রুমা মোদক

যে জীবন দায়ের

হঠাৎ করে নয়,পাড়ার চেহারাটা  খোল নলচে সহ ভেতর থেকেই  ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে গত কয়েক বছরে এমন পাল্টেছে যে এদের জীবন সংশ্লিষ্ট মূল যে জীবিকা,তার পরিচয় ধীরে ধীরে লীন হতে হতে পাড়ার বিশেষত্বটা একটা মজা ডোবায় পরিণত হয়েছে। যে ডোবায় যে কোন সময় কয়েক ঝাঁকা মাটি ঢেলে দিলেই  তার আর কোন নাম নিশানা থাকে না, তেমন। ধুঁকতে ধুঁকতে যে কয় ঘর এখনো পাড়ায় আছে যে কোন অজুহাতে যে কোন দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে পরদিনই পাড়াটির কথা সবাই বেমালুম ভুলে যাবে। মনে রাখার সংগত কোন কারণের মতো মোটেই প্রয়োজনীয় নয় এরা।

   ঢোকার মুখে যে রায়সাহেবের মাঠটা পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়েছিলো পাড়াটাকে আগলে, সেখানে যখন ইট সিমেন্ট সুরকি এসে টিলার মতো উঁচু হতে থাকে তখনও এর সুদূর প্রসারী প্রভাব নিয়ে কেউ তেমন চিন্তিত ছিলো না বরং এই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সময়ে শেষ অবধি তাদের পাড়াটাও বাদ পড়েনি, ইট সিমেন্ট জমাট বাঁধছে, দালান উঠছে এই গর্বে স্ফীত হয়েছে পাড়ার মানুষেরা।  যাক শহরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বেমানান তাদের জরাজীর্ণ পাড়াটাও অবশেষে ইটের গাঁথুনির অহংকার অর্জন করতে পারলো। 

এ নিয়ে আফিয়ার উত্তেজনা ছিলো  সব চেয়ে বেশি।আফিয়া সব সময় নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে বড়ো অধৈর্য। যেনো নিজের ভেতরে জন্ম নেয়া আকাঙ্ক্ষার দাস হয়ে যায় সে নিজেই। কোনভাবেই একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। নইলে বংশানুক্রমে পাওয়া জমি জিরাত গ্রামে রেখে শহরে এসে উঠা ভদ্র ঘরের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এই ঢাকী পাড়ার ছেলের সাথে চলে আসে! 

পাড়ার চেহারা আগলে এই ইট পাথরের গাঁথুনি সুউচ্চ হতে থাকলে সবচেয়ে খুশি হয় সে। বাপের বাড়ির মানুষ জন তার এই বিয়ে মেনে নেয়নি,  শুধু তাই নয় এই এক পেশার কারণে আত্মীয় স্বজন পরিজন সবাই যে অসহনীয় বিরক্তির চোখে তাকায়  তার আর ছালু মিয়ার দিকে আফিয়ার লজ্জায় আর অনুশোচনায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। বিয়ে বাড়ি কিংবা গানের আসরে বাজনা বাজানো বেয়াদাত কাজকাম। এই বেয়াদাত কাজ করে তার স্বামী ছালু মিয়া।শুধু বাপের বাড়ি কেন, বন্ধু বান্ধব পরিচিত সবাই তাকে উপেক্ষা করে  ঘরের ভেতর মরে পচে ফুলে উঠা ইঁদুর ছানার মতো। পারলে এই আত্মীয়তার পরিচয় তারা ছুঁড়ে ফেলে দিতো নর্দমায়, ভাগ্যিস সম্পর্ক চাঁদনি রাইতের জোছনার মতো,ছোঁয়াও যায়না, অস্বীকারও করা যায়না। দোকানে, পথে ঘাটে কারো সাথে দেখা হলে সবাই এমন অচেনার মতো চোখ ঘুরায় যেন শুধু পচা ইঁদুর নয়, কীটে কিলবিল করছে তার শরীর।  এমন পরিণতি কল্পনাতেও ছিলো না তার কাঁচা বয়সের প্রেমে যখন তৃণের মতো ভেসে যাচ্ছিলো সে। ছালু মিয়াকে আঁকড়ে ধরার সময় এর কিচ্ছু তলিয়ে ভাবেনি। শুধু কি তাই, এই পেশার কারণে নিত্য অনটন সংসারে। চাল কেনা হয় তো মাছ হয়না, মাছ হয়তো তেল হয়না। এমন অভাবী দিনের সাথে জীবনে পরিচয়  নাই তার। অবশ্য ছালু মিয়াকে দোষ দেয়ার সুযোগ নেই। আহার নিদ্রাহীন উন্মাদ উন্মাদ সময়ে আফিয়া যখন ঘুমের মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠতো ছালু মিয়াকে স্বপ্ন দেখে তখন ছালু মিয়া বারবার নিরস্ত করেছে তাকে। বারবার বুঝিয়েছে এই সমাজে কতোটা অচ্ছুত তারা। যার চোখের দিকে তাকালে ভেতরের শিহরণ সামলে ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না আফিয়া, তার কোন যুক্তিই তখন যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেনি সে। ছালুওতো তাকে ভালোবেসেছিলো, কাঁহাতক আর নিজের আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য করা যায় অপরপক্ষ যখন এমন উন্মাদ! ছালু আগলে নিয়েছিলো আফিয়াকে। 

এই ইট পাথর কাঠের গাঁথুনির সাথে সাথে আফিয়ার চোখে স্বপ্ন জাগে সব স্বাভাবিক হবে, স্বামী সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওরি যাবে সে। বন্ধু বান্ধব পরিজনদের সাথে সম্পর্ক হবে। ছোট খালার মেয়ের গায়ে হলুদে যাবে। বড় ফুফুর নাতিনের জন্মদিনে যাবে। এ নিয়ে ছালু মিয়ার সাথে তার বিস্তর ঝগড়া ঝাঁটিও হয়।

তুই কিতা ভাবছিলে তরে বিয়া কইরা আমি ঢাক বাজানি বাদ দেলামু? 

হ বাদ দেওন লাগ্লে দিবায়।  পরকালের ভয়ডর নাই?

শোন আফিয়া ঢাক বাজানি বাদ দিলেও আম্রারে কেউ ভদ্রলোক কইত নায়। তুই জাইন্যা বিয়া করস নাই আমি যে ঢাকী, আমার বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী ঢাকী! আমি বারবার কইছি না?

 বাড়ির সামনে বড় রাস্তার মোড়ে সুন্দর আলীর মুদি দোকানে সমবয়সীদের সাথে সাদাকালো টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতো ছালু মিয়া। ঘরের জানালা দিয়ে দেখতো আফিয়া, ছক্কা ছক্কা বলে সে কী নাচ ছালু মিয়ার। একবার ঈদের দিনে ডেক সেট বাজিয়ে রাস্তায় নেচেছিলো ছালু মিয়া, তুম পাস আয়ে কিও মুসকারায়ে…।সম্ভবত সেদিনই তুলেমূলে ডুবে গিয়েছিলো আফিয়া। এমনই ডুবা ডুবলো সব বাস্তবতা তুচ্ছ করে পালিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করে ফেললো। 

ছালু মিয়া সত্যি বড়ো ভালোবেসেছিলো আফিয়াকে। সামাজিক অবস্থানে দুজনের আকাশ পাতাল ফারাক ভেবেই কোনদিন নিজ থেকে প্রকাশ করে নি। আফিয়াই  চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলো ওকে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না প্রিয়তম। প্রিয়তম যে কেবল একজনকেই বলা যায় এটা বুঝতে পেরে প্রথমেই ছালু মিয়ার মাথায় কাজ করেছে বিপুল বেদনা। আহা সে তো ঢাকী সমাজের মানুষ। ভদ্র সমাজে পতিত। তায় আবার ও শুনেছে ওর পূর্বপুরুষ কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে কিন্তু পেশা ছাড়েনি। আফিয়াকে এটাই বলেছে সে, কী করে সম্ভব। আফিয়া তখন কিচ্ছু শুনতে রাজি হয়নি। ছালু মিয়ার সাথে গাছতলায় থাকবে সে। লবণ ভাত খাবে। ছালু মিয়া বিশ্বাস করেছিলো। নিজের অন্ধ প্রেমকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো। অথচ এই গাছতলায় থাকা, লবণ ভাত খাওয়া যে কেবল কথার কথা বুঝতে তার সময় লাগেনি দুই মাস। মোহের জাল বাস্তবের রুক্ষ পাথরে মিইয়ে যাবার পর  আফিয়া হয়তো ফিরেই যেতো। কিন্তু পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।সবার কথায় আলোচনায় ব্যবহারে  তার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল ঢাক বাজানো ছেড়ে যদি অন্য পেশা নেয় ছালু মিয়া, ধর্মে কর্মে মতি ফেরে তবে হয়তো তাঁকে মেনে নিবে ভদ্র সমাজ।

ইট পাথর সুড়কিতে যখন সুসজ্জিত দালান  উঠতে থাকলো,দেয়ালে বাহারি নকশার টাইলস বসে জ্বলজ্বল ঔজ্জ্বল্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো ঢাকী গ্রামটির মলিন জীবন, আফিয়ার মনে তখন বিশ্বাস সত্য হওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো। ততোদিনে ঢাকী পাড়ায় আফিয়ার সতেরটি বছর পার হয়েছে। তিন তিনটি সন্তান বড় মেয়েটারও ষোল বছরের শরীরে যেনো কুড়ি বাইশের ঢলঢ্লানি। আফিয়া তাকিয়ে দেখে ওর মা খালাদের গড়ন মেয়েটার, এ পাড়ায় বড়োই বেমানান। কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি কম ঢ্যাঙা মেয়েটা তখনো এক্কাদোক্কা খেলে। মনের ভেতরে দশ বছরের বালিকা। 

আলী লন্ডনীর ছোট ছেলে তখন ঘনঘন এলাকায় আসে। নামাজের ঘর বানানোর তদারকি করে। আর সন্ধ্যায় পিডিবির লাইন থেকে  তার এনে বাঁশের মাচায় বেঁধে আলো জ্বালায়। সে আলোতে তফসির করে,এই দুনিয়াদারি দুদিনের ঝকমারি। আসল জীবন পরকালে। সেই আসল জীবনের জন্য আমল জমাও মিয়ারা। সময় থাকতে দীনের পথে আসো। বড় দয়ার শরীর তার। দালানের কাজ করতে করতে আফিয়ার এই মেয়েটিকে মনে ধরে গিয়েছিলো রাজমিস্ত্রি কুদ্দুসের। হয়তো প্রকাশও করেছিলো আলী লন্ডনীর ছেলের কাছে।  নিজ খরচে রাজমিস্ত্রি কুদ্দুসের সাথে নিকাহ পড়িয়ে দিয়েছিলো ছালু মিয়ার কইন্যার। ছালু মিয়াকে বুঝিয়েছিলো, সময় থাকতে পুরুষের হাতে না দিলে মেয়ে মানুষ রাস্তার গাছে ঝুলে থাকা আমের মতো হয়ে যায়। আসতে যেতে সব পথচারী ঢিল দেয়। মেয়ে তার ঢ্যাঙা, বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। সমবয়সীদের সাথে এক্কাদোক্কা খেলে। সংসারের স ও যে বুঝেনা তাকে সংসারের কারাগারে বন্দি করে দিতে ভেতরটা অক্ষম যন্ত্রণায় টনটন করছিলো ছালু মিয়ার। কিন্তু আফিয়ার তীব্র সম্মতিতে পলিথিনের ফেলনা ব্যাগের মত উড়ে যায় তার আপত্তি।

প্রতিদিন ঢাকী পাড়ার কেউ না কেউ তওবা করে ফিরে আসে। ঘরের ঢাক ভেঙে কাছের পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের পেশা অস্বীকার করে। পরদিন অনভ্যস্ত হাতে অন্য জীবিকার সন্ধানে যায়।

শুধু ছালু মিয়া পারেনা। বাপ মালু মিয়া পাঁচ গাঁয়ের বিখ্যাত ঢাকী।  আশেপাশে এমন কোন হিন্দু পরিবার নেই নাতি পুতি সহ কয়েক প্রজন্মের বিয়েশাদি মালু মিয়ার ঢাক ছাড়া হয়েছে। ছয় ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে ছালুকেই সে ঢাক ঢক্কি বুঝিয়ে দিয়ে গেছে মৃত্যুর আগে। তার বিশ্বাস ছিলো একমাত্র ছালুই পারবে বাপের নাম রাখতে। ছালু ছোট থেকেই সাথে সাথে থাকতো বাপের। কাছের শহরতলি থেকে দূর দূরান্তের গ্রাম বায়না পেলেই সাথে নিতো ছালুকে। সাথে যেতে যেতে কেবল বাপ নয় বাপের পেশাটাকেও ভালোবেসে ফেলেছে সে। কিন্তু আফিয়ার নিত্য এক ঘ্যানঘ্যান। এই কাম ছাড়েন। আফিয়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এক গভীর রাতে সবাইকে ঘুমে রেখে আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দিয়ে একেবারেই অবিমৃষ্যকারীর মতো গ্রাম ছাড়ে সে। নওল কিশোরের মতো অভিমানী মনে ভাবে, একদিন এই ঢাক বাজিয়েই দেখিয়ে দেবে সে। ঢাকটা সঙ্গে নিতে ভুলেনা। এটি দিয়েই আফিয়াকে বুঝিয়ে দেবে তার দিন ফুরিয়ে যায়নি।

এমনিতেই অভাবের সংসার পাড়ার তাদের। তবু নিজস্ব পেশা ছিলো যখন ব্যাটাছেলেরা ঘর সংসারেই থাকতো। বায়না থাকলে কাজে যেতো, না থাকলে সবাই উঠানে বসে মিলেমিশে চর্চা করতো। শানাই ধরতো ঐ ঘরের দিদার, মঙ্গল দীপ জ্বেলে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু। বাঁশিতে সুর তুলতো নেহার, দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না... হয়তো পেটে ভাত নাই। তবু খোলা উঠানে বসে সবার এই  যুথবদ্ধ চর্চা মন ভরিয়ে দিতো। এই সুরে এই ঢুম ঢুম ঢুম ঢ্রিম, ঢুম ঢুম ঢ্রিম, ঢুম ঢুম ঢ্রিম আওয়াজের রেশে অনটনের জীবনেও একটা উৎসবের সুর বাজতো। এখন কিছুই নেই।

 সবাই পেশা ছেড়ে দিয়ে নানা জীবিকা খুঁজে নেয়ার চেষ্টায় আছে। ঢাক বাজানো ছাড়া অন্য কোন কাজ জানেনা। ফলে আধখেঁচড়া পেশায় সেই অভাব আরও পোক্ত হয়েছে তাদের জীবনে। উৎসবের রং লাগা তাল লয় সুরও হারিয়ে গেছে। 

অথচ এই আকালে আফিয়া বিবির মেয়ে জামাই কুদ্দুস ব্যাগ ভর্তি চাল ডাল আলু মুলা নিয়ে দাওয়ায় উঠে এলে  আফিয়া বিবির রাজকপাল নিয়ে পাড়ায় চলমান বিস্তর গবেষণা আরো জমে উঠে। এর ঘরের বউ আড়চোখ গোপন করে ওর ঘরে যায়। পান সুপারি আর তামাক পাতার আপ্যায়নে  চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওরা আফিয়া বিবির বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। দূরে কোথাও একটা কানাকুয়ো ডাকে। অমঙ্গল পাড়াটাকে যেন আর ছাড়ে না।   

ছালু মিয়া যেমন ভেবেছিল তেমন আর হয়না। এ শহর সে শহর ঘুরে বেড়ায় সে। দল তৈরির চেষ্টা করে। হয়না। কোথাও আর গান বাজনা নেই। যাত্রা, পালাগানের দল নেই।যাও বা মন্দিরে মন্দিরে কীর্তনীয়া দল আছে তারা মুসলমান ছালু মিয়াকে দলে ভিড়তে দেয়না। কয়েকজন দলনেতার সাথে আলাপ করে একই উত্তর পেয়ে বড় পরিচয় হীন বিপন্ন লাগে নিজেকে। হায় বাজনাদার জীবনহিন্দুরা দলে নেয়না ধর্মের কারণে। নিজের ধর্মেও ঠাঁই মিলেনা।

চৌদ্দ বছর বয়সে আফিয়া বিবি যখন এই পাড়ায় বউ হয়ে আসে তখন পাড়ার মুরুব্বি মালু মিয়ার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তার ছয় ছেলের নাতি পুতিদের পনের ষোল টা ঘর পাড়ায়। ছোট ছেলের বউ আফিয়া। বিয়ে হওয়া নাগাদ সে জেনেছে এই পুরা ময়াল আলী লন্ডনীর। বেদখল যেনো না হয় সেজন্য উদ্বাস্ত মালু মিয়াকে ঘর বানিয়ে থাকতে দিয়েছে এখানে।  পুকুর কেটে, ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে মালু মিয়ার পরিবার পরিজন দের নানান সুবিধা করে দিয়ে গেছে সে।  

শোনা কথা মাঝে মাঝে শ্বশুরের কাছে ঝালিয়ে নিতো আফিয়া, আব্বাজান মাইনষে যে কয় আপ্নেরা আগে হিন্দু আছিলেন।

মালু মিয়া অস্বীকার করেনা। হিন্দু বিয়ে বাড়িতে বাজনা বাজানো পেশা ছিলো তার বাবার। কিন্তু নিশিচাঁন বিবিকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছিলো সে। অনেকদিন  হিন্দু  বিয়েশাদিতে ডাকতো না তাকে। আয় রোজগার নেই, থাকার জায়গা নেই। আলী লন্ডনীর সাথে একদিন দেখা হয়েছিলো বাজারে চালের আড়তে। তার প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিলো মালু মিয়ার বাবা। নতুন এলাকায় কেউ হয়তো ব্যাপারটা জানবে না। পুরানো পেশায় ফিরে যেতে পারবে সে। গিয়েওছিলো। নিজে তো নিজে বংশানুক্রমে  ছেলেপুলে নাতি গুলোও এই ঢোল বাজানো ছাড়া শিখেনি তেমন কিছু। অথচ ততোদিনে  বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রাদলে ডাক পড়াও। বন্ধ হয়ে গেছে অন্য অনেক পথ ঘাট।  তাদের ঘরে ঘরে তখন  অভাবের স্থায়ী বাস। 

ততোদিনে আলী লন্ডনী আর মালু মিয়ার বাপ দুজনের কেউই আর নাই। আলী লন্ডনীর ছেলে এসে মসজিদ তুলে। ঘনঘন পাড়ায় এসে এসব হারাম কাজ না করার পরামর্শ দেয়।  পুকুরে বৌ ঝিদের গোসলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাস্তার পাশে উঠতি মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলা বন্ধ হয়। এরা অখুশি হয়না। সম্ভ্রমের এই নিষিদ্ধতার তাদের যেন সম্ভ্রান্ততায় ফিরিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখায়।

 পুরুষ কুলের জীবিকাহীন জীবনে নিত্য অনটনের জীবনে তাদের বাঁচিয়ে রাখে অচ্ছুত জীবনের অভিশাপ বিমুক্ত হওয়ার নেশা।কোন কোন বেলায় চুলায় ভাত চড়েনা, পুকুর পাড় খুঁজে তুলে আনা শাকপাতা সেদ্ধ করে খায় তবু কেউ মুখ ফুটে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেনা। ঘর থেকে বের হলেই এদের এই না জায়েজ পেশা নিয়ে কী বিড়ম্বনার জীবন এদের। এবার যদি মুক্তি মেলে। সবচেয়ে বিপদে পড়ে ঘরের বউরা। না পারে স্বামীদের এই না জায়েজ কাজে উৎসাহ দিতে না পারে সন্তানদের দিনমান না খাওয়া শুকানো মুখ দেখতে।

প্রয়োজন নানা পথ খুলে দেয়, গোপন কিংবা প্রকাশ্য। এদের কেউ কেউ শহরের বাড়িতে বাড়িতে আয়ার কাজ নেয়। ভোরে ভোরে পথ দেয় আর মাগরিবের আগে আগে ফিরে আসে।  ঝি চাকরানির কাজ করেও যখন তাদের দুবেলা পেটের নিশ্চয়তা জুটে না তখন সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আফিয়ার মেয়ে জামাই কুদ্দুসের উপর। একখান জামাই পেয়েছে বটে আফিয়া। মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই ঢ্যাঙা। অথচ জামাইটা কি ভালো মানুষ। প্রায় প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি করে বাজার দিয়ে যায় শাশুড়ির সংসারে। 

গত কয় বছরে এবারই দেদার রোজগার হয় ছালু মিয়ার। প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠান আর র‍্যালি।  আজ এর তো কাল ওর। প্রতিদিন বায়না। নানা জায়গা থেকে নানাজন এসে জুটে যায়। কেউ শানাই, কেউ বাঁশি। দেখতে দেখতে দেশটা স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলো। ছালু মিয়ার অস্পষ্ট মনে পড়ে যুদ্ধের সময় মালু মিয়ার হাত ধরে চা বাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলো সে। বাপ মালু মিয়া সেদিনও আর কিছু নয় ঢাকটাই সঙ্গে নিয়েছিলো।  

টাকাগুলো একসাথে করে অনেক টাকা হয়। প্রানভরে বাজার করে সে। তিন কেজি ওজনের বড় একটা  কাতলা মাছ, এক কেজি গরুর মাংস, জেতা কই মাছভালো করে দেখে নিয়েছে চাষের মাছ নাকি গাঙের। বেকারির বিস্কুট চানাচুর। একটা কেইক, দুই লিটারের ঠাণ্ডা। পোলাওয়ের চাল। যা পড়েছে চোখের সামনে। তার কল্পনারা যেন অপেক্ষা করতে পারেনা। এতোদিন খোঁজ খবর না রাখার জন্য আফিয়া হয়তো প্রথমটায় খুব রাগ দেখাবে, কিন্তু ছালু মিয়া জানে আফিয়া তারে কতোটা ভালোবাসে। বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতেই পারবে না। কাল সকালে উঠেই মেয়েটাকে নাইওর নিয়ে আসবে সে।    

গভীর রাতে কুদ্দুসকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফেরার সময় মোবাইল ফোনের টর্চে মালু মিয়ার ছোট ছেলে ছালু মিয়াকে বিভ্রান্তের মতো দাওয়ায় বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে আফিয়া। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ব্যাটা মানুষ নিরুদ্দেশ হইতে পারে, মাইয়া মানুষ পারে না। পেডের সন্তানরে খাওয়াইয়া বাঁচাইবার দায় মাইয়া মানুষ এড়াইতে পারে না। 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment