Runa Bandyopadhyay

যুগলবন্দীঃ কবিতা না ছবিতা

 

বহির্জগৎ আমাদের হৃদয়বৃত্তির রূপে রসে রঙে স্পন্দিত হয়ে অন্তরমহলে যে অপরূপ মানসজগৎ গড়ে তোলে তার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে আমাদের বিস্ময়, প্রেম আর কল্পনা। আমাদের সুখ দুঃখ, ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, ভয় ও আনন্দের রাগিণীতে বাজতে থাকে চিত্তবীণা। যখন সেই অন্তরবাসী অব্যক্ত ব্যথাটি নিজেকে ব্যক্ত করতে চায়, তখনই সেই সামান্য আমিটি হয়ে ওঠে কবি, শিল্পী বা আলোকচিত্রী। কিন্তু অন্তরের এই অপরূপ রাগিণীটিকে রূপের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে গেলে বচনকে যেতে হয় অনির্বচনীয়তায়, ভাষাকে ভাষাতীতে, চিত্রকে কল্পচিত্রে।

তো এই চিত্র হ’ল গতিশীল চায়ীর তারণ বর্ত্তমান থাকে যাতে, picture বা image অর্থে প্রচলিত। অস্তিত্ব থেকে চয়নেচ্ছা বেরিয়ে যাত্রা করেছে বস্তু বা বিষয়ের দিকে, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে না, মাঝপথে আশ্রয় নেয় কাম্য বস্তু ও বিষয়ের চিত্রে, যা এক অদ্ভুত, অপূর্ব, আশ্চর্যজনক, উজ্জ্বল উদ্ভাস। এই চিত্র বা ইমেজ, তা কবির কবিতা হোক বা ফটোগ্রাফারের আলোকচিত্র হোক, বিশ্বরূপের ছন্দে ঝংকৃত হৃদয়বীণার স্পন্দিত আবেগ─ যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আইরিশ-ব্রিটিশ কবি ও ঔপন্যাসিক সিসিল দ্যে লুইসের কবিতার চিত্র সংজ্ঞায়নে, “a poetic image is a word picture charged with emotion or passion.”1

চিত্র, যা প্রথমত চোখের দর্শনজাত, তা কবি বা আলোকচিত্রীর কল্পনা স্বপ্ন আর জীবন সম্পর্কে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ফিল্টারে পরিবর্তীত হতে হতে, মিডিয়ার অস্বচ্ছ ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে পরিণত হয় বিমূর্ত ভাবনায়। এই কল্পনা শব্দটি ‘কল্প’ শব্দজাত, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হ’ল করণের গতিবিধি পালিত হয় যাতে। অর্থাৎ যে কর্ম সামগ্রিকভাবে মনে মনে কল্পনা করা হয়। এই কল্পের বিন্দু রূপ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত অসংখ্য রূপ। আর এই কল্প on থাকে যাতে, সেই হ’ল কল্পনা। প্রাচীন ভাষাবিদগণ ভবিষ্যৎ ভাবনার মূলত দুটো ভাগ করেছিলেন─ কল্পনা ও স্বপ্ন। কল্পনা দুরকম─ কল্পনা ও জল্পনা। কল্পিত ব্যাপারে যে চিত্র আঁকা হয়, তাই চিত্রকল্প আর জল্পিত ব্যাপারের চিত্র হ’ল চিত্রজল্প। বাংলা ভাষাতত্ত্বের মহান দার্শনিক কলিম খানের মতে2, বাস্তবায়িত করার জন্য হিসেবি কল্পনার ওপর ভিত্তি করা চিত্রই হ’ল চিত্রকল্প আর সৃজনশীল ভাবনার বিকাশের জন্য হিসেবি বেহিসেবি, যৌক্তিক অযৌক্তিক মিশিয়ে কথায় রঙে রেখায় যে চিত্র, সেই হ’ল চিত্রজল্প, যাকে নতুন কবিতার কবি বলেন কল্পচিত্র। এ হ’ল চিত্রকল্প পেরিয়ে আর এক imagery-র কথা─ চিত্রকল্প স্বীকার করে চিত্রের অস্তিত্ব এবং তারই সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণে গড়ে ওঠে ভাষার এক নতুন অবস্থান। কল্পচিত্রে চিত্রটির অস্তিত্ব নেই। বিস্তৃত কল্পনায় প্রসারিত চেতনায় কবি যে সম্ভাবনাময় চিত্রের আশ্রয় নেন, সেখানে উপলব্ধির multidimension; সংবেদনে, আবেগে, বিষয়বস্তুর বন্ধনীহীন সেন্সেশনে রূপ পেরিয়ে অপরূপের সন্ধান করে, উত্তীর্ণ হয় এক গূঢ়তর ব্যঞ্জনায়, যেমন বলেছিলেন বিশ্ববন্দিত মার্কিন আলোকচিত্রী অ্যানসেল অ্যাডাম, “A great photograph is a full expression of what one feels about what is being photographed in the deepest sense, and is, thereby, a true expression of what one feels about life in its entirety.”3 ফটোগ্র্যাফিক মিডিয়ামের ভাষায় আলোকচিত্রীর মুহূর্তের অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ দর্শক কবির চেতনায় মূর্ত হয়ে ওঠে রূপকল্পে, আর কবির শব্দনির্মাণ ও বিনির্মাণের ভেতর অর্জিত অভিজ্ঞতায় শুরু হয় এক মিথস্ক্রিয়া, চলে নিরন্তর পারস্পরিক খেলা, যা ব্যাকরণে বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানে না, শুধু তার খেলার নিয়মে চলে, যার আভাস দেয় অস্ট্রিয়ান-ব্রিটিশ দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের “language-game”4.

Poet and photographer
play an open-ended game
to place you in a multidimensional space
to explore the inner force of words
with multivectorial sense of the image.
It’s not facial but spatial art
to place you in the space-time of hyperreality
to bend you on a poedesic line
by the pull of gravity
of the their thoughts.

এমনই এক ফটোগ্রাফারের কথা বলতে বসেছি আজ─ আমাদের প্রিয় পাহাড়ু ওরফে প্রণব কুমার দে, যিনি আপন অনুভবের রঙে রঞ্জিত করেন তাঁর অসামান্য আলোকচিত্রগুলো, যেখানে আলো ও সময়কে নিয়ে তাঁর অনন্যসাধারণ অভিযান। তিনি কেবলমাত্র একজন দীক্ষিত পর্বতারোহীই নন, বরং জীবন বলো বা পাহাড় বলো, সবসময়ই অ্যাডভেঞ্চারিস্টের মতো নতুন দুর্গম প্রদেশ আবিষ্কারের নেশায় ও আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকেন। যেহেতু কবিও তাঁর কাব্যজগতে একজন অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, তাই আলোকচিত্রী ও তাঁর চিত্রের দর্শক কবি, এই দুজনের মধ্যে জারিত হয় এক অভ্যন্তরীণ রসায়ন, যা উসকে দেয় কবিতা ও আলোকচিত্রের এক ধারণামূলক বা conceptual ফিউশন। পরমাণু বিজ্ঞানের প্রচলিত ফিশনের ধারণা, যা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের বিভাজনের কথা বলে, তার বিপরীতে এই ফিউশন হ’ল এক মিলনগাথা, রঙের সঙ্গে শব্দের অন্তরধ্বনির ফিউশন, যার অনুরণন শোনা যায় প্রাচীন রোমান কবি হোরেসের “Ars Poetica”(The Art of Poetry)কবিতার সেই উচ্চারণে─“ut pictura poesis” (as is picture so is poetry)।

প্রণব কুমার দের চিত্র আলোর উদ্ভাসে রচিত মুহূর্তের এক সংকেত, যা দর্শক কবির ব্যক্তিহৃদয়ের মুহূর্তের আবেগকে ট্রিগার করে। এই মুহূর্ত যে সময়ের কথা বলে তা কোনো ঘড়ির সময় নয়, বরং এক মনস্তাত্ত্বিক সময়, যা এক নিমেষের বার্তা, মুহূর্তের গ্রন্থন। কালপরম্পরার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক সম্পূর্ণ আলোড়ন, যা এক গতিশীল সত্তার দিকনির্দেশ করে, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় সক্রেটিসপূর্ব গ্রীক দার্শনিক জেনোর প্যারাডক্সে─ what is in motion moves neither in the place it is nor in one in which it is not─ শুরুতেও নেই, মাঝেও নেই, শেষেও নেই; যার অন্তরমহলে বাজছে প্রাচ্যের দর্শন─ সেই ব্রহ্মা, সেই অন্তরতম সত্তা, সেই অনির্বচনীয় সমগ্র, বসত করে তার অংশগুলোতে, উত্তেজনার তীব্র মুহূর্তগুলোতে, যার সুর শোনা যায় মার্কিন কবি চার্লস বার্ন্সটাইনের কাব্যশৈলীতে─ “a poetics of temporal nowledge rather than atemporal knowledge.”5 সময় শুধু এই ‘now’-এর সমাবেশ আর এই মুহূর্তগুলো গ্রন্থন করে রচিত হয় বস্তুগত জগতের ঘটনাসমূহ, যা সমস্ত স্পেস-টাইম জুড়ে পাতা সুপারস্ট্রিং এর ক্ষণস্থায়ী স্পন্দনের প্যাটার্ন মাত্র, অবিরাম সীমাহীন রিদ্‌মে রত। আমরা এই রিদ্‌ম শুনি। আলোকচিত্রের ভিস্যুয়াল উপাদান দর্শক কবির চেতনায় যে শব্দগত ভাষার ভিত্তি রচনা করে, সেখানে কবিতা কোনো বার্তা পৌঁছোয় না বরং ভাষার নিজেরই মিডিয়ামের সঙ্গে আপনাকে নিযুক্ত করে, যাকে ভিটগেনস্টাইন তাঁর Philosophical investigations গ্রন্থে বলেছিলেন, “a particular act of gazing….turning my attention on to my own consciousness.” আলোকচিত্রের সেন্সেশন কবির নির্মিত কবিতার হৃদয়ে রেখে যায় এক অস্পষ্ট ছাপ, যা কোনো ছবির অর্থ নির্ণয় নয়, “But internal difference/When the Meanings, are”6 যেমন বলেছিলেন এমিলি ডিকিনসন। অর্থ অতিক্রম করে কবির অভিপ্রেত অন্য এক গূঢ় অর্থ যোগ করে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

কবিতা বর্তমান মুহূর্তের এক বাস্তবতার সংগীত, বেজে ওঠে পাঠকের চেতনায়, যেখানে সে বসত করে তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভাষা, ভালোবাসা ও হারানোর ব্যথা নিয়ে। ঠিক তেমনি আলোকচিত্রে গাঁথা মুহূর্তের অভিজ্ঞতাজাত সেন্সেশন স্পর্শ করে দর্শকের চেতনার পরিসর, যা কোনো থমকে থাকা পরিসর নয়, বরং এক চলমানতা, যেখানে বাজে ঐতরেয় উপনিষদের বাণী─ চরৈবতি চরৈবতি। শোনা যায় সেই মিথস্ক্রিয়ার স্পন্দন, সেই বাস্তব, যা পরিবর্তনীয়, যেখানে প্রতিমুহূর্তে খুলে যায় অনন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত। বিমূর্ততায় নির্মিত এ এক ব্যতিক্রমের বিজ্ঞান। আলোকচিত্রের সাথে দর্শক কবির চেতনার সক্রিয় অভিজ্ঞতায় যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়, তা মনের বিষয়, মানসিক এই পদ্ধতিই মননশীলতা। বাস্তবতার কোয়ার্ক ও অ্যান্টিকোয়ার্কের দোলাচলে, ভাষার অবিরাম সম্মেলনে যেমন কবি ও পাঠকের মধ্যে রচিত হয় এক সম্পর্ক, তেমনি আলোকচিত্রী ও দর্শক কবির মধ্যেও বিরাজ করে এক আন্তঃসম্পর্ক, যেখানে প্রতিমুহূর্তে আবিষ্কৃত হয় অসীম স্পেস-টাইমে বস্তুর অবিরাম রূপান্তরে জীবন ও অস্তিত্ত্বের সঙ্গে বস্তুগত জগতের ডায়নামিক সম্পর্ক─

Your exploration with light and moment
infuse me to intensify conceptual fusion,
not to defuse but to perfuse my passion,
through every vein of the image,
shine with light to tune in to the sign of time.
It’s the science with the freedom of conscience,
not only to view but also to listen
to the magic of Himalaya’s melodic rhythm.
It’s the passion to voice the compassion,
not to define but to refine my inner soul.

একজন কবি তাঁর অনুভাবনার কেলাসিত রূপের প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করেন; চিহ্ন ও চিহ্নিতের যোগে চিহ্নকটিকে উচ্চারণ করেন, যার শব্দগত উপাদান পাঠককে নিয়ে যায় এক সংবেদনশীল বিজড়নে, ট্রিগার করে পাঠকের Imagination. ঠিক তেমনি, প্রণব কুমার দের আলোকচিত্রের ভিস্যুয়াল উপাদান ও বহুমাত্রিক শব্দহীন স্বরের অভিজ্ঞতা আমার দর্শকসত্তায় সৃষ্টি করে চলে অবিরাম চলন্ত কাল্পনিক অভিজ্ঞতার বিদ্যুৎ ঝঞ্জা, বেজে ওঠে চিত্রধ্বনির সংবেদন, যেখানে হঠাৎই অনুভূত হয় স্পার্ক, যাকে বারীন ঘোষাল চিহ্নিত করেছিলেন SPARK–– Spontaneous Power Activated Resonance Kinetics7 এই আলোকিত মুহূর্তের অভিজ্ঞতাটির উৎসরেখা ধরে ছড়িয়ে দিই অজাত শব্দবীজ। জল দিই, সার দিই, কর্ষণযোগ্য মাটিও। একদিন সেই বীজ ভেঙে জন্ম নেয় শব্দ, নির্মিত হয় কবিতা ও আলোকচিত্রের মধ্যে এক অনুভবের সেতু, চিত্রের নির্বাক অন্তরাত্মা কথা কয়ে ওঠে শব্দের ঝলকে, যার ভাষাকে বলা যায় অভ্যন্তরীণ ভাষা বা Internalized Language. কবির কম্পাঙ্কে অনুরণিত পাঠক যেমন শুরু করে তার নিজস্ব নির্মাণ, তেমনি প্রণব কুমার দের আলোকচিত্র থেকে শুরু হয় আমার দর্শক সত্তার নিজস্ব নির্মাণ। এই নিজ-র স্ব─ আমার অস্তিত্বের বাহন, যেখানে নিহিত জনন। কবিগুরু যথার্থই উচ্চারণ করেছিলেন, নিজেরে হারায়ে খুঁজি তোমারই নয়নমাঝে। কবি ও পাঠকের মিলনবিন্দুটি যে অনুভব, সে কথা শুনিয়েছিলেন সুদূর অষ্টাদশ শতকের কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ─ “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquillity”8─ তেমনি আলোকচিত্রের মুহূর্তজাত রিদ্‌মে স্পন্দিত হয় দর্শক কবির চিন্তাতরঙ্গ। কবির কাল্পনিক অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ যেমন পাঠকের চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠলে কবি-কবিতা-পাঠকের ত্রিভূজটি সম্পূর্ণতা পায়, তেমনি আলোকচিত্রী-চিত্র-দর্শকের ত্রিভূজটির অন্তিম বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে দর্শক ‘আমি’। কবি ও আলোকচিত্রীর অন্তর্লীন মিথস্ক্রিয়া নির্মাণ করে কবিতা। এই সহাবস্থান একদিকে যেমন কবিকে আলোকচিত্রে ব্যবহৃত আলো, রঙ, রিফ্লেকশন ও তাদের কম্পোজিশনের কৌশলগুলোর গুরুত্ব ও পার্থক্যকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে, তেমনি কবির শব্দময় কবিতার নৈঃশব্দ্য আলোকচিত্রীকে শোনায় এক অন্য পৃথিবীর গান─

My silence asks who am I.
You voice my biography
with an oblique image
that nourish to flourish
the eyes of wisdom.
My existence asks where am I.
You capture the negative space
to write my positive geography
with your speechless perception.
My reality asks why am I.
Philosophy answers I think therefore I am,
but you freeze the moment
to say I cease to exist, therefore I am.

আলো ও রঙের পারস্পরিক প্রভাব এবং বৈপরীত্যের ভেতর কবিতা ও চিত্রের যে সমন্বয়ের লীলা চলে, সেখানে আলোকচিত্রীর ভ্রমণে চলা পা কবিকে নিয়ে যায় তার চেতনাভ্রমণে, বর্তমান সময়ের সীমাবদ্ধতা পেরোনো এক চলমানতায়। জানা অতীত ও অজানা ভবিষ্যতের মাঝখানে থাকে এক দরজা। বর্তমান হ’ল সেই দরজা, যে দরজা পেরিয়ে ভবিষ্যৎ চলে যায় অতীতে। কিন্তু এই দরজাটি নিষ্ক্রিয় নয়। এখানে ধুনন ক্রিয়াশীল। এই ক্রিয়া ভবিষ্যৎকে একটু একটু করে গ্রহণ করছে, তাকে ধুনছে আর অতীতের দিকে নিক্ষেপ করছে। এইমাত্র যাকে নিক্ষেপ করা হ’ল, তাকেই কলিম খান বলছেন অধুনা। এই সময়ভাবনার প্রতিধ্বনি শোনা যায় অঁরি বার্গসনের Matter and Memory গ্রন্থে, “what I call ‘my present’ has one foot in my past and another in my future9. এই অধুনার স্পন্দনসিঁড়িতে সংকেত রেখে যায় প্রণব কুমার দের চিত্র, যা নতুন কবিতার কবিকে উসকে দেয় তার নতুন নির্মাণে। ভ্রমণপিয়াসী প্রণব তাঁর আলোকচিত্রের দর্শকের জন্য তৈরি করেন সেই উন্মুক্ত স্পেস, যেখানে দর্শকের মানসভ্রমণ, যেখানে মেলে তার নিজস্ব কল্পনার জগতে ভ্রমণের ছাড়পত্র, যা নিয়ে দর্শক কবি এক মহাজাগতিক আলোর ভ্রমণে লিপিত করে তার আপনলোকের কেলাসিত দিনলিপি। দর্শক কবির এই চেতনাভ্রমণে রঙের সঙ্গে শব্দের অন্তরধ্বনির ফিউশনে গড়ে ওঠে এক ডিসটোপিয়ান সময়ের ভার্সাবলী10, যা মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের বিরোধভাবনা পেরিয়ে পরিপূরকতাবোধের কথা বলে, ভালোবাসার স্বপ্ন দেখায়, বেঁচে থাকার গল্প বলে─

Picture speaks the presence
in its absence,
not the time but the moment,
to render a relational-angle
between you and me.
We share our sorrow
to sing the cosine of the angle.
We bare our pain
to pulse the creative impulse
with sine of the angle.

প্রাচীন ঋষি উচ্চারণ করেছিলেন, ওঁ তৎসৎ─ তৎ-ই সত্য, বস্তুর অভ্যন্তরস্থ চলমান সত্তা বা সত্তার সূক্ষ্ম রূপ, যা দৃশ্য নয় অথচ সক্রিয় ও উপলব্ধ, যার বহিরঙ্গটি সাময়িক রূপ মাত্র। বস্তুর ভিতরের সেই সত্তা─ সেই তৎ─ প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় “পুরুষ”─ ইংরিজিতে content─ যে সত্তা অধ্যায় থেকে অধ্যায়ে, বস্তু থেকে বস্তুতে উত্তীর্ণ হয়, নিজের স্বভাব ক্রমান্বয়ে বদলায়, রূপ থেকে রূপে, দেহ থেকে দেহে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। ফলত বিমূর্ততা ছাড়া বস্তুকে চিহ্নিত করার কোনো উপায় নেই। কোনো দৃশ্য বা ঘটনার বাস্তবতার অস্তিত্ব কবি, শিল্পী বা আলোকচিত্রীর নৈতিক ধারণা, সামাজিক ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রচলিত ভাষার ওপর নির্ভরশীল; আর সেই প্রচলিত ভাষাকে পেরিয়ে প্রতিমুহূর্তের বহির্মুখী জীবনজাত মূর্ত অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপায়ণ করেন আপন সৃষ্টিতে। শিল্পী মাত্রই জানেন reality নকল করা যায় না। তাই চোখের দর্শন পেরিয়ে, বাস্তবতার কালচক্র পেরিয়ে তাঁদের প্রসারিত চেতনায় প্রতিফলিত বাস্তবতা সৃষ্টি করে চলে hyperreality─

I wonder whether beauty is truth

or truth’s smile, but surely
it’s omnipresent.
Photographer listen to the
rhythm of beauty, buzzing everywhere.
Poet discovers the illusion,
woven into the warp and woof
of light and dark.
Rhythmic oscillations
between hope and despair
acknowledge the paradox of hyperreality
to personalize its impersonal beauty.
————

যে আলোকচিত্রের অন্তরভ্রমণে আমার এই মানসভ্রমণ তার রচয়িতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়─
প্রণব কুমার দে :
প্রণব কুমার দে এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা জামশেদপুরের ইস্পাত নগরীতে। কর্মজীবনে Social Responsibility Missions of Tata Motors-এর সম্মানজনক পদাধিকারী ছিলেন। মাউন্টেনিয়ারিঙ ইন্সটিটিউট থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রণব কুমার একনিষ্ঠ পর্বতারোহী, অভিযান করেছেন হিমালয়ের দুর্গম প্রদেশ। খ্যাতিমান লেখক ও হিমালয়প্রেমিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য প্রণব কুমার নেতৃত্ব দিয়েছেন একাধিক ট্রেকদলের। তিনি কেবলমাত্র পর্বতারোহীই নন, বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। বন্ধুমহলে পাহাড়ু নামে পরিচিত প্রণব কুমার দে সদানন্দ মুক্তপুরুষ, কখনো একাকী বেরিয়ে পড়েন সুদূরের হাতছানিতে, আবার কখনো হিমালয়ের পথে কবিবন্ধুদের কবিতার ট্রেকিঙে পথপদর্শকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁর আলোকচিত্রের সম্ভারে ইংরেজি ভাষায় রচিত করেছেন সাড়াজাগানো দুটি গ্রন্থ─ প্রথমটি Kinnaur: A Pictorial Journey, প্রকাশক এখন বাংলা কবিতার কাগজ, ২০১৮ এবং দ্বিতীয়টি The Magical Five Oven, প্রকাশক প্রকৃতি ভালোপাহাড়, ২০১৯.

1The Poetic Image by Cecil Day Lewis, First published in 1947, 10th ed. A.W. Bain & Co Ltd, London, 1961
2কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান, ভাষাবিন্যাস প্রকাশনী, ২০০৯
3Essay “A Personal Credo” by Ansel Adams, American Annual of Photography, 1944.
4Wittgenstein, Ludwig. 1958. Philosophical investigations. ed. G. E. M. Anscombe, R. Rhees, G. H. Von Wright. Translated by G. E. M. Anscombe. Oxford: Basil Blackwell Ltd.
5Pitch of Poetry by Charles Bernstein, Chicago: University of Chicago Press, 2016.
6The Manuscript Books of Emily Dickinson, ed. R. W. Franklin, 2 vols. (Cambridge, MA: Harvard University Press, 1981)
7অতিচেতনার কথা─ বারীন ঘোষাল, কৌরব প্রকাশনী, ১৯৯৬
8“Preface to Lyrical Ballads” by William Wordsworth
9Matter and Memory by Henry Bergson, originally published in 1896 in French, translated by N.M. Paul and W.S. Palmer, published by New York: Zone Books, 1994.
10প্রবন্ধ সংগ্রহ, একশো সূর্যে─ স্বপন রায়, নতুন কবিতা প্রকাশনী, ২০০৯

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment