অনিমিখ পাত্র

নিঘাত সাহিবার কবিতা

 

 

নিঘাত সাহিবা

পরিচিতিঃ  পৃথিবীর সবচেয়ে পীড়িত জায়গাগুলির অন্যতম – কাশ্মীরে জন্মগ্রহণ করে নিঘাত সাহিবা হয়ে উঠেছেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের স্বর খুঁজতে থাকা মহিলাদের মূর্তকন্ঠ প্রতিনিধি। দর্শকদের শান্তি দেবে ভেবে যা সব চকচকে আর ঝকমকে জিনিষপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, নিঘাতের কবিতার ক্যানভাস সেইসবের পেছন থেকেই যাবতীয় পচা আর দূষিতকে তুলে এনে দেখিয়ে দেয়।
পেশায় শিক্ষক এই কবির কাশ্মীরি কবিতার সংকলন ‘ফ্যাকাশে পাতার স্তূপ’ ( Zard Paneki Dair ) ২০১৭ সালের সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কারে সম্মানিত হয়।
তিনি ২০১৪ তে উর্দু কবিতার জন্য ‘আকবর জৈনপুরী মেমরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৮ তে সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার পেয়েছেন।
তার কবিতা (কাশ্মীরি এবং উর্দু উভয় ভাষায়) প্রচুর সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যজার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরাজি, হিন্দি, পর্তুগীজ এবং কন্নড় ভাষায়। নিঘাতের এই একগুচ্ছ কবিতা এই প্রথম বাংলায় অনূদিত হল।

 

একটি শান্তির কবিতা

তুমি মানুষকে হত্যা করো আমার সামনে, আমি শোক করি
এবং মানুষেরা হত্যা করে তোমাকে আমার সামনে, আমি শোক করি

তুমি মানুষকে হত্যা করো ওদের জন্য, ওরা উল্লাস করে
এবং মানুষেরা তোমাকে হত্যা করে ওদের জন্য, ওরা উল্লাস করে

এই ‘আমি’গুলো সংখ্যায় অতি অল্প, বিস্রস্ত, ক্লান্ত আর ক্রমেই সঙ্কুচিত,
এই ‘ওরা’রা অনেকঃ ঐক্যবদ্ধ, উদ্দীপনাময় এবং যারা ক্রমশ বাড়ছে।

 

(ইংরাজি অনুবাদঃ নিঘাত সাহিবা)

 

বন্ধ্যা ভূমি

“তুমি একটি বন্ধ্যা ভূমি”, তুমি বলেছিলে, “দিতে পারো না কিছুই”
সমুদ্র জমে উঠল আমার দুচোখে
যে ফোঁটা লুকিয়ে রইল, মুক্তো হয়ে উঠল সে
আর যে ফোঁটা বেরোতে পারল, নদী হয়ে গেল
হাতে একটা মশাল নিয়ে আমি এই প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াই,
যে নোংরা তারা আমায় লেপেছে, আসলে তা আমার অলঙ্কার
এই দুঃখ আমার জন্য, ওই যন্ত্রণা আমার জন্য
আর তারপর ওই সত্যের পতাকাটাও, আমার জন্যই

এক ইভের কন্যা আমি, খ্রিষ্টের মা আমি
জন্মাইনি কারো থেকে, জন্ম দিয়েছি প্রফেট অনেক
যেখানেই কাঁটা বিদ্ধ করেছে আমায়, সেখানেই ফুটেছে ফুল
যেখানেই ক্ষত আমার, সেখানেই কবিতার অঙ্কুর
যেখানেই বল্লম ফুঁড়ে দিয়েছে আমায়, সেখানেই ফেটে বেরিয়েছে ঝর্ণা!

বেচারি হৃদয় আমার- এই হতভাগ্য হৃদয়
এই দুঃখী চোখগুলো
এই বন্ধ্যা শরীরটা
এই যন্ত্রণা – একটা পরশমণি
বদলাবে না, নাই বা বদলালো, আমি তো একটা জ্বলন্ত মোমবাতি।

সেইসব শুভাকাঙ্খী যাদের হাতে তুমি তুলে দিয়েছ তলোয়ার, তাদের বলা যাক
‘শেষবিচারের দিন অবধি আমি টিকে থাকবো’
প্রতিদিন তারা আমাকে হত্যা করবে
আর প্রতিদিন তারা দেখবে আমি বেঁচে আছি
ওই যে সূর্যটা, তোমার
ওই নদীটাও তোমারই
ক্রুদ্ধ বাতাসের মতো ওই তলোয়ারটাও তোমার!

আমি এক নিজে-নিজেই-পুনরুজ্জীবিত পাইনগাছ
না আমি বেড়ে উঠি বসন্তে না আমি হেমন্তে মলিন

আমি কাঁদি, আমি হাসি
আমি পড়ে যাই, তবু ফের উঠে দাঁড়াই;

কিন্তু হে ঈশ্বর, শপথ নিয়েই বলি
তোমার ফুলের চেয়ে ঢের ভালো ফুটে উঠি আমি

 

(ইংরাজি অনুবাদঃ প্রফেসর শফি শওক)

 

কথামুখ

১.

কবিতা তো সেই শিশু নয় যে
তাকে স্কুলে ভর্তি হতে হবে
আর যাকে বলবো আমার কথা শুনে রিপিট করো
‘আলিফ ইজ ফর আল্লাহ্‌’*

ও যদি মিঠাই চায়
আমি ওকে বরফি দেবো
পুতুলের জামাকাপড়ের জন্য পীড়াপীড়ি করলে
আমি কাগজের পোশাক তুলে দেবো ওর হাতে
এবং দরজার পেছনে দুঃখী মুখ করে
হঠাৎ লুকিয়ে কাঁদার পর,
এক মুহূর্তের জন্য এসে বসবে আমার কোলে।

 

(*’আলিফ’ হল কাশ্মীরি ভাষার বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। বাংলায় যেমন ‘অ’। বাংলায় যেমন ‘অ’য় অজগর আসছে তেড়ে’ – তেমনিই এই ‘আলিফ ইজ ফর আল্লাহ্‌’।)

 

২.

কবিতা তো সেই বন্ধু নয়
যে দেখা করতে চাইবে
আর নিজের অভিজ্ঞতার আলো থেকে
আমাকে পরামর্শ দেবে বলে
যে তার সব কাজকারবারকে বিদায় দিয়ে দেবে
আমি যখন সমস্যায় পড়বো
যার কাছে বলবো আমি যন্ত্রণার কথা
আর আমাকে শান্ত করবে সে
যার সঙ্গে ভাগ করে নেবো আমার চোখের জল,
যে আমাকে অনুসরণ করবে স্বেচ্ছায়
যখন তার সামনে আমি বলে ফেলবো
নতুন একটা রাস্তা আবিষ্কারের কথা

 

৩.

কবিতা তো হেমন্তের বিবর্ণ একটা পাতা নয়
যে নিস্তার পাওয়ার জন্য
আমি কুড়িয়ে নেবো তাকে
আর ফেলে দেবো আগুনের ভেতর;
যাকে আমি মাড়িয়ে যাবো
পায়ের তলায়;
আর তার বদলে
এক ভগ্নাংশ সেকেন্ডের জন্য
সে চিৎকার করবে
এবং আত্মসমর্পণ করবে!
এবং তুষার ছেয়ে যাবে তার ওপর
বইয়ের পাতাগুলো কোথায় যে চলে যায়
বসন্ত কখনো তা কি মনে রাখে আর?

 

৪.

কবিতা তো কোনো তরকারি নয়
যা আমি রান্না করবো
ভালোভাবে কেটেকুটে নিয়ে
শিখে নিয়ে জেনেবুঝে নিয়ে,
আমার পছন্দমতো মিষ্টি আর টক ঢালবো তাতে।
ভেজে নিয়ে আর সুগন্ধি যোগ করার পর
যার যার রুচি অনুযায়ী
পরিবেশন করবো উপভোক্তাদের কাছে

 

৫.

কবিতা তো একটা লাইব্রেরি নয়
যে যখনই আমি চাইবো
ঢুকে পড়তে পারবো তার ভেতরে,
খেয়ালখুশি মতো বই তুলে নেবো একটা,
ভাঁজ করে রাখবো,
শেলফ আর আলমারিগুলোর চারদিকে
ঘুরে বেড়াবো অলসভাবে,
ধুলো ঝাড়বো বইগুলোর
আর প্রত্যেকটার খাঁজেই একটা কার্ড ঢুকিয়ে দেবো

 

৬.

কবিতা তো কোনো বিউটিশিয়ান নয়
যে ম্যাজিক পদ্ধতিতে
সব ভাঙাচোরাকে সুশোভিত করে তুলবে
যে বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দেবে যৌবন
ছন্দের পোশাক দিয়ে সুসজ্জিত করে
সমস্ত কটু কথায় অলঙ্কার পরিয়ে দেবে যে

 

৭.

কবিতা তো একজন যুবতী কন্যা নয়
যে তোমার যে কোনো ফর্মান সে
মেনে নেবে প্রশ্নাতীতভাবে!

 

৮.

কবিতা তো জল নয়
যে তাকে যেরকম বোতলে রাখা হবে
তারই বর্ণ ধারণ করবে সে।

 

৯.

কবিতা তো একজন মা নয়
যে চৌকাঠে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করবে,
আর তুমি যা চাও
তাই তোমাকে এগিয়ে দেবে,
এমনকি নিজের দৃষ্টিও!

 

১০.

কবিতা তো একটা ছোট্ট নদী
পাহাড় থেকে অঝোরধারায় পড়ছে;
যার কোনো পথপ্রদর্শকের দরকার নেই
কেউ আঙুলটা ধরবে এমন কোনো অপেক্ষাও যার নেই!

 

১১.

কবিতা হল জীবন
মাথা নোয়ায় দৈবের পায়ে,
স্বেচ্ছায় আসে আর যায়।

 

(ইংরাজি অনুবাদঃ পারভেজ আলি)

 

 

Facebook Comments

Related posts

2 Thoughts to “নিঘাত সাহিবার কবিতা”

  1. Farooq Shaheen

    very nice

  2. Saubhik De Sarkar

    খুব ভালো কাজ হয়েছে অনিমিখ ।ভালো লাগল কবিতাগুলো।

Leave a Comment