অনন্ত-গাথাঃ একটি অতিবাস্তব উপন্যাসের খসড়া ১ যখন সকাল তাকে, অন্ধকার সমগ্রতা থেকে, সহসা বিচ্ছিন্ন করে পর্দার ফাঁক দিয়ে, সকালের আলো যেভাবে ছেতরে পড়ল মেঝের ওপরে, যেন তাকে ডিমের কুসুম বলে ভ্রম হয়— তেমনি কমলা আর সামান্য আঁশটে গন্ধ, ঈষদুষ্ণ। ডিমের প্রসঙ্গ উঠলে, জন্মের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক—ভাবো, সেই আলো, যোনির মাংস-ছেঁড়া, রক্তমাখা আলো, কী ভীষণ যন্ত্রণার, সদ্যোজাত শিশুটির কাছে, যা তাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে! এবং, বাধ্য করে শ্বাস নিতে, মায়ের বুকের ওমে, অন্ধকারে ফিরে যেতে প্ররোচনা দেয়! যেন সেই কান্না থেকে মানুষের ভাষার সূচনা— ক্রমশ সমস্ত বোধ, বিপন্নতা, যন্ত্রণার গায়ে পৃথিবীর বস্তুপুঞ্জ, তাদের জটিল নকশা ফুটিয়ে তুলেছে। অথবা, ভাষার কেন্দ্রে, অন্ধকার কোনো জলময় গুহা আছে, আকর্ষণ আছে যদিও সেসব কথা, অনেক পরের। অনন্ত এতকিছু ভাবেনি তখনও। সবেমাত্র, ঘুম ভেঙে, অন্ধের মতো, নিজের চশমা খুঁজছে... * ভাষাহীন, অবয়বহীন কালো পাথরের গায়ে আলো পড়লে, ধীরে ধীরে, স্পষ্ট হয় পশুর আদল। চশমা পরার আগে, যেমন সমস্ত রঙ, দৃশ্যাবলী একাকার হয়ে থাকে— তুমি তাকে টুকরো করো। ফলে, ভাষায়, দৃশ্যের মধ্যে শুধু এক ভাঙাচোরা পৃথিবীর ছবি ফুটে ওঠে। অর্থাৎ, শব্দের ভেতরে শুধু বস্তুর প্রকাশ নয়, তাকে তার পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করারও এক প্রবণতা আছে। * চশমার মধ্যে দিয়ে, অনন্ত দেখতে পায়, সকালের রোদে মুহ্যমান হয়ে আছে চারিদিক। মনে হচ্ছে, যেন-বা কোথাও কিছুমাত্র ভয় নেই, সংশয় নেই। অথচ, সমস্ত রাত কীভাবে কেটেছে তার, সে-ই জানে! আবার নতুন করে, সেইসব কথা, মনে পড়লে ফের অনন্ত কেঁপে ওঠে। যেন-বা পিছন ফিরে তাকালেই, অজানা-অচেনা সেই পশুটির চোখে চোখ পড়ে যাবে তার, যে ভীষণ অন্ধকার ছায়ার আদল জন্মের মুহূর্ত থেকে এতদূর তাকে, উর্ধ্বশ্বাসে, ক্রমাগত তাড়িয়ে এনেছে, তার স্মৃতি— ২ যখন শৈশব মানে, অনুভূত শব্দের ত্রাস স্মৃতিকে অনন্ত তবু, পুরোপুরি, বিশ্বাস করে না। ধর’, যা-কিছু প্রত্যক্ষ—ঠিক এই মুহূর্তে, এইখানে, আমাদের ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে যা-কিছু বর্তমান—তাদের অস্তিত্ব তা-ও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু, যা কেবল মস্তিষ্কের খাঁজে-খাঁজে জমে থাকা তড়িৎ-রাসায়নিক চিহ্ন ও সংকেতমাত্র (আর তা-ই বা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে?), তাকে তুমি কীভাবে বিশ্বাস করবে? স্বপ্নের সঙ্গে, দৃষ্টিবিভ্রমের সঙ্গে, মরীচিকার সঙ্গে, কতটুকু পার্থক্য তার? তবু, অনন্ত-র মনে পড়ে—তখন তো খুবই ছোট—রাত্রিবেলা কিছুতেই সে ঘুমোতে চাইত না। শেষে তার মা, পাশে শুয়ে, একের পর এক গান গেয়ে শোনাত, পৈশাচী-ভাষায়। গান গাইতে-গাইতে, মায়ের খোলা চুল, রাত্রির অন্ধকারে মিশে তাকে আরো জটিল ও দুর্ভেদ্য করে তুলত। তারপর, একসময়ে, ঘন মেঘে ঢেকে যেত আকাশ, বৃষ্টি নামত। শব্দের সঙ্গে, বস্তুতান্ত্রিক জগতের এই গোপন আঁতাত, অনন্তকে বারবার বিস্মিত করেছে। এবং তার কাছে, শব্দ আর ভাষা ক্রমশ এক যুক্তিহীন সন্ত্রাসে পরিণত হয়। একদিন, স্কুল থেকে ফিরে, সে মা-কে জিজ্ঞেস করেছিল ‘স্তন’ কাকে বলে। ঠা-ঠা করে হেসে উঠে, মা তখন নিজের বুকের আঁচল খুলে দেখিয়েছিল, সেই উৎসুক মাংসপিণ্ডের মাঝখানে ঠেসে ধরেছিল অনন্ত-র ভয়-পাওয়া মুখ। ঘামের সঙ্গে মিশে থাকা সাবানের হালকা সুগন্ধে, সে হঠাৎ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। কে যেন, অনন্ত-র খাতার পিছনে, ‘বোকাচোদা’ লিখে, ফের কেটে দেয়। দিদিমণির ডাকে, সে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আর দিদিমণি তাকে মারার জন্য হাত তুললে, সে কিছুতেই তাঁর ঘামে-ভেজা বগলের দিক থেকে, চোখ সরাতে পারছিল না। রাত্রিবেলা, যখন জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে, আর কেবলই এপাশ-ওপাশ করছে বিছানায় শুয়ে, হঠাৎ সে দেখতে পায়, মায়ের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে, উঁকি দিচ্ছে একটি কালো বিড়াল। অন্ধকারে, তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল। পরদিন, মা তাকে ডেকে বলেছিল, “শুনে রাখ, এখন থেকে ওনাকে ‘বাবা’ বলে ডাকবি।“ ৩ যখন দুঃস্বপ্নের ভেতর, বাস্তবিক পাখি ওড়ে অনন্ত কল খুলে, হাত পাতে। বয়ে-যাওয়া জলের শব্দ, হাতের তালুতে তার শিরশিরে অনুভূতি, ক্রমশ তাকে সুস্থির করে, আশ্বস্তও। সে যে বেঁচে আছে, একটা জ্বলজ্যান্ত শরীর আর সচেতন অস্তিত্বসমেত—এর চেয়ে বড় কথা আর কী-ই বা হতে পারে! এখন, এমনকী, চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাতেও তার কিছুমাত্র অস্বস্তি হয় না। তেলচিটে কাচের গায়ে একটা মুখ, অর্ধেক শরীর। নিজেকে এখন বেশ সম্পূর্ণ আর উজ্জ্বল বলে মনে হয় তার। সে ভাবে। কাল রাতে, অস্পষ্ট কোলাহলে একবার, তার ঘুম ভেঙেছিল বটে! অনন্ত জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছিল, একদল হিজড়ে মিলে, মহোল্লাসে, মড়া নিয়ে শ্মশানে চলেছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! নতুন পোষাক-পরা শবটিকে দু’জনে দু’দিক থেকে জাপটে ধ’রে, হাঁটিয়ে, মাটিতে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে-যেতে মড়ার পেছনে কেউ লাথি মারে, কেউ আবার সপাটে থাপ্পড় মেরে, হাসতে-হাসতে কুটোপাটি হয়। একজন, ফস করে সিগারেট ধরিয়ে, মড়ার মুখে গুঁজে দিল, তারপর কোথা থেকে, রোদচশমা বের করে তাকে পরানোর চেষ্টা করে— অনন্ত ভাবে, এসব কি সত্যিই ঘটছে, না কি স্বপ্ন? তবুও সে মজা পায়। ভাবে, এমনকী মৃত্যুকেও কেমন তামাশা বলে মনে হচ্ছে, দেখ! মৃত্যু কি সত্যিই তামাশা নয়? যা-কিছুই অর্থহীন, পরম্পরাহীন তা-ই কি তামাশা নয়, হাস্যকর নয়? এইভাবে, কিছুক্ষণ কাটে। হিজড়েরা ততক্ষণে রাস্তার মোড় ঘুরে, অদৃশ্য হয়েছে। সহসাই, কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যবর্তী বিদ্যুতের তারে, উড়ে এসে বসে এক নিশাচর পাখি, ডানা ঝাড়ে। সমস্ত পালক আর মাংস-মজ্জা ততক্ষণাৎ ঝরে গেলে, অনন্ত দেখে, তীক্ষ্ণ শিসের মতো চেরা-ডাকে আকাশ বিদীর্ণ করে উড়ে যাচ্ছে শাদা হাড়ের কাঠামোটুকু। অনন্ত-র বুক কাঁপে। মনে হয়, এসবের অত্যন্ত গূঢ় কোনো, তামসিক, অর্থ রয়েছে। ৪ সিঁড়ি, প্রদীপ আর আয়নার ত্র্যহস্পর্শে, যখন একটি ষড়যন্ত্রের আভাস ফুটে উঠবে বলে মনে হয় সে এক আশ্চর্য সিঁড়ি, পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে কখনও ওপরে ওঠে, কখনও হঠাৎ, ভাঙাচোরা, অপ্রশস্ত চাতাল পেরিয়ে, নেমে যায় অন্ধকারে, মাটির তলায় ভুলে-যাওয়া, সারি-সারি কুঠুরির দিকে। বিচিত্র নকশা-কাটা লোহার রেলিঙ— বিলুপ্ত জন্তুর মুখ, বিষাক্ত লতাপাতা, অচেনা হরফ— বহুদিন ব্যবহারে, এখন অস্পষ্ট, কালো, তেলতেলে। অনন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়, হাতে কাচের ঢাকনা-দেওয়া কেরোসিন-ল্যাম্প। ফলে তার চারিদিকে একটি আলোর বৃত্ত তৈরি হয়, পাশের দেয়ালে অতিকায় ছায়া কাঁপে। অনন্ত ভাবে, দেখ, এই প্রদীপের শিখা কেমন সহজে এই সিঁড়িটিকে দৃশ্যমান করে, এবং নিজেও ফের, একইসঙ্গে, দৃশ্যমান হয়। রহস্যজনক বটে, এই কূট! দমকা হাওয়ার ঝোঁকে, লাজুক শিখাটি নিবে এলে বোঝা যায়, কী বিপুল অন্ধকার ওঁত পেতে বসে আছে, কী ভীষণ নৈঃশব্দ, কালচে-নীল জড়ুলের মতো রাত্রিকালীন যত ভালোবাসা, ভয়! হঠাৎ, মস্ত এক দরজার গায়ে, সিঁড়িটি ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। অনন্ত কান পেতে শোনে। নীরবতা! মস্ত এক পিতলের চাবি দিয়ে অনন্ত দরজা খুলে ঘরে ঢোকে। দরজা ভেজিয়ে দেয়। এবং অবাক হয়ে লক্ষ করে, ঘরের ভেতরে কোথাও কবিতা নেই। “কবিতা, কবিতা” বলে কয়েকবার ডাকে। হঠাৎ, পেছন থেকে (দেরাজে লুকিয়ে ছিল, সম্ভবত) কবিতা লাফিয়ে এসে, অনন্ত-কে আক্রমণ করে। কাচের বাতিটি তার হাত থেকে পড়ে, ভেঙে যায়। চারিদিকে, তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ— * তারপর দেখ’, সেই অন্ধকার ঘরে, কবিতা অনন্ত-কে কামড়ে দেয়, দীর্ঘ, ধারালো নখে, অনন্ত-র গাল ফালাফালা করে ফেলে। কবিতার ঠোঁটে অনন্ত-র রক্ত লেগে, সে এক দৃশ্য হয়, সে এক আশ্চর্য হয়, যতটুকু দেখি নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে, যতটুকু ভাষাহীন চিৎকার কানে আসে। যদিও চিৎকার ঠিক ভাষাহীন নয়, আসলে তো যেকোন ভাষাই এক আর্তনাদ— অনির্দিষ্ট নাম ধরে ডেকে ওঠা, যেন কেউ আচমকা সাড়া দেবে (যদিও তা ফাঁকা ঘরে প্রতিধ্বনি ছাড়া, হয়তো কিছুই নয়), অথবা, ভাষার মধ্যে, যেন এই অপেক্ষা রয়েছে— অন্ধকারে, আমাদের চোখ যদি সয়ে যায়, ক্রমশ স্পষ্ট হবে বস্তুর আকার আর রেখাগুলি, যাদের নিজস্ব কোনো রঙ নেই— ভাষায় কি রঙ আছে? অনন্ত কেঁদে ফেলে। চশমাজোড়া কোথায় ছিটকে গেছে ঠিক নেই, হয়তো ভেঙেছে, পায়ের তলায় পড়ে। রক্তে, চোখের জলে অনন্ত-র মুখ ধুয়ে যায়। বলে, “কবিতা, শান্ত হও, দেখ এদিকে তাকিয়ে দেখ। আমাকে চেনো না? অনন্ত, অনন্ত! আমি—" কবিতা বোঝে না। তবু, চুপ করে। বিছানার চাদরের নীচে, তাড়াতাড়ি, ঢুকে যায়। ফোঁপায়, হেঁচকি তোলে। অনন্ত পাশে বসে। ধীরে ধীরে, কবিতার পিঠে হাত রাখে—"একদিন নখগুলো কেটে দেব, যদি তুমি স্থির হয়ে, শান্ত হয়ে বসো।" চাদরের তলা থেকে উঁকি দিয়ে, ভীরু চোখে, কবিতা জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে গো? তোমাকে কি কোনোদিন দেখেছি কোথাও, এর আগে?” * বাইরে বৃষ্টি নামল, জানলার কাচে জলের ফোঁটার শব্দ। কিছুক্ষণ পরে, যখন জলের নীচে রাস্তাঘাট ডুবে যাবে, জলের ওপরে ঢেউ-তোলা অন্ধকার, কাঁপা-কাঁপা তারাদের আলো ভেঙেচুরে সরে যাবে অতিকায় মাছের আদল, প্রাগৈতিহাসিক ছায়া; যখন ভুতুড়ে এক্কা, রাত্রিচর ঘোড়ার ট্রলপ কোনো শ্যাওলাধরা পাঁচিলের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়বে তোমাদের ঘরে, তোমাদের রক্তে মৃদু প্রতিধ্বনি তুলে সহসা মিলিয়ে যাবে, তখন অনন্ত খুব আলগোছে কবিতার বুক খুলে, তাতে আঙুল ছোঁয়াবে, আর ঠোঁট পেতে শুষে নেবে বিষন্ন রাত্রির জল—ও কার শরীর, কাটা-ছাগলের মতো, দাপায় মেঝেতে! এখন, আমরা আর অনন্ত-র দিকে সোজাসুজি তাকাব না। বরং, ঘরের মধ্যে ওই যে আশ্চর্য এক চাপা আলো ছড়িয়ে পড়েছে, তার ফলে, এককোণে, ধুলোমাখা আয়নার কাচে ফুটে-ওঠা শরীরের রেখাগুলি, চুপিচুপি দেখে নেব— স্পর্শহীন বর্ণহীন ছায়ামাত্র আয়নার নীচে কুলুঙ্গিতে রাখা আছে প্রসাধন যত, কবিতার, অধুনা অব্যবহার্য— যেন ওই আয়নাকেই, ভাষা বলে ভুল হয়! হয় না কি?
Facebook Comments