সৌমাভ

সৌমাভ’র কবিতাগুচ্ছ

আত্মহত্যা

আত্মহত্যার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়,
আত্মহত্যার বাড়ি উঁচু দেওয়াল বাই জিরো জিরো ঘুলঘুলিপুর রোড,
আত্মহত্যা হলুদজামা পরা এক নাদুস টিকটিকি,
ঘুলঘুলি থেকে রোজ মুখ বাড়ায়…
তার শীতল বিস্ফারিত চোখে চোখ মেলানোর জন্য মুখ তুলতে হয় শূন্যের দিকে,
আপন মনে সে আলোর ম্যাপ পয়েন্টিং করে দেওয়ালে,
এই ম্যাপের ভিতরে হুট করে একেক দিন ঢুকে পড়ে আমাদের মন,
মন নিয়ে টিকটিকি পাড়ি দেয় মহাকাশে,
সমস্ত তারা সেদিন পরে থাকে হলুদ রঙের জামা…

মাঝেমধ্যেই দরজা জানালার ফাঁকে অজান্তে আত্মহত্যাকে পিশে মেরে ফেলি …
কয়েকদিন পর শুকনো আত্মহত্যা টুপ করে ঝরে পরে মাটিতে …
তার উলটানো পায়ের পাতাকে দেখায় মৃত্যুর চেয়েও নরম স্বর্গচ্যুত এক শিউলি ফুল…

 

দুঃখ

দুঃখ এক ডালিমফুল-রঙা আনন্দ। আনন্দ মন্ডল ভোরবেলার ট্রেনে চা বিক্রি করে। তার চাআআ– ডাক শুনে বোঝা যায় ভোরের ফার্স্ট লোকাল এইমাত্র ছাড়ল নির্জনপুর স্টেশন। আনন্দ এক কামরা থেকে অন্য কামরায় উড়ে উড়ে যায় যেন ধ্যানমগ্ন কোনো প্রার্থনা সভায় এক সাদা প্রজাপতি…

কোনো কোনো দিন লাইন পেরতে গিয়ে দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে আনন্দকে দু’খান করে দিয়ে যায় এক্সপ্রেস ট্রেন। এই প্রথম জানা যায় আনন্দ মন্ডলের বাড়ির ঠিকানা, তার দ্বিতীয় বউ থাকে কোথায়…

পরদিন ফার্স্ট লোকাল ওঠে এক নতুন দুঃখ যাকে আনন্দ মন্ডলের মতোই দেখতে, ট্রেনের কামরায় তার চাআআ- ডাক ঝুলে থাকে ডালির আঁকা গলে যাওয়া ঘড়ির মত, ট্রেন ঘড়ির এক কাঁটা থেকে অন্য কাঁটায় এগিয়ে যায়… সবাই জেনে যায়, আনন্দ এক ডালিমফুল-রঙা দুঃখ।

 

জুতো

যেখানেই যাই সমুদ্র আমাকে নিয়ে যায়। দরজার বাইরে তার ঢেউকে খুলে রেখে আমি ভিতরে ঢুকি। গন্তব্য নিয়ে সমুদ্র কখনো আমায় প্রশ্ন করেনি। একেক দিন সমুদ্রের শুকতলা খুলে যায়, সেদিন তার কোন ঢেউ থাকে না, সৈকত থেকে অনেক দূরে মুখ মুষড়ে স্থির হয়ে থাকে। তার মাথার ওপরে অর্ধেক চাঁদকে দেখায় আধখানা আপেলের মতো যে আর কোনোদিকে গড়িয়ে যেতে পারবে না। ঝড় বৃষ্টি রোদ মাথায় মেখে সে ক্রমশ প্রাচীন হয় … তুলসীতলায় দু’তিনটি দীপ জ্বলে ওঠে… ভাঙা মন্দিরের পাশে শুকনো কাঁঠাল পাতা পতনের শব্দে কান নাড়ায় বুড়া সমুদ্র…

নতুন সমুদ্র কিনে নিয়ে আসি পায়ের মাপ অনুযায়ী, প্রথম প্রথম দুরন্ত তার শব্দ, সারা পাড়ার ঘুম ভেঙে যায় তার রমকে ঠমকে… তারপর সুখতলা খসে পড়ে একদিন পুরানো বাড়ির চটা-ফাটা দেওয়ালের মত… তার জলজ পাঁজর থেকে ঝুলতে থাকে কালো ফিতে যেন পায়ে ঘা হওয়া নিশ্চল কুকরের ক্লান্ত জেদী জিভ…

 

অবসাদ

অবসাদ থাকে মোড়ের দর্জি দোকানে। বুড়া দর্জি সেলাই মেশিনে নানান মাপের অবসাদ খুলে উল্টে পালটে রাখে। অর্ডার অনুযায়ী, কোনো কোনো অবসাদের সেলাই খুলে মাপে ছোট করে, পুরানো চটা-ফাটা অবসাদের ঘাড়ের কাছে রিফু করে, কোন কোন অবসাদকে একেবারে নতুনভাবে বানায় নতুন ছিট কেটেকুটে। সন্ধে যত রাতের দিকে যায়, পুরানো বাক্স খুলে নীল, সাদা, কমলা রঙের গল্পসুতো ঢেলে দেয় অবসাদের শরীরে। চোখে কম দেখে বুড়া দর্জি, সেলাই করার সময় প্রায়শই সমস্ত অবসাদকে মিশিয়ে ফেলে। ফলে, মিনতির ব্লাউজে লুকানো অবসাদ চলে যায় মন্টুর বউয়ের কাছে, মীরচাচার কুর্তার অবসাদ অসীমজ্যেঠুর পাজামায়, ধানখেতের বৈকালিক বিষাদ একতারার তারে হলুদ হয়ে থাকে, ঘড়ির দোকানের অবসাদ যায় স্টেশন মাস্টারের বুক পকেটে…

একদিন দুপুরে যখন ঘুঘুটি ডাকছিল একা, দেখি ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে ফাঁস লাগানো বন্ধুর দেহ যার অবসাদ আমার মুখের মত দেখতে।

 

করাতের সা

করাতের সা টিপতে বেজে উঠল জামরুল গাছ, রে টানতে বেজে উঠল গাছের নিচের পাঁচিল, গা টানতে ঝমঝম করে উঠল লম্বা দালান আর বিকাশ মাস্টারের গলা… মা টিপতে বেজে উঠল পাঁচিলের ঐপার থাকা অনন্ত ঝাউ, সুপারি আর খেজুরের বন, পা টিপতে ডেকে উঠল খেজুর গাছে বসা পাখিটি, ধা বাজতেই আমরা ছুটে যাচ্ছি বাতিল টায়ার চালিয়ে খেজুর গাছ পেরিয়ে দুর্গামণ্ডপের দিকে, নি টানতেই দেখতে পাই বাঁশের সাঁকো, ঐপারে বড়খুড়ির মাঠ আর সা টিপতেই অনন্ত মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছে দাঁতাল রাক্ষস…

মহাপ্রলয়ের পর পাঁচিলের পাশে উপড়ানো জামরুল গাছ, গাছের উপর করাতের রিড বাজছে সমান তালে- কোনো তাড়াহুড়ো নেই… যেন এক ব্রিজের উপরে ওঠা, তারপর কিছুটা সোজা হেঁটে আবার একই লয়ে নামা… তারপর প্রাইমারি ইস্কুলের দালান, আবার একটা ব্রিজ সামনে, তারপর সুপারি-খেজুরের বন, আবার একটা ব্রিজ…

গানের মূর্ছনায় নীচে ঝরে পড়ছে কাঠের গুঁড়ি যেন কষাইখানার গলা কাটা মুরগি যাদের রক্ত-শৈশবের দাগ এখনো শুকায়নি…

 

বিপ্লব

টকটকে লাল রঙের জামাটি প্রথম যেদিন ছিঁড়ল, কারো চোখে পড়েনি। চোখে পড়লেও পাত্তা দেয়নি বিশেষ। ফ্যাকাশে হলুদ সুতো দিয়ে সেলাই করার পরও তেমন কারো চোখে পড়ত না। কদিন পর আবার একটি ছিদ্র তৈরি হল জামায়… পুনরায় হলুদ সুতোর রিফু… লালের উপর হলুদ রংকে বেশ বেমানান লাগল প্রথম প্রথম। বিচ্ছিন্ন দুই হলুদ রংকে গ্রামের শালিশি সভায় খুব শাসানি দেওয়া হল। মারধর-শাসানি খাওয়ার পর হলুদের কিছুটা জনপ্রিয়তা তৈরি হল, দল বাড়ল হলুদের… কদিন পর আরো তিনটি ছিদ্র তৈরি হল… টকটকে লালের ওপর এখন পাঁচটা হলুদ সেলাইয়ের দাগ… বৈঠক বসল মন্ত্রীসভায় … বেমানান হলুদদের গলা টিপে ধরা হল, অনেক হলুদ নিখোঁজ হতে লাগল দ্রুত … যত বেশি হলুদের গলা বন্ধ করা হল তত বেশি বাড়তে লাগল হলুদের সংখ্যা… এভাবে একদিন বহু ঋতু পর জামাটি ভরে গেল সম্পূর্ণ হলুদ রঙে… জামার সমস্ত রাস্তা ঘাট, বাজার, নদী, আকাশ, বাতাস, এমনকি রাজার মুখ, ফুসফুস, হৃতপিণ্ড হলুদ রঙে ভরে উঠল… বেশ সুখেই চলছিল হলুদ রাজপাট …

তারপর একদিন, প্রকাণ্ড হলুদ জামার পেছনদিকে সামান্য ছিঁড়ল, সবুজ সুতো দিয়ে সেলাই করা হল … একটা তুচ্ছ সবুজকে লোকে তেমন পাত্তাই দিল না।

 

কাকতাড়ুয়ার বাইসাইকেল

কোনো একদিন চিঠি লেখা হত,
কোনো একদিন জমির তারখুঁটি দেখে মনে হত
আজ বিকালে বাড়ীতে আসবে পিয়ন,
কোনো একদিন অন্ধকারকে কারো মুখ ভেবে
ঝিল্লির ক্রন্দন ধ্বনি সারারাত বেজেছে আলো…

মহাপ্রলয়য়ের পর নরম আখর খুঁটে খাচ্ছে সঞ্জীবনী বক,
তাদের ডানার সাদা শব্দে কান নাড়ায় গোধূলির কাকতাড়ুয়া,
কাকতাড়ুয়া এক বিষণ্ণ পোষ্টম্যান
যার বাইসাইকেল জ্যোৎস্না রাতে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে …

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment