অনিমিখ পাত্র

লুসিয়া কুপার্তিনো’র কবিতা 

মূল ইতালিয়ান থেকে ইংরাজি ভাষান্তরঃ পিনা পিক্কোলো।

বাংলা অনুবাদঃ অনিমিখ পাত্র।

 

ছবি সৌজন্যঃ Michelino Savino

কবি পরিচিতিঃ লুসিয়া কুপার্তিনো’র জন্ম ১৯৮৬, ইতালির এক সৈকতশহরে। তিনি একজন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ, কবি (ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ) ও অনুবাদক। বর্তমানে থাকেন কলম্বিয়ায় যেখানে তিনি পরম্পরাগত দেশীয় কৃষিপদ্ধতি এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। ইতালীয় সাহিত্য জার্নাল Nuovi Argomenti, Fili d’aquilone, Iris di Kolibris ইত্যাদিতে কবি, সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন। তিনি La Macchina Sognante এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং একজন বর্তমান সম্পাদক যার ফোকাস বিশেষত দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দেশীয় জনগোষ্ঠী, চিরাচরিত কৃষি ও গাছপালা এবং অভিবাসন-এর উপর। কবির প্রথম চ্যাপবুক প্রকাশ পায় ২০১৪ তে। তার কিছু স্প্যানিশ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে La otra, Círculo de poesía এবং Vallejo &Co ইত্যাদি পত্রিকায়। তিনি সম্পাদনা করেছেন 43 Poeti per Ayotzinapa (Arcoiris 2016), এই সংকলনগ্রন্থের, যা ইতালীয় অনুবাদে একটি বহুভাষিক কবিতার সংকলন, যেখানে যেমন ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর কবিতা আছে তেমনই আছে স্প্যানিশভাষী মেক্সিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের কবিতা। লুসিয়ার প্রথম পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই Non ha tetto la mia casa/No tiene techo mi casaএকটি দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ যার স্প্যানিশ ও ইতালীয় সংস্করণ ২০১৬ সালে প্রকাশ করেন Casa de poesia, San Joseকবির সাম্প্রতিকতম অরিগ্যামি-বই – Cinco Poemas de Lucia Cupertinoপ্রকাশ করেছেন Los ablucionistas, Mexico City, 2017লুসিয়া এখন পরীক্ষা চালাচ্ছেন ছোট গল্প লেখা নিয়ে, এবং তার কিছু কাজের হদিশ পাওয়া যাবে  La Macchina Sognanteদুনিয়াদারি’র এই সহযোগী ইতালিয়ান সাহিত্য জার্নালে। 

পিনা পিক্কোলো গুরুত্বপূর্ণ দ্বিভাষিক (ইতালিয়ান ও ইংরাজি) কবি, অনুবাদক এবং একজন সক্রিয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ‘দ্য ড্রিমিং মেশিন’ ও ‘লা মাশিনা সগনান্তে’ নামক দুটি যমজ সাহিত্যজার্নালের সম্পাদক।

 

 

 

 

 

 

এলোমেলো চিহ্নগুলো 

উষ্ণ ও স্বাগত জানানোর মতো তার বাড়ি
প্রচুর নম্র কার্পেটময়
সামনের দরজায় সমুদ্র আঁকা
তামাটে হলুদ রঙের ঘোরানো সিঁড়ি
ব্যালকনি থেকে তুমি দেখতে পাবে
পার্শ্ববর্তী পরিত্যক্ত লাইব্রেরিটিকে
রান্নাঘরে কিছু মাকদুস* বানানো হয়েছে
সবকিছুই সাদামাটা ও শান্তিপূর্ণ   
ব্ল্যাকবোর্ড-এর ওপর কিছু আরবি শব্দ
সেই পাঠ থেকে যা এক্ষুনি শেষ হয়েছে
গোলমেলে সব চিহ্নে ভরা ব্যাখ্যাসমূহ
শব্দগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে এক্ষুণি
একটা কাগজের টুকরো – ভাঙা আর ছিন্নভিন্ন,
সিরিয়া ঠিক এইরকম, সে আমাকে বলে
আমার সঙ্গে ম্লান দৃষ্টি বিনিময় করে 
একটা লাল, কালো আর ধূসর স্তুপ
কিছু আরবি চিহ্ন
দেখিয়ে দেয় সেইসব রাস্তাদের যা বস্তুত আর নেই
আসবাবপত্রের ভাঙা টুকরোর মধ্যে দোমড়ানো পর্দাগুলি         
এবং চায়ের কাপ যাতে সুগার কিউবের মতো প্লাস্টারের টুকরো পড়ে আছে
তাদের ধরার জন্য কোনো কাটা হাত নেই  

 

*মাকদুস – বেগুন দিয়ে বানানো একটি মধ্যপ্রাচ্যের খাবার। 

 

মৃত্যু-জ্যাকেট

আমাদের এই সমুদ্রের অপরপিঠে 
ওরা তোমাকে একটা মৃত্যু-জ্যাকেট দিয়েছিল,
ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি তোমার জীবন
তুমি এক বেচারা, প্রতারিত লোক, এখন মোহমুক্তও
ওই জ্যাকেট যা ডুবে যায় যা সস্তা
পরীক্ষিত নয়, উপযুক্তও নয়
বাঙ্কারের মতো কারখানায় অন্যান্য শোষিত লোকজনের দ্বারা   
যা তৈরি হয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে নয় যত্ন দিয়েও না। 
যখন তা আত্মার ক্রেতার পকেটটাকে স্ফীত করে তুলছে
যখন তা কয়েকটি মৃতদেহ বৃদ্ধি করছে
এই ভেঙচিময় কবরখানায়, যাকে 
এই হিমজমাট ঢেউ শাশ্বত করে তুলছে
তখনই তোমার জীবনকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হবে  

 

যেকোনো স্বপ্ন ফেলে পালাও

রাত্রির গুঞ্জনের মধ্যে হারিয়ে গেল
একটি নৈশ তীর, যেন উদ্যত রাইফেলের দিকে শেয়ালের ঝাঁপ,
যা এক শিকারী সেই মেয়েটির জন্য গেঁথে রেখেছিল
সে এই পৃথিবীতে এমন একটি কোণ চায়
শান্তিপূর্ণ যদি নাও হয়, অন্তত যেন কিছু অল্প ফাটল থাকে তাতে।         
তুমিও তো পালিয়ে যাচ্ছো ফাঁদ থেকে
তোমার চোখ বরফশীতল আর তোমার দেহ কাঁপছে
অলিভ গাছের ছেঁড়া শিকড়ের মতো,
ইনান্না* নাম্নী এক সুমেরীয় দেবীর মতো
দাগে ভরা মুখ
সাদা চুল চুড়ো করা
তুকতাককারীর উদ্গত হাতের মতন।             
এমনকি তোমার মাথার ওপর ঝুলে আছে
আরেকটা জগতের গরজ,
এমন এক মানবতা যার হৃদয় আর্সেনিকহীন। 
  
দৌড়ে পালাও তুমি আর তোমার রগের দু’পাশে ইতিমধ্যেই উদ্যত রাইফেল।
জানোয়ার কিংবা বেশ্যা – ওরা তোমাকে যা বলেই ডাকুক, 
একই ব্যাপার,
দৌড়নোই  নিয়তি তোমার
যেকোনো স্বপ্নকে ফেলে
চারপাশে তাকাতে তাকাতে। 

রাত্রির গভীরে, আমাদের প্রত্যেক ভীরুতার ভেতর
তুমি একটি হরিণ। 

 

*ইনান্না – সুমেরীয় দেবী, প্রেম, যৌনতা এবং যুদ্ধের। 

 

ওই জঘন্য দেওয়ালগুলি আমি  

আমার ছিন্ন শরীর এখনো উষ্ণ সেই জীবন দিয়ে
যা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে
আমার কেটে ফেলা স্তন
তার বীর্যে ভরা আমার চোখ
আমার যোনি খুলে ফেলা হয়েছে
কাঁটাতার দিয়ে।      

আমাকে দ্যাখো ওই ডোবা’র ভেতরে
শূন্যদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি
আমাকে দ্যাখো তীরবর্তী ওই দোলনায়
আমাকে দ্যাখো মরুভূমিতে
আমাকে দ্যাখো ভূমধ্যসাগরে
আমাকে দ্যাখো নদীর ওপরে ভাসমান
দ্যাখো আমার রক্ত কেমন অরণ্যকে পুষ্টিরস জোগায়
তোমার বাড়ির পেছনের প্রাঙ্গণে তাকাও
ওখানেই আমি আছি, ওখানেই আমরা আছি, তুমিও কি থাকবে ওখানে?  

আমিই সেই নারী যে কাজ খুঁজছে
আমি সেই মেয়ে যার পাঁচ সন্তান
সেই হাত যা ওরা কেটে ফেলেছে আমার থেকে
আমিই সে যে নেকড়েকে বিশ্বাস করেছিল
কারণ বিশ্বাস করার মতো আর কোনো গল্পই ছিলো না
আমি সেই বাড়ির কাজের লোক যে সবেমাত্র তোমার জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দিল               
আমি আসছি লিমা, কারাকাস, আলেপ্পো
জুবা, ঢাকা, মসুল, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক
পোর্ট-ও-প্রিন্স, ওয়াগাডুগু থেকে
আমাজনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে
এমন সমস্ত জায়গা থেকে আসছি যা তুমি জানবেই না
কিন্তু খবরের কাগজে পড়বে প্রথমবারের জন্য  
আমিই সেই লোক যে চটজলদি জেলখানা হিসেবে গড়ে নেওয়া ভ্যানের ভেতরে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছিলাম
আমিই মেক্সিকো বাজারের সেই দোকানি যাকে জঘন্য মনে হয়েছিল তোমার
আমিই সাবওয়ের সেই নোংরা বাচ্চাটা
আমিই সেই পড়শী এলাকা যেখানে কক্ষণো পা রাখবে না তুমি
আমি সেই বেশ্যা যে ঠান্ডায় মারা যাচ্ছে 
আমি সেই সমাজকর্মী যে মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়    
আমি সেই জঙ্গল যাকে ওই স্তনের মতোই কেটে ফেলা হয়েছে
আমি সেই ক্রুশবিদ্ধ হরিণ যে অন্যত্র চলে যেতে চেয়েছিল
আমি সেই পশুর ছানাগুলি যারা বেড়ার মধ্যে আটকা পড়েছে
আমি মৃত্যু আর চুমুর মধ্যেকার সেই চার সেকেন্ড
আমিই সেই গৃহের ঘ্রাণ আর বিস্মৃতির পূতিগন্ধ
আমি হিতৈষী গোষ্ঠীর সাহায্যে মেটানো সেই ক্ষুধা
আমি হয় সেই হয়ে উঠতে না পারা শনিবার নয়তো মঙ্গলবার
আমি তোমার মা তোমার বাবা তোমার কাজিন তোমার ছেলে
আমি এই পৃথিবীজোড়া ক্ষতচিহ্ন
আমি ওই মারাত্মক জঘন্য দেওয়ালগুলো।       
      

 

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “লুসিয়া কুপার্তিনো’র কবিতা ”

  1. সোহেল ইসলাম

    দুর্দান্ত অনিমিখ, ভালোবাসা নেবেন।দারুন কাজ করেছেন।কেয়া বাত।

Leave a Comment