হাওড়া থেকে এসে গঙ্গায় ডুব, ছেলেবেলার মতো শীতকালেও গায়ে-গায়ে কাপড় শুকানো, গেরস্তের মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে কাগজ ছড়িয়ে প্রুফ দেখা, থালার উপর উপুড় হয়ে ভাত চটকে দলা পাকিয়ে আহার। থালার বাইরে মেঝেতে মাছের কাঁটা ফেলেন; সশব্দে জল খান, গেলাস ডান হাতে ধরে। এমার্জেন্সির আমরা তিনজন যখন অতি ঘনিষ্ঠ, তখন একে-অপরের ম্যানারিজম আড় চোখে লক্ষ্য করতাম। কুলীন বংশোদ্ভুত আকুল প্রশান্ত বসু ছিল পরিপাটি কেতাদুরস্ত। পুলিশ গলিতে ঢুকে পড়েছে, তবু আমাদের আকুলের ইস্তিরি-করা শার্টেরর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। আকুল শিউরে-শিউরে উঠত শম্ভুর একেকটি আচরণে। হয়তো এক কাঁথার মধ্যে তিনজন কুঁকড়ে-সুকড়ে শুয়েছি; আকুল হঠাৎ বেরিয়ে পাতলা চাদর গায়ে শুয়ে পড়ল! এমন নাকি ঘানির গন্ধ সর্ষের তেল চর্চিত শম্ভুর গায়ে। খাবার সময় আকুলের স্বআরোপিত ভূমিকা মার্জিত হোস্টের। সে অগ্রে অন্যদের ভালোটা দিয়ে, পশ্চাতে নিজে কমটা নেয়। আর শম্ভু সুযোগ পেলে খাবলা দিয়ে নেয় মুড়োটা কিন্তু এও জানত আকুল যে শম্ভু নিজে একেবারেই এসব নিয়ে কুণ্ঠিত নয়। সে সম্পূর্ণ ভড়ং-বর্জিত। পুলিশের নাকের উপর দিয়ে গলফ্ ক্লাবের বাড়িতে গিয়ে মীনাক্ষীর হাতে আমার চিঠি গুঁজে দিয়ে এসেছে। মীনাক্ষী আঁতকে উঠে বলেছে, “সে কি তুমি এখানে কেন?” শম্ভু বলেছে, “দূর, পুলিশ আমায় জিজ্ঞেস করলে বলবো, আমি ধোপা, বৌদির কাপড় নিতে এসেছি। আমায় একটা নোংরা বোঁচকা দিয়ে দেবেন।” আমাদের সেই আধা-বনভোজন, আধা-রাজনৈতিক অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লেখার সময় এখনও আসেনি। “শিগক’-সম্পাদক স্বয়ং ঐ কাহিনীর একটি পরিচ্ছেদের নায়ক; তিনিই নয় তার আত্মজীবনীর কোনো অংশে ‘সাহেবনগর-কৃষ্ণনগর-ডোমজুড়’ অংশটি ঢুকিয়ে নিন। কিন্তু এটাও সেই পাথরে খোদাই করে যেতে চাই আমাদের সব ভিন্নতা সত্ত্বেও, ১৯৭৫-এর সেই একটা রোমাঞ্চকর বছর, আমরা তিনজন ছিলাম। একই লক্ষ্যে ফোকাস করা একটা দূরবীন কি ক্যামেরার ট্রাইপডের তিন পায়া। বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে জীবনের সেই তীব্র ফোকাসও যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।

যদি পোস্টমর্টেম না-করলে বোঝা যায় না, মৃত্যুর কারণ কী, কোন বিষ আছে শবের অন্ত্রে, তেমনি অনুবাদ না-করলে অনেক সময় ধরা পড়েনা কী সেই কষ, কী সেই শব্দের শিরায় শোণিত যা কোনো কোনো রচনাকে জীবন দেয়, আপাত-সম্পর্কহীন শব্দসমষ্টি হয়ে ওঠে কবিতা। কিন্তু এই কবি হয়ে উঠছেন সিকিমের ছামব্ হ্রদ।

(পুনঃপ্রকাশিত)

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment