অভিরূপ সরকার

বন্ধুর কথায় বন্ধু

(গৌতম বসুর স্মরণসভায় স্মৃতিচারণা)

শহরটা তখন বদলে যাচ্ছে। শহরের দেওয়ালে চেয়ারম্যান মাও এর ছবি ক্রমশ মলিন হয়ে আসছে, তার বদলে এশিয়ার মুক্তিসূর্য’র ছবি। কলেজ স্ট্রিটে রোজই গণ্ডগোল লেগে থাকে, নকশালদের সঙ্গে কংগ্রেসের। তার আঁচ কলেজের (প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভেতরেও টের পাই। এইসময়, প্রথম প্রায় দেড় বছর, গৌতমের সঙ্গে আমার অতটা বন্ধুত্ব হয়নি। এটার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, তখন কলেজে পরিষ্কার দুটো রাজনৈতিক দল ছিল – একটা বামভাবাপন্ন দল, পুরনো নকশালরা অনেকেই ছিল তার মধ্যে, আরেকটা অবাম, কংগ্রেসই বলা যায়। আমি সেই অ-বাম দলটিতে ছিলাম, ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিলাম, ছাত্র পরিষদের হয়ে। এবং গৌতম অন্তত মনে মনে বামপন্থী দলটিতে ছিল। যার ফলে প্রথম দেড়বছর গৌতমের সঙ্গে খুব বেশি কথাবার্তা হতো না।তারপর, কলেজ ম্যাগাজিনে গৌতমের একটা লেখা বেরল। লেখাটার নাম ‘ব্ল্যাক অর্ফিয়ুস’, ইংরিজিতে লেখা। কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের নিয়ে লেখা। ওই প্রথম জানতে পারলাম যে গৌতম বসু কবিতা পড়েন। কবিতার ব্যাপারে আমারও খুব উৎসাহ ছিল। প্রসঙ্গত, আমিও একটা লেখা জমা দিয়েছিলাম উইলিয়াম ব্লেকের ওপরে – সেটা ছাপা হয়নি। ভাগ্যিস ছাপা হয়নি! লেখাটা এত কাঁচা… এখন ভাবি… আমার বন্ধু স্বপন চক্রবর্তী, সে এডিটর ছিল… আমার সৌভাগ্যক্রমে সে লেখাটি বাদ দিয়েছিল। তখন অবশ্য সেটা মনে হয়নি! তখন মনে হয়েছিল, গৌতম আর স্বপন একই ইস্কুলের ছেলে, সেই ক্যালকাটা বয়েজ থেকে বন্ধুত্ব, … সেইজন্য ওর লেখাটা ছাপা হল আর আমার লেখাটা ছাপা হল না! যাইহোক, সেই দুঃখ কিছুদিন ছিল। তারপর একদিন গৌতমকে ক্লাসের শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই তুই কবিতা টবিতা পড়িস?” বলল, “হ্যাঁ, পড়ি!” আমি বললাম, “কার কবিতা তোর ভালো লাগে?” ও বলল – “অনেক কবি আছেন, যাদের মাইনর পোয়েটস বলে, তাদের কবিতা আমার ভালো লাগে। যেমন, আর. এস. টমাস।” আমি তো নামই শুনিনি তার আগে! তো, আমি বললাম – “আর?” ভাবলাম এবারের নামটা জানতে পারব! বলল – আনা আখমাতোভা। ওসিপ মান্দেলস্তাম। আমি তো ওই দুটো নামও শুনিনি! আমি একটু বিজ্ঞের মতো হুঁ হুঁ করে গেলাম, কিন্তু ওই তিনটে নামের একটাও শুনিনি। আমার জ্ঞান তখন টি. এস. এলিয়ট, ডাব্লিউ. বি. ইয়েটস – মোটামুটি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  গৌতম বলল, না, এলিয়টের কবিতা আমার ভালো লাগে না। আমি ভাবলাম – সে কী কাণ্ড! এলিয়ট তো বিরাট কবি! এসব নিয়ে ওর সঙ্গে একটা তর্কাতর্কি পর্যায়ের  আলোচনা হল। সেই সময়  পেঙ্গুইন থেকে একটা সিরিজ বেরতো, দু’জন বা তিনজন করে কবির কবিতা একসঙ্গে একটা বইতে ।সেইরকম একটা সংকলন রিলিজিয়াস পোয়েটস।  তাতে আর. এস. টমাসের কবিতা ছিল।  গৌতমের উৎসাহে সেই প্রথম পড়লাম আর. এস. টমাসের কবিতা। এবং  গৌতমের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিছুদিনের মধ্যে অনেকটাই গাঢ় হল। গৌতমের তখন একটা সাহেবিয়ানা ছিল, অস্বীকার করা যায় না। ইতিমধ্যে, আমাদের ক্লাসেই পড়ত আরেক বন্ধু ভাস্বর মৈত্র (?), তিনিও গতবছর প্রয়াত হয়েছেন, ভাস্বর আর গৌতম একটা পত্রিকা বার করল। ৭৪ সাল। ইংরিজি পত্রিকা। পত্রিকার নাম _’ইয়োথেন’__। মানেটা কী? তখন জানতাম, তারপর সম্পূর্ণ ভুলে গেছিলাম। আজ আবার আসার আগে  ইন্টারনেটে মানেটা দেখে এলাম। ইয়োথেন__ মানে ‘ফ্রম দ্য ইস্ট’। পূবদিক থেকে। ঠিক হল পত্রিকায় দুটো অংশ থাকবে -– প্রথম অংশে যেসব ভারতীয়রা ইংরিজিতে লেখেন, তাদের লেখা থাকবে। আর দ্বিতীয় অংশটা, যেটায় গৌতমের বেশি উৎসাহ ছিল – ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যেসব কবিতা লেখা হয়, যার সবটা আমরা জানিনা, সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ। আর. এস. টমাস একটা লেখা পাঠিয়েছিলেন, সেই আর. এস. টমাস! আমাদের অধ্যাপিকা ছিলেন সুদেষ্ণা চক্রবর্তী। সুদেষ্ণাদি একটা ইংরেজিতে কবিতা পাঠিয়েছিলেন। আমার মনে আছে বাংলা কবিতার কয়েকটা অনুবাদ ছিল তাতে। তার মধ্যে একটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অনুবাদ ছিল। আমি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে কিছুটা চিনতাম আমার বাবার বন্ধু বলে। তো, গৌতম আর ভাস্বরকে নিয়ে বীরেনকাকার বাড়িতে গেলাম। সেটাও একটা মজার এক্সপিরিয়েন্স। বীরেনকাকা বললেন যে – “আমার কবিতা ইংরাজিতে অনুবাদ করবা? কেন?” গৌতম খুব বিনীতভাবে বলল – না, মানে, আরও অনেকে পড়বে… ইত্যাদি। তো, উনি বললেন – ঠিক আছে, ইংরাজি আমি ভালো জানি না। অরুণ সরকারকে দেখিয়ে নেবে। তো, সেই পত্রিকা বেরল। গৌতমের ইংরাজি ভাষায় সাহিত্যচর্চার বোধহয় এখানেই ইতি। 

এতো স্মৃতি! পরপর এভাবে বলা মুশকিল! সময়েরও অভাব আছে। 

এম.এ. যখন পড়তাম, সেইসময় গৌতমের সঙ্গে একটা বিরাট সৌহার্দ্য হল। অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে এম.এ. পড়ার সময়ে। সেসময় আমরা কাঁটাকলে পড়তাম। ইকনমিক্স এর এম.এ. টা ওখানে হত, বরানগরে। তার পাশে ছিল এমারেল্ড বাওয়ার, তখনও রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটি ওখানে আসেনি। গৌতম আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরেছি, একটা ঝিল ছিল, সেই ঝিলটার ধারে। প্রায় সবটাই কবিতার আড্ডা। 

হঠাৎ ছুটি হয়ে গেছে একদিন, কাঁটাকলে, কোনো কারণে। গৌতম আর আমি L-20 বাস ধরে চলে গেলাম ব্যারাকপুরে। একটা পুরনো চার্চ, সেখানে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা মারলাম, চা খেলাম। 

অসংখ্য সিনেমা দেখেছি একসঙ্গে। মূলত হলিউড। কিন্তু আমরা যখন এমএ পড়ি হলিউডের সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন। রাশিয়ান ছবি আসত। তা-ই দেখতাম। এবং সেইসময়ে, যমুনা বলে একটা সিনেমা হল তৈরি হল৷ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে, সদর স্ট্রিট অঞ্চলে। যমুনা’র অন্য পাশে ‘লী জনসন’ নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। চিনে খাবার পাওয়া যেত। তারা মিট চাউমিন বলে একটা বস্তু বিক্রি করত, আড়াই টাকা করে প্লেট। তারা অত্যন্ত সত্যবাদী, কারণ কোন মিট তা কখনও বলত না। আমার মনে হয় কখনও বেড়াল,  কখনও ইঁদুর, কখনও কুকুর – মানে, যেদিন যেটা পাওয়া যায় আর কী! তো, সেই মিট চাউমিন আমরা দিনের পর দিন খেয়েছি। আড়াই টাকা করে প্লেট এবং তারপর যমুনায় সিনেমা। 

আরও স্মৃতি! গৌতম আর আমি তিন দিনের জন্য বকখালি বেড়াতে গেছি। তখন, বকখালি যাওয়া একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার ছিল! বাসে প্রথমে ডায়মন্ড হারবার, তারপর ডায়মন্ড হারবার থেকে কাকদ্বীপ আরেকটা বাসে, আবার একটা বাসে নামখানা, নামখানা পৌঁছে একটা নদী – হাতানিয়া দোয়ানিয়া, সেটা পার হলাম, তারপর আবার একটা বাসে ফ্রেজারগঞ্জ, ফ্রেজারগঞ্জ থেকে ঘন্টাখানেক হেঁটে বকখালি। তো, সেই দুর্গম জায়গায় একটা সরকারি থাকার জায়গা ছিল। চমৎকার কাটল তিনটে দিন। সঙ্গে কবিতার বই ছিল। রবীন্দ্রনাথ এবং তখন আমরা দুজনেই এক গ্রিক কবির লেখা পড়ছিলাম – ইয়ানিস রিটসস__। 

একবার, লাইটহাউসে দেখলাম সন্ধেবেলায় একটা সিনেমা হচ্ছে, দুর্ধর্ষ সিনেমা – নাইটওয়াচ। এলিজাবেথ টেলর ছিলেন। দারুণ সাসপেন্স! গৌতম তখন দাড়ি রাখত। আমার মনে আছে, এতটা সাসপেন্স যে উত্তেজনায় দাড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে  ওর গোটা জামাটা দাড়িভর্তি হয়ে গিয়েছিল! তো, সেই সিনেমা ‘নাইটওয়াচ’ দেখার আগে আমাদের প্রবল খিদে পেয়ে গেল! সেটা শীতকাল। গৌতমের একটা নীল রঙের কোট ছিল। কী খাবো, টাকা তো নেই! কারণ একটু বেশি দামের টিকিট কাটতে হয়েছে। হঠাৎ ও কোটের ভেতরের পকেট থেকে জাদুকরের মতো একটা পাঁচ টাকার নোট বার করল! ভাবা যায় না! সে যে কী আনন্দ! ফলে, আবার সেই লী-জনসন, আবার সেই মিট চাউমিন! 

আমি আর গৌতম কফি হাউসে। মোহনবাগান দীর্ঘদিন বাদে এক গোলে জিতল – আকবরের সেই প্রথম মিনিটে দেওয়া গোল! গৌতমের একটা মেরুন রঙের রুমাল ছিল। গৌতম বলল এইটাই ওড়ানো যাক, সবুজটা তো পাচ্ছি না! গৌতম আর আমি – দুজনেই খুব মোহনবাগানের সাপোর্টার ছিলাম।

শিব্রাম চক্রবর্তীর বাড়িতে গেছি। আমি, গৌতম আর আমাদের এক বন্ধু সত্যজিৎ। সত্যজিৎই নিয়ে গেছে।, ওর দাদা প্রমার সুরজিৎ ঘোষ। সেই সূত্রে শিবরামের সঙ্গে ওর আগেই পরিচয় ছিল। আমরা ভেবেছিলাম উনি খুব হাসিঠাট্টা করবেন। গিয়ে দেখলাম ভীষণ ডিপ আর সিরিয়াস শিব্রাম চক্রবর্তী! আমরা প্রণাম করতে যেতে উনি বললেন, দ্যাখো আমি তো তোমাদের প্রণামের যোগ্য নই! বাবা মা ছাড়া আর কাউকে কোনোদিন প্রণাম করবে না। এবং সেদিন ফিরে এসে এতটাই মনটা ভারাক্রান্ত ছিল যে ফিরে আবার কফি হাউস – রিলকে নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করেছিলাম। রিলকের  দিনলিপি – মাল্টি লরেড্‌স্‌ ব্রিগ্‌গে এবং দুয়োনো এলিজি নিয়ে। 

এর কোনো শেষ নেই! অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়ে। এমএ পাস করার পরে আমি একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পেলাম, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, এলাহাবাদে পোস্টিং। গৌতম তখন কলকাতায়। নীল ইনল্যান্ডে চিঠি আসত। বলতে গেলে সেই চিঠির জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম। লাঞ্চ আওয়ারে, ব্যাঙ্কের বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করতে করতে চিঠি পড়তাম। একবার একটা চিঠি এল, তাতে কমলকুমার মজুমদারের মৃত্যুসংবাদ। গৌতম লিখল, কমলকুমারের যে ছবিটা আনন্দবাজারে ছেপেছে সেটা বোধহয় খুব ছোটো বয়সের ছবি। দেখে প্রায় কুস্তিগীরের মতো লাগছে। 

বিদেশে আমি যখন পড়তে গেলাম, ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, গৌতম তখন প্রথম চাকরি পেয়েছে। আমি লিখলাম, তুই খাওয়ালি না? ও তখন একটা ছবি এঁকে দিল – আমি আর গৌতম লী-জনসনে ঢুকছি। দূরে লী-জনসন লেখা, চমৎকার ছবি! 

অসংখ্য চিঠি বিনিময় হয়েছে গৌতমের সঙ্গে। তার মধ্যে সাহিত্য ছাড়াও আরও অনেক কিছু থাকত। একবার মনে আছে, মোহনবাগান আবার শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছে। ১-০ গোলে। মাত্র ১-০ গোল, মানে সেই ৫ গোলের বদলা তো নেওয়া হল না! ও লিখছে, দুটো কারণ – প্রথমত, এক-শূন্য একটা সুচারু ব্যবধান, এস্থেটিক্যালি ডিসেন্ট! আর, দ্বিতীয়ত, আমাদের দয়ার শরীর, আমরা তো বেশি গোল দিতে চাই না! 

তারপর তিরাশি সালে, তখন আমি পড়াশোনা শেষ করে পড়াচ্ছি, একটা ভিসা নিয়ে সমস্যা হল, আমি পাগলামি করে হট করে চলে এলাম। গৌতমও জানত না, কেউই জানত না, আমি খুব অল্প নোটিশে চলে এলাম। চাকরি টাকরি নেই! তো, যেদিন ফিরলাম, এসে  শুনলাম যে সেদিনই গৌতমের বিয়ে! বিয়ের কথা আমাকে কিছুই বলেনি! এটাও শুনলাম যে বিবাহবাসরটা আমাদের বাড়ির খুব কাছে, চারুচন্দ্র কলেজের উল্টোদিকে। আমি পরদিন সকালে গিয়ে হাজির। আমি বললাম, বিয়ে করছিস, বলিসনি তো? ও বলল, একটু লজ্জা করছিল বলতে, তাছাড়া তোকে চমকে দেবো এরকম একটা ইচ্ছেও ছিল! আমি বললাম, যাকগে, বিয়ের দিন যেমন দেখানো উচিত ছেলেদের তোকে ঠিক তেমনই লাগছে! তারপর অবশ্য ওর বৌভাতে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে পরিবার নিয়ে দীঘা বেড়াতে গেছি, তখন মুনিয়া আর আমার ছেলে দুজনেই ছোটো। 

রবীন্দ্র পুরস্কার! হঠাৎ আমাকে জয় গোস্বামী ফোন করে বলল গৌতম এবার রবীন্দ্র পুরস্কার পাচ্ছে। আমি সব বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে জানালাম। সবাই মিলে দারুণ আনন্দ করলাম। খুব খুব আনন্দ হয়েছিল। গৌতমের কবিতা নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু বলব না। কারণ আমার সেই যোগ্যতাও নেই, আর আমার সঙ্গে কবিতার যোগাযোগটাও খুব কমে এসেছে। কিন্তু… সব মানুষেরই তো একটা… আমি জীবনদর্শন কথাটা যদি ব্যবহার করি… একটা জীবনদর্শন থাকে! সেদিক থেকে দেখতে গেলে… যেহেতু গৌতম কে অনেক অনেকদিন ধরে দেখেছি… খুব গভীরভাবে দেখেছি… গৌতমেরও একটা জীবনদর্শন ছিল… আমাদের সবারই আছে। তিনটে বই গৌতমকে ছোটোবেলা থেকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল – একটা হচ্ছে ভিক্টর হুগোর লে মিজেরাবল্‌স্‌, একটা হচ্ছে চার্লস ডিকেন্সের ক্রিসমাস ক্যারল, আরেকটা হচ্ছে দস্তয়েভস্কি’র ব্রাদার্স কারমাজভ। এখন, এই তিনটের যে থিম এবং গৌতম পরে যা নিয়ে লিখেছে যা নিয়ে ভেবেছে তাকে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হবে  – হিউম্যান সাফারিং! মানুষের দুঃখকষ্ট। এটার বাইরে কিছু নিয়ে ও কখনও কিছু ভেবেছে বলে আমার মনে হয় না। ও যা-ই লিখেছে এই জিনিসটাই ঘুরেফিরে এসেছে। এবং মানুষের সাফারিং কেন – মানুষের একটা অপূর্ণতা রয়েছে – সেখান থেকেই সাফারিং! সেই সাফারিং থেকে কি কোনো মুক্তি আছে? সেটা পরের কথা, কিন্তু এই সাফারিংটা না থাকলে কোনো শিল্পকর্মই সম্ভব হত না। আমি প্রমাণ হিসেবে গৌতমেরই একটা ছোট্ট কবিতার বই ‘মঞ্জুশ্রী’ – তার গোড়ায় গৌতম তারকভস্কি থেকে একটা কোটেশন দিয়েছে – তারকভস্কি বলছেন যে –  পৃথিবীটা যদি নিখুঁত হত কোনো উপযোগিতাই থাকত না শিল্পের৷ কারণ মানুষকে তখন সুরসঙ্গতির সন্ধানে ঘুরে মরতে হত না। সর্বব্যাপী এক ঐক্যবোধে সে সর্বদা বিরাজ করতে পারত। এক কুবিন্যস্ত পৃথিবীই শিল্পের উৎপত্তিস্থল। 

অর্থাৎ আমাদের যেহেতু অনেক অসম্পূর্ণতা আছে, এবং তারই একটা দিক হচ্ছে মানুষের দুঃখকষ্ট, সেইজন্যই আমরা শিল্প তৈরি করি। এবং আমার মনে হয়, গৌতমের সমস্ত শিল্পসৃষ্টি সেখান থেকেই। গৌতমের যে কবিতাসমগ্র, তার মলাটে ও মহাভারত থেকে একটা কোটেশন দিয়েছে… এটা ওর খুব প্রিয় জায়গা আমি জানি… সেটা পড়ে আমি শেষ করছি। উতঙ্ক গৌতমমুনির খুব প্রিয় একজন শিষ্য ছিলেন৷ এতই প্রিয় যে গৌতমমুনি উতঙ্ককে ছাড়তে চাইতেন না। এইভাবে দিনের পর দিন যায়, উতঙ্ক বৃদ্ধ হয়ে যান। কিন্তু সে নিজেও টের পেল না যে সে কতটা বৃদ্ধ হয়ে গেছে! তারপর একদিন সে জঙ্গলে কাঠ কেটে আনতে গেছে… ভার আর সে বহন করতে পারছে না… কাঠের ভারে সে নুয়ে পড়েছে… কোনোরকমে আশ্রমে এসে সে কাঠের ভার যখন নামালো একইসঙ্গে তার মাথার একটা চুল ওই কাঠের সঙ্গে নীচে পড়েছে… এবং সেই চুলটা সাদা। সেই সাদা চুল দেখে উতঙ্ক বুঝল যে তার সময় হয়ে এসেছে। তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এল। তখন গৌতমমুনির নির্দেশে তাঁর মেয়ে দুইহাতে সেই অশ্রু ধারণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেই অশ্রুর এতটাই ক্ষমতা যে সে গৌতমমুনির মেয়ের  হাত ভেদ করে ধরিত্রীর উপর পড়ল। এবং মা ধরিত্রী অতি কষ্টে সেই অশ্রু ধারণ করলেন। অর্থাৎ আমাদের এই যে অশ্রু তার বিরাট ক্ষমতা! মস্ত বড়ো ক্ষমতা। এবং সেই ক্ষমতাই শিল্পের উৎস। এটা গৌতম বিশ্বাস করতেন। 

নমস্কার।।                                                                                                          

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment