হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৪

ভোগ ও ত্যাগ

কাঁপতে কাঁপতে যখন হাজির হলাম ক্যাম্পের মধ্যে, আমার তখন শরীরের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। একে, টানা ১৪ কিলোমিটার চড়াই অতিক্রম করে এসেছি। ৬০০০ ফুট থেকে টানা ১৬০০০ ফুটে। তার উপর টানা বৃষ্টি। ভিজে গেছি। খাইনি। আর ঠিক তখন জলদগম্ভীর গলা- ‘এখানেও এসে গেছেন?’ চেয়ে দেখি, চেনা মুখ। ‘কী অবস্থা!’ সঙ্গে সঙ্গে কিছু ওষুধ আর গরম চা। বসলাম এক জায়গায়। জামাকাপড় পাল্টালাম। হেমকুণ্ড সাহিবে গেলেই আপনি পাবেন গরম গরম খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ভালো করে চারিদিকে তাকালাম। আমি একটা স্বতন্ত্র ক্যাম্পে শুয়ে আছি। চারিদিকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক, ওষুধের বাক্স। শুয়ে আছি ক্যাম্প খাটে। ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমোনো যাবে না। এ অবস্থায় নাকি ঘুমোনোই বিপদ। উঠলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলেন সেই সন্ন্যাসী ডাক্তার। নাম বলছি না। বলা বারণ।

‘এই তো ছিলেন কেদারে, এখানে যে?’

আমার কথা শুনে সেই বাঙালি সন্ন্যাসী ডাক্তার বললেন- ‘আরে আমি তখন কেদারে ছিলাম। কিন্তু ঘুরে ঘুরে বেড়াই তো। আর এসময়ে হেমকুণ্ড সাহিবে এত পর্যটক আসেন, তাই চলে আসি। কিন্তু আপনার এমন অবস্থা হল কেন?’  

বললাম, ‘একটাই ভুল করেছি। আর জানেন তো পাহাড়ে একটা ভুল, যে কেমন মারাত্মক হয়ে ওঠে! সকালে ব্রেকফাস্ট না করে বেরিয়ে পড়েছি। ভেবেছিলাম এসেই খাব।‘

‘সে কী! ইডিমা হয়ে যেতে পারত!’

ইনি একজন বাঙালি ডাক্তার। ইউরোপ ফেরত। ডাক্তারি করতেন কলকাতায়। কিন্তু ‘তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?’ বেরিয়ে পড়লেন স্রেফ ডাক্তারির সার্টিফিকেট, মার্কশিট, স্টেথিস্কোপ, প্রেসার মাপার যন্ত্র এবং কিছু টাকা নিয়ে। আর ফিরে যাননি। ইচ্ছে ছিল কিছুই করবেন না। কিন্তু এই গাড়োয়ালে এসে তিনি এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন, যাতে স্থির করলেন এখানে থেকে ডাক্তারি করবেন। তিনি সেবার যাচ্ছিলেন হিমাচল প্রদেশের চাম্বা থেকে পাঙ্গি। অনেকটা রাস্তা। যাওয়ার পথে একটা জায়গায় দূর থেকে দেখলেন একজন আসছেন। তো এক সময়ে তিনি উপস্থিত হলেন। একজন মানুষ, কাঁধে আলুর বস্তা। এসে বললেন- শুনলাম একজন ডাক্তার আছেন। তিনি কি আমায় একটু দেখবেন? আমার তো কিছু নেই, কিছু আলু নিয়ে এসেছি। তিনি দেখলেন, লোকটির পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে, পা কেটে বাদ দিতে হবে নাহলে লোকটি বাঁচবেন না। কথায় কথায় জানতে পারলেন ডাক্তার দেখাবার বহু চেষ্টা করেছেন সেই লোকটি। কিন্তু গ্রামের আশেপাশে চারশো কিলোমিটারের মধ্যেও কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় দেখাতে পারেননি। তাই একজন ডাক্তার এলাকায় এসেছেন শুনেই আলুর বস্তা কাঁধে চলে এসেছেন দেখাতে। সে সময়ে ডাক্তারের কাছে কিছুই ছিল না। শুধু একটি ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে লোকটিকে বিদায় করেছিলেন। কিন্তু সেই থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, হিমালয়ের কোণে কোণে পৌঁছে দেবেন চিকিৎসা। পূর্বাশ্রমে ত্যাগ করলেন নাম। কিন্তু কাজ না। প্রথম আলাপ হয় আমার সঙ্গে কেদারনাথে। কেদারের মন্দিরের ঠিক পাশে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের পাশেই একটা তাঁবু। তার ভিতরেই ছিল তাঁর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল। যে ক’দিন ওখানে ছিলাম আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতেন। একবার হাঁটতে হাঁটতে বা বেড়াতে বেড়াতে তাঁর সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম কেদার মন্দিরের পিছনে চোরাবারিতালে। সামনেই বরফের বিশাল পাহাড়। তার ছায়া পড়েছে গান্ধী সরোবরে (সে সব এখন আর নেই  দুর্যোগের পরে)। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই যে সব ছেড়ে চলে এলেন, জীবনে কত কিছুই না ভোগ করতে পারতেন!’ তিনি হেসে উঠে বললেন- ‘ভোগ-ই তো করছি। তুমি কি মনে করো সন্ন্যাস একধরনের ভোগ নয়? শুধুই ত্যাগ? ভুল ধারণা। এও একধরণের ভোগ। শুধু ভোগের ধারণাটি আলাদা। আমার কোনও সামাজিক পরিচয় নেই। আমার কাজটাই আমার পরিচয়। আবার আমি একজায়গায় থাকিও না। ফলে কোনও সমাজ তৈরিও হয় না আমাকে ঘিরে। এই যে পরিচয়হীন কাজ করে যাওয়া, এও কি ভোগ করা নয়? আমি এই জীবনে প্রবল আসক্ত। শুধু আমি সামাজিক পরিচয়ে আসক্ত নই’।

শুনে কোনও কথা বলে উঠতে পারিনি। কী বলব! আমি তো সত্যিই এসব অনুভূতির কাছে বেড়াতে আসি মাত্র। কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে যাই আমাদের ক্লেদাক্ত জীবনে।

প্রশ্ন আসে তাহলে কে কবি? কবি কি তাহলে কেবল সে-ই যে শব্দে শব্দে দিতে পারে দারুণ বিবাহ? তবে এও ঠিক, কবি সম্পূর্ণ অন্য কেউ, যাকে অত পোশাক পরানোর হয়ত আদৌ দরকার নেই। কবি খুব নগ্ন, তীব্র এবং সেই সন্ন্যাসীর মতো, যাঁর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আবার তা-ই বলে, প্রয়োজনীয় সময়ে কবি নীরবতা অবলম্বন করবেন ভয় পেয়ে গিয়ে, এমনটাও নয়। তাহলে যিনি কবি, প্রকৃতই যিনি কবি, তিনি কি সারাজীবন এই সংশয় বুকে নিয়েই কাটাবেন? নাকি তিনি এই ইউরোপ ফেরত সন্ন্যাসী ডাক্তারের মতোই উদাসীন এক ব্যক্তি, যাঁর কাছে সামাজিক পরিচয় বড় কথা নয়, কাজটি করে যাওয়া বড় কথা। কিন্তু এমন কবি ক’জন?  উল্টোদিকেও প্রশ্ন আসতে পারে, এমন সন্ন্যাসীই বা ক’জন?

ওই যে বললাম বেড়াতে এসেছি বিভিন্ন অনুভূতিমালার কাছে, এ যে কত বড় সত্যি অন্তত আমার কাছে, তা বলে বোঝানো কঠিন। শুধু, এই সব অনুভূতিমালা আমাকে কিছু অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত এনে দেয়। আর সেই সব অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত আমাকে দিয়ে কী সব যে লেখায়- আমি সেই সব লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ি, নিজেও চরিত্র হয়ে পড়ি সেই সব লেখার। আবার নিজেই বুঝতে পারি, শেষ পর্যন্ত যা হল, তা আর যাই হোক, আমার অচেনা কিছু। মনে পড়ে পড়েছিলাম জেন গল্পেই, এক শিক্ষক সন্ন্যাসীর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন এক শিক্ষার্থী সন্ন্যাসী। তাদের হাঁটা আর ফুরোচ্ছে না। বছরের পর বছর কাটে। গাছের তলায় বিশ্রাম করতে করতে সেই শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন- এই যে এত বছর আমার সঙ্গে হাঁটছ, তুমি কোথায় কী উদ্দেশ্যে হাঁটছ, তা জানো কি? উত্তরে ছাত্র বললেন- না, জানি না। তাতে কী? আপনি তো আমার গুরু। আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন, যাব। আপনি তো জানেন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শিক্ষক বললেন- আমিও জানি না।

সেই দিন প্রথম জেন প্রাপ্তি হল সেই ছাত্রের।

জেন বা বৃহত্তর দর্শন যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে সাধনাই হোক বা লেখা- সে সব কেবলমাত্র মাধ্যম ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। কিন্তু মাধ্যম যদি উদ্দেশ্য হয়, দর্শন তবে তার চরিত্র হতে পারে। ধরা যাক, হাঁটছি। আমার কাছে যদি পাহাড়ের দৃশ্যই উদ্দেশ্য হয়, তবে হাঁটাটি তাকে পাওয়ার মাধ্যম। এই দৃশ্যকে আমরা নানা ভাবে ভাবতে পারি। দৃশ্যকে অনুভূতিমালা হিসেবেও ধরা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এই উদ্দেশ্য, সেই পাহাড়ে নির্জনে থাকা সন্ন্যাসীর মতোই চিরকালীন অধরা। আবার তিনিও আমার কাছেই আসবেন বলে মরীয়া এক অভিযাত্রায় আছেন। সেক্ষেত্রে হাঁটাটি এক সময়ে অসমাপ্ত থেকে ফুরিয়ে যাবে। মাধ্যম নশ্বর। মাধ্যম ক্ষণস্থায়ী। আবার মাধ্যম জানেও না, সে আসলে কোন উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। কারণ একই রাস্তা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যায়। রাস্তা কখনও ফুরোয় না। একটা সময় অগম্য হয়ে যায়, দুর্ভেদ্য হয়ে যায়, দুরূহ হয়ে যায়। কিন্তু রাস্তা থাকে। ধরুন, পাহাড়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেকিং রুট। তার পরে আর হাঁটা যায় না। তখন ক্লাইম্ব করতে হয়। এর মানে, রাস্তা আছে, কিন্তু তা হেঁটে যাওয়া মানুষের জন্য উপযুক্ত রাস্তা নয়। কিন্তু আপনি একটি পাখির দিকে তাকান, সে সহজেই উড়ে উড়ে হয়ত সেই চূড়াটির উপর দিয়েও উড়ে চলে গেল। নির্ভর করে যে হাঁটছে, তার আধারের উপর। সে কত রাস্তা ধারণ করার যোগ্য। কিন্তু সেও জানে না আসলে তার উদ্দেশ্য কোনটি। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ভালোবাসতেন ভ্রমণ করতে। তিনি লিখেছিলেন- বেরিয়ে পড়ো হাওয়ায়, হাওয়া বাইরে থেকে আসছে। এই যে বাইরে থেকে আসা হাওয়া, এটিই তাঁকে উদ্বেল করে তুলত। তিনি বেরিয়ে পড়তেন, কিন্তু ঠিক কোথায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছেন, তা তাঁর কাছে আদতে অজানা। তবে কি তাঁর কাছে হাঁটার পথটা মুখ্য? না মনে হয়। মনে হয়, তাঁর কাছে হাঁটার পথটা নিজের মনে মনে কথা বলার মতো। প্রকৃতি, রাস্তা তাঁকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলে যাচ্ছেন। তাই বোধহয় তিনি তাঁর কবিতাগুলি খুব একটা কাটাকুটি বা সংশোধন করতেন না। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার নন। কারা তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার? যাঁদের জীবন সম্পর্কে ধারণা খুব সীমাবদ্ধ। সামাজিক জীবন সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ত। তাঁরা খুব সফল হতে জানেন। কারণ তাঁদের সাফল্য নির্ভর করে সামাজিক পরিচিতির উপর। এই সামাজিক পরিচিতিই তাঁদের নিয়ে যায় ক্রমে ক্ষমতার দিকে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দিকে, তার জন্য নানান রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দিকে, এমনকী ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকেও। কাজ তখন হয়ে যায় গৌণ। পরিচয়টাই প্রধান। সেই ডাক্তার সন্ন্যাসী যদি ভাবতেন, কেন করব, এই কাজে ‘আমি’ কই, এই কাজে ‘আমার পরিচয়’ কই, এই কাজের মধ্যে দিয়ে আমার সমসময়ে ক্ষমতা কই, তাহলে তিনি এই কাজ করতেই পারতেন না। প্রকৃত কাজ আসলে সবসময় নিশ্চেষ্ট হয় বলে মনে হয়। কিন্তু আমিত্বের প্রতিষ্ঠা চেষ্টাকৃত।

জ্ঞানের বা প্রজ্ঞার কথা বলা আমার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তার কারণ আমি প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী নই। আমি নিজেকে মনে করি বেড়াতে বেরিয়েছি। আমার কাছে, আমার জীবন মোটেই চাঁদনী চকের জ্যামে ফেঁসে থাকার মতো নয়, বরং তা অনেকটা জাপানি চিত্রকলার মতো। আমার মনে হয় সকলের জীবনই তা-ই। কিন্তু আধুনিকতার সঙ্গে কি এই ভাবনার বিরোধ দেখা যাচ্ছে না? এইখানে এসে আমি থমকে দাঁড়াই, কারণ আমার মনে হয় প্রতিটি দেশেই আছে নিজের নিজের মতো করে আধুনিকতার দিকে অভিযাত্রা, এবং এই অভিযাত্রা কখনওই বিশ্বজনীন নয়। তবু কোথাও সময়ের ভাষা জেগে ওঠে সেই অভিযাত্রায়। আবার, আধুনিকতার মধ্যেই রয়েছে সমস্ত সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া আবহমানতার অন্তসলিল স্রোত। যেমন সমসময়ের মধ্যেই রয়েছে চিরকালীন সময়। খণ্ড খণ্ড বৈচিত্রগুলি আসলে অখণ্ড সেই চিরকালীনতাকে ছুঁতে চাওয়ার সাধনা।

আবার একটি জেন গল্পের কথা মনে পড়ে। গল্পটি এরকম- এক দেশে এক প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসী বাস করতেন। তিনি প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং বৃদ্ধ। সেই দেশেই বাস করতেন এক তরুণ জেন সন্ন্যাসী। তিনিও প্রাজ্ঞ, কিন্তু অতটা অভিজ্ঞ নন। এই দুই জনের মধ্যে দার্শনিক ঝামেলা লেগেই থাকত। একদিন তরুণ সন্ন্যাসীটি বলে উঠলেন- জীবনে কিছুই নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, ঈশ্বর নেই, রূপ নেই, অরূপ নেই, শুধুই শূন্যতা। এই শুনে প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীটি হাতের কাছে একটি লাঠি ছিল, তা দিয়ে তরুণের মাথায় দুম করে আঘাত করলেন। সেই তরুণ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন- আপনি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারেন না। এই শুনে প্রাজ্ঞ ও বৃদ্ধ সন্ন্যাসীটি বললেন- যদি কিছুই না থাকে, তবে এই ক্রোধ এলো কোথা থেকে? এই শুনে তরুণ সন্ন্যাসী জেন প্রাপ্ত হলেন। জেন কিন্তু এর কোনও উত্তর দেননি, যে সত্যিই কিছু যদি না থাকে, তবে এই ক্রোধ কোথা থেকে এলো। আবার এও বলেননি, যে তার মানে সবকিছুই আছে। এইখানে এসে মনে হতেই পারে, যে তরুণ সন্ন্যাসীটি যা লাভ করলেন , তা আসলে কী! আমার মনে হয় এই প্রশ্নটি। এই সংশয়, তাঁকে শূন্যতার এক বস্তুগত ধারণার থেকে শূন্যতার এক চিরন্তন দার্শনিক প্রশ্নের কাছে তাঁকে ঠেলে দিল। সমসময়ে যে সমস্ত দ্বন্দ্বগুলির কারণে আমাদের মনে অস্তিত্ববাদের জন্ম হয়েছিল একটি সময়ে, তার অন্তস্থলে যদি খুঁজি, তবে আমরা সেই অস্তিত্ববাদেরও অন্দরমহলে যে শূন্যতা আছে, তার দিকে চলে যাব, আর তা আমাদের ক্রমশ এক আবহমান শূন্যতার দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাবে।

প্রকৃতির বৃহৎ অথচ সূক্ষ্ম যে অস্তিত্ব, তা আমাদের সেই অনুভূতিমালার কাছে নিয়ে যায়। অলৌকিক শব্দটি আমি বলব না, কিন্তু বলতেই পারি অপ্রত্যাশিত শব্দটি। বৃহৎ যা কিছু, সে সব হয়ত প্রকৃতই বড় বেশি উদাস। তার কারণ কি তার একাকীত্ব? সেই অস্তিত্ব কি আসলে কথা বলতে চায়? সাচ পাসের কাছাকাছি একটি জায়গায় একটি তাঁবুতে বসে আছি। ঘন রাত। এমন একটা জায়গায় আমাদের তাঁবু, যেখানে পাহাড়ের এক ঢালের কারণে চাঁদ আড়াল হয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকার নিয়ে আসে। দূরে দেখা যায় চাঁদের আলো। কিন্তু আপনি থাকেন নিকষ অন্ধকারে। এমন অন্ধকার, যে নিজেকেও দেখা যায় না। অথচ রাতের আকাশের আলো ঠিক এসে পড়ে। তারাগুলিকে মনে হয় মাথার উপর এসে পড়েছে। এমন এক রাতে, আমি ও আমার এক বন্ধু দুজনের ঘুম আসছিল না । তাঁবু থেকে বেরোলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। এদিকে কখনও অন্ধকার, কখনও আলো। অন্ধকারে থাকলে, বোঝাও যাচ্ছে না, যেখানে পা ফেলছি, সেখানে খাদ কিনা। প্রতিটি পদক্ষেপ সেখানে অনিশ্চয়তা। প্রথম প্রথম নিজেদের দোষ দিচ্ছিলাম। তারপর ভাবলাম দোষ দিয়ে আর লাভ কী! তার চেয়ে অপেক্ষা করা ভালো। কিন্তু ঠান্ডা ক্রমে বাড়ছে। জমে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বেশ দিশেহারা লাগছিল। রাত তখন ১১টা হবে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা যখন কিছুই করতে পারছি না, তখন কিছু করার কথা ভাবব না। বসে থাকার চেয়ে অনির্দিষ্ট পথে পা বাড়াব, আর তাঁবুর কথা ভাবব না, কোথায় যাব, তার কথাও না। এই ভেবে আমরা পা বাড়ালাম। জানি, অনিশ্চিত প্রতি পদক্ষেপ। কিন্তু পা তো বাড়াতেই হবে। বসে থাকলেই জমে যাব। সুতরাং গল্প করতে করতে এগোলাম। তাঁবুর কথা না ভেবে। প্রায় দু ঘণ্টা এদিক সেদিক ঘুরে, ঘুরতে ঘুরতে আমার বন্ধু আবিষ্কার করল, ওই যে চাঁদের আলো আর ওই যে তাঁবু। এগোলাম। যেমন রাস্তা হারিয়ে হারিয়ে গেছিলাম, তেমন রাস্তা হারিয়ে খুঁজেও পেলাম। শুরুটাও ছিল উদ্দেশ্যহীন। শেষটাও হল উদ্দেশ্যহীন।

পাহাড়ে যাঁরা যান, তাঁদের প্রত্যেকের হয়ত এমন নানাবিধ অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এই যে অনিশ্চয়তার কথা বললাম, সেটি টের পেয়েছিলাম, যখন অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছি আর আমার মুখের দিকে নেমে আসছে অজ্ঞান করার মাস্ক। আমি বুঝতে পারছি আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। খুব ক্রিটিকাল অপারেশন। কী হবে জানি না। কিন্তু ভেবেও লাভ নেই। কারণ আসলে তো উদ্দেশ্যহীন সবকিছুই। তাই সমর্পণ ভালো। ভালো করে ভাবলে দেখা যায়, সমর্পণ করা ছাড়া জীবনের আসলে কিছু করার থাকে না। আমরা নানান চেষ্টা করি, উদ্যম ছাড়া কিছুই হয় না, মানি। কিন্তু উদ্যমেও কিছু হয় কি? উদ্যম থাকা দরকার সেই কাজটিকে নিখুঁত করার জন্য। কিন্তু সেই কাজটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য না। পরে ভেবে দেখেছি, যদি উদ্যম না নিয়ে বসে থাকতাম, তো জমে যেতাম। আবার যদি উদ্যম নিয়ে তাঁবু খুঁজতেই বেরোতাম, তাহলে হয়তো আরও হারিয়ে যেতাম। তার চেয়ে ভালো ছিল ওই আমাদের উদ্যম নিয়ে আবার হারিয়ে যাওয়াতেই।

মনে পড়ে একটি স্বতন্ত্র জেন গল্প। এক জেন সন্ন্যাসীর কাছে এক স্ত্রী এসেছেন, তাঁর স্বামীকে নিয়ে। স্ত্রীর বক্তব্য, তাঁর স্বামী খরুচে। আর স্বামীর বক্তব্য তাঁর স্ত্রী কিপটে। এই শুনে সেই সন্ন্যাসী বললেন- হাত মুঠো কর তোমরা। দুজনেই হাত মুঠো করলেন। জেন সন্ন্যাসী বললেন- এইবার এহাত দিয়ে তোমরা কিছুই কি করতে পারছ? দুজনেই বললেন- না। এর পর তিনি বললেন – হাত এবার সোজা করে মেলে ধর। দুজনে তা-ই করলেন। তিনি বললেন- এইবার কি তোমরা কোনও কাজ করতে পারছ? দুজনেই বললেন- না। জেন সন্ন্যাসী বললেন- হাত শক্ত করে মুঠো করে ধরলেও কিছু করতে পারবে না, আবার একদম সোজা করে রাখলেও কিছু করতে পারবে না। খুব মিতব্যয়ী হলেও বিপদ, আবার অমিতব্যয়ী হলেও বিপদ। মাঝামাঝি থাক।

তেমন, উদ্যম ছাড়াও বিপদ, আবার খুব উদ্যমী হলেও বিপদ। নিজেকে ছেড়ে দিয়েও বেঁধে রাখতে হয়। কিন্তু সেটি সমর্পণে কীভাবে সম্ভব? এ এক ধোঁয়াটে ব্যাপার।

Facebook Comments

Related posts

2 Thoughts to “বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৪”

  1. BARUN DEY

    পড়তে পড়তে কখন যে শেষে চলে এলাম বোঝা গেল না। তোমার লেখায একটা সাবলীল গতি আছে যা পাঠককে আরও গভীরে নিয়ে যায়। এ তো শুধু নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয় এ এক কবির অন্তর্জগতের দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশ। আশাকরি এই পর্ব গুলো পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবে । শেষে, সঙ্ঘমিত্রা ও অনিমিখ কে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর লেখা উপহার দেওয়ার জন্য। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    1. Sanghamitra Halder

      অনেক ধন্যবাদ বরুণদা।

Leave a Comment