দেবব্রত কর বিশ্বাস

একটি অদ্ভুত গল্প

গত সোমবার আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিলো।

আজকেও সোমবার। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না ঠিক এক সপ্তাহ আগে ঠিক কী হয়েছিলো। এমন সময় আমার এক পুরনো বদভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি একটার পর একটা পুরনো অপমানের কথা মনে করতে থাকি, যাতে আমার মন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী হয়, মনকে আরাম দিতে আমার অন্য মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠে। তখন স্মৃতি খুঁজে খুঁজে বের করে আনে এমন সব অদ্ভুত আলোঅন্ধকারস্মৃতি, যার ফলে আমার মন অন্য দিকে ঘুরে যায়, অন্য রাস্তায় হাঁটতে থাকে আমার ভাবনাগুলো, তখন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই ভুলে যাওয়া অতীতে। যদিও অতীত নিয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। আমি কোনও পুরনো ঘটনা নিয়ে ভাবছি মানেই সেটা আমার কাছে অতীত নয়। সময়ের খেলায় সে দূরে চলে গেছে মানেই সে অতীত এমন সরলরেখায় আমি বিশ্বাস নেই। চলো এবার ভাবা যাক এই এক সপ্তাহ আমি কী ভাবে কাটিয়েছি। দাঁড়াও দাঁড়াও, তার একটা সিগারেট খেয়ে নিই।

আমি একটা সিগারেট ধরালাম। গোল্ডফ্লেক কিং। রমেশদাকে জিজ্ঞেস করলাম- “লাইটার আছে?” শুনে এমনভাবে তাকালো যেন এক লাখ টাকা চেয়েছি। তারপর আবার হাসিমুখে এগিয়ে দিলো। কী অদ্ভুত পাবলিক! পৃথিবীর যাবতীয় অদ্ভুত জিনিস দেখলে প্রথমে আমার রাগ হয়, তারপর হাসি পায়, তারপর আমিও অদ্ভুতভাবে উদাসীন হয়ে পড়ি। আমি রাগের চোটে লাইটারের চাকা বার চারেক ঘষলাম। চিরিক চিরিক করে দুবার আগুন বেরোলো, কিন্তু তাতে সিগারেট ধরানো যায় না। কারণ সিগারেট ধরানোর জন্য ফস করে আগুন বেরোনোর প্রয়োজন। আমি পারলাম না। আমাকে দেখে রমেশদা হেসে বললো, “অন্যের রাগ লাইটারের ওপর ঝাড়ছো কেন? দাও আমি ধরিয়ে দিই।” বলেই আমার অনুমতি না নিয়ে আমার হাত থেকে লাইটারটা কেড়ে নিয়ে দুহাতে আড়াল করে ফস করে আগুন জ্বালালো। তারপর এলআইসির অর্ধেক লোগোর মতো করে হাতটা আমার সিগারেটের দিকে এগিয়ে দিলো। আমি সিগারেট ধরালাম। ফুকফুক করে দুবার টানালাম। ধোয়াটা ভিতরে ঢুকে আমার মাথাটা সাময়িক পরিষ্কার করলো। আমি হাসিমুখে বললাম- “তুমি জানো না রমেশদা, সেদিন অফিসে ঠিক কী হয়েছিলো।” রমেশ অন্যদিকে তাকিয়ে একে ওকে তাকে সিগারেটটা, পানটা দিচ্ছে। আমি চুপ করে মজাসে সিগারেট টানতে লাগলাম। সিগারেট এমন এক বস্তু, বিশেষ করে এই তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্তদের কাছে, যাকে প্রাণভরে শুষে শুষে উপভোগ করা যায়, এবং শেষ হয়ে গেলে ছুঁড়েও ফেলা যায়। মানে মধ্যবিত্তদের অবস্থাবদল করা আর কী! অনেকক্ষণ পরে, যখন দোকান একটু ফাঁকা হয়ে এসেছে, তখন রমেশদা বলে উঠলো, “কী হলো, চুপ করে গেলে কেন? বলো কী হয়েছে অফিসে?”… আমি বললাম- “ছাড়ো তো ওসব কথা, কী হবে আর! যা হয় সব জায়গায়, বলে কোনও লাভ নেই, কারণ আমার বা তোমার কথা কেউ শুনবে না রমেশদা।” রমেশদা লজেন্স এগিয়ে দিয়ে বললো, “আহা বলোই না শুনি”… আমি বলতে শুরু করলাম- “একটা চাকা গো রমেশদা, আচ্ছা তোমার গাড়ি আছে? আমার নেই তো, তাই আমি জানি না। সেদিন মানে, এই-তো সেদিন, এগজ্যাক্ট ডেটটা মনে নেই, সেদিন আমাকে আমার বস বললো কোম্পানির একটা চাকা আটকে গেছে, মানে আমার চাকাটা, বাকি সব চাকা চলছে বুঝলে, শুধু আমারটা আটকে গেছে। ঘষে ঘষে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাকি সব চাকাগুলো। অথচ লাস্ট মান্থ যখন আমি বেস্ট পারফর্ম করলাম, তখন আমাকে কোনও অ্যাপ্রিশিয়েশন দেয়নি…”
– লাস্ট মাসের কথাটা তুমি বললে না কেন?
– বলেছি তো
– কী বলেছে শুনে?

বললো, ভালো পারফর্ম করাটাই তোমার কাজ। সেটা মেনশন করার কিছু নেই। ভাবতো পারো রমেশদা? এরা বিজনেসম্যান? দে আর ফাকিং ট্রেডার্স। হাঃ, চাকা আটকে গেছে?

– এখন কী করবে ভাবছো?
– ভাবছি চাকাটা ফুটো করে দেবো
– মানে?
– মানে ছেড়ে দেবো।

রমেশদার মুখে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। কারণ আমি এবং আমার মতো অনেকেই সপ্তাহে তিনবার করে চাকরি ছাড়বে ভাবে। আবার ভুলেও যায়, যেমন আমার এখনও মনে পড়ছে না গত সোমবারের কথাটা। আমরা এমন অনেকেই রোজ ভিড় জমাই শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রমেশদাদের চায়ের দোকানে। ঘন ঘন টানে সিগারেট শেষ করি। এদের দেখে দেখে আর রমেশদা চিন্তিত হয় না। সে এখন কাস্টমারের জন্য গুছিয়ে পান বানাচ্ছে। আমার দিকে না তাকিয়েই সে আমাকে বললো, “মুখটা কুলের বিচির মতো করে রেখো না। দ্যাখো তোমার বস যাচ্ছে।” আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, গেরুয়া কালারের প্যান্ট এবং কালো জামা পরা একটা কুৎসিত কালো জন্তু ফোর্ড গাড়িতে উঠছে। পাশে একটা মাখন-মেয়ে লেপ্টে আছে। আমি আবার একটা সিগারেট ধরালাম। তফাৎ এটাই, এবার একবারেই আগুন জ্বললো- ফস!

আমার মাথাটা আরও গরম হয়েছে। আমাদের মাথা তৃতীয় বিশ্বের আবহাওয়ার মতো, দিনে দিনে গরম হচ্ছে। আর প্রথম বিশ্ব খালি জমছে। সাদা সাদা বরফ-উদাসীনতায়।

আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হাডকো-মোড়ের দিকে।

উত্তর কলকাতার এই জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকগুলো রাস্তা এদিক সেদিক থেকে এসে পড়েছে এই মোড়ে। বাসগুলোও তাই। এমনকী মানুষগুলোও তাই। এদিক সেদিক থেকে এসে আবার চলে যাচ্ছে এদিক সেদিক। এই জায়গাটা খানিকটা জংশনের মতো। অথবা মাথার মতো। নানা দিকে ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে। একেকটা ডালপালা ধরে নেমে যাচ্ছে সময়। আমি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। একবার কী মনে হতে আকাশের দিকে তাকালাম। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমিও সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। বিদ্যুৎ! এ এক অদ্ভুত জিনিস। যেন মুহূর্তের জন্য আকাশে ফুটে উঠলো সাদা রঙের একটা ন্যাড়া গাছ। শুধু ডালপালা। হঠাৎ একজন লোক পাশ থেকে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠলো- “আয়… আয়…”। বৃষ্টিকে ডাকছে। এই প্রথা কলকাতা শহরের ফুটপাথের সমস্ত হকারদের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি। গরমের দিনে সামান্য মেঘ করলে বা বিদ্যুৎ চমকালেই ফুটপাথের দোকানিরা সমস্বরে বৃষ্টিকে ডাকেন। অথচ বৃষ্টি এলে ক্ষতি তো তাদেরই। কাস্টমার আসবে না। মাল বিক্রি হবে না। তবু এক অনাবিল আনন্দে তারা বৃষ্টিকে ডাকতে থাকেন। সবার গলায় আওয়াজ মিলে সুর তৈরি হয়। হইচই আনন্দের মধ্যেও যেমন হাহাকার মিশে থাকে, এই সুর ঠিক তেমনই। বলতে বলতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। আমি তাড়াতাড়ি একটা শেডের নিচে ঢুকে পড়লাম। শেড বলতে একটা প্লাস্টিকের শেড। ফুটপাথের দুপাশে লাইন দিয়ে যেসব হকারেরা স্টল সাজিয়ে বসেছেন তারা ওই পলিথিনের চাদর টাঙিয়ে মোটামুটি রাস্তার মাথার ওপরে থাকা আকাশকে ঢেকে ফেলেছেন। তেমনই একটা শেড। ওদিকে হুহু করে ঝড় উঠেছে। নতুন নতুন কাদা ঘাটতে শেখা শিশুর মতো মাথা নাড়াচ্ছে পলিথিনের ছাউনি। হাওয়ার সঙ্গে ছুটে আসা বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগলো আমার গায়ে। এই ঠান্ডা হাওয়াটা আমার বেশ প্রিয়। বৃষ্টির দিনে এমন জল মেশানো হাওয়ার জন্য আমি হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি। হাওয়া আর বৃষ্টি দুটোই বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে দোকানিদের বিরক্তিও বাড়ছে। হ্যাঁ, দোকানিদেরই, মানে কিছুক্ষণ আগেই যারা বৃষ্টিকে ভালোবেসে ডাকছিলো। এখন এসে তুমুল ভাবে এসেছে, এবার আর ভালো লাগছে না। বড় অদ্ভুত মন পৃথিবীর এই প্রান্তের। ভালোবাসা চাই, কিন্তু তা সীমার মধ্যে। বেশি বাড়লে তা বাড়ন্ত হয়ে যায় তাদের কাছে। আসলে ডিমান্ড কম তো! তাই দোকানিরা পলিথিন দিয়ে ঢাকছে তাদের মালপত্তর। এবার আমার কানে এলো পাশের মেয়েটির কথা। মেয়েটা তখন চোখের এবং বৃষ্টির জল আড়াল করে ফোনে কথা বলছে। বৃষ্টির আওয়াজের জন্য তাকে একটু জোরে কথা বলতে হচ্ছে, যেসব কথা আস্তে বলাই ভালো। আমরা তো কান পেতেই থাকি। আমাদের যে পরিণতি হয়েছে অন্যেরও যেন সেই পরিণতি হয়, এই আশা আমাদের অবচেতন মনে চলতেই থাকে। আমি কান পাতলাম।

– কিন্তু তুমি বলো আমার দোষটা কোথায়?
– আমি কি তোমাকে কোনও কিছু শেয়ারও করতে পারবো না?
– ও তোমাকে ওরকম করবে কেন? ওকে সেই অধিকার কে দিলো?
– তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে বাবি?

আবার বিদ্যুৎ চমকালো। আমিও চমকালাম। বাবি? আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। কালো রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা। হাতের কাছটা নেটের। বৃষ্টিতে ভিজে ভিতরের ত্বক বোঝা যাচ্ছে। ফরসা। পাশ থেকে দেখছি বলে বুকটাও ভালো নজরে পড়ছে। একটু যেন অবনত। যেন মাথা নিছু করে আছে। ভিজে আছে। কোমরের কাছটাও তাই। অল্প মেদ। চূড়ান্ত শরীরী আকর্ষণ তৈরি করার মতো একটা শরীর। এতটাই তীব্র যে আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই ভুলে গেলাম। এমনকী আমি যে আড়ি পেতে মেয়েটার কথা শুনছিলাম, সেটাও ভুলে গেলাম। শুধু শরীর আমাকে টানছে তখন। আরেকবার ওর বুকের দিকে তাকালাম। আর ঠিক তখনই আমার মনে পড়লো বাবির কথা। একদিন আমাকে বলেছিলো- “তোমরা ছেলেরা মেয়েদের মুখের দিকে না তাকিয়ে প্রথমেই বুকের দিকে তাকাও। এটা বেশ অস্বস্তিকর।”… আমিও বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছিলাম। কারণ বাবি কথাটা বলার জাস্ট আগেই আমি একটা মেয়ের বুকের দিকে তাকিয়েছিলাম। বাবি ছিলো বেশ উদারমনের। আমাকে বলতো- “সুন্দরী মেয়েদের দিকে নিশ্চই তাকাবে। তুমি আমার সাথে রিলেশনে আছো, তার মানে এই নয় যে তুমি অন্য কারোর দিকে তাকাবে না। কিন্তু পুরোটা দেখো। কথা বলা তো সম্ভব নয়, শুধু দেখা যখন সবটা মিলিয়ে দেখো। চোখ কান নাক বুক পেট পা সবটা মিলিয়েই তো একজন মানুষ। তাই না?” দ্বিমত হওয়ার উপায় নেই। সমস্যাটা হলো, বাবির সঙ্গে বেশিরভাগ বিষয়েই আমি একমত না হয়ে পারতাম না, কারণ ওর যুক্তি ছিলো অকাট্য। তাই ও যখন বলেছিলো, “তোমাকে আর ভালো লাগছে না আমার। বলতে পারো, পোষাচ্ছে না। তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। আমি এখানেই এটা শেষ করতে চাই। তোমার আর আমার ভিউপয়েন্ট একদম আলাদা। তাছাড়া আমি চলে যাচ্ছি আবার। খুব ভালো হয়, তুমি যদি আর যোগাযোগ না রাখো… ওয়েল, এই কথাগুলো আমি আরও একটুই পোলাইটলি বলতে পারতাম। বাট ট্রাস্ট মি, এটা পোলাইটলি এলো না। আমাকে এডুকেশন আমাকে পোলাইট নয়, অনেস্ট থাকতে শিখিয়েছে।” বাবি বিদেশে পড়াশোনা শিখেছে। ক্যালিফোর্নিয়া। আমিও কম যাই না, ২০০৩ প্রেসিডেন্সি ব্যাচ। তবে এটাও ঠিক, আমাদের শিক্ষা আমাদের সত্যি কথা বলার চেয়েও বেশি শেখায় সহনশীল হতে।

তবে সেই মুহূর্তে এসব কিছুই বলতে পারিনি। শুধু আলতো ভাবে বলেছিলাম- “তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে বাবি?”

বাবির সাথে আমার ফাইন্যালি ব্রেক-আপ যেন কবে হলো? লাস্ট সোমবার? তাই কী? সিরিয়াসলি মনে পড়ছে না।

আমি আবার সিগারেট ধরালাম। ভিজে ছিলো বলে ধরতে টাইম নিলো। ইতিমধ্যে আমার পাশে আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। ওই মেয়েটি এখনও কথা বলছে। মুখটা অন্যদিকে ফেরানো বলে মুখ দেখা গেলো না। বৃষ্টির তেজ আরও বেড়েছে। পায়ের তলায় জল উঠে এসেছে। এবার আমারও বিরক্ত লাগছে। ওদিকে এখন আবার স্টলে স্টলে দোকানিরা পা গুটিয়ে বসে হাসিমুখে গুলতানি মারছে। কী অদ্ভুত পাবলিক সব! এই হাসছে তো এই রাগছে। এক্সপ্রেশনের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। আমারও এবার হাসি পেলো। টুক করে দৌড়ে গলির মধ্যে গেলাম। পাশেই একটি বার, সেখানে ঢুকে পড়লাম।

নীচের সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে এসে তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে এই বার। ভিতরে প্রচন্ড ভলিউমে মিউজিক। একটা পাশে অনেকগুলো টেবিল আর চেয়ারে মদ খাওয়ার আয়োজন। অন্য পাশে একটা স্টেজে সাদা এবং লাল সিফন শাড়ি পরা দুটো মেয়ে কোমর দুলিয়ে নাচছে। বুক অস্বাভাবিক রকমের উঁচু। কোমরের কাছে শাড়িটা অনেকটা নামানো। ফলত সামনের দিকে নাভি এবং পিছন দিকে নিতম্বের ঢেউটা দেখা যাচ্ছে। আমি দু’বোতল বিয়ার নামিয়ে দিয়েছি অলরেডি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমার টেবিলে আমার সামনের চেয়ারে যে মানুষটি বসে আছে, সেই মানুষটি এখন গড়াগড়ি খাওয়ার আগের পর্যায়ে আছে। আমার দিকে লোকটি ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো। লোকটার দু’চোখের দুপাশ থেকে দুটো রেখা মুখের দিকে নেমে এসেছে। চোখ আর মুখের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে যেন সেই জ্যামিতি। এই অঙ্কটা না কষলে যেন চোখ আর মুখ দুটোই ঝুলে পড়তো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে, এতটাই নেশা করেছে লোকটা। কিছু বলতে চায় নাকি? বললো, “মদেও আজকাল জল মেশায়, কী বুঝলেন? মদ গ্লাসে ঢালার আগেইও তাতে জল ছিলো, গ্লাসে পড়ার পরেও জল। তাই নেশাতেও জল! জল মেশানো নেশা। খানিক পরেও নেশা ভেঙে যাবে বমি হয়ে। কী বুঝলেন? হাঃহাঃহাঃ…” আমার হাসি বা রাগ কোনওটাই পেলো না। একটা আশ্চর্য অনুভূতি হলো। ঠিক এই কথাটা, ঠিক এই টেবিলে বসে, ঠিক এইরকম পরিবেশে, ঠিক এই লোকটার মুখে আমি আগেও শুনেছি। হ্যাঁ, এখন বেশ মনে করতে পারছি। লাস্ট সোমবার, আমি এই সময়ে ঠিক এখানেই তো এসেছিলাম। আরে না না, বাবির সাথে ব্রেক-আপের দুঃখে নয়, আমি মাঝেমাঝে টাইম পেলে এখানে চলে আসি, বাড়ি ফেরার পথে। অফিস থেকে কাছে হয় বলে। সে যাই হোক, এটা কী করে মিলে গেলো? আবার ভাবলাম। এবার স্পষ্ট মনে পড়ছে, হুম, এই এক ড্রেস পরে আমিও এসেছিলাম। এই ভাবেই আমার সামনে একটা খালি আর একটা অর্ধেক ভর্তি বিয়ার বোতল রাখা ছিলো। মাথাটা ঘুরে গেলো। ঝিমঝিম করতে লাগলো বারের সব দৃশ্যগুলো। বাবি, রমেশদা, বস, ওই মেয়েটা সব কি একইরকম ছিলো? সেদিনও কি বৃষ্টি হয়েছিলো? একবার মনে হচ্ছে ছিলো, একবার মনে হচ্ছে ছিলো না। বাবি ঠিকই বলেছিলো। ঠিকই করেছিলো। আসলে আমারও ওকে আর পোষাচ্ছিলো না। খালি কথায় কথায় ইউএসএ-র তুলনা দেওয়া আমি আর জাস্ট নিতে পারছিলাম না। কেন বাওয়া? আমরা কি বানের জলে ভেসে আসা মানুষ? হুম? আমাদের নেশা ধরাবে তোমরা? জল মেশানো নেশা? হুম? হাঃহাঃহাঃ, মালটা গেছে বাঁচা গেছে। কিন্তু… আই মিন… কিন্তু এসব মিলে যাচ্ছে কী করে বস? কী যেন বলে একে? কোথায় একটা পড়েছিলাম, ও ইয়েস, দে-জা ভ্যু… এটা হলো, কোনও দৃশ্য দেখে বা কোনও কথা শুনে মনে হওয়া যে এমনটা, ঠিক এমনটাই আগেও দেখেছি বা শুনেছি। একদল মানুষ বলেন, আমাদের জীবনের সমস্ত ঘটনাই আগে হয়ে গেছে অন্য কোথাও। এখন যেটা হচ্ছে সেটা হলো ওই আগের ঘটনার প্রতিফলন। প্রতিফলনে বাস করতে করতে সেই সত্যি ঘটনা মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়, আর তখন সবটাই চেনা চেনা লাগে। এটা মূলত পশ্চিমী দুনিয়ার কনসেপ্ট। আর আমাদের দেশের দর্শন বলে, সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। দুটোই তো এক, তাই না? আমাদের নিজেদের কথাগুলো যখন পশ্চিম দিক থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে তখন আমরা তার মর্ম বুঝতে পারি। তখনও আমাদের দে-জা ভ্যু হয়। চেনা চেনা লাগে। এটার কথাই কি লোকটা বললেন- ‘জল মেশানো নেশা’? আর এই নেশা আমাদের আছে বলেই না আজ ২৮ তারিখ, মাসের শেষ, আমি বসের থ্রেট ভুলে, প্রেমের দুঃখ ভুলে, ক্রমশ ছোট হয়ে আসা মানি ব্যাগ ভুলে এসব কনসেপ্ট মারাচ্ছি, বাবি, ও আমার বাবি, মনে পড়ছে তোমাকে, লাস্ট সোমবারের পরে তোমাকে আর দেখিনি, ২১শে মার্চ তারিখটা দাগ দিয়ে রেখেছি মনে, আমার ডেস্ক ক্যালেন্ডারে। দাগ, তোমার দাগ। প্রেম নেই বাবি, হেরে যাওয়ারও একটা নেশা আছে, সেই নেশাটাই তুমি। ২১শে মার্চ, বাবি, ২১শে মার্চ… জানো বাবি, তোমার ছবি আমার ফোনে এখনও রাখা, এই দ্যাখো… বলে আমি ফোনটা অন করলাম। আজ অন করতেই চমকে গেলাম? কী হলো কেসটা? আজকেই তো ২১ তারিখ। আজকে, হ্যাঁ, আজকেই তো ২১ তারিখ, আমার মাথাটা টাল খেয়ে গেলো আবার। লাস্ট সোমবার কী হয়েছিলো? ভাবতেই মনে পড়লো, রমেশদার দোকান, বৃষ্টির ছাউনি, ফোন হাতে মেয়েটি, বার, বারের অদ্ভুত লোকটি। হ্যাঁ, এগুলোই মনে পড়লো, এমন ভাবে মনে পড়লো যেন আজকেই ঘটেছে সব। তবে এটাও তো ঠিক, আজকে তবে কী ঘটলো? প্রতিফলন? কার? আমার? আমাদের? নাকি সময়ের? নাকি সময়টা একইরকম, তৃতীয় বিশ্বের অবস্থার মতো, নড়েও না, চড়েও না, স্থবির। তাই যদি হবে তাহলে ঘটনা অতীত হবে কী করে?

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment