ভাস্কর খাঁড়া

রামমোহনঃ আধুনিকের লড়াই

প্রায় দুশো বছর আগে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কয়েকপৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তক সম্বাদ’। (এরপর থেকে ‘প্রথম সম্বাদ’ বলে উল্লেখিত)। রচয়িতা রামমোহন রায়। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ নারীজাতির অধিকার নিয়ে তখনও উচ্চকিত হয়ে ওঠে নি। সমাজে তখনও বহমান বিধবা নারীকে পুড়িয়ে মারার  শাস্ত্রসম্মত সেই নারকীয় প্রথা –সতীদাহ। ক্ষুদ্র এই পুস্তিকায় রামমোহন রায় স্ত্রীজাতির সবচেয়ে বড় অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন – তা হল বেঁচে থাকার অধিকার। সহমরণ ও অনুমরণ প্রথার নারকীয়তা নিয়ে বর্তমানে কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু আধুনিকতার সেই ঊষালগ্নে প্রয়োজন ছিল বুঝিয়ে বলার। প্রয়োজন ছিল স্ত্রীজাতির প্রাণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা।রামমোহন সেই কাজটিই করেছেন। এই প্রাণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রামমোহন মূলত শাস্ত্রবাক্যের সাহায্য নিয়েছিলেন। কারণ এই প্রথার সমর্থনকারীরা বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করেই বহুকাল ধরে চলে আসা এই প্রথার যৌক্তিকতা প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন। রামমোহন লোহা দিয়ে লোহা কাটার প্রচলিত পথে গিয়েই তাদের যুক্তিকে ধরাশায়ী করতে চেয়েছিলেন। আর একটা দিকও নিশ্চয়ই তার মাথায় ছিল। সতীদাহের মতো প্রথা যে এখনও বর্তমান তার কারণ নিশ্চয়ই তিনি বুঝেছিলেন শাস্ত্রবাক্যের প্রতি জনসাধারণের অগাধ বিশ্বাস।যে দেশের অধিকাংশ মানুষ তখনও ধর্মভয় ও পরলোকের জন্য সঞ্চিত পাপের ভয়ে ভীত, যে দেশের শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মানুষদের সিংহভাগই ইংরেজদের ‘কার্য্যালয় হইতে অপরাহ্নে ফিরিয়া আসিয়া অবগাহন স্নান করিয়া ম্লেচ্ছসংস্পর্শজনিত দোষ হইতে মুক্ত হইতেন’ [দ্র রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ] –সেই দেশের মানুষদের মন থেকে সতীদাহের মতো পরম্পরাবাহিত সংস্কারকে উচ্ছেদ করার জন্য রামমোহন শাস্ত্রবাক্যকেই প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করেছেন।কিন্তু লক্ষ্যণীয় শাস্ত্রকারদের সঙ্গে শাস্ত্রবাক্য দিয়ে যুক্তি সাজালেও তিনি বারবার তাঁর যুক্তিজালের মধ্যে টেনে এনেছেন সাধারণ নীতিবোধ, অধিকারবোধ ও মানবিকতার স্পর্শকাতর প্রশ্নগুলিকে। নিজের যুক্তিজালে নিবর্ত্তকের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছেন ‘হত্যা’ বা ‘স্ত্রীহত্যা’ শব্দগুলি। যেন বারংবার মনে করিয়ে দিতে চাইছেন যতই শাস্ত্র থেকে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা হোক না কেন, সহমরণ আসলে সমবেত যূথমণ্ডলীর সামনে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। শাস্ত্রবাক্য দিয়ে অন্য শাস্ত্রবাক্য খণ্ডন করা সত্ত্বেও এই কারণেই সতীদাহ বিষয়ক রামমোহনের রচনা এক অন্যমাত্রা পেয়ে যায়।

আর রামমোহনের রচনার এই অন্যমাত্রার মধ্যেই রয়ে গেছে রামমোহনের যুক্তিকৌশলের অনন্যতা। শাস্ত্র নয়, জীবনের নীতিবোধ থেকেই তাই তিনি সবার আগে তোলেন ‘আত্মঘাত’ এর প্রশ্নটি। স্বেচ্ছায় সহমরণ তো আসলে আত্মঘাত বা আত্মহননের নামান্তর। সদ্যবিধবা, শোকগ্রস্তা (দুশো বা তার বেশি বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে হিন্দু নারীর জীবনে বৈধব্য কি বিপর্যয় ডেকে আনতো এ প্রসঙ্গে তা ভেবে দেখা জরুরি) নারীকে হিন্দুধর্মের যে ধ্বজাধারীরা স্বামীর সঙ্গে অখণ্ড স্বর্গলাভের প্রলোভন দেখিয়ে, আশ্বাস দেখিয়ে সহমরণে প্রেরণা দিচ্ছে, রামমোহনের চোখে এরা সকলে ‘স্ত্রীলোকের আত্মঘাতে উৎসাহ’ প্রদানকারী। সর্বশাস্ত্রে যেমন আত্মঘাত নিষিদ্ধ, পাপজনক; সেই নিষিদ্ধ পাপকাজে উৎসাহদানকারীও রামমোহনের চোখে শিষ্ট মানুষ হিসাবে গণ্য নয়। প্রথম সম্বাদে রামমোহন একাধিকবার ধর্মের ধ্বজাধারীদের শাস্ত্রবাক্যের নিষেধের সঙ্গে সঙ্গে আচরণীয় এই শিষ্টতার দিকটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নিরক্ষর, শাস্ত্রপাঠের অধিকারহীন স্ত্রীজাতিকে যারা ভুল বোঝায় তাদের উদ্দেশ্যে রামমোহনের শাস্ত্রসম্মত সতর্কবাণী, ‘আর যে সকল ব্যক্তি আপনার অজ্ঞানরূপ কর্মকাণ্ডেতে মগ্ন হইয়া অভিমান করে যে আমরা জ্ঞানী এবং পণ্ডিত হই, সেই মূঢ়েরা জন্মজরামরণাদিদুঃখে পীড়িত হইয়া পুনঃ ২ ভ্রমণ করে, যেমন এক অন্ধকে অবলম্বন করিয়া অন্য অন্ধসকল গমন করিলে পথে নানাপ্রকার ক্লেশ পায়’।

আত্মঘাত ও তাতে উৎসাহদানের প্রসঙ্গের পর রামমোহন ‘স্বেচ্ছা’ সহমরণের হাস্যকরতা, নির্দয়তার দিকটিকে আঘাত করেছেন। রক্ষণশীল হিন্দুদের চূড়ান্ত লজ্জাহীনতার প্রকাশ সহমরণকে বিধবার ‘স্বেচ্ছাপূর্বক’ কর্ম বলে দাবি করার বিষয়টি। তারা বলে থাকেন হিন্দুরমণীরা স্বেচ্ছায় স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করেন। কিন্তু তথাকথিত এই স্বেচ্ছামৃত্যু যে নেহাত আত্মঘাতে প্রেরণা দান নয়, তা যে আসলে হত্যার নামান্তর রামমোহনের শ্লেষাত্মক যুক্তিই তার প্রমাণ। যদি স্বেচ্ছাতেই হিন্দু বিধবাদের এই মৃত্যুবরণ তাহলে কেন পূর্বে স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে বিধবাকে দৃঢ়ভাবে বন্ধন করা হয়? কেনই বা সেই বিধবার উপর এতো পরিমাণে কাঠ চাপানো হয় যাতে ওই বিধবা উঠতে না পারে? আর কেনই বা অগ্নি সংযোগের কালে ও তার অব্যবহিত পরে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়ে তাকে চেপে ধরে থাকা হয়? এই ধরণের আচরণ যে কোনও শাস্ত্রবাক্য নিঃসৃত নয়, তা নিশ্চিত। আর তাই রামমোহনের সিদ্ধান্ত, ‘অতএব এ কেবল জ্ঞানপূর্বক স্ত্রীহত্যা হয়’।

প্রবর্তক কথিত চিতা থেকে উঠে এলে বিধবার লোকনিন্দা হবে ইত্যাদি যুক্তিও রামমোহন নৈতিক শিষ্টতার দিক থেকেই নাকচ করেছেন। যে সকল লোক জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী-কে হত্যা না করলে নিন্দা করে তাদের স্তুতি নিন্দাকে সাধু ব্যক্তিরা গ্রহণ করেন না বলেই তার অভিমত। আর ঈশ্বরের ভয়, ধর্মের ভয় ও শাস্ত্রভয় –সবকিছু ত্যাগ করে কেবল লোকনিন্দার ভয়ে স্ত্রী হত্যার যুক্তি যে ভারে দাঁড়ায় না সে তো বলাই বাহুল্য। যেহেতু এটি হত্যা নামক অপরাধ তাই সতীদাহের পরম্পরার যুক্তিকে নাকচ করে তাঁর বক্তব্য, ‘বিশেষত কোনও ব্যক্তি যাহার লোকভয় ও ধর্মভয় আছে’ সে কিছুতেই এটা বলতে পারে না যে ‘পরম্পরাপ্রাপ্ত হইলে স্ত্রীবধ, মনুষ্যবধ ও চৌর্যাদি কর্ম্ম করিয়া মনুষ্য নিষ্পাপে থাকিতে পারে’। এইরকম পরম্পরা মেনে চলতে হলে ‘বনস্থ ও পর্ব্বতীয় লোক’ যারা পরম্পরায় দস্যুবৃত্তি করে আসছে তাদেরও নির্দোষ বলে গণ্য করতে হবে।

‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’ রচনায় রক্ষণশীল হিন্দুদের মুখপাত্র কাশীনাথ তর্কবাগীশ মহাশয় রামমোহনের এই যুক্তির বিরুদ্ধেও প্রতিযুক্তি দিয়েছিলেন শাস্ত্রবাক্য অনুসরণ করেই। হারীত বচন উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন, স্ত্রী শরীরের প্রতিটি খণ্ড খণ্ড অংশও যতক্ষণ না প্রকৃষ্টরূপে দাহ হচ্ছে ততক্ষণ স্ত্রীযোনি মুক্ত হয় না। আগুনে স্ত্রীর মৃত শরীর যাতে খণ্ড খণ্ড হয়ে চিতা থেকে ইতস্তত ছড়িয়ে না পরে তাই এই বন্ধন। তা একর্থে শাস্ত্রের পালন মাত্র। এমনকি এরূপ কাজ করার জন্য দাহকেরা স্ত্রীহত্যার পাপ সঞ্চয় করে না। পরন্তু তাদের পুণ্য হয়। আপস্তম্বের বচন উদ্ধৃত করে বিধায়কের বক্তব্য,শাস্ত্রমতে বৈধকর্মের প্রযোজকও কর্তার মতো সম পুণ্যফল লাভ করে থাকেন। আর তাছাড়া তৃণ ও কাষ্ঠ সহযোগে এবং স্ত্রীর অনুমতিক্রমে দাহকেরা দাহ করেন। তাই তাদের পুণ্যই হয়, পাপ হয় না। এবং মৎস পুরাণের গল্প উদ্ধৃত করে জানানো হয় ‘বেতন গ্রহণ না করিয়া পরের পুণ্য কার্যের আনুকূল্য যে করে তাহার অত্যন্ত পুণ্য হয়’। সতীদাহকে সাধারণ হত্যা বা দস্যুতার সঙ্গে একাসনে বসাতেও রাজি নন বিধায়ক। ‘বনস্থ ও পর্ব্বতীয়’ লোকেদের পারম্পরিক দস্যুবৃত্তির সঙ্গে সতীদাহের সাধারণীকরণকে নাকচ করে বিধায়কের বক্তব্য বনচর লোকের ব্যবহার উত্তম লোকের গ্রাহ্য নয়। সহমরণ বিষয়ক যে আচার তা মহাপ্রামাণিক ধার্মিক পণ্ডিতেরা আদ্যোপান্ত গ্রহণ করে এসেছেন। ‘অতএব শিষ্টাচারেরই গ্রাহ্যতা, দুষ্টব্যক্তির আচারের গ্রাহ্যতা নাই’। জ্বলন্ত হুতাশনে প্রবেশ করার বিধান সত্ত্বেও বিধবাকে আগে বেঁধে তারপর অগ্নিসংযোগের অশাস্ত্রীয় পদ্ধতিকেও বিধায়ক ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ এর যুক্তি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং এমন ভাব দেখিয়েছেন, যেন রামমোহনের মূল আপত্তি ‘দাহ’ নিয়ে নয়, ‘জ্বলচ্চিতারোহণ’ ‘শাস্ত্রবিহিত হইয়াছে’ কিনা তা নিয়েই।

আমাদের পরম সৌভাগ্যে বস্তুত ‘বিধায়ক নিষেধক সম্বাদ’ লিখিত হয়েছিল। নয়তো শাস্ত্রজ্ঞ রামমোহনের মানসিক দৃঢ়তা, ক্ষমাহীন প্রত্যাঘাত ও শাস্ত্র বেড়াজাল ছিন্ন করে নৈতিক যুক্তির শানিত ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হতাম আমরা। হয়তো লিখিত হতো না ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’। (এর পর থেকে ‘দ্বিতীয় সম্বাদ’ বলে উল্লেখিত) স্ত্রী স্বাধীনতার সপক্ষে আর দু এক দশক পর থেকেই যে প্রবল আন্দোলন সূচিত হবে তার বীজ যেন রামমোহন উপ্ত করে দিয়ে গেলেন এই দ্বিতীয় সম্বাদের মাধ্যমে। ভারতীয় পাপপুণ্য, স্বর্গবাস-নরকবাসের ধারণায় হানলেন তীব্র আঘাত। পতি-সহ অক্ষয় স্বর্গলাভের যে প্রলোভন সতীনারীকে দেখানো হয় সেই পতিসঙ্গ যে  মুক্তি তথা মোক্ষসাধনার অন্যতম প্রধান অন্তরায় তা দেখালেন। কাম নামক যে রিপুর দমন হিন্দু অধ্যাত্ম সাধনার অন্যতম মূল অবলম্বন, কল্পিত স্বর্গের সঙ্গে তার যে প্রচণ্ড বিরোধ তা তাঁর অভূতপূর্ব যুক্তির দ্বারা যেন পরিস্ফুট হল–  ‘আমরা এই নিশ্চই জানি যে পুরুষ কি স্ত্রী স্বভাবসিদ্ধ কাম, ক্রোধ, লোভেতে জাড়িত হয়েন, কিন্তু শাস্ত্রের অনুশীলন দ্বারা এবং সৎসঙ্গের দ্বারা ঐ সকল দোষের দমন ক্রমশ হইতে পারে, এবং উত্তম পদপ্রাপ্তির যোগ্য হইতে পারেন, এই নিমিত্ত আমরা স্ত্রীলোককে এবং পুরুষকে অধম শারীরিক সুখের কামনা হইতে নিবৃত্ত করিবার প্রয়াস করি, অর্থাৎ স্বর্গে যাইয়া স্বামীর সহিত অত্যন্ত নিন্দিত স্ত্রীপুরুষের ব্যবহারপূর্ব্বক কিছু কাল বাস করিয়া পুনরায় অধঃপতিত হইয়া গর্ভের মলমূত্রঘটিত যন্ত্রণা ভোগ করহ, এমত উপদেশ কদাপি করি না’। স্বামী-স্ত্রীর একত্রে স্বর্গবাস যে তাদের এই কামতাড়িত জীবন থেকে মুক্তি দেবে না বরং তা কামনারই পৃষ্ঠপোষণা করবে – এ এক অভুতপূর্ব যুক্তি। এ কোনও শাস্ত্রবাক্য দিয়ে সতীদাহ নিরোধের প্রচেষ্টা আর নয়। বরং পরস্পরবিরোধী শাস্ত্রবাক্যকে অস্বীকার করে স্বাভাবিক যুক্তিবোধের দিকে তাঁর যাত্রা। চিতায় বেঁধে অথবা না বেঁধে কিংবা আগে থেকে জ্বলছে এমন চিতায় নাকি পরে প্রজ্জ্বলিত শ্মশানশয্যায় স্ত্রীকে প্রবেশ করতে হবে –এইসব অহেতুক প্রশ্ন অস্বীকার করে তাঁর সহজ স্পষ্ট বক্তব্য, ‘স্ত্রীবধ, ব্রহ্মবধ, পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যা ইত্যাদি দারুণ পাতক সকল দেশাচারবলেতে ধর্ম্মরূপে গণ্য হইতে পারে না। বরঞ্চ এরূপ আচার যে দেশে হয়, সে দেশই পতিত হয়’। যদি সকল দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই কাজ করে তাহলেও ‘বধকর্ত্তারা পাতকী হইবে, অনেকে ঐক্য হইয়া বধ করিয়াছি এই কথার ছলে ঈশ্বরের শাসন হইতে নিষ্কৃতি হইতে পারে না’। রামমোহন কথিত এই ‘ঈশ্বরের শাসন’ যে বস্তুত সর্বকালের সর্বদেশের, সর্বমানুষের উপর প্রযোজ্য সহজ নৈতিকতা, শিষ্টাচার আর লৌকিকতার বোধ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না আমাদের। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের যে স্বাভাবিক যুক্তিবোধ তা কোনও শাস্ত্রবাক্য দ্বারা সমর্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের শুভচৈতন্যে সর্বকালে সেই বোধ বিরাজমান। রামমোহন তাই মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘দুষ্টতা ও শিষ্টতা মানুষের ক্রিয়া দ্বারা নিশ্চিত হয়’। তাই শাস্ত্রজ্ঞ যুক্তি-অনুসারী মহাজনও যদি জ্ঞানপূর্বক স্ত্রীলোককে দাহ করেন, ধার্মিক বলে প্রচারিত হন, ‘তবে অধার্মিক মহাজনের স্থল আর নাই’।

চিতার কতটুকু অংশ জ্বলন্ত হলে ‘চিতাকে জ্বলচ্চিতা’ বলা যায় –বিধায়কের এই ধরনের কূটতর্কে তাঁর স্পষ্ট অভিমত, ‘এরূপ বাক্যকৌশল করিয়া কতিপয় মনুষ্য যাহারা স্ত্রীবধে অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছেন, তাহাদের মনোরঞ্জন করিলেন, কিন্তু বাক্যপ্রবন্ধবলে ঈশ্বরের বিচারে কি ত্রাণ হইতে পারে?’ তবে বাক্যপ্রয়োগের কূটতর্কের নিষ্প্রয়োজনীয়তা নৈতিক শিষ্টতার দিক থেকে ঘোষণা করলেও রামমোহন খাঁটি যুক্তিবাদীর মতোই বিধায়কের শব্দপ্রয়োগের অবৈধতাকেও বিচার করেছেন এবং নস্যাৎ করেছেন নিপুণ ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানের সাহায্যে। বিধায়ক বিধবাকে মৃতদেহের সঙ্গে রজ্জু দিয়ে বন্ধনের কারণ হিসাবে বলেছিলেন, স্ত্রীর শরীরের নানা খণ্ড দাহকালে যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না পড়ে তাই এই বন্ধনের ব্যবস্থা। রামমোহন এই বক্তব্যের নির্লজ্জ যুক্তিহীনতাকে ব্যঙ্গ করে জানতে চাইলেন, ‘অতএব জিজ্ঞাসা করি যে লৌহরচিত রজ্জু দিয়া এরূপ বিধবাকে বন্ধন করিয়া থাকেন, কি সামান্য প্রসিদ্ধ রজ্জু দিয়া বন্ধন করেন? কারণ লৌহযন্ত্রে শরীরকে প্রবিষ্ট করিয়া দাহ করিলে তাহার খণ্ড ২ ইতস্তত পড়িবার সম্ভাবনা থাকে না, অন্যথা সামান্য রজ্জু দিয়া যদি বন্ধন করেন, তবে সে রজ্জু শরীর দাহের পূর্বেই প্রাণত্যাগ সময়ে দগ্ধ হয়। অতএব সে দগ্ধ রজ্জু দ্বারা শরীরের ইতস্তত পতন কোনোরূপে বারণ হইতে পারে না’। রামমোহনের এই যুক্তিতে বলাই বাহুল্য কোনও শাস্ত্রজ্ঞান নেই, রয়েছে কাণ্ডজ্ঞান। অধর্মকে ধর্মরূপে সংস্থাপিত করতে গিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু পণ্ডিতেরা সেযুগে এতোটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে উঠেছিলেন যে জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে রজ্জু দগ্ধ হয় না এই মতও প্রচারে সচেষ্ট হয়েছেন। সতীদাহ নিবারণ আইনের প্রতিবাদে গঠিত ‘ধর্মসভা’ সেই কাণ্ডজ্ঞানহীনতার আর এক প্রমাণ।

কিন্তু কেবল সতীদাহ নিবারণের উদ্দেশ্যে যুক্তি সাজিয়েই রামমোহন ক্ষান্ত হননি। দ্বিতীয় সম্বাদের সমাপ্তিতে রামমোহন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রীজাতিকে যে প্রতিনিয়ত দুঃসহ যন্ত্রণা ও লাঞ্চনার মুখোমুখি হতে হয় তার বিবরণ ও প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন। কোনও শাস্ত্রবিশারদ নন, একজন সহানুভূতিশীল সমাজসংস্কারকএদেশের অর্ধেক মানুষকে যে নিরতিশয় আগুনে প্রতিনিয়ত দাহ করা হচ্ছে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। স্ত্রী স্বাধীনতার সপক্ষে এর দু-এক দশক পর থেকেই যে প্রবল আন্দোলন সূচিত হবে তার বীজ যেন রামমোহন উপ্ত করে দিয়ে গেলেন এই রচনায়। প্রথম সম্বাদ রচনাতেই প্রবর্ত্তকের মুখে শোনা গিয়েছিল নারীদের চরিত্র সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত এক সাধারণ বক্তব্য। যেহেতু সতীত্ব রক্ষা করে চলাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রধান কর্তব্য, তাই প্রবর্ত্তক সতীদাহের পক্ষে এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে বিধবা স্ত্রী জীবিত থাকলে ‘ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে’। তাই জাতি-কুটুম্ব প্রমুখ সকলের নিঃশঙ্কচিত্ততার জন্য, এমনকি পতি যদি জীবিত অবস্থাতেই স্ত্রীর সতী সংকল্পের কথা অবগত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে মৃত্যুকালে তার মনেও কোনও স্ত্রী-ঘটিত কলঙ্কের মনঃকষ্ট থাকবে না। প্রথম সম্বাদে নিবর্ত্তক স্ত্রীর ভবিষ্যৎ ব্যভিচারের আশঙ্কায় স্ত্রীবধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মাত্র। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রশ্ন না তুলে মৃদুভাবে জানিয়েছিলেন স্বামী বর্তমানেও স্ত্রীর ব্যভিচারী হওয়ার নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সম্বাদে রামমোহন রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিকতাকে নারীজাতির দুর্গতির জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন এবং নারীর প্রতি পুরুষ বুদ্ধিহীনতা, অস্থিরচিত্ততা, ব্যভিচারীতার যে সব অভিযোগ করে থাকে তার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। রমমোহনের সেইসব বক্তব্য কোনওটাই সহমরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। কিন্তু প্রাণের অধিকার স্থাপন করতে গিয়ে হয়তো পিতৃসমাজের নানা অসঙ্গতিতে তার মধ্যে জমা হওয়া ক্ষোভ এখানে বেরিয়ে এসেছে। নারীজাতির প্রতি সমানুভুতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অন্তর।

তাই স্ত্রী জাতির বুদ্ধিহীনতার অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর প্রত্যুত্তর, ‘স্ত্রী লোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোনকালে লইয়াছেন যে, অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই। তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?’ স্ত্রীজাতিকে অস্থিরচিত্ত বলে সমালোচনা করা হলে তিনি মনে করিয়ে দেন অন্তঃকরণের স্থৈর্য ছাড়া স্বামীর উদ্দেশে অগ্নিপ্রবেশ করা সম্ভব হত কি? স্ত্রীজাতির বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় শঙ্কিত পুরুষের প্রতি তার তথ্যভিত্তিক উত্তর, ‘প্রতিনগরে, প্রতি গ্রামে বিবেচনা কর, যে কত স্ত্রী পুরুষ হইতে প্রতারিতা হইয়াছে আর কত পুরুষ স্ত্রী হইতে প্রতারণা প্রাপ্ত হইয়াছে, আমরা অনুভব করি যে প্রতারিত স্ত্রী’র সংখ্যা দশগুণ অধিক হইবে’। প্রতারণার কথা ছেড়ে দিলেও একজন পুরুষ একাধিক বিবাহ করেন, কিন্তু স্ত্রীলোকের একপতি। সে মারা গেলে তার সমস্ত সুখবাসনা শূন্য হয়। সবশেষে রামমোহন তুলে ধরেন আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনে স্ত্রীজাতির সম্মানহীন পদদলিত চেহারা। একান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ সেই ছবিতে কি নেই? রয়েছেন সেই নারী যার কুলীন স্বামী শুধুমাত্র অর্থের জন্য দশ পনেরটি বিবাহ করেছেন। স্বামীর নিয়মিত সাক্ষাৎ ব্যতিরেকেই পিতৃগৃহ বা ভাতৃগৃহে যাকে নিরতিশয় লাঞ্ছনায় দিন কাটাতে হয়। রয়েছেন স্বপত্নী পরিবেষ্টিতা অসহায় নারী। আছেন সেই নারী যার সারাটা জীবন পতিগৃহে নিদারুণ পরিশ্রমের গৃহকর্ম করতে করতে অবসিত হল। স্ত্রীকে অর্ধঅঙ্গ বলে স্বীকার করে এনেও পুরুষেরা তাদের সঙ্গে ব্যবহার করে পশুর তুল্য। ‘যেহেতু স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জ্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জ্জন, গৃহলেপনাদি তাবৎ কর্ম্ম করিয়া থাকে; এবং সূপকারের কর্ম্ম বিনা বেতনে দিবস ও রাত্রিতে করে’। দৈনন্দিন ঘরকন্নার মধ্যে পিতৃতন্ত্রের যে আগ্রাসন রয়েছে ১৮১৮-১৯ সালের বাংলাদেশে বসে সেগুলি একটার পর একটা তুলে আনতে থাকেন রামমোহন। গৃহকর্ম যে আসলে বেতনহীন দাস্যবৃত্তি এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই কাজের না দেয় স্বীকৃতি, না দেয় সম্মান –এমন আধুনিক নারীবাদী ধারণাও রামমোহনের লেখায় অত্যন্ত পরিস্ফুট।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment