শম্ভু রক্ষিত

শম্ভু রক্ষিতের নির্বাচিত কবিতা

নির্বাচনঃ গৌতম বসু, সেলিম মল্লিক, সঙ্ঘমিত্রা হালদার, অনিমিখ পাত্র।

আমাদের প্রেম

আমাদের নতুন বাড়ির দিকে আসার পথে পাশাপাশি তুমি তিনটে সিনেমা হাউস দেখতে পাবে, যেখানে হিন্দী আর নোংরা ছবি সব শোতেই দেখানো হচ্ছে। সিনেমা হাউসের নামগুলোও বিশ্রী, নোংরা এবং দীর্ঘ উদীরিত। আর তারপরেই হোটেল, চায়ের দোকান, মনিহারীর দোকান ইত্যাদির ভিড়। অতঃপর মুখোশ ও পরচুলার একটা দোকান, তার পাশে পশ্চিমী মজুরদের একটা খানাঘর, পেঁয়াজিভাজার দোকান, মুদিখানা ― এসবের পাশ দিয়ে ডাকবাংলোর গেট, গেটের পাশে আবার খানকতক বিচিত্র দোকান পশরা, তারপর পেট্রল পাম্প, দুর্লভ কেবিন, সোডাওয়াটারের স্টল, এবং সেই ঘরেই মুদিখানা দোকান, অতঃপর খানকতক হুমড়ি খাওয়া চালার পিছন দিক এবং একটা মিষ্টির দোকান, গোকুল মিত্তিরের ডাক্তারখানা, তারপর একটা ভাঙা কাঠের দোতলা, ওপরে নর্থপোল ল্যাবরেটরি, নীচে দি ওরিয়েন্ট প্রেস ও হোটেল, তারপর ফাঁকা, রেলের গুদাম আর তারপরেই আমাদের নতুন বাড়ি ‘মহাপৃথিবী’। তুমি যেদিন আমাদের নতুন বাড়িতে আসবে, সেদিন এই রাস্তার দুই দিকে একবার না একবার চোখ ফেরাতে হবেই হবে তোমাকে। অবিশ্যি, এই রাস্তা, বড় রাস্তা ধরে যেতে যেতে রাস্তার বড় রাস্তার দুই দিকে আমার এক-একদিন চোখ পড়ে, আবার এক-একদিন পড়ে না। আমি তখন নিঃস্ব রিক্ত শুকনো মাঠ দেখার কথা ভাবি, পাহাড়ী নদী, ধানগাছের ডাঁটা দেখার কথা, তোমার কথা, অথবা আঙুলের নখগুলোকে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে তোমার ফিতের মতো সরু করে ফেলি আমি। কিংবা সেই শিলাবৃষ্টির সময় সেই ছোট্ট বাগানটিতে(যেখানে আমাদের প্রণয়ের প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল)যেখানে মানুষ নেই, রণহুংকার নেই, দ্বেষ নেই, ষড়যন্ত্র নেই, নেই বৈরিতা, নিষ্ঠুরতা ― সেখানে তোমাকে নিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধবার কথা ভাবি। আবার মাঝে মাঝে আমার স্বার্থপর মামার সেই অশিক্ষিত কথাও আমার মনে পড়ে যায়, ‘তোমাদের কি আর তেমন বয়েস হয়েছে, তোমাদের আবার প্রেম কি? অতএব বেশ কিছুদিন ধরে অপেক্ষা করতে হবেই তোমাকে। যেমন, অপেক্ষা করছে আমাদের নতুন বাড়ির দিকে আসার পথে রাস্তার দুই দিক, যেমন, অপেক্ষা করছি আমি, অপেক্ষা করছে আমাদের প্রেম। বিশেষ করে এই ততদিন, অন্তত দশ বছর, যখন আমরা সাবালক, অবিশ্যি, ইতিমধ্যে আর কোন দুর্বিপাক যদি না ঘটে। তাছাড়া তুমি তো জানো, তোমার অপেক্ষার শেষ লক্ষ্য কে? তোমার আমার জন্যই তো মৃত্যুর সৃষ্টি হয়েছিল।

-‘পাঠক, অক্ষরগুলি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে (১৩৮৮/১৯৮২)

 

আমার শত্রুদের জন্য

আমি আমার অগণিত শত্রুদের মধ্যে একা, সঙ্গীহীন।
আমি বস্তুত সেই শত্রুদের চিনি, যারা আমার বিকৃত গল্প নিয়ে
মাঝরাত্রি পর্যন্ত মেতে থাকেন

আমি, আমার শত্রুদের জন্য আমার তেজ ত্রিধা বিভক্ত করেছি।
এবং আমার হৃদয় বায়ু দ্বারা বর্ধিত হয়ে
তাদের সঙ্গে এখন বীরের মতো যুদ্ধ করছে।

সেদিন এত বেশি ঝড়ের মতো হাওয়া বইছিল
যে, মনে হচ্ছিল আমি ও আমার শত্রুরা একই সঙ্গে মারা যাব
যেদিন আমি একটি উচুঁ মাটির ঢিপির ওপর নরমুণ্ড সাজিয়ে
একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছিলাম।

বালক, বৃদ্ধ বা যেসব অনুচর, যারা এখনও
আমার শত্রুর আজ্ঞাবহ হতে পারেনি
আমি তাদেরকে রত্নখচিত ছোরা, প্রাচীরবেষ্টিত ভূমি
এবং একটি গৃহ দান করেছি।
আমি শহর ছেড়ে দণ্ডকারণ্যের পথে
আমার শত্রুদের জন্য এক বিশ্রামকেন্দ্র গড়েছি
পৃথিবীর যে সমস্ত দুর্গম স্থান কারুর দেখা হয়নি
তা আমি আমার শত্রুদের জন্যই দেখেছি।

আমি বরফের দেওয়াল ঘেরা এক ছোট জায়গায়
আমার কয়েকজন শত্রুকে মৃতসঞ্জীবনী খাইয়েছিলাম।

আমি আমার শত্রুদের সৃষ্টিকর্তাকে দেখে পূত হয়েছি
আমার সমস্ত শত্রুরা তাদের সৃষ্টিকর্তার আজ্ঞায়
আমার মৃন্ময় রাস্তার ওপর এসে এখন দাঁড়িয়েছে।

আমার শত্রুরা পায়ে পায়ে পেছিয়ে গিয়ে
দ্রুত আমার ওপর তীর নিক্ষেপ করুক!

-‘সঙ্গহীন যাত্রা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে (১৯৯১)

 

সর্গ

আমার চার বন্ধু এক দিন নন্দীগ্রামে রওনা হল

চার বন্ধুর
এক জন কাঠুরে
এক জন স্বর্ণকার
এক জন তাঁতি
এক জন সিঁদুরবিক্রেতা

চার বন্ধু নন্দীগ্রামে রাত্তিরে এসে
খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভাবল
ভাবতেই থাকল

কাঠুরে প্রথমে জেগে রইল
একটি কাঠ কেটে, যুঝে
গড়ল সে এক নারীমূর্তি
ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ল

তার পর স্বর্ণকার উঠল
জাগল
জেগে গয়না তৈরি করে
নারীমূর্তিতে পরাল আবার সে নিদ্রা গেল

এর পরই তাঁতি ঘুম থেকে জেগে উঠল
কাপড় তৈরি করল
এবং সেই নারীমূর্তিতে সুন্দর করে পরাল
আবার শুয়েই সে সুপ্তিতে নাক ডাকতে শুরু করল

সিঁন্দুরবিক্রেতা প্রথম উঠল ঘুম থেকে
সে সিঁদুর পরিয়ে দিল নন্দীগ্রাম-নারীর সীমন্তে

-‘ঝাড়বেলুনে জোট’ কাব্যগ্রন্থ থেকে (২০১৩)

 

সোনার দাসী

অনেক দূর দেশ ঘুরে আমার সোনার দাসী আসে
আমি সংক্ষিপ্ত গলিপথ থেকে ঘরে কোলে করে নিয়ে আসি তাকে।

সোনার দাসী, যাকে প্রজাপতির মত দেখতে—
আমি চোখ বুজে শুঁকি যার টকটকে লাল সিল্কের জামা, গর্ভের শিরা
যার শুকনো অল্প চুল মাথার ওপর দুভাগ হয়ে
আমার কানের পাশে জটার মত ঝোলে।

আমার ঘরে লোহার খাট, জামা কাপড় রাখার দেরাজ
দেয়ালের মধ্যে মার্বেল পাথর বসানো কয়েকটা ড্রয়ার
এবং আখরোট কাঠের ওপর খোদাইকাজ করা ছোট্ট একটা টেবিল
যেন স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে থাকে।

আমি অবৈধ কার্পেট পুঁথি, ছেঁড়া কাপড় সোনার দাসীকে পরাই।
আমি হেসে তার সঙ্গে কথা বলি, তার জন্যে আমার নিশ্বাস,
আঙ্গুলের সাদা হাড় তাকে দেখাই, তার জন্য আমার জলস্তম্ভ
এবং আমার জন্যে তার দ্বিতীয় সত্তা অনেক দূরে চলে গেছে।

আমি সোনার দাসীর মনের কথা চিন্তা করি, সগর্বে উদাসীন হই
ফলে সোনার দাসী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে
বায়ুমণ্ডলের মতো তাকে মনে হয়
সে রঙিন বাদ্যযন্ত্র ও টুপি নিয়ে আমার সঙ্গে লড়াই লড়াই খেলে
আমি দেখি তার দীর্ঘস্পন্দিত খেলা, দীর্ঘ অঙ্গসঞ্চালনও করি
সোনার দাসীর অনুপক্রীড়ায় এখন আমার মূর্ত শরীর–

আমার ও সোনার দাসীর খেলা দেখে নিরাবরণ বুড়িরা উঁচু বাড়ি থেকে
বেরিয়ে আসে, সোনার দাসীকে তারা দয়াময়ের বাতাস দিতে থাকে
তাকে ঘিরে ধরে পাথরের পতগ লাগনো ওদের গুলবদন সম্ভ্রম।

চতুর্দিক দেখা বারুদের মতন সোনার দাসী শীতল মনে হাই তোলে
তার নিহিত চোখের ভেতর হতে অনর্গল রশ্মিকণা আসতে থাকে
তার জালি চোখ, উত্তপ্ত লাল ঠোঁট — ঝালর লাগানো স্মৃতি–

তার শরীরে আমার বেদনা মাখানো গন্ধ

আমি ও সোনার দাসী আমরা দুজনে এখনও স্পষ্ট, স্ফীত
আহরিৎ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে যাই প্রায়ই নিচে।

 

 

চিন্তন

আমি ভেবেছি আমাকে ঘরের দেওয়ালে বিভিন্নভাবে স্থাপন করে
বৈচিত্র্য সৃষ্টি করব।
আমি আজ নিরস্ত্র, অযুগ্ম, ত্বরমাণ।

আমি আমাকে আত্মসাৎ ও আক্রমণ করি, দ্বিধাহীনভাবে সমস্ত কিছু প্রকাশ
করে দেখাই
আমি আমাকে থামিয়ে রাখি, অপরিবর্ত আকার তৈরি করি
আমি আমাকে দেবতার, পর্বতমালার বা জড়পিণ্ডের ঋজুরেখা তৈরি করতে
কখনো দেখিনি; ধ্রুব বিশ্লেষণ ও স্থির বিষয়বস্তুতে আমি ক্লান্ত।

আমি বস্তু আমাকে দেখছি না,
আমার হাতের একটা ছোট্ট পেরেক সেই আমাকে দেখে যাচ্ছে

আমার ভেতর হালের কলাকৌশলের দেদার অনুপ্রবেশ ঘটছে
অসংখ্য বিশ্বাস, সূর্যের যোজনা, অকৃত্রিম অস্তিত্ব, আলজি-ঘন কালচে পাথর
বড় বেশি অর্থবহ ছবি, মধুর বিহ্বল কারুকার্য সচেতন হয়ে আমার মধ্যে আসছে
প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বৈচিত্র্য সৃষ্টিকরা উদাহরণ, বৃত্তাকার গতিশীল পাহাড়

আমি চিন্তা ও নিষ্ঠার শুদ্ধ পার্থক্য দেখাই স্বচ্ছ পাথরে। উত্তর হতে দক্ষিণের
অভিযোগও নিবদ্ধ করি। প্রতিরূপ-মূর্তি আমাকে দেখে ফেলে
ও মুখোমুখি কাষ্ঠ খণ্ড।

আমি লাল রঙ পরিমিতভাবে সূর্যকিরণের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি
শঙ্কুর মতো ধূসর ছাইরঙের কিছু গ্রামের, কিছু শহর দেখা যাচ্ছে
গড়িয়ে পড়ছে রঙিন ঘাসের ঘোড়া
আমি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অনুসন্ধানযানের ওপর শুয়ে প্রতিধ্বনি খুঁজছি।

 

বঙ্গদেশে টুপি

বিশ শতকের গোড়ায় অজঅ বঙ্গালে টুপির সংস্কার ও টুপির প্রসারসংক্রান্ত
৪৮০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট বিখ্যাত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র উদ্ভবের সময়
রিপোর্টের সবকটি পৃষ্ঠা ব্রিটিশ শক্তির হাতে চলে যায়। আমি বিধিসম্মতভাবে
রিপোর্টটি উদ্ধার করে এনেছি আজ।
বঙ্গদেশ টুপি প্রদর্শক দেশ। এই দেশে সর্বাধিক বিক্রিত বস্তু টুপি। বঙ্গদেশে
এর পরই বিক্রি মেষচর্মের ওপর লেখা টুপিবিষয়ে তথ্যপুস্তক।
সেই দেশের অধমাধম আবহমানকাল ধরেই টুপি পরে আসছে। তাদের টুপি
পরার ইতিহাস ১০,০০০ বছরের। তারা টুপিকে দেবতার দূত, অপদেবতা ও
মানুষের মাঝে হিসেবে ধরে। এদের টুপি দেবতার নিম্নাংশে গাধা,
উপরার্ধে ষাঁড়, সশ্মশ্রু, কৌতুকপ্রিয় তার মুখশ্রী, মাথার মস্তাকাবরণে
মহিষের শিং।
মাত্র দু শতক আগে বঙ্গদেশের প্রথম ফ্যাশনদার টুপির প্রচলন করেন মেরী টেলার
নামক এক মহিলা। তিনি টুপি বুনতেন স্টকিংস পদ্ধতি ডিজাইন ২x২ রিবং
দিয়ে। সেই সময় এই দেশের মেয়েদের মাথায় মাংকি, কাউন্টি, স্কাল ক্যাপ;
কিস্তি, ফারা, পানামা, কাশ্মিরি, বর্মী টুপি ইত্যাদি পোশাকের শুধু
কায়দাবাগিশ উপাদানই ছিল না, ছিল পোশাকের কৃতকীর্তি অঙ্গও। আর সব
প্রদেশের সব বয়সের জন্য যথাযথ টুপি ব্যবহৃত হত।
উনিশশতকী বঙ্গদেশে বাঙ্গালিটুপি আ-মু-খৃ-দরদের প্রতীক বলে গণ্য হয়।
আর এই শতকেই বেঙ্গলি ক্যাপ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা পায়। এই কোম্পানির
প্রকৃত মালিক স্কটল্যান্ডের আর্চিবন্ড। তার উদ্দেশ্য ছিল দেশের মহিলাদের
উপযোগী টুপিনির্মাণ ও নির্মাণে সাহায্য করা এবং তা প্রদর্শন করা। তার
কোম্পানি অনেকদিন সচল ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মাথার টুপি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় বাস্কেটের খেলোয়াড়রা
পোষা কাকেদের অন্যের টুপি ছিনিয়ে আনতে শিখিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত
কাকেদের এটা আর শেখানো হয়নি। তবে তারা টুপি ছিনিয়ে নিয়েই চলেছে।
মজার ব্যাপার বঙ্গদেশের প্রত্যেকেরই মাথায় এক অদৃশ্য টুপি রয়েছে। আর এ
শিল্পকলা ক্রমশ ঢাকা পড়ছে ক্র্যাশ হেলমেট আর ব্রেস্টপ্লেটে। আর হয়ে
উঠেছে অপেক্ষাকৃত সরল গণতান্ত্রিক, আর একই সঙ্গে তার সহজাত রোম্যান্টিক
বৈশিষ্ট্য বজায় থাকছে।
বঙ্গদেশের একো টুপির নতুন চিত্তাকর্ষক নমুনার প্রস্তাবও রেখেছেন আর্মামেন্ট
রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্ট-এর শ্রীগেগং আপাং। তার তৈরি প্রতিটি টুপিতেই
তিনটি কনডেনসর একটি ট্রানসিসটার ও একটি রয়েল থাকছেই।

 

 

রাজনীতিবিদরা

রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে
রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে
প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে
রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমসমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরের মানুষদের শেখায়
‘নিতান্তই দলের একজন লোক’ — তাদেরই দুর্দশার হেতু

যারা কোনো শিশুদর্শকদের হয়ে ছবি আঁকে না
বা লাথিয়ে খামচে চেঁচিয়ে হাড় ভাঙবার জোগাড় করে না
রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের উপর নির্ভর করে না
জনগণ নামক শ্রবণযন্ত্রে সাড়া জাগাবার উদ্দেশ্যে
রাজনীতিবিদরা কাগজে বেতারে পাঠায়
দেশ স্বাধীনতা পৃথিবী মঙ্গল বিষয়ে বিষ-অভিজ্ঞতা

রাজনীতিবিদরা রচনা করে এখনও কারাগার
পশু-সংস্করণ, রাক্ষস খোক্কসের সৃষ্টি-রহস্যের আদিকাণ্ড

তারা আধা পুরনো সমাজের মায়াপঞ্জিকার ভেতরে এখনও লুকিয়ে থাকে

 

আমার সুহৃদদের কথায় শুধু

আমার সুহৃদদের কথায় শুধু জন্ম-মৃত্যুর প্রসঙ্গ
আমার সব সুহৃদরা সমস্ত সময় জুড়ে
জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করতে প্রস্তুত

শহরে আমার হাজার-সুহৃদ আছেন, যারা জীর্ণ জাতির অন্তরে
ভরে তুলছেন নিস্তল অনুভুতির জয় পরাজয়, জন্ম-মৃত্যু

আমার সব সুহৃদরা যেন জন্ম-মৃত্যুর আদর্শের ভয়ংকর ছায়া

কিন্তু আমি চিন্তা করতে রাজী পৃথিবী যা জীবন বিষয়ে
কেননা, ওর মধ্যেও সুখ-দুঃখ, জরা-মৃত্যু, জড়-চেতন, শান্তি-সংঘর্ষ
অন্তত এই মাটির পৃথিবীকে নিয়ত শাশ্বত করে রাখছে যে-জীবন
তার তৈরি হওয়া সম্পর্কে যে-মতবাদ সুপ্রচলিত
সে-প্রসঙ্গটি আরো ভালোভাবে তলিয়ে দেখতে চাই

আমি আপঃকে বন্দনা করে নিজেকে অগ্নিদগ্ধ করি
বহু শতাব্দীর মৃত জগৎ বা জীবনকে কুঁদে তুলে নিই
তবে প্রেতযোনিমুক্ত ভবিষ্যতের হিরণ্যসময়ে
আমি পৃথিবী বা জীবন বিষয়ে ভাবতে পারি না

আমি জন্ম-মৃত্যুকে ভস্মসাৎ করে স্বজনব্রতে শুকিয়ে নিই

 

 

প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না

**
আচমকা এক ঝাঁকানি খেয়ে চলে আসব আমি আমার কাছে, অদ্ভুত এক
রহস্যময় রোগে মারা যাব আমি – আমি বাতি জ্বেলে রাখবো, যাদু থাকবে
আমার বেহালায়; এক দুষ্ট বানর ছুঁচের ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে আমাকে
আমি ধর্মনিষ্ঠ, কোনো ঈগলকে ধরব না আমি, আমার গান আমার প্রতিকৃতি হয়ে
যাবে – ভয়ংকর সংকেত দগ্ধ হয়ে জড়িয়ে ধরবে আমাকে, খচ্চর ছােটলােক
প্রভুদের নিয়ে আমি গবেষণা করব; আমি কাঁদতে পারব না, কাউকে কিছু
বলতে পারব না, আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলার মধ্যে আমার বোরিং গর্জন
করতে করতে চলে যাবে – সূর্যস্নাত আকাশ থেকে মৃদু হাস্যে নেমে আসবে বিদ্যুৎ
সমস্ত দেওয়াল কানাকানি করে উঠবে – কবি রূপকের মত মূৰ্ছিত হয়ে কাঁদবে
বিষণ্ণ গিটারে লোকায়ত সুর শোনাবে আমাকে – আমি স্বর্ণ কৌপিন পরে
দাঁড়ালে কুয়াশা উড়ে যাবে – একটা ভাঙ্গা ফুসফুস বেজে উঠবে আমার কানে
যুবা মানুষ দেবতা চুম্বন করে আলিঙ্গন করবে আমাকে, ও ‘জীবন অনেকটা
এই ভেরীর মতো’ মন্ত্র লিখে মরবে – আমার ভালো লাগবে না; জ্যোৎস্নায় হেঁটে
যাবে আমার শরীর – শুদ্ধ পিয়ানো আমার পায়ে মাথা নত করবে
মুহুর্তে সমগ্র পৃথিবীর বাকি অন্ধকার ও শৈত্য জ্বলে উঠবে
বৃষ্টি কুয়াশা নিয়ে আমার শরীর জেগে উঠবে

**

তোমার ঘর্মাক্ত মুখের ওপর মশালের রক্ত রং আলো, তোমার অন্তরের
এই রকম উজ্জ্বলতা, সবই গহ্বর ও আমার এই ধরণের বিষয়; তুমি কি
আন্দোলিত ধূসর পাথরে? ঘূর্ণি চাকায় পালিশ করে পৃথিবীর চন্দ্রমুখী
একটি তারা। স্বাগত জানাই আক্রমণকারিণীদের। আর তুমি অসুন্দর
প্রায় অতিপ্রাকৃত — প্লাটিনাম ফলকের ওপর তোমার ঐ বৈদ্যুতিক নক্ষত্রেরা
এইভাবে চাকচিক্য দিয়ে শরীরের ভিতরের চামড়ার ঠিক নিচেকার
যন্ত্রগুলি পরীক্ষা করেছিল
তুমি ছিলে জীবিত, এখন মৃত, তুমি কণিকা ও সূর্যের মধ্যে বিন্দু
ও বিস্ফোরণজাত গোলাপ। তুমি শ্যেন তরঙ্গিণী। শূন্য বিভীষিকাপূর্ণ
আমি ক্যানভাসে তোমার নাচের একটি বিশেষ মুহূর্ত আঁকি
অত্যন্ত কুপিত হই, তোমার ঈশ্বরের সঙ্গে আলাপ করি
বিষপূর্ণ ছত্রাক ও মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে অন্য জগতে
বজ্র বিদ্যুৎ সূর্য চন্দ্র নিয়ে তোমার যাত্রা, তুমি ক্ৰমশঃ ছায়ায় গ্রাসিত
তোমার ত্রিশূল ও সময় নিয়ে যায় সংক্ষিপ্ত কাষ্ঠে
তোমার মধ্য দিয়ে আমি সংক্ষিপ্ত রামধনুর ঘুরপাক দেখি
এবং আমার আত্মা জুলাই মাসের পপিফুল যেন
বুদ্ধের মত আমি হাসি, আমি কাগজ ক্যানভাসহীন এক শূন্যতা

**

সেখানে আকাশ শেষ, মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে একবার
বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করো সেখানে
বাঁয়ে ও মাঝখানে তোমার সাফল্য, আলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকা
হে ভ্রমণ, হে স্বল্পায়ু তেজস্ক্রিয়তা, রাসায়নিক কৌশলে আস্তে আস্তে
নামো, সুয়েজখাল ও আরব উপদ্বীপের মধ্যে –
আমাদের চিন্তাধারার শিকড় ধরে নাড়া দাও, দয়া ভিক্ষা চাও
অথবা ধাঁ করে নিজের ক্ষমতা জানো। সন্ধিপদ প্রাণীর মতো
বা ভবিষ্যতের পুনরাবিষ্কৃত নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল কিছু দ্যাখো
জলের মতো সহজ হও বা বাতাসের মতো ক্ষীণ
আর তারপরই দিশাহারার মতো, যেন নিজ ক্ষমতায় বিস্মৃত হও
অহেতুক বিচলিত হবার কিছু নেই, আকাশে ঘুরে বেড়ানোও কিছু শক্ত নয়
অনড় এবং রুমপাথর ঢাকা তোমার আত্মা, চতুর্ভুজ না দেখে
কোন ত্রিভুজকে দেখে নিতে অভ্যস্ত; কয়েক বছর অতিক্রান্ত, তুমি
ভৌগলিক দক্ষিণ মেরুতে; আজ তোমার কাজ পৃথিবী ছোঁয়া
আর লোহিতাভ আমি— আপন সৃজনশীল কর্ম নিয়ে একা
নিষ্কলঙ্ক আমার মুর্তি জলের মত সহজ মনে হয়
অগণ্য বিস্মৃতির স্তর সরিয়ে আমি এসে দাঁড়িয়েছি
সৌররাজ্যের সীমানা পার হয়ে আমি
মাটির কাছাকাছি কোনো দেশে উল্কার মতন, কী যেন আমার নাম

**

অন্তহীন অন্ধকারে তুমি রৌদ্রসেবন করেছিলে
স্থাবর-জঙ্গমাত্মক নিঃসঙ্গতা জলের আর ছায়ার স্বপ্নে, অস্থির ছায়াময় আঁধার
অজানা দৃশ্যের ছায়ার আর অসম্ভবের স্বপ্নে, আশপাশ থেকে শিশিরের আর
রামধনুর দেহ আনচান করে ওঠে, এমন অনুদাত্ত কন্ঠস্বর তোমার বিশাল জগতে
নিঃসীম নিঃসঙ্গ শূন্যে, ছায়ায় ছায়ায়, পাইন-ওয়ারবার পাখির কলধ্বনিতে
কেঁপে উঠছে হৃদয় আর সুস্থ উন্মাদনায় মত্ত বাতাস ভস্মশেষের দুরূহ পবিত্র
+ ক্রুশগুলিতে আর অধীর আরক্তিম রেখা প্রাচীন বিস্ফোরণশীল নক্ষত্রের নীচে
ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির মৃত্তিকার দুহিতার মর্মরিত স্বরলিপির মালার মতো
যখন অদ্ভুতভাবে যাই, উচ্ছ্বাস উন্মত্ত হয়, চেতনাকে মৃত রেখে আবহাওয়া
চামড়ার ডালের মতো খসখস করে, তুমি হলুদ আবরণে দেহ সাজালে
নিজের জগৎ নিজেই গড়লে
পশ্য, বাতাসদল কেমন কান্নার মতো ছুটে চলেছে দুর্ভাবনার পালে
বিস্তীর্ণ বর্ণবিভূষিত আকাশ শব্দহীন অঘ্রাণের প্রান্তরে
এই নিঃসঙ্গ শূন্যের মাঝখানে
এবং আমাকে বলোঃ তুমি নির্বাসিত হলেও তোমার নভোদীর্ঘপথ নির্বাসিত নয়

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment