হাসনাত শোয়েব

হাসনাত শোয়েবের কবিতাগুচ্ছ

 

 

হারানো সন্তানদের জন্য প্রার্থনা

 

৩৭

পিটার বিকসেলের গল্প থেকেই বেরিয়ে এসেছিল সে বুড়ো। যে চেয়েছিল সব কিছুর নাম বদলে দিতে। ইতিহাসকে সে বদলে দিয়েছিল পৌরনীতিতে৷ তার গল্পে কবিরা হয়ে উঠেছিল সর্বনাশা জুডাস৷ রাজ্যের পর রাজ্য দখল করে নিয়েছিল তারা। হলদে পাখির গায়ে সে পরিয়েছিল কালাশনিকভের জামা। রোদকে সে ডাকত নমরুদ আর তার পৃথিবীতে যুদ্ধগুলো সব ছিল প্রার্থনা। ভাষার এই প্যাচে সে দেবদূতদেরও ফেলে দিয়েছিল বিভ্রান্তিতে৷ দুনিয়াজুড়ে স্থায়ী হতে শুরু করল নিপীড়কদের অত্যাচার। রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্র আচ্ছাদিত হয়ে গেল বিষণ্ণ দেবদারু গাছে। হত্যা, যুদ্ধ, প্রতারণা, জিঘাংসা সবকিছুই লেখা হতে থাকল পুণ্য হিসেবে৷ আর বিশ্বস্ততা, প্রার্থনা, পরোপকারীতার মতো গুণগুলো লেখা হতে থাকল পাপ হিসেবে৷ বিভ্রান্তির এই বাবলেই পৃথিবীর ঘৃণ্য মানুষগুলো পেতে থাকল স্বর্গ আর পুণ্যাত্মাগুলোর ভাগ্যে জুটতে থাকল নরক। আর পুণ্যের আধারেই গোটা পৃথিবী ভরে উঠতে থাকল পাপে। একদিন তার মৃত্যুর সঙ্গে মরে গেল পরিবর্তিত ভাষাটাও। বিমূঢ় ঈশ্বর বিকল্প পৃথিবী হাতে নিয়ে ভুলে গেলেন নিজের ভাষাও।

 

 

৩৮

একটা গম বীজের জীবনী দিয়েই শুরু হয়েছিল গল্পটা। যার বিনাশ না ঘটলে সে থেকে যায় একা, আর বিনাশের ভেতর দিয়েই সে হয়ে উঠে ফলদায়ী। সে ফলদায়ী গম-বীজের খোঁজেই সে চষে বেড়িয়েছিল পূর্ব ইউরোপের সমস্ত অলিগলি। গম-বীজের পরিবর্তে সেখানেই সে খোঁজে পেয়েছিল মানবাত্মার ইতিবৃত্ত। তিন ভাই এবং একজন পিতার গল্প। পিতৃখুনের নৃশংস ঘটনার ভেতর দিয়েই তারা হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তি। সেই ভাইয়েরা মিলেই সৃষ্টি করেছিল দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর। বিচার দিবসে যাদের প্রত্যেককে নিক্ষেপ করা হয়েছিল অনন্ত নরকে। সেই মুহূর্ত থেকে নরক হয়ে উঠে মানুষের পরম আরাধ্য। তার কারণেই আন্দালুসিয়ান যুবকেরা হয়ে উঠেছিল আত্মঘাতী। মধ্য বয়সী এক ব্যাঙ্কার অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্রিজ থেকে। সে আমাদের বলতে পেরেছিল, ‘সুখ স্মৃতির ওপর আর কোনো অমূল্য সম্পদ নেই।’ কিংবা ‘আমরা সবাই যার যার জীবনের কথা একে অন্যকে বলব।’ হায়, কে জানত তার জীবনকথা ছিল মাখনের ওপর ছুরি চালানোর মতো। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে যখন তার জীবনের কথা মনে পড়বে আপনি নিজের অজান্তেই বলে উঠবেন, ‘সারা আকাশ জুড়ে ধূসর পাণ্ডুলিপির রঙ।’

 

 

৩৯

পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু মনে ছিল তার। পড়তে পারত দুর্বোধ্য সব ভাষা ও সিনট্যাক্স। সে ছিল লিওপোল্ড ব্লুমের বউয়ের পরকীয়াজাত সন্তান। তার কথা প্রথম বলেছিলেন বোর্হেস। বলেছিলেন সে একটা দানব, তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছিল সফলভাবে ইউলিসিস পাঠের জন্য। বুয়েন্স এইরেসের উপকণ্ঠে আংশিক জারাথুস্টিয়ান হিসেবেও পরিচিতি ছিল তার। আরণ্যকের খোঁজেই এসেছিল ঘাটশিলার পাড়ে। কিন্তু অতদূর পৌছানোর আগে রেললাইনের ধারেই পেয়েছিল অপু-দুর্গার দেখা। হাত ধরে টানতে টানতে দুর্গা তাকে নিয়ে এসেছিল উঠোনে। অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি দেখে খানিকটা বিরক্তই হয়েছিল সর্বজয়া৷ পিঁড়িটাও একটু এগিয়ে দেয়নি। তবু মুচকি হেসেই বিদায় নিয়েছিল। দুর্গার মৃত্যুর সময় মাথার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। যেভাবে আরও অনেক বছর পর তাকে দেখা যাবে শম্ভনাথ হাসপাতালে। এভাবে পৃথিবীব্যাপী নিজেকে বিস্তৃত করে রেখেছিল দানবটা। যে কিনা স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে অপেক্ষা করে আরেকটি করুণ কমলালেবুর মৃত্যুর।

 

 

৪০

এখানেই শেষ হয়েছিল সব। সূর্য মোমের মতো গলে গলে পড়ছিল মাটিতে। বাতাস নিজেকে বয়ে দিয়েছিল উল্টো দিকে। এই য়েহোশাফাতের পাড়েই শেষবারের মতো ফিরবে সবাই। গলায় সাপের মতো ঝুলতে থাকবে নিজেদের ভাগ্য আর দুই হাতে থাকবে কৃতকর্ম। এখান থেকেই আত্মা ফিরে যাবে তার শরীরের কাছে। আর অনন্ত যাত্রার মুহূর্তে তার মনে পড়বে সবকিছু। ইডেন থেকে আদমের পতন, মরুর বুকে ঝড় তোলা ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ, রাবণের বজ্র নিনাদ, শমী বৃক্ষে লুকিয়ে রাখা অর্জুনের তীর ধনুক এবং হলুদ অবিচুয়ারি লিখে হারিয়ে যাওয়া তাতার দল—সবকিছু। আর মনে পড়বে পিটার্সবার্গের সেই দানবটিকে, হা মুখ করে যে গিলে ফেলেছিল আধুনিক মানুষের আত্মাকে। মনে পড়বে সেই জেরুজালেমের কথাও, যে কিনা য়েহোশাফাতকে বুকে নিয়ে হারানো সন্তানদের জন্য এখনো কেঁদে যাচ্ছে একা একা। সেই কান্নার ভেতর দিয়ে পৃথিবী যখন বিলীন হয়ে যাবে, তখন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু এক জায়গায় মিলিত হয়ে সপ্ত আসমানের দিকে ছুড়ে দেবে নিজেকে। আর শাশ্বত শূন্যতার ভেতর একটি বিন্দুর মতো অনন্তকাল ভাসতে থাকবে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment