৩.
ট্রেন রাত এগারটা পঞ্চাশে। বসেই যেতে হবে। সিটিং রিজারভেশন পেয়েছে তারা। না, স্লিপিং বার্থ খালি নেই। ইন্ডিয়ার মতো ট্রেনের ব্যবস্থা নয় এদেশে। হাওর-বাওর, নদী-নালার দেশ, ট্রেন লাইন বসানই কষ্টের। বছর বছর বন্যা। লাইন ভেসে যায়, উপড়ে যায় বন্যার জলের তোড়ে। আর বাস কোম্পানির কলকাঠি। ট্রেন হলে বাস বসে যাবে। তাদের ট্রেনের নাম হাওর এক্সপ্রেস। ঢাকা থেকে নেত্রকোনা হয়ে মোহনগঞ্জ যাবে। মোহনগঞ্জে হাওর আছে মস্ত, তা পেরিয়ে গেলে অবিভক্ত সিলেট জেলা। সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ নিজেই এখন জেলা হয়ে গেছে। চন্দ্রকুমার বলেছে, সন্ধে থেকে একটু ঘুমিয়ে নিন দাদা, রাত্তিরে ঘুম হবে কি না বলা শক্ত। আর যত আপে যাবেন, আমার দেশের দিকে যাবেন, ঠান্ডা বাড়বে, উত্তরপুব দিক তো, জাড় আপনারে আষ্টেপিষ্টে চেপে ধরবে।
বিপুল ঘুমবে কি, উত্তেজনায় সে ছটফট করছে। অনিমেষ কি যাচ্ছে দুর্গাপুর ? না পেরে বিপুল ডাকল চন্দ্রকুমারকে, বলল, আমার কিছু কথা আছে।
কিছু কেন, অনেক কথা আছে স্যার। ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, অনেক কথা আছে বলেই আমি সুসঙ্গ করতিসি আপনার সাথে।
বিপুল বলল তখন সুধীন্দ্র সোমের কথা। সুধীন্দ্র আর কুমুদিনীর কথা। তাদের এক মাত্র পুত্র প্লাবনের কথা। কুমুদিনীর মৃত্যুর পর নিরুদ্দিষ্ট সুধীন্দ্রকে খুঁজতে তার নেত্রকোনা আসা। আর বলবে না বলবে না করে বলল অনিমেষের কথা। অনিমেষ সুধীন্দ্রর পুত্র প্লাবনের সহপাঠী। ক্ষমতার রাজনীতি করে। অনিমেষ কেন স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল সকালে? অনিমেষকে দেখে তার চিন্তা হয়েছে।
শুনতে শুনতে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, চিন্তার কারণ নাই স্যার, আপনি ভুল লোক দেখতি পারেন, হয়তো তিনি অনিমেষ না, এক রকম মানুষ অনেক হয়।
একটা সই দরকার হতে পারে সুধীন্দ্রর। না হলে ঐ বাড়ি ভাঙা যাবে না।
তিনি নিরুদ্দেশ হলে ? জিজ্ঞেস করল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার।
জানি না আইন কী বলে, কিন্তু মনে হয়, বছর বারো না হলে আইন বলবে না তিনি মৃত।
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, উনি কি সই নিবার লগে আসসেন এদেশে ?
বিপুল বলল, হতে পারে, না হলে কেন আসবে ?
উনি কি নেত্রকোনা হয়ে দুর্গাপুর যাবেন ?
মনে হয়, আমি ওকে বলেছিলাম সুধীন্দ্র সোম তাঁর পৈতৃক ভিটেয় চলে গেছেন।
আপনি কেন বলেসিলেন এ কথা ? ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
উনি বলেছিলেন এ জীবনে একবার অন্তত ফিরে যাবেন সোমেশ্বরী গাঙের পারে।
স্যার উনি যা লিখেসিলেন কুমুদিনী নিয়ে, সেই পাণ্ডুলিপি কোথায় ?
কুমুদিনী ওঁর স্ত্রীর নাম, বহেরাতলী বলে একটা গ্রামের পাশের গ্রামে তাঁর বাপের বাড়ি ছিল। বিপুল বলে, বহেরাতলী কি কুমুদিনী হাজঙের গ্রাম ?
জ্বি, আমি আপনারে নিয়ে যাব। বলল চন্দ্রকুমার।
সুধীন্দ্র কি আসতে পারবেন এই এতদূর এই পথে ?
জ্বি, উনি মেঘালয় থেকে আমাদের বাঘমারা বর্ডার দিয়ে নামতে পারেন বাংলাদেশে।
তাইই তো। এমন মনে হয়নি। প্লেনে শিলঙ পাহাড়ে গিয়ে গাড়িতে করে বাংলাদেশ বর্ডারে এসে ঢুকে পড়তে পারেন। বিপুল বলল, আমি সুধীন্দ্র সোমকে খুঁজতে এসেছি আর অনিমেষ যদি আসে, তাঁর স্বাক্ষর নিতে এসেছে, আপনাকে বললাম সব।
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, কিন্তু আমি চাই তাঁরে দিয়ে যদি মৈমনসিং গীতিকা নোতন করে লিখানো যায়।
মৈমনসিং জেলাই তো আর নেই।
না থাক, মৈমনশাহী পীরের দোয়া এই মাটির পরে আসে স্যার, এই মাটিতি কত কাহিনি, কত কিসসা, হাজঙ জাতির কত গীতিকা, তা কি লিখা হবেনি ? ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলে।
বিপুল বলে, আমি তো লিখতে পারিনে।
না পারেন, বলেন আমাদের কথা, শুনুন স্যার আমার আন্দাজ একটুও ভুল হয় না, আমি সেই কিসসা কুড়িয়ে আনতি ইন্ডিয়া গিয়েসিলাম, কিন্তু কিসুই পাইনি করতে করতে বিমান বন্দরে আপনারে পেয়ে গেসি, আপনি শুনে যান আমার দেশ গাঁর কথা, পীর মৈমন শাহীর দোয়ার কথা।
আমি এসেছিলাম এক কারণে, কিন্তু কারণ আসলে তা কি না বুঝতে পারছি না, আমার এখন মনে হচ্ছে সুধীন্দ্র যা লেখেননি, তা শুনতে এসেছি আমি, আমি যদি বাকিটা পারি। অদ্ভুত এক আবেগে বলল বিপুল, আমি কেমন লিখব জানি না, কিন্তু চন্দ্রকুমার যা কুড়িয়ে দেবে সোমেশ্বরীর কুল থেকে, তাই দিয়ে চেষ্টা করে যাব।
ইমতিয়াজ আলী বলল, আমি ইন্ডিয়া গিসিলাম বাণেশ্বর খবরিয়ার খবরে হাতিখেদা বিদ্রোহ, টঙ্ক আন্দোলন নিয়ে কিছু জুড়ার কথা বলতে, আমাদের মৈমনসিং জিলার কত কিসসা, কত কাহিনি, তা দশে জানুক, জানুক হাজংমাতা রাশিমনির কথা।
রাশিমণির কথা বলুন। বিপুল সোম বলল।
কুমুদিনীরে বাঁচাতে রাশিমণি সেপাইয়ের গুলিতে মরেছিল, দুর্গাপুরে তখন টঙ্ক আন্দোলন চলছে, মুর দাদাজি, সাফিন আলী খান, চন্দ্রধর, তিনি লিখেসিলেন।
লিখেছিলেন ?
হুঁ, লিখেছিলেন, মুর বংশ খবরিয়ার বংশ, মুর বংশের লোক লিখব ছাড়া কে লিখব বলুন ? ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল। আমাদের কাজ চাদ্দিকের ভালো মন্দ খবর খুঁজে বের করা। আমাদের কাজ যা কিছু হয়েছিল তার কথা মনে করিয়ে দেওয়া। বাণেশ্বর খবরিয়া খবর নিয়ে ঘুরত, আমি খবর ছাপি, আপনার কাছে কি তাঁর কোনো ছবি আছে ?
সুধীন্দ্রর ছবি ?
তাঁর ছবি দরকার, আমি আমার পত্রিকায় ছেপে দেব, লোকাল কেবলে দিয়ে দেব, খোঁজ নাই, খোঁজ চাই, শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রকুমার সোম।
ছবি কি আছে ? মোবাইল ঘাঁটতে থাকে বিপুল। পেয়ে গেল। সে তুলেছিল নতুন মোবাইলে। সুধীন্দ্র হাসপাতালে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। ছবিটি কুমুদিনীর মৃত্যুর আগের। একটাই ছবি। বিমর্ষতা দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু আচমকা ছবিও তুলে ফেলেছিল। কেন তা বলতে পারবে না। এমন হতে পারে, কুমুদিনী সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এলে ছবিটা সুধীন্দ্রকে দেখাত সে। আবার ভেবেছিল সুধীন্দ্রর পুত্র প্লাবনকে পাঠিয়ে দেবে হোয়াটস আপে। তার বাবা এখন মায়ের জন্য হাসপাতালে এমন নিরূপায় বসে থাকেন। কিন্তু পাঠান হয়নি। প্লাবনের হোয়াটস আপ নম্বর সে জানে না এখনো।
ছবিটি ব্লু টুথের মাধ্যমে চন্দ্রকুমারের কাছে পাঠিয়ে দিল বিপুল। তাইই তো করতে হবে। অত বড় জেলা নেত্রকোনা, কত গ্রাম, কোথায় গিয়ে উঠেছেন বৃদ্ধ তার ঠিক কী ? ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন করলে সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। রাত সোয়া এগার নাগাদ তারা স্টেশনে গেল। অনেক পুরোন একটা ষ্টেশন। অদ্ভুত এক বাজার যেন। স্টেশনের বাইরে রিকশা হকার, খাদ্য পানীয় সব মিলিয়ে গমগমে ভাব। ভিতরে ঢুকে দেখল ট্রেন ছাড়তে লেট হবে আধ ঘন্টা। মানে ১২টা ২০। তারিখ বদল হয়ে যাবে। হেসে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, আমার দেশের হাওর এক্সপ্রেস, রেলগাড়ি সবদিনই আজকের গাড়ি কালকে ছাড়ে। আগামীকাল ছাড়বে সুতরাং ঘন্টা খানেক বসতে হয়। ১২টা ২০ না হয়ে ১২টা ৩০ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অতএব ওয়েটিং রুমে বসতে হয়। শীত খুব বেশি। মোটা সোয়েটার মাফলার, মাঙ্কি ক্যাপেও শীত যাচ্ছে না। শাল গায়ে জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসল তারা পাশাপাশি। তার পাশে এক মহিলা দুইটি নাবালক সন্তান নিয়ে। দেখেই মনে হয় দুঃস্থ। বিপুলের সামনে টয়লেটের খোলা দরজা। ক্রমাগত ভিতরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে মানুষ। টয়লেট থেকে ভেসে আসছে কড়া অ্যামোনিয়া যুক্ত প্রস্রাবের কটু গন্ধ। জিনসের নিচে লম্বা ড্রয়ার থাকলেও পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এক হকার চটি ইসলামী কিতাব বিক্রি করছে। বেহেস্তের পথ, দোজখের আগুন, প্রশ্নোত্তরে ইসলাম, মৈমনসিঙের কিসসা । মৈমনসিঙের কিসসা বইটি হাত বাড়িয়ে নিল বিপুল। লেখক বাণেশ্বর গাজী। আলেয়া বুক হাউস, গেন্ডারিয়া, ঢাকা। চমকে উঠল সে। তার পাশের মহিলা প্রশ্নোত্তরে ইসলাম কিনেছে। তাকে বলল, আপনি কি হিঁদু নন ?
কেন বলুন দেখি ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
ইসলামের কিতাব কিনলে না আপনি।
এইটা কি হিন্দুর কিতাব ?
মাথা নাড়ে বছর তিরিশের মহিলা, বলল, না বটে, কিন্তু আপনি হিঁদুর কিতাবও কিনোনি, তবে কি কেরেস্তান ?
এইটা কি খ্রীস্টানের কিতাব ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
না, কেরেস্তানের কিতাব না, তবে কি আপনি বুদ্ধদেবের ধর্ম মানো ?
বিপুল জিজ্ঞেস করে, এইটা কি বৌদ্ধ ধর্মের কিতাব ?
সেই ময়লা চাদর মুড়ি দেওয়া মহিলা তার দুই সন্তানকে দুই ধারে ঘুমন্ত ধরে রেখে বলল, না, তা না।
তবে এইটা কী কিতাব ?
ধম্মোর কিতাব না। মহিলা বলে।
বিপুল হেসে বলল, গল্পের কিতাব।
কিসসা। মহিলা বলল, কিন্তু আপনি তাহলে কোন ধম্মোর লোক ?
বিপুল বলল, থাক না বোন।
আপনার কিসসা না পড়া ভালো। মহিলা বলল।
কেন, কিসসা না পড়ব কেন ?
মহিলা বলল, কিসসায় সব মিথ্যে কথা থাকে।
কী করে বুঝলে মিথ্যে ? বিপুল তার কথা বাড়িয়ে যায়।
বুঝা যায়, মিথ্যে শুনলিই আমি ধরতি পারি আসলডা কী ?
আসল না থেকে যদি সবটাই মিথ্যে হয় ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
আসল একটা থাকবেই, যারে কয় ফ্যাক্ট, তারে যতই তুমি যতই বাদ দেও, ফুটি ওঠবে।
তোমার নাম কী ? বিপুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বলে, তুমি অনেক জানো।
কিছুই জানিনে, আল্লা সব জানে, আমার নাম আয়না বিবি, আবার রাশিমণি খাতুনও, আয়না আমার বরের দিয়া নাম।
বাহ, কী সুন্দর দুটো নাম ! বিপুল বলল।
সোন্দরের কিসু নাই, আল্লার পিথিবীতে সবই সুন্দর, অসুন্দর কী আছে কন ?
বিপুল বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ ?
আমি যাব পূর্ব ধলা, কংস নদীর ধারের গেরাম, বাপের বাড়ি।
শ্বশুরবাড়ি কোথায় ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
গাজিপুর, সোয়ামী গেছে আরবে, ফেরতেসে না।
কথা হয় ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
দুমাস ফুন বন্ধ, তারে ফুনেও মিলসেনি। আয়না বিবি বলল, আল্লাহ ভরসা, এখন খুব অভাব যাচ্ছে, আমার ভাই আমারে যেতি বলেসে, সে ইমামতি করে, অন্তঃকরণ ভালো।
কী নাম ভাইয়ের ? জিজ্ঞেস করল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার ।
জ্বি, বদিউল ইসলাম।
ঢ্যাঙা মানুষ ? জিজ্ঞেস করে ইমতিয়াজ।
জ্বি, ঢ্যাঙা বলা যাবে না, গেঁড়াপানা।
ধলা না কালা ? জিজ্ঞেস করে ইমতিয়াজ।
ময়লা রঙ, সে আল্লা ছাড়া কিছু জানে, আল্লা ছাড়া তার জবান নাই।
কী কথা বলে ? জিজ্ঞেস করল চন্দ্রকুমার।
এই ধরো, আমাদের সৃষ্টিকর্তার নাম কি?
উত্তরঃ আল্লাহ্।
তখন জিগাবে, আল্লাহর কতগুলো নাম রয়েছে?
উত্তরঃ আল্লাহ তা’আলার নাম অসংখ্য-অগণিত।
তখন ফের জিগাবে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ কোথায় আছেন?
উত্তরঃ সপ্তাকাশের উপর আরশে।
প্রশ্নঃ আল্লাহর আরশ কোথায় আছে?
উত্তরঃ সাত আসমানের উপর।
প্রশ্নঃ আল্লাহ কি সর্বস্থানে বিরাজমান?
উত্তরঃ না। আল্লাহ্ সবজায়গায় নাই। তিনি সপ্তকাশের উপর তাঁর সিংহাসন।
বিপুল অবাক। মুখস্ত সব আয়না বিবির। বয়স বছর তিরিশ। মুখখানি সুগোল, চোখদুটি ছোট, বলছে, তার ভাই বদিউল যা জিজ্ঞেস করবে, উত্তর দিতিই হবে, সেই কারণে কিতাবখানা সে আবার কিনল, আগের কিতাবখান তার ননদ আয়েশা নে গেসে তার শ্বউরবাড়ি, সেখেনে তার সোয়ামী জিজ্ঞাস করে এইসব কথা।
বাণেশ্বর গাজীর বইটি খুলল বিপুল। বই দেখে চন্দ্রকুমার অবাক। বলল, এই বই কে দিল ?
কেন, কে দেবে, কিনেছি।
বাণেশ্বর গাজী কেডা ?
তা তো জানি না, তুমি জানতে পারো চন্দ্রকুমার।
চন্দ্রকুমার বলল, এই দেখুন স্যার, এতে কী লিখসে, লিখসে, হাতিখেদা বিদ্রোহ কী ?
প্রশ্নোত্তর ?
জ্বি, এই লিখেসে, টঙ্ক আন্দোলন কী ?
বাহ, আমার দরকার।
জ্বি, এই লিখেসে, মনি সিং কে ?
তখন আয়না বিবি বলল, কুমুদিনী হাজং আর রাশিমণি ?
আছে, সব আছে।
আয়না বিবি বলল, আমারে কিতাবটা দাও না দাদা, আমি পড়ব।
তুমি তো ইসলামী কিতাব পড়বে বলে কিনলে।
আমি এইডাও পড়ব দাদা, আমার খুব জানতি ইচ্ছে হয়। আয়না বিবি বলল, আমি কিসুই জানিনে।
তোমার ভাই যদি না বলে ?
লুকোয় রাখব, কিন্তু আমার জানা হয়ে যাবে তো, একবার পড়লিই মাথায় ঢুকি যাবে, ভোলব না।
বিপুল তখন চন্দ্রকুমারের কাছ থেকে বইটা নিয়ে আয়না বিবিকে দেয়। চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ বলে, এই সব কিসসাতে সেক্স থাকে, কিন্তু এ দেখি আলাদা, খবরিয়া বাণেশ্বরের নামে কেডা লিখল ? বিপুলকে জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার, সে কিতাবওয়ালা গেল কুথায় ?
বিপুল পুস্তকটি কিনে ব্যাগে ভরে আয়না বিবির সঙ্গে কথা বলছিল। আয়না বিবির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু এই বই কি তার জন্য নিয়ে এসেছিল কিতাবওয়ালা ? আর একটা দরকার নিজের জন্য। কিন্তু কিতাবওয়ালাকে আবার পাবে কোথায় ? সঠিক বই-ই কিনেছে সে। বিপুলের মনের ভাবটি আয়না বিবি বুঝে ফেলল, বলল, তুমি আবার পেয়ে যাবা, কিন্তু আমি পাতাম না, কবে সে লোক আরব থেকে আসবে, ফুন দিবে, তবে আমি ভাইয়ের হাত থেকে রিহাই পাব।
ট্রেন এল প্ল্যাটফর্মে। ঘোষণা হচ্ছিল। তারিখ বদলে গেছে আধ ঘন্টা আগে।
৪.
দু’সিটের সারিতে তারা দুজন বসেছে। ভোর চারটে কিংবা সাড়ে চারটেয় পৌঁছবে ট্রেন। গাড়ি ভর্তি নানা কিসিমের লোক। হকার। কিতাবওয়ালা নেই। সকলেই খাদ্যদ্রব্য আর পানিবোতল হাঁকছে। তার সঙ্গে নানা মানুষের নানা কন্ঠস্বর মিলেমিশে একটা হৌস তুলেছে যেন। গাড়ি ছাড়তে জানালা ঠেসে বসেছে বিপুল। ভাবছে একা সে কী করে যেত নেত্রকোনা ? ঠান্ডা বাড়ছে। রাতে ঘুম হবে কি হবে না সে জানে না। মোহনগঞ্জের দিকে হাওড় এক্সপ্রেস রওনা হলো লম্বা হুইসিল বাজিয়ে দুপাশের জনপদ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে, ঘুম ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে। গাড়ি কাঁপছিল কম নয়। চন্দ্রকুমার বলল, যখন নামবেন, খুব জাড়, সহ্য করা কঠিন, কিন্তু আমি অতীন স্যারকে খবর দিয়েসি।
অতীন স্যার কে ?
জ্বি, কলেজে পড়াতেন, খুব জ্ঞান আমাদের নেত্রকোনা জিলা নিয়ে, বলতি পারেন মৈমনসিং নিয়ে।
বিপুল জিজ্ঞেস করে, নেত্রকোনায় বাড়ি ?
জ্বি, ওঁর দাদা নীতিন স্যার আরো পন্ডিত মানুষ, এঁরা সব পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন, অতীন স্যার কোনোদিন ইন্ডিয়ায় যাননি, সেই যুদ্ধের সময় ছাড়া।
তাঁরা কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
জ্বি, তেনাদের মতো কেউ জানে না মৈমনসিং গীতিকা আর মৈমনসিঙের হাতিখেদা আন্দোলন, মণিসিং, টঙ্ক আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি……। বিড়বিড় করে বলতে থাকে চন্দ্রকুমার।
তাই, আমি এই সব জানব ?
জ্বি, জানবেন, জানতি এয়েসেন তো।
বিপুল বুঝতে পারে এই উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকটা, এই ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার খবরিয়া তাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সে এসেছে সুধীন্দ্র সোমকে খুঁজতে। কিন্তু তাকে হাতিখেদা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি, মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনাতে অতীন, নীতিন , দুই সরকারের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রকুমার।
সুধীন্দ্র সোমকে খুঁজতে এসেছি তো। বিপুল বলল।
জ্বি, তা আমি জানি, তিনি যে কিতাব লিখেসেন, তাও আমি জানি, কিন্তু তারে খুঁজতে হলে এসব জানা দরকার, না জানলে সেই সুধীন্দ্র সোমবাবুরে পাবেন কোথায় ? বলল চন্দ্রকুমার।
কথা বলছিল তারা। শীতের ছুরি প্রবেশ করছে জানালার ফাঁক দিয়ে। খুব করে নিজেকে মুড়ে নিল বিপুল। তাদের কথা কমে আসছিল। ঘুম এসে ভর করছিল দুচোখে। চন্দ্রকুমার বলল, ঘুমান স্যার, আমি নজর রাখি।
কিসে নজর রাখবেন ?
আপনার অনিমেষ, সে কি যাসসে আমাদের সঙ্গে ?
দেখিনি তো স্টেশনে।
আপনি ঘুমান, আমি নজর করে আসি, কামরাটা একবার টহল দেই। বলল চন্দ্রকুমার খবরিয়া।
তাকে চিনতে পারবেন ?
জ্বি পারব। বলল চন্দ্রকুমার খবরিয়া।
কী করে পারবেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
জ্বি, আপনারে যে ভাবে পেরিসি। বলল চন্দ্রকুমার।
চোখ বুঁজল বিপুল। শীতের ভিতরে চোখ জুড়িয়ে এল ধীরে ধীরে। ট্রেন চলছিল অন্ধকার চিরে। কতকাল কেটে গেছে দেশ দ্বিখন্ডিত হওয়ার পর, বহু বছর ধরে তারা ছিন্ন হয়ে আছে যে মাটি, যে নদী, যে বন-বনান্তর, গ্রাম-গ্রামান্তর, আলো বাতাস থেকে, তার দিকেই ছুটে যাচ্ছে হাওর এক্সপ্রেস। অন্ধকারে হাওর এক্সপ্রেস যেন ১৯৪৭-এর দিকে ছুটছিল। ৭০ বছর পিছনে। সময় ছুটছে অসময়ের দিকে। বিপুল এদিকের কিছুই জানে না। যেটুকু জানে তা অন্যের স্মৃতি। বাবার স্মৃতি, মায়ের স্মৃতি, সুধীন্দ্রর স্মৃতি, কুমুদিনীর স্মৃতি। তাদের স্মৃতি দিয়েই কল্পনা করে নিয়েছে নেত্রকোনা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর, গারো পাহাড় আর সোমেশ্বরী নদী। তার জন্ম ওপারে। পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই বঙ্গ অনেক অনেক দূর। হাওর-বাওর, প্রান্তর, তেপান্তর পেরিয়ে, অনেক অন্ধকার পেরিয়ে যেতে হয় সেই সময়ে। বিপুল মাথার ভিতরে গুমগুম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। খাল বিল পার হয়ে ছুটছে রেলগাড়ি। বিপুল ঘুমিয়ে গিয়েও জেগে উঠছিল, জেগে উঠেও ঘুমিয়ে পড়ছিল। ক্রমাগত এমনই চলছিল। তারপর এক সময় সে ডাক শোনে। তাকে ডাকছিল চন্দ্রকুমার। ঈশ্বরগঞ্জ এসে গেছে। এরপর নেত্রকোনা। ঈশ্বরগঞ্জে ট্রেন থেমেছিল। শীতের রাতের অন্ধকার ছেয়েছিল বাইরেটা। অনেক মানুষ নেমে গেল। আর চোখ বুঁজতে হবে না। এখন চারটে পাঁচ। সাড়ে চারটের ভিতরে তারা পৌঁছে যাবে নেত্রকোনা। তাইই হলো। নেত্রকোনা এল মিনিট কুড়ি পরে। বাইরে বেরিয়ে আসতে হিমশীতল এক অন্ধকারে পা রাখল তারা। অনন্ত এক অন্ধকার বাইরে। কনকনে বাতাস। প্ল্যাটফরমে পা দিয়ে বিপুল দেখল পুবের আকাশে একটি তারা। কিন্তু খুব আবছা। কুয়াশা নামছে শেষ রাতের পৃথিবীতে। ফোন বাজছে চন্দ্রকুমার খবরিয়ার। সে বলল, নেমেসি স্যার, আপনারা ইস্টিশনে এসেসেন ?
অতীন সরকার আর বিধান চন্দ এসেছিলেন স্টেশনে। নেত্রকোনায় আসছেন ইন্ডিয়া থেকে একজন। তিনি নেত্রকোনা হয়ে মৈমনসিংহ গীতিকার সন্ধানে সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাবেন। আর এক নিরুদিষ্ট মানুষের জন্যও তাঁর আসা। শুনে অতীন সরকার এই শীতের ভোরে ভারতীয় অতিথিকে স্বাগত জানাতে স্টেশনে। চাদরে মাথাটি মোড়া দুই জনের হাতে হাত মেলায় বিপুল। জাড়ে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হাত মেলাতে জীবিতের উষ্ণতা টের পায় বিপুল, বলল, এমন আবাহন দেখিনি জীবনে, এই ঠান্ডায় শেষ রাত্রে কেউ স্টেশনে আসে, চন্দ্রকুমার নিয়ে যেত, ও কি আপনাদের বাড়ি চেনে না ?
চেনে, কিন্তু আপনি অতিথি, এই দেশে ছিলেন আপনার পূর্বপুরুষ, স্টেশনে আসা কর্তব্য আমাদের।
এই শীতের রাতে ঘুম থেকে উঠে, আমি ভাবতে পারছি না।
অতীন বললেন, পরে ভাবলে হবে, আগে ঘরে চলুন, সব কথা হবে, কিন্তু হেঁটে যাওয়াই ভালো, রিকশা ঘুরে যাবে অনেক, হাঁটা পথই কম।
চন্দ্রকুমার বলল, হেঁটেই যাব স্যার, গা গরম হবে।
ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে টিমটিমে আলোয় অটো রিকশা, টুকটুকি গাড়ি, ট্রেকার এবং রিকশার গ্যাঞ্জাম দেখছিল সে। রিকশা হাঁকছে, দক্ষিণ পাড়া, কলেজ পাড়া। ট্রেকার হাঁকছে, পূর্বধলা, আটপাড়া, কেন্দুয়া…। তারা হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল, বিপুল জিজ্ঞেস করল, অনিমেষ কি এসেছে এই গাড়িতে ?
বুঝতে পারিনি স্যার, কাউর মুখ দেখার উপায় নাই, সবাই মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছিল। বলল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার।
কী মনে করে অতীন সরকার বলল, আপনার চিন্তা নেই, আপনি চন্দ্রকুমারের সঙ্গে সরকারবাড়ি এয়েসেন।
অভিভূত বিপুল বলল, আমার মনে হচ্ছে আমার পূর্বপুরুষ কেউ এসেছেন এই অন্ধকারে এই প্রবল শীতে আমাকে নিয়ে যেতে।
অতীন সরকার বললেন, এই অনুভূতিটা ভালো, আমার গায়েই কাঁটা দিচ্ছে, আপনারা কবে চলে গেসেন ?
আমার তো ওপারে জন্ম নাইনটিন ফিফটি থ্রিতে।
জানেন না কবে গিইসিলেন আপনার বাপ-ঠাকুরদা ?
এবড়ো খেবড়ো উচ্চাবচ রাস্তা। টর্চ জ্বেলে তাদের পথ দেখাচ্ছে বিধান চন্দ। অতীনের কথায় বিপুল বলল, মনে হয় পারটিশনের সময়।
ফরটি সেভেনে ?
তাইই তো হবে। বিপুল বলল, আগে পরে, অনেকদিন ধরে পাকিস্তান হবে হবে করছিল তো।
তাহলে তো টঙ্ক বিদ্রোহ দেখে গেসেন তাঁরা ?
বিপুল বলল, হতে পারে।
কুমুদিনী হাজং আর রাশিমণি হাজং না জানা নয়।
সত্যি বলতে আমি অল্প শুনেছি, বেশি শুনেছি মৈমনসিংহ গীতিকার কথা, বাবা পড়ে শোনাতেন।
হুঁ, তার ভিতরে হারিয়ে গেল রাশিমণির কথা, হাজংদের হাতিখেদা বিদ্রোহের কথা, গারো পাহাড়ের কথা। বিড়বিড় করে বললেন অতীন, এই মাটির অনেক কাহিনি।
বিপুল জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে গারো পাহাড় দেখা যায় ?
না, দুর্গাপুরে গিয়ে দেখতে পাবেন। বিধান চন্দ জবাব দিলেন।
অতীন নীতিন দুই ভাই এই প্রাচীন নগরের সুখ্যাত মানুষ। নীতিনের খ্যাতি নগর ছাড়িয়ে সমস্ত দেশে। তাঁর অনেক বই আছে। ‘পাকিস্তানের পতন অনিবার্য ছিল’ বইটি বাংলাদেশের জন্মকাহিনি রয়েছে। আর নেত্রকোনার ইতিহাস রচনা করেছেন নীতিন। দুই বাড়ি পাশাপাশি। অতীনের বাড়িতেই উঠল তারা। নীতিনের বয়স আশীর উপর। ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর কাছে যাওয়া হবে বেলা বাড়লে। বিধান বাড়ি ফিরে গেলেন। চন্দ্রকুমার, অতীন আর বিপুল মুখোমুখি বসেছে। বাড়িটি টানা একটি বারান্দাযুক্ত। সেই বারান্দার এক অংশে বসার জায়গা, কিন্তু বারান্দায় ঠান্ডা খুব। হিমেল বাতাস ঢুকছে ক্রমাগত। তাঁরা বসেছেন ভিতরে। অতীনের স্ত্রী সুরমা অতিথির জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাঁরা আলাপ করছিলেন। কী আশ্চর্য, অতীন নেত্রকোনা থেকে খুব দরকারে বাংলাদেশের এদিক ওদিক গেছেন, কিন্তু সেই ১৯৭১-র এপ্রিলের শেষে ছাড়া সীমান্ত পার হননি। ভারতে যাননি। দরকার পড়েনি তাই যাননি। তাঁর দুই পুত্র দুটি কলেজে পড়ায়। একজন ফরিদপুর, অন্যজন টাঙ্গাইল। ফরিদপুর পদ্মার ওপারে। পদ্মার ওপারই যেন বিদেশ মনে হয়, বলতে বলতে হা হা করে হাসতে লাগলেন অতীন। কেন যাননি, কলকাতা যেতে ইচ্ছে হয়নি ? একদম না। বাংলাদেশেরই কত জায়গায় যাইনি। কলকাতা গিয়ে কী হবে। আমি নিজের বাড়ি ছাড়া থাকতে পারি না।
দিদি আপনি ? জিজ্ঞেস করল বিপুল।
সুরমা বললেন, তাঁর ইচ্ছে যে হত না তা নয়, এক বোন থাকে কলকাতা, কিন্তু এক সঙ্গে বসবাস করতে করতে সে ইচ্ছে চলে গেছে। কলকাতা কেন মার্কিন মুলুক থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ এসেছিল, অতীন যাননি। যেহেতু এক জীবনে এত বড় ভূমন্ডলের কিছুই দেখা সম্ভব নয়, সুতরাং না দেখে তাঁর আফশোস নেই। সে দেশে অতীন নীতিনের অনেক ছাত্র। তারা কত ডেকেছে। তবে নীতিনের কন্যা থাকে প্রাগ শহরে। নীতিন প্রাগে যাননি। সে খুব শীতের দেশ। অত শীত সহ্য হবে না। সুরমা ধীরে ধীরে কথা বলেন। তাঁর ভিতরে এমন এক আভিজাত্য রয়েছে, যা চোখে না পড়ার নয়। বিপুল তার আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। সুধীন্দ্র সোম, দুর্গাপুরে আদি বাড়ি, ফিরে এসেছেন একা। তাঁকে খুঁজতে আসা। বিপুল সব কিছু পরিষ্কার করে দিল। সুধীন্দ্র নতুন মৈমনসিংহ কাহিনি। সে কাহিনি কমলা সায়র নিয়ে। হয়তো তাঁদের পূর্ব পুরুষের কেউ সেই গীতিকার রচয়িতা ছিল, যা সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। না হলে এত বয়সে সেই কাহিনি নতুন করে লিখতে যাবেন কেন সুধীন্দ্র, কুমুদিনী ? মূল গীতিকার সঙ্গে তার মিল আছে কম। এ একেবারে নতুন কাহিনি। শুনতে শুনতে অতীন বললেন, দাদার কাছে একজন এসেছিলেন মনে হয়, ইন্ডিয়ারই হবেন। তখন তিনি মৈমনসিং শহরে গিয়েছিলেন কদিন। সুরমার ভাইয়ের মেয়ের বিবাহ ছিল। সেটা কবে হবে ? এই অঘ্রানের আরম্ভে। মানে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। কে বলল, এসেছিলেন তিনি ?
কেন দাদাই বলেছে্ন। তিনি কদিন বাদে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। চন্দ্রকুমার তখন এ মুলুকে ছিল না। একজনকে সঙ্গে দিতে হয় তো বহেরাতলী গ্রামে নিয়ে যেতে। তিনি আর আসেননি। কোথায় গেলেন তা দাদার জানা থাকতে পারে। তিনি কলকাতা থেকে এসেছিলেন। কলকাতা থেকে বড় কেউ একটা আসেন না। যারা গেছে চিরতরে গেছে। তাই মনে আছে সব।
আপনি কলকাতায় যাননি, ভাবতেই আমার কেমন লাগছে। বিপুল বলে।
তিনি বললেন, কেন কলকাতায় যেতে হবে কেন, আপনি কি আগে এসেছেন এই নেত্রকোনায় ?
আমরা তো চলে গেছি এদেশ ছেড়ে।
হা হা করে হাসলেন অতীন, আমরা তো যাইইনি, তখন যখন যাইনি, এখন কেন যাব ?
চন্দ্রকুমার বলল, গেলি ক্ষতি আসে, না গেলি ঠিক।
কেন ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
চন্দ্রকুমার বলল, কত খারাপ মানুষ রইসে দাদা, তারা বলবে একেবারেই যান না কেনে, দেশটাকে তারা মুসলমানের দেশ করতি চায়, কিন্তু মুসলমানের দেশ হয়ে গেলি কাদের তাড়াবে জমি দখল করতি।
অতীন বললেন, তা নয়, আমার কোনো আকর্ষণ নেই, দাদাকে তবু যেতে হয়েছে এক সময়, আমি নড়তে পারিনে, আর সেই কারণে হয়তো পারটিশনের সময় আমাদের ফ্যামিলির কেউ যায়নি ওপারে।
সুরমা বললেন, অলস।
হুঁ, ঘরকুনো। বলে হাসলেন অতীন, তারপর বললেন, আমি একটা লিখসি অনেকদিন ধরে।
কী লিখছেন ?
মৈমনসিংহর কাহিনি।
কমলা সায়র না কি কাজলরেখার কাহিনি, ্মহুয়া, মলুয়া যা চন্দ্রকুমার দে সংগ্রহ করেছিলেন ?
না হাজং জাতির বিদ্রোহ।
চন্দ্রকুমার বলল, আমি তো সেই জন্যিই আপনার কথা বলে স্যারকে ফুন দিয়েছিলাম।
চুপ করে থাকে বিপুল। তার আসা যে কারণে সেই কারণের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। উপায় নেই। যা ঘটার তা ঘটবে। সে বলল, আমাকে দেবেন পড়তে ?
শেষ হয়নি, কিন্তু সেই কাহিনি কি ভালো লাগবে, তার ভিতরে রোমান্স নেই, তার ভিতরে রাজরানি, রাজার আর রাজকন্যার কথা নেই।
না থাক। বিপুল বলে, যা আছে তাও তো মানুষের জীবন।
কমিউনিজমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস টলে গেছে, এখন আর পুরোন কথা কে শুনবে?
বিপুল বলল, কোনো বিশ্বাসই চিরস্থায়ী হয়নি, চিরস্থায়ী কোনো কিছুই মানুষ মেনে নেয় না, তা ঠিকও নয়, মানুষ বিচার করছে অনেক বেশি, কিন্তু বিপ্লব বিদ্রোহ কোনোদিন কি মুছে যেতে পারে, মানুষ কি ক্রীতদাস হয়ে বাঁচবে আবার, বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে।
বুঝতে পারি না, কিন্তু মনে হয় এখন না লিখে রাখলে মুছে যাবে মনা সর্দার, কুমুদিনী, রাশিমণি, যাদুমণি হাজঙের কথা, হাজংরা নেমেছিল সিমসাং নদীর স্রোতের সঙ্গে গারো পাহাড়ের উপর থেকে।
নেত্রকোনা থেকে গারোপাহাড় কেন দেখা যায় না। বিপুল আচমকা জিজ্ঞেস করল, আমি তো ভেবেছিলাম নেত্রকোনায় পা দিয়েই দেখব গারো পাহাড়ের মাথায় তুষারপাত হয়েছে।
অতীন বললেন, শুনেছি আগে দেখা যেত, পরে পাহাড়টা পিছিয়ে যায়।
কে বলল এই কথা ? হেসে জিজ্ঞেস করল বিপুল, পাহাড় পিছিয়ে যায়, ভারী চমৎকার কথা।
হাজংরা বলে। অতীন জবাব দিলেন।
উপকথা ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
তা জানি না, হাতি ধরার জন্য পাহাড়ের ওদিক থেকে তাদের ডেকে আনা হয়েছিল।
পাহাড় কেন পিছিয়ে গেল ?
এরা তো পাহাড়ের সন্তান, বিনি পয়সায় হাতি খেদিয়ে ধরতে খুব কষ্ট, পেটের ভাত জুটত না, তখন হাতিদের নিয়ে পাহাড় পিছিয়ে যেতে থাকে। বললেন অতীন। যে কাহিনি শোনালেন অতীন, তা বড় বিচিত্র।
(চলবে)