কৌশিক দত্ত

প্রকৃত সারস

অমলতাস নিতান্ত নিরীহ নয়, সেকথা জানা ছিল। তবুও তো সে বৃক্ষ। সে যে এমন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, ধারণা ছিল না শুভ্রার। অথচ সে দেখেছে গ্রীষ্ম দুপুরের একাকী ব্যাঙ, কেমন সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাফে পুকুরের ঢাল বেয়ে উঠে আসতে আসতে হঠাৎ নেই হয়ে যায়… সহসা সাপের মুখ একবার খোলে, বন্ধ হয়… ধীরে ধীরে ফুলে ওঠে তার গলা, ফোলাটা নামতে থাকে ঘাড় বেয়ে, বুক বেয়ে পেটের দিকে আর ক্রমশ ব্যাঙের স্মৃতি মুছে যায় পুকুরের মানচিত্র থেকে। অশ্রান্ত কাঠঠোকরার পার্কাশনেও এমন গ্রীষ্ম শুনেছে শুভ্রা, বুঝতে শিখেছে কখন অদৃশ্য হয় ছাল-বাকলের আড়াল থেকে এক-একটি পোকা। গ্রীষ্মের দীর্ঘ দ্বিপ্রহর পেরোনো কঠিন, শুভ্রা জানে। সকালের অনেক প্রাণীই সন্ধ্যার আরাত্রিকে আসবে না রোদের পাঁচিল পার হয়ে, এই ব্যর্থতাটুকু কবিমাত্রেই চেনে। তবু এক বৃক্ষ এইভাবে ধৈর্যচ্যুত পাহাড়ের মতো অদ্ভুত আচরণ করবে, ভাবেনি। বৃক্ষকে চিরকাল ভিন্ন এক জীব ভেবেছে সে… প্রাণী নয়, ভাইরাস নয়, প্রবাহী বিরুৎ নয় আলিঙ্গনকারী… বৃক্ষ বৃক্ষই, চিরস্থির। ম্যাকবেথে দেখেছিল বটে জঙ্গল তেড়ে আসছে, কিন্তু সে তো ছলনামাত্র। যেমন আইনস্টাইন থেকে “লিটল বয়”, তেমনই শেক্সপীয়ার থেকে দুনিয়া নিয়ে যুদ্ধের উর্দি পাতা আঁকা। জঙ্গল স্বস্থানেই আছে। সেই স্থিতিতে বৃক্ষ শান্ত, এমনকি অমলতাস, সেও।           

লক ডাউনের একত্রিশে মে। দুপুর প্রায়। দগ্ধ দিল্লির পিচ-সড়ক বিগলিত, ধূমায়মান। এসময়ে এমনিতেই মানুষ বিরল রাজপথে। এবছর আরও প্রকট নিদাঘ শূন্যতা। শুভ্রা বারান্দায় কেন এই তাপে, তা সে নিজেও জানে না। হয়ত অন্দরমহলের স্তব্ধতাকে শহরের নিস্তরঙ্গতায় মিলিয়ে নিতে চায়। পুষ্করের সঙ্গে এই গ্রীষ্মে আর দেখা হবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। দেখা না হলে মিথ্যে হয়ে যাবে না চিনে বাদাম আর মাছরাঙার ঠোঁট। মিথ্যে না হলেই বা কী? সাজানো সত্যের মধ্যে সত্য কতটুকু? মাছরাঙার আদিমতাটুকুই সৎ। মাছের হেরে যাওয়াটুকুই সত্য। দুজনে মিলে সেসব দেখার মধ্যে মহৎ কী ছিল? দৃশ্য মাত্র, যা নির্মাণযোগ্য। দেখার ক্রিয়াটুকুও ছিল কল্পনা আর বুদবুদে জর্জর। স্মৃতির কতটুকু সত্য আর কতটুকু চিত্রকল্প, শুভ্রা বলতে পারে না। পুষ্কর না থাকলে কি শুভ্রা অন্য কিছু দেখত? অন্য এক মাছরাঙা? আরও বাস্তব, আরও তাৎক্ষণিক এক পাখি? অনেক গ্রীষ্ম আগে তাদের দেখা না হলে, চিনে বাদামের মৃত্যু হত অন্য কারও হাতে। এছাড়া আর কি বদলাত কিছুই? এই গ্রীষ্মে দেখা হবে না, শীতেও না, আগামী গ্রীষ্মেও না। পুষ্কর আজ মারা যাবে। অথবা কাল। যন্ত্র তার ফুসফুসে ফুঁ দিয়ে চলেছে হাপরের মতো। হারমোনিয়ামের বেলোর মতো অক্লান্ত হাপর, কিন্তু সুর জেগে উঠছে না। ডাক্তার বলেছে, সময়ের অপেক্ষা। সুস্মিত জানাল সকালে। সময়ে সব অপেক্ষা মুছে যায়। ডাক্তার জানে, সুস্মিতও। ওরা অপেক্ষায় আছে। শুভ্রা অপেক্ষায় নেই। পুষ্করের মরতে দেরী হলে কিছু যায় আসে না। হাসপাতালের বিল মেটানোর দায় শুভ্রার নয়। তার কোনো প্রত্যাশী প্রতীক্ষা নেই। পুষ্কর আজই মারা গেলেও কিছু যায় আসে না। মৃত্যু-প্রতীক্ষার বিপ্রতীপ প্রত্যাশাও নেই শুভ্রার। বস্তুত পুষ্করের প্রসঙ্গটাই অবান্তর, তবু তার মৃত্যুর কল্পনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না শুভ্রা। যেন তার নিভে আসার ধীর যাত্রার ঢালে মিশে আছে এক মাছরাঙার উড়াল, একসঙ্গে নির্মাণ করা এক দৃশ্যকল্প, যার অন্তিমে একটি মাছ কমে যায় হালদার-পুকুরের ভাঁড়ার থেকে। মাত্র একটি মাছ কমে গেলে কিছুই যায়-আসে না দ্রষ্টা শুভ্রার। পুষ্করও বিচলিত হত না। আহত হয়নি কবিতারাও।

এইখানে এসে হোঁচট খায় শুভ্রা। কবিতারা আহত হয়নি। তবে কি সেই পাঁচ বছরে একটাও কবিতা লেখা হয়নি? শুধুই পদ্য লিখে বরাদ্দ সময় খরচ করেছে দুজনে? মাছের মৃত্যুতে বিদ্ধ হয় না যে ছন্দবন্ধ শব্দস্তুপ … একটিমাত্র মাছের নিরুদ্দেশ হওয়ায় বিচলিত, লাইনচ্যুত হয় না যে অক্ষরশৃঙখল, সে কি কবিতা? শুধু মাছরাঙার উড়ালটুকুর মতো আকাশী সৌন্দর্যে অনাবিল ভেসে থাকে যে পদ্য, জল ছোঁয় অমোঘ বঁড়শির মতো অল্প ও অকস্মাৎ, শুধুই প্রত্যাশায়… জলের বুকে বুক রাখে না, জলনিবাসীর ভিটে চেনে না, জল থেকে আলাদা করতে পারে না জলজের অশ্রু… সে কি কবিতা? কবিতাকে নয়, এভাবে নিজেকে সন্দেহ করতে শিখেছিল শুভ্রা, পুষ্করকেও। “পুষ্কর নিকটে গেলে প্রকৃত কবিতা উড়ে যায়।” বিনয়োচিত ভাষ্যে সহাস্যে একদিন পুষ্করকে বলেছিল সে। এটুকু বলতে পারা অব্দি পৌঁছতে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছিল শুভ্রার। পুষ্কর আহত হয়েছিল। হাসিটি অচঞ্চল রেখে পুষ্করের আহত মুখের রেখাচিত্রে মনোনিবেশ করেছিল শুভ্রা। এই আক্রমণ অনিবার্য ছিল, অথচ আঘাতের অভিপ্রায়কে প্রতিজ্ঞা আর প্রতিজ্ঞাকে প্রয়োগে পরিণত করতে পাঁচ বছর লেগেছিল শুভ্রার। এই বাক্যটুকু নির্ভুল নিশানায় গেঁথে দিতে পেরে অতুলনীয় সুখের অনুভূতি হয়েছিল সেদিন… দীর্ঘ পথ বয়ে আনা বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে রাখতে পারা লাল-পোশাক কুলির মতো অথবা সঙ্গমের শীর্ষবিন্দুতে স্খলনকে প্রতিহত করার প্রয়াস ত্যাগ করা পুরুষের মতো। এই অনুভূতি অন্য উপায়ে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। পুষ্করের মুখের বেঁকে যেতে থাকা মসৃণতা বাষ্পকে মুক্তি দিয়েছিল, যে বাষ্প জমে উঠেছিল শুভ্রার সমগ্র জুড়ে রন্ধনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তার অতিরিক্ত পরিমাণে। সেফটি ভালভ খুলে না দিলে বিস্ফোরণ তছনছ করে দিত তার বর্মের সামান্য ইস্পাত। বর্মটুকু ছিঁড়ে গেলে সত্তার নরম মাংস বেড়ালেও খেয়ে যায়, সেই হত্যায় বাঘ লাগে না।

“আমি আপনাদের মতো অজস্র হাবিজাবি লিখি না। পারি না এবং প্রবৃত্তিও হয় না। আমি আজ অব্দি একুশটা গল্প লিখেছি। প্রত্যেকটাই মাস্টারপিস।” ঘর জুড়ে ছড়ানো বইপত্রের মধ্যে বসে বলেছিলেন আটল্লিশ বছরের সুদেষ্ণা সরকার। চেহারা গোলগাল, কথা কাঠকাঠ। সবাইকে “আপনি” বলেন, “তুমি, তুই” আত্মীয়তা নেই। অর্ধেক বয়সের পুষ্কর, শুভ্রাদেরও “আপনি”, কিন্তু সম্বোধনটুকুর বাইরে প্রাপ্যের অতিরিক্ত সম্মান কাউকে দেন না। অন্যের লেখাকে “রাবিশ” চিহ্নিত করতে ইতস্তত করেন না। ভদ্রতার ভারি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে অনীহা, হয়ত সেই কারণেই খ্যাতি তাঁকে বিড়ম্বিত করেনি। নিজের সৃজনশীলতার প্রতিও অকারণ ভদ্র ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না। আটচল্লিশ বছর সময় পেয়ে মাত্র একুশটি ছোটগল্প লিখতে পেরেছেন। অথচ আত্মবিশ্বাসের মাথায় ঘোমটা নেই। “প্রত্যেকটাই মাস্টারপিস!” নিজের লেখা সম্বন্ধে এমন কথা কাউকে কখনো বলতে শোনেনি শুভ্রা, এমনকি নিয়মিত তোষামোদে স্নাত হতে অভ্যস্ত প্রতিষ্ঠান-প্রতীম অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদেরও না।

ফেরার পথে পুষ্কর হাসছিল। “নিজের লেখাকে মাস্টারপিস বলে, তাও আবার প্রত্যেকটাকে। এরা কারা? মাত্র একুশটা গল্প লিখে এত অহংকার!”

শুভ্রা তর্ক এড়িয়েছে। সে আসলে মোহিত হয়েছিল, কিন্তু পুষ্করের হাসির কারণে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে পারেনি। “অহংকার থাকলে মাত্র একুশে আটকে থাকত না রে,” নিরুচ্চারে ভেবেছিল। হয়ত বছরে একটিমাত্র গল্প লেখেন মহিলা এবং সেই একমাত্র গল্পটিকে সযত্নে, সগর্বে সাজিয়ে রাখেন। প্রত্যেকেই তারা এক একটি অভিজ্ঞান, এক এক যোজন পেরিয়ে যাবার উজ্জ্বল ফলক। অমাবস্যার রাতেও হেডলাইটের আলোয় তারা জ্বলে ওঠে হাইওয়ের ধারে… ঊনিশ, কুড়ি, একুশ। প্রত্যেকটাই মাস্টারপিস। এই উদ্ধত উচ্চারণে পৌঁছতে লেখককে, নারীকে কতটা পথ আর পাথর ডিঙোতে হয়, পুষ্কর তার কী জানে? ঠিক দুদিন আগেই শনিবার সন্ধ্যার আড্ডায় শুভ্রার পায়ের সামনে পাথর নামিয়ে রেখেছিলেন মৃণালদা। “কবি না, বলো মহিলা কবি।” সকলে হেসে উঠেছিল শুভ্রা আর পুষ্কর ছাড়া। “কিছু মনে কোরো না,” বিনীত হন কবি মৃণাল গুপ্ত, “মেয়েদের লেখালেখির ব্যাপারে আমি খুবই উৎসাহী, মানে তাদের উৎসাহ দিই। দেওয়াই তো উচিত, কবিতা সবার আর লেখার অধিকারও সকলেরই আছে। তবু, কী বলব, মেয়েদের লেখা প্রায় কখনওই সীমানা পেরিয়ে কাব্যের চিরন্তনতায়, উদার প্রশান্তিতে পৌঁছতে পারে না। শেষ অব্দি ওই মহিলা কবি বলেই তাদের চেনা যায়।” আবার একচোট সমর্থনসূচক হাসি।

মৃণালদা একজন সমাদৃত কবি। এই সময়ে প্রবীণ কবিদের মধ্যে যে কজনকে কবি বলা চলে, তাঁদের একজন। ভালোমানুষ, আপনভোলা। কর্মজীবনে সাংবাদিক হিসেবে সৎ ছিলেন। চরিত্র নিয়ে বদনাম নেই, ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতেও নেই। তরুণীরা তাঁর উপস্থিতিতে শারীরিকভাবে নিরাপদ। সেই মৃণালদাও এমন কথা বলেন! শুনে আমোদ পায় যারা, তারাও সকলে শিক্ষিত, সাহিত্যরসিক এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে জন্মানো তরুণ। ঘরময় গুঞ্জনের মধ্যে কুঁকড়ে যেতে যেতে তুলনামূলক সাহিত্যের উজ্জ্বল ছাত্রী কবি শুভ্রা বসাক ধীরেধীরে মহিলা কবি হয়ে যাচ্ছিল। পুষ্কর একবার শুভ্রার দিকে তাকিয়ে মৃদু আপত্তি তুলেছিল মৃণালদার কথার পিঠে। বড় বেশি মৃদু কণ্ঠস্বর, যা কোলাহলে ডুবে যাবার জন্যেই ক্ষণিক ধ্বনিত হয়। পুষ্কর এর চেয়ে জোরে প্রতিবাদ জানাতে শেখেনি, অথবা ভয় পেয়েছিল প্রবীণ কবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দলছুট হতে। মেরুদণ্ড মজবুত হয়নি। নিজের কলমের ওপর যতখানি ভরসা এলে জোটের প্রয়োজন ফুরোয়, তাও আসেনি, অথচ কবিযশোপ্রার্থীর তালিকায় নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে। এই তালিকায় নাম উঠে গেলে প্রার্থনায় হাত জোড় হয়ে যায় আপনা-আপনি। কলমের বদলে হাতে উঠে আসে ছিপ। মাছটির জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকতে হয় চুপচাপ, তখন জোরে শব্দ করা চলে না।

পুষ্করকে দেখছিল শুভ্রা। তার কণ্ঠস্বরের ডুবে যাওয়া শুনছিল। বান্ধবী আর আইকনকে যুগপৎ তুষ্ট রাখার নাজেহাল চেষ্টায় এক কবির সাঁতার ভুলে যাওয়া দেখছিল। টেবিল চাপড়ে তর্ক করতে পারল না, সোজা উঠে দাঁড়িয়ে আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে যেতেও সাহস পেল না। শুভ্রাও বেরিয়ে যেতে পারেনি সেদিন, কিন্তু সকলের অলক্ষে তার বসার চেয়ারটি পিছলে যেতে থাকে। প্রথমে ঘরের এক কোণায়, তারপর অন্ধকারে, তারপর দেওয়াল ভেদ করে তিনতলার বরাদ্দ আকাশটুকু আঁকড়ে পিছন দিকে হাওয়া সাঁতরে সেই কোণঠাসা অপমানিত চেয়ার এক মহিলা কবিকে নিয়ে শহরের সন্ধ্যায় ভেসে যাচ্ছিল মৃণাল গুপ্ত আর পুষ্কর চট্টোপাধ্যায়ের থেকে অনেক দূরে।

ফেরার পথে এ নিয়ে কোনো কথা তোলেনি শুভ্রা, কিন্তু নিজে থেকেই ইনিয়েবিনিয়ে বিস্তর ক্ষমা চেয়েছিল পুষ্কর। সবার সামনে যা বলতে পারেনি, সেসব কথা বলেছিল। মৃণালদার মানসিক সংকীর্ণতার কথা স্বীকার করে এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবার পরামর্শ দিয়েছিল। শুভ্রা উত্তর দেয়নি। শহরের পদপিষ্ট ধুলোর গন্ধ শুঁকছিল চুপচাপ। বেনিয়াটোলার বাতাসে ঘামের গুঁড়ো ভেসে বেড়াচ্ছে অচেনা মানুষের। তার স্পর্শে খানিক স্বস্তি বোধ করছিল শুভ্রা। পুষ্কর ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি, পারলে অগ্রাহ্য করার কথা বলত না। প্রকৃতি মানুষকে দুটো করে কান দিয়েছে শুধু শরীরের ভারসাম্য রক্ষা আর ভালো মন্দ দুরকম কথা আলাদাভাবে শোনার জন্যই নয়, অপমানে লাল হয়ে ওঠার জন্যেও। রেড ফ্ল্যাগ। সংকেত। সাবধান। ওখানেই থামো, এগিয়ো না আর। এদিকের এলাকা নিষিদ্ধ এখন। পুষ্করের পাশে হাঁটতে হাঁটতে শুভ্রা ক্রমশ মহিলা কবি হয়ে ওঠার প্রয়োজন অনুভব করে। সেটাই হবে তার আইডেন্টিটি, তার নিজস্ব কলম আর কালি। পুরুষ কবি আর মহিলা কবি, দুটো আলাদা শিবির, আলাদা সত্তা। যতদিন পৃথিবী জুড়ে পুরুষ কবিরা সদম্ভে পায়চারি করছে, ততদিন কুচকাওয়াজে প্রয়োজন বহু মহিলা কবির, যারা শুধুমাত্র কবি না হয়ে মহিলা কবি হয়ে ওঠার সাধনা করবে প্রতিষ্ঠা বাজি রেখে। সেই রাত থেকেই কাব্যের উদার প্রশান্তিকে ঘৃণা করে শুভ্রা, ঘৃণা করে পুষ্করদের সেসব পদ্যকেও যারা উদার শান্তিতে ভরপুর। তার দুদিন পরেই পুষ্করকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সুদেষ্ণাদির বাড়ি। মহিলা গদ্যকার। সমবায়হীন, একক, দর্পিত। “আপনাদের মতো অজস্র হাবিজাবি লিখি না।” পুষ্করের বদলে মৃণালদাকেও একই উচ্চারণে বলে দিতেন নিশ্চিত।

এখন দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে কোলকাতার হাসপাতালে বিনা প্রতিবাদে পুষ্কর মরে যাচ্ছে। আক্রমণটা শুভ্রার বদলে তার নিজের ওপরে হলেও সে বিশেষ লড়তে পারে না দেখা গেল। কোমাচ্ছন্ন, সুস্মিত বলছিল। করোনার আঁচড়ে ফুসফুস ঝাঁঝরা। গলায় নল। শ্বাসের আউটসোর্সিং করে দিয়েছে ডাক্তার। ফুসফুস ফেটে নাকি বুকের খাঁচার ভেতর হাওয়া জমেছে বেজায়গায়। পাঁজরের ফাঁকে মাংস কেটে দু’দিকে দুটো প্লাস্টিকের নল দিয়ে হাওয়া বের করা হচ্ছে, তবে ফুসফুসে জায়গা পাচ্ছে যন্ত্রের ধার দেওয়া অক্সিজেন। পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস হয়েছে একবার, কিন্তু দ্বিতীয়বারের ধকল নিতে পারবে না বলেই ডাক্তারদের ধারণা। রক্তচাপ নুয়ে পড়েছে পুষ্করের মেরুদণ্ডের মতো। কীসব ইঞ্জেকশন দিয়ে কোনোক্রমে আটকানো হয়েছে তার মুখ থুবড়ে পড়া। চোখ খোলা বা সাড়া দেবার কোনো লক্ষণ নেই। এসব খবর এতদিন পর শুভ্রার জানা দরকার বলে কেন সুস্মিতের মনে হল, তা সেই জানে। হয়ত পুরুষ বলেই তার ধারণা প্রাক্তন প্রেমিককে স্মৃতিতেও অতিক্রম করে অনিরুদ্ধ এগিয়ে যাওয়া কোনো নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। এই রোমান্টিক কল্পনা অবলম্বন করেই এরা বাঁচে, ভেবে করুণা অনুভব করে শুভ্রা, পুষ্করের বদলে সুস্মিতের জন্য। অথবা মূলত পুষ্করের বন্ধু হিসেবে তার মনে হয়েছে শুভ্রাকে একেবারে বিব্রত না করে মরে যাওয়া পুষ্করের পক্ষে ঠিক নয়। বান্ধবীর অন্তত একটা বেলা বরবাদ করে সে শেষবার নিজের অন্তিম উপস্থিতিটুকু জানান দিতে পারে অন্য কাউকে কিছু জানানোর ক্ষমতা হারানোর পরেও।

পুষ্করের খবরে একটা গোটা সকাল নষ্ট হবার কোনো কারণ নেই। বিশেষ কোনো কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে না, তবু প্রসঙ্গটা ভাবনায় ঢুকে পড়ছে বারবার। সেই হিসেবে সুস্মিত সফল, পুষ্করও। কিছুটা সময় তারা অগোছালো করে দিতে পেরেছে। সকালে যে প্রবন্ধটা শেষ করার কথা ছিল, সেটা হয়নি। অবশ্য জানতে পেরে ভালোও হয়েছে এক অর্থে। পুষরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দেবার ছিল শুভ্রারও। বলার সুযোগ হয়নি এর আগে, পরেও আর হবে না কোনোদিন। এইবেলা বলে ফেলা ভালো। পুষ্কর উত্তর দিতে পারবে না। তার প্রয়োজনও নেই, কিন্তু শোনার ক্ষমতাও কি একেবারে হারিয়েছে সে? গভীর অজ্ঞান মস্তিষ্কেও নাকি কিছু কিছু সংবেদন বাকি থাকে, শুভ্রা শুনেছে। চেতনার স্তরে কিছুই পৌঁছায় না, ফলে বুঝতে পারে না হয়ত, কিন্তু টের পায়। শুনতেও পায় কি? চেষ্টা করে দেখা যাক। লোহার বিছানায় শোয়া পুষ্করের অচেতন অথচ জীবিত দেহটা কল্পনা করে শুভ্রা। তারপর তার কানের একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে কেটে কেটে বলে, “শোনো পুষ্কর চট্টোপাধ্যায়, গত তিন বছরে আমি মোট ঊনত্রিশটা কবিতা লিখেছি। প্রত্যেকটাই মাস্টারপিস এবং তাতে তোমার অবদান শূন্য। আমার জীবন আমি গড়ে নিচ্ছি দূরের শহরে। একা গড়ছি। সেখানেও তোমার কোনো ভূমিকা নেই। মৃত্যু তোমার কোনো কাজে লাগবে না, কারণ তুমি বেঁচে থাকতেই আমি সম্পূর্ণ একা নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছি। ইউ আর লেট পুষ্কর, ইউ লস্ট দ্য বার্গেইন।”

মৃত্যু অথবা তার সম্ভাবনা একসময় পুষ্করের হাতিয়ার হয়ে উঠছিল। সম্পর্কটা ক্রমশ ফুটো নৌকোর মতো তলিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর অনিবার্যতায় ক্ষীণতর হতে হতে বিলয়ের পথে যাচ্ছে উদ্ধারের সম্ভাবনা… একথা বুঝতে পেরে — চিকিৎসক নয় তো সে — “খুব বেশি হলে আর চারমাস” ঘোষণা করে সত্যকে তার নিরাবরণ নিষ্ঠুরতায় সকলের সামনে উপস্থিত না করে বরং লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল আমচোর বালকের মতো। অথচ মৃত্যুর বিরুদ্ধে চিকিৎসকই লড়তে পারে না যথাযথ, বৃদ্ধ ক্ষয়রোগীর সন্ত্রস্ত সন্তান কীভাবে দাঁড়াবে? দুর্যোধন মৃত্যুর বিরুদ্ধে অগত্যা সে মৃত্যুকেই ঢাল বানায়। “তাড়াহুড়ো খুব? আমি খুব চটপট মরে যাব, দেখে নিয়ো। সেই কটা দিন অপেক্ষা করলে হত না? তাহলে সম্পর্কটা মরত না আমার জিয়ন্তে।”

পুষ্কর তখনো বিশ্বাস করত, ভালোবাসাকে সে একক চেষ্টায় বাঁচাতে পারে এবং শুভ্রা তাতে বাধা দেবে না। তার ধারণা ছিল, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা শুভ্রাকে বিচলিত করবে, তার পথরোধ করবে অনায়াসে। কেন করবে? নিশ্চয় সে বিশ্বাস করত যে তার জীবন ও মৃত্যু শুভ্রার জীবনেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু, অত্যন্ত প্রভাবশালী কোনো বিষয়। কোথা থেকে আসত এই শিশুসুলভ আস্থা? শিশুসুলভ অবশ্যই, কারণ শিশুর মতোই সে নিজেকে শুভ্রার ভাবনার কেন্দ্রে কল্পনা করেছিল নিশ্চিতভাবে। শৈশবের আত্মমগ্নতা ছাড়া এমন অযৌক্তিক বিশ্বাস কি আসে? নাকি পুরুষের এই শৈশবটুকু যায় না? নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে থাকার বিলাসটুকুই হয়ত পৌরুষ। এই বিশ্বাস, এই গুরুত্ব আর প্রভাবের কল্পনাকে অতুলনীয় রোম্যান্টিক ভাবত পুষ্কর, তা তার কথাবার্তা থেকে বোঝা যেত স্পষ্ট। অথচ তার এই সারল্য, এই শিশুসুলভ অরাজনৈতিক বিশ্বাসই ছিল শুভ্রার সবচেয়ে বড় বিরক্তির কারণ। শুভ্রা যত বেশি করে বাস্তবের পাথুরে জমিতে লোহার শিকড় গেঁথে গেঁথে বৃক্ষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করছিল, পুষ্কর ততই তাকে ঘিরে ভাবালু হয়ে উঠছিল। এসব রঙিন মিথ ও মিথ্যা নিয়ে কেউ নিজের জগতে আলাদা থাকলে তাকে সন্তর্পণে অবজ্ঞা করে স্বপথে এগোনো যায়, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে অপরকেও আবেগের চাদরে জড়িয়ে ফেলতে থাকলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয় ঋজু পদাতিককেও। সে বড় বিরক্তিকর। জীবন থেকে, পড়াশোনা থেকে যাকিছু শুভ্রা শিখেছে, যাকে সত্য বলে জেনেছে, যে মৌলিক বোধের শক্ত কাণ্ডের ভরসায় তার মনন সবে ডালপালা মেলছে, মুহুর্মুহু মিথের আক্রমণে তাকেই যেন মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা। এরকম ভালোবাসা শুভ্রা চায়নি। এতে শান্তির চেয়ে বিভ্রান্তি বেশি। নিজের অর্জিত জ্ঞান আর বোধের ওপর বিশ্বাস টলে যায়। এই চেয়ে হয়ত প্রেমহীনতা, রূঢ়তা ভালো ছিল। পুষ্কর যদি আরও খারাপ মানুষ হত, আত্মম্ভরী হত বা অত্যাচারী, তাহলে বোধহয় তার সঙ্গে লড়াই করা সহজতর হত। তেমন লড়াইয়ের একটা চেনা ছক ছিল। ঠিক কেমন হলে ভালো হত, তা শুভ্রা জানে না, কিন্তু এরকমটা সে চায়নি, এটুকু জানে। যে বিক্ষোভ জমে ওঠে, কিন্তু প্রকাশ করার উপায় থাকে না, তার চেয়ে বেশি ক্লেশদায়ক আর কী আছে?

“তোমার যা শিক্ষা, ভাবনা, রাজনীতি, সব ঠিক। সাধারণভাবে দুনিয়ার কথা ভাবলে একদম ঠিক তুমি, কিন্তু প্রত্যেক মানুষ বা প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই কি সব তত্ত্ব একইভাবে প্রযোজ্য? সুন্দর সম্পর্ক কি নেই মানুষে মানুষে, নরেতে নারীতে? প্রত্যেকটা মানুষ কি আলাদা নয়? আইন তো লিপিবদ্ধ আছে কেতাবে, তা বলে প্রতিটি কেসের বিচার কি আলাদাভাবে হয় না? তোমার রাজনৈতিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কটুকু, আমাদের ভালোবাসাটুকু নিয়ে কি তারও ঊর্ধ্বে এক অন্য স্তরে উঠতে পারি না আমরা? এই পবিত্র ভূমিটুকুতে না হয় রাজনীতি আর বিশ্লেষণ নাই বা এল। নিজেদের মতো করে একটু বাঁচলাম।” এই ছিল পুষ্করের কৌশল। এটাই তার রাজনীতি। কিছু আপাতগ্রাহ্য যুক্তিকে ট্রয়ের ঘোড়ার মতো ব্যবহার করে নিজের আবদারটিকে পাঁচিল পার করে দুর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া। এই কৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। শুভ্রার সদাজাগরুক সত্তা আর অভিজ্ঞতাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায় পুষ্কর। সম্পর্কের মধ্যে প্রশ্নের জেগে থাকা তার কাছে অপ্রেম। তুমি কি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রেমিক ভাবো পুষ্কর? এতই যদি আত্মবিশ্বাসী, তাহলে বিশ্লেষণ আর রাজনীতিকে ভয় পাও কেন? তাদের মুখের ওপর বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিতে চাও কেন? তাদের নজরদারি এড়িয়ে আসলে কী করতে চাও তুমি? মিথ্যে বোলো না পুষ্কর, এই এড়িয়ে যাওয়াই তোমার নিজস্ব রাজনীতি। বন্ধ দরজার আড়ালে শুভ্রার রাজনীতিকে ব্রাত্য করে নিজের রোম্যান্টিকতার রাজনীতিকেই একচ্ছত্র করতে চাও তুমি। তুমি একা নও পুষ্কর, অনেকেই এভাবে নিজের রাজ্যপাট বাঁচায়। এই ছকটাও তাই চেনা। তুমি স্বীকার করো বা না করো, যেকোনো যৌথ যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি চলন রাজনৈতিক… কে প্রথম চুম্বনের আগ্রহ ব্যক্ত করবে, সেটাও। প্রেম সেই রাজনৈতিক বিশ্বের একটা মিনার মাত্র। রাজনীতিটুকু ঝেড়ে ফেললে সম্পর্কের মধ্যে আর কিছু থাকে না। বিশুদ্ধ রোম্যান্টিকতার মধ্যে কোনো রোমান্স বা রোমাঞ্চ নেই, মৃণালদার কাব্যিক প্রশান্তির মতোই তার অন্তর সারশূন্য।

“তুমি অন্যায় করছ পুষ্কর। তুমি যা দাবি করছ, তা অন্যায্য। ইতিহাস আমাদের জন্য অরাজনৈতিক প্রেমের দরজা খোলা রাখেনি, অথবা রেখেছে শুধু চোখ বেঁধে অন্ধকূপে ঝাঁপ দেবার জন্য। সেটাই করতে বলছ? সামান্য ভোটাধিকার বা সম্পত্তির অধিকারটুকু পাওয়ার জন্য মেয়েদের কম লড়তে হয়নি। এই যে পড়াশোনা, লেখালেখি করতে পারছি, তুমি আমার চুলের মুঠি না ধরে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হচ্ছ, বিয়ে না করেই তোমার সঙ্গে আছি, এই অধিকারটুকু আমাকে আদায় করে দিয়েছেন অনেকে মিলে অনেক লড়াই করে। তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব তোমার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে? নিজেকে এত মূল্যবান ভাবো কেন?”

কথার প্রথম অংশে যুক্তি, শেষটুকু খোঁচা। সুযোগ পেলেই পুষ্করের পৌরুষ আর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করার লোভ সামলাতে পারে না শুভ্রা। এই না পারাটুকু কি শুভ্রার দুর্বলতা? পুষ্কর অন্য মানুষের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে তার জীবনে অবস্থান করছে বলেই হয়ত বাকি সবাইকে ভদ্রভাবে অগ্রাহ্য করলেও পুষ্করকে বারবার আঘাত করা জরুরি হয়ে পড়ে। পুষ্করের এই চওড়া অবস্থানটা আসলে এক অবরোধ। এই বদ্ধ ঘরের বাইরে শুভ্রা দেখতে পাচ্ছে এক অপার বিশ্ব, যেখানে এই গৃহকোণের মতো নিরিবিলি আদর নেই, বদলে সংঘাত আছে, কেটে-ছড়ে যাওয়া আছে, কিন্তু আঘাতের সঙ্গে মিশে আছে সত্য, যার আবহমান সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব নিজের চেষ্টায়। শুভ্রা সেখানে যেতে চাইছে, সেই সত্যকে পেতে চাইছে। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্কর। শুভ্রাকে জগত দেখতে দিতে চায় না বা প্রতিষ্ঠা পেতে দিতে চায় না, এমন নয়, কিন্তু তাকে অনাদরের দুনিয়ায় একা ছেড়ে দিতে ভয় পায়। অথচ সেটাই শুভ্রার প্রয়োজন। সেই অনিশ্চয়তা, অবন্ধু বাস্তবের রূঢ়তাই তাকে ঘষে মেজে পূর্ণ মানুষ করে তুলবে আর তবেই সে খুঁজে পাবে সেই কবিতাকে, যা তার একমাত্র ইষ্ট। পুষ্করকে সঙ্গে নিয়ে সেই সন্ধান আর সাধনা সম্ভব নয়, সেকথা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিল শুভ্রা। সর্বত্র সে আগলে রাখতে চেষ্টা করবে, আড়াল করতে চাইবে চোট-আঘাত থেকে আর একের পর এক শুভ্রার হাতছাড়া হয়ে যাবে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ।

শুভ্রা চাইত নিরাশ্রয় হয়ে শীতের রাতে উত্তুরে হাওয়ার মুখোমুখি বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে আর পুষ্কর ভাবত কীভাবে চাদর মুড়ি দিয়ে হিম থেকে রক্ষা করবে প্রিয় নারীটিকে! তার চাদর থেকে মুক্তি না পেলে শীত চেনা হবে না, শুকনো চামড়া, ফেটে ওঠা গালের কাব্য অধরা থেকে যাবে, এই দুশ্চিন্তায় চাদর ছেঁড়ার চেষ্টায় থাকত শুভ্রা। হতাশ লাগত, আবার হাসিও পেত। শিরদাঁড়া নোয়াতে ভুলে যাওয়া এক যুযুৎসু মেয়ের আশ্রয় হয়ে উঠতে চায় এমন এক পুরুষ, যার মেরুদণ্ড শক্ত হয়নি! এর থেকে বড় প্রহসন কোন নাট্যকার কবে লিখেছেন?

এই লোকটার সঙ্গে সুখে সংসার করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু নিজেকে খুঁজে পেতে চাইলে এই প্রেমের বলয় ছিঁড়ে বেরোতে হবে, ছেড়ে যেতেই হবে পুষ্করকে। এই উপলব্ধি সিদ্ধান্ত হয়ে উঠেছিল ততদিনে, কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। প্রেমে বিশ্বাস হারানো সহজ, কিন্তু ভালবাসার কাঁটাতারের ফাঁক গলে পালানো কঠিন। ক্ষতচিহ্ন থেকেই যায়। ছেলেটাও ভালবাসত প্রাণপণ। বড় তরল আর জাগরুক সেই ভালবাসা, সর্বদাই ঢেউ এসে লাগে গায়ে। উপরন্তু কবি হলে যা হয়, প্রকাশ অফুরন্ত। বিরক্ত হত শুভ্রা। “এসব রেটরিক আমার ভালো লাগে না,” বলেছিল সে। “অপরকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসার কথা যারা বলে, তাদের আমি বিশ্বাস করি না। বাস্তব সমস্যায় কার কতটুকু ভূমিকা, সেটাই আমার কাছে বিচার্য।” পুষ্করের দেখনদারিকে সন্দেহ করেই শুধু নয়, হয়ত নিজের তরফের ভালবাসাটাকে কাবু করার জন্যেও তাকে বলতে হয়েছিল এসব। পুষ্করকে আঘাত করার মধ্যে নিজেরও যন্ত্রণা ছিল, ছিল সেই ব্যথার একরকম নেশা। 

এই কথাটা বলেই বোধহয় সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল শুভ্রা। শুরু হল বাস্তব প্রেম। শুভ্রাকে “সাহায্য” করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুষ্কর। পড়াশোনা লেখালেখির নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ দেবার জন্য শুভ্রাকে যাবতীয় গৃহকর্ম থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দিতে সে বদ্ধপরিকর, এই মর্মে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়ে রান্নাবান্না শিখে ফেলে গেরস্থালীর সম্পূর্ণ দখল নিতে চেষ্টা করল পুষ্কর। “তোমাকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, তুমি নিজের কাজটা করো মন দিয়ে।” এই সুযোগের প্রত্যাশা শুভ্রার ছিল কিনা, সেকথা জিজ্ঞাসা করেনি। রান্নাঘর শুভ্রার প্রিয় জায়গা নয় কোনোকালে, সুতরাং অব্যাহতি পেলে সমস্যা হবার কথা নয়, কিন্তু সাহায্যের আস্ফালন সহ্য করা গেরস্থালী সামলানোর চেয়েও কষ্টকর। পুষ্কর আদরে মানুষ, কিন্তু শৈশবে মাতৃহারা শুভ্রা নিজেই নিজেকে বড় করেছে। আর্থিক নিশ্চয়তা আর স্বাধীনতা ছাড়া আর বিশেষ কিছু পায়নি গবেষণা-পাগল অধ্যাপক বাবার কাছে। জীবনের যা কিছু অর্জন, সব একক প্রচেষ্টায়, এই অহংকারটুকুই তার মেরুদণ্ড। প্রয়োজন ফুরোনোর পর হঠাৎ একজন এক ঝুড়ি সাহায্য সাজিয়ে এনে সেই কৃতিত্বের ভাগিদার হতে চাইছে তার ইতিহাসকে নাকচ করে! দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াত শুভ্রা সাহায্যের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য। পুষ্কর বুঝত না। বুঝতে না চাওয়ার শপথটুকু ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল কি তার? নিজের অক্ষমতা সে জানত। শুভ্রা তখন পিএইচডি করছে। কবিতার পাশাপাশি লিখছে গল্প, প্রবন্ধ। নিয়মিত অনুরোধ আসে নতুন লেখার। পুষ্কর এগোতে পারেনি। শিক্ষকতার চাকরি জোটাতে না পেরে প্রাইভেট কোম্পানির দশটা-পাঁচটা। শুভ্রা ঘুমিয়ে পড়লে রাত আর চাঁদ সাক্ষী রেখে যা লেখে, নির্দিষ্ট কিছু ছোট পত্রিকার পাতায় উঁকি মারে মাঝেমাঝে। সেসব কাগজের পাঠক নেই, ঠেলাঠেলি করে যে পঞ্চাশ কপি বিক্রি হয়, তার অধিকাংশ ঘুমিয়ে থাকে ধুলোর আস্তরণে। বইমেলায় শুভ্রাকে টেনে নিয়ে যায় অল্প পরিচিত লোকজন নিজেদের স্টলে বা আড্ডায়, পুষ্করকে কেউ চিনতে পারে না। অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সঙ্গিনী ক্রমশ দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবে, সে বোঝে। ভয় পায়। সেই মেয়েটির হাত ধরে থাকতে চাইলে ত্রাতার ছদ্মবেশ ছাড়া অন্য অবলম্বন ছিল না তার। সম্পর্ক থেকে খসে পড়লে খাদের আগে আর বুঝি কোনো নুয়ে পড়া গাছের ডাল নেই ঝুলে থাকার মতো। অন্ধকারকে ভয় পেত পুষ্কর, খাদকে ভয় পেত। এই মেয়েটির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাই ছিল লঙ্গরখানার কুপন। ওইটে না দেখাতে পারলে তাড়িয়ে দেবে। পুষ্কর কি মনে মনে শুভ্রাকে ঈর্ষা করত? নিশ্চয় করত। প্রকাশ না করার মতো বুদ্ধি তার ছিল, কিন্তু ঈর্ষাকাতর নয় এমন কোনো পরাজিত পুরুষ দেখেনি শুভ্রা জীবনে। পুষ্কর পুরুষ ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ঈর্ষা পুরুষের ভূষণ।

পুরুষেরা নিজেদের কেরিয়ারকেই এগিয়ে রাখে, পিছিয়ে যেতে হয় স্ত্রীকেই… এই মর্মে একটা প্রবন্ধ লিখতে হয়েছিল শুভ্রাকে। তার দুদিন পর শুভ্রাকে এগিয়ে দেবার জন্য নিজে সাহিত্যচর্চা বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে পুষ্কর। মহান আত্মত্যাগী সাজার এই বিলাসী প্রস্তাবে প্রবল অপমানিত বোধ করেছিল শুভ্রা।

“কী মনে করো তুমি? তোমার সঙ্গে আমার কম্পিটিশন? তুমি লেখা ছেড়ে দেবে, তবে আমি লিখব? তবে লোকে আমার লেখা পড়বে? তুমি বা তোমরা লিখলে আমরা আর পাত্তাই পাব না মনে করো?”

“তা নয়। আসলে তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো লেখো, তাই আমি নিজে কলম ঘষে সময় নষ্ট করার বদলে যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, তাহলে সাহিত্যের অনেক বেশি উপকার হবে।”

কথাটা সত্যি, তা শুভ্রাও জানে। পুষ্করের তুলনায় সে বহুগুণ ভালো লেখে, এই বিশ্বাস তার নিজেরও আছে। বস্তুত পুষ্করের লেখালেখিকে সে ধর্তব্যের মধ্যেও আনে না। পড়ে সময় নষ্ট করে না, যদি না পুষ্কর ঘ্যানঘ্যান করে পড়তে বাধ্য করে। তার সঙ্গে নিজের তুলনা করার প্রশ্নই নেই, তাতে অকারণ আত্মশ্লাঘা জন্মাবে শুধু। তুলনা করা উচিত বৃহতের সঙ্গে। বরং মৃণালদার সঙ্গে নিজের লেখার তুলনা করা বেশি কাজের। মানুষটাকে অপছন্দ হলেও তাঁর লেখার মধ্যে শেখার রসদ আছে, যা পুষ্করের নেই। পুষ্কর লেখা ছেড়ে দিলে সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হবে না। তার মতো অনেকে সরে গেলে লাভই হবে এক অর্থে, আবর্জনার স্তুপ থেকে ভালো লেখা খুঁজে বের করার পরিশ্রম কমবে। শুভ্রার সমস্যা ছিল অন্যত্র। শুভ্রাকে এগিয়ে দেবার জন্য লেখা ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যর্থতা লুকিয়ে পুষ্করের মহান সাজার চেষ্টাও একধরনের আক্রমণ। দুজনে পাশাপাশি লিখতে থাকলেই পাঠক বুঝতে পারবে কে লেখক আর কে নয়। সেই দৃষ্টিপাত থেকে পালিয়ে “আহা রে, মেয়েটার জন্য নিজের চোখ থেকে স্বপ্ন মুছে ফেলল অসামান্য প্রেমিক” আক্ষেপ সুরভিত সমবেদনার কোটরে লুকোতে চাইছে ছেলেটা, একথা বুঝেই রুখে দাঁড়িয়েছিল শুভ্রা। পাঁচ মাইল পিছিয়ে পড়েছে যে সঙ্গী, শীর্ষাভিযাত্রীকে এগিয়ে দেবার ভান করে হাততালি কুড়োবে সেই? সাহিত্যসভা থেকে পুষ্কর হারিয়ে যাবেই অচিরে, শুভ্রা নিশ্চিত জানত। তার আগেই দূরে সরে যাওয়া প্রয়োজন ছিল, যাতে নিজের ব্যর্থতার দায় সে সঙ্গিনীর কাঁধে চাপাতে না পারে।

দিল্লির চাকরিটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল শুভ্রাকে। পিএইচডির থিসিস জমা দিতে না দিতেই পেয়ে গিয়েছিল কাজটা। লুফে নিতে দেরি করেনি। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে অনেকটা পুষ্করহীন নিঃসঙ্গ আকাশ। ডানার ব্যায়াম লেখা মেঘে। পালক ফুলিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বৃষ্টি ঝেড়ে ডানা শুকিয়ে নিচ্ছিল শুভ্রা। সন্তর্পণে ভেজাতে এল পুষ্কর।

“কোলকাতা ছেড়ে এতদূর যাবে? তোমার লেখালেখির কী হবে? এখানে এতটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে তোমার! একটা চাকরির জন্যে সব ছেড়ে…”

“চাকরিটা আমার প্রয়োজন। আমি করব।”

“এখানেও পেয়ে যাবে কদিন বাদে। ততদিন আমি তো আছিই।”

“তুমি নেই পুষ্কর, কারণ তোমার ভরসায় আমি নেই। আমি ওখানেই যেতে চাই।”

“কটা দিনের তো ব্যাপার। এর জন্য নিজের পরিমণ্ডল ছেড়ে চলে যাবে? ব্যবসায়ীরা যেমন বেশি ভাড়া দিয়ে গুরগাঁও আর গোরেগাঁওতে অফিস খোলে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জন্য, বাঙলা সাহিত্যেও তেমনি কোলকাতার একটা অফিস লাগে। জানোই তো।”

“কে বলেছে তোমাকে যে আমি এই শহরের কৃপায় প্রতিষ্ঠা পেতে চাই? দিল্লিতে বসেই লিখব। তোমাদের বাঙলা সাহিত্য ভৌগলিক সীমায় আটকে গেলে ইংরেজিতে লিখব, ফরাসী ভাষায় লিখব। তারপর ফের বাঙলাতেও। কোলকাতার অফিসটা তুমি রাখো। তোমার কাজে লাগবে। রোজ গা ঘষাঘষি করলে দু-চারটে পদ্য এদিক-ওদিক বন্ধুমহলে ছেপে বেরোবে। কবি পুষ্কর চাটুজ্জে গলা খাঁকারি দিয়ে স্বরচিত কবিতা পড়বে বেহালা বইমেলায়। ওটা তোমার স্বপ্ন, আমার নয়।”

“এভাবে পালানো কি খুব জরুরি? আমি খুব তাড়াতাড়ি…”

পূর্বা এক্সপ্রেস মোগলসরাই পেরোতে সেই যে ঘুম নেমে এল ঘূর্ণমান পাখার হাওয়া বেয়ে আপার বার্থে অব্যর্থ, তার মধ্যে হিজিবিজি স্বপ্নে অনিতা এল, স্বরূপ ছিল তার সঙ্গে, প্রমিলা ভরদ্বাজ শুভ্রার বাবার সঙ্গে কী যেন আলোচনা করছিলেন, এমনকি মাছরাঙাটাও উড়ে গেল একবার, কিন্তু পুষ্কর এল না। তার গণ্ডি ছোট। ঝাড়খণ্ড, বিহার পেরিয়ে উত্তর প্রদেশেও বান্ধবীকে ছুঁয়ে দেবার মতো দীর্ঘ হাত সে অর্জন করতে পারেনি। তিনমাস পর প্রথমবার কোলকাতা গিয়ে তবু পুষ্করের সঙ্গে দেখা করেছিল শুভ্রা, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে আর হয়ে ওঠেনি। ক্রমশ ফোন, হোয়াটস্যাপ বেঁটে হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। জেএনইউ-এর শ্রীনিবাস গোয়েল বা আম্বেদকর ইউনিভার্সিটির অনুপম হাজরা হয়ত অনুঘটকের কাজ করেছিল এই বামনায়নে, কিন্তু অনুঘটক মাত্র। শুভ্রা মোহজাল ছিঁড়ছিল নিজের তাগিদেই। ওরা ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল, বিশেষত অনুপম। বন্ধুত্ব পেরিয়ে শরীর অব্দি হেঁটে এসেছিল, কিন্তু মনের দরজার সামনে হাসিমুখে চেয়ার পেতে চা খাইয়ে তাকে বসিয়ে রেখেছিল শুভ্রা, ভেতরে ডাকেনি। এখনও সে সেখানেই আছে। তর্ক, আলোচনা, গবেষণা, যৌথ লেখালেখি আর কিছু ছোঁয়াছুঁয়ি। তার চেয়ে বেশি আকাশ বন্ধক দিতে রাজি নয় শুভ্রা। দ্বিতীয় পুষ্কর চায় না সে। খাঁচা চায় না। ডানা ক্লান্ত হলেও তাকে উড়ে যেতে হবে সাইবেরিয়া থেকে পূর্বস্থলী চুপির চরে। সেখানে এক লুকোনো সরোবরে নবদ্বীপের গঙ্গাকে ফাঁকি দিয়ে শীতের দুপুরে রোদ পোহাচ্ছে এক বিরল কবিতা সারস। সৌখিন ট্যুরিস্টের মতো সপরিবার হেঁটে কাছে গেলেই সে উড়ে যাবে। একমাত্র পরিযায়ী ডানা মেলে দীর্ঘ উড়ে গেলেই বসা যাবে তার পাশে।

অনুপম আসেনি দুই মাস। আসতে পারেনি। শহরের অন্য প্রান্তে তালাচাবি বন্ধ হয়ে আছে ভাইরাসের ভয়ে। ফোনও করেনি দুদিন হল। বদলে আজ ফোন করল সুস্মিত, প্রায় তিন বছর বাদে। গ্রীষ্মের নিরিবিলি যাপনের মধ্যে পুষ্করকে নামিয়ে দিয়ে গেল। পুষ্কর মরে যাচ্ছে। বহুদিন যাবৎ মৃত পুষ্কর ডাক্তারি মতে আইনত মরে যাচ্ছে। তাতে কারো কিছু যায়-আসে না, কারণ পুষ্করের বেঁচে থাকায় কারো সমস্যা হচ্ছিল না। কারো ক্ষতি করার ক্ষমতাই তার ছিল না, উপকার করারও না। পুষ্কর মরে গেলে পরবর্তী সংখ্যায় তার বন্ধুদের পত্রিকাগুলোতে একই সংখ্যক এবং একই মানের কবিতা থাকবে। পুষ্করের অনুপস্থিতি কেউ খেয়াল করবে না। সুস্মিতের ফোন আসার আগে দীর্ঘ সময় পুষ্করের অনুপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন ছিল না শুভ্রাও। এই মুহূর্তে খুব গদগদভাবে তাকে সমবেদনা জানালেও হয়ত টের পাবে না পুষ্কর, সুতরাং অকারণে সেসব বেদনায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করার কোনো মানে হয় না। অনুভা মেহতা কাল রাতেও লেখার জন্য তাড়া দিয়েছে। সেটা সকালেই শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। বিকেলের মধ্যে করতেই হবে। দুপুরের গরমের মধ্যেও গরম কফি হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় শুভ্রা। মনের সাময়িক স্থবিরতা ভাঙতে রোদ আর কফির উত্তাপ কাজে লাগবে। কার্নিশে কাপ রেখে দু’হাত উপরে তুলে শরীর টানটান করে কাপটা আবার হাতে তুলে নেবার জন্য সামান্য ঝুঁকল শুভ্রা আর সেই মুহূর্তে উন্মাদ অমলতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।

প্রথমবার ফ্ল্যাটে এসেই সাবধান করেছিল অনুপম। “একদম বাড়ির সামনে এই গাছ! সর্বনাশ! এমন সুন্দর আর ভয়ঙ্কর গাছ দুটো নেই শুভ্রা। একা বারান্দায় এসো না, বিশেষত দুপুরবেলা।”

“কেন?”

“আক্রমণ করে। একা পেলে কখন যে হঠাৎ কী করবে, কেউ জানে না। সন্ধের পর ঝিমিয়ে যায়, কিন্তু ছুটির দিনে দুপুরবেলায় এরা মারাত্মক।”

“গাছ আক্রমণ করে?” হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল শুভ্রা, “তুমিও চুপিচুপি কাঁচা কাব্য লেখো নাকি?”

“হেসো না। আমার আগের বাড়ির সামনে একটা ছিল। রবিবার দুপুরে বারান্দায় উঠে এসে বলত, মরে যা এইবার। একদিন প্রায় হেরে গিয়েছিলাম। আত্মহত্যাই একমাত্র কর্তব্য মনে হয়েছিল। পালিয়ে বেঁচেছি। কেউ জানে না, ওই গাছের ভয়েই আমি বাসা বদলেছিলাম।”

শুভ্রা আর হাসেনি ভদ্রতার খাতিরে। কারো আতঙ্ক নিয়ে হাসা উচিত নয়। কথাটাকে আলতো করে ফেলে দিয়েছিল পুরুষ কবিদের কাছ থেকে পাওয়া কল্পনা-বিলাসের টুকরো ফেলার ডাস্টবিনে, যার মধ্যে পড়ে আছে মৃণালদার কাব্যিক প্রশান্তি, পার্থজিতের আঁকা পোর্ট্রেট, সংকল্পদার বিমূর্ত কবিতা সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা, পুষ্করের সবকিছু। এরা বড় বেশি সুখী, সমস্যাহীন, তাই চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারে, গাছের সঙ্গে গা-ছমছম খেলতে পারে। অনুপম ভালো বন্ধু, মেধা আর দেহগুণে তার সঙ্গ উপভোগ্য, কিন্তু দুজনের পৃথিবী আলাদা, জীবন সংগ্রাম আলাদা, উদ্বর্তন আলাদা, কবিতা ভিন্ন। পেপারের সাইটেশন লেখার পদ্ধতি বা ইনশিওরেন্সের খুঁটিনাটি বিষয়ে তার উপদেশ শোনা যেতেই পারে, কিন্তু দুপুরের মাংসাশী গাছ সম্বন্ধে নয়।

অবজ্ঞাটা অনুপম বুঝতে পারেনি, কিন্তু গাছটা কি নজর রাখছিল? দেখত পেয়েছিল অদৃশ্য ছুঁড়ে ফেলা? প্রতিশোধ নেবার জন্য আজ দুপুরটাকেই বেছে নিল, যখন শহরজুড়ে সবাই একা… নিকটতম মানুষটিও আর্তনাদের ঢেউসীমার বাইরে কোনো নিরন্ধ্র কোটরে বন্দী! দুপুর থমথমে, মৃদুতম বাতাসও নেই। বারান্দা আগলে দাঁড়ানো গাছটার একটা পাতাও নড়ছে না, অথচ কি দাপট তার। প্রাচীন সংস্কারের মতো স্থানু, নিশ্চুপ, অমোঘ সন্ত্রাস। যে মুহূর্তে শুভ্রা উঠে দাঁড়াল পিছুটান ছিঁড়ে দু’কদম এগোবে বলে, তখনই অজস্র হাত ছড়িয়ে অমলতাস গ্রাস করল পথরেখাটুকু। যেন সে খেলছে মেয়েটির সাথে, সহস্রবাহু কার্তবীর্যার্জুন যেমন খেলাচ্ছলে নর্মদার গতিরোধ করেছিলেন। কবি হোক বা নদী, ক্রিড়ার আনন্দে তার প্রবাহ রুদ্ধ করাই পৌরুষ। অমলতাস কি পুরুষ বৃক্ষ? গাছের নারীপুরুষ থাকে? নাকি মুছে যাবার মুহূর্তে ডাস্টবিন থেকে পুষ্করই উঠে এল ডালপালা মেলে? পথ আটকে দাঁড়ানোর পুরনো অভ্যেস! না, এত বড় হয়ে ওঠার শক্তি পুষ্করের কোনো কালে ছিল না। শুভ্রার পৃথিবীতে এতটা জমিও তার নেই, যেখানে শিকড় ছড়িয়ে সে মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে, এমনকি কল্পনায়। তাছাড়া এই গাছ হিসহিস করে এমন কথা বলছে, যা পুষ্কর কখনো বলত না।

“মরে যা। মরে যা। যা খুঁজছিস, তা পাবি না। সেই কবিতা তোর নাগালের বাইরে। কে তুই? কী তোর কৌলীন্য? সামান্য মেয়ে হয়ে স্বেচ্ছায় আশ্রয় হারালি! সহজে পাওয়া স্নেহ-যত্ন ফেলে দিলি! এখন কোথায় দাঁড়াবি? কোথাও হীরে নেই, ছাদ নেই। এইবেলা মরে যা।”

দেওয়ালের গায়ে সেঁটে যেতে যেতে শুভ্রা কানে আঙুল দেয়। কেন মরব? কেন মরব ঝড়ের আগেই? আশ্রয় চাইনি তো। বইতে চেয়েছি জটার বাঁধন ছিঁড়ে। একেবারে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েই মরব। বালিতে মুখ গুঁজে এখানে নয়, এখন নয়।

“মরে যা, মরে যা এইবেলা। এখনই সময়। সেই লোকটাকে দেখ, চিরকাল হেরে হেরে এইবেলা জিতে গেল। টেক্কা দিয়ে গেল। বলেছিল কিনা তোকে, তাড়াতাড়ি যাবে? গেল তো? জিতে গেল। এবার সবার কারুণ্যে সে বেঁচে থাকবে দুঃখ হয়ে। তুই একা ক্লিষ্ট হবি পরিশ্রমে। হয়রান হয়ে শেষে একদিন তো যেতেই হবে। তবে আর কেন? এই তো সময়।”

“করুণা কে চায়? কে চায় এমন অপ্রাসঙ্গিক মৃত্যু, যা জীবনের মতোই ব্যর্থ। মহামারীতে অনেকের মধ্যে একজন হয়ে অপ্রতিরোধী মৃত্যু আমার নয়। যুদ্ধেই মরব। বুকে ত্রিশূল নিয়ে মরব। এভাবে নয়, এখন নয়।”

লড়াই জারি রাখে বৃক্ষ ও যুবতী, কিন্তু আগ্রাসী গাছের সঙ্গে কে পারে এঁটে উঠতে, বিশেষত এমন দুপুরে? সন্ধের পর ওরা ঝিমিয়ে পড়ে, কিন্তু দুপুরে ওরা মারাত্মক। সহস্র হাত তার। তরুণীর তূণীর থেকে একে একে উপড়ে আনে যত্নে শান দেওয়া একএকটি ‘মাস্টারপিস’। ছিঁড়ে ফেলে কবিতাগুলোকে নিহত পাখির পালকের মতো। কেড়ে নেয় ঢাল। খুলে নেয় কবচ-কুণ্ডল। একেএকে ধ্বংস করে ধ্বজ, অশ্ব, সারথি ও রথ। নিরস্ত্র, বর্মহীন, পদাতিক মেয়েটিকে ঠেলে নিয়ে চলে গহ্বরের দিকে। পদস্খলনের প্রাক-মুহূর্তে মেয়েটির মনে হয়, অনুপমকে ফোন করলে হত। এই গাছের আক্রমণ সয়ে সে বেঁচে আছে। সে কি বলে দিতে পারবে না চক্রব্যূহের নিষ্ক্রমণপথ? লক-ডাউনের শিকল ছিঁড়ে ছুটে আসবে না বাঁচাতে?

হয়ত পারবে, হয়ত আসবে। সেই কারণেই তাকে ডাকা যাবে না। তাহলে সে হাতে করে নিয়ে আসবে নতুন পিঞ্জর। এই অমলতাস হয়ত তারই মারীচ। সেই ক্ষমতা দিয়ে গেছে এই গাছকে। মায়াবী করে গেছে স্থবির বৃক্ষকে এই নারীটির লোভে। অনুপম সেসব উপাখ্যান না শোনালে কি শুভ্রার মনে বাসা বাঁধত কোনো গোপন ভয়? এই দুর্বল মাটিটুকুতে অনুপম লাঙল না দিলে কি অমলতাস পারত এত বড় হয়ে উঠতে? দুপুরের রোদের আড়ালে অনুপম বসে আছে খাঁচার দরজা খুলে আর অমলতাস শুভ্রাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে সেই দরজার দিকে। আশ্রয়ের লোভ দেখাচ্ছে আর ঝড়ের ভয়। একবার আশ্রয়ে লুকোলেই দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।

অথচ আজ স্বাধীনতা দিবস। পুষ্করের জৈবিক মৃত্যু যতই অপ্রাসঙ্গিক হোক, তার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাবে বিভ্রান্তি আর সোনার খাঁচার ইতিহাস। একত্রিশে মে দু’হাজার কুড়ি শুভ্রার স্বাধীনতা দিবস। সেই দিনে নতুন বশ্যতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। কিন্তু এভাবে নয়। আত্মহনন নয়। ঋজু হয় শুভ্রা। ঝড়ের মেঘ মনে রেখেই তো সে একাকী উড়াল চেয়েছিল। এতদিনে এসেছে তার পরীক্ষার মুহূর্ত। ওই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই না-পাওয়া কবিতা এক অক্লান্ত ডানার মহিলা কবির প্রতীক্ষায়। যে পারবে মেঘ পেরোতে, সে তারই। এই লড়াই শুভ্রার একার। একাই লড়তে হবে। বর্ম ছেঁড়া বুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে সে বের করে আনে অন্তিম কুঠার। পাঁজর ভেঙে বের করে আনে। দু’হাতে কাটতে থাকে রাবণের কুড়ি লক্ষ হাত, দশ লক্ষ শির। দেওয়াল থেকে পিঠ সরিয়ে এগোতে থাকে কার্নিশের দিকে। তারপর স্তম্ভিত অমলতাসের ডালে পা দিয়ে আকাশ বেয়ে উঠে মেঘ ভেদ করে উড়তে থাকে প্রকৃত সারসের সন্ধানে। 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment