হোসে লেসামা লিমা
প্রথমে একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার, আমাদের দেশে বা অন্যান্য প্রাক্তন ইংরেজ উপনিবেশে সাতটা মহাদেশের মডেল পড়ানো হয়, আমাদের কাছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা দুটি আলাদা মহাদেশ। কিন্তু বাকি প্রাক্তন উপনিবেশে আমেরিকা একটিই মহাদেশ। আমি যেহেতু অইংরেজি আমেরিকার কথাই বলব আপাতত, তাই আমেরিকাকে একটি মহাদেশ হিসেবেই ধরব
এমন এক অঞ্চলে ঢুকে পড়া গেল, যার থেকে বেরনোর রাস্তা আজ অব্দি ইতিহাস জানে না। এসে পড়বে ঔপনিবেশিক প্রশ্ন ও উত্তরহীনতা। এসে পড়বে থিওডর আডরনোর সেই বিখ্যাত আউশউইতশ এর পরে কবিতা লেখা যায় না মার্কা দার্শনিক হাই তোলা, যেন কোনওদিন কোনও উপনিবেশ হয় নি, যেন গণহত্যার নমুনা প্রথমবার দেখা গেল সভ্য দুনিয়ায় সেই গ্যাস চেম্বারে, অথচ উপনিবেশ মানেই এক দীর্ঘ ক্রমপ্রবহমান গ্যাস চেম্বার এবং অবশ্যই কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প তার কথা শুধু উপনিবেশবাসীরাই জানেন, আর জানেন একবার উপনিবেশ হওয়ার অর্থ তার দাগ আজীবন বহন করা অ্যাসিডে জ্বলে যাবার মত। ইউরোপে পা দেওয়া মাত্রই মনে হয় কী সুন্দর! অথচ মেহিকো বা ভারতবর্ষে এলে তা মনে হয় না। সময় লাগে তার সৌন্দর্য খুঁজে পেতে, বিদেশির পক্ষে হয়ত বা সম্ভব নয় পাওয়া। কেন? কারণ বহুরৈখিক হলেও সেই কালিবান ও প্রসপেরো বাইনারি থেকেই যায়। আসতে আস্তে কালিবান বোঝে প্রসপেরোর দেশই সুন্দর। তার সব কিছুই অসভ্য নেটিভ। ফরাশি ক্যারিবিয়ানের মার্তিনিক দ্বীপের কবি এমে সেজেয়ার বা সেনেগালের কবি লেওপোল্ড সেঙ্গর বা নাইজেরিয়ার নিয়ি ওসুন্দারে এক দীর্ঘ উপনিবেশমুক্তির রাস্তায় হেঁটেছেন, অথচ তা মোটা দাগের দেশাত্মবোধ নয়, বরং এক কন্টকাকীর্ণ বোধের মানচিত্র। কিন্তু এই মানচিত্রের একটা অন্যদিকও আছে — এস্পানিওল ও পুর্তুগেশভাষী আমেরিকা। যার কথা আমি শুরু করেছি ওক্তাবিও পাসকে দিয়ে। নেরুদা যে মহাদেশের প্রাণ আবিষ্কার করেছেন ক্রিস্তোবাল কোলনের ( কলম্বাসের ইস্পানো নাম) আসার আগেকার ইনকা সভ্যতায়, ওক্তাবিও পাস যে প্রাণ আবিষ্কার করেছেন আস্তেকা ও মাইয়া সভ্যতায়, সেই মহাদেশেরই আরেক মস্ত প্রাণ কুবা (Cuba) তথা ইস্পানো ক্যারিবিয়ানের কালো মানুষের মিশ্র সংস্কৃতি।
নেরুদার চেয়ে ৬ বছরের ছোট এবং পাসের চেয়ে ৪ বছরের বড়, ১৯১০ সালে কুবায় জন্মানো কবি হোসে লেসামা লিমা ( José Lezama Lima)-র তুলনা আমরা বাংলাভাষীরা সহজেই জীবনানন্দ দাশের সংগে করতে পারি। কারণ ধীর লয়ে তরুণদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন লেসামা লিমা, তাঁর সমগ্র কাব্য ও তাত্ত্বিক গদ্য এবং তাঁর একমাত্র আত্মজৈবনিক উপন্যাস হয়ে উঠেছে কবি জীবনের ম্যানুয়াল, এমনকি তাঁর কবিতা ও তত্ত্বকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ইবেরো আমেরিকার একমাত্র আভাঁগার কবিতা আন্দোলন, যা কিনা সে অঞ্চলের সবচেয়ে সফল কবিতা আন্দোলনও বটে। লেসামা লিমা হলেন সেই প্রথম কবি যিনি শুধুমাত্র ইস্পানোপূর্ব আমেরিকার নস্টালজিয়াতে না ভুগে সরাসরি তুলে ধরেছেন মিশ্র সংস্কৃতির ফল। দেখিয়েছেন আমেরিকার আত্মা তার “বেজন্মা” উৎসব। (এখানে মনে পড়ে যাবে তাঁর প্রায় সমসাময়িক আরেক কুবানো লেখককে, আলেহো কার্পেন্তিয়ের – এর কথা, যাঁর কনসিয়ের্তো বাররোকো উপন্যাসের বাদ্যযন্ত্রী নায়ক প্যারিসে গিয়ে একঘেয়ে বোধ করে, মনে হয় সব কিছু মৃত, সব কিছু প্রাক্তন, অথচ সেইসময়ের ক্যারিবিয়ানে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সঙ্গীতের বীজ, যা বহু পরে রূপ নেবে জ্যাজ বা অন্যান্য কৃষ্ণধ্বনিতে, সে সেই নবজন্মের উত্তেজনা ফেলে, মৃত ইউরোপ ছেড়ে ফের চলে আসে কুবায়।) ।
লেসামা লিমা সম্পর্কে প্রথমেই যেটা আলোচ্য — তাঁর নববারোক রীতি, তাঁর সেই ১৯৫১ সালে প্রকাশিত বক্তৃতামালা La expresión americana ( আমেরিকার স্বর?) যেখানে তিনি শুরু করছেন আজ প্রবাদ হয়ে যাওয়া সেই লাইন “যা কিছু কঠিন তাই উদ্দীপক; শুধুমাত্র প্রতিরোধ আমাদের চ্যালেঞ্জ করে, সে জন্ম দেবার মত শক্তিধর, সে আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণাকে উৎপ্লব করে, বাঁচিয়ে রাখে…” আর এই বিবৃতিই হয়ে উঠবে বিরাট এক প্রজন্মের চাবিকাঠি। জিয়নকাঠি। পাবলো নেরুদার মত সর্বগ্রাসী কবিপ্রতিভা থেকে বেরনোর রাস্তা। কারণ হয়ত লেসামা লিমা ছিলেন রেনেসাঁস-মানুষ — যেমনটা বলেন ইবেত ফুয়েন্তেস, লিমা বিশেষজ্ঞ — তিনি ছিলেন জ্ঞানচর্চা ও শিল্পকে আলাদা না করার মানুষ। তাঁর মাথা, একই সঙ্গে সংশ্লেষী ও বিশ্লেষী। তাঁর মূল শিল্প কবিতায় দেখা গেছে সেই সংশ্লেষী মাথার কাজ। যেমনটামা তাঁর প্রিয়তম বারোক শিল্পরীতিতে পাওয়া যায়। তিনি আমেরিকাকে আবিষ্কার করেছেন বারোকরীতির নব নিরীক্ষাগার হিসেবে। যেখানে ঔপনিবেশিক ঘা শুকনোর একতা প্রধান রাস্তাই হল নিজেদের “বেজন্ম” – কে আত্তিকরণ করা, ইউরোপের ধ্রূপদী ক্লান্তিকে চুষে নিয়ে তৈরি করা এক নিজস্ব শিল্পরীতি। আর এই রীতিই তাঁকে ক্রমশ পরিণত করেছে এক দুরূহ লেখকে। তিনি চাইতেন তাঁর লেখন যেন তাঁর পাঠকের কাছে এক fiesta intelectual এ পরিণত হয়। এক বিশালবপু মানুষ যিনি সারাজীবন খাদ্যরসিক হিসেবে খ্যাত, অন্য দিকে তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যজগতে এক বিশালতনু উপস্থিতি যাঁকে পেরনোর দরকার নেই বরং দরকার আত্তিকরণের। যেমনটা বা আমাদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ। সেই কবি যাঁর প্রতিটা নিঃশ্বাস হয়ে উঠেছে অনুকরণীয়, যাঁর প্রতিটা আড্ডা আজ হয়ে উঠেছে সহস্র স্মৃতিচারণের আধার, যাঁর প্রতিটা অক্ষর হয়ে উঠেছে সংগ্রহযোগ্য। সেই লেসামা লিমা যিনি জীবনে একবারই আবানা ( La Habana) শহরের বাইরে গিয়েছিলেন একবেলার জন্য, সকালে গিয়ে বিকেলেই দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন কেন না বাইরের গাঁইয়া বাতাস তাঁর সহ্য হয় না। বহু সুযোগেও ইউরোপ বা মার্কিন দেশে যান নি, কারণ “ইউরোপ ক্লান্তিকর, মার্কিন দেশ খুব সাদা, আর তাছাড়া আবানার বাইরে গেলে কবিতা মরে যাবে।” শুধু তাঁর খাবার পরিমাণ ও রুচি নিয়েই আস্ত বই লেখা হতে পারে — মারিও বার্গাস যোসা এক সাক্ষাৎকারে সে বর্ণনা দিয়েছেন — তাঁর চুরুটপ্রীতি ও গবেষণা নিয়ে বই লেখা যেতে পারে। অথচ গোড়ার দিকে তিনি ছিলেন নিছক এক অন্যরকম কবি। দুনিয়া তখন নেরুদা আর পাস কে নিয়ে মত্ত। বেরিয়ে গেছে নিকানোর পাররার বই। গোটা আমেরিকা মহাদেশের কবিতা বাঁক নিচ্ছে। বিশেষত চিলে নামক দেশের কবিতা। চতুর্দিকে ক্লোন কবিদের দল হই হই করে তেড়ে আসছে অন্যরকম কবিতার দিকে। তার উপর রয়েছে রাজনীতির প্রথাগত অঙ্ক। প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট কবিই আসল কবি। স্বাধীন বা লিবেরাল চিন্তকরা একেবারেই মানচিত্রে নেই বা ঘৃণার পাত্র যেমনটাবা ওক্তাবিও পাস। সেখানে লেসামা লিমার অন্তর্মুখি কবিতা ও চিন্তা একেবারেই অলক্ষ্যে থাকার। কিন্তু তেমনটা হল না। তাঁর বই দ্বীপরাষ্ট্রের বাইরে গেল। এবং ধীর লয়ে গিলে নিল আস্ত সব প্রজন্মকে। ক্লোন কবি নয়, সমভাবাপন্ন। তারপর সেই আমেরিকার স্বর বক্তৃতামালা। তিনি আস্তে আস্তে হয়ে উঠলেন কবিদের শান্ত গেরিলা নেতা। ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতা নেবার পর কিছুদিন তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে গৃহবন্দি করে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের অনুমতি মেলে, তবে শুধুই তাঁর আত্মজৈবনিক মহাগ্রন্থ পারাদিসো নামক বইটির জন্য। বহু পরে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়, তাও প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক খুলিও কোর্তাসার -এর অনুরোধে। প্রসঙ্গত জানানো দরকার ১৯৮০ সালে কোর্তাসার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে ক্যাম্পাসে অতিথি ছিলেন সৃষ্টিশীল সাহিত্যে। সেখানকার এক ক্লাসে এক ছাত্র উল্লেখ করেন লেসামার, এবং কোর্তাসারকে বলেন তাঁর সম্পর্কে বলতে। কোর্তাসার উত্তরে জানান লেসামাকে নিয়ে বলতে গেলে অনেকগুলো ক্লাস লাগবে। এই কোর্তাসার ছিলেন লেসামার সমসাময়িক অথচ তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল প্রায় গুরু শিষ্যের। কোর্তাসার বিশালবপু লেসামাকে ডাকতেন “মহাজাগতিক মোটু” বলে। মহাজাগতিক কারণ তাঁর দৈনন্দিন কথাও ছিল তাঁর সূক্ষ বারোক নির্মাণের মত। কোর্তাসারই বলেন আদি বারোক রীতি কৃত্রিম নির্মাণ। লেসামাতে এসে সে পরিণতি পেয়েছে। এতটাই পরিণতি পেয়েছে যে পাড়ার মোড়ের পুলিশকেও তিনি গ্রিক দর্শন সহজে বোঝাতে পারেন।
আর এই চর্চার ছায়া এসে পড়েছে তাঁর নির্মাণে — তাঁর নিজস্ব আমেরিকা, মিশ্র অথচ বারোক, বারোক অথচ উপনিবেশের প্রত্যক্ষ ছাপমুক্ত — তাঁকে ড্রাগপ্রতিম করে তুলেছে পরের প্রজন্মের কবিদের কাছে, যার অভিঘাত আজও রয়ে গেছে মহা বিস্ফোরণের মত — যেমন বলে তাঁর কবিতা “ সেই স্বেচ্ছাচারী যে নিজের মায়ের থেকে পালায়” …