কেমব্রিজে নিউটন
(১৬৬১-১৬৬৫)
সতের শতকের কেমব্রিজ। হাজার পাঁচেক লোকের এক বসতি। কেমব্রিজের আয়তনের নিরিখে সংখ্যাটি কিছুই নয়। শহরের চারপাশে উন্মুক্ত অংশ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। কেমব্রিজের তখন দুটি জিনিস নিয়ে ভারি গর্ব! প্রথমটি, তাদের শতাব্দী প্রাচীন ইউনিভার্সিটি। আর দ্বিতীয়টি হল ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মেলা, স্টৌরব্রিজ ফেয়ার, যা প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে রিভার ক্যাম-এর একেবারে ধার ঘেঁষে এই কেমব্রিজেই বসে। সেপ্টেম্বর এখানে তাই উৎসবের মাস। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে সরগরম হয়ে ওঠে কেমব্রিজ শহর। ইস্ট এংলিয়া, মিডল্যান্ডস্, নর্থ ইংল্যান্ড, এমনকি খোদ লন্ডন শহর থেকেও লোকজন জমায়েত হয়। অনেক ব্যবসায়ী, ক্যাম ধরে নানা রকমের শস্য, কাঠ, উল, পোশাক ইত্যাদি বয়ে নিয়ে আসে মেলায় বিক্রির জন্য। প্রায় এক মাস ধরে চলে স্টৌরব্রিজ ফেয়ার। কেমব্রিজের যত রাস্তা, কাসেল স্ট্রিট, মিড স্ট্রিট, সিলভার স্ট্রিট, কিং স্ট্রিট, সেসময় মুখর হয়ে ওঠে ঘোড়ার গাড়ির শব্দে, আর মানুষজনের কোলাহলে। এই একটি মাস বাদ দিলে, বছরের অন্য সময় অবশ্য এ-শহর শান্তই থাকে।
১৬৬১-র ৪ জুন। কেমব্রিজে এসে পৌঁছলেন আইজাক নিউটন। উলস্থর্প ম্যানর থেকে, গ্রেট-নর্থ-রোড ধরে প্রায় একশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কেমব্রিজে আসতে সময় লাগল ঠিক তিন দিন। সতের শতকের ইংল্যান্ডে পথঘাটের অবস্থা মোটেও সুবিধার ছিল না। উঁচু-নিচু। খানা-খন্দে ভরা। ঘোড়ায় টানা কৌচের গতি ঘণ্টায় মাইল পাঁচেকের বেশি হয় না। মধ্যে মধ্যে ঘোড়াগুলিকে বিশ্রাম দিতেই হয়।
আসার পথে নিউটন একরাত্রি কাটালেন স্যুইসটার্নে। মা, হান্নার কিছু সম্পত্তি রয়েছে সেখানে। দ্বিতীয় রাত্রি থাকলেন স্টিলটনে।
পরের দিন, অর্থাৎ ৫ জুন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজের ডিন ও হেড-লেকচারার, প্রথা মাফিক একবার দেখে নিলেন আগত ছাত্রটি লেকচার গ্রহণের উপযুক্ত কিনা। এরপর ৮ জুলাই, ইউনিভার্সিটির ম্যাট্রিকুলেশন বুক-এ নিউটনের নাম নথিভুক্ত হল। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মেম্বার হলেন আইজাক নিউটন। একই সঙ্গে আরও ষোল জন শিক্ষার্থীও হলেন ইউনিভার্সিটির নতুন সদস্য।
সতের শতকের যে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, সেখানে পারিবারিক আভিজাত্য ও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল সুস্পষ্ট বিভাজন। বিশেষ মর্যাদা পেত উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা ‘অভিজাত-শ্রেণি’র ছাত্রেরা। অন্যেরা দুটি নিম্নস্তরভুক্ত – ‘সাইজার’ ও ‘সাব-সাইজার’। এই সব পড়ুয়ারা বিত্তহীন পরিবার থেকে উঠে আসা। শ্রেণি বিন্যাসে সর্বনিম্ন র্যাঙ্ক ‘সাব-সাইজার’। এই দুই গোত্রের শিক্ষার্থীদের, ‘অভিজাত-শ্রেণি’-র সেবকের কাজ করতে হত। তাদের ঘুম থেকে তোলা, বুট পালিশ করা, কলমে কালি ভরে দেওয়া, বাটারি থেকে ব্রেড ও বিয়ার এনে দেওয়া, ডাইনিং টেবিল সাফ করা, চেম্বার পট থেকে পায়খানা পরিষ্কার করা, ইত্যাদি। বিনিময়ে ‘কোর্স-ফি’ মকুব! থাকা-খাওয়া ফ্রি! আন্দাজ করা যায়, এই বিভাজনের জন্য কী দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হত ‘সাইজার’ এবং ‘সাব-সাইজার’ পড়ুয়াদের।
হান্নার আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল হওয়া সত্ত্বেও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির রেজিস্টারে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম নথিভুক্ত হল একজন ‘সাব-সাইজার’ হিসাবে।
বাৎসরিক আয় ৭০০ পাউন্ডের কিছু কম নয় হান্নার। বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী তিনি! তা সত্ত্বেও এই বিধবা মহিলা তাঁর পুত্রটির পড়াশোনার জন্য কেন যে কার্পণ্য করেছিলেন তার সদুত্তর মেলে না। ছাত্রাবস্থায় নিউটন যে নোটবুকে খরচের হিসাব রাখতেন তাতে দেখা যাচ্ছে, মায়ের থেকে বছরে খুব বেশি হলে ১০ পাউন্ড বরাদ্দ জুটছে তাঁর। অনুমান করা কঠিন নয়, হান্না পুত্রের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে মোটেও রাজি ছিলেন না।
হয়তো সেকারণেই ‘সাব-সাইজার’ গোত্রের ছাত্র হয়েই কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পদার্পণ ঘটল তাদের ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ ছাত্রটির।
উলস্থর্পের সেই নিঃসঙ্গ বালক, গ্রান্থামের সেই একাকী স্কুল ছাত্র, কেমব্রিজে এসে যেন আরও বেশি একলা হয়ে গেল। উলস্থর্প ম্যানর-এর জমিদারি তাঁদের। বাড়িতে চাকরদের সাহায্য পেয়ে বড় হয়েছেন এই যুবক। অথচ ‘সাব-সাইজার’ গোত্রভুক্ত তিনি এখন। নিম্ন মেধার সহপাঠীদের ফাইফরমাশ খাটতে হয়। সামাজিক ভাবে নিজেকে যেন বিচ্ছিন্ন, একঘরে বলে বোধ হতে লাগল আইজাক নিউটনের। নিউটনের হিসাবের খাতা ওল্টালে দেখা যায়, ঠিক এই সময়কালে, সহপাঠীদের অল্প পরিমাণের অর্থ ধার হিসাবে দিচ্ছেন তিনি। পোলার্ড, অলিভার, উইলফোর্ড, টোটাম, এনড্রুজ, বেন, আগাথা, বিগ – এরকম একাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে সেখানে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ‘অভিজাত-শ্রেণি’র ছাত্র। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, সাব-সাইজার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইছেন না নিউটন। তিনি যে বিত্তহীন পরিবারের সন্তান নন তা বোঝাতেই যেন তাঁর এই মরিয়া প্রচেষ্টা!
বাড়ি থেকে আসার সময় নিউটন, কটি বই, এক বোতল লেখার কালি, রাতে পড়ার জন্য এক পাউন্ড মোমবাতি, ডেস্কে লাগানোর জন্য তালা, আর একটি চেম্বার-পট, সঙ্গে করে এনেছেন। ছোট দুটো নোটবুকও রয়েছে তাঁর সঙ্গে। যার একটি (R.4.48c) খরচের হিসাব লেখার জন্য।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা কখনওই সম্ভব হত না নিউটনের, যদি-না এই ইউনিভার্সিটিরই এক ফেলো, হাম্ফ্রি ব্যাবিংটন-এর সঙ্গে তাঁর সঠিক সময়ে যোগাযোগ হত। মিস্টার ব্যাবিংটন-এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় আছে। উলস্থর্পের কাছেই লিঙ্কনশায়ারের এক গ্রাম, ‘বুথবি-প্যাগনেল’-এর তিনি রেক্টর বা যাজক। অবশ্য, নিউটনের সঙ্গে মিস্টার ব্যাবিংটন-এর পরিচয় হয় গ্রান্থামে ক্লার্কের বাড়িতেই। ব্যাবিংটন হলেন, ক্লার্কের শ্যালক। নিউটনের বান্ধবী স্টোরারের মামা। আইজাকের লেখাপড়ার প্রতি তীব্র আগ্রহ নিশ্চিতভাবেই নজরে এসেছিল তাঁর।
ব্যাবিংটনকে, ট্রিনিটি কলেজে মাঝে মধ্যে আসতেই হয় প্রয়োজনে। নিয়ম অনুযায়ী, কেমব্রিজের প্রত্যেক ফেলোর একজন ‘সাইজার’ থাকে। অল্প কিছুদিন ‘সাব-সাইজার’ থাকার পর, আইজাক নিউটনের নাম ব্যাবিংটনের ‘সাইজার’ হিসাবে নথিভুক্ত হল। আন্দাজ করা যায়, ব্যাবিংটনের ব্যবস্থাপনাতেই এসব সম্ভব হয়েছিল। কেমব্রিজে সারা বছরে এক-দেড় মাস থাকেন তিনি। কাজেই ধরতে গেলে, শুধুমাত্র খাতায় কলমেই ‘সাইজার’ হয়ে রইলেন নিউটন।
কেমব্রিজে যখন এলেন, নিউটন তখন উনিশ। লিংকনশায়ারের গ্রাম্য এলাকায় বড় হওয়া এই যুবকের কাছে কেমব্রিজ যেন এক আশ্চর্য নগরী! সেকালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধীনে যত কলেজ ছিল তার মধ্যে ট্রিনিটিই বৃহত্তম। প্রাকৃতিক শোভায় সবচেয়ে সুন্দরও। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রিভার ক্যাম। রাজহাঁস চড়ে বেড়ায় ক্যামের স্ফটিক জলে। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন অষ্টম হেনরি, ১৫৪৬-এ। সুপ্রাচীন মাইকেল হাউস ও কিংস হল নিয়ে পথ চলা শুরু হয় ট্রিনিটি কলেজের। তারপর একে একে, গ্রেট-গেট, গ্রেট-কোর্ট, ক্যামের গা-ঘেঁষে নেভিলস্-কোর্ট, ক্লক-টাওয়ার নির্মিত হয়। প্রতি ঘণ্টায় দুবার শোনা যায় ঘণ্টা ধ্বনি। প্রথমে নীচু ও পরে উচ্চস্বরে, বেজে ওঠে টাওয়ারের ঘড়ি।
ট্রিনিটির আভিজাত্য ও গাম্ভীর্যে যুবকটি গভীরভাবে প্রভাবিত। এখানে এসে খোঁজ মিলল এক ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর। আক্ষরিক অর্থেই এ-এক অনাবিষ্কৃত জগৎ তাঁর কাছে। পরিচয় ঘটল ইতালিয় কবি ও দার্শনিক দান্তের রচনার সঙ্গে। অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শন দিল চিন্তার রসদ। কোপার্নিকাস, টাইকো ব্রাহে, কেপলার ও গ্যালিলিও তাঁকে চেনালেন পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধ আধুনিক বিজ্ঞানকে।
নিউটন যখন কেমব্রিজে এলেন, সেখানে তখন বড় অস্থির সময়। ইতিমধ্যে, পার্লামেন্টারিয়ান শাসনের অবসান হয়েছে। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র ফিরেছে। ক্ষমতার রাশ রয়্যালিস্টদের হাতে। কলেজের নিয়ম কানুন ও ধর্মাচরণ পাল্টে ফেলা হচ্ছে সম্পূর্ণ। প্রশাসনিক স্তরেও রদবদল ঘটছে দ্রুত। কলেজের মাস্টার পদে জন উইলকিন্স-ই যাতে থাকেন সেজন্য প্রায় পঞ্চাশ জন অধ্যাপক ও স্কলার আবেদন জানালেন রাজা দ্বিতীয় চার্লসের কাছে। জন উইলকিন্স ছিলেন একজন সুদক্ষ প্রশাসক। দ্বিতীয় চার্লস কিন্তু কর্ণপাত করলেন না আবেদনে। যাঁকে যোগ্য বলে বিবেচনা করলেন, তিনি ইতিপূর্বেই ‘ব্রেভ-লয়্যালিস্ট’ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৬৬০-এর গ্রীষ্মে, ট্রিনিটির নতুন কলেজ মাস্টার হয়ে দায়িত্বভার নিলেন হেনরি ফার্ন। অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। ‘হাই-চার্চ প্র্যাকটিস’ অর্থাৎ পোপতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ফার্ন।
কিন্তু ট্রিনিটিতে সেসময় পিউরিটান ভাবধারার প্রভাবই যেন বেশি। পিউরিটানরা চান ইংল্যান্ডের সমস্ত চার্চের জাঁকজমক, গোঁড়ামি ও অনুশাসনের আমূল পরিবর্তন। কোনও ব্যক্তি বাইবেলের বাণীর মর্মোদ্ধার করতে পারবে নিজের মতো করে। সহজ সরল জীবনযাপনই প্রার্থিত তাঁদের। ট্রিনিটির মধ্যে পিউরিটান আদর্শে বিশ্বাসী অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চূড়ান্ত বিরোধ বাঁধল ফার্ন-এর। ১৬৬২-র আগস্টে ‘ইউনিফর্মিটি অ্যাক্ট’ চালু হল ট্রিনিটিতে। আইন করে প্রতিষ্ঠিত হল পোপতন্ত্র। এখন থেকে, বিধিবদ্ধ উপাসনা ও চ্যাপেলে সারপ্লাইস পরিধান বাধ্যতামূলক ঘোষিত হল।
ঈশ্বর উপাসনার ‘অযৌক্তিক’ প্রাচীন রীতিনীতি যাঁরা মানতে পারলেন না, ট্রিনিটি ছাড়তে হল তাঁদের। প্রায় বিশজন ফেলো ও স্কলার বিতাড়িত হলেন কলেজ থেকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জন রে-এর মতো সুপণ্ডিত অধ্যাপকও। ট্রিনিটির ইতিহাসে এই বিতাড়ন ‘দ্য গ্রেট ইজেকশান’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইল। বছর দেড়েক কলেজের মাস্টার হিসাবে কাটিয়ে, হেনরি ফার্ন চলে গেলেন চেস্টার-এর বিশপ পদে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে এলেন জন পিয়ারসন। তিনি একজন আদ্যপ্রান্ত রয়্যালিস্ট। ফলে ট্র্যাডিশানাল খ্রিস্টিয় রীতিনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পালে হাওয়া আরও জোরাল হল।
ট্রিনিটির এই সংকটময় আবহের মধ্যেই, কলেজে এসে পৌঁছল এক ঝাঁক নতুন পড়ুয়া। বলা বাহুল্য, আইজাক নিউটনও রয়েছেন সেই দলে।
গ্রান্থামের কিংস স্কুলে পড়ার সময়েই ঈশ্বরের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্য জন্ম নিয়েছে নিউটনের মধ্যে। বাইবেল-এর জ্ঞানও কিছু কম নয়, এই ধর্ম ভীরু যুবকটির।
ট্রিনিটি কলেজে, নিউটনের টিউটর হলেন বেঞ্জামিন পুলিন। গণিত অথবা প্রাকৃতিক দর্শন নয়, তাঁর শিক্ষাদানের প্রায় সবটুকু জুড়েই থাকে খ্রিস্টিয় রীতিনীতি ও গোঁড়া ধর্মীয় আলোচনা। ইউনিভার্সিটির স্ট্যাটিউটে যে সিলেবাস আছে, তা একশো বছরেরও বেশি পুরনো। ইউরোপের অন্য প্রান্তে, ঠিক ওই সময় যে মানের গণিত ও বিজ্ঞান চর্চা চলছে, তার বহু যোজন দূরে ট্রিনিটির পাঠক্রম। অধিকাংশ অধ্যাপকই ইউনিভার্সিটির এই পাঠক্রমকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন না। শিক্ষার্থীদের তাই নিজেদের পছন্দমত পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়। তার একটা অসুবিধাও ছিল। কেমব্রিজে নবাগত শিক্ষার্থীদের সঠিক গাইডেন্স-এর অভাব। কী বই পড়তে হবে, কোন পথে অগ্রসর শ্রেয়, বুঝে উঠতে পারে না তারা। নিউটনের অবশ্য সে সমস্যা নেই। বরাবরই ‘সেল্ফ-রিডার’ এই যুবক। সম্ভব হলে, জগতের সমস্ত বই-ই একবার পড়ে দেখে নেবেন তিনি!
যুবকটি ইতিমধ্যেই, সৎপিতা বারনাবাস স্মিথের শ-দুয়েক থিয়লজি বিষয়ক বই-এর মালিক। গ্রান্থামের কিংস স্কুলে লেখাপড়া ও ক্লার্কের বাড়িতে থাকার সুবাদে, ধর্মতত্ত্বের বই ছাড়াও মেডিসিন, অ্যাস্ট্রোলজি ও গণিত বিষয়ক বেশ কিছু বইপত্র পড়ার সুযোগও ঘটেছে তাঁর। কিংস স্কুলে আসা যাওয়ার পথেই পড়ে উলফ্রাম চার্চের লাইব্রেরি। সেখানকার সমস্ত বই চেন দিয়ে বাঁধা। যে কোনও প্রকার গ্রন্থ-ই বহু মূল্যবান সেই কালে। চেন-বাঁধা সেসব বই নিউটন পড়েননি তা কি সম্ভব?
নিউটনের মৃত্যুর পর, দু-হাজারেরও বেশি বই তাঁর নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে আবিষ্কৃত হয়। ‘দ্য লাইব্রেরি অব আইজাক নিউটন’ শীর্ষক বই-এ লেখক জন হ্যারিসন এই সমস্ত বই এর একটি ক্যাটালগ প্রস্তুত করেন।
এই ক্যাটালগটিতে দেখা যায়, ১৬৬১ সালে অর্থাৎ আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট-এর প্রথম বছরে, নিউটন কয়েকটি মাত্র বই-ই কিনেছেন। তার মধ্যে চারটি থিয়লজির। তালিকাটি অবশ্য দীর্ঘ হওয়া সম্ভবও ছিল না। ব্যয়ের জন্য অতি সামান্য অর্থই যে তাঁর বরাদ্দ! জন কালভিনের ‘ইন্সটিটিউট অব দ্য খ্রিস্টান রিলিজিয়ন’, রবার্ট স্যান্ডরসন-এর লজিক বই, একটি গ্রিক-লাতিন ও লাতিন-গ্রিক অভিধান, প্রাকৃতিক দর্শনের একটি বই, ‘দ্য ইলিয়াড অ্যান্ড দ্য ওডিসি’-র একটি সংক্ষিপ্ত ভার্সান, ইত্যাদি। বড়জোর সাত-আটখানি বই। লক্ষণীয়ভাবে, ট্রিনিটিতে অন্তত প্রথম দুটি বছর, গণিত অথবা বিজ্ঞান বিষয়ে কোনও প্রকার উৎসাহ নিউটনের মধ্যে অনুপস্থিত। জীবনের এই কালটিতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন ছিলেন ধর্মতত্ত্ব ও খ্রিস্টিয় ইতিহাস চর্চায়।
১৬৬২-র গ্রীষ্ম। নিউটন পড়লেন মহা সংকটে। নিজের ধর্মাচরণে সন্তুষ্ট নন। ইতিমধ্যেই অনেকগুলি ‘পাপ কাজ’ করে ফেলেছে যে যুবকটি! ‘কৃত পাপ কর্ম‘-এর একটি তালিকা প্রস্তুত করলেন তিনি। টমাস সেল্টনের শর্ট নোটেশন-এ লিখলেন সেই তালিকা। কেমব্রিজের একজন ছাত্রের কাছে শর্ট নোটেশন শিখে নেওয়াটা খুব জরুরী ছিল সেসময়। একদিকে যেমন সময় বাঁচে, সেই-সঙ্গে লেখার কাগজও বাঁচে। কিন্তু, নিউটন শর্ট নোটেশন ব্যবহার করলেন কেন? সহজেই কেউ যাতে তালিকাটি পড়ে নিতে না পারে? যতই হোক, এসব যে তাঁর স্বকীয় ‘অপকর্ম’!
এক কালে, ট্রিনিটির জনৈক শিক্ষক, জেমস্ ডুপোর্ট, ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের জন্য ‘আদর্শ আচরণবিধি’ রচনা করেছিলেন। ডুপোর্ট লিখেছেন, একজন বিদ্যার্থী নিজেকে ‘স্পিরিচুয়াল অ্যান্ট’ বলে ভাববে। যে নিরন্তর থাকবে ব্যাপৃত তার আত্মার খাদ্যান্বেষণে ও পুষ্টিসাধনে। তাকে হতে হবে অধ্যবসায়ি। প্রত্যহ সকাল ছটায় এবং সন্ধ্যা পাঁচটায় প্রার্থনার জন্য হাজির থাকতে হবে চ্যাপেলে। রবিবার লর্ডস্ ডে। আর সব দিনের তুলনায় কিছু আগে ঘুম থেকে উঠে উপস্থিত হতে হবে ‘গ্রেট সেন্ট মেরি চার্চে’।
সময়ের সাথে-সাথে ডুপোর্টের আচরণবিধি অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে ট্রিনিটিতে। কিন্তু কেমব্রিজে আসার পর নিউটনের মধ্যে ভারি একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ক্রমে হয়ে উঠছেন খাঁটি ধর্মপ্রাণ মানুষ! হয়তো সেকারণেই এই আত্মগ্লাণি! আর তা থেকে জন্ম নিল একটি ‘পাপের-তালিকা‘ (Fitzwilliam Notebook)!
তালিকাটিকে তিনি দুভাগে ভাগ করলেন। ওই দিনের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ, উলস্থর্প ও গ্রান্থামে থাকার সময়কার ‘পাপ কাজ’, যা তিনি স্মৃতি থেকে লিখলেন। আর ওই দিনটির পর থেকে তিনি যে সব ‘পাপ কাজ’ করতে থাকলেন তা তালিকাটিতে জুড়তে থাকলেন।
প্রথম তালিকাটি এরকম – চার্চের মধ্যে আপেল খেয়েছিলেন একদিন, রবিবার রাত্রে পাই বানিয়েছিলেন, এক রবিবার ইঁদুর ধরার ফাঁদ তৈরি করেছিলেন, সারমন অর্থাৎ ধর্মোপদেশ পাঠ শোনার সময় ছিলেন অমনোযোগী, কিমনেল-এ সাঁতার কেটেছিলেন রবিবার, ইয়ন কিস-এর টুপির মধ্যে পিন রেখেছিলেন, সৎ-বাবা ও মা-কে পুড়িয়ে মারা এবং একই সঙ্গে গোটা বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, একাধিক ব্যক্তিকে পেটানো, বোনকে ঘুষি মারা, এডওয়ার্ড স্টোরারের চেরি কবস্ চুরি করা এবং তা চুরি করে অস্বীকার করা, মন্দ কথা ভাবা ও স্বপ্নে দেখা, মায়ের বাদাম ও চিনির বাক্স চুরি করা, ভৃত্যদের সঙ্গে ঝগড়া করা, ডরথি রোজ-কে গালমন্দ করা, আর্থার স্টোরারকে মারা, এক পিস ব্রেড আর বাটারের জন্য মাস্টার ক্লার্কের সঙ্গে অশান্তি করা, ঈশ্বরের চেয়ে জাগতিক বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, ঈশ্বরের থেকে মানুষকে অধিক শক্তিধর ভাবা, ইত্যাদি।
পরের তালিকাটি অবশ্য দীর্ঘ নয়। অতিভোজন, নিজের তোয়ালের বদলে উইলফোর্ডস-এর তোয়ালে ব্যবহার, চ্যাপেলে যাওয়ার ব্যাপারে অবহেলা, প্রার্থনায় অবহেলা, পেটিটকে শনিবার রাত্রি বারোটার সময় জল-ঘড়ি বানাতে সাহায্য করা, আপত্তিকর আচরণ করা, ইত্যাদি।
ট্রিনিটিতে নিউটন সঙ্গিহীন। প্রতিভাধর বলেই হয়তো কারও সাথে তাঁর মেলে না। কলেজে অনেকেই, অবসর সময়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে, ফুটবল অথবা টেনিস খেলে। নিউটনকে এসব টানে না। তবে তাঁর হিসাবের খাতায় অর্থাৎ ‘ট্রিনিটি কলেজ নোটবুক’ (R.4.48c)-এ দেখা যায়, কেমব্রিজে এসেই যে কটি সামগ্রী তিনি কেনেন, তার মধ্যে ২ সিলিং ৬ পেন্স দিয়ে কেনা একটি দাবার বোর্ড রয়েছে। তার মানে দাবা খেলায় তাঁর আগ্রহ ছিল। টেনিস কোর্টের জন্য তিনি যে নিয়মিত ৭ পেন্স ফি দিতেন তারও উল্লেখ রয়েছে এই নোটবুকেই। তবে তিনি টেনিস খেলতেন কিনা তা জানা যায়নি। অনেক পরে, নিউটন তাঁর ভাগ্নি, ক্যাথেরিনকে বলেছিলেন যে তিনি চাইনিজ চেকার খেলায় যে-কোনও প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতেন যদি প্রথম চালটি তাঁর হত।
যা-ই হোক-না-কেন, যুবকটি নিজের মধ্যে নিমগ্ন থাকতেই যে পছন্দ করেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই!
এই প্রসঙ্গে, ট্রিনিটি কলেজে নিউটনের ছাত্রজীবনের একটি অ্যানেকডোট উল্লেখ করা যায়। নিউটন তাঁর প্রথম রুমমেটকে নিয়ে অত্যন্ত অখুশি ছিলেন। একদিন বিকালে, কলেজ প্রাঙ্গণে একাকী হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই তাঁর সাক্ষাৎ হয় আর এক নিঃসঙ্গ যুবক, জন উইকিন্স-এর সাথে। কলেজে উইকিন্স সামান্য জুনিয়র তাঁর থেকে। এই ছেলেটিকে দেখে নিউটনের বেশ ভাল লাগে। ওদিকে উইকিন্সও খুশি ছিলেন না তাঁর রুমমেটকে নিয়ে। এরপর নিউটন ও উইকিন্স, তাঁদের ‘বিশৃঙ্খল’ রুমমেটদের থেকে আলাদা হয়ে একসাথে থাকতে শুরু করেন। একটি নতুন চেম্বারে। পরবর্তীকালে এই ঘটনাটির কথা জানান উইকিন্সের ছেলে। উইকিন্সের মতো বন্ধু সারা জীবনে নিউটন আর পাননি। বহু ক্ষেত্রে কপি করার কাজে নিউটনকে সাহায্য করেছেন উইকিন্স অর্থাৎ নিউটনের অনুলিপিকরের ভূমিকা পালন করেছেন।
উইকিন্স বন্ধু ঠিকই, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় সঙ্গী বই! যে কোনও বই পেলেই নিউটন সাথে সাথে পড়তে শুরু করেন এবং যতটুকু পড়েন একটি নোটবুকে (MS Add. 3996) নিজের মতো করে তা লিখে রাখেন।
১৬৬৩ সাল। নিউটন পড়লেন অ্যারিস্টটলের দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও লজিক। অ্যারিস্টটল জিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের প্রবক্তা। অর্থাৎ, তাঁর দর্শন অনুসারে পৃথিবীই হল মহাবিশ্বের কেন্দ্র। পৃথিবীকে ঘিরেই গ্রহ নক্ষত্রেরা বিচরণ করে। কোপার্নিকাসের হিলিওসেন্ট্রিক অর্থাৎ সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের মীমাংসা কিন্তু ততদিনে হয়ে গেছে। অ্যারিস্টটলের জিওসেন্ট্রিক মডেল যে ভুল তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের আর কোনও সংশয় নেই। সম্ভবত বিষয়টি নিউটনও অবগত।
অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শনকে ভিত্তি করে জার্মান দার্শনিক জোহানেস ম্যাগিরাস-এর লেখা, ‘ফিজিওলজিয়েই পেরিপ্যাটেটাইসেই’ ছিল সে সময়ের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাঠ্যবই। ম্যাগিরাস-এর বই পড়ে আলোর স্বরূপ সম্পর্কে কৌতূহলী হলেন নিউটন। বইটি থেকে নিজের মতামত সহ বেশ কিছু অংশ, ‘আলোর কণা ধর্ম’ শিরোনামে লিখে রাখলেন তাঁর নোটবুকে।
অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান বলছে, রামধনু আসলে আকাশ থেকে ঝরে পড়া আলোর কণিকা। অ্যারিস্টটলের এই সনাতন বিজ্ঞান দর্শন নিউটনের তরুণ মনকে গভীর ভাবে নাড়িয়ে দিল। সেই সঙ্গে এই প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্যে নানা গরমিলও নজর এড়াল না। অ্যারিস্টটলের সব কথা যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হচ্ছে যুবকটির। তিনি যে সংশয়ী, সে কথা নোটবুকে লিখে রাখলেন ল্যাটিন-এ। যার বাংলা তর্জমাটি হল – “অ্যারিস্টটল এবং প্লেটো নিঃসন্দেহে আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু আমার পরম বন্ধু সত্য!” এই সেই সত্য যার সন্ধানে আইজাক নিউটন জীবনভর থাকবেন ব্যাপৃত।
ম্যাগিরাস শেষ করার কিছু আগেই তাঁর যতটুকু প্রয়োজন তা নোটবুকে কপি করে, নোটের নিচে লাইন টেনে ইতি টানলেন।
শুধুমাত্র প্রকৃতি বিজ্ঞান নয়, যুবকটি এবার ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হচ্ছেন উচ্চতর গণিতের প্রতি। একাকী পথ চলা। টিউটরের সাহায্য ছাড়াই শিখতে শুরু করলেন এনালাইটিক জিওমেট্রি, সিম্বলিক অ্যাল্জেবরা, ট্রিগনমিট্রি।
অথচ, গণিতে তাঁর প্রেম কিছুটা যেন আকস্মিক ভাবেই ঘটল। ঘটনাটি জানান, বিশ্বখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ আব্রাহাম ডি ময়ভার্। তিনি ছিলেন আইজাক নিউটনের বন্ধু স্থানীয়। নিউটনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় লন্ডনের বাসভবনে। বয়সে নবীন এই গণিতবিদ ছিলেন নিউটনের প্রবল গুণমুগ্ধ।
ময়ভার্-এর বিবরণ অনুযায়ী, ১৬৬৩-র স্টৌরব্রিজ ফেয়ার থেকে খানিক কৌতূহলের বশেই অ্যাস্ট্রোলজির অর্থাৎ জ্যোতিষবিদ্যার একটি বই কিনেছিলেন নিউটন। বইটি পড়তে গিয়ে এক জায়গায় বাধা পান। জ্যামিতির বিশেষ ধারণা না থাকায় অসুবিধা হল বিষয়টি বুঝতে। নিউটন তখন, ইউক্লিডের জিওমেট্রি, ‘দ্য এলিমেন্টস্’-এর পাতা উল্টে দেখলেন। কিন্তু প্রথমবার পড়ায় তেমন নতুন কোনও ধারণা এলিমেন্টস্ থেকে পাওয়া গেল না। এরপর উইলিয়াম অট্রেড-এর ছোট চটি আকারের গণিত বই, ‘ক্লাভিস ম্যাথামেটিকা’ এবং দেকার্তের জিওমেট্রি বই-তে মনোনিবেশ করলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে গেলেন ইউক্লিডের এলিমেন্টস্-এ। এবার তিনি খুঁজে পেলেন জ্যামিতির নানান খুঁটিনাটি বিষয়। ইউক্লিড শেষ করে দেকার্তের গণিতে আবারও একবার নিমগ্ন হলেন। তারপরই ওই সময়কার অঙ্কশাস্ত্রের যে আধুনিক বই, ‘এরিথমেটিকা ইনফাইনিটোরাম’, নিয়ে বসলেন নিউটন।
এই বইটি কলেজেরই কোনো একজনের থেকে ধার নিয়েছিলেন তিনি। বইটির লেখক এক প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ গণিতবিদ ও একইসঙ্গে খ্রিস্টিয় পাদ্রি জন ওয়ালিস। বইটির শুরুতেই, বৃত্ত, উপবৃত্ত, অধিবৃত্ত, ইত্যাদি অর্থাৎ কনিক সেকশান নিয়ে আলোচনা করেছেন ওয়ালিস। দেকার্তের জিওমেট্রিতে যে সব ত্রুটি ও অস্বচ্ছ ধারণা যুক্ত ছিল, ওয়ালিস তা দূর করে এরিথমেটিকা ইনফাইনিটোরাম রচনা করেছেন প্রণালীবদ্ধ ভাবে। সূচকের রীতি, বক্ররেখার অন্তর্গত ক্ষেত্রফল নির্ণয় ইত্যাদি বিশদে ও নিজের উদ্ভাবিত পথে আলোচনা করেছেন বইটিতে। (প্রসঙ্গত, গণিত বিশারদ ওয়ালিস-ই সর্বপ্রথম ইনফিনিটি বা অসীম সংখ্যার প্রতীকটির প্রচলন করেন।)
একটি প্রশ্ন মনে জাগে, ইনফাইনিটোরাম-এর মতো এরকম একটি উচ্চমানের গণিত বই কার থেকে ধার করেছিলেন নিউটন? ট্রিনিটিতে কোন অধ্যাপক তাঁকে সাহায্য করছেন আধুনিক অংক শাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে?
এর উত্তর পেতে, ট্রিনিটি কলেজে, ১৬৬৩-র একটি বিশেষ ঘটনার সমাপতন নজর করতে হবে। গণিতে লুকাসিয়ান চেয়ার পদটির প্রচলন হয় ওই বছরই। সর্বপ্রথম, যিনি এই পদটির যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন, তিনি প্রফেসর আইজাক ব্যারো। এরপর যিনি এই পদটি অলংকৃত করবেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং আইজাক নিউটন। কিন্তু, ১৬৬৩-তে তার কোনও প্রকার আভাস মেলে না নিউটনের পরীক্ষার ফলাফলে!
প্রফেসর ব্যারোর অঙ্কের লেকচার ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন নিউটন। যুবকটির গণিত প্রীতি নিশ্চিত ভাবেই মুগ্ধ করেছিল প্রফেসর ব্যারো-কে। খুব সম্ভবত, প্রফেসর ব্যারোই, নিউটনকে ওয়ালিস-রচিত গণিতের বইখানি দিয়েছিলেন।
১৬৬৪। নিউটনের প্রাকৃতিক দর্শন ও গণিত সাধনা চলছিল নিভৃতে। কিন্তু, ট্রিনিটিতে থাকতে গেলে যে স্কলারশিপ চাই! তাঁর একান্ত প্রয়োজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ। না-হলে কেমব্রিজ ছাড়তে হবে তাঁকে। আর ঠিক এই সময়েই তিনি, ইউনিভার্সিটির নির্ধারিত পড়াশোনা সরিয়ে রেখে, মনোনিবেশ করলেন উচ্চতর গণিতে! যার কোনও মূল্য নেই স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে! নিউটনের একাডেমিক রেকর্ডও ভাল নয় এবং সেই সঙ্গে তিনি আবার সাইজার গোত্রভুক্ত। আশার আলো ক্ষীণ। কিন্তু ছেলেটি যে মেধাবী, টিউটর পুলিন তা জানেন। আরও একজন জানেন। তিনি প্রফেসর ব্যারো।
কলেজ মাস্টার জন পিয়ারসন-এর সঙ্গে যে আটজন সিনিয়র ফেলো কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব সামলান তাঁদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলেন ব্যারো। অপরদিকে, একনিষ্ঠ রাজভক্ত হিসাবে হাম্ফ্রি ব্যাবিংটনও হয়ে উঠছেন রীতিমত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। অচিরেই তিনি ট্রিনিটির সিনিয়র ফেলো মনোনীত হবেন। এই ব্যাবিংটনের হাত ধরেই ট্রিনিটিতে এসেছেন নিউটন। মনে করা হয়, প্রফেসর ব্যারো অথবা মিস্টার ব্যাবিংটন – এঁদের দুজনের মধ্যেই কোনো একজন ছিলেন নিউটনের পেট্রন, পৃষ্ঠপোষক। শেষমেশ সকল বাধা দূর হয়ে, ১৬৬৪-র ২৮ এপ্রিল, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের জন্য নিউটনের নাম বিবেচিত হল।
স্কলারশিপ লাভের পর নিউটন আর ‘সাইজার’ শ্রেণির রইলেন না। পরবর্তী চার বছর অর্থাৎ, ১৬৬৮-তে এম-এ পড়ার আগে পর্যন্ত, কেমব্রিজে থাকতে পারবেন তিনি। খাওয়া-পরা বাবদ, বছরে বরাদ্দ হল ১৩ সিলিং ৪ পেন্স। এছাড়াও বৃত্তি হিসাবে পাবেন সমপরিমাণ নগদ অর্থ। এবার তিনি নিশ্চিন্ত মনে, পরমানন্দে, মগ্ন থাকবেন নিজের পছন্দের ক্ষেত্রে। প্রকৃত অর্থে, নিউটনের বিজ্ঞান সাধনা শুরু হল এই সময় থেকেই।
রুমমেট উইকিন্সের স্মৃতি চারণায় জানা যায়, নিউটন যখন কোনও বিষয় নিয়ে চর্চা করতেন, তখন এতটাই নিবিষ্ট হয়ে যেতেন যে, খাওয়া-দাওয়ার কথা আর খেয়ালই থাকত না তাঁর। এমন ঘটনা কতবার হয়েছে, তাঁর খাবার শেষ পর্যন্ত দিয়ে দিতে হয়েছে পোষা বেড়ালকে। উইকিন্স মজা করে সংযোজন করেছেন, অতিরিক্ত ভোজনের ফলে নিউটনের বেড়ালটিই ক্রমশ মোটা হয়ে গেল!
১৬৬৪-র ডিসেম্বর মাস। আকাশে এক ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটল। নিউটন রাতের পর রাত জেগে, পর্যবেক্ষণ করলেন ধূমকেতুটিকে। দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, সিরিয়াস অর্থাৎ লুব্ধক ও প্রোসিয়ন অর্থাৎ প্রশ্বা, এদের সাপেক্ষে ধূমকেতুটির কৌণিক অবস্থান ও পর্যবেক্ষণের সময়কাল লিখে রাখলেন নোটবুকে (MS Add. 3996) – ‘On Saturday at 30min past 4 of the clock in the morning December 17th 1664 A Comet appeared Whose distance from Sirius was 30d,0ʹ. from Procyon 38d, 45ʹ…’।
গ্রহ, নক্ষত্র ও ধূমকেতুদের চলাচল ঘিরে, নিউটনের মনে হাজারো জিজ্ঞাসা। সমকালীন দুই বিজ্ঞানী, রণে দেকার্তে এবং রবার্ট বয়েলের প্রাকৃতিক দর্শনও তাঁকে অস্থির করে তুলেছে! অনেক প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেতে হবে তাঁকে।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ওই সময়কার তাঁর একটি নোটবুক (MS Add. 3996) এসবের সাক্ষ্য বহন করে। কেমব্রিজে ছাত্র থাকাকালীন, ১৬৬১ থেকে ১৬৬৫-র মধ্যে, বিভিন্ন সময়ে নিউটন এই নোটবুকটিতে লিখেছেন। তাঁর নোটবুকগুলির মধ্যে, এক অর্থে এটি-ই সবচেয়ে মূল্যবান! বাদামী চামড়ার মলাটে মোড়া। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে, চোদ্দ বাই সাড়ে-নয় সেন্টিমিটার। পৃষ্ঠা সংখ্যা, ১৪০। নোটবুকের প্রথমেই, নিজের নাম লিখে নোটবুকটির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘আইজাক নিউটন, ট্রিনিটি কলেজ, ১৬৬১’। নোটবুকটির শুরু ও শেষ, একসাথে দু’প্রান্ত থেকে লিখতে আরম্ভ করেছেন নিউটন। সেসময় এরকমটা অনেকেই করতেন। কারণ, লেখার কাগজ ছিল খুবই দামি।
এই নোটবুকে, কোন বিষয় ঠিক কখন লিখেছেন, তার সন-তারিখের উল্লেখ নেই। না থাকার-ই কথা। এ-তো আর কোনও অফিসিয়াল ডকুমেন্ট নয়। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সামগ্রী। ভিন্ন ভিন্ন পেন ও কালি দিয়ে লিখেছেন। কোথাও-বা হরফও গেছে বদলে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এক-দু বছরের ব্যবধানে, নিজের দরকার মতো লিখেছেন। এমনকি, একই পাতায় বিভিন্ন সময়ের লেখার ছাপ স্পষ্ট।
এই নোটবুকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অংশটি, তা অবশ্যই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ‘কয়েকটি দার্শনিক প্রশ্ন’। এই বিশেষ প্রশ্নগুলি, যেন তিনি নিজেকেই করছেন এবং নিজেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
গ্রহ, নক্ষত্রদের গতি ও স্থিতি সংক্রান্ত রণে দেকার্তের যে ‘ভর্টেক্স-মডেল’ বা ঘূর্ণি-তত্ত্ব সে সময় প্রচলিত, সেই মডেলে ধরা হয়, সৌরজগতের সমস্ত স্থান বা স্পেস ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার পদার্থ দিয়ে পূর্ণ। আর সেই সব পদার্থ, সূর্যকে ঘিরে প্রকান্ড ঘূর্ণিরূপে বেগবান। ঘূর্ণির কেন্দ্রস্থলে সূর্য।
দেকার্তের এই ভর্টেক্স মডেল নিয়ে তখন রীতিমতো চর্চা হচ্ছে ইউরোপের সমস্ত ইউনিভার্সিটিতে। এই ফরাসি দার্শনিক, গণিতবিদ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী, রণে দেকার্তে, ইউরোপের শিক্ষা প্রাঙ্গণে তখন অথরিটি। তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান চেতনা প্রায় প্রশ্নাতীত! কিন্তু, বাইশ বছরের এক যুবক মেনে নিতে পারছেন না, দেকার্তের ভর্টেক্স থিয়োরি। যুবকটি, একান্তে তাঁর জিজ্ঞাসা ও সংশয়ের কথা লিখে রাখছেন নোটবুকে।
তিনি লিখলেন – ‘দেকার্তের ঘূর্ণি কি ধূমকেতুকে মেরুর দিকে নিয়ে যেতে পারে? এ-কি সেই একই ঘূর্ণি যা সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত? দেকার্তের এই তত্ত্ব কি ধূমকেতুর পুচ্ছ সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করতে পারে?’
শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা নয়, সেইসঙ্গে তিনি নিজের মতো করে একাধিক নৈসর্গিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করছেন। মেরুচ্ছটা সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ নিউটন লিখেছেন তাঁর নোটবুকে। জোয়ারভাটা কি কারণে হয়, তারও অনুসন্ধান করছেন যুবকটি। যদিও, জোয়ারভাটা সৃষ্টির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে আরও বেশ কয়েক বছর পর, তাঁর প্রিঙ্কিপিয়া গ্রন্থে।
এই সব প্রাকৃতিক ঘটনা ছাড়াও পদার্থের অ্যাটম, আলোর প্রকৃতি ও বর্ণের প্রতিও নিউটনের অদম্য কৌতূহল।
তামা, টিন, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ইত্যাদি ধাতু গলিয়ে কিভাবে সংকর ধাতু প্রস্তুত করা যায়, সেসবের ফর্মুলা লিখে রেখেছেন নোটবুকে। এটির প্রয়োগ হিসাবে তিনি লিখেছেন ‘মেটাল ফর রিফ্লেকসন‘ অর্থাৎ, প্রতিফলক ধাতু। এই-সেই মিশ্র ধাতু, যা দিয়ে আর কয়েক বছর পরই তিনি সৃষ্টি করবেন অবতল দর্পণ এবং তা ব্যবহার করবেন তাঁর প্রতিফলন টেলিস্কোপের অভিলক্ষ্য বা অব্জেক্টিভ হিসাবে। ইউরোপের বিজ্ঞানী মহল অবাক হয়ে দেখবে সেই আবিষ্কার। কেমন সে মানুষ! এমন বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা, অথচ কী নিখুঁত যন্ত্র বানানোর হাত!
নিউটনের নোটবুক দেখলে বোঝা যায়, শুধুমাত্র দেকার্তে ও বয়েল নন। কেমব্রিজে ছাত্রাবস্থায়, তিনি হেনরি মোর-এর ‘ফিলোজফিক্যাল রাইটিংস’, গ্যালিলিও গ্যালিলির ‘ডায়ালগ’ এবং টমাস হবস্ ও যোসেফ গ্ল্যানভিল-এর লেখা পড়েছেন। তাছাড়া, ডাচ গণিতজ্ঞ ভন স্কুটেন-এর ল্যাটিনে রচিত এনালাইটিক জিওমেট্রির দুটি খন্ডও নিউটনকে সাহায্য করেছে গাণিতিক দক্ষতা অর্জনে।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, ১৬৬৫-র জানুয়ারিতে, ট্রিনিটি কলেজের ছাব্বিশ জনের একটি ব্যাচকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি প্রদান করল। সেই ব্যাচের একটি নাম আইজাক নিউটন। গ্র্যাজুয়েট হলেন নিউটন।
১৬৬৫-র গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের শহরাঞ্চলে প্লেগ ভয়াবহ আকার নিল। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ লন্ডন শহরে প্লেগের প্রকোপ হল মারাত্মক। প্রতি সপ্তাহে, মৃত্যু ঘটছে সাত-আট হাজার মানুষের। ১৬৬৫ থেকে ১৬৬৬ এই দুই বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে হত্যালীলা চালাল প্লেগ দানব। ‘গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন’ নামে চিহ্নিত হয়ে রইল এই মহামারী। কেমব্রিজ টাউনেও এর শিকার হল বহু মানুষ। জারি হল সরকারি নির্দেশ। সমস্ত রকম পাবলিক মিটিং, জমায়েত নিষিদ্ধ। কেমব্রিজের জনপ্রিয় স্টৌরব্রিজ ফেয়ার বাতিল করা হল সে বছর।
৮ আগস্ট, ট্রিনিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করল কলেজ বন্ধের। যদিও, অধিকাংশ ছাত্র মাস দুই আগেই কলেজ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছে। দূরে শহরতলী অঞ্চলে, কিছু ছাত্র পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকল টিউটরের তত্ত্বাবধানে।
আত্মপ্রত্যয়ী আইজাক নিউটন কেমব্রিজ ছেড়ে চললেন উলস্থর্প ম্যানরের উদ্দেশ্যে।
ঠিক কোন মাসে তিনি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন, তা জানা যায় না। তবে, কলেজের তথ্য থেকে বোঝা যায়, নিউটন গিয়েছিলেন ১৬৬৫-র মে থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে কোনও এক দিন। তার মানে, কলেজ অফিসিয়ালি বন্ধ হওয়ার আগেই।
সূত্রনির্দেশ
- https://www.historic-uk.com/CultureUK/The-Stagecoach
- http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/PERS00001 (R.4.48c, Trinity College Library, Cambridge, UK)
- http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/diplomatic/ALCH00069 (Fitzwilliam Notebook, Fitzwilliam Museum, Cambridge, UK)
- http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/THEM00092 (MS Add. 3996, Cambridge University Library, Cambridge, UK)
- A. R. Hall, Sir Isaac Newton’s Note-Book, 1661-1665, Cambridge Historical Journal, Vol. 9, 1948, pp. 239–250
- R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980
- R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017
- A. R. Hall, Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996
(চলবে)
অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী