ভোররাত। নীলার খুব শীত করছিল। সূর্যের আলো চোখে পড়তে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় পরীটার মধ্যে নিজেকে দেখতে পেল। পিঠের ডানা হাতের বাজনা সমেত পাথরের শরীর। শীতল। আশ্চর্যের বিষয় হল যে গোটা ব্যাপারটা তে তার যতটা চমকে যাওয়ার কথা ছিল তার ভগ্নাংশ ও সে চমকাল না। যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। এমন কিছুর স্বপ্নই সে দেখেছিল নীলাঞ্জনের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া চত্বরে প্রেম করে বেড়ানোর দিনগুলোয়। তফাৎ শুধু নীলাঞ্জনকে আর সে আশপাশে দেখতে পেল না। একটা চিল কোথাথেকে এসে তার হাতে ধরা বাজনাটার ওপর বসলো। চিলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নীলার চোখে স্যাটেলাইট ভিশন খুলে গেল।“নীলাঞ্জন” – বলে ডাকতেই জুম করতে করতে তার দৃষ্টি চলে গেল নীলাঞ্জনের কিউবিকলে। নাইট শিফট শেষ করে টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছে। এভাবেই ও ঘুমায় যতক্ষণ না পরের শিফটের কর্মী ও কে ঠেলে তোলে।
স্ট্যাচু হয়ে থাকাটা খুব বোরিং। তা সে পরী হোক বা স্বাধীনতা। প্রত্যেকটা স্ট্যাচুরই তাই ফার্স্ট ফরোয়ার্ড ভিশন থাকে। ট্রাফিক, ভিড়, সিগন্যাল। নীলা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে। মিছিল। পজ বাটন টেপে। শোনে। ব্রিগেডে মিটিং। থামে। তারপর রিওয়াইন্ড করে ফিরে যায় ছোটবেলায়। শীতকাল। সিঁথির মোড়ে সার্কাস এসেছে। পশু পাখির সার্কাস তো এখন বন্ধ। শুধু জোকারের মুখটা একই থেকে গেছে। মুখ না কি মুখোশ? মুখ বদল করে একবার ভাষণরত নেতার মুখে বসে পরক্ষণেই নিউজ চ্যানেলে বুদ্ধিজীবীদের মুখে উড়ে এসে জুড়ে বসে। গদি মুছতে মুছতে বলে “প্রভু, বিক্রি হয়ে যাই”।
মুখোশ বলতেই নীলা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে। মিছিল পাতলা হয়ে আসে। রাস্তার ভিড়ে মুখোশ আঁটা মানুষের সংখ্যা বাড়ে। বাড়তেই থাকে। হঠাৎ ট্রাফিক কমে। নিত্যযাত্রী। রোজগারপাতি। সবই। ট্রেন বাস সব বন্ধ হয়ে যায়। কাকগুলোও চেঁচামেচি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। হোটেল– রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। এঁটো কাঁটাও নেই। ক্রমশ অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াত বাড়ে শহরের হাসপাতালগুলোয়। মর্গের উপর চক্কর দেওয়ার সময় কয়েকটা শকুনের উপর চড়াও হয়ে তাদের ভাগাড়ে ফেরত পাঠায় চিলেরা। যেতে যেতে শকুন গুলো হেঁকে যায় – “আমাদেরও ভালো দিন আসছে।“
কাকেদের মিটিং বসে। চেঁচামেচি। বাক বিতণ্ডা। শকুনরা তাদের ইউনিভার্সিটিতে মৃতজীবীর আত্মকথা পড়িয়েছে। গোপনীয় গল্পে বলে গেছে – মন্দিরে গরু আর মসজিদে শুয়োর মেরে ফেলে দিলে মৃতজীবীদের আর খাবার অভাব থাকবে না। রাস্তায় রাস্তায় মহল্লায় মহল্লায় শুধু মানুষের লাশ পড়ে থাকবে। সুদিন আসছে। মৃতজীবীদের সুদিন। কতগুলো পাতিকাক ফেক নিউজ আর ভোজপুরী সিনেমার মারদাঙ্গার ভিডিও ফরোয়ার্ড করছিল। কোথা থেকে একটা দাঁড় কাক এসে গম্ভীর গলায় তাদের জ্ঞান দিয়ে গেল– “ কাকেরা ঘেরা করে না। পরিস্কার করে। যা যা কিছু ঘেন্না করে ভদ্রলোকেরা –সব”। পাতিকাকেদের ঝাঁক তাকে এলাকা ছাড়া করে ছাড়লো।
হাসপাতালের সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। একটা আস্ত মৃতপ্রায় শহর রাস্তায় বসে আছে অ্যাম্বুলেন্সে ঠেস দিয়ে। চালক নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আবেদনে কেউ কান দিচ্ছে না। নীলা ছুটে যেতে চায় কিন্তু নড়তে পারেনা। উড়তে চায় কিন্তু তার ডানা দুটো পাথরের। নীলার মনে হয় ও নীলাঞ্জন কে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। একটু গেলেই ওষুধ আছে। জীবন আছে। কিন্তু সব পথচারীরাই পাথর হয়ে গেছে। হসপিটালের কয়েক পা দুরে অ্যাম্বুলেন্সে ঠেস দিয়ে মরে যায় একটা আস্ত শহর।
“ মূর্তিরা কাঁদে না এই প্রচণ্ড বৈশাখে। শ্রাবণ পর্যন্ত অপেক্ষা করূন।“ নীলা ঘাড় ঘোরাতে পারে না। বুঝতে পারে আকাশে যে প্রকান্ড শকুনটা দেখেছিল– সেটাই বসেছে তার মাথায়।
“ মৃত্যু দেখেছিলাম কোম্পানির আমলে – 1176 বঙ্গাব্দে। রাস্তায় রাস্তায় লাশ। গোটা দেশটাই ভাগাড়। পূর্ব পুরুষদের এত গর্বের ইতিহাস না থাকলে কি এমন মেমোরিয়াল হয়!”।
-“ কি করেছিলেন তাঁরা?”
-“ তারা ছিল আমাদের মতোই চালাক শকুন, শাসকের অক্ষমতার সুযোগ নিত। শাসক শিকার করে মাংসের নয় ক্ষমতার লোভে। পায়ের নীচে শিকারের ছবি তোলাই আসল নেশা। লাভের গুড় খেত কোম্পানি। প্রথমে নবাবদের হাতের পুতুল করে রেখে শাসন চালানো – নবাবী রুপোর টাকা বাতিল করে কোম্পানির সিক্কা চালানো। নতুন নতুন কর বসানো। মসলিন তাঁতিদের বুড়ো আঙুল কাটা হল। চাষীদের পেষাই করতে লাগানো হল ইজারাদারদের। আরও অনেক পরে এলো নীলকর রা। খাজনার চাপে সর্বস্ব হারানো চাষীদের তারা বোঝালো ধানের বদলে নীল চাষ করলে অনেক লাভ। দাদন ধরালো। জমিদার নীলকর সাঁড়াশী চাপে গাছে গাছে ঝুলতে থাকলো চাষীদের শরীর। আহা সেকি স্বাদ মানুষের মাংসের। এই শহরে আর দুটো সালে পেয়েছিলাম তেমনটা – 1943 আর 1946 খ্রিষ্টাব্দে। “
-“ 1943 র দুর্ভিক্ষ আর 1946 এর দাঙ্গা?”
-“ তুমি যে সৌধের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের সেনাবাহিনী কে খাওয়াতে আর ভারতছাড়ো আন্দোলন কে থামাতে খাবার মজুত করে দুর্ভিক্ষ তৈরী করা হয়। ফ্যানটুকুও পায়নি মানুষ। “
– “ আর 1946 এ?°
– “ চতুর্দিকে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, আমাদের এলাকার লোকেদেরই সাহস হচ্ছিলো না। বাচ্চাগুলো খালি মানুষের মাংস খাবার বায়না করছে –”
– “ সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া গল্পটা বলবেন তো? মসজিদে শুয়োর আর মন্দিরে গরুর মড়া ফেলে দাঙ্গা বাধিয়েছিলেন ——-”
-“ বাজে কথা—ওটা বানানো গল্প – আমরা মানুষ নাকি যে ধর্মের নামে মানুষ মারবো।“
মাথার উপর থেকে শকুনটা উড়ে গেল।
ফিফটি পার্সেন্ট স্যালারি কমেছে। তবু চাকরিটা যায়নি। যাদের সেটাও গেছে তাদের কাজটাও করতে হচ্ছে নীলাঞ্জনকে। 24 ঘন্টা সময়টা বড্ড কম। তার মধ্যে হাগা মোতা খাওয়া – ঘড়িটা টিকটিক করে চলে – সময় নষ্ট – সময় নষ্ট। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়িটাই অফিস হয়ে গেছে। চোখ মনিটরে, হাত মাউসে, কান হেডফোনে। নীলা বাড়িতে আছে বোঝা যায় খাবারের প্লেটগুলো আসতে দেখে। সেগুলোর গরম ভাপ খিদেতে চাগাড় দেয়। কিন্তু ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না।
নীলা তার দৃষ্টি জুম করেহ তার শেষ দিয়ে যাওয়া খাবারের প্লেট জুড়ে কালো ফাঙ্গাস মাথা তুলেছে। ঘরের মধ্যে সে নীলাঞ্জন কে খোঁজে। একটা মনিটরে তার চোখ জোড়া, মাউস আর কি বোর্ডে কর্মব্যস্ত আঙুল গুলো আর হেড ফোনে কানজোড়া দেখতে পায়। কি আশ্চর্য নীলাঞ্জনের পেটটা পুরো ভ্যানিস। বাঁচা গেছে। পেট থাকার বড় জ্বালা। খিদে পাবে, না খেলে যণ্ত্রনা হবে। তারপর গ্যাস অম্বল, গা বমি। খেলে হাগা মোতার ঝামেলা। এমন বিচ্ছিরি অঙ্গের দায় কোম্পানি থেকে সরকার কেউ নিতে চায় না। তাপর ও যদি কারুর পেট, মেরুদণ্ড ইত্যাদি আপত্তি ও বিপত্তি জনক অঙ্গ থাকে—তবে দ্বায়িত্ব তার নিজের। মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন।
অরুণ বরুণ কিরণমালা নয়– পাথরের মূর্তি হয়ে যাওয়া সেই দেশের যানবাহন শূণ্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে অসংখ্য মানুষ। তাদের খাবার ফুরিয়েছে– গাছের পাতা খেয়েছে। জল ফুরিয়েছে– জল খুঁজে নিয়েছে। তারা এক ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছে। সে ঘোরে চোখের সামনে ভাসছে স্ত্রী – সন্তানের মুখ। খাবারের থালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকা মা। ক্লান্ত শরীরে বিছানা করেছে রেল লাইন কে। তারপর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। ট্রেনে কাটা শরীরগুলো থেকে রক্ত ছিটকে পড়ে নীলার মুখে। মূর্তি মুখ ঘোরাতে পারে না। মুখ মুছে ফেলতেও পারেনা। জামিলো বলে মেয়েটাকে দূর থেকে দেখে নীলা। জলশূণ্য শরীরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। নীলা চেঁচিয়ে বলে উঠেছে–
“ ওঠ। আর তো মাত্র তিন কিলো মিটার।“ মেয়েটা ওঠেনি। নীলা তাকে ঠেলা দিতে চেয়েছে মুজফ্ফরপুর জংশনের সেই বাচ্চাটার মতো। যে তার মৃত মায়ের আঁচল ধরে টানছিলো। কিন্তু কিছু করেই সে লেগে থাকা রক্তের দাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। জলের শব্দ পেয়ে সে বহু দূরে তাকিয়ে দেখে– হোস পাইপ করে ব্লিচিং গোলা জল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মণ্ত্রী হওয়ার আগে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দুষ্টু জাদুকর ফিরিওয়ালা ছিল। রাস্তায় হাঁক দিয়ে দিয়ে যেত “ পুরোনো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ।“ তার চটকদার অফারে ভুলে পুরোনো প্রদীপের সঙ্গে জিনির ও যে হাত বদল হয়ে গেছিলো সে গল্প আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই বোকা বনে গিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছি অব্যবহৃত ল্যান্ডলাইন ফোন, খেলনা রেল আর এরোপ্লেন। পুরোনো হয়ে আসা এই খেলনাগুলোতে ম্যাজিক ছিল। আমাদের বাপ দাদাদের ঘামের – রক্তের ম্যাজিক।
নীলা প্রায়ই এক ফিরিওয়ালাকে হেঁকে হেঁকে যেতে শোনে “ পুরোনো ল্যাপটপ বিক্রি আছে, কম্পিউটার বিক্রি আছে।“ শুনে ভয় পেয়েছে। মনিটরে সেঁটে থাকা নীলাঞ্জনের চোখ জোড়ার জ্যোতি কমেছে। চশমার পাওয়ার বেড়েছে। হাতের যে আঙুলগুলো কি বোর্ড হয়ে গেছিলো সেগুলো আর আগের মত দ্রুত চলতে চলতে পারে না। মাউসের নড়া চড়াও কমে গেছে। নীলাঞ্জনকেও যে কোনদিন ফিরিওয়ালাটা বস্তায় পুরে নিয়ে যাবে।
ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলোই। সঙ্গে বৃষ্টিও এলো অনেকদিনের জমানো ক্ষোভের মত দমকা বেহিসেবী হাওয়ার সাথে। ঝড়ে শিকড় শুদ্ধু উপড়ে যাওয়া গাছেরা রাস্তা অবরোধে। হঠাৎ সেই ঝড়ের ধাক্কায় নীলা বেরিয়ে পড়লো পরীটার থেকে। কোলকাতার বুকে তখন ঝড় বৃষ্টি আর অন্ধকার। নীলা নিজেকে দেখতে পায় না। বুঝতে পারে – রক্ত মাংস বা পাথর কোনো শরীরেই সীমাবদ্ধ ছিলো না ও। ঝড়ে উজাড় হওয়া ঝুপড়িগুলোর পাশ দিয়ে, জলে ভেসে যাওয়া ক্ষেতগুলোর পাশ দিয়ে একদঙ্গল মানুষের ভিড়্ মিশে যায় ও। যারা সব হারিয়ে ভেঙে যাওয়া বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে।