স্বকৃত নোমান

পুত্র

মুন্সেফ ভূঁইয়া কবে বড়পুত্র মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়েছে, কবে বাজান বলে ডেকেছে মনে করতে পারে না। একই বাড়িতে থাকে, একই পুকুরে গোসল করে, একই পাতিলের ভাত খায়, অথচ দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পিতাপুত্রের দেখা হয় না, কথা হয় না। 

জন্মের পর ভূঁইয়া কখনো ছেলেকে নাম ধরে ডাকেনি, আদর করে সবসময়বাজানকিংবাবাবা মঞ্জুবলে ডেকেছে। মঞ্জু ছিল তার চোখের মণি। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখত। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হলে অস্থির হয়ে উঠত। সাত বছর বয়সে মঞ্জু একবার নানার সঙ্গে নানাবাড়ি গিয়েছিল। টানা দশ দিন ছিল। দশ দিনকে মুন্সেফ ভূঁইয়ার মনে হয়েছিল দশ মাস। তখন বাড়িটাকে মনে হতো বিরাণ। যেন বহু কালের ছাড়াবাড়ি। স্ত্রী, তিন কন্যা কিংবা ছোট পুত্র ইশরাকও সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি।

মাধবপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে মঞ্জু ফাইভ পাশ করার পর বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল ভূঁইয়া। মাধবপুরে কোনো হাইস্কুল নেই, হাইস্কুল দুই মাইল দূরে কাশিগড়ে। বলভদ্র পাড়ি দিয়ে মঞ্জু এত দূরে কীভাবে যাবে? না, কোনোভাবেই পুত্রকে একা ছাড়বে না মুন্সেফ। বারো আনা মাসোয়ারায় কালাচানকে নিযুক্ত করেছিল মঞ্জুকে স্কুলে আনানেওয়ার কাজে। 

ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিল মঞ্জু। ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত রোল নম্বর ছিল এক। সেভেনে ছিল দুই। এইটেও। নাইনে চলে গেল সতেরোয়। মুন্সেফ ভূঁইয়া বুঝে উঠতে পারছিল না পুত্রের এই পিছিয়ে পড়ার কারণ। বুঝল সেদিন, মঞ্জু যেদিন বিড়ির আগুনে কাচারি ঘরের কাঁথাবালিশ পুড়ে ফেলেছিল। সেদিন কাচারি ঘরের মাঝের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছিল মঞ্জু। সহসা বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে লন্ত বিড়িটা বালিশে চাপা দিয়ে পেছনের দরজা খুলে সটকে পড়ল। বালিশ পুড়ল, কাঁথা পুড়ল, চকির অর্ধেকটাও পুড়ে কয়লা হলো। অল্পের জন্য ঘরে আগুন লাগেনি। ভূঁইয়া সেদিন মঞ্জুকে চকির পায়ার সঙ্গে বেঁধে কাঁচা কলমির বেত দিয়ে মেরে শরীরটা ফুলিয়ে ফেলেছিল। লাভ হয়নি, বিড়ির নেশা ছাড়াতে পারেনি।

ভূঁইয়া তবু আশায় ছিল। ভেবেছিল, কাঁচা বয়স, এই বয়সে একআধটু ভুল তো করবেই। কৌতূহলের বশে হয়ত বিড়ির স্বাদ নিতে চেয়েছে, বিড়িতে কখনো আসক্ত হবে না। হলেও লেখাপড়া ঠিকঠাক চালিয়ে যাবে। কিন্তু না, আশা ভঙ্গ হলো তার। মেট্টিকে ফেল করল মঞ্জু। এবার ধরল মদ। প্রায়ই চোলাই খেয়ে বাড়ি ফেরে। ধরল জুয়া। বলভদ্রের ওপারের কুইশ্যার ক্ষেতে সারাদিন জুয়া খেলে। 

একদিন ভোরে, মঞ্জু ঘুম থেকে জাগার আগে, চকির পায়ার সঙ্গে রশি দিয়ে তার হাতঠ্যাং বেঁধে ফেলল ভূঁইয়া। কাঁচা কলমির বেত দিয়ে যেই না মঞ্জুকে মারতে গেল, অমনি মঞ্জু হুংকার ছাড়ল, আমি কারো বাপের টাকায় মদ খাই না, জুয়া খেলি না। খবরদার, গায়ে হাত তুলবেন না। 

ভূঁইয়ার চোখ উল্টে গেল, হাত থেকে বেতটা পড়ে গেল, বাক হারিয়ে ফেলল। আর একটা কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর থেকেই পিতাপুত্রের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথা বন্ধ।

এখন মুন্সেফ ভূঁইয়ার চোখের মণি ছোট পুত্র ইশরাক। ক্লাস এইটের পর পড়ালেখা আর চালিয়ে যেতে পারেনি ইশরাক। মেধা কম। অংকে বড় কাঁচা। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে বসলে মাথা ঘোরে। ইংরেজির কিছুই মাথায় ঢোকে না। বই নিয়ে বসলে কেবলই ঘুম পায়। লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাবার সঙ্গে চাষাবাদে মন দিয়েছে। কখনো বাবার কথার ওপর কথা বলে না। বেয়াদবি হবে বলে বাবার চোখের দিকে তাকায় না। বাবার সামনে গেলে মাথাটা সবসময় নুইয়ে রাখে, হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখে। মদ খাওয়া তো দূর, কখনো মদ কী জিনিস সে চোখেও দেখেনি। গ্রামের যেসব ছেলেপিলে বিড়ি খায়, চৌরাস্তার মোড়ে বাজে আড্ডা জমায়, তাদের সঙ্গে ভুলেও মেশে না। বাবা যদি বলে, রাত জেগে আলুক্ষেত পাহারা দাও বাবা ইশরাক। সে এক লহমা না ঘুমিয়ে পাহারা দেবে। বাবা যদি বলে, সারা দিন জমিনে রোয়া লাগাও বাবা ইশরাক। সে সূর্যাস্তের আগে জমিন থেকে উঠবে না। ঠাটা পড়া ঝড়বৃষ্টির দিনে বাবা যদি বলে, বলভদ্র পাড়ি দিয়ে কাশিগড় বাজারে গিয়ে গরুর জন্য খল্লি-ভুষি নিয়ে আসো বাজান। সে মৃত্যুভয় পায়ে দলে সোজা চলে যাবে বাজারে। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে বাবা যদি ছাতিয়াকান্দির বনে বসে থাকতে বলে, সে সাপবিচ্ছুর পরোয়া না করে চুপচাপ বসে থাকবে।

মুঞ্জুর ব্যাপারে নানা কথা মুন্সেফ ভূঁইয়ার কানে আসে। সেদিন কানে এলো, মঞ্জুকে আজকাল প্রায়ই ওলিপুরের জেলেপাড়ায় দেখা যায়। পাড়ার কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মুন্সেফ ভূঁইয়া সেদিন স্ত্রীকে সাফ বলে দিয়েছে, কোনো জাইল্যার বেটির স্থান এই বাড়িতে হবে না। জাইল্যার বেটিকে বাড়িতে ঢোকালে তোমার পোলাকে আমি ত্যাজ্য করব। তাকে বলে দিও তুমি। সাবধান!

দুদিন পরেই গভীর রাতে বাড়িতে পুলিশ এলো। হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে ধরে নিয়ে গেল মঞ্জুকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। লাখাইয়ের মুসলিম লীগ নেতা নূরুল্লাহ চৌধুরীর পাঞ্জাবির কলার ধরে হত্যার হুমকি দিয়েছে। বলেছে, বলভদ্রের চরে ইলিয়াস মিয়ার জমির দিকে হাত বাড়ালে ভুঁড়ি নামিয়ে দেবে। ব্যাস, মঞ্জুকে এক নম্বর আসামী করে আটজনের বিরুদ্ধে চৌধুরী থানায় ঠুকে দিল মামলা।

সকালে গ্রামের লোকজন এসে মুন্সেফ ভূঁইয়াকে বলল, মঞ্জুর তো জামিন চাইতে হবে, একজন উকিল ঠিক করতে হবে। ভূঁইয়া বলল, কিসের জামিন? কিসের উকিল? কোনো উকিলটুকিল আমি ঠিক করব না। মঞ্জু নামে আমার কোনো ছেলে নাই। আমার ছেলে হলে সে গুন্ডামিমাস্তানি করে বেড়াত না, মানুষকে খুনের হুমকি দিত না।

ইশরাক বলল, বাবা

বলো বাজান। ভূঁইয়া বলল।

ইশরাক চোখ নামিয়ে হাতের তালুতে তালু ঘষতে ঘষতে বলল, জেলখানা তো ভালো জায়গা না বাবা। যে গরম পড়ছে, ভাইয়া কষ্ট পাবে। এবারের মতো তারে মাফ করে দেন। 

স্নেহের ধন ইশরাকের অনুরোধ ফেলে কী করে ভূঁইয়া? ব্যাস, মুহূর্তে উবে গেল রাগ। তবে বলল, এই শেষ। ভবিষ্যতে কখনো জেলে গিয়ে মরে পচে গেলেও আমি লাশ আনতে যাব না, বলে দিস তাকে।

ভূঁইয়া ভেবেছিল জেল খেটে নিশ্চয়ই শিক্ষা হয়েছে মঞ্জুর। আর কখনো গুণ্ডামিমাস্তানি করবে না। কিন্তু না, থামল না মঞ্জু, বরং এগিয়ে গেল আরো কুড়ি হাত। একদিন বলভদ্রের চরের দখল নিয়ে নূরুল্লাহ চৌধুরী আর ইলিয়াস মিয়ার মধ্যে লাগল গন্ডগোল। দুই পক্ষে কয়েক লাঠিয়াল। চরে যখন ধন্ধুমার লাঠালাঠি চলছিল, হঠাৎ গুলির শব্দে সবাই চমকে উঠল। চরের দখল নিয়ে লাঠালাঠি তো আগেও হয়েছে বিস্তর, কখনো তো গুলি হয়নি! কে করল গুলি? চৌধুরীর ভয়ার্ত লাঠিয়ালরা দেখল, পাইপগান উঁচিয়ে ছুটে আসছে মঞ্জু। আর কি দাঁড়ায় কেউ? জান নিয়ে যে যেদিকে পারল পালিয়ে বাঁচল।  

গোটা তল্লাটে ছড়িয়ে পড়ল মঞ্জুর হাতে পাইপগানের খবর। নূরুল্লাহ চৌধুরী আর চর দখলের সাহস পায় না। মামলামোকদ্দমা করতেও না। সত্যি সত্যি মঞ্জু যদি তার ভুঁড়ি নামিয়ে দেয়! বলা তো যায় না। ছেলের হাতে পাইপগানের খবর মুন্সেফ ভূঁইয়ার কানও এড়ায় না। সে ভেবে পায় না তার ঘরে কেমন করে জন্ম নিল এত বড় মাস্তান। মঞ্জু কি সত্যি সত্যি তার ঔরসজাত? তার সন্দেহ জাগে। তার ঔরসজাত হলে মঞ্জুর এত অধঃপতন হয় কী করে!

ছোট পুত্রকে আঁকড়ে ধরে ভূঁইয়া, আরো বেশি করে। কেননা সে বুঝে গেছে, যে পথে গেছে মঞ্জু সেই পথ থেকে আর কখনো ফিরবে না। ফেরা অসম্ভব। কোনো খুনের মামলায় যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে হয় জেলে মরবে, কিংবা তার মতো কোনো গুণ্ডামাস্তানের গুলিতে অকালে জান খোয়াবে। যারা এই পথে যায় এমনই হয় তাদের পরিণতি। লম্বু মতিনের কথা মনে আছে তার। লাখাইয়ের লম্বু মতিন। মুসলিম ছাত্র লীগের ডাকসাইটে নেতা ছিল। কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা নাঈম উদ্দিন তাকে চিনতো। প্রায়ই সে ঢাকার মোগলটুলির পার্টি অফিসে যেত। একদিন শোনা গেল জোড়া খুনের অভিযোগে দল থেকে সে বহিষ্কার। তার কয়েক মাস পর শোনা গেল দুই ডাকাতদলের গোলাগুলিতে লম্বু মতিন নিহত, লাশ পড়ে আছে তিতাসের চরে।

মুন্সেফ ভূঁইয়ার আশঙ্কা মিথ্যে হয় না। একদিন তার কানে আসে আন্তঃজেলা ডাকাতদলের সঙ্গে মঞ্জুর সম্পৃক্ততার খবর। প্রথমে সে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ইশরাক যখন বলল, আমি নিজ চোখে দেখে এসেছি থানার বারান্দায় একটা কালো বোর্ডে ডাকাতদের নাম লেখা। তিন নম্বরে আছে ভাইয়ার নাম। স্পষ্ট হরফে লেখা একরামুল হক মঞ্জু, পিং মুন্সেফ আলী ভূঁইয়া।

ভূঁইয়া কি আর অবিশ্বাস করে? ইশরাককে সে জড়িয়ে ধরল বুকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, তুই আমার পুণ্যির ফল বাজান। আমি নিশ্চয়ই এমন কোনো পুণ্যি করেছিলাম, যার কারণে খোদা তোকে আমার বেটা করেছে। তুই বেঁচে থাক বাবা। খোদা যেন তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে না নেয়। আমার অর্ধেক জীবন তোকে দিয়ে হলেও খোদা তোর হায়াত দরাজ করুক। বল আমিন। বাবা বল, আমিন।

ইশরাক বলে, আমিন।

পরদিন সকালে দাঁত মেজে পুকুরঘাট থেকে ঘরে ফিরছিল মঞ্জু। হালের বলদ আর লাঙ্গল নিয়ে জমিনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল ভূঁইয়া। মঞ্জুকে দেখামাত্র তার মেজাজ গেল চড়ে। চিৎকার করে বলল, এই বাড়ি আমার। আমার বাড়িতে হয় আমি থাকব, নয় কোনো চোরডাকাত থাকবে।

গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল মঞ্জু। তাকাল বাবার মুখের দিকে। ভূঁইয়া আবার কুঁদে উঠল, আমার সামনে থেকে সর হারামজাদা।

মঞ্জু বলল, আমি মদখোর, জুয়াবাজ সবই ঠিক আছে বাবা। কিন্তু পুলিশের খাতায় নাম উঠলেই কেউ ডাকাত হয়ে যায় না। নাম নানা কারণে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের বহু কর্মীর নাম ডাকাত হিসেবে পুলিশের খাতায় লেখা। তাই বলে তারা ডাকাত? ঠিক আছে, আপনার যখন এতই আপত্তি, আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি। 

আর দাঁড়াল না মঞ্জু। ভূঁইয়ার রাগ দমে না। সে আবার চিৎকার করে ওঠে, ওই জাইল্যার বাড়ি যাবি তো? যা। শালার পুত, শেষ পর্যন্ত জাইল্যার বেটি তোর মাথা খাইল! আমার বাড়ির ত্রিসীমানা আর মাড়াবি না। এক্ষুণি বের শুয়রের বাচ্চা।

বেরিয়ে গেল মঞ্জু। তার মা দরজায় দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পুত্রের চলে যাওয়া দেখল। মঞ্জু ঠাঁই নিল বলভদ্রের পাড়ে আখ মাড়াইয়ের টঙঘরে। দোচালা ঘর। ভেতরে একটা চকি। কাঁথাবালিশ আর একটা মশারিও আছে। কালাচান থাকত এই ঘরে। কদিন হলো সে বিয়ে করেছে। কালাচান বয়সে তার প্রায় সাত বছরের বড়, কিন্তু সম্পর্ক বন্ধুর মতো। খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হলো না। কাছেই কালাচানদের বাড়ি। বাটিতে ভরে ভাততরকারি দিয়ে যায় কালাচান।

পুত্রের জন্য মুন্সেফ ভূঁইয়ার মন খারাপ হয় না। মঞ্জু চলে যাওয়ায় বাড়িটা বরং তার কাছে হালকা মনে হতে লাগল। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালোএই বলে সে নিজেকে সান্ত¡না দেয়। স্বামীর আড়ালেআবড়ালে পুত্রের জন্য কাঁদে মঞ্জুর মা। তার কান্নাকাটি ভূঁইয়ার চোখ এড়ায় না। কিছু বলে না। কাঁদুক। কাঁদতে কাঁদতে একদিন চোখের জল ফুরিয়ে যাবে। 

কদিন পরেই বেজে উঠল যুদ্ধের ঢামাঢোল। মাধবপুরের লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ঢাকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা অ্যাটাক করেছে, বহু মানুষ খুন করেছে, রাস্তাঘাটে লাশ আর লাশ। মুন্সেফ ভূঁইয়ার ঠিক বিশ্বাস হয় না। কদিন আগেই তো দেশ ভাগ হলো। মুসলমানরা এলো পাকিস্তানে, হিন্দুরা গেল ইন্ডিয়ায়। কত মিছিল, কত মিটিং, কত রক্ত, কত লাশ। এই তো সেদিনের কথা। আবার কেন যুদ্ধ? কীসের যুদ্ধ? মাধবপুরে সব খবর আসে না। হাটেবাজারে গেলে খবরাখবর কিছু পাওয়া যায়। কাশিগড় বাজারে গিয়ে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে ভূঁইয়া। সত্যমিথ্য যাচাই করে। বোঝে, না, খবর মিথ্যে নয়, সত্যি সত্যি যুদ্ধ লেগেছে দেশে। ইশরাককে সে হুঁশিয়ার করে, দেশের অবস্থা ভালো না বাজান। আপাতত কিছু দিন বাজারঘাটে যাস না। কোনো কিছুর দরকার হলে আমিই যাব। সব সময় বাড়িতে থাকবি। আমাকে না বলে কোথাও যাস না।

ইশরাক যথারীতি মাথা নুইয়ে ঘাড় কাৎ করে বলে, জি বাবা, কোথাও যাব না।

জি বাবাকথাটা বড় মধুর শোনায় ভূঁইয়ার কানে। গর্বে তার বুকটা ফুলে যায়। খোদা বড় দয়াবান। কাউকে তিনি দয়া থেকে বঞ্চিত করেন না। বড় পুত্র তাকে যত কষ্ট দিয়েছে, সব কষ্ট ধুয়েমুছে সাফ করে দিচ্ছে ছোট পুত্র। নামাজের পর মোনাজাতে ছোট পুত্রের জন্য সে দোয়া করে, হে পাক পরওয়ারদিগার, আমার ইশরাকরে তুমি বালামুসিবত থেকে ফানা দিও। আামার আর কোনো দুঃখ নাই, কোনো কষ্ট নাই। ইশরাকের হায়াত তুমি দরাজ করো মাবুদ।

আমের মৌসুম শেষ হতে চলেছে, মৌসুমী মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। বর্ষার আর দেরি নেই। মুন্সেফ ভূঁইয়া সেদিন কাশিগড় বাজারে গিয়ে মির্জাবাড়ির লতিফ মির্জার দেখা পেল। লতিফ মির্জা তার বাল্যবন্ধু। ঢাকায় ব্যবসাপাতি আছে। সপরিবার ঢাকাতেই থাকে। মির্জার কাছ থেকে জানতে পারে যে ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। পরিবারপরিজন নিয়ে লোকজন গ্রামে পালাচ্ছে। মির্জাও পরিবার নিয়ে এসেছে। আবার কবে ফিরতে পারবে ঠিক নেই।

হাটে তো নানা কথা ঘুরে বেড়ায়। কথারা এক কান থেকে আরেক কানে ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে একটা কথা মুন্সেফ ভূঁইয়ার কানে এসে ঠেকল। মুসলিম লীগ নেতা নূরুল্লাহ চৌধুরীকে নাকি লাখাই থানার পিস কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। অনেক বড় পদ। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে এই পদে বসিয়েছে। আগামী সপ্তায় কাশিগড় বাজারে আসবে নূরুল্লাহ চৌধুরী। স্কুলমাঠে সভা করবে। সভায় কে যাবে, কে যাবে না নিয়ে হাটুরেরা দ্বিধা বিভক্ত।

কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির পথ ধরল ভূঁইয়া। বলভদ্রের খেয়াঘাট পার হতেই ইলিয়াস মিয়ার সঙ্গে দেখা। ইলিয়াসের সঙ্গে দশবারোজন যুবক। সবাই মাধবপুরের, সবাই ভূঁইয়ার চেনাজানা। সে চোখ বুলিয়ে দেখে এই দলে মঞ্জু আছে কিনা। নেই। ইলিয়াস তাকে সালাম দিল। ভূঁইয়া মুখ নাড়াল না, নাড়াল শুধু মাথা। মুখ কেন নাড়াবে? এই ইলিয়াসের কারণেই তো মঞ্জু জেল খেটেছে, অস্ত্র হাতে তুলেছে। তার প্রশ্রয় না পেলে এতটা নষ্ট হতো না মঞ্জু।

বাড়ি ফিরে মোড়া পেতে উঠানে বসল ভূঁইয়া। চাঁদের আলোয় চারদিক ফর্সা। দমকা বাতাস বইছে। বাতাসে বৃষ্টির আভাস। রাতে বুঝি বৃষ্টি নামবে। ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে ভ ভূঁইয়ার খিঁচড়ানো ভাবটা দূর করতে মনকে সে অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করে। গত বছর ঘরের চালের ছন পাল্টানো হয়নি, বছর পাল্টাতে হবে। গোয়ালঘরের একটা বেড়া উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে, সেটাও পাল্টাতে হবে। এবারের শীতে পুকুরঘাটে জলিবেড়া দিতেই হবে। মেয়েরা বড় হচ্ছে, বেড়া না দিলে আর হচ্ছে না।

তখন একটা পাখা হাতে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল ইশরাক। বাবার মাথায় বাতাস করতে করতে বলল, একটা কথা ছিল বাবা।

কী কথা বাজান? ভূঁইয়া বলল।

কাল সকালে আমি লাখাই যাব।

কেন?

নূরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে।

বুঝলাম না! তার সাথে তোর কী কাজ?

আমি শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছি বাবা। আগামী মাসে এক সপ্তার ট্রেনিং নিতে মহকুমা সদরে যাব। চৌধুরীসাব বলেছেন বদরবাহিনী গঠন করা হলে ভালো একটা পদ দেবেন আমাকে। শান্তি কমিটির অনেক মেম্বার কাল লাখাই আসবে। বদরবাহিনী গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হবে।

কী বলছিস তুই এসব

জি বাবা।

তোর মাথা ঠিক আছে! তোকে না বলেছিলাম বাড়ির বের না হতে?

দেশের যা অবস্থা, বের না হয়ে উপায় কী বাবা?

অসম্ভব! তোকে আমি যেতে দেব না।

আমাকে যেতেই হবে বাবা। বদরবাহিনীতে যোগ দেওয়া আমার ঈমানি দায়িত্ব। আপনার বাধা আমি মানব না।

পাখাটা ঠাস করে মাটিতে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল ইশরাক। নির্বাক বসে থাকে ভূঁইয়া। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, যেভাবে একদিন বলেছিল মঞ্জুকে, এক্ষুণি বের শুয়রের বাচ্চা। আমার বাড়ির ত্রিসীমানা আর মাড়াবি না। কিন্তু পারে না। এক অদৃশ্য তালা ঝুলছে তার মুখে। ঠোঁট ছিঁড়েখুড়ে সে তালাটা সরানোর চেষ্টা করে, পারে না। অনেক রাত অবধি সে বসে রইল উঠানে। চাঁদটা যখন মাথার উপর থেকে পশ্চিমে হেলল, তখন সে ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ দুটি যেন শুকিয়ে গেছে, কোনোদিন আর মুদবে না। গলাটা বারবার শুকিয়ে আসে। পানি খেতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু উঠে রান্নাঘরে গিয়ে পানি খেয়ে আসার শক্তি পায় না। জেগে থাকতে থাকতে শেষ রাতে ঘুম নামে চোখে। খানিকের ঘুম। দুঃস্বপ্নেরা এসে ভেঙে দিয়ে যায়।

দুদিন আর মুখ খুলল না ভূঁইয়া। কারো সঙ্গে একটা কথা বলল না। স্ত্রী কন্যারা ভয়ে তার সামনে এলো না। তৃতীয় দিন সকালে গরু নিয়ে ভূঁইয়া মাঠের উদ্দেশে যাচ্ছিল, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল মঞ্জু। বাবাকে কদমবুচি করল। ভূঁইয়া নির্বাক। একটি বার পুত্রের মুখের দিকে তাকায় না। মঞ্জু বলল, আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছি বাবা। এক মাসের ট্রিনিংয়ে আজ আগরতলা যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন করে যেন ভালোভাবে ফিরতে পারি, এই দোয়া করবেন।

চকিতে, বহু দিন পর, চোখ তুলে পুত্রের মুখের দিকে তাকাল ভূঁইয়া। মঞ্জু আর দাঁড়াল না, ব্যাগটা কাঁধে ফেলে হেঁটে চলল রাস্তার দিকে। ভূঁইয়ার পা নড়ে না। গরুর দড়িটা তার হাতে। দড়িটা খুব টানছে গরু। দড়িটা সে ছেড়ে দিল। মঞ্জু যখন তালগাছটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল, ভূঁইয়া তখন ভেজা গলায় হাঁক দিল, বাবা মঞ্জু!

বাতাসের শব্দে বুঝি মনজু  শুনতে পায় না বাবার ডাক।

ভূঁইয়ার দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ডান হাতটা তুলে সে বলল, ফিআমানিল্লাহ বাজান। বাবার কাছে আবার ফিরে আসিস। আমি তোর অপেক্ষায় থাকব বেটা।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment