সঙ্ঘমিত্রা হালদারঃ রাহুলদা, আগের কথার সূত্র ধরে এবার একটা কথা বলি। ধরো, আমার চারপাশের মানুষজন খুব খারাপ আছেন। সামাজিক স্থিতি বলতে কিছু নেই। তুমি-আমি শাদা চোখে যেমন দেখছি, একজন ‘কবি’ও দেখছেন। তাঁর অনুভূতির তারটা খাদে ও সপ্তকে সমান কার্যকরী, ফলে তাঁর সংবেদনক্ষমতাও তীব্রতম সেখানে। এমতাবস্থায় যিনি ‘কবি’, তাঁর তো অসহায় লাগবেই। যাঁরা, যেসব কবি-লেখক বেছে বেছে প্রতিবাদ করেন, নিশ্চিতভাবেই তাঁদের কথা বলছি না। কিছু- কিচ্ছু হবে না জেনে তিনি হয়ত তাঁর সাধ্যানুযায়ী একটা বিরুদ্ধতার রাস্তায় হাঁটতে চাইবেন। হয়ত কেবল তাঁর মুক্তির জন্যই। সেটা হতে পারে তাঁর কলমকে হাতিয়ার করে। হতে পারে রাস্তায় নেমে। যেমন ধরো, রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সময়টার কথা ভাবো। একদিকে দেশের পরাধীনতা। অন্যদিকে তাঁর জীবৎকালে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা। অনেকক্ষেত্রেই দেশের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের সঙ্গে নিজের মতের বিরোধ লক্ষ করে একটার পর একটা লেখা তৈরি করছেন। ভুল বোঝাবুঝিতে কষ্ট পাচ্ছেন। শেষপর্যন্ত লেখাতেই আবার দম নিচ্ছেন। বেশকিছু ক্ষেত্রে তাঁর সেই সমালোচনা পরবর্তীকালে অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে ঠাহর হয়েছে। যেমন,জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড নিয়ে নাকি গান্ধিজিকে জানিয়েছিলেন—বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে। কিন্তু গান্ধিজি প্রথমে রাজি হন নি। কলকাতার নেতাদেরও সেসময় জানিয়েছিলেন প্রতিবাদ আন্দোলনে যেতে, তিনি নিজেও অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতার নেতারা নাকি সে দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের উপরেই চাপাতে চেয়েছিলেন! রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবী’কে জানাচ্ছেন গান্ধিজি’র নাকি সেসময় ইংরেজদের সঙ্গে একটা সুবিধের আলোচনা চলছিল, তাই প্রথমে আন্দোলনে যেতে রাজি হননি। পরে সে আলোচনা ভেস্তে গেলে আবার আন্দোলনের পথে হাঁটেন। আর রাজনীতির এই দরকষাকষির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই শান্তি পাননি, যতক্ষণ না ভোররাত অব্দি জেগে ‘নাইট’ উপাধিটা ফিরিয়ে দিতে চেয়ে ইংরেজ বাহাদুরকে চিঠিটা লিখে ফেলছেন। এই অসহায়তা তো মানুষ মাত্রেই থাকবে। আর ‘কবি’ যেহেতু সংবেদনশীল, তার তো থাকবেই! ফলে রবীন্দ্রনাথের যে ‘সামাজিক জোব্বা’টার বলছিলে, সেটা তো সময়ের ফসল! সময়ের অসহায়ত্ব! আর সংবেদনশীল মানুষ বা কবি এই অসহায়ত্বের হাত ছাড়িয়ে কোথায়ই বা যাবে? কেউ লেখায়। কেউ রাস্তায়। দরকষাকষি-হিশেব নিকেশের দাঁড়িপাল্লা সেখানে কাজ করে যদিও, অন্তত বর্তমান সময়ের নিরিখে। তবু কোনও লেখক বা কবি’র হাতে মাত্র দুটোই তো পথ! তাই নয় কি? আর সময় কি আদৌ মনে রাখে কার প্রতিবাদে দাঁড়িপাল্লা ছিল, বা ছিল না?
রাহুল পুরকায়স্থঃ প্রতিবাদের দাঁড়িপাল্লা বলে আদৌ কিছু হয় কিনা আমি জানি না। শঙ্খ ঘোষ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, আগুণ হাতে প্রেমের গান। আমার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এমনকি প্রত্যেক কবি শিল্পীও সারাজীবন আগুণ হাতে প্রেমের গান গেয়েই চলেন। একটু খেয়াল করলেই হয়ত বুঝতে পারব যে প্রেম প্রতিবাদ ও মৃত্যু ছাড়া ইহজীবনে কোনও সৃষ্টিই সম্ভব নয়। আবার প্রতিটি মৃত্যুই কোনও না কোনওভাবে হত্যা। মানুষ যেকোনও হত্যারই বিরোধিতা করে। তবে তুই যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগ বললি এরকম রাষ্ট্রিয় নিপীড়ন বীভৎসভাবে নেমে এলে কবি-শিল্পী চেতনাসম্পন্ন মানুষ আরও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বেশিদূর যেতে হবে না সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমঙ্গের নন্দীগ্রাম হত্যাকান্ডের পর এই বাংলার অনেক কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী সরকারি পদ ত্যাগ করেন এবং সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দেন। কবি-শিল্পীরা মুখরতর হয়ে ওঠেন, যেমনটি হয়েছিল নকশাল আন্দোলন বা জরুরি অবস্থার সময়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ রাহুলদা, ১ম পর্বের সাক্ষাৎকার পড়ে সরোজ দরবার তোমার প্রতি একটা প্রশ্ন রেখেছে। ‘Letters to a Young Poet’—রাইনের মারিয়া রিলকের এই বইটা সম্পর্কে তোমার কী মত?
রাহুলঃ একসময় তো ভীষণভাবে বিশ্বাসী ছিলাম। তবে যতো বয়স বাড়ে না… এই বইগুলির মধ্যে একপ্রকার আলোছায়া কাজ করে। বিশ্বাসচ্যুতি ঘটে। তবে এখনো আমার মনে হয়, তরুণ কবির প্রতি চিঠিটা একটা জরুরি পাঠ্য। তারপর, সেটা তুমি মেনে নিলে কী নিলে না, যাপনের অঙ্গ করলে কী করলে না সেটা অন্য প্রশ্ন। এমন একটা বই যা তোমাকে পড়তেই হবে। তুমি নিজের অজান্তেই হয়তো পড়ে ফেলেছো, যদিও বইটা হয়তো পড়োনি! এটাই তো হয়! বিভিন্ন লেখা আমরা বিভিন্ন জায়গায় পাঠ করি। তারপর বইতে দেখে চমকে উঠি। এই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াই বইয়ের কাজ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ তোমার কি কোথাও মনে হয় যে বইটাতে নীতিজ্ঞান বিতরণ করা হয়েছে?
রাহুলঃ একজন মানুষ যা ভাবেন, তাই তো লেখেন। সেটা পরে হয়তো কারো কাছে নীতিজ্ঞান মনে হতে পারে। এই বইয়ের পেছনে কোনো প্ররোচনা আছে কিনা জানি না আমি, তবে একটা মানুষের ভাবনা হিসেবেই আমি পড়েছি এটা।
সঙ্ঘমিত্রাঃ রাহুলদা, একটা কথা বলি—সব জিনিষেরই তো একটা প্রোডাক্টিভ ভ্যালু আছে। তোমার কী মনে হয়—কবিতার কোনও প্রোডাক্টিভ ভ্যালু আছে? তুমি বিশ্বাস কর এরকম কোনও ধারণায়?
অনিমিখ পাত্রঃ যদিও তুমি বলেছো যে কবি বিনোদনশিল্পী নয় …
রাহুলঃ প্রোডাকশন তো বিভিন্নরকম হয়! ধরো, আমি যদি আমার মনটাকে প্রোডাক্ট মনে করি। এর মূল্যটা আমার বেঁচে থাকায়। সেটাকে আমি বিক্রি করছি না কিন্তু! কবিতাও এইধরণের একটা অনুভূতি। এটা বড়ুয়ার কেক নয়।
অনিমিখঃ বাজারি অর্থে যদি ধরো… তুমি একটা কবিতার বই ছাপছো… তারপর সেটা…
রাহুলঃ সেটা অন্য জিনিষ। প্রথমত, কবিতার বই খুব অলাভজনক। কেউ পয়সা দিয়ে করেন কেউ করেন না। যাঁরা করেন না, তাঁরা কোনো রয়্যালটি পান বলে মনে হয় না। খুব কম প্রকাশক রয়্যালটি দেয়। বই বিক্রি হয় না, রয়্যালটি দেবে কোত্থেকে? কবি নিজের বই নিজেই কেনেন, কিনে বিলোন। ভাবতে খারাপ লাগে, ২০১৭ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই বিক্রি হয় না। কাদের বই বিক্রি হয়? যারা সোশাল মিডিয়ায় খুব জনপ্রিয়। সোশাল মিডিয়া আমার কাছে খুব মারাত্মক একটা ক্ষতিকারক জায়গা বলে মনে হয়। যে যা লিখছে তুলে দিচ্ছে এবং সবাই লাইক দিয়ে দিচ্ছে। হাজার হাজার লাইক। কোনো একটা ঘটনা ঘটলো তো সঙ্গে সঙ্গে কবিতা। লক্ষ লক্ষ শেয়ার হচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয় এঁরা এজেন্ট পোষেন কিনা! আবার আরেকটা ব্যাপার আছে। শ্রীজাত’র কিছু কিছু লেখা আমার খুব ভালো লাগে। শ্রীজাত খুব পপুলার ফেসবুকে। আমার সমস্যা শ্রীজাতকে নিয়ে নয়। ওখানে কোনো এক ভদ্রলোক শ্রীজাত কবিতা লিখলেই পাঁচ-ছ’লাইনের কমেন্ট করেন। এই কমেন্টটা যেন ক্রিয়েটেড প্রসেস। পড়লে বোঝা যায়…’আপনি আছেন বলেই কবি আমি বেঁচে আছি’ … ‘আপনার ভাষাই আমাকে প্রাণ দেয়’ … এইরকম। রোজ কমেন্ট করেন। একসময় মাসখানেক আমি রোজ দেখতাম। যেদিন কমেন্ট করলেন না ভদ্রলোক, সেদিন আমার ভয় করলো … মারা গেছেন কিনা! আমাদের মনে রাখতে হবে, নিয়মিত লাইকে দ্রব্যগুণ নষ্ট হয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কীরকম?
রাহুলঃ যেমন ধরো, শালা শালা শালা এই শব্দটা বারবার ব্যবহারে— আগে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হত, আর হবে না। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা চমৎকার কথা ছিল ‘তিনপয়সায় পালা’য়—(উঠে গিয়ে বই পেড়ে এনে) “ক্রমাগত ব্যবহারে যেমন ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি ক্রমাগত শুনতে শুনতে এসব ভালো কথার গুণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই… যেমন ধরুন, এই কিছুদিন আগে একটা বড় চল হয়েছিল; ‘দেশের জন্য প্রাণ দাও। আরেকটা হয়েছিল ‘গুজব ছড়াবেন না’। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একটা ভালো কথা বেশিদিন চলে না। কিছুদিন পরেই আর কেউ দেশের জন্য প্রাণ দেয় না। কিছুদিন পরেই সবাই গুজব ছড়াতে লেগে যায়। তারপর যেই বললেন দেশের জন্য প্রাণ দাও অমনি সব দাঁত বের করে হাসে। এই তখন আরেকটা নতুন ভালো কথা খুঁজতে হয়। বুইলেন, এই হচ্ছে যাকে বলে ‘সফলতার মূলধন’।“
অনিমিখঃ আমি আবার কোনো কোনো কবিকে জানি, তাঁরা নিজেদের ফেক প্রোফাইল খুলে রেখেছেন। সেখান থেকে গিয়ে নিজেদের প্রশংসা করে আসেন।
রাহুলঃ ফেসবুকে কবিতা দেওয়া মানে হচ্ছে তাকে সামাজিকীকরণ করা।
অনিমিখঃ কিন্তু রাহুলদা এ নিয়েই তো আমাদের চলতে হবে। কারণ কোনো টেকনোলজিকাল অ্যাডভান্সমেন্টকেই তুমি ফেলে দিতে পারবে না…
রাহুলঃ সে তো আমরা সারা জীবনটাই এমন অনেক জিনিষ নিয়ে চলেছি যা নিয়ে না চলতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে চলেও খুব একটা যে খারাপ কিছু করেছি তা নয়। কিন্তু স্বীকার অস্বীকারের অধিকার তো আমার আছে! প্রথমত, ফেসবুকে কবিতা পড়তে আমার অসুবিধা হয়। কাগজে যতক্ষণ না পড়ছি সমস্যা হয় একটা। দ্বিতীয়ত, কবিতা বিভিন্নরকম হতে পারে। কিন্তু হয়তো আমার সীমাবদ্ধতা যে আমার নির্দিষ্ট কিছু ধরণের কবিতা ভালো লাগে। নির্দিষ্ট কিছু কবির কবিতা পড়তে ভালো লাগে। একজন কবিকে যদি আমার মনে হয়, ইনি আমার কবি, এর লেখা আমার ভালো লাগছে… তাহলে কিন্তু সারাজীবন আমি তাঁর লেখা লক্ষ্য করবো। তাঁর লেখা তখন আর আমার কাছে ভালো বা খারাপ না… তাঁর লেখা আমার কাছে তখন প্রয়োজনীয়। তিনি কোন্ পথে হাঁটছেন… তাঁর পথটাকে অনুসরণ করছি আমি। এই লাইসেন্সটুকু আমি চাই। তারপরে তো অন্য অন্য প্রশ্ন আসবে। আমরা বাঙালিরা… হিন্দু-মুসলিম দুইই… আমরা হলাম মহাকাব্যের সন্তান। কোরান খুব উৎকৃষ্ট কবিতার বই বলে মনে হয় আমার। তার যে ভাষা! ইসলামি বাংলা! আমার সঙ্গে মাঝেমাঝে আবুল বাশারের কথা হয়। বাশারের গদ্য আমি খুব পছন্দ করি। খুব একটা মুসলিম মহল্লার গন্ধ আছে। আমাদের মহাভারত এর ভাষা। অন্য একটা মেজাজ দেয়। প্রাকৃতিক বর্ণনা! ভাবা যায় না! সেই ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার আমরা বহন করছি কিন্তু। এখন, জোর করে মনে রাখার তো ব্যাপার নেই। লেখা হচ্ছে খুব সহজ কাজ। একটা কাগজ কলম নিলাম আর লিখে ফেললাম। দশটা বন্ধু তোমার, আটজন বলবে ‘অসামান্য কবিতা!’ এর মধ্যে একজন বন্ধু হয়তো কোনো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। তিনি তলায় নোট দিয়ে তোমার পাঁচটা কবিতা ছেপে দিলেন। তারপর সবাই হাততালি দিতে শুরু করলো। তোমার আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা হলো। তখন তুমি মঞ্চে মঞ্চে ঘুরছো। শীতকালে কবিরা খুব হাততালি পান। কে হাততালি পাচ্ছে… কে পাচ্ছে না… এই নিয়ে মনখারাপ মনভালো… একটা জমজমাট জিনিষ তৈরি হয়।
অনিমিখঃ আরেকটা মজার জিনিষ লক্ষ্য করি। ‘এই আজকাল সব মঞ্চসফল কবি’ … ‘সব ধান্দাবাজিতে ছেয়ে গেছে’ – এই একটা কমন সমালোচনার সুর। যে ধান্দাবাজি করছে সেও বলছে ‘ধান্দাবাজিতে ছেয়ে গেছে!’ মানে সবাইই বলছে। তাহলে করছেটা কে ?
রাহুলঃ আসলে যখনই কবিতা পারফর্মিং আর্ট হয়ে যায় না… তখনই এটা হবে! পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে এই কম্পিটিশনটা থাকে। একটা বই পড়া নিয়ে এসব হয় না। সেটা একটা নিভৃতির ব্যাপার।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা রাহুলদা তোমার কবিতার পাঠকদের কি চিনতে ইচ্ছে করে?
রাহুলঃ মাঝে মাঝে করে। আমি খুব অনিশ্চয়তায় ভুগি। লেখাটা আদৌ কিছু হলো কিনা… কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো কিনা… । আমি অর্থ খোঁজার চেষ্টাও করি না। কিন্তু যিনি পড়ছেন তার মনের সঙ্গে কীভাবে সংযোগ করছে, জানতে ইচ্ছে করে। কেউ আমার কবিতা পড়লে অবশ্যই ভালো লাগে। তবে জনপ্রিয় কবিতা আমার অনেকটা জনপ্রিয় বস্ত্রালয়-এর মতো লাগে। আগে দোকানে লেখা থাকতো না ‘পরীক্ষা প্রার্থনীয়’, ওইটা খুব জরুরি। জনপ্রিয়তার সঙ্গে সাহিত্যের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাটা খুব নৈতিক নয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ যে কোনো শিল্পের ক্ষেত্রেই…
রাহুলঃ শিল্প যদি সুলভ শৌচালয় হয় তাহলে খুব চাপের বিষয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনো মাধ্যমে তোমার যেতে ইচ্ছে করে?
রাহুলঃ একসময় খুব ইচ্ছে হতো শর্ট ফিল্ম তৈরি করার। এখন অবশ্য সেই ইচ্ছেটা চলে গেছে। আমার মনে হয়, শর্ট ফিল্ম কবিতার খুব কাছাকাছি। কিন্তু এখন সবাই যেমন কবিতা লেখে, সবাইই শর্ট ফিল্ম বানায়! সবাই বানালে পরে মনে হয়, আমি আর কী বানাবো? আমি যেহেতু পেশাগত দিক থেকে দীর্ঘদিন অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম… এখনো মানসিকভাবে ওইজায়গাতেই থাকি। ফলে আমার চোখের সামনে ছবি তৈরি হয়…ধরো, রেড রোড দিয়ে একটা বাস আসছে। খুব ভীড় বাস, চাপাচাপি হচ্ছে। হঠাৎ বাস থেকে একটা বল গড়িয়ে নামলো। দেখা গেল, এক মা তার ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে। ছেলেটা নেমে সেই বলটা কুড়ালো। ছেলেটা বলটা নিয়ে রেড রোডের ওদিকের মাঠটায় যাবে। যতবারই সে রাস্তা পেরতে যাচ্ছে… হয়তো কোনো ভেড়ার পাল চলে আসছে… কখনো ট্যাক্সি চলে আসছে… তার হাত থেকে বলটা পড়ে যাচ্ছে… একটা সময় সে মরীয়া হয়ে রাস্তা পেরতে গেল… একটা বাস এসে ভয়ঙ্কর ব্রেক কষে থামলো তার সামনে… আমি, দর্শক, মনে করছি এই বুঝি মারা গেল চাপা পড়ে… বাসটা বেরিয়ে যায় আর দেখা যায় যে ছেলেটা হাসতে হাসতে বলটা নিয়ে মাঠে নেমে যাচ্ছে। এটা আমার কাছে একটা শর্ট ফিল্ম। কথা নেই বার্তা নেই, কিন্তু এমন মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে যে আমার দম কখনো বন্ধ হচ্ছে কখনো ছাড়ছে। একটা প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সে প্রশ্নটা যে কী আমি জানি না! এরকম অনেকক্ষেত্রেই সারা জীবনযাপন ঘিরেই আমার মনে হয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ প্রশ্ন না সংকেত?
রাহুলঃ প্রশ্ন। সংকেত থেকেই প্রশ্ন তৈরি হয়। কবিতা এবং ছবি – ফিল্ম বলো বা পেইন্টিং – এদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। একটা কবিতা একটু পিছলে গেলেই হয়তো পেইন্টিং হয়ে যেতে পারে। বা একটা ফিল্ম একটু অন্যরকম হলেই কবিতা হয়ে যেতে পারে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিয়ারোস্তমি’র যেমন …
রাহুলঃ হ্যাঁ, পুরোটা পোয়েট্রি। কুরোসাওয়া। তারকোভস্কি, ফিল্ম নয় কবিতা দেখছি বলে মনে হয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ বা কিয়েসলস্কির শর্ট ফিল্মগুলো… বা ট্রিলজি…
রাহুলঃ আহা! ওই যে ‘এ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’। দুরন্ত! ফলে, এই একটা মাধ্যম আরেকটা মাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে লেগে আছে। খুব মৌলিক মাধ্যম বলে তো কিছু নেই! আমাদের জীবনযাপনটাই তো মৌলিক নয়! মৌলিক কবিতা বলে কি কিছু হয়? আমি তো ভুঁইফোঁড় কেউ না। আমার কবিতার মধ্যে খোঁজ করলে দেখবে তার মধ্যে শক্তি আছে, উৎপল, শঙ্খ, হয়তো মাইকেল কিছুটা – অনেকে আছেন। ভারতচন্দ্রও থাকতে পারেন। আমার তো একটা উত্তরাধিকার আছে!
অনিমিখঃ তোমার উত্তরাধিকার রমেন্দ্রকুমারের কাছে অনেকটা বলে আমার মনে হয় …
রাহুলঃ হ্যাঁ, আছে। রমেন্দ্রকুমার আমার খুব প্রিয় কবি। একটা মজার ঘটনা আছে। তখন আমি জানতাম না যে রমেন্দ্রকুমার আমার কবিতা পছন্দ করেন। একটা পত্রিকা ছিল ‘প্রতিক্ষণ’, সেরকম বাংলায় আর হয়নি। তো, প্রতিক্ষণ থেকে রমেন্দ্রকুমার আমায় একদিন ফোন করলেন – ‘আমি প্রতিক্ষণ এ আছি। আপনার কবিতাগুলি পড়লাম। আমার একটা অনুরোধ আছে, সে অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।‘ রমেন্দ্রকুমার তো একটা বিরাট ব্যাপার। তো, গেলাম। বললেন, অনুরোধটা হচ্ছে… আমি একটা গাড়ি কিনেছি … মারুতি ভ্যান… আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবো। বলে উনি সেই গাড়িতে চাপিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। রমেন্দ্রকুমার আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। বাংলা কবিতায় যে এরকম লেখা হতে পারে… সংকেতপ্রধান লেখা… অনেকসময়ই যে লেখার কোনো পাঠক নেই। নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজের সঙ্গে কথা বলাটা না খুব জরুরি। পরের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেই তখন কবিতা সামাজিক প্রতিবাদী এইসব হয়ে যায়…
অনিমিখঃ খুব সচেতন স্তরের কবিতা এইগুলি। আমার মনে হয় কবিতা বেশির ভাগই সচেতন স্তরের তলায় থাকে…
রাহুলঃ হ্যাঁ। একটা মানুষ তো নিজের সঙ্গে কথা বলে! বিড়বিড় করে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ মানে, ধ্যানটা কম বলতে চাইছো ?
রাহুলঃ তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরো, জীবনানন্দ যখন লিখে যাচ্ছেন- ‘সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি …’ আসলে কিন্তু নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। সুরঞ্জনা নামক কোনো প্রেমিকাকে বলছেন বলে মনে হচ্ছে না। নিজের মধ্যেই ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ধরো, লোকগান। বাংলা কবিতার সঙ্গে লোকগানের ভীষণ সম্পর্ক।
সঙ্ঘমিত্রাঃ একদম। তোমার নিজের কবিতায় বিশেষ করে বাউলপ্রভাব তো আছেই।
রাহুলঃ আমার খুব প্রিয় হচ্ছেন হাসন রাজা। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, লালন না হাসন … কোনো তুলনা হয় না। তবে আমার হাসনের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব একটু বেশি। লালনের যে জীবনচর্যার বাতাবরণ তার মধ্যেএক আশ্চর্য আধ্যাত্মিকতাও ছিল। ওই জগতের মধ্যে থাকতে থাকতে একটা অন্য মেটাফর তৈরি হয়। কিন্তু হাসন হচ্ছে একমাত্র লোক যে চূড়ান্ত ভোগী। অত্যাচারী জমিদার। এমন গল্পও আছে— ওই গ্রামে কোনো মেয়ে বিয়ে করে এলে প্রথমে হাসনের সঙ্গে শুতে হতো। উনি মেয়েদের নিয়ে বজরায় উঠতেন। ফুর্তি করতেন, নাচতেন এবং গান লিখতেন। ওটা একটা প্রসেস ছিল কিন্তু! একসময় হয় কী… গ্রামের মহিলারা এসে হাসনের মায়ের পায়ে পড়েন যে আমাদের বাঁচান। একদিন বসে আছে হাসন দাওয়ায়… পালকি করে নতুন বউ আসছে। তো সে বউ হাসনের ঘরে আসে নিয়মানুযায়ী… হাসন বলেন, সুন্দরী বোরখা তোলো তো দেখি। তিনি তোলেন না। তো, হাসন নিজের হাতে বোরখা তুলে দেখেন যে মা! তারপর একটা অন্য হাসন রাজা!এই যে, ‘কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যেরও মাজার…লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা না আমার’ – এই অনুভূতির জন্য না একটা জীবনযাপন চাই। বলছেন, ‘দেখিয়া তার রূপের চটক/ হাসনের মন হইল আটক… মাইল মাইল মাইল মাইল মদনে…’ এ্যাঁ! কবেকার লেখা! মাইল মাইল ভালোবাসা! দ্যাখো ( বই খুঁজে নিয়ে এসে ), বলছেন – ‘আসে না মোর মায়ের আগে / দ্যাখো যে লক্ষণছিরি ( গ্রামের নাম )/ হাসন রাজার সন্ধান আছে / যম কি আসবে তার কাছে? / প্রাণ দিয়েছি হরি’র কাছে / যম কারে নিবে ধরি?’ এই যে, হরি কাকে ধরবে! এর মধ্যে না এক অদ্ভূত সন্দেহ আছে! পূর্ববাংলায়… আমাদের এখানেও… কৌম সমাজের… কায়িক শ্রমকে লাঘব করার জন্য… আনন্দকে উপভোগ করার জন্য… এদের মধ্যে না ভীষণভাবে কবিতার এলিমেন্ট রয়েছে। সেগুলি বাংলা কবিতায় ব্যবহারও হয়েছে। ধরো, শক্তির কবিতায় রবীন্দ্রনাথের গানের ভীষণভাবে প্রভাব রয়েছে। সুনীলদা’র তো হাসনকে নিয়ে লেখাই আছে। তুমি দেখবে, এই লোকগান শুধু গলা নয়, তার চেয়েও বেশি শরীর দিয়ে গাওয়া হয়। ফলে, বিভিন্ন ভঙ্গিমা তৈরি হয়। এগুলো তো একপ্রকার ছন্দ। এগুলো কোনোভাবে আমাদের সাহিত্যে ছবিতে এসে ঢোকে। অনেকসময় শিল্পী নাচতে নাচতে ছবি আঁকেন। আসলে হয়তো ওই রিদম্টাকে ধরার জন্য নাচতে নাচতে আঁকছেন। কেউ কেউ আবার প্লাগের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে একহাতে কারেন্ট খান, অন্যহাতে রঙ চাপান। এই যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে… শরীরের মধ্যে একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া কাজ করছে। কেমন জানো তো, অন্ধের বর্ণনার মতো। অযৌনের যৌনতা যাকে বলে। একজন জন্মগত অন্ধকে যদি জিজ্ঞেস করো, লাল রঙটা কেমন, সে যা বলবে… আমার মনে হয়, শিল্পের জগতটাই পুরো অন্ধের দর্শনের জগত।
অনিমিখঃ ইংরেজিতে ‘সাইনেস্থেশিয়া’ যাকে বলে আর কী… এলিমেন্ট বদলে বদলে যায়… মানে, গন্ধের হয়তো রঙ পাওয়া গেল… শব্দের হয়তো ঘ্রাণ…
রাহুলঃ হ্যাঁ, শব্দের রঙ আছে। সে রঙ সময়ান্তরে এবং আমাদের মেজাজান্তরে পালটে পালটে যায়। ‘শালি’ শব্দটা কোথাও আদর আবার কোথাও খিস্তি!
অনিমিখঃ তখনই বোধহয় লেখার ক্ষেত্রে নতুন শব্দেরও জন্ম হতে পারে। যাকে সচেতন মন দিয়ে ধরা যাচ্ছিল না। যার অর্থ সেভাবে মানেবইতে লেখা যাবে না।
রাহুলঃ নতুন বোধের জন্ম হচ্ছে তো! বোধ তো শব্দকে তাড়িত করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যে দেখবে। বোধটাই একটা পরিবেশ তৈরি করছে। কাহিনি লিখতে লিখতেই কখনো কবিতায় ঢুকে যাচ্ছেন, কখনো নাচে ঢুকে যাচ্ছেন! বিভিন্ন মাধ্যমে!
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা রাহুলদা, বাংলা কবিতায় বহুদিন ধরেই একটা তত্ত্ব সম্বন্ধিত সচেতনতা কাজ করছে। তোমার কী মনে হয়?
রাহুলঃ খুব স্পষ্টভাবে বলি। আমরা যখন লেখালিখি করতে আসি, উত্তরাধুনিক বলে একটা জিনিষ খুব চালু হয়েছিল। আমার খুব প্রিয় কবি অমিতাভ গুপ্ত, যার অনেক লেখাই… বিশেষত দুটো বই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্তর দশকে অনেকের নামটাম বলা হয়… দুজনের নাম একটু চেপে দেওয়া হয় – একজন অমিতাভ গুপ্ত, আরেকজন তুষার চৌধুরি। তুষার চৌধুরি অন্য স্পেল, আদ্যোপান্ত কবি একজন! কিন্তু, অমিতাভ গুপ্ত-ও ভীষণ প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ‘মাতা ও মৃত্তিকা’, ‘খরা ও যমুনা’ বা ‘বুলন্দ দরওয়াজা’র মতো দীর্ঘকবিতা… যেখানে বলছেন – বিজেপি’র ভোটচিহ্ন জেনে বা না জেনে/ আঁজলা ভরে যমুনা থেকে পদ্মফুল তুললেন আসমান বিবি।
অনিমিখঃ খুব রাজনীতি সচেতন…
রাহুলঃ ‘মাতা ও মৃত্তিকা’য় আছে –আমার সর্বস্ব বলতে পোড়া হাঁড়ি, কানাভাঙা থালা, একপেট খিদে / তাই নিয়ে বসে পড়ি, যখন যেখানে পারি, যেমন সুবিধে / ভারতগাথায় আমি বিস্ময়চিহ্নের মতো / মা গো, ফ্যান দাও। লেখাটার নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। কী নতুন ব্যাখ্যা! এবং ওই যে গোপীবল্লভপুর… ‘নীলাভ জয়, কাঁটাতারের বেড়া / অপরাজিতায় জড়িয়ে আছে পুরনো বন্ধুরা’। কিন্তু যে মুহূর্তে উত্তরাধুনিকের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন না… তখন কবিতা থেকে ডিপার্চার শুরু হলো। তখন তো তিনি তত্ত্বকথা বলছেন। উত্তরাধুনিকের সে সঙ্কলনের বিভাব কবিতাটা ছিল আমার। সেই সঙ্কলনে ভাস্কর চক্রবর্তী ছিলেন, কিন্তু জয় গোস্বামী ছিলেন না। কেন ছিলেন না? কোনো ব্যাখ্যা নেই কিন্তু! এই তত্ত্বগুলি এতো পিছল… এতো অস্থিরমতি… শেষপর্যন্ত কোথাও গিয়ে দাঁড়ায় না।
অনিমিখঃ এই ‘অস্থিরমতি’ টা খুব দুর্দান্ত বললে! আমরা তো জানি যে, তত্ত্ব একটা নির্দিষ্ট ভিত্তিভূমিতে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করবার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু আসলে তারা নিজেরাই অস্থিরমতি!
রাহুলঃ ফলে, সারা পৃথিবীতে কী হয়েছে আমি জানি না, বাংলা সাহিত্যে কোনো আন্দোলন না টেকেনি! ধরো, আমরা ছাপ দিয়েছি ‘হাংরি’! বাসুদেব দাশগুপ্তের মতো গদ্যকার কোন্ সাহিত্যে ক’টা আছে? তিনি যদি হাংরি না হতেন তো কী আসতো যেতো? ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ – এই বই লেখার জন্য মলয় রায়চৌধুরির হাংরি হতে লাগে না। বা সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষির গলি’।
অনিমিখঃ তাহলে, এইসমস্ত তত্ত্বনির্ভর আন্দোলনগুলো গড়ে ওঠে কেন?
রাহুলঃ সেই সময়কালে আমার বা আমার গোষ্ঠীর প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য! যদিও কৃত্তিবাসের তেমন কোনো তত্ত্ব ছিল না।
অনিমিখঃ সেজন্যই বোধহয় কৃত্তিবাস অনেক বেশি টিকেছে!
রাহুলঃ হ্যাঁ। হাংরি শ্রুতি একটাও টেকেনি।
অনিমিখঃ ইতিহাসে নাম লেখাবার একটা প্রবণতা বোধহয়…
রাহুলঃ হ্যাঁ, ‘আমরা আলাদা’! কিছুই আলাদা না!
অনিমিখঃ মণীন্দ্র গুপ্ত সম্ভবত বলেছিলেন যে, প্রত্যেকটি সাহিত্য আন্দোলনের একটিই সফলতা যে তারা কিছু শাশ্বত কবিতার জন্ম দেয়। যারা কবিতার মূলস্রোতের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
রাহুলঃ ফলে, হাংরি না হলেও বাসুদেব দাশগুপ্ত শৈলেশ্বর ঘোষ অরুণেশ ঘোষ এঁরা লিখতেন। অরুণেশের জীবনানন্দকে নিয়ে ওরকম একটা বই… যেকোনো সাহিত্যের গর্ব হতে পারে। তাঁর ওই কবিতা… গল্প… একটা অন্য জগত ছিল! এখন না আবার এইরকম অন্য ধরণের বইপত্র পড়াটা শুরু হয়েছে। আমরা যখন এসেছিলাম, আমাদের দাদারা অন্যরকম পথ দেখিয়েছিলেন… তুমি বুদ্ধদেব গুহ পোড়ো না, সন্দীপন পড়ো। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় পোড়ো না, দেবেশ রায় পড়ো। ফলে, আমাদের শুরুতেই অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছিল। অনেক বেশি বয়সে বুদ্ধদেব গুহ পড়তে গিয়ে দেখেছি, চোখে জল চলে আসে! কিছু কিছু জায়গায় কবিতার মতো বর্ণনা। কতো বড়ো লেখক আমি জানি না, কিন্তু চোখে জল আসছে কেন? ঋভু… মাধুকরী… এই যে কেউ তোমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে…
অনিমিখঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে কে বারণ করতো? এই যে বইটা ( ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ দেখিয়ে ), এটা তো বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ …
সঙ্ঘমিত্রাঃ একটা বিশেষ ঘরাণার দিকে চালিত করা আর কী…
অনিমিখঃ কিন্তু সন্দীপন তো সে অর্থে প্রগতিশীলদের মধ্যে পড়েন না!
রাহুলঃ না, কিন্তু প্রগতিশীলদের গা ঘেঁষা! সন্দীপনদার লেখা আমার ভালো লাগে। ‘বিজনের রক্তমাংস’ অসাধারণ একটা বই। কিন্তু উনি তো খুব সচেতন ভাবে লিখতে চেয়েছিলেন- আমি সৃষ্টিকর্তা! এই সৃষ্টিকর্তা হলে কিন্তু মুশকিল আছে।
অনিমিখঃ সন্দীপনের একটা দুর্বলতা আমার মনে হয় যে, উনি একই কথা এতোবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছেন যেন তাঁর জীবনে আর কিছু তৈরিই হয়নি!
রাহুলঃ আমাদের সময়ে না, প্রতিষ্ঠান বলে একটা জিনিষ খুব চালু ছিল। এখন ডাইল্যুটেড। এখন সবাই প্রতিষ্ঠান। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তিন পয়সার পালা’য় একটা গান ছিল – ‘চেষ্টা করলে হাঙরেরও দাঁত দেখতে পাবে / কিন্তু যখন মহীনবাবুর ছুরিটা চমকাবে / কেউ দেখতে পাবে না পাবে না…’ এই তো প্রতিষ্ঠান! এরা সবজায়গায় বিরাজ করে। লিটল ম্যাগাজিন কি প্রতিষ্ঠান নয়? হ্যাংলা প্রতিষ্ঠান। হাঁ করে বসে থাকে, কবে দেশ বলবে ‘কী দারুণ!’, কবে শঙ্খ ঘোষ বলবেন ‘এই একটা পত্রিকা!’ ফলে, এটা যেন ওপরে ওঠার একটা সিঁড়ি। ভণিতাসর্বস্ব।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মধুসূদন যখন পয়ারের কাঠামোয় অমিত্রাক্ষরে তিন মাত্রায় যতি দিলেন, এটা তো সেই সময়ে অদ্ভুত অভিনব ব্যাপার! বা, জীবনানন্দের অক্ষরবৃত্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা …তাঁর অক্ষরবৃত্তের মাত্রা কেবল চোদ্দো বা আঠারোয় থামছে না, তাঁর অক্ষরবৃত্তের মাত্রা প্রায়ই ছড়িয়ে পড়ছে বাইশ থেকে ছাব্বিশ বা তিরিশে। অজস্র ড্যাশ, কমা’র ব্যবহার, স্বরবৃত্তকে ক্রমে মন্থর করে অনেকটা মুখের ভাষার কাছাকাছি আনা, গহন বোধের কথাগুলো সেখানে আঁটিয়ে ওঠা… বা, রবীন্দ্রনাথ গদ্যকবিতায় এলেন। এসবই ভেতরের মৌলচাপ, গহন অনুভবের সঙ্গে আস্তে আস্তে বাইরের কাঠামোটায় অন্য রঙ চাপানোর একটা তাগিদ! ভেতর যেখানে বাহিরকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু নব্বই থেকে এই আমাদের সময় অবধি, তোমার কি মনে হয় সেই প্রকৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদটা কতটা আছে? বা, যাঁরা করছেন কিছু ক্ষেত্রে কি শুধুই পরীক্ষা-নিরীক্ষাসর্বস্ব? অনেক সময় তাঁদের কবিতা থেকে প্রাণটা চলে যাচ্ছে…
রাহুলঃ হ্যাঁ, দ্বিতীয়টার সঙ্গে আমি একমত। পরীক্ষা-নিরীক্ষাসর্বস্বতা গ্রাস করেছে। কিন্তু, সাহস কম –তাও নয়। ধরো, চিহ্নগুলির অর্থ পাল্টাচ্ছে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আমি সাহসের কথাটা বলছি… নতুন বাঁক… নতুন চিন্তার সঙ্গে আঙ্গিক বদলের সহবাসের কথা বলছি…
রাহুলঃ সেটা সাহসের প্রশ্ন না। সেটা আসছে। ধরো, সমর সেন। ওঁকে আমি বিরাট কবি বলে মনে করি কী! সমর সেনের একটা উদ্দেশ্য ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু, ওঁর মধ্যে অদ্ভুত যুক্তিবাদি মন ছিল, যেটা কবির যুক্তির মন নয়। কবির তো অযৌক্তিকতার যুক্তি! তার ফলে, তিনি দিনের পর দিন সফলভাবে ফ্রন্টিয়ার সম্পাদনা করে গেলেন। আমার ধারণা ছিল, উনি কবিতা ছাড়েন নি, কবিতাই ওঁকে আস্তে আস্তে ছেড়ে গেছে। পরে আমাকে কবীর সুমনও বললেন, ওঁর সঙ্গে সমর সেনের কথাবার্তা হতো, সুমন ফ্রন্টিয়ারে লিখতেনও। কবীর সুমন জিজ্ঞেস করেছিলেন, কবিতা ছেড়ে দিলেন কেন? সমর সেন বলেছেন, না আমি ছাড়িনি। কবিতাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কবিতা না অতো যুক্তির প্রাবল্য নিতে পারে না।
অনিমিখঃ ছন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। এখানে আমার একটা ছোট্টো জিজ্ঞাসা আছে। অনেককেই বলতে শুনি, বিশেষত অগ্রজদের, যে সনেট একবার না লিখলে না প্র্যাকটিস করলে নাকি বাংলা কবি হওয়া যায় না… কী মনে হয়?
রাহুলঃ এরকম মনে হয় না। আনন্দ পুরস্কার পেলেন উৎপলদা… তখন বইটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রিভিউ করেছিলেন… লিখেছিলেন উৎপল ছন্দ জানে না। তাতে তো কোনো অসুবিধে হয়না! উৎপলদার সনেটের মতো দু একটা লেখা আছেও। কিন্তু সেগুলো সনেট হিসেবে পড়িনা! এটা তো সঙ্গীতবিষয়ক পরীক্ষার মতো না, যে সনেট বিষয়ক পরীক্ষা দিতে হবে! অক্ষরবৃত্তে লিখতে হবে স্বরবৃত্তে লিখতে হবে! যেহেতু আমাদের কথাবার্তার সঙ্গে অক্ষরবৃত্তের একটা টান আছে, ওটা চলে আসে। আবার, পাঁচমাত্রা খুব মনোগ্রাহী ছন্দ। মাত্রাবৃত্তে। স্বরবৃত্তে কতোটা কবিতা লেখা সম্ভব সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ সে তো মধুসূদন যখন বিজোড় সংখ্যায় যতি দিলেন অমিত্রাক্ষরে, কেউ কেউ বলেছিলেন ‘শ্রুতিকটু’! (হাসি…)
রাহুলঃ অক্ষরবৃত্তের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন যোগাযোগ। কিন্তু নিজের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তো সনেটের প্রয়োজন হয় না, লেখার প্রয়োজন হয়!
অনিমিখঃ আমিও বুঝতে পারি না! সনেট তো ১৪ লাইনের কবিতা, তার স্তবকভাগ শেক্সপিরিয়ানে একরকম পেত্রার্কান এ আরেকরকম – এই তো ব্যাপার! তাকে তুমি আরও অনেকরকম করে দেখাতে পারো। কিন্তু তাতে কী আসে যায়?
রাহুলঃ সবচেয়ে ভালো উত্তর দেবেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। (হেসে) উনি এতোরকম সনেটচর্চা করেছেন…
অনিমিখঃ মানে, আমি ছন্দের পরীক্ষায় পাশ করলাম, সেই পাশ সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যাপার?
রাহুলঃ শঙ্খবাবুর ছন্দের বারান্দায় বসে থাকার মতন। (হাসি)। ‘ছন্দের বারান্দা’ খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। আর নীরেনবাবুর ‘কবিতার ক্লাস’ পড়েছিলাম।
অনিমিখঃ একটু আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এই ‘সামাজিক বিবেক’ কে প্রাধান্য দেওয়া লোকেরাই কি সেই পাঠক যারা কবিতায় সবসময় অর্থ খুঁজতে যান?
রাহুলঃ অবশ্যই।
অনিমিখঃ তাহলে এ ধরণের পাঠকের সংখ্যাই বেশি বাংলা কবিতায়। তবুও যে উৎপলকুমার বসু…
রাহুলঃ অলোকরঞ্জন… । তুমি লক্ষ্য করে দেখবে, পঞ্চাশের অনেকেই কিন্তু সফল হয়েছেন। যেমন, অলোকরঞ্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবি। ধরো যখন তেলযুদ্ধ হল, উনি লিখছেন আমেরিকার সৈনিকেরা যুদ্ধজয় করে ফিরে আসছে… মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে মালা দেবে বলে… শেষলাইন হচ্ছে যে, ‘একেও যদি বিজয় বলো, আমার তবে বলার কিছু নেই’। বা, সত্তরে লিখেছিলেন, ‘উলটে থাকা কাঠগড়াকে তোরণ ভেবে / ওরা শুধুই বিকলাঙ্গের জন্ম দেবে’। ভাবা যায়! এঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল তো! কিন্তু, ওই সুনীলদা মঞ্চে উঠলে নীরা নীরা বলে চিৎকার! ফলে, সুনীলদার ভালো কবিতাগুলি আমরা অনেকে লক্ষই করিনি।
অনিমিখঃ এই কথাটাই বলতে চাইছি। উৎপলকুমার বসুর এতোরকম কবিতা আছে… কিন্তু ওই যে পোস্টারে ‘মন মানে না বৃষ্টি হল এতো / সারাটা রাত ডুবো নদীর পাড়ে / আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল / স্পর্শ করি জলের অধিকারে’ – ওইটাই সবাই…যখন উনি লিখছেন, ‘ঘুম আর মোমিনপুরের মাঝে একটুকরো বারান্দা রয়েছে’ – সেইটা কেউ পড়ছেনা!
রাহুলঃ উৎপলদা’র এইটা একটা মজা ছিল। উৎপলদা কবিতা পড়লে ‘আরেকটা পড়ুন’ ‘আরেকটা পড়ুন’ এইসব কেউ বলতো না। ফলে, উৎপলদা কবিতা লিখতে পেরেছিলেন। উৎপলদার শ্রোতা ছিল না। আমাদের কবিদের শ্রোতা থাকে জানো তো ! উৎপল, বিনয় – এঁরা বেঁচে গেছেন। তাদের পাঠক ছিল, শ্রোতা ছিল না। তাও বিনয়ের একটা মিথ খাড়া করা হয়েছিল। আমাকে কিছুদিন আগে একটা পত্রিকা, ‘বোহেমিয়ান সংখ্যা’ করছে, বলল বিনয় মজুমদার কে নিয়ে লিখতে। আমি বললাম, বিনয় তো বোহেমিয়ান নন! আমরা দাগ দিয়ে দিই – পাগল, বোহেমিয়ান! তার ইমেজ খাড়া করি।
সঙ্ঘমিত্রাঃ তাঁর দারিদ্র্য… ইত্যাদি…
অনিমিখঃ হ্যাঁ। দরিদ্র থাকতে যে কেউ পছন্দ করে না, সেটা কেউ বোঝে না! তো, উৎপলকুমারকে তাও কিন্তু কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে নি।
রাহুলঃ পারবে না তো! উৎপলদা এইবছর অনুবাদের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, জানো তো?
অনিমিখঃ জয়দা’র ক্ষেত্রেও অনেকটা এইরকম ব্যাপার হয়েছে।
রাহুলঃ জয়দা তো খুবই শক্তিশালী কবি। ওঁর ‘এক’ বলে একটা বই ছিল। আমার খুব প্রিয় বই। শুনেছিলাম, দেশ নাকি সেই বইয়ের কবিতা ছাপতে চায়নি। জয় গোস্বামী একদম প্রকৃত কবি একজন… অনস্বীকার্য…। কয়েকদিন আগেই রোববারের প্রতিদিন-এ একগুচ্ছ লেখা পড়লাম, এখনো পারেন! খবরের কাগজে চাকরি করলে তো চাপ থাকে যে এই লিখতে হবে ওই লিখতে হবে… উনি খুব শক্তিশালী কবি বলে হয়তো উৎরে গেছেন। জয়দা’র আরেকটা জিনিষ খুব ভালো লাগে – উনি ঠিক সময়মতো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মানে ‘সমাজের মাথা’… গলায় গাঁদাফুলের মালা জড়িয়ে কবিতা পড়া… সেই আসক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।
অনিমিখঃ কবিতার দিকে তাঁর ধ্যানটা সর্বদাই প্রথম প্রায়োরিটি ছিল…
রাহুলঃ ফলে, আমি জয়দা’র খারাপ কবিতা বলে কিছু মনে করি না… দেখি, জয়দা কী লিখছেন…। জয়দা’র কবিতার মধ্যে একধরণের সততা আছে। সেটা অনুভব করা যায়। এটা খুব জরুরি। সত্তরে যাঁরা কবিতা লিখেছিলেন, তিন-চারজন বাদ দিলে… অনেকেই যা বিশ্বাস করেন তা লেখেননি। তৈরি করা কবিতা… আমি ছন্দ জানি…শব্দ জানি… লিখে ফেললাম! (অন্য দু-এক প্রসঙ্গের পর) আমার খুব প্রিয় কবি দেবদাস আচার্য। ওঁর ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ অবশ্যপাঠ্য। সেইসময় লিখেছিলেন – ‘আমাকে চাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’। ভাবতে পারো?
সঙ্ঘমিত্রাঃ অসাধারণ! আচ্ছা রাহুলদা, বয়ঃসন্ধির নস্টালজিয়া তো ঘুরেফিরে আসে তোমার কবিতায়… তোমার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
রাহুলঃ একটা বড়োসময় কেটেছে আসামের ডিগবয়, যোড়হাটে আর কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে। আমার বাবার চায়ের ব্যবসা ছিল।
সঙ্ঘমিত্রাঃ তুমি সেই বয়ঃসন্ধিকে কি মিস করো?
রাহুলঃ খুব স্মৃতি কাজ করে। একটা বয়সের পর মনে হয়, মানুষ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকে। তার স্বপ্ন-টপ্ন বলে কিছু হয় না। আমার কাছে স্মৃতি খুব প্রবল এবং তার রঙ পালটায়। সাম্প্রতিকতম মৃত্যু আমার কাছে খুব গভীর মনোযোগ দাবি করে। আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল বাংলার ‘৯৫ সালে, তারপর মা’র মৃত্যু ২০১২ তে। মা’র মৃত্যু অনেক বেশি প্রকট। বাবা আমার সঙ্গে আছেন, কিন্তু মৃত্যুটা আর নেই। ফলে, স্মৃতি আমার কাছে খুব মূল্যবান বিষয়। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কথা বলছো সবই স্মৃতির জন্য।
সঙ্ঘমিত্রাঃ স্মৃতি কি তোমাকে বর্তমান বা আগামীকে অন্যভাবে দেখতে প্ররোচিত করে?
রাহুলঃ ভয়ঙ্করভাবে। স্মৃতি তো একধরণের দৃষ্টি। ধরো, অনেকসময় বলি না, যে ওই লোকটা আমার বাবার মতো – মানে, বাবার স্মৃতি আর ওই লোকটার অবস্থান – কোথাও একটা সাযুজ্য আছে। আমার বাবা যখন এই বেলঘরিয়াতে একটা ছোট্ট দোকান দেন… কংগ্রেসি আমল… সাঙ্ঘাতিক গরম আবহাওয়া… সিপিএমের একজন নেতা ছিলেন ননী সাহা… আরেকজন ছিলেন কংগ্রেসের ইনু মিত্তির… তাঁকে নিয়ে উৎপল দত্ত একটা নাটক লিখেছিলেন – ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’… সোর্ড নিয়ে লড়াই রাস্তায়… কিছুদিন পরে পুলিশ বিস্কুটের গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করবে… কিছুদিন পর প্রদীপ পালিত এম এল এ হবেন। যখন মনে করছি না, চোখের সামনে একটার পর একটা পাতা খুলছে। সেই জায়গা থেকে আমরা খুব যে এগিয়ে এসেছি তা নয়। তার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র। কিন্তু এইসব স্মৃতি খুব তাড়িয়ে বেড়ায়। এখানে একজন মহিলা ছিলেন, নিকষ কালো, বিয়ে হলো এক সুপুরুষ ভদ্রলোকের সঙ্গে, সন্তান হলো। তারপর এক কার্তিক মাসে একে একে দুজনকেই হারালেন। তিনি একা একা চুপিচুপি একটা গান গাইতেন। অহনাপিসি।একটাই গান, ‘হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে’। একজায়গায় থেমে গিয়ে বলতেন, ‘আমার জীবনে হেমন্ত বলে কিছু আর নাই রে, সকল মাসই কার্তিক মাস!’ বলতেন, ‘অনেক কাক ডাকে’। শুনলে মনে হবে যেন, উপন্যাসের ডায়লগ বসাচ্ছি!
অনিমিখঃ ফেসবুক নিয়ে খুব ধন্দ আছে। আমরাও লিখতে আসার ১০-১২ বছর পর ফেসবুক এল। সেটাও দেখছি সাম্প্রতিক ৩-৪ বছর সাহিত্যের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। একে জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতেই হবে। আবার আমরা তো আসলে সেই বইয়ের পুরনো জগতের লোক। কী করা যায়!
রাহুলঃ করার কিছু নেই। সভ্যতাই আমাদের হাত ধরে এদিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, বই থেকে মানুষ সহজে সরবে না। বই থাকবে। আমার বিশ্বাস।
অনিমিখঃ থাকবে বলছো? আমার তো বাংলা ভাষা নিয়েই চিন্তা হয়!
রাহুলঃ কোথাও যে কোন্ জিনিষ ঢুকে থাকে! উৎপলদা একবার গল্প করছিলেন – এক দার্শনিকের গল্প, যিনি মারা যাওয়ার আগে দীর্ঘ দু’মাস কোমায় ছিলেন। মৃত্যুর ৫ মিনিট আগে তার চেতনা ফেরে। এবং তিনি একটা গান শুরু করেন। সেই গানটা গাইতে গাইতেই তিনি মারা যান। তার ছাত্ররা সেটা টেপ করে। গানটা কী ভাষায় কেউ বুঝতে পারে না। তারপর অনেক গবেষণার পর জানা গেল – উনি একশ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন – যেখানে জন্মেছিলেন, সে এক মরুপ্রদেশ – তিনি শিশুবেলায় যখন কাঁদতেন, এক ধাই-মা – মরুবাসিনী এক মহিলা – গান গেয়ে গেয়ে খাওয়াতেন, ঘুম পাড়াতেন। সেই ভাষা কিন্তু মরে গেছে। কিন্তু সেই ভাষা তাঁর মাথার কোন্ কোষে লুকিয়ে ছিল। সে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। একটা লোকের ডানহাতটা কেটে ফেলা হয়েছে, তবুও সে ডানহাতটা চুলকোয়। ‘এ টেল টু টেল’ বলে একটা বই পড়ছিলাম… মাথার মধ্যে সেই ছাপটা রয়ে গেছে… তাই মনে হয় ডানহাতটা চুলকোই। এইরকমভাবেই আজ থেকে কয়েকশ বছর বাদে কেউ হয়তো বাংলা ভাষায় একটা গান গেয়ে উঠবে।
অনিমিখঃ বাংলাভাষার ভরকেন্দ্র কি বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে বলে মনে হয়?
রাহুলঃ বাংলাদেশের মানুষেরা বাংলা ভাষাকে নিয়ে অনেক বেশি কাজ করেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং সংরক্ষণ করেন।
অনিমিখঃ তুমি তো বাংলাদেশের এই সময়ের কবি লেখকদের লেখা পড়ছো। তুলনা করে কী মনে হয়?
রাহুলঃ তুলনা করা যায় না। ওদের ডিকশন আলাদা। কিন্তু ওরা অনেক বেশি মনোযোগী বলে মনে হয়। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য নিয়ে চর্চাও প্রবল। তরুণেরা লেখা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবেন।তাবলে এখানের তরুণরা ভাবেন না, বলতে চাইছি না। ক’দিনধরে একজন তরুণ কবির কবিতা পড়ছি। নির্ঝর নৈঃশব্দ। তাঁর বইটির নাম—হু হু পাখি আমার প্রাণ রাক্ষস। তাঁর একটি লেখা এরমধ্যে আমার মনে গেঁথে গেছে। রাত্রিমা। ‘আমার মায়ের নাম জেনেছিলাম শ্রীমা/ পাটের বনে মা তুলে সবুজের ছাই/ রাত্রিমার কোলে দুলি আমি আর অমা/ ছাই মেখে সবুজের পাণিভাত খাই/ কচুপাতার বনে মা কচুবউ তোলে/ খাই শাক কতশত পারিজাত পাতা/ কচুবউ খেয়ে ফেলি ইলিশের ঝোলে/ বরষায় আমাদের নেই কোনও ছাতা/ আকাশটা ছেয়ে যায় শিমুল তুলায়/ বনপথে ঘুরে ঘুরে বকুল কুড়াই/ উঠানে নদীটি এসে সাঁতার শেখায়/ কলাকাঠ ভেলাখানি বেহুলার ভাই/ আমাদের পথ হাঁটা কদুলি ভেলায়/ নদী ফিরে গেলে পরে আমি ঘুম যাই’। তবেএকটা জিনিষ মনে হয়, একটা সময় অব্দি বাংলাদেশের অনেকে কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকতেন; এখন আর নয়।
অনিমিখঃ হ্যাঁ। ওরা নিজেদের কথ্য ভাষাও কবিতায় তুলে আনছেন…
রাহুলঃ সেটা একদিক দিয়ে ভালো। বাংলা ভাষাটা বেঁচে গেল হয়তো।
অনিমিখঃ অবশ্যই। শুধুই কলকাতাকেন্দ্রিক মান্য বাংলা থাকবেই বা কেন! আচ্ছা, কবিতা নতুন হয়ে উঠবে কীভাবে?
রাহুলঃ তোমার জীবনযাপনের সঙ্গে নতুন হয়ে উঠবে। প্রত্যেকটা মানুষ তো নতুনভাবে বাঁচে!
অনিমিখঃ আবার একটা মতবাদ এরকমও আছে, নাকি আজ আর নতুন কোনো কথাই বলবার বাকি নেই, শুধুই দেখাবার ভঙ্গীটুকু আছে।
রাহুলঃ না, এটা আমি মানি না। পৃথিবী পালটে যাচ্ছে, মতবাদ পালটে যাচ্ছে, যে মতবাদে বিশ্বাস করতাম সে মতবাদে ভুলভ্রান্তি ধরা পড়ছে। তাহলে?
সঙ্ঘমিত্রাঃ রাহুলদা, আমার মনে হয়েছে তোমার লেখায় একধরণের ‘কসমিক অ্যাংক্সাইটি’ আছে। তোমাকে কে বেশি আকর্ষণ করে – একজন মহাকাশচারী না একজন বাউল? তোমার লেখায় দুটো চেতনাই আছে।
রাহুলঃ একসময় দু’লাইনের একটা ছোট্ট লেখা লিখেছিলাম –‘নভশ্চর, আমি চাই উড়ন্ত বালিশ’। এর সঙ্গে না বাউলের একটা মিল আছে। দু’জনেই না নিজের নিজের মতো করে একটা পৃথিবী পরিক্রমা করে। উড়ন্ত গালিচার মতো তার একটা উড়ন্ত বালিশ থাকে। তারপর তত্ত্ব তৈরি হয়। দেহতত্ত্ব তো দেহকে পরিভ্রমণ! শুধু রমণ নয়। নভশ্চরের পরিক্রমাটাও কিন্তু দেহপরিক্রমার মতোই। আকাশটাই তাঁর দেহ। তুই প্রশ্নটা করলি… আমি তো ভেবে দেখিনি কিছুই… কিন্তু যেহেতু আমি লোকগান খুব ভালোবাসি… আমার দেশ ছিল সিলেট পূর্ববঙ্গে… আব্দুল করিম…বিয়ের গান… গানটা ওখানকার প্রধান সংস্কৃতি। ওর মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে এই গান আমাকে খুব আকর্ষণ করে। যেহেতু আমার জীবনযাপনের একটা বড়ো অংশ এই গান, ফলে লেখার মধ্যে চলে আসে আর কি! গানগুলি শরীরের মধ্যে কাজ করে। আমার তো সুর নেই …
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু তার একটা মৌলিক চাপ থাকে…
রাহুলঃ রবিশঙ্করের ছাত্র, খুব গুণী শিল্পী ছিলেন দীপক চৌধুরি। উনি যখন বাজান ওঁর শরীরটা দোলে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি দোলেন কেন? উনি বললেন – না, আমার মুখ দিয়ে কোনো সুর বেরোচ্ছে না তো! শরীরে সেই ক্রিয়াটা হচ্ছে। সাপ …
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, অনেকে বলেন যে এই কঠোর কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে লিরিক কবিতা লেখা একধরণের বিচ্ছিন্নতা। কী মনে হয়?
রাহুলঃ তাহলে তিনি বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই বাঁচতে চান। আসলে তিনি তো লেখেন না, কেউ তাঁকে লেখায়। এর তো খারাপ ভালো হয়না! আমি যা লিখি, আমাকে মেরে ফেললেও এর চেয়ে ভালো লিখতে পারবো না। এটাই আমার ক্ষমতা!
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, সচেতনভাবে লিরিক প্রত্যাহার করবো – এইভাবে তো হয়না!তাছাড়া যেকোনও শিল্পই তো একধরণের অভাবসঞ্জাত! যা আছে নয়। যা নেই—তার দিকে যাত্রা। সেই অভাবকে ভেতরঘরে ধারণ করা!
রাহুলঃ হ্যাঁ, একটা লেখা হয়তো লিরিক নিয়েই তোমার কাছে এল, তুমি তো তাকে অস্বীকার করতে পারো না!
অনিমিখঃ কিন্তু অনেকেই তো সচেতনভাবে একটা নির্দিষ্ট পথে চালিত হয়!
রাহুলঃ সেটা খুব সমস্যার। যে কোনো শিল্পচর্চায় সচেতনতার প্রয়োজন হয় অন্য ক্ষেত্রে। কিন্তু আমি তার ফর্ম তার কনটেন্ট সবকিছুকে…
সঙ্ঘমিত্রাঃ সবকিছুকে ডিকটেট করতে পারি না।
রাহুলঃ হ্যাঁ। হলে তো সে পূর্বপরিকল্পিত একটা জিনিষ হবে। যে, আমি আজ সকালে উঠে অনিমিখকে নিয়ে ৮টা কবিতা লিখবো! এবার যিনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন তাঁর একটা মুন্সিয়ানা আছে। তিনি কিন্তু ৮টা কবিতা নামিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু সেসব কবিতা হয় কিনা সন্দেহ হয়।
অনিমিখঃ কিন্তু অনেকসময় হয় না যে, আমি আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতার দ্বারে আঘাত করে দেখি আর কতোটা যাওয়া যায়…
রাহুলঃ এটা তো অন্তহীন। তুমি তো জানো না তোমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা কতোটা!
অনিমিখঃ ‘নিদ্রিত দর্পণে যা দেখি’ তে কিন্তু তৎসম শব্দের ব্যবহার অনেক কম। এরকম হয়তো তুমি দশবছর আগেও ভাবতে পারতে না… এরপরে হয়তো তোমার পথ সেই অর্থে আরও হালকা হয়ে যাবে…
রাহুলঃ না, আমি এসব কিচ্ছু ভাবিনি। তৎসম শব্দ নিয়েও ভাবিনা। আমার পুরনো শব্দের প্রতি ভীষণ একটা আকর্ষণ আছে। পুরনো শব্দের মধ্যে আমি অন্যরকম গন্ধ পাই। সময়ের গন্ধ। এই আর কি! ‘বসন্ত বাতাসে সই লো বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে’।
অত্যান্ত সমৃদ্ধ লেখা , পরে সমৃদ্ধ হলাম।
প্রশ্নোত্তর যেভাবে এগিয়েছে একটা রেকর্ডেড ভার্সন থাকলে ভালো হত। ইউটিউবে আপলোড করা যেত। সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার
অনলাইনে পড়া ক্লান্তিকর।
আমাদের প্রজন্মের দুই সমর্থ কবির নেওয়া এই সাক্ষাৎকার! রাহুলদাকে আর কী বলি,বরাবরের মতোই তীক্ষ্ণ,প্রাঞ্জল ও গভীর!
দুনিয়াদারি এই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ কথোপকথনটি
আমাদের সামনে মেলে ধরার জন্য ধন্যবাদার্হ হবেন।