অনির্বাণ ভট্টাচার্য

‘নবান্ন হইয়া গেল’

আমাদের কোনও নিজস্ব জমিজমা নেই। নেই সোনা সোনা মাটি কিংবা উগলে হীরে মোতি। আমরা যারা মফস্বলে বড় হয়েছি, শহরকে চেনার চেষ্টা ছিল খুব দূর থেকে। গ্রাম, আমাদের ফ্যান্টাসির পৃথিবীতে সেভাবে আসেনি। অগ্রহায়ণ। শ্রেষ্ঠ ধান্য। কেন শ্রেষ্ঠ? কেনই বা শ্রেষ্ঠ? আমাদের রোজ রাতে রুটি আর আখের গুড়ের পয়সা বাঁচানো নিম্ন মধ্যবিত্ততার ভেতর এসব প্রশ্ন হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কারণ সন্ধে হলেই লোডশেডিং। আর অনেক দূরে স্টেশন পেরিয়ে দেখা টিমটিম আলোর গ্রামে ওদের বাড়িতেও সেভাবে আলো থাকত না। ওরা মানে যারা কাজ করে। বৈশাখ। বছরের শুরু। কেন? এত গরম, এত অজস্র দুর্যোগচিন্তার মাঝে কিভাবে একটা শুরু হতে পারে? বুঝেছিলাম আসলে খাজনা আদায়ের হিসেব কষার সুবিধের জন্য এক উচ্চবিত্তীয়, রাজকীয় চালাকি। আসলে তো সবকিছুই অগ্রহায়ণ দিয়েই শুরু। মাসের প্রথম সপ্তাহ। প্রথম মা। প্রথম গন্ধ। আমন। পুরনো বন্ধুর নাম মনে পড়ে। ওই নামেই। একসঙ্গে ইলিয়ট, কিটস আওড়াতাম। ওদের বাড়িতে যেতাম। তখনও তো বুঝিনি, মানুষ দুরকম, বাঙালি আর মুসলমান। তখনও বুঝিনি ভাগ করা, মার, পাল্টা মার এইসব বড় হওয়া সুলভ সংখ্যাগুরুত্ব। তখনও …। যাই হোক, সেই আমন। ধান ঝাড়াই করে কেটে রাখত এক মানুষ। দাদুর কাছে গল্পে বড় করেছিলাম তাঁকে। কেটে ঝাড়াই করে রোদে দিচ্ছেন। শুকোচ্ছে ঐশ্বর্য, আদর, ঘ্রাণ। তারপর আবার ঝেড়ে একটা সময়ে ঢেঁকিতে দেওয়া। এসব মানুষ কারা? মনে থাকে কিসের পর কী? আমরা যারা চাষবাস বলতে মনোজ কুমারের সাদা কালো ছবি, লাঙ্গল, ট্র্যাক্টর, আর দূরদর্শন জানতাম, তাদের কাছে এসমস্ত প্রশ্ন বড়সড় জীবনবোধের মতো শোনাত। ওরা সুপারহিরো ছিল। ওদের ঘাম, ওদের আনন্দ, ওদের দুদণ্ড জিরনোর একটা মাস – আমাদের মেলানকোলিয়া ভুলিয়ে দিত। আমরা ফ্যান্টাসিয়া সেরে স্বপনকুমারে ফিরে যেতাম। কেন পিতৃশ্রাদ্ধ? নতুন চাল, পুজো, তারপর কাক হয়ে খেয়ে আসা পূর্বপুরুষের এক মায়াবী প্রেতগর্ভ। এতসবের একটা সরলীকরণ করতাম। গয়া, পিন্ডি, নীচ থেকে কিলবিল করে হাত বের করা ‘আমায় আগে দে, না আমায়’ সুলভ বীভৎস মরবিড যে ছবি তৈরি করে দিয়েছিল ছোটবেলার ততটা সবুজ নয় এমন একটা পার্ট, সেখান থেকেই এই পিতৃতর্পণের ব্যক্তিগত ভার্সন তৈরি হয়ে যেত। শেকড়, শেকড়। যতই গাছ বড় না কেন, শেকড়টাই আসল। কারণ, নবান্ন যতটা না নবান্ন, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ‘লবান’। ক্রমশ বুঝতে শেখা ধর্ম শব্দটার চেয়ে কয়েকডজন দূরে থাকা এক তিন অক্ষরের ম্যাজিক। শরতে কিছুটা দেখনদারি থাকে। বাধা থাকে। নবান্ন শব্দটায় সেসব নেই। খাবার, খাবার, শস্য। এখানেই তো ম্যাজিক। নতুন শস্যের ভেতর হারিয়ে যাওয়া বিভেদ। বিভেদের পাঁচিল। নব্বইয়ের বার্লিনের চেয়েও শক্ত এক দেওয়ালে কুড়ুল। পতনের শব্দ। আসল উৎসবচেতনা। গ্রাম? হোক না। গ্রাম দিয়েই তো শহর ঘেরার কথা আমাদের? ভুলে যাব? আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি আমার এক স্বপ্নবাড়ি ছিল। তখনো তো মহীন শুনিনি। অবশ্য দরজার বাইরে রাখা একগোছা ধানের ছোঁয়ার কথা জানতাম। লবান এসছে না। মিষ্টি এক যুবতীর মুখ। পুকুর। বাড়িতে পুজো। চাল, ভাত, পায়েস। কলাপাতা করে মুঠো ভর্তি আতপ চাল। বড় একটা বাটিতে খেজুরে গুড়, মিষ্টি, মণ্ডা। সাদা সোনার মতো নারকেল। কুড়ে রাখা। সঙ্গে আরও কত যে ফল, কলা, আখ, মুলো, আলু এইসব। এক খোয়া কাঁচা দুধ। যজমেনে। এসমস্ত ছবির মধ্যে আমি কোথাও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পাইনি। গল্পকথায় বড় করা। বীরভূমের আখের বাখার শুনেছি। টোটেম, যাদুবিশ্বাস। কুহেলি কাকলি। সেখানেও নতুন ধান। একটু দূরেই এই নবান্নে এসব যাদুমন্ত্র কিছুই নেই। যদিও হাত ধরাধরি আছে অন্তহীন। নতুন চাল নিয়ে মসজিদ বা মাজারে যাওয়া ‘ওদের’ সঙ্গে দোরের ওপর ধানের গোছা ঝুলিয়ে বামুন ডাকতে যাওয়া ‘আমাদের’ সঙ্গে সেভাবে ফারাক করার মতো ‘বড়’ এখনও হয়ে উঠতে পারলাম না। আর, তখন তো ধার ধারতাম না। আমার ব্যক্তিগত ভালোবাসায় এক ধরনের নবান্নবোধ ছিলই। পাড়ার রাস্তায় ভিখারিনীর মুখে গত জন্ম খুঁজতাম। ‘জাতিস্মর আছে বাবা?’ সপ্তাহান্তে আসা বাবার চোখে কড়া নিরুত্তর পেতাম। বিশ্বাসের কথা না। বরং, একধরনের রহস্যবোধে কিছুটা ভাত দিয়ে দিতাম সেই নারীর হাত ধরা বাচ্চা ছেলেটির দিকে। ভিখারিনীর গায়ে আমার মায়ের মতোই শাড়ি। সকড়ির দাগ। ছেলেটার বাঁহাতে একটা আঙুল নেই। আমার নিজেরটা দেখতে গিয়ে সাড় পেলাম না। জাতিস্মর, সত্যিই নেই বাবা? দেজাভু আছে? একটা সময়ে সারি বাঁধা পিঁপড়ে পিষে দেওয়ার বীভৎসতা এবং তারপর ঘরে ঢুকে ডুকরে কান্নার গিল্টি ফিলিং পেরিয়ে একদিন পিঁপড়েদের গর্তের দিকে দিনের প্রথম ভাত এগিয়ে দেওয়ার অভ্যেস। একটা, দুটো, তিনটে। আমাদের উঠোনে শালিখগুলো ভালো খবর খারাপ খবর পেরিয়ে এমনভাবে আসত, বেশিরভাগ দিনে প্রায় কিছুই হত না। কোনও ভালো খবর আসত না। খারাপ খবরও না। কোথাও নিয়ে যেত না কেউ। ঘরে কেউ আসত না। তবু, শালিখ দেখলেই ছুঁড়ে মারতাম ভাত। কিছুটা। জলের সঙ্গে মফস্বলোচিত দূরত্ব ছিল। সাঁতার না জানা ছেলের ওপর মায়ের ভয় ছিল। তাই, মাছকে সেভাবে দেওয়া হয়নি কিছু। জল আমার অনেক ব্যথা বুঝে রেখেছে। পরে শোধ নেবে? বাঁশবনের জন্য বাবা কাকার গল্পের দিক করে ছুটতাম। আমাদের শহরতলি, মফস্বল সেসব তুমুল কৈশোরকে প্রশ্রয় দেয়নি। আমার শৃগালের জন্যেও কিছু তর্পণ করা হয়নি। তবে পাড়ার নেড়িগুলো ছিল। ওদের দিতাম। একটা করে এক এক বছর মরত। জন্মাত। তর্পণ। অন্নবিতরণ। আবার জীবন, মরণ, জীবন। চক্র, চক্র, চক্র। স্বপ্ন, বাস্তব আর ফ্যান্টাসির মতো আমাদের উৎসবযাপন। প্রার্থনা ছিল। নবান্নবোধ। সুখী জীবন। শস্যপ্রাপ্তি। সন্তানের মঙ্গল। বৃষ্টি। বয়স হল। বোধ পাল্টালো না। বৃষ্টি চাইতে পারিনা। শহরে যাতায়াত যে। বৃষ্টিতেই সব খারাপ অসুখ। এশহরে বৃষ্টি আর সন্তানের মঙ্গল কামনা একসঙ্গে চাওয়া যায় না। এখনও ওর দুদিনের বেশি জ্বর হলে হাত পা ঝাপসা হয়ে যায়। বোধ চলে যায়। সেই মুখই নতুন বানান করতে শিখে ‘অঘ্রান’ লেখে। ‘অঘ্রান মানে কী বাবা?’ অহঙ্কার। আস্বাদ। ভাষা। এও এক নবান্নবোধ। বড় হওয়া, বড় হওয়ার লড়াইয়ে আমাদের এভাবেই নবান্ন হয়ে যায়। আমরা যারা দীনেন্দ্রনাথ রায় পড়িনি, তাঁদেরও। ‘…বাড়ির বউ-ঝিরাও এক এক বাটি চাউল লইয়া রান্নাঘরের বারান্দায় উনুনের ধোঁয়ায় ভিজে চুলে পা মেলিয়া বসিয়া সিক্ত তন্ডুলরাশি নতমুখে চর্বণ করিতে লাগিল। রাখাল, কৃষাণ ও পরিবারস্থ অনুগত ব্যক্তিগণ সকলেরই নবান্ন হইয়া গেল …’।

 

 

কৃতজ্ঞতা –

‘দেশে দেশে নবান্ন উৎসব’ (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

‘নবান্নের ডাক’ – সোমা মুখোপাধ্যায় (চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, নভেম্বর ২, ২০১৮)

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment