কৃষ্ণেন্দু তালুকদার

স্ট্যাচু

ভোররাত নীলার খুব শীত করছিল সূর্যের আলো চোখে পড়তে ঘুম ভাঙল চোখ খুলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় পরীটার মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলপিঠের ডানা হাতের বাজনা সমেত পাথরের শরীরশীতলআশ্চর্যের বিষয় হল যে গোটা ব্যাপারটা তে তার যতটা  চমকে যাওয়ার কথা ছিল তার ভগ্নাংশ সে চমকাল নাযেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিলএমন কিছুর স্বপ্নই সে দেখেছিল  নীলাঞ্জনের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া চত্বরে প্রেম করে বেড়ানোর দিনগুলোয়তফাৎ শুধু নীলাঞ্জনকে আর সে আশপাশে দেখতে পেল না একটা চিল কোথাথেকে এসে তার হাতে ধরা বাজনাটার ওপর বসলোচিলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নীলার চোখে স্যাটেলাইট ভিশন খুলে গেল।“নীলাঞ্জন” – বলে ডাকতেই জুম করতে করতে তার দৃষ্টি চলে গেল নীলাঞ্জনের কিউবিকলেনাইট শিফট শেষ করে টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছেএভাবেই ও ঘুমায় যতক্ষণ না পরের শিফটের কর্মী কে ঠেলে তোলে

     স্ট‍্যাচু হয়ে থাকাটা খুব বোরিংতা সে পরী হোক বা স্বাধীনতাপ্রত‍্যেকটা স্ট‍্যাচুরই তাই ফার্স্ট ফরোয়ার্ড ভিশন থাকে ট্রাফিক, ভিড়, সিগন্যাল নীলা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করেমিছিলপজ বাটন টেপেশোনেব্রিগেডে মিটিংথামে তারপর রিওয়াইন্ড করে ফিরে যায় ছোটবেলায়শীতকালসিঁথির মোড়ে সার্কাস এসেছেপশু পাখির সার্কাস তো এখন বন্ধশুধু জোকারের মুখটা একই থেকে গেছে মুখ  না কি মুখোশ? মুখ বদল করে একবার ভাষণরত নেতার মুখে বসে পরক্ষণেই নিউজ চ‍্যানেলে বুদ্ধিজীবীদের মুখে উড়ে এসে জুড়ে বসেগদি মুছতে মুছতে বলেপ্রভু, বিক্রি হয়ে যাই”। 

    মুখোশ বলতেই নীলা ফার্স্ট  ফরোয়ার্ড করে মিছিল পাতলা হয়ে আসে রাস্তার ভিড়ে মুখোশ আঁটা মানুষের সংখ্যা বাড়ে বাড়তেই থাকে হঠাৎ ট্রাফিক কমে নিত‍্যযাত্রী রোজগারপাতি সবই ট্রেন বাস সব বন্ধ হয়ে যায়কাকগুলোও চেঁচামেচি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেহোটেলরেস্টুরেন্ট সব বন্ধ এঁটো কাঁটাও নেইক্রমশ অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াত বাড়ে শহরের হাসপাতালগুলোয় মর্গের উপর চক্কর দেওয়ার সময় কয়েকটা শকুনের উপর চড়াও হয়ে তাদের ভাগাড়ে ফেরত পাঠায় চিলেরাযেতে যেতে শকুন গুলো হেঁকে যায় – “আমাদেরও ভালো দিন আসছে।“ 

       কাকেদের মিটিং বসেচেঁচামেচিবাক বিতণ্ডাশকুনরা তাদের ইউনিভার্সিটিতে মৃতজীবীর আত্মকথা পড়িয়েছেগোপনীয় গল্পে বলে গেছেমন্দিরে গরু আর মসজিদে শুয়োর মেরে ফেলে দিলে মৃতজীবীদের আর খাবার অভাব থাকবে নারাস্তায় রাস্তায় মহল্লায় মহল্লায় শুধু মানুষের লাশ পড়ে থাকবেসুদিন আসছেমৃতজীবীদের সুদিনকতগুলো পাতিকাক ফেক নিউজ আর ভোজপুরী সিনেমার মারদাঙ্গার ভিডিও ফরোয়ার্ড করছিলকোথা থেকে একটা দাঁড় কাক এসে গম্ভীর গলায় তাদের জ্ঞান দিয়ে গেল– “ কাকেরা ঘেরা করে নাপরিস্কার করেযা যা কিছু ঘেন্না করে ভদ্রলোকেরাসব”।  পাতিকাকেদের ঝাঁক তাকে এলাকা ছাড়া করে ছাড়লো।  

     হাসপাতালের সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়েএকটা আস্ত মৃতপ্রায় শহর রাস্তায় বসে আছে অ্যাম্বুলেন্সে ঠেস দিয়েচালক নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেতুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আবেদনে  কেউ কান দিচ্ছে নানীলা ছুটে যেতে চায় কিন্তু নড়তে পারেনাউড়তে চায় কিন্তু তার ডানা দুটো পাথরেরনীলার মনে হয় নীলাঞ্জন কে টেনে তোলার চেষ্টা করছেএকটু গেলেই ওষুধ আছেজীবন আছেকিন্তু সব পথচারীরাই পাথর হয়ে গেছেহসপিটালের কয়েক পা দুরে অ্যাম্বুলেন্সে ঠেস দিয়ে মরে যায় একটা আস্ত শহর      

       “ মূর্তিরা কাঁদে না এই প্রচণ্ড বৈশাখেশ্রাবণ পর্যন্ত অপেক্ষা করূন।“ নীলা ঘাড় ঘোরাতে পারে নাবুঝতে পারে আকাশে যে প্রকান্ড শকুনটা দেখেছিলসেটাই বসেছে তার মাথায়। 

     “ মৃত্যু দেখেছিলাম  কোম্পানির আমলে – 1176 বঙ্গাব্দেরাস্তায় রাস্তায়  লাশগোটা দেশটাই ভাগাড়।  পূর্ব পুরুষদের এত গর্বের ইতিহাস না থাকলে কি এমন মেমোরিয়াল হয়!”। 

 -“ কি করেছিলেন তাঁরা?” 

-“ তারা ছিল আমাদের মতোই চালাক শকুন, শাসকের অক্ষমতার সুযোগ নিতশাসক শিকার করে মাংসের নয় ক্ষমতার লোভেপায়ের নীচে শিকারের ছবি তোলাই আসল নেশা লাভের গুড় খেত কোম্পানি প্রথমে নবাবদের হাতের পুতুল করে রেখে শাসন চালানোনবাবী রুপোর টাকা  বাতিল করে কোম্পানির সিক্কা চালানোনতুন নতুন কর বসানোমসলিন তাঁতিদের বুড়ো আঙুল কাটা হলচাষীদের পেষাই করতে লাগানো হল ইজারাদারদেরআরও অনেক পরে এলো নীলকর রাখাজনার চাপে সর্বস্ব হারানো চাষীদের তারা বোঝালো ধানের বদলে নীল চাষ করলে অনেক লাভদাদন ধরালোজমিদার নীলকর সাঁড়াশী চাপে গাছে গাছে ঝুলতে থাকলো চাষীদের শরীর আহা সেকি স্বাদ মানুষের মাংসেরএই শহরে আর দুটো সালে পেয়েছিলাম তেমনটা – 1943 আর 1946 খ্রিষ্টাব্দে। “ 

 -“ 1943 দুর্ভিক্ষ আর 1946 এর দাঙ্গা?”  

 -“ তুমি যে সৌধের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের সেনাবাহিনী কে খাওয়াতে আর ভারতছাড়ো আন্দোলন কে থামাতে খাবার মজুত করে দুর্ভিক্ষ তৈরী করা হয়ফ্যানটুকুও পায়নি মানুষ। “ 

– “ আর 1946 ?° 

– “ চতুর্দিকে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, আমাদের এলাকার লোকেদেরই সাহস হচ্ছিলো নাবাচ্চাগুলো খালি মানুষের মাংস খাবার বায়না করছে –” 

– “ সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া গল্পটা বলবেন তো? মসজিদে শুয়োর আর মন্দিরে গরুর মড়া ফেলে দাঙ্গা  বাধিয়েছিলেন ——-” 

 -“ বাজে কথাওটা বানানো গল্পআমরা মানুষ নাকি যে ধর্মের নামে মানুষ মারবো।“  

  মাথার উপর থেকে শকুনটা উড়ে গেল।  

        ফিফটি পার্সেন্ট স্যালারি কমেছেতবু চাকরিটা যায়নিযাদের সেটাও গেছে তাদের কাজটাও করতে হচ্ছে নীলাঞ্জনকে। 24 ঘন্টা সময়টা বড্ড কমতার মধ্যে হাগা মোতা খাওয়াঘড়িটা টিকটিক করে চলেসময় নষ্ট সময় নষ্টওয়ার্ক ফ্রম হোমবাড়িটাই অফিস হয়ে গেছেচোখ মনিটরে, হাত মাউসে, কান হেডফোনেনীলা বাড়িতে আছে বোঝা যায় খাবারের প্লেটগুলো আসতে দেখেসেগুলোর গরম ভাপ খিদেতে চাগাড় দেয়কিন্তু ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না। 

 নীলা তার দৃষ্টি জুম করেহ তার শেষ দিয়ে যাওয়া খাবারের প্লেট জুড়ে কালো ফাঙ্গাস মাথা তুলেছেঘরের মধ্যে সে নীলাঞ্জন কে খোঁজেএকটা মনিটরে তার চোখ জোড়া, মাউস আর কি বোর্ডে কর্মব্যস্ত আঙুল গুলো আর হেড ফোনে কানজোড়া দেখতে পায়কি আশ্চর্য নীলাঞ্জনের পেটটা পুরো ভ‍্যানিসবাঁচা গেছেপেট থাকার বড় জ্বালাখিদে পাবে, না খেলে যণ্ত্রনা হবেতারপর গ্যাস অম্বল, গা বমিখেলে হাগা মোতার ঝামেলাএমন বিচ্ছিরি অঙ্গের দায় কোম্পানি থেকে সরকার কেউ নিতে চায় নাতাপর যদি কারুর পেট, মেরুদণ্ড ইত্যাদি আপত্তি ও বিপত্তি জনক অঙ্গ থাকেতবে দ্বায়িত্ব তার নিজেরমাল নিজ দায়িত্বে রাখুন  

  অরুণ বরুণ কিরণমালা নয়পাথরের মূর্তি হয়ে যাওয়া সেই দেশের যানবাহন শূণ্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে অসংখ্য মানুষ তাদের খাবার ফুরিয়েছেগাছের পাতা খেয়েছেজল ফুরিয়েছেজল খুঁজে নিয়েছে তারা এক ঘোরের মধ‍্যে হেঁটে চলেছেসে ঘোরে চোখের সামনে ভাসছে স্ত্রী সন্তানের মুখখাবারের থালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকা মাক্লান্ত শরীরে বিছানা করেছে রেল লাইন কেতারপর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছেট্রেনে কাটা শরীরগুলো থেকে রক্ত ছিটকে পড়ে নীলার মুখেমূর্তি মুখ ঘোরাতে পারে নামুখ মুছে ফেলতেও পারেনাজামিলো বলে মেয়েটাকে দূর থেকে দেখে নীলাজলশূণ‍্য শরীরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছেনীলা চেঁচিয়ে বলে উঠেছে– 

  “ ওঠআর তো মাত্র তিন কিলো মিটার।“ মেয়েটা ওঠেনিনীলা তাকে ঠেলা দিতে  চেয়েছে মুজফ্ফরপুর জংশনের সেই বাচ্চাটার মতোযে তার মৃত মায়ের আঁচল ধরে টানছিলোকিন্তু কিছু করেই সে লেগে থাকা রক্তের দাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নাজলের শব্দ পেয়ে সে বহু দূরে তাকিয়ে  দেখেহোস পাইপ করে ব্লিচিং গোলা জল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে

     মণ্ত্রী হওয়ার আগে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দুষ্টু জাদুকর ফিরিওয়ালা ছিলরাস্তায় হাঁক দিয়ে  দিয়ে যেতপুরোনো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ।“  তার চটকদার অফারে ভুলে পুরোনো প্রদীপের সঙ্গে জিনির যে হাত বদল হয়ে গেছিলো সে গল্প আমরা সবাই জানিআমরা সবাই বোকা বনে গিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছি অব‍্যবহৃত ল‍্যান্ডলাইন ফোন, খেলনা রেল আর এরোপ্লেনপুরোনো হয়ে আসা  এই খেলনাগুলোতে ম‍্যাজিক ছিলআমাদের বাপ দাদাদের ঘামেররক্তের ম‍্যাজিক।      

    নীলা প্রায়ই এক ফিরিওয়ালাকে হেঁকে হেঁকে যেতে শোনেপুরোনো ল‍্যাপটপ বিক্রি আছে, কম্পিউটার বিক্রি আছে।“ শুনে ভয় পেয়েছেমনিটরে সেঁটে থাকা নীলাঞ্জনের চোখ জোড়ার জ্যোতি কমেছেচশমার পাওয়ার বেড়েছে হাতের যে আঙুলগুলো কি বোর্ড হয়ে গেছিলো সেগুলো আর আগের মত দ্রুত চলতে চলতে পারে নামাউসের নড়া চড়াও কমে গেছেনীলাঞ্জনকেও যে কোনদিন ফিরিওয়ালাটা বস্তায় পুরে নিয়ে যাবে।  

  ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলোইসঙ্গে বৃষ্টিও এলো অনেকদিনের জমানো ক্ষোভের মত দমকা বেহিসেবী হাওয়ার সাথেঝড়ে শিকড় শুদ্ধু উপড়ে যাওয়া গাছেরা রাস্তা অবরোধেহঠাৎ সেই ঝড়ের ধাক্কায় নীলা বেরিয়ে পড়লো পরীটার থেকেকোলকাতার বুকে তখন ঝড় বৃষ্টি আর অন্ধকারনীলা  নিজেকে দেখতে পায় নাবুঝতে পারেরক্ত মাংস বা পাথর কোনো শরীরেই সীমাবদ্ধ ছিলো না ঝড়ে উজাড় হওয়া ঝুপড়িগুলোর পাশ দিয়ে, জলে ভেসে যাওয়া ক্ষেতগুলোর পাশ দিয়ে একদঙ্গল মানুষের ভিড়্ মিশে যায় যারা সব হারিয়ে ভেঙে যাওয়া বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে।   

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment