রাজদীপ রায়

রাজদীপ রায়ের কবিতাগুচ্ছ

নীরব বেহাগ

মৃত্যু নিয়ে আদিখ্যেতা করা, এসব মানুষের স্বভাব
হাসিমুখে কাউকে বিদায় জানানো—
তারপর তার কথা ভেবে সহজে চোখের জল ফেলা…
এসব স্ববিরোধ নিয়েই তো বেঁচে থাকা
জনরুচি মেনে লেখা কবিতার মতো
যার কয়েক পঙক্তি পড়েই তুমি
থুতু ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলে—ছ্যা ছ্যা

আত্মহননের দিন শেষ হয়ে এল তাড়াতাড়ি
এবার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে
তার আগে প্রস্তুতির পর প্রস্তুতি
দৃশ্য আবছা হয়ে আসে

দূরের গেরুয়া রং দেখে ঠিক
বোঝা যায় না তেমন, সূর্যোদয় না কি
সূর্যাস্তের ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে…
তুমি হাঁটু মুড়ে প্রার্থনায় বোসো—
জন্মদিন লুকিয়ে ফেলা
সব থেকে প্রশ্নাতীত কাজ…

 


ওই পথ ছেড়ে এই পথে এসো
এই পথ ছেড়ে ওই পথে চলে যাও—
তেমন সমস্যা হলে আমার আড়ালে বসে থাকো
দেখো, ওই সংসারী পিঠে কত জলছবি আঁকা
আরেকটু দেখলে, সমুদ্রও চোখে পড়তে পারে

তোমাকে আমার বুক দেখতে হবে না।
তোমাকে আমার মুখ দেখতে হবে না।
কোনোটা ছুরির ঘায়ে সংক্রমিত
কোনোটা গুলির আঘাতে খুবলে…

জানি আত্মারাম, তুমি এতসব দাগ
মেনে নিতে পারবে না। তাই
আমার পিছনে শান্ত হয়ে বোসো
খিদে পে… এ কী!
পিঠে এত ঠান্ডা, শক্ত কী?
ধার লেগে চিনচিন করছে
তোমার আঙুলে এত ধার আছে আত্মারাম?

আত্মারাম, তাহলে…তুমিও!


এভাবেও একদিন দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি কখনো।
তোমার দু-হাতে ডাঁই করা বাজারের ব্যাগ
কী এনেছ আজ তবে? স্বাদু বাঁধাকপি?
না কি কোনো কিশোরের মাথা
তুলে আনলে ক্ষেত থেকে?

বাড়ি যাবে বুঝি?
গিয়ে দ্যাখো, ওখানেও কারা নাকি
এসেছিল, মুখে ফেট্টি বেঁধে…
আমিও ছিলাম কি?

আজকাল প্রশ্ন বেশি আসে মনে
উত্তর আসে না।
কমলা আগুনে শুধু আকাশ বধির করে রাখে…

সূর্য অস্ত গেল তবে…

এসো আত্মারাম, পরস্পরকে খনিক
অবিশ্বাস করা যাক।


সামনের বাড়িটা জ্বলছে কেমন দ্যাখো…
কোনো তাড়া নেই, মায়া নেই, কষ্ট নেই
ঠিক এরকম মৃত্যুই তো পছন্দ তোমার!
কেমন নিরিবিলি আনন্দে সব ছাই হয়ে গেল…
জোকারেরা রাজপথে নেচেছিল খুব
তাদের রঙিন তাস থেকে ছিটকে পড়েছিল
ভেষজ আবির…

দোল এসে গেল আত্মারাম, হঠাৎ অসময়ে।
রং না পেলে রক্ত দিয়েই না হয়
একটু রামলীলা আয়োজন করি…

তুমি শুনেছ নিশ্চয়ই
প্রকৃত বসন্তকাল সাতিশয় লিবিডো-ব্যঞ্জক…


তোমার নাম ধরে ডাকতে আজকাল ভয় করে
তাই আড়ালে ফিসফিস করি
যদি শুনতে পাও—যদি, সাড়া দাও…
তোমারও কি তবে কোনো অযোধ্যা ছিল?
কারো মৃত্যু হলে বুঝি
তালে তালে খঞ্জনি বাজাতে?
প্রেমিক না রাজা, না কি আদ্যন্ত শয়তান তুমি—
আজো বুঝে উঠতে পারিনি।
বুঝেছে কি অন্য কেউ?
অন্য কোনো মাড়ু পৃথিবীর শিসধ্বনি…

শুধু তুমি আঙুলের শীর্ষ তুলে বলে দিলে
এই ভূমি এখন থেকে ভ্রুণহত্যাকারী
ফতোয়া-রঙিন…

যতদূর মৃত মতবাদ, তার চেয়েও দূর
পড়ে আছে রূপের খোলস…
মাড়ু ব্যক্তিরা এসেছে
মূত্রপদ্ধতি গলায়।
এবার অমৃতবাণী শোনাবেন তারা
প্রসূতি গাভীর রবে…


তোমার নামটা দয়া করে পাল্টে দাও
প্রখর যুক্তির যুগে এইসব আত্মা-ফাত্মা চলে নাকি?
আর রাম? বড়জোর খেয়ে দেখতে পারো…
তার চেয়ে যদি যদুনাথ কিংবা দীপাঞ্জন রাখতে
কাজের কাজ হত।
তোমায় নিয়ে এত বদনাম কুড়োতে হত না।

এখন তোমাকে ডাকলেই এমন আতঙ্কে ভুগি
মনে হয়, শরীরের ভেতর থেকেই
জেগে উঠেছে অন্য কেউ—
স্নায়ুর গভীরে আমি তার শিহরণ
খুঁজেছিলাম একদিন
কোপানোর তুমুল সময়ে
সে হঠাৎ কীভাবে সর্বজ্ঞ হয়ে
উড়ে চলে গেল তাই ভাবছি

পড়ে আছে তার ফেলে যাওয়া রক্তাপ্লুত ডানা…
ওটুকু নিয়েই শুতে যাব…

যে এখন জ্ঞানের অতীত
নামে তার কী বা আসে যায়…


রাস্তা বন্ধ হয়ে নাকি?
কোথাও যাবার পথ নেই?
এতসব চিন্তা করে কী হবে আত্মারাম…
লৌহখননের শব্দে হাঁটু ভেঙে যায়
কৃষিপতনের আওয়াজ শুনতে পেলে?
শতাব্দীপ্রাচীন কোনো এক দেশ
মেরুদন্ড ভেঙে পড়বার ভয়ে ওয়া ওয়া কাঁদছে…
তাকে ভোলাবার মতো কেউ আর অবশিষ্ট নেই।
মৃগনাভি খুঁজতে গিয়ে তালেবর মহামান্য সব
নিষেধাজ্ঞা প্রসব করেছে…
ফলত রাস্তায় আর কেউ আসবে না এখন
নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এসো—দিশেহারা
পরিযায়ী পাখির মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব…
রোস্টেড বাতাসে
উড়ে যাবে তার নিরন্ন পালক—
গেরুয়া আকাশ থেকে তন্দুর পায়ের সমাধিস্থ পথে-পথে…


জিভ যদি ছিঁড়ে নিতে
তাহলে বলার আর থাকত না কিছু

শূন্যস্থান থেকে গড়িয়ে পড়ত শুধু রক্ত…

জিভের গভীর ভ্রুণ ছিঁড়ে নিলে বলে
অফলা জিভের আর জন্ম হল না শরীরে…

সেই থেকে এই মুখ, বোবা শব্দের ভেতর
কুকুর লেলিয়ে দেয়…

ঘ্রাণ আসে পরজন্ম থেকে
যেন কোনো বৌদ্ধ ভিক্ষু, উত্তরীয় ভেবে
সেই কাঠামোবিহীন জিভ গলায় পড়বে—

বহুদূর হেঁটে হেঁটে রাস্তা শেষ হলে দেখবে
নীরব বেহাগ এসে ছড়িয়ে রয়েছে শীতঘুমে

তোমার হাতের কোনো কথা নেই আর
কান্নাও হারিয়ে গেছে—দৃষ্টিহীন সরল কৌতুকে…

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment