শাশ্বতী সান্যাল

শাশ্বতী সান্যালের কবিতাগুচ্ছ

নীল আর্মস্ট্রং সেই মেয়েটির নাম

১.
জামাকাপড় খুলে দাঁড়ালে এখানে কেউ দেখবেনা আমায়
জামাকাপড় খুলে দাঁড়ালেও এমনকি
এখানে কেউ দেখবে না আমায়

পাখির চোখের রঙ ততটা হলুদ নয়
তার বসন্তপূর্ণিমার গান এখনো
সঞ্চারীর কাছে অসম্পূর্ণ
ছায়ার বিভঙ্গ নিয়ে লজ্জায় ঘাসবনে লুকিয়ে আছে
চিত্রকূট হরিণের দল
শরীরে পূর্ণিমা এলে তারা দল বেঁধে
নদীবাঁধে জল খেতে আসবে

শহর থেকে মাত্র বারোটা আলোকবর্ষ
পার হয়ে এখানে এসেছি
সঙ্গে যার আসার কথা ছিল,
সে নেমে গেছে মাঝপথে
মেয়েলি নামের একটা অজানা স্টেশনে

ফলত এ নতুন মুলুকে বনজ্যোৎস্না পুরোনো হচ্ছেনা
নগ্ন যুবক চাঁদ শরীরে সংকেত ঢেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে
যেন অভিজ্ঞ পুরুষ বেশ্যা
ব্যাধিঘোর মেয়ে আমি, লজ্জাবস্ত্র বুকে বেঁধে
পূর্ণিমা আসার আগে তার কাছে কীকরে পৌঁছবো?

প্রতিটা সিঁড়ির মুখে যেহেতু ভীষণ ঝরে গেল
সব মৃতমুখ, প্রাচীন খোলস…

২.
চাঁদের শরীরে এসে টের পাই আমার ওজন
কমে গেছে। বাতাস কেমন হালকা
বাসি মহুয়ার মতো, তাতে পুরুষের দেহঘ্রাণ

মৃগনারীদের তেষ্টা দুচোখে বহন ক’রে, বুকে ভর দিয়ে
এসেছি এতটা পথ, নদীর সঙ্গম দেখব ব’লে

অথচ কোথায় নদী? সৌরধুলোর দেশে
যতদূর চোখ যায় মরা সোঁতা, খড়ের কাঠামো
পুরোনো ব্যথার পিন্ড ইতস্তত জমে আছে
যেন দাবিহীন লাশ, সৎকার হবেনা

কবে শেষ কেঁদেছিল? শৈশবে? না, মাতৃগর্ভে?
চাঁদ ভুলে গেছে…
জমে আছে পোড়া নুন,
শিলাচূর্ণ, দুঃখী আকরিক আর উল্কাপাতের কালো দাগ

কলঙ্কগল্পের মতো। চিহ্ন মুছে গেছে ফলনের

সঙ্গমের ইতিহাস তাই এত ভরশূন্য
চাঁদের শরীরে জল নেই…

৩.
এতদিন ধরে লেখা সব চিঠি ব্যর্থ মনে হয়
তোরঙ্গে জমিয়ে রাখা অর্থহীন নীল শ্যাওলা মাখা
এই সব চর্যাপদ, অভিযাত্রিকের দিনলিপি…

তারা নাম্নী মেয়েটিকে মনে পড়ে যায়…
খবরের কাগজে কাগজে
যার মুখ কিছুদিন চন্দ্রাহত করেছিল নগরবাসীকে,
কিছুদিন সমস্বরে তোমরা যার ফাঁসি চেয়েছিলে…

শহুরে পুলিশ তাকে খুঁজে পায়নি। সরকারি কুকুর
বন্দরে, বাজারে, মর্গে, পার্কস্ট্রিট, পতিতাপল্লীতে
তল্লাশ করেছিল। এখন নীরব।

শেষরাতে নিজেকেই প্রশ্ন করি, ‘তারা’ ভালো আছে?
গৃহস্থ স্বামীর ঘর ছেড়ে
তরুণ চাঁদের সাথে যে পাড়ি জমিয়েছিল
মহাকাশে, পাশের শহরে…

৪.
শহরে নাটক দেখতে বড়জোর একবার দুবার
গড়ের মাঠের দিকে সে আমার হাত ধরে
কখনো যাবেনা
দূরে দূরে সাঁতরাগাছির বাস নীলসাদা ডাকাতের মতো
সুপুরুষ তাকে, ছিনতাই করে নেবে
ভিড়ের ভিতরে

মুঠোর আড়ালে ঘেমে ওঠা
ব্যাঙের আধুলি নিয়ে সেই সন্ধ্যাকাল থেকে
একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছি

হলুদ বাতির সামনে থেমে যাওয়া সন্ধের শহরে
আমাকে নির্বাক রেখে মফসসলের ঘরে
চাঁদ ফিরে গেছে…

৫.
রাস্তার বিষাদ নিয়ে ফিরে আসি তেমাথার মোড়ে

প্রতিটি দিকেই আছে গর্জনশীল যন্ত্রণা
প্রতিটি দিকেই আছে ট্রাফিকের রক্ত-বাহু
সাদা-কালো জেব্রাক্রসিং

শহরে, মোহরকুঞ্জে নেমে আসে ফোঁটা ফোঁটা রাত
পতন-শব্দের নীচে জলের দোকানে
নীলাভ পাওয়ার-ল্যাম্প জ্বলে ওঠে ধীরে

ঘোড়ার খুরের দাগ, কবেকার সাদাকালো ট্রাম
স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। মাঝরাতে কঙ্কালের মতো
তার বিষাদ শরীরে নিয়ে ফেরা

চাঁদের স্বপ্নটি ভেঙে
ঘুমিয়ে পড়েছে দূরে হিমবাহ, বোবা পাথরেরা

৬.
এরকম সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে
E 1 পাওয়া যায় না। পথচারী ভৌতিক মুখে
সময় জিজ্ঞেস করে। আর টের পাই
দুখানা কাঁটার মধ্যে ক্রমাগত এসে পড়ছে
বিজ্ঞাপন দখলের আলো

সময়, পুরুষ চাঁদ, আলোক-বছর পার হয়ে
কতদূর, সে এগিয়ে গেছে!

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment