সঙ্ঘমিত্রা হালদার

অল আই হ্যাভ ইজ আ ভয়েস

প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রের এমন এমন চিল-ঠোক্কর মানুষ শেষ কবে দেখেছে? আমাদের যাদের বয়স ত্রিশের কোঠায়, তারা এই প্রথমবার, এই দেশে। এমন অ্যাটেনশান সিকার রাষ্ট্র-ব্যবস্থা আমরা এর আগে নাৎসি জার্মানির ইতিহাসে দেখেছি, সিনেমায়, গল্পে। সত্যি বলতে এক ত্রাসের অনুভূতি ছাড়া বাকি অনুভূতিগুলো কেমন যেন বসে যাওয়া গলার মতো মোটা আর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভয় হচ্ছে। সত্যিকারের ভয়। ভাবি, এই তো একটাই মানবজীবন! তাকে কি তবে এবার থেকে এই এইমাত্র ত্রাসের অনুভূতি নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে, বা জীবনের বড় একটা অংশ এই ভয় ত্রাসের ঘরে যুঝতে যুঝতে ফুরিয়ে যাবে! লক্ষ জন্ম ঘুরে ঘুরে যে মানব জনম, সে কি তবে এমনিই বিফলে যাবে! আস্ত একটা মন, তার রামধনু অনুভূতি, বুদ্ধিবৃত্তি সবই কি তবে ভয় পেয়ে কেঁচোর মতো গুটিয়ে যাওয়াতেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে? কেঁচোর মতো বললাম বটে তবে একটু ভাবলেই খেয়াল হয়—কেঁচো এখনকার মানুষের থেকে স্বাধীন, নিরাপদ। তার এন আর সি নেই, ক্যা নেই, এনপিআর নেই। 

আর যেখানে এমন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি, বিশেষত রামনামের নামে থেকে থেকে আজ এখানে আক্রমণ তো কাল সেখানে গণহত্যার প্রস্তুতি, পরশু জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর নামে পিটিয়ে মারা। এই পরিস্থিতিতে কিছুতেই চুপ করে বসে থাকা যায় না, তেমনি নিজের কাজও করা যায় না। নিজের কাজ মানে? যার যার নিজের কাজ। কারও কাজ ছবি আঁকা, কারও লেখা, গান গাওয়া। কিছুতেই সেসব কাজে মনসংযোগ করা যায় না। এসবই অস্থির করে তোলে। অথচ আমার মতো সাধারণ মানুষের এক শান্তিপূর্ণ মিছিল ছাড়া কিছু করার উপায় নেই। আর বড়জোর এই রাগ-ভয়-ত্রাস খানিক উগরে দিতে শাদা পাতার সামনে বসা যায়। কিন্তু তাতে আমার খানিক স্যালভেশান ছাড়া আর কারও কি তাতে কিছু এসে যাবে? হতাশা আসে। কালো জল উঠে এসে মস্তিষ্কের ঘিলু অব্দি ধুয়ে দেয় একচোট। তবু ভাবতে ভাবতে একসময় বিদ্যুৎ ফুঁড়ে একটা ক্ষীণ আলোও দেখা দেয়।  

মনে পড়ে শেলি’র চেতাবনি— `Rise like Lions after slumber/In unvanquishable number,/ Shake your chains to earth like dew/ Which in sleep had fallen on you –/ Ye are many — they are few.’—( দ্য মাস্ক অফ অ্যানার্কিঃ ৩৮)। সত্যিই তো ঘুমিয়ে আছি বলেই নানা শৃঙ্খল চেপে ধরছে। এই ঘুমিয়ে থাকা আসলে দিবানিদ্রা, জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকা, দেখতে না-চেয়ে, দেখতে না-পেরে ঘুমিয়ে থাকা। দেখতে চাইছি না বা দেখতে পারছি না বলেই আমরা বুঝতে পারছি না ধর্মের চেন গলায় বাঁধা পড়ে রয়েছে, যা একটা শৃঙ্খল ছাড়া কিছু নয়। এই চেন, এই শৃঙ্খলই আমাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সুরক্ষা না থাকার ক্ষোভকে একত্রে পুঞ্জিভূত হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আটকে রেখেছে সম্মিলিত হওয়া থেকে, একত্রে প্রতিরোধ গড়া থেকে। এ এক সুগভীর চক্রান্ত। একটা বিপদ ঘটলে সেটাকে আমরা চিহ্নিত করছি কোনও একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের বিপদ হিসেবে। একটি খুন’কে, একটি জেনোসাইড’কে কোনও বিশেষ ধর্মের মানুষের বলে চিহ্নিত করছি। আসলে জেনে বুঝে বা না বুঝে আমরা একটি ফাঁদে পা দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, আজ ধর্মের নামে একদলকে সরিয়ে দিলেই তাদের ক্ষুধা মিটবে না। তারপর শ্রেণির নামে, বর্ণের নামে চলবে এই দূরে সরিয়ে রাখার—অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কৌশল। এই কিউ’র কোনও শেষ নেই। আর এই ‘সত্যিটা’ যদি আমরা বুঝতে পারি, তবে শৃঙ্খল ফেলে দিতেও বেশি সময় লাগবে না। তাই বোধ করি শেলি সেই শৃঙ্খলকে শিশিরের মতো ক্ষণস্থায়ী আর হালকা বলতে পেরেছেন। শিল্পী কবি সংবেদনশীল ব্যক্তি এই ধূর্ততা অনেকদূর দেখতে পান। পান বলেই কখনও প্রফেসর কালবুর্গি কখনও দাভোলকর কখনও গৌরি লঙ্কেশ খুন হন। বিচার হয় না। বর্ষ মাস অস্তে ঢলে পড়ে। নতুন নতুন সমস্যা আসে। অবিচারের উপর আরেক অবিচারের ধুলো পুরু হয়ে জমে। তখন আর ঠিক মতো চোখের দৃষ্টিসীমায় সে আর থাকে না। দৃষ্টিও একসময় কমে আসে। আর তাই শিল্পী কবি মাত্রেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই আগামীকে চিহ্নিত করা—এই সুকৌশল ফাঁদের কথা আকাশ বাতাসে রটিয়ে দেওয়া তার অন্যতম দায়িত্ব। কেননা তাঁরা ‘seer’। আগামীকে কেন দেখতে পান একজন শিল্পী, কবি? কেননা তাঁদের কল্পনার ক্ষমতা আছে। আবারও শেলিকেই ডাকতে হল, তিনি ‘আ ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি’ নামে এক প্রবন্ধে তাই লিখেছিলেন—‘poets are the unacknowledged legislators of the world’। কবি তো আর সেই অর্থে সত্যিই আইনপ্রণেতা হতে পারেন না। কিন্তু তিনি তার কল্পনা দিয়ে দেখতে পান আগামীর পৃথিবী। তাই তাঁর লেখায় এমন কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, যা অনেকক্ষেত্রে আগামীর সমাজগঠনে কাজে লাগে, লাগতে পারে। কবিতা বা শিল্প কখনওই মানুষের খিদে মেটাবে না। কিন্তু মানুষের জন্য মানুষের হয়ে অনেকদূর ভাবতে পারে। লড়তে পারে। কথা বলতে পারে তার হয়ে।   

তাই ইস্তেহারের মতো প্রাসঙ্গিক আর আগামীর দিক নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে সময়ের গরল ধারণ করে লেখা কবিতা। হয়ে উঠছেও এইসময়ে লেখা কবিতা— 

‘Kill us, we will become ghosts and write
of your killings, with all the evidence.
You write jokes in court;
We will write ‘justice’ on the walls.
We will speak so loudly that even the deaf will hear.
We will write so clearly that even the blind will read.
You write ‘black lotus’;
We will write ‘red rose’.
You write ‘injustice’ on the earth;
We will write ‘revolution’ in the sky.
Everything will be remembered;
Everything recorded
So curses may be sent to you;
So your faces may be smeared;
Your names and your faces will be remembered;
Everything will be remembered;
Everything recorded.’ 

(Amir Aziz) 

এই কবিতা ঝড়বৃষ্টিসুনামিতে হারিয়ে যাবে না। কেননা এই যন্ত্রণা এই অঙ্গীকার প্রতিটি স্নায়ু আর ধমনীতে দগদগে হয়ে জেগে থাকবে। যতদিন অন্যায় আর অবিচারের মেরুকরণ থাকবে। জেনোসাইড থাকবে ধর্ম বা জাতের নামে। সত্তার গভীরে গড়ে ওঠা এই ব্যারিকেড রাষ্ট্র হাজার সেনা নামিয়েও হাজার খুনের ঘটনা ঘটালেও ভাঙতে পারবে না। এই দ্রোহ চিরকালীন। এই দ্রোহের আঁচ অন্তঃসলিলার মতো রক্তে জেগে থাকবে। জেগে থেকে অপরকে জাগাবে এই পংক্তি, এই কবিতা। শাদা পাতা এমনকি পৃথিবীর জল-মাটি সবকিছুই অধিকার করে নেওয়া চলে, কিন্তু আকাশ, সে তো ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাই সেখানেই রটে থাকবে এই দ্রোহ। আসলে প্রতিটা শোষিত, অত্যাচারিত মনের আকাশে লেখা থাকবে এই পংক্তি, জেগে থাকবে চেতনার গভীরে, তাই তার হারাবার কোনও ভয় নেই!     

একইসঙ্গে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, লেখায় যুদ্ধের—সন্ত্রাসের—নিপীড়নের কোনও ফ্যান্টাসি যেন না থাকে, বরং সে সম্বন্ধে থাকবে বাড়তি সতর্কতা। থাকবে ফ্যাসিস্টের ফাঁদকে চিনিয়ে দেওয়া। আমাদের নিত্যদিনের বাস্তব অসুবিধা আর অনেকদিনের অন্যায় অবিচার সবকিছুই আছড়ে পড়ুক সেখানে। আজকের ফ্যাসিস্টের আচরণ থেকে কৃষকের আত্মহত্যা, মানুষের হাতে কাজ না থাকা তবু দু’হাজার কোটি টাকার মূর্তি বসানোর ধূম সবই জুড়ে যাক সেখানে। ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/ মাইনে তোমার একশ বারো’— শ্লেষাত্মক হলেও, এই শ্লোগান আসলে পুলিশের যন্ত্রণার শরিক হতে বলে আমজনতাকেও। কেননা— ‘ Hunger allows no choice/ To the citizen or the police;’(September 1, 1939: W.H. Auden) কেননা রাজাকে একা করে দেওয়ার এও এক শ্রেষ্ঠ উপায়। সুতরাং, কেন পুলিশ কিংবা সেনার আজও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পর্যাপ্ত নয়, থাকুক সেই কথাও। ‘আর্টিকেল ফিফটিন’ সিনেমায় যেমন দেখা গেছে – আজও একটা শ্রেণির মানুষকে ড্রেন পরিষ্কারের জন্য উপযুক্ত পোশাক ছাড়াই কেন নেমে যেতে হয়; দিনের পর দিন আমাদের বর্জ্য পরিষ্কার করতে গিয়ে, অসুরক্ষিত পোশাকে কাজ করতে গিয়ে যাঁরা তাঁদের আয়ু ক্ষইয়ে ফেলছেন, কেন তাঁদের ন্যূনতম একটা পোশাকের সুরক্ষার কথা আমাদের চেতনায় হানা দেবে না? কিংবা খনি শ্রমিকের নিরাপত্তা কেন এমন প্রহসনে দাঁড়িয়ে আজও! ধর্মের নামে যখন একদল মানুষ খুন হন, আসলে ‘মানুষ’ই খুন হন, মুসলিম, খ্রিষ্টান বা হিন্দু খুন হন না, এই কথাটা যদি আমাদের চেতনায় কেটে বসে না যায়, তাহলে আমরাও ফ্যাসিস্টের চেনা ফাঁদেই জড়িয়ে পড়ব। যে ধরনের লেখাই হোক, গদ্যে বা কবিতায়—এই কথাগুলো চেতনায় পরিস্রুত হলেই তবে আমাদের পংক্তিতে ধরা দেবে সত্যিকারের অমোঘ কিছু পংক্তি—‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,/ পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,/ এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/ যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’ জানি অনেকেই হয়ত আল মাহমুদের এই পংক্তি দেখে প্রশ্ন করবেন তিনি তো নিজেই একটা সময়ে মৌলবাদের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। ঠিক, শেষ দিকে উনি মৌলবাদের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত এই পংক্তিগুলোর গায়ে তার কোনও দূরতম ছায়াও নেই। নেই বলেই এত অহরহ আমাদের মনে পড়ে ‘সোনালি কাবিন’-এর এরকম কিছু আশ্চর্য পংক্তি!         

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ফ্যাসিস্ট মাত্রেই চায় মানুষের জড়ত্ব সম্পূর্ণ হোক। তার যাবতীয় সুকুমার প্রবৃত্তি,  অনুভূতি সব চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাক। তাহলে মানুষে মানুষে বিভাজনে ফ্যাসিস্টের আরও সুবিধা হবে।চাইলেই ধর্ম কিংবা জাতির নামে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়া যাবে। জড়ত্ব সম্পূর্ণ হলে ফ্যাসিস্টের নিপীড়ন আর গায়ে লাগবে না, ফ্যাসিস্ট জানে। মানুষ তখন ফ্যাসিস্ট প্রভুর জো-হুজুর রোবট। তার বিচার শক্তির অতন্দ্র চোখ, ভালোবাসবার কড়ি ও কোমল সব তখন ধুলোর নীচে পুরু হয়ে বসে যাওয়া একদলা প্রত্নতাত্ত্বিক ধুলো বা শ্লেষ্মা। গ্যাস চেম্বারে কিংবা মাথায় বুলেট ঠুসে দেওয়ার আগে দেওয়ালে শেষ ধাক্কাটুকু দেওয়ার মনোভঙ্গি তখন আর অবশিষ্ট থাকবে না। চেতনার লালনীলসবুজ হীরেপান্না ক্ষয়ে গিয়ে কেবল ধূসর মরুভূমি জাগুক, এইই চায় যে কোনও ফ্র্যাঙ্কো, যেকোনও মুসোলিনি। চায়, ব্যক্তিমানুষের পরিচয় ঘুচে সে হয়ে উঠুক রক্তকরবীর নাটকের মতো ৬৯ঙ কিংবা ৪৭ফ। যাতে তাকে দিয়ে যাইচ্ছেতাই করানো যায়, এবং কোনওরকম বেগ না পেতে হয়।

এই যে এই অস্থির সময়ে কিচ্ছু ভালো লাগছে না, এই হতাশা কাটিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে নিজের মুখোমুখি, আমাদের চেতনা আমাদের প্রশ্নকে ঘুরিয়ে মারতে হবে সমস্যার গভীরতম প্রদেশে নেমে গিয়ে। উত্তর হয়ত একদিনে আসবে না বা একবছরে। আমাদের মনে রাখতে হবে একটা বাস্তিল দুর্গের পতনও একদিন বা একবছরে ঘটেনি। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েও, সবশ্রেণির অসন্তোষ দানা বেঁধেও ছোটবড় নানা বিদ্রোহে ফেটে পড়েও শেষ কামড় বসাতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে গিয়েছিল। আর তাই প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে রিলেরেসের গতিতেই। আমাদের জড়ত্বে পৌঁছানো রুখে দিতে হবে আমাদেরই। আমাদের গান কবিতা আমরা থামাবো না। তাছাড়া সত্যি বলতে এই স্বরটুকুই তো কেবল আছে আমার, আমাদের—

 All I have is a voice 

To undo the folded lie, 

The romantic lie in the brain  

Of the sensual man-in-the-street 

And the lie of Authority 

Whose buildings grope the sky: 

There is no such thing as the State 

And no one exists alone; 

(September 1, 1939) 

আমাদের ক্যানভাস সাজুক আমাদেরই হাত ধরে সময়ের জল কিংবা আলকাতরায়। অন্ধকার আর ভালোবাসা পাশাপাশি থাকুক সেখানে। আলকাতরা আর লাল এক দেওয়ালে ঘেঁষাঘেঁষি জায়গা করে নিক। রক্তকরবী আর অন্ধকার বমি এক স্ক্রিনে জ্বলুক নিভুক। সেতার ঝালায় পৌঁছে ফেটে পড়ুক। হ্যাঁ, অন্ধকারেই। ভোঁতা সময়ে অনুভূতির পর্দা বাঁচিয়ে রাখাও একটা দ্রোহ। তাই গান আমরা গাইব। হ্যাঁ, এই সময়েই— ‘In the dark times/ Will there also be singing?/ Yes, there will also be singing./ About the dark times.’  (Motto: Bertolt Brecht)         

[এই লেখার শিরোনাম W.H.Auden-এর ‘September 1, 1939’ কবিতা থেকে নেওয়া।] 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment