অনিমিখ পাত্র

মারিয়া ভেজ্জালি’র কবিতা

ইংরাজি ভাষান্তরঃ পিনা পিক্কোলো
বাংলা অনুবাদঃ অনিমিখ পাত্র

কবি পরিচিতিঃ পুরস্কার বিজেতা প্রখ্যাত কবি ও অনুবাদক মারিয়া লুইসা ভেজ্জালির জন্ম ১৯৬৪ সালে, ইতালির বোলোগনা শহরে। তিনি এখানেই এক উচ্চবিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ান। তিনি আদ্রিয়ান রিচ এবং লোরান্ড গ্যাসপার এর ইতালীয় অনুবাদক। তিনি সেন্ট-জন পার্স এর ‘আনাবাসি’র সম্পাদিকাও। দীর্ঘ তিরিশ বছরে প্রকাশিত হয়েছে মারিয়ার অনেকগুলি কবিতার বই – :  L’altra eternità (1987), Eleusi marina (1992), dieci nell’uno (2004) lineamadre (2007, এই বইটির জন্য পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ‘মন্তানো পুরস্কার’), Forme implicite (2011)। এইসমস্ত কাব্যগ্রন্থে কবির নিরাভরণ কবিতাগুলি, অনেকসময়ই যা পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বৈশিষ্ট্যে ভরা, আলোকপাত করে ঘনিষ্ঠ মানবিক আদানপ্রদানের যেমন কিনা পরিবারের ওপর, লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যেকার বিষম ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্তঃসম্পর্কের ওপর, ভাবনাচিন্তা উঠে আসে তাঁর গভীর অন্তর-জীবন এবং এক সুস্পষ্ট নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। মারিয়া’র সাম্প্রতিক্তম কাব্যগ্রন্থ Tutto questo (২০১৭) তাঁর পূর্বেকার রচনা থেকে অনেকটাই ভিন্নপ্রকৃতির। এই বইয়ের কবিতাগুলির উপাদান উঠে এসেছে ইতিহাসগতভাবে কবির সামাজিক সম্পর্কগুলির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা থেকে, তাঁর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকেও উঠে এসেছে অনেক কবিতা। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরাজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, সুইডিশ এবং আরবীয় ভাষায়। প্রকাশিত হয়েছে বহুবিধ জার্নাল এবং সংকলনে। তিনি সাহিত্যজার্নাল “Le voci della luna”  র সম্পাদক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত।

বাংলা ভাষায় এই প্রথম মারিয়া ভেজ্জালি’র কবিতা অনূদিত হল।

পিনা পিক্কোলো গুরুত্বপূর্ণ দ্বিভাষিক (ইতালিয়ান ও ইংরাজি) কবি, অনুবাদক এবং একজন সক্রিয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ‘দ্য ড্রিমিং মেশিন’ ও ‘লা মাশিনা সগনান্তে’ নামক দুটি যমজ সাহিত্যজার্নালের সম্পাদক। ‘দুনিয়াদারি’র জন্য মূল ইতালিয়ান থেকে এই কবিতাগুলির অসামান্য অনুবাদ করে দিয়েছেন পিনা।

** ‘হিংসা নিয়ে’ ও ‘গ্রেটেল’ কবিতাদুটির ইংরাজি রূপ ‘দ্য ড্রিমিং মেশিন’-এ প্রকাশিত।

 

 

 

 

 

আরনৌত **

প্রতিদিন তুমি দেখো এই ট্রামরাস্তা
তার ভেতরের লোকজনের লুকোচুরি খেলাকে উস্কে দেয়
সিঁড়িগুলো ডুবে যায় চিৎকারে
সামনের ডেস্ক থেকে কেন্দ্রবিমুখ বল

এমন তোমার ঘ্রাণ যেন ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে
যেন বিদায় নিচ্ছে ক্যারাভান
বালি যখন ক্রমশ মরুভূমি হয়ে উঠছে, তার ভেতর
রক্তের মধ্যে নৈশশিকড়
একটা ঘুঁষি বেরিয়ে আসছে কাগজপত্র থেকে
তুমি এত কর্কশরকম ঠান্ডা আর অনমনীয়
যে তোমার দৃষ্টিই কাচের ওপর আরবীয় নকশা কেটে দেয়
অন্যরকম পোশাকের জন্য প্রস্তুত হও এখন
যদি এটা ঘর হয়
আর একে তো ঘর বলতেই হবে তোমায়
তবে প্রস্তুত হও অন্যরকম নকশার জন্য
সবকিছুই পিছলে যায়, বদলায়, বেরিয়ে যায়

ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলে উঠলেও নদী
সরলরেখায় প্রসারিত হতে পারে না, তোমার শিরদাঁড়াটি যেমন
যখন তোমার চামড়ার নীচে জমা নীরবতার ভেতর থেকে
ফেটে বেরোয় নুড়িপাথর আর একটা ঘুঁষি ছিঁড়ে ফ্যালে ইতিহাস
তার উত্থান পতন কোনো স্থানমাহাত্ম্য ছাড়াই
যেন একটা জলাশয় অথচ তাকে অটুট রাখার জন্য পাড় নেই কোনো
অন্যরকম ধ্বনির জন্য প্রস্তুত হও এখন
যদি এটা ভাষা হয়
আর একে তো ভাষা মনে করতেই হবে তোমায়
তবে গ্রহণ করো অন্যরকম স্বাদ
মাড়ি থেকে ছিঁড়ে যাওয়া দাঁতে

এবং তুমি, সুপ্রভাত, স্থির হয়ে দাঁড়াও
যদি অর্থ দাঁড় করাতেই হয়
এমনকী এই রোগারোগা
হাওয়ার শস্যাগারে
এমনকী স্রোতের বিরুদ্ধে

** আরনৌত – কবির হাইস্কুল ক্লাসের এক পাকিস্তানী ছাত্রের ছদ্মনাম, যে সবেমাত্র অভিবাসন নিয়ে ইতালিতে এসেছে।

 

 

লিউকোপেট্রার সৈকত বরাবর

এটা সত্যি নয় যে আমরা সুখী ছিলাম না, আমাদের ছিল ম্যানিফেস্টো গুলিয়ে ফেলা কিংবদন্তীগুলি, ভাঙা ঘর ও জমে যাওয়া জাহাজতলের মধ্যে। ওলোটপালট হাওয়া, ক্ষতিপূরণহীন ঢেউ, উদ্বিগ্ন আর অদম্য যেন পাতার অন্তহীন শামিয়ানায় অজস্রচোখ নলখাগড়া। আমরা জানতাম সেই যৌথসঙ্গীত যা রাস্তার ম্যাপের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা ছিলাম আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ও বিচ্ছিন্ন যখন দেখলাম কাঁচি আমাদের দিকে ঝঙ্কার তুলতে তুলতে এগিয়ে আসছে। ছাদে, ফুলের টবের মধ্যে খবর রাখা ছিল আমাদের জন্য। গোপন রেডিওর কম্পাঙ্কে কী অদ্ভুতভাবে সচল! আমাদের ছিল সকালভর্তি চিঠি, হতে-পারতো-এমন দেহগুলির ল্যান্ডস্কেপ। আমরা হাঁটছিলাম খোলা উন্মুক্ত সীমান্তরেখা ধরে, বাঁক আর মাথা ঝিমঝিমের মধ্যে। এক নক্ষত্রখচিত নীরবতা যাকে পেরিয়ে গেলে প্রত্যাশাগুলি কাচের ক্ষুরের মতো প্রলম্বিত অথবা হয়তো তা নয়, আসলে ফাঁকা ফুটপাথের ওপর শীতের স্বপ্ন হয়তো। কিন্তু এখন ভিন্নতর যুদ্ধ থেকে এক ভিন্নতর জীর্ণ অনুভূতি, ভিন্ন ভিন্ন মৃত্যু তবু যেন একইরকম দেখায় তাদের। আর আমরা জানি না, কোন্‌ ওষুধ যে রাত্রিবেলা ঘুম পাড়িয়ে দেয় আমাদের!

** এই কবিতাটি লেখা ২০১০ সালে, যখন গ্রিসের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং ইওরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তার বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছিল।

 

 

সাজিয়ে না তুলে সে কোনোকিছুই স্পর্শ করে না

১.
চোখ বন্ধ করো আর যে অনুপস্থিত তাকে শোনো
কেবলমাত্র একটা লুকনো সমুদ্র আর বিড়িবিড় করা জন্তু
যা কিছুই হারিয়েছে ধোঁয়া উঠছে চোখের পাতার নীচ থেকে
এইসব শহরগুলো হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির গায়ের ওপর
আমাদের হয়ে উঠতে হবে বিস্ময়কর
সংঘর্ষের দ্বারা সচকিত

আমাদের বইপত্র ডুবে গেছে সেই লুকনো সমুদ্রের ভেতর
আমাদের চুক্তিগুলি ভিজেছে ফেনায়
আমরা হয়ে উঠবো উদ্দীপিত
জাজ্বল্যমান ঢেউগুলো লিখে চলেছে অন্ধকারের ভেতর
চোখ বন্ধ একটা বদলে যাওয়া ব্লেড
একটা বিষাদগ্রস্ত রাডার
যা আসলে অনুপস্থিত জনের ঘন্টাধ্বনির
কিন্তু ইতিহাসের এই কনুইয়ে তার দৃশ্যমান নরম পেট
যেন বাঁকানো যন্ত্র খোলা করতলে তুলে ধরা

এবং ওলাফিয়া আটকে আছে হিমের ভেতরে
কমবেশি একশ বছর আগে থেকে
তার সাদা রিবনগুলি
কাদায় হস্তক্ষেপের মতো এখনো রয়েছে

ডাকনামে ডাকো তাকে ‘লাফফি’ বলে ডাকের উত্তাপ নিয়ে
যখন তুমি বুঝতে পারছো ঠান্ডার উপস্থিতি
দিনগুলির উপস্থিতি
মৃত্যুর উপস্থিতি এবং সহমর্মিতাও
কিংবা কেবলমাত্র আইসল্যান্ড

** কবিতাটি ওলাফিয়া জোহানসদত্তির (১৮৬৩ সালে আইসল্যান্ডে জন্ম এবং মৃত্যু ১৯২৪ এ অসলো শহরে) এর প্রতি উৎসর্গীকৃত। তিনি ছিলেন লেখক, নারীবাদী, বঞ্চিত মানুষের বন্ধু, যাদের জন্য তিনি মাথা গোঁজার নকশা এবং সহায়ক প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন।

 

 

অন্ধকার

স্পষ্টতই, আমাদের ভেতরে যা কিছু দীপ্তিমান, নিশ্চয়ই তা এসেছে এই নভেম্বর-হানা’র বাইরে, এই নথিপত্রের বাইরে থেকে। যেখানে ক্রমাগত পেছতে থাকা একটা সময়ের ভেতর প্রশ্নগুলির মুন্ডু কাটা পড়তে দেখা যায়। এবং ঘরের মধ্যে একটা স্বচ্ছ বিশ্বাসঘাতক দ্বিতীয় সত্তা, যে কিনা দুর্দম হয়ে পড়ছে মাপতে মাপতে যে কোন ফসিল হয়ে যাওয়া জিনিষটি রঙ্গমঞ্চে পরবর্তী রক্তস্নান উসকে দেবে, তা সে নিজে করুক বা অন্যে। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই আমরা খুব পার্থিব লোক, আমরা ওজন টানি, আমরা চাকা আবিষ্কার করি, আমরা যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসা করি, আমরা রাস্তা বানাই, আমরা মন্দির খাড়া করি, আমরা নৌকা ভাসাই, আমরা যারা জল থেকে উঠে এসেছিলাম কোটি বছর আগে, ফুসফুসে হাওয়ার কুঠুরি নিয়ে, উড়বার জন্য আমরা তৈরি হইনি, আমরা ফুরফুরে শুদ্ধ বাতাসকে কার্বন মনোক্সাইডে বদলে দিয়েছি। এই কাজই আমরা করি, পৃথিবীর সঙ্গে এই আমাদের অদলবদল। বরং আমরা যদি সবুজ হতাম, সোজাসুজি কেন্দ্রের দিকে শিকড়ের মতো নাড়াতে পারতাম আমাদের চুল, সমবেত সঙ্গীত হয়ে যোগদান করতাম আমরা, ভোরের ফুটো ফুটো স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যেতাম এক ধ্বনিসাম্য হয়ে। যদি আমরা সবুজ হতাম, এই কালো বাতাসকে বদলে দিতাম শুদ্ধ পানীয় অক্সিজেনে। সেই কাজ যা আমরা করি না।

** ১৩ নভেম্বর, ২০১৩ য় প্যারিস আতঙ্কবাদী হামলার প্রেক্ষিতে লেখা।

 

 

হিংসা সম্বন্ধে

এসো, ছাঁটো সেই শাখা যা ফুলে জ্বলজ্বল করছে না
ছাঁটো দরজার হাতলটাকে
সেই চাকার স্পোকগুলোকে যা আর ঘোরে না
ছাঁটো সেই রাস্তাটা যে নিজেকে বুলিয়ে নেয়না অনেকদূর
এসো, যে বাতাস অন্ধকারে কাশছে, তাকে ছাঁটো
উজ্জ্বল করে তোলো সেই রক্ত যা শিস দিতে দিতে
ক্ষতির দিকে নৌকা ভাসায়

তোমার সঙ্গে যা যা হওয়া সম্ভব তা তোমার সঙ্গে হবে

সেইসব জিনিষ যা একইসঙ্গে নিকট ও লুকনো
আর তুমি জানবেও না কখন, কী
তুমি ঠাহর করতে পারবেনা এমনকি কতদূর,
কেবল আধুনিকতম কোনো ব্যাঙ্কের কাউন্টারে
ভয়ের বিনিময়মূল্য খুঁজে পাবে তুমি

 

 

গ্রেটেল

তুমি যদি চুপ করে থাকো, মার্গারিটা, তাহলে ওরা বুঝতে পারবে না
যে আমি তোমাকে আমার লকারে বন্ধ করে রেখেছি
গতবছরের পুরনো বই আর কাগজপত্রের সঙ্গে একত্রে
রিফ্রেশার কোর্সের ক্যাঁচক্যাঁচে ভিডিও-বাঁধাইগুলোর সঙ্গে
তারা হয়তো লক্ষ্য করবে না যে তোমাকে যেতে দিতে চাই না আমি
বেরোতে দিতে চাইনা এখান থেকে

লক্ষ্য করবে না যে কুলার থেকে আমি তোমাকে এনে দিচ্ছি জল
একটা প্লাস্টিকে মোড়া স্যান্ডউইচ
এই লকারটাই হয়ে উঠতে পারে তোমার ডেরা
যাইহোক, বাইরের থেকে এখানে ভালো আছো তুমি
লকারের দরজা থেকে বাড়িয়ে দেখো তোমার গোলাপি
যদি এখনো হাড়ের চারদিকে মাংস থাকে, তুমি থেকে যেতে পারো
এখনো পর্যন্ত ভুখাপেটের বিপদে তুমি নেই

ভেতরে থাকো, কিন্তু চুপচাপ, অতিরিক্ত ভীতিপ্রদ তোমার মুখ
তোমার দুটো চোখ তার মাঝখানে যেন মাউন্ট এটনা
যারা কাটাছেঁড়া করে সময়,
যা-খুশি-জিনিষের রোলকল করে,
ব্ল্যাকবোর্ডে কড়মড় করে তোমার মুখ, ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়েও কালো,
ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়েও বেশি লেখায় ভরা,
আর তুমি যখন তোমার চিবুকের রেখাকে বাঁকাও
নোংরা প্রশ্নদের ঠেকিয়ে দাও
তখন তুমি খারাপ আদবকায়দার লোক এবং
বড়োও হয়েছো খারাপ সঙ্গে।
নগ্ন পায়ে প্রায় আদিমতার সীমায় দাঁড়িয়ে তুমি নাচো।

নাচো, তুমি পা দিয়ে আঘাত করো,
তোমার হাতদুটো নাড়াও
ঠিক যেন সত্যি সত্যি আগুনে পুড়ছো তুমি

কিন্তু তুমি যদি চুপচাপ থাকো,
মার্গারিটিনা, ওরা লক্ষ্য করবে না
এবং আরও কিছুক্ষণ তোমাকে আমার মধ্যে রাখতে পেরে যাবো আমি

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment